শাঙ্করভাষ্যম্ উপক্ৰমণিকা
‘মঙ্গলাচরণম্’
ॐ নারায়ণঃ পরোঽব্যক্তাত্ অণ্ডমব্যক্তসম্ভবম্ ।
অণ্ডস্যান্তস্ত্বিমে
লোকাঃ সপ্তদ্বীপা চ মেদিনী ॥
অব্যক্তা প্রকৃতি
অপেক্ষা নারায়ণ শ্রেষ্ঠ। এই ব্রহ্মান্ড অব্যক্তা প্রকৃতি হইতে উদ্ভূত হইয়াছে। পাতাল
হইতে সত্যলোক পর্য্যন্ত চতুর্দ্দশ ভূবন এবং সপ্তদ্বীপযুক্ত মেদিনী এই ব্রহ্মান্ডেরই
ভিতর।
সেই ভগবান্ এই জগৎ ব্ৰহ্মাণ্ড সৃষ্টি করিয়া তাহার
স্থিতি সম্পাদন মানসে মরীচ্যাদি প্রজাপতিগণকে সৃষ্টিকরতঃ সংসারপ্রবৃত্তি লক্ষণরূপ বেদোক্ত
ধৰ্ম্মোপদেশ করেন এবং অনন্তর সনকসনন্দনাদি ঋষিগণকে সৃষ্টি করিয়া জ্ঞান বৈরাগ্যাদি
নিবৃত্তিলক্ষণরূপ ধৰ্ম্মোপদেশ প্ৰদান করেন। যাহা জগতের স্থিতিকারণ এবং প্রাণিগণের সাক্ষাৎ
অভ্যুদয় অর্থাৎ উন্নততর অবস্থা যথা স্বর্গাদি এবং নিঃশ্রেয়স অর্থাৎ ত্রিবিধ দুঃখের
নিবৃত্তিরূপ মোক্ষের হেতু, তাহাই ধর্ম্ম। এই নিঃশেয়স ধর্ম ব্রাহ্মণাদি চতুর্বর্ণ ও ব্রহ্মচর্যাদি
চতুর্বিধ আশ্রমীদের মধ্যে যাঁহারা শ্রেয়ঃপ্রার্থী তাহাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে।
বেদোক্ত ধর্মে দ্বিপ্রকার লক্ষণ দৃষ্ট হইয়া থাকে, একটী সংসার-প্রবৃত্তি, অপরটি নিবৃত্তি। দীর্ঘকাল অতিক্রম হওয়াতে
যখন এই বেদোক্ত ধৰ্ম্মানুষ্ঠানকারীদিগের মধ্যে নিষ্কাম ধর্মের অনুশীলনে কামোদ্ভব হেতু
বিবেক বিজ্ঞান হ্রাস হয় এবং সেই জন্য অধর্ম দ্বারা ধর্ম অভিভূত হইতেছিল, তখন জগতের স্থিতি ও পালন ইচ্ছা করিয়া আদি কৰ্ত্তা নারায়ণাখ্য বিষ্ণু ভূদেব
ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণত্ব রক্ষার্থে বসুদেবের ঔরসে অংশের (বলরামের)
সহিত দেবকীর গর্ভে কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। যেহেতু
ব্রাহ্মণত্ব রক্ষা হইলে বৈদিক-ধর্ম্ম রক্ষা পাইবে। কারণ গুণ ও কর্ম্মভেদে বর্ণ এবং
আশ্রমের যে ভেদ তাহা বৈদিক ধর্ম্মের অধীন।
তিনি যদিও জন্ম রহিত, সৰ্ব্ব ভূতেশ্বর, নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ,
মুক্তস্বভাব পরমাত্মম্বরূপ, তথাপি লোকানুগ্রহার্থে
স্বীয় ঐশ্বর্য্য, শক্তি, বল,
বীর্য্য ও তেজাদির দ্বারা ত্রিগুণাত্মিকা আপন বৈষ্ণবী মায়াকে বশীভূত
করিয়া দেহ ধারণ পূর্বক জন্ম পরিগ্ৰহ করিয়া থাকেন। তাহার স্বপ্রয়োজন না থাকিলেও ভূত
সকলের প্রতি কৃপা ইচ্ছা করিয়া এই প্রকার লীলা আবির্ভাব করিতে হয়। ভগবান যখন দেখিলেন,
অর্জুন শোক মোহাদি সাগরে নিমগ্ন তখনই অৰ্জ্জুনকে বৈদিক ধৰ্ম্মদ্বয়
উপদেশ করিয়াছিলেন। শ্রীভগবান কর্তৃক অৰ্জ্জুনকে লক্ষ্য করিয়া যথোপদিষ্ট সে ধৰ্ম্মই
সৰ্ব্বজ্ঞ ভগবান বেদব্যাস সপ্তশত শ্লোকদ্বারা গীতানামে নিবদ্ধ করিয়াছেন। এই
গীতাশাস্ত্র সমস্ত বেদাৰ্থ সারসংগ্ৰহ স্বরূপ ও দুর্বিজ্ঞেয়ার্থ। যদিও গীতার অর্থ
