ব্রহ্মসূত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় পাদের আত্মাধিকরণের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় জীবের উৎপত্তিরাহিত্য অর্থাৎ নিত্যতা। "অগ্নি হইতে ক্ষুদ্র বিস্ফুলিঙ্গসকল যেমন নানাদিকে নির্গত হয়, এই প্রকারেই এই আত্মা (পরমাত্মা) হইতে প্রাণসকল নির্গত হয়"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২।১।২০, মাধ্যন্দিন শাখা), এই প্রকারে শ্রুতিতে প্রাণ প্রভৃতি ভোগ্যপদার্থসমূহের সৃষ্টিকে উপদেশ করিয়া 'এই আত্মা সকল নানাদিকে নির্গত হয়'-এইভাবে ভোক্তা আত্মা সকলের পৃথগ্ ভাবে সৃষ্টির উপদেশ করিতেছেন। এইভাবে কোন কোন শ্রুতিতে পরব্রহ্ম হইতে জীবাত্মার উৎপত্তি পঠিত হইতেছে।
আবার কোন কোন শ্রুতিতে যেমন-"তাঁহাকে সৃষ্টি করিয়া তাহাতেই অনুপ্রবেশ করিলেন"-(তৈত্তিরায় উপনিষৎ-২।৬) এই প্রকারে কিন্তু অবিকৃত পরব্রহ্মেরই কার্য্যের মধ্যে প্রবেশ দ্বারা জীবভাব অবগত হওয়া যাইতেছে, কিন্তু জীবের উৎপত্তি পঠিত হইতেছে না।
অতএব এসব শ্রুতির পরস্পর বিরোধবশতঃ শ্রুতির প্রামাণ্য সিদ্ধ হয় না, এইরূপ আশঙ্কা আর সন্দেহ উৎপন্ন হইলে ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত করিতেছেন-
নাত্মাশ্রুতের্নিত্যত্বাচ্চ তাভ্যঃ৷৷-ব্রহ্মসূত্র-২.৩.১৭৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- ভাষ্যকার ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য বাদরায়ণ ভগবতের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করিতেছেন-
আত্মা অর্থাৎ জীব উৎপন্ন হয় না। কোন হেতু বলে? যেহেতু শ্রুতিতে বর্ণিত হয় নাই। যেহেতু উৎপত্তি প্রকরণে বহুস্থলে ইহা শ্রুত হয় নাই। কিন্তু কোন স্থলে শ্রুত না হওয়া অন্যত্র শ্রুতকে বারণ করিবে, ইহা সঙ্গত নহে; এইরূপ শঙ্কা হইতে পারে। কিন্তু আমরা বলিতেছি জীবের উৎপত্তি সম্ভব নহে। কেন নহে? যেহেতু সেই উৎপত্তি নিষেধকারিণী শ্রুতিসকল হইতে জীবের নিত্যতা অবগত হওয়া যায়। সূত্রস্থ 'চ' শব্দটী হইতে জন্মরাহিত্য প্রভৃতিবশতঃও 'জীবের নিত্যতা সূচিত হয়। এইরূপে ইহার জন্মরাহিত্য, বিকাররাহিত্য; অবিকৃত ব্রহ্মেরই জীবরূপে এবং ব্রহ্মরূপে অবস্থান, ইত্যাদি শ্রুতিসকল হইতে অবগত হওয়া যাইতেছে। সেই শ্রুতিসকল কি কি?
