Friday, 26 July 2019

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-“সাংখ্যযোগ” (শাঙ্করভাষ্য অনুযায়ী ভাবার্থ)


সাংখ্যযোগ



সঞ্জয় উবাচ।
তন্তথা কৃপয়াবিষ্টমশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্। বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ || ||

সঞ্জয় বলিলেন-
তখন সেই কৃপাবিষ্ট অশ্রুপূর্ণাকুললোচন বিষাদযুক্ত (অর্জ্জুন)কে মধুসূদন এই কথা বলিলেন।

শ্রীভগবান্ উবাচ।
কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্।
অনার্য্যজুষ্টস্বর্গ্যকীর্ত্তিকরমর্জ্জুন || ||

শ্রীভগবান্ বলিলেন-
হে অর্জ্জুন! এই বিষম সঙ্কটে অনার্য্য-জনোচিত স্বর্গহানিকর এবং অকীর্ত্তিকর তোমার এই মোহ কোথা হইতে উপস্থিত হইল?

ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে ৷ 

ক্ষুদ্রং হৃদযদৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ ৷৷ ৩ ৷৷


কৌন্তেয়! ক্লীবতা প্রাপ্ত হইও না, ইহা তোমার উপযুক্ত নহে। হে পরন্তপ! ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্ব্বল্য পরিত্যাগ করিয়া উত্থান কর।


অর্জ্জুন উবাচ।
কথং ভীষ্মমহং সংখ্যে দ্রোণঞ্চ মধুসূদন। 
ইষুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পূজার্হাবরিসূদন || ||

অর্জ্জুন বলিলেন-
হে শত্রুনিসূদন মধুসূদন! পূজার্হ যে ভীষ্ম এবং দ্রোণ, যুদ্ধে তাঁহাদের সহিত বাণের দ্বারা কি প্রকারে আমি প্রতিযুদ্ধ করিব?

গুরূনহত্বা হি মহানুভাবান্
শ্রেয়ো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমপীহ লোকে।
হত্বার্থকামাংস্তু গুরূনিহৈব
ভূঞ্জীয় ভোগান্ রুধিরপ্রদিগ্ধান্ || ||

মহানুভব গুরুদিগকে হত্যা না করিয়া ইহলোকে ভিক্ষা অবলম্বন করিতে হয়, সেও শ্রেয়। আর গুরুদিগকে হত্যা করিয়া যে অর্থ কাম ভোগ করা যায়, তাহা রুধিরলিপ্ত।

ন চৈতদ্বিদ্মঃ কতরন্নো গরীয়ো
যদ্বা জয়েম যদি বা নো জয়েয়ুঃ।
যানেব হত্বা ন জিজীবিষাম-
স্তেহবস্থিতাঃ প্রমুখে ধার্ত্তরাষ্ট্রাঃ || ||

আমরা জয়ী হই বা আমাদিগকে জয় করুক, উহার মধ্যে কোন্‌টি শ্রেয়, তাহা আমরা বুঝিতে পারিতেছি না-যাহাদিগকে হত্যা করিয়া আমরা বাঁচিতে ইচ্ছা করি না, সেই ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ সম্মুখে অবস্থিত।

কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ
পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্ম্মসংমূঢ়চেতাঃ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রুহি তন্মে
শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্ || ||

কার্পণ্য-দোষে আমার স্বভাব অভিভূত এবং ধর্ম্ম সম্বন্ধে আমার চিত্ত বিমূঢ় হইয়াছে, তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। যাহা ভাল হয়, আমাকে নিশ্চিত করিয়া বল। আমি তোমার শিষ্য এবং তোমার শরণাপন্ন হইতেছি-আমাকে শিক্ষা দাও।

(শাঙ্করভাষ্যের টীকাকার আনন্দগিরি বলেন- যোহল্পাং স্বল্পমপি স্বক্ষতিং ন ক্ষমতে ব স কৃপণঃ। যে সামান্য ক্ষতি স্বীকার করিতে পারে না, সেই কৃপণ।)

নহি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাদ্-
যচ্ছেকমুচ্ছোষণমিন্দ্রিয়াণাম্।
অবাপ্য ভূমাবসপত্নমৃদ্ধং
রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্ || ||

এই ভূমন্ডলে অসপত্ন সমৃদ্ধ রাজ্য এবং সুরলোকের আধিপত্য পাইলেও যে শোক আমার ইন্দ্রিয়গণকে বিশোষণ করিবে, তাহা কি উপায়ে অপনোদন হইবে, আমি দেখিতেছি না।

সঞ্জয় উবাচ।
এবমুক্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপঃ।
ন যোৎস্য ইতি গোবিন্দমুক্ত্বা তূষ্ণীং বভূব হ || ||

সঞ্জয় বলিতেছেন-
জিতনিদ্র ও শত্রুজয়ী অর্জ্জুন হৃষীকেশকে এইরূপ বলিয়া, যুদ্ধ করিব না, ইহা গোবিন্দকে বলিয়া মৌনভাব অবলম্বন করিলেন।

তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্ম্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ || ১০ ||

