শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ উত্তর মীমাংসা বেদান্তদর্শনের উভয়লিঙ্গাধিকরণের সিদ্ধান্ত হইল নির্বিশেষ ব্রহ্মই বেদান্ত প্রতিপাদ্য, সবিশেষতা উপাসনার সৌকর্যের জন্য। ব্রহ্মসূত্রের তৃতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদে বর্ণিত আছে-
ন
স্থানতোপি পরস্যোভয়লিঙ্গং সর্বত্র হি৷৷ ব্রহ্মসূত্র- ৩.২.১১৷৷
ভগবৎপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ-ব্রহ্মবিষয়ক উভয়লিঙ্গক অর্থাৎ সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয়প্রকার ব্রহ্মজ্ঞাপক শ্রুতিসকল আছে। যথাঃ-
'সর্বকর্মা
সর্বকামঃ সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৩।১৪।২)
'সমস্ত
জগৎ যাহার কর্ম্ম, যিনি সর্ব্ববিধ বিশুদ্ধ কামনাবান্, সকলপ্রকার সুখকর গন্ধযুক্ত, সকল
প্রকার উত্তম রসযুক্ত'- ইত্যাদি এই সকল শ্রুতি সবিশেষ লিঙ্গ অর্থাৎ সবিশেষ ব্রহ্মের
জ্ঞাপক।
পুনশ্চ
বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ এর শ্রতি বলিতেছে-
'অস্থূলমনণ্বহ্রস্বমদীর্ঘম্'-(বৃহদারণ্যক
উপনিষদ্ ৩।৮।৮)
'ইনি
স্থুল নহেন, অণু নহেন, হ্রস্ব নহেন, দীর্ঘ নহেন', এইসকল নির্বিশেষ ব্রহ্মের জ্ঞাপক।
এই শ্রুতিসকলে কি ব্রহ্মকে সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয়লিঙ্গরূপে বুঝিতে হইবে, অথবা উভয়ের
মধ্য যে কোন একরূপে বুঝিতে হইবে?
তাহা
হইলে তিনি কি সবিশেষ, অথবা নির্বিশেষ,-ইহা মীমাংসা করা হইতেছে। তাহাতে পূর্ব্বপক্ষীয়রা
বলেন দুইপ্রকার শ্রুতি থাকায় ব্রহ্ম সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয়াত্মক।
এই
প্রকার পূর্ব্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে বলিতেছি-'পরের' অর্থাৎ সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মের স্বভাবতঃ
উভয়লিঙ্গতা অর্থাৎ সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয়াত্মক হওয়া যুক্তিযুক্ত নহে। যেহেতু একই বস্তুর
স্বভাবতঃই রূপাদি বিশেষযুক্ত এবং তাহার বিপরীত, ইহা অবধারণ করিতে পারা যায় না, কারণ
বিরোধ হইয়া পড়ে।
শঙ্কা
হইল-আচ্ছা, তাহা হইলে 'স্থানবশতঃ' অর্থাৎ পৃথিবী প্রভৃতি উপাধির সহিত সম্বন্ধবশতঃ
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।১)'ব্রহ্মের সবিশেষতা সিদ্ধ হইবে'। সমাধান হইল-তাহাও সঙ্গত
নহে। যেহেতু উপাধির সহিত সম্বন্ধ হইলেও একপ্রকার স্বভাব সম্পন্ন বস্তুর অন্যপ্রকার
স্বভাব সম্ভব নহে। দেখ, স্ফটিক স্বচ্ছ হওয়ায় আলতা প্রভৃতি উপাধি সহিত সম্বন্ধবশতঃ কদাপি
অস্বচ্ছ হয় না, যেহেতু তাহাতে অস্বচ্ছতা বিষয়ক অভিনিবেশ জ্ঞান ভ্রমমাত্র।
আর
যেহেতু উপরিউক্ত ছান্দোগ্য শ্রুতির ব্রহ্মের সবিশেষতা সম্পাদক গন্ধ ও রূপরসাদি উপাধিসকল
অবিদ্যা কর্তৃক প্রত্যুপস্থাপিত। আর সেইহেতু অন্যতর লিঙ্গের পরিগ্রহ হইলেও সমস্তবিশেষরহিত
নির্বিকল্পরূপেই ব্রহ্মকে অবগত হইতে হইবে, তাহার বিপরীতরূপে নহে। যেহেতু সকল স্থলেই
অর্থাৎ উপনিষদ্ সকলে ব্রহ্মস্বরূপ প্রতিপাদনপর 'অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ম্'-(কঠ উপনিষদ্-১।৩।১৫)
অর্থাৎ 'শব্দরহিত, স্পর্শরহিত, রূপবিহীন, ক্ষয়রহিত' ইত্যাদি
এই বাক্যসকলে যাঁহা হইতে সমস্ত বিশেষ নিরাকৃত হইয়াছে, সেই ব্রহ্মই উপদিষ্ট হইতেছেন।
No comments:
Post a Comment