'ন জীবো ম্রিয়তে'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।১১।৩)
অর্থাৎ জীবের মৃত্য হয় না।
'স বা এষ মহানজ আত্মাজরোমরোমৃতোভয়ো ব্রহ্ম'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৪।২৫)
অর্থাৎ সেই এই মহান ও জন্মরহিত আত্মা জরাহীন মৃত্যুহীন অমৃতস্বরূপ, ভয়বর্জ্জিত এবং ব্রহ্ম (-নিরতিশয় মহান)।
'ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিত্'-(কঠ উপনিষৎ-১।২।১৮)
অর্থাৎ (অবিলুপ্ত চৈতন্যস্বরূপ এই আত্মা) জাত হন না, বিনষ্ট হন না।
'অজো নিত্যঃ শাশ্বতোয়ং পুরাণঃ'-(কঠ উপনিষৎ-১।২।১৮)
অর্থাৎ ইনি জন্মরহিত, নিত্য, ক্ষয়শূন্য এবং পুরাণ(-বৃদ্ধিবিবর্জ্জিত, পুরাতন হইয়াও নতুন)।
'তত্সৃষ্ট্বা তদেবানুপ্রাবিশত্'-(তৈত্তিরায় উপনিষৎ-২।৬)
অর্থাৎ তাঁহাকে সৃষ্টি করিয়া তাহাতেই অনুপ্রবেশ করিলেন।
'অনেন জীবেনাত্মনানুপ্রবিশ্য নামরূপে ব্যাকরবাণি'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।৩।২)
অর্থাৎ এই জীবাত্মারূপে অনুপ্রবেশ করিয়া নাম ও রূপকে অভিব্যক্ত করিব।
'স এষ ইহ প্রবিষ্ট আ নখাগ্রেভ্যঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১।৪।৭)
অর্থাৎ সেই (নিত্য শুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব) ইনিই নখের অগ্রভাগ পর্য্যন্ত এইখানে (-সমগ্র শরীরে) প্রবিষ্ট হইয়া আছেন।
'তত্ত্বমসি'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।৮।৭)
অর্থাৎ তুমি তৎস্বরূপ।
'অহং ব্রহ্মাস্মি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১।৪।১০)
অর্থাৎ আমি ব্রহ্মস্বরূপ।
'অয়মাত্মা ব্রহ্ম সর্বানুভূঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২।৫।১৯)
সর্ব্বাত্মকরূপে সকলের অনুভবকর্ত্তা এই আত্মাই ব্রহ্ম।
ইত্যাদি এই সকল শ্রুতি জীবের নিত্যতাবাদিনী হইয়া জীবের উৎপত্তিকে প্রতিবন্ধন অর্থাৎ সুষ্পষ্টরূপে বাধা দান করিতেছে। কিন্তু ব্রহ্ম হইতে জীব বিভক্ত হওয়ায় ইহার কার্য্যতা সিদ্ধ হয় এরূপ আপত্তি উত্তরে বলা হইতেছে-জীবের ব্রহ্ম হইতে বিভাগ স্বভাবতঃ বর্ত্তমান নাই, যেহেতু-
'একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা' -(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ- ৬।১১)
অর্থাৎ 'এক অদ্বিতীয় দেব(-জ্যোতিঃস্বরূপ পরমাত্মা) সর্ব্বপ্রাণীতে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থিত আছেন, তিনি সর্ব্বব্যাপী ও সকল প্রাণীর অন্তরাত্মা।' এইসকল শ্রুতি আছে। কিন্তু বুদ্ধি প্রভৃতি উপাধিরূপ নিমিত্তবশতঃ জীবের ব্রহ্ম হইতে বিভাগ প্রতিভাত হয়, যেমন ঘটাদির সহিত সম্বন্ধবশতঃ (ঘটাকাশ ও মহাকাশরূপে) আকাশের বিভাগ প্রতিভাত হয়। এই বিষয়ে শ্রুতিপ্রমাণ-
'স বা অয়মাত্মা ব্রহ্ম বিজ্ঞানময়ো মনোময়ঃ প্রাণময়শ্চক্ষুর্ময়ঃ শ্রোত্রময়ঃ' --(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৪।৫)
অর্থাৎ 'সেই এই আত্মা ব্রহ্মস্বরূপই, ইনিই বিজ্ঞানময় (বুদ্ধিরূপ উপাধিযুক্ত), মনোময়, প্রাণময়, চক্ষুর্ম্ময় ও শ্রোত্রময় (-চক্ষু ও শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়ের বৃত্তি হইলে আত্মাও দ্রষ্টা ও শ্রোতা ইত্যাদি রূপে প্রতিভাত হন)।' ইত্যাদি এইসকল শাস্ত্র ব্রহ্ম এক ও অবিকৃত হইলেও, তাঁহার বুদ্ধ্যাদিময়তারূপ অনেকত্ব প্রদর্শন করিতেছেন। ইহার তন্ময়তাকে(-জীবের বিজ্ঞানময়তাকে) তাঁহার বিবিক্ত (অসঙ্গ) স্বরূপের অনভিব্যক্তিবশতঃ বুদ্ধ্যাদির সহিত উপরক্তস্বরূপে (সম্বন্ধযুক্তরূপে) বুঝিতে হইবে........
আর কোন কোন স্থলে (যেমন বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২।১।২০) জীবের যে উৎপত্তি এবং প্রলয় শ্রুত হইয়াছে, তাহাও এই হেতুবলেই অর্থাৎ উপাধির সহিত সম্বন্ধবশতঃই ব্যাখ্যা করিতে হইবে; অর্থাৎ (অন্তঃকরণরূপ) উপাধির উৎপত্তিদ্বারা জীবের উৎপত্তি এবং প্রলয়দ্বারা প্রলয় হয়, এইপ্রকারে ব্যাখ্যা করিতে হইবে।
'প্রজ্ঞানঘন এবৈতেভ্যো ভূতেভ্যঃ সমুত্থায় তান্যেবানু বিনশ্যতি ন প্রেত্য সংজ্ঞাস্তি'- (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৫।১৩)
অর্থাৎ এই আত্মা সর্ব্বতোভাবেই প্রজ্ঞানঘন (-জ্ঞানস্বরূপ), ইনি এই ভূতসকল হইতে উত্থিত হইয়া তাহাদের নাশের অনন্তর নাশ প্রাপ্ত হন, মৃত্যুর পর ইহার সংজ্ঞা থাকে না।'
এইরূপে ইহা (-মৃত্যুর পর সংজ্ঞা না থাকা) উপাধিরই প্রলয়, কিন্তু আত্মার বিলয় বা নাশ নহে।
অত্রৈব মা ভগবান্মোহান্তমাপীপদন্ন বা অহমিমং বিজানামি'ন প্রেত্য সংজ্ঞাস্তি-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৫।১৪, মাধ্যন্দিন শাখা)
অর্থাৎ "পূজার্হ আপনি এইস্থলেই আমাকে মোহের মধ্যে ফেলিলেন, যিনি প্রজ্ঞানঘন মৃত্যুর পর তাঁহার সংজ্ঞা থাকে না, ইহা আমি কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছি না" এইপ্রকার প্রশ্নপূর্ব্বক শ্রুতি প্রতিপাদন করিতেছে-
'ন বা অরেহং মোহং ব্রবীম্যবিনাশী বা অরেয়মাত্মানুচ্ছিত্তিধর্মা' -(ঐ)
অর্থাৎ প্রিয়ে আমি মোহোৎপাদক বাক্য বলিতেছি না, প্রিয়ে এই আত্মা অবিনাশী যেহেতু উচ্ছেদ (-পরিণাম) না হওয়াই ইঁহার ধর্ম্ম (-স্বভাব), কিন্তু মাত্রার (-বিষয়ের) সহিত ইঁহার সংসর্গ হয় না (-দেহেন্দ্রিয়াদি উপাধির বিলয়রূপ মৃত্যুর অনন্তর বিষয়ের সহিত সম্বন্ধ না হওয়াই ইহার বিশেষ জ্ঞান হয় না, 'ইহাই মৃত্যুর পর সংজ্ঞা থাকে না', এইরূপে বর্ণিত হইতেছে।)
আবার 'একটী বিজ্ঞাত হইলে এই সকলই বিজ্ঞাত হয়'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ ৬।১।৩, মুণ্ডক উপনিষৎ ১।১।৩) এইরূপ প্রতিজ্ঞার সিদ্ধির জন্য জীবকে ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন বলা হইয়াছে এইরূপ আপত্তি জন্মালে তদুত্তরে সিদ্ধান্তী বলিতেছেন-অবিকৃত ব্রহ্মেরই জীবভাব অঙ্গীকৃত হওয়ায় প্রতিজ্ঞার বাধও হয় না।
আবার অবিকৃত ব্রহ্মই জীব, ইহা জানিতে পারা যায় না; যেহেতু জীব ও ব্রহ্মের লক্ষণভেদ আছে, যেহেতু পরমাত্মা পাপাদি দোষরহিত, জীব কিন্তু তাহার বিপরীত এইরূপ শঙ্কা জন্মিলে সিদ্ধান্তী সমাধান করিতেছেন- ব্রহ্ম ও জীবের লক্ষণভেদও (বিম্ব ও প্রতিবিম্বের ন্যায়) উপাধিবশতঃই হইয়া থাকে, যেহেতু
'অত ঊর্ধ্বং বিমোক্ষায়ৈব ব্রূহি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।১৫)
অর্থাৎ 'ইঁহার পর বিমুক্তির জন্যই (-যাহাতে আমার সংসার বন্ধনের মোচন হয়, তাহার জন্যই) বলুন'-এইরূপে প্রস্তাবিত বিজ্ঞানময় আত্মার সর্ব্বসংসার ধর্ম্মের প্রত্যাখ্যান দ্বারা পরমাত্মভাব প্রতিপাদিত হইয়াছে। সেইহেতু আত্মা (-জীব) নিশ্চয়ই উৎপন্ন হয় না এবং প্রলীন হয় না।......ইতি