আবিষ্কারের জন্য পদ-পদার্থ-বাক্যার্থ ও ন্যায় অনেকে বিবৃত করিয়াছেন, কিন্তু তথাপি
লৌকিক মনুষ্যদ্বারা গীতার ঐ সকল পদ-পদার্থ প্রভৃতির পরস্পর অত্যন্ত বিরুদ্ধ এবং
নানাবিধ অর্থ গ্রহণ করা হইয়াছে দেখিয়া আমি এই ভাষ্যে বিবেকতঃ অর্থ নির্দ্ধারণের
জন্য সংক্ষেপে বর্ণনা করিব।
এই গীতা-শাস্ত্রের সংক্ষেপতঃ প্রয়োজন পরম
নিশ্রেয়স (পরম কল্যাণ)-যাঁহার লক্ষণ হইতেছে সহেতুক সংসারের অত্যন্ত উপরম বা
শান্তি। সেই নিঃশ্রেয়স, সর্ব্বকর্ম্মসংন্যাসপূর্বক আত্মজ্ঞান-নিষ্ঠারূপ ধর্ম্ম
হইতে লাভ হয়। আর ইহাকেই এই গীতার প্রতিপাদ্য রূপে উদ্দেশ্য করিয়া ভগবান মহাভারতের
শান্তিপর্ব্বের অনুগীতাতে বলিতেছেন-'ব্রহ্মপদ বেদনে এই গীতোক্ত ধর্ম্ম
সুপর্য্যাপ্ত।' এবং সেখানে ভগবান আরও বলিতেছেন-যিনি কোন কর্ম্মের দ্বারা ধর্ম্মী
বা অধর্ম্মী হন না বা কোন কর্ম্মফলের দ্বারা শুভাশুভী হন না, যিনি একাসনে
কিছুমাত্র চিন্তা না করে, ব্রহ্মে লীন হইয়া তুষ্ণীম্ভাবে অবস্থান করেন, তিনি সেই
নিঃশ্রেয়স প্রাপ্ত হন।' তাছাড়াও বলিয়াছেন-'সংন্যাসই জ্ঞানের লক্ষণ' ইত্যাদি। আর এই
গীতাশাস্ত্রেরও শেষভাগে বলিয়াছেন-'সর্ব্বধর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক আমার শরণ লও।'-(গীতা
১৮।৬৬)
বর্ণাশ্রমকে উদ্দেশ্য করিয়া অভ্যুদয়ের জন্য যে
প্রবৃত্তি-লক্ষণ ধর্ম্ম বিহিত হইয়াছে, তাহা দেবাদি স্থান প্রাপ্তির হেতু; কিন্তু
সেই সকল কর্ম্মই যদি ফলাভিসন্ধি বর্জ্জিত হইয়া ঈশ্বরার্পণ বুদ্ধিতে অনুষ্ঠিত হয়
তাহা হইলে তাহা চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত হইয়া থাকে। নিষ্কামকর্ম্মের দ্বারা
শুদ্ধচিত্তের জ্ঞাননিষ্ঠারূপ যোগ্যতা প্রাপ্তির দ্বারা জ্ঞানোৎপত্তির হেতু হয়
বলিয়া নিষ্কাম কর্ম্মকে নিঃশ্রেয়স অর্থাৎ মুক্তির দূর কারণ বলা যাইতে পারে। ভগবান
এই অর্থকে লক্ষ্য করিয়াই পরে বলিবেন-'ব্রহ্মে কর্ম্মফল অর্পণ করিয়া',-(গীতা-৫।১০);
'যোগীগণ আসক্তি ত্যাগ করিয়া চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত কর্ম্ম করিয়া থাকেন।'-(গীতা-৫।১১)
নিঃশেয়স প্রয়োজন প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি-লক্ষণ
দুই প্রকার ধর্ম্ম এবং অভিধেয়ভূত (প্রতিপাদ্য বিষয়ক) বাসুদেবাখ্য পরংব্রহ্মরূপ
পরমার্থতত্ত্বকে বিশেষভাবে অভিব্যক্ত করিবার জন্য এই গীতাশাস্ত্র বিশিষ্ট
প্রয়োজন-সম্বন্ধ-অভিধেয়যুক্ত। যেহেতু গীতার অর্থ বিজ্ঞানের দ্বারা সমস্ত পুরুষার্থ
সিদ্ধ হয়, সেইহেতু তাহার ব্যাখ্যায় আমাকর্তৃক যত্নকৃত হইতেছে-
ইতি শ্রীমৎপরমহংস
পরিব্রাজকাচার্য্যস্য গোবিন্দভগবৎপূজ্যপাদ শিষ্যস্য শ্রীমৎ শঙ্করভগবৎপাদাচার্য্য
কৃতৌ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতোপদ্ঘাত ভাষ্যম্।
No comments:
Post a Comment