হে ভারত! হৃষীকেশ হাস্য করিয়া উভয় সেনার মধ্যে বিষাদপর অর্জ্জুনকে এই কথা বলিলেন।

ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য এই শ্লোক থেকে প্রারম্ভ। আচার্য্য বলেন-“শোকমোহাভ্যাং হ্যভিভূতবিবেকবিজ্ঞান: স্বতএব ক্ষত্রধর্ম্মে যুদ্ধে প্রবৃত্তোহপি তস্মাদ্‌ষুদ্ধাদুপরমরাম পরধর্মঞ্চ ভিক্ষাজীবনাদিকং কর্ত্তুং প্রববৃতে অর্থাৎ অর্জ্জুন প্রথমেই ক্ষাত্রধর্মরূপ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াও শোকমোহে অভিভূত হইয়া বিবেক বিজ্ঞান বশত সেই যুদ্ধ হইতে বিরত হইলেন এবং পরধর্ম (ব্রাহ্মণ বর্ণাশ্রম ধর্ম) যে ভিক্ষাদির দ্বারা জীবনধারণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ‘সাংখ্য’ শব্দের উত্তরে আচার্য্য শঙ্কর অবতারণা করিয়াছেন- অশোচ্যান্' (গীতা ২.১১) ইত্যাদি শ্লোক হইতে ভগবান কর্তৃক 'স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য' (গীতা ২.৩১) ইত্যাদি শ্লোক পর্য্যন্ত গ্রন্থের দ্বারা যে পরমার্থ আত্মতত্ত্ব নিরূপণ করা হইয়াছে তাহাই সাংখ্য৷ তদ্বিষয়া বুদ্ধিঃ অর্থাৎ আত্মার জন্মাদি ষড়বিকার ভাবের অভাবহেতু আত্মা অকর্তা এইরূপ প্রকরণার্থ (গ্রন্থার্থ) নিরূপণ হইতে যে বুদ্ধি জন্মায় জন্মায়, তাহাই সাংখ্যবুদ্ধি৷ যে জ্ঞানীরা এই বুদ্ধির অধিকারী হইয়া থাকেন তাহারাই সাংখ্যযোগী৷ (ষড়বিকার ভাব বুঝিতে বেদের নিরুক্তকার যাস্কাচার্য্যের মতাবলম্বীরা বলিয়া থাকেন বার্ষায়ণি নামক আচার্য্যের মতে জন্ম, সত্তা, বৃদ্ধি, বিপরিণাম, অপক্ষয় এবং নাশ এই ষড়ভাব পদার্থের বিকার অবস্থা)। শঙ্করাচার্য্য তাহার বৃহৎ ভাষ্যান্তে অবতারণা করিতেছেন এইভাবে-“তত্রৈব ধর্মসংমূঢচেতসো মিথ্যাজ্ঞানবতো মহতি শোকসাগরে নিমগ্নস্য অর্জুনস্য অন্যত্রাত্মজ্ঞানাদুদ্ধরণমপশ্যন্ ভগবান্বাসুদেবঃ ততঃ কৃপযা অর্জুনমুদ্দিধারযিষুঃ আত্মজ্ঞানাযাবতারযন্নাহ অর্থাৎ ধর্মসংমূঢ চিত্ত মিথ্যাজ্ঞান বশত মহা শোকসাগরে নিমগ্ন অর্জুনের আত্মজ্ঞান ভিন্ন উদ্ধারের উপায় না দেখিয়া ভগবান বাসুদেব কৃপাপূর্ব্বক অর্জুনকে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে আত্মজ্ঞানের অবতারণা করিতেছেন-

শ্রীভগবান্ উবাচ।
অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে।
গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পণ্ডিতাঃ || ১১ ||

 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- শ্রীভগবান্ বলিতেছেনযাহা শোকের অযোগ্য তাহাই অশোচ্য অর্থাৎ ভীষ্মদ্রোণাদিরা সদাচারী এবং পরমার্থরূপে নিত্যত্বহেতু অশোচ্য। সেই অশোচ্যদিগের নিমিত্ত তুমি শোক করিতেছ। কিভাবে? “আমারই হস্তে ইহারা মারা যাইবেন; আমি তাহাদের সঙ্গ রহিত হইয়া রাজ্য সুখাদি দ্বারা কি করিব?” আবার তুমি প্রাজ্ঞ বুদ্ধিমানের ন্যায় বচন সকল বলিতেছ; অর্থাৎ শ্রীভগবানে অভিপ্রায় এই যে এইভাবে তুমি উন্মাদের মত মূর্খতা আর বুদ্ধিমত্তা এই দুই পরস্পর বিরুদ্ধ ভাব দেখাচ্ছ। যেহেতু আত্মজ্ঞ পণ্ডিতেরা গতপ্রাণ অর্থাৎ মৃত এবং অগতপ্রাণ অর্থাৎ জীবিতদের জন্য অনুশোচনা করেন না। ১১

ভীষ্মাদির বিনাশ কি জন্য অশোচ্য? কারণ তাঁহাদের আত্মা নিত্য। কি করে বুঝা যাবে?-

ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্ব্বে বয়মতঃপরম্ || ১২ ||

 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- আমি কদাচিৎ ছিলাম না, এমন নহে। অতীত জন্মের দেহোৎপত্তি বিনাশ হইলেও আমি নিত্য বর্তমান ছিলাম তুমি বা এই জনাধিপেরা ছিলেন না, এমন নহে পরন্তু ছিলেনই-ইহা নিশ্চিত। ইহার পরে ভবিষ্যতে আমরা সকলে যে থাকিব না, এমন নহে, পরন্তু আমরা সকলে থাকিবই। অতএব এই দেহ বিনাশের উত্তরকালেও থাকিব, যেহেতু আমরা সবাই ত্রিকালে আত্মস্বরূপে নিত্য। এইখানে ‘বয়ম’ শব্দের দ্বারা বহুবচনের প্রয়োগ দেহভেদের বিচারে করা হইয়াছে, আত্মভেদের অভিপ্রায়ে নহে। ১২

তাহা হইলে আত্মা কিরূপ নিত্য তাহার দৃষ্টান্ত বলিতেছেন-

দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি || ১৩ ||
                                                                      
 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- দেহীর অর্থাৎ দেহরূপ উপাধিযুক্ত আত্মার যেমন এই বর্তমান দেহে কৌমার অর্থাৎ কুমারভাব বাল্যাবস্থা, যৌবন অর্থাৎ যুবকভাব মধ্যমাবস্থা ও জরা অর্থাৎ বয়সহানি জীর্ণাবস্থা ক্রমে উপস্থিত হয়, তাহাতে দেহীর কোনও পরিবর্তন হয় না, সেইরূপ দেহান্তরপ্রাপ্তিতে অর্থাৎ একদেহ হইতে অন্য দেহান্তর প্রাপ্তিতে আত্মা অবিক্রিয় থাকেন ধীমান ব্যক্তিরা তাহাতে মোহ প্রাপ্ত হন না। ১৩

যাঁহারা আত্মা নিত্য জানিয়াছেন তাহাদের পক্ষে আত্মবিনাশনিমিত্ত মোহ যদিও সম্ভব নহে, তথাপি শীতোষ্ণ ও তজ্জন্য সুখদুঃখপ্রাপ্তনিমিত্ত যে মোহ এবং সুখ-বিয়োগ-নিমিত্ত ও দুঃখসংযোগ-নিমিত্ত যে শোক, যাহা লোকে দেখা যায়-এসব কী? অর্জ্জুনের এইরূপ প্রশ্নবচন আশঙ্কা করিয়া ভগবান বলিতেছেন-

মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।
আগমাপায়িনোহ নিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত || ১৪ ||

 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- হে কৌন্তেয়! মাত্রা অর্থাৎ শব্দাদি বিষয় সকলকে যদ্দারা জানা যায় সেই শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়গণ আর ইন্দ্রিয় সকলের স্পর্শ অর্থাৎ শব্দাদি বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়সকলের সংযোগ, ইহাই শীতোষ্ণাদি সুখদুঃখদায়কসে সকলের উৎপত্তি ও বিলয় আছে, তাহা অনিত্য। অতএব হে ভারত! হর্ষ ও বিষাদশূন্য হইয়া তাহা তিতিক্ষা অর্থাৎ সহ্য কর। ১৪

শীতোষ্ণাদি সহ্যকারীর তাহাতে কি হয়?-তাহা শ্রবণ কর-

যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ।
সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে || ১৫ ||

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- হে পুরুষর্ষভ (শ্রেষ্ঠ পুরুষ)! সুখদুঃখে সমভাব অর্থাৎ সুখদুঃখ প্রাপ্তিতে হর্ষবিষাদ রহিত যে ধীমান পুরুষ, নিত্যাত্ম দর্শনহেতু পূর্বোক্ত শীতোষ্ণাদি সকলে ব্যথিত অর্থাৎ বিচলিত হন না, আত্মার নিত্যত্ব দর্শননিষ্ঠ দ্বন্দ্বসহিষ্ণু তিনিই অমৃতত্ব অর্থাৎ মোক্ষ প্রাপ্তিতে সমর্থ হন। ১৫

এইজন্য শোক মোহ না করিয়া শীতোষ্ণাদি সহ্য করা যুক্তিযুক্ত, কারণ-

নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ।
উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ || ১৬ ||

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- কারণ হইতে উৎপন্ন, অতএব অসৎস্বরূপ শীত উষ্ণ প্রভৃতি বস্তুর বিদ্যমানতা অর্থাৎ অস্তিত্ব নাই। শীত উষ্ণাদি যে কারণ হইতে উৎপন্ন, তাহা প্রমাণ দ্বারা নিরূপিত হয়; সুতরাং উহারা সৎ পদার্থ হইতে পারে না। যেহেতু সকারণ শীতোষ্ণাদি বিকার পদার্থ মাত্র, এবং বিকার পদার্থের সর্ব্বদা ব্যভিচার বা স্বরূপচ্যুতি দৃষ্ট হয়। যেমন চক্ষু দ্বারা দেখিতে পাইলেই ঘটাদি পদার্থ মৃত্তিকা ভিন্ন অন্য কিছু বলিয়া উপলব্ধি হয় না, সেইরূপ কারণ ভিন্ন অন্য কিছু বলিয়া উপলব্ধি না হওয়ায় সর্ব্বপ্রকার বিকার পদার্থই অসৎ। অতএব দেহাদি দ্বন্দ্ব কারণ হইতে উৎপন্ন ও অসৎ, উহার অস্তিত্ব নাই; এবং সৎ যে আত্মা, তাঁহার কোথাও অভাব বা অবিদ্যমানতা নাই, যেহেতু তাঁহার কোথাও ব্যভিচার দৃষ্ট হয় না। ইহাই সৎ এবং অসৎরূপ আত্মা এবং অনাত্মার স্বরূপনির্ণয়। যে সৎ, সে সৎই; যে অসৎ, সে অসৎই। তত্ত্বদর্শি অর্থাৎ ব্রহ্মের মাহাত্ম্য দর্শনে সমর্থ ব্যক্তিদের দ্বারা সৎ ও অসৎ উভয়ের অন্ত অর্থাৎ নির্ণয় দৃষ্ট তথা উপলব্ধ হইয়াছে। ১৬

তাহা হইলে যাহা সৎ অর্থাৎ সর্ব্বদাই বর্ত্তমান তাহা কি?- এইবিষয়ে বলা হইতেছে-

অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্ব্বমিদং ততম্।
বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্ত্তুমর্হতি || ১৭ ||

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- যে সদ্ নামক ব্রহ্মের দ্বারা এই সকলই অর্থাৎ আকাশের সহিত সমগ্রবিশ্ব ব্রহ্মান্ড ব্যাপ্ত, তাহাকে অবিনাশী জানিবে। এই অব্যয় অর্থাৎ যাহার উপচয় (বৃদ্ধি) ও অপচয় (হ্রাস) নাই কেননা সদ্ নামক ব্রহ্ম অবয়বরহিত হওয়ার কারণে দেহাদির মত নিজের স্বরূপচ্যুত হন না; সেই আত্মরূপী ব্রহ্মকে কেহই বিনাশ করিতে সক্ষম নন। ১৭

তাহা হইলে সেই অসৎ পদার্থ কি, যাহা নিজ আত্মসত্তা থেকে চ্যুত হয়?-বলা হইতেছে-

অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যসোক্তাঃ শরীরিণঃ।
অনাশিনোহপ্রমেয়স্য অস্মাদ্‌যুদ্ধস্ব ভারত || ‍১৮ ||

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- নিত্য, অবিনাশী এবং অপ্রমেয় অর্থাৎ প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের দ্বারা অপরিচ্ছেদ্য শরীরী আত্মার এই সকল দেহ অন্তবন্ত অর্থাৎ বিনাশশীল বলিয়া বিবেকিগণ কর্তৃক উক্ত হইয়াছে। যেহেতু আত্মা এইরূপ নিত্য ও অবিক্রিয়, অতএব হে ভারত! যুদ্ধ করইহাতে যুদ্ধের কর্ত্তব্যতা বিধান করা হইতেছে না। যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াও অর্জ্জুন শোকমোহপ্রতিবদ্ধ হইয়া তূষ্ণীম্ভাবে আছেন, ভগবান্ তাঁহার কর্ত্তব্যপ্রতিবন্ধের অপনয়ন করিতেছেন মাত্র। অতএব যুদ্ধ করইহা অনুবাদ মাত্র, বিধি নয়। শোকমোহাদি সংসার কারণ নিবৃত্যর্থ গীতাশাস্ত্র যুদ্ধাদি কার্য্যের প্রবর্তক নহে। ১৮

তুমি যে মনে করিতেছ, ‘যুদ্ধে আমার দ্বারা ভীষ্মাদিরা নিহত হইবেন, আমি তাহাদের হন্তা হইব’, তোমার এইরূপ বুদ্ধি মিথ্যা। কেন?-

য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে || ১৯ ||

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- যে এই প্রকৃত দেহীকে হন্তা অর্থাৎ হনন ক্রিয়ার কর্তা বলিয়া জানে, এবং যে ইঁহাকে হত বলিয়া জানে, ইহারা উভয়েই অবিবেকহেতু অহংপ্রত্যয় বিষয়ীভূত আত্মাকে জানে না, অভিপ্রায় এই যে ইহারা উভয়ই আত্মস্বরূপে অনভিজ্ঞ। এই আত্মা হনন ক্রিয়ার কর্তা নন আবার হতও হন না; কারণ আত্মা অবিক্রিয়। ১৯

আত্মা অবিক্রিয় কেন? তাহাই বলা হইতেছে-

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচি-
ন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে || ২০ ||

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- এই আত্মা কখনও জাত বা মৃত হন না, কারণ পূর্বে না থাকিয়া পরে বিদ্যমান হওয়ার নাম জন্ম এবং পুর্বে থাকিয়া পরে না থাকার নাম মৃত্যু; আত্মাতে এই দুই অবস্থার কোনটিই নাই। অর্থাৎ আত্মা জন্ম-মৃত্যুরহিত তাই নিত্য, আত্মা নিরবয়বত্ব ও নির্গুণত্বহেতু শাশ্বত অর্থাৎ অপক্ষয়শূন্য, আত্মা পুরাণ অর্থাৎ বর্ধিত হয় না; শরীর হত হইলেও ইনি হত হন না। ২০

আত্মার অবিক্রিয়ত্বের হেতু উল্লেখ করিয়া, প্রতিজ্ঞাত অর্থের উপসংহার করিতেছেন-

বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্ ।
কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্ ।। ২১

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- যে এই আত্মাকে অবিনাশী অর্থাৎ অন্ত্যভাব বিকার রহিত, নিত্য অর্থাৎ বিপরিণাম রহিত, অজ অর্থাৎ জন্মরহিত এবং অব্যয় অর্থাৎ অপক্ষয়রহিত এইরূপ পূর্বমন্ত্রের শ্রুতি লক্ষণের দ্বারা জানে, হে পার্থ! সে বিদ্বান পুরুষ কি প্রকারে হনন ক্রিয়া করিতে পারেন? আর কি করেইবা ঘাতককে হনন কার্য্যে প্রয়োজিত করিতে পারেন? ২১

ব্যাখ্যাঃজীবের জন্মরাহিত্য, বিকাররাহিত্য; অবিকৃত ব্রহ্মেরই জীবরূপে এবং ব্রহ্মরূপে অবস্থান, ইত্যাদি শ্রুতিসকল হইতে অবগত হওয়া যাইতেছে। সেই শ্রুতিসকল কি কি? 'ন জীবো ম্রিয়তে'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।১১।৩) অর্থাৎ জীবের মৃত্য হয় না। 'স বা এষ মহানজ আত্মাজরোমরোমৃতোভয়ো ব্রহ্ম'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৪।২৫) অর্থাৎ সেই এই মহান ও জন্মরহিত আত্মা জরাহীন মৃত্যুহীন অমৃতস্বরূপ, ভয়বর্জ্জিত এবং ব্রহ্ম (-নিরতিশয় মহান)। 'ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিত্'-(কঠ উপনিষৎ-১।২।১৮) অর্থাৎ (অবিলুপ্ত চৈতন্যস্বরূপ এই আত্মা) জাত হন না, বিনষ্ট হন না। 'অজো নিত্যঃ শাশ্বতোয়ং পুরাণঃ'-(কঠ উপনিষৎ-১।২।১৮) অর্থাৎ ইনি জন্মরহিত, নিত্য, ক্ষয়শূন্য এবং পুরাণ(-বৃদ্ধিবিবর্জ্জিত, পুরাতন হইয়াও নতুন)। 'তত্সৃষ্ট্বা তদেবানুপ্রাবিশত্'-(তৈত্তিরায় উপনিষৎ-২।৬) অর্থাৎ তাঁহাকে সৃষ্টি করিয়া তাহাতেই অনুপ্রবেশ করিলেন। 'অনেন জীবেনাত্মনানুপ্রবিশ্য নামরূপে ব্যাকরবাণি'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।৩।২) অর্থাৎ এই জীবাত্মারূপে অনুপ্রবেশ করিয়া নাম ও রূপকে অভিব্যক্ত করিব। 'স এষ ইহ প্রবিষ্ট আ নখাগ্রেভ্যঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১।৪।৭) অর্থাৎ সেই (নিত্য শুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব) ইনিই নখের অগ্রভাগ পর্য্যন্ত এইখানে (-সমগ্র শরীরে) প্রবিষ্ট হইয়া আছেন। 'তত্ত্বমসি'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।৮।৭) অর্থাৎ তুমি তৎস্বরূপ। 'অহং ব্রহ্মাস্মি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১।৪।১০) অর্থাৎ আমি ব্রহ্মস্বরূপ। 'অয়মাত্মা ব্রহ্ম সর্বানুভূঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২।৫।১৯) সর্ব্বাত্মকরূপে সকলের অনুভবকর্ত্তা এই আত্মাই ব্রহ্ম। ইত্যাদি এই সকল শ্রুতি জীবের নিত্যতাবাদিনী হইয়া জীবের উৎপত্তিকে প্রতিবন্ধন অর্থাৎ সুষ্পষ্টরূপে বাধা দান করিতেছে। 

এক্ষণে প্রকৃত বিষয় বর্ণনা করিব। এই প্রকরণে আত্মার যে অবিনাশিত্ব প্রতিজ্ঞাত হইয়াছে এবং তাহার হেতুও দেখান হইয়াছে, এক্ষণে তাহা কিরূপ তাহা সদৃষ্টান্ত বলা হইতেছে-


বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী || ২২ ||

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- যেমন মনুষ্য জীর্ণ অর্থাৎ দূর্বল বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া অন্য নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, তেমনি আত্মা জীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করিয়া নবীন দেহ প্রাপ্ত করেন। ভাবার্থ ইহা যে জীর্ণ বস্ত্র ছাড়িয়া নূতন বস্ত্র ধারণকারী পুরুষের ন্যায় আত্মা অবিক্রিয়ই থাকেন। ২২

ব্যাখ্যাঃ- গতাগতি বুদ্ধ্যাদি সমন্বিত লিঙ্গশরীররূপ উপাধিরই। আত্মার বিভুত্বহেতু গতাগতি সম্ভব নহে। সুক্ষ্মশরীরের গতাগতিরূপ ধর্ম্ম আত্মাতে অধ্যারোপ করে আত্মার গতাগতি কল্পনা করা হয়। বেদান্ত দর্শনের উৎক্রান্তিগত্যধিকরণের সিদ্ধান্ত হইল জীব স্বরূপত বিভু। ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত করিতেছেন- উৎক্রান্তি, গতি, অগতি ইত্যাদি হইল বুদ্ধির গুণ, কিন্তু এইগুলিকে জীবাত্মার উপরই আরোপ করা হয়। ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে উৎক্রান্তি প্রভৃতির উপাধির অধীনতা বিষয়ে শ্রুতি প্রদর্শন করিতেছেন। যথা-

'কস্মিন্নু অহমুত্ক্রান্ত উত্ক্রান্তো ভবিষ্যামি কস্মিন্বা প্রতিষ্ঠিতে প্রতিষ্ঠাস্যামীতি' 'স প্রাণমসৃজত'-(প্রশ্ন উপনিষৎ-৬।৩-৪) "কে উৎক্রমণ করিলে আমি উৎক্রান্ত হইব এবং কেই বা শরীরে অবস্থিত হইলে আমি অবস্থিত থাকিব", "তিনি প্রাণকে (-বুদ্ধিসহ সমষ্টি লিঙ্গশরীরকে) সৃষ্টি করিলেন", ইত্যাদি শ্রুতি। আর উৎক্রান্তির অভাবে গমন ও আগমনেরও অভাব অবগত হওয়া যাইতেছে। যেহেতু দেহ হইতে অনিষ্ক্রান্ত কাহারও গমন ও আগমন সম্ভব নহে।

                                      কিরূপ নিদর্শনহেতু আত্মা অবিক্রিয়? বলিতেছেন-

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ || ২৩ ||

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- নিরবয়বত্ব হেতু অস্ত্রশস্ত্রাদি এই আত্মাকে ছেদন অর্থাৎ ইঁহার অবয়ব বিভাগ করিতে পারে না পাবক অর্থাৎ অগ্নি এই আত্মাকে দহন তথা ভষ্মীভূত করিতে পারে না অপ অর্থাৎ জলের সাবয়ব বস্তুর আর্দ্রীভাব করণের দ্বারা তাহার অবয়ব বিশ্লেষণ সামর্থ্য রহিয়াছে কিন্তু নিরবয়ব আত্মাতে তাহা সম্ভব নহে। মারুত অর্থাৎ বায়ু স্নেহযুক্ত দ্রব্যের স্নেহশোষণের দ্বারা তাহাকে নাশ করে কিন্তু ঐ একই কারণে বায়ু স্বীয় আত্মাকে শোষণ করিতে পারে না। ২৩

যেহেতু এইরূপ, সেইজন্য-

অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ।
নিত্যঃ সর্ব্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ ।। ২৪ ।।

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য ইত্যাদি, যেহেতু পরস্পর নাশহেতু ভূতসকল এই আত্মাকে নাশ করিতে সমর্থ নহে সেইহেতু আত্মা নিত্য; নিত্যত্ব হেতু সর্ব্বগত-এইহেতু স্থিরস্বভাব; স্থিরস্বভাব হেতু অচল; অচল-এই হেতু সনাতন অর্থাৎ চিরন্তন। ২৪

ব্যাখ্যা- (পূর্বপক্ষ) এই সকল শ্লোকের প্রতি পুনরুক্তি দোষারোপ করা কি উচিত নয়? যেহেতু "ন জায়তে ম্রিয়তে বা" ইত্যাদি একটি শ্লোকের দ্বারা আত্মার নিত্যত্ব এবং অবিক্রিয়ত্ব পূর্বেই বলা হয়েছে। সেখানে আত্মবিষয়ক যা কিছু বলা হয়েছে তা এই শ্লোকার্থ হতে অতিরিক্ত নয়, কেবল কিছু শব্দের পুনরুক্তি এবং কিঞ্চিৎ অর্থের পুনরুক্তি।

(উত্তরপক্ষ) আত্মবস্তুর দুর্বোধত্বহেতু (সহজে বোধগম্য নহে, এই হেতু), শ্রীভগবান বাসুদেব পুনঃ পুনঃ ঐ প্রসঙ্গ উত্থাপিত করে বিভিন্ন শব্দ দ্বারা সেই একই বস্তু নিরুপণ করছেন এই চিন্তা করে যে সেই সূক্ষ্মতত্ত্ব সংসারীদের বুদ্ধিগোচর হয়ে সংসার নিবৃত্তির হেতু হবে।

বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রে এই বিষয়ের আরও স্পষ্ট মীমাংসা আছে। যথা- "শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন, এ সকল অনুষ্ঠান একবার করলে যদি আত্মদর্শন না হয়—তবে পুনঃ পুনঃ করতে হবে। যতদিন না আত্মদর্শন হয় ততদিন পর্যন্ত করতে হবে। শাস্ত্র সেই অভিপ্রায়েই বার বার এবং শ্রবণাদি বহুবিধ উপায় উপদেশ করেছেন।" -(সূত্রার্থ সংক্ষেপ, ব্রহ্মসূত্র ৪/১/১)

অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে |
তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি || ২৫ ||

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- এই আত্মা অব্যক্ত অর্থাৎ সর্বকরণ ইন্দ্রিয়সকলের বিষয় নহে বলিয়া অপ্রকাশিত, ইন্দ্রিয়গোচর নহে বলিয়া অচিন্ত্য ও অবিকারী অর্থাৎ দধি, দম্বল প্রভৃতি দ্বারা দুধ যেমন বিকারী; আত্মা এমন নহে বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে। কারণ অবয়ব রহিত হওয়ার কারণে আত্মা অবিক্রিয়। এইরূপ যথোক্ত প্রকারে এই আত্মাকে জানিয়া তোমার শোক করা উচিত নহে ২৫

লোকায়ত দেহাত্মদৃষ্টির দিক থেকে আত্মার অনিত্যত্ব স্বীকার করিয়া এই পরবর্তী শ্লোকটি বলিতেছেন—

অথ চৈন নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্।
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং শোচিতুমর্হসি || ২৬ ||
জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্য্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি || ২৭ ||

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- আর যদি তুমি মনে কর যে, এই প্রকৃত আত্মা নিত্যজাত অর্থাৎ লোকপ্রসিদ্ধিহেতু প্রত্যেক শরীরের উৎপত্তির সঙ্গে জাত হন এবং প্রত্যেক শরীরের বিনাশের সঙ্গে মৃত হন, তথাপি হে মহাবাহো, ইঁহার জন্য তোমার অনুশোচনা করা উচিত নহে কারণ জাত অর্থাৎ জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তির ধ্রুব তথা অব্যভিচারী মৃত্যু এবং মৃত ব্যক্তির ধ্রুব জন্ম অবশ্যম্ভাবীসেইহেতু এই জন্মমরণলক্ষণ অপরিহার্য বিষয়ে তোমার অনুশোচনা করা উচিত নহে

ব্যাখ্যাঃ- অদ্বৈতবেদান্তীরা মৃত্যু মানে— এক ব্রহ্মবস্তুতে একটি বিশিষ্ট কালিক, দৈশিক ও নৈমিত্তিক নামরুপাত্মক ভ্রান্তি অপগত হইয়া অপর একটি নামরূপাত্মক ভ্রান্তির-প্রতীয়মানতা বলেন। দেহে আত্মবুদ্ধিহেতু দেহের উৎপত্তি ও বিনাশে আত্মার উৎপত্তি ও বিনাশ হয়, এইরূপ অবিবেক প্রতীতি হয়।

অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা || ২৮ ||

কার্য-করণ সংঘাতে উৎপত্তি হইয়াছে এমন যে পুত্রমিত্রাদিরূপ বিভিন্ন দেহ সেই ভূতসমূহ আদিতে অব্যক্ত অর্থাৎ যে অবস্থায় ভূতসকলের দর্শন বা উপলব্ধি নাই, কেবল মধ্যে অর্থাৎ উৎপত্তির পর মরণের পূর্ব্বক্ষণ পর্য্যন্ত ব্যক্ত, আবার নিধনে অর্থাৎ মরণের পরও অব্যক্ত; সেখানে প্রলাপ কিসের?

আশ্চর্য্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেন
মাশ্চর্য বদ্বদতি তথৈব চান্যঃ।
আশ্চর্য্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি
শ্রুতাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ || ২৯ ||

এই আত্মাকে কেহ আশ্চর্য্যবৎ দেখেন; কেহ ইহাকে আশ্চর্য্যবৎ বর্ণনা করেন; কেহ ইহার সম্বন্ধে আশ্চর্য্যবৎ হইয়া শ্রবণ করিয়া থাকেন। আবার দেখিয়া, শুনিয়া বা বলিয়াও কেহ ইহাকে জানিতে পারেন না। কারণ, আত্মা অত্যন্ত দুর্বোধ্য 

দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্ব্বস্য ভারত।
তস্মাৎ সর্ব্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি || ৩০ ||

হে ভারত! সর্বগতত্বহেতু স্থাবর-জঙ্গমাদি সর্বভূতে স্থিত থাকিয়াও এই দেহী বা আত্মা সর্বদা সর্বাবস্থাতেই নিত্য ও নিরবয়বত্ব নিত্যতাহেতু অবধ্য। অতএব সকল প্রাণিসমূহের দেহ বধ্যমান হলেও যেহেতু দেহী বধ্যমান নহে সেইহেতু ভীষ্মাদি সকলের জন্য তোমার শোক করা উচিত নহে।

স্বধর্ম্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে || ৩১ ||

পরমার্থতত্ত্বের দিক হইতে শোক বা মোহ হইতে পারে না, কিন্তু কেবল পরমার্থতত্ত্বরূপ উপনিষদাদি মোক্ষশাস্ত্রের দিক থেকে নয়; মন্বাদি ধর্ম্মশাস্ত্রের দিক হইতে স্বধর্ম্ম অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম্ম হইল যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া বিকম্পিত অর্থাৎ বিচলিত হইও না। এই যুদ্ধ পৃথিবী জয়দ্বারা ধর্ম্মার্থ ও প্রজারক্ষণার্থ; অতএব এই ধর্ম্মযুদ্ধের অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে অন্য কোন শ্রেয় বিদ্যমান নাই।

যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্।
সুখিনঃ ক্ষত্রিয়া পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্ || ৩২ ||
অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি।
ততঃ স্বধর্ম্ম্যং কীর্ত্তিঞ্চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি || ৩৩ ||

উদ্ঘাটিত স্বর্গদ্বারস্বরূপ ঈদৃশ যুদ্ধ, অপ্রার্থিতভাবে যাহা উপস্থিত হইয়াছে, সুখী ক্ষত্রিয়েরাই ইহা লাভ করিয়া থাকে। এইরূপ কর্তব্যতা প্রাপ্ত হইয়াও যদি তুমি এই ধর্ম্ম্য বিহিত সংগ্রাম অর্থাৎ যুদ্ধ না কর, তবে স্বধর্ম্ম এবং কীর্ত্তি অর্থাৎ মহাদেবাদি দর্শন ও পাশুপাতাস্ত্র লাভ ইত্যাদি পরিত্যাগে পাপযুক্ত হইবে।

অকীর্ত্তিঞ্চাপি ভূতানি কথয়িষ্যন্তি তেহব্যয়াম্।
সম্ভাবিতস্য চাকীর্ত্তির্মরণাদতিরিচ্যতে || ৩৪ ||
ভয়াদ্রণাদুপরতং মংস্যন্তে ত্বাং মহারথাঃ।
যেষাঞ্চ ত্বং বহুমতো ভূত্বা যাস্যসি লাঘবম্ || ৩৫ ||

সাধারণ লোকেরা তোমার দীর্ঘকাল ধরিয়া অকীর্ত্তি রটনা করিবে। ধর্মাত্মা শূর ইত্যাদি গুণসমূহের দ্বারা সম্যক্ রূপে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির অকীর্ত্তি অপেক্ষা মরণ ভাল। দুর্যোধনাদি মহারথগণ মনে করিবে, কৃপাহেতু নয় বরংচ তুমি শূরবীর কর্ণাদির ভয়ে রণ হইতে নিবৃত্ত হইলে। যাঁহাদের নিকট তুমি বহুমান অর্থাৎ বহগুণসম্পন্ন ছিলে, তাঁহাদিগের নিকট তুমি লাঘব অর্থাৎ লঘুভাব প্রাপ্ত হইবে।

অবাচ্যবাদাংশ্চ বহূন্ বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ।
নিন্দন্তস্তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম্ || ৩৬ ||
হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্।
তস্মাদুক্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ || ৩৭ ||

তোমার অহিতকারী শত্রুরা তোমার নিবাতকবচাদি যুদ্ধ নিমিত্ত সামর্থ্যের নিন্দা করিবে ও বহু অবাচ্য কথা বলিবে। তাহা অপেক্ষা অধিক দুঃখতর আর কি আছে? হত হইলে স্বর্গ পাইবে আর কর্ণাদি শূরবীরদিগকে জয় করিলে মহী অর্থাৎ পৃথিবী ভোগ করিবে। অতএব হে কৌন্তেয়! যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উত্থান কর।

সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ।
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি || ৩৮ ||

ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধ স্বধর্ম, ইহা মানিয়া যাহারা যুদ্ধ করেন তাহাদের জন্য শ্রীভগবানের উপদেশ হইল- অতএব সুখ-দুঃখ অর্থাৎ রাগদ্বেষ না করিয়া লাভালাভ, জয়পরাজয় সমতুল্য জ্ঞান করিয়া যুদ্ধার্থ নিযুক্ত হও। এই বুদ্ধিতে যুদ্ধ করিলে পাপযুক্ত হইবে না।

(‘স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য’ শ্লোক হইতে ‘সুখদুঃখে সমে’ ইত্যাদি শ্লোক দ্বারা শোক আর মোহ দূর করার জন্য লৌকিক ন্যায় বলা হইয়াছে, অর্থাৎ যাহারা আত্মার বিভূত্ব না বুঝিয়া, দেহাতিরিক্ত কোন আত্মা আছে; যাহা কর্মানুযায়ী স্বর্গ বা নরকে যায়-এইরূপ যাহাদের বিশ্বাস তাহাদের উদ্দেশ্যে ধর্মমীমাংসার উপদেশরূপ তর্ক ন্যায় দেখানো হইয়াছে। কিