শ্রুতিতে "সাক্ষী চেতা কেবলো নির্গুণশ্চ।" -(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৬/১১) বলে সাক্ষীর স্বরূপ নির্ণয় করা হয়েছে। এই শ্রুতির ভাষ্যে ভগবান্ শঙ্করাচার্য বলেছেন —"সর্বভূতের সাক্ষী অর্থাৎ সাক্ষাৎ দ্রষ্টা, ব্যাকরণ শাস্ত্রে সাক্ষাৎ দ্রষ্টাকেই 'সাক্ষী' সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। চেতা অর্থ চেতয়িতা —চেতন বা চৈতন্যসম্পন্ন, কেবল অর্থ কোনপ্রকার উপাধিবিশেষ বা ধর্ম তার নেই। নির্গুণ অর্থ সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণরহিত।" সুতরাং নির্গুণ নির্বিশেষ চৈতন্যই সাক্ষী, এটাই শ্রুতির মর্ম।
সাক্ষী
কাকে বলে? এই প্রশ্নের
উত্তরে চিৎসুখাচার্য বলেছেন যে, "সর্ব্বপ্রত্যগ্ভূতং বিশুদ্ধং ব্রহ্মাত্র জীবাভেদেন সাক্ষীতি ব্যপদিশ্যতে"-(চিৎসুখী) অর্থাৎ বিশুদ্ধ ব্রহ্মই জীবাভিন্ন হয়ে সাক্ষী বলে
কথিত হন। এক অদ্বিতীয়
মায়াতীত, নির্গুণ, বিশুদ্ধ পরব্রহ্মই জীবের অধিষ্ঠান বা আশ্রয় থেকে
জীবের সহিত অভিন্নরূপে প্রতিভাত
হয়ে এবং প্রত্যেক জীব-শরীরের ভেদে ভিন্নের ন্যায়
প্রতীতি গোচর হয়ে সাক্ষী
বলে অভিহিত হয়ে থাকেন। সাক্ষী
স্বয়ং উদাসীন, সুতরাং সাক্ষী জীবকোটিও নয়, ঈশ্বরকোটিও নয়।
কেন না, জীব বা
ঈশ্বর কেউই উদাসীন নন।
কূটস্থ চৈতন্যই স্বভাবতঃ উদাসীন এবং সাক্ষী হবার
যোগ্য। আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামী তৎকৃত পঞ্চদশীর কূটস্থ দীপে জীবের স্থুল
ও সূক্ষ্ম এই দুই প্রকার
শরীরের অধিষ্ঠান বা আশ্রয় নির্বিকার
কূটস্থ চৈতন্যকে সাক্ষী বলে অভিহিত করেছেন।
স্বয়ংজ্যোতি
প্রকাশস্বভাব সর্বাবভাসক ঐ চৈতন্য দৃক্
বা জ্ঞানস্বরূপ হলেও ওটাকে দ্রষ্টা
বলেই লোকে মনে করে।
দৃক্ স্বরূপ শুদ্ধ চৈতন্যের দ্রষ্টৃত্ব বা দর্শন ক্রিয়ার
কর্তৃত্ব স্বাভাবিক নয়, ওটা ঔপাধিক।
কূটস্থ চৈতন্যের সহিত জীব-চৈতন্যের
অন্যোন্যাধ্যাসের ফলে অভেদ বোধের
উদয় হয়ে থাকে বলে
সাক্ষী ও জীব অভিন্ন
বলে বোধ হয়, বস্তুতঃ
ওরা অভিন্ন নয়। কূটস্থ সাক্ষী
চৈতন্যের কোন প্রকার ভোগ
নেই, সে উদাসীন দ্রষ্টা
মাত্র। কিন্তু জীব তাঁর স্বীয়
কর্মানুরূপ সুখ, দুঃখ ফল
ভোগ করে থাকে, সুতরাং
বিষয়ভুক্ জীব-চৈতন্যকে কোনমতেই
উদাসীন সাক্ষী বলা যায় না।
জীব ও সাক্ষীর ভেদ
কিরূপ, তা আচার্য বিদ্যারণ্য
স্বামী পঞ্চদশীর নাটকদীপে নাটকীয় রঙ্গমঞ্চের প্রদীপের দৃষ্টান্তের উল্লেখ করে পরিস্কার ভাবে
আমাদের বুঝাবার চেষ্টা করেছেন।
রঙ্গমঞ্চের
প্রদীপ যেমন নাচঘর, নট,
নটী, দর্শক প্রভৃতি সকলকেই সমানভাবে প্রকাশিত করে, এবং অভিনয়
সমাপ্ত হলে নট, নটী,
দর্শকগণ চলে গেলেও পূর্বের
ন্যায়ই জ্বলতে থাকে, সেরূপ সর্বসাক্ষী স্বপ্রকাশ ব্রহ্ম-দীপ জীব, জৈব
অহঙ্কার, বুদ্ধি-বৃত্তি, ইন্দ্রিয় প্রভৃতি সকলকে স্বীয় ভাস্বর জ্যোতিঃদ্বারা প্রকাশিত করে, আবার সর্বপ্রকার
জৈব অভিমান, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়-বৃত্তি প্রভৃতি বিলীন হলে ওদের অবর্তমানেও
পূর্ণ জ্যোতিতেই বিরাজ করতে থাকে। সংসারের
রঙ্গমঞ্চে সর্বদা বুদ্ধির নৃত্য চলছে। অহং অভিমানী জীব
বিষয় ভোগের আশায় মশগুল। অহং অভিমানী জীবই
গৃহ-স্বামী। বিষয় সকল তাঁর ভোগের
সাধন। ইন্দ্রিয়গণ বুদ্ধি-বিকাশের আনুকূল্য সম্পাদন করে বলে ওরা
বুদ্ধির নৃত্যের তাল-লয়-রক্ষক
বাদ্যকরস্থানীয়। কূটস্থ নিত্য চৈতন্য সাক্ষী। এই সর্বসাক্ষী নিত্য
আনন্দময় জ্যোতিঃ বিদ্যমান আছে বলেই সংসারের
রঙ্গশালায় বুদ্ধির নৃত্য দেখা যাচ্ছে। বুদ্ধির
নৃত্যকলা সমাপ্ত হলেও এই নিত্য
জ্যোতিঃ এই ভাবেই বিরাজ
করবে। সাক্ষী সর্বপ্রকার অজ্ঞান লীলারই নিরপেক্ষ দ্রষ্টা।.....
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান্ শঙ্করাচার্যের শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ ভাষ্য।
২.
"বেদান্ত দর্শন—অদ্বৈতবাদ" শীর্ষক গ্রন্থ, কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি, অধ্যাপক শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
জুন
২৬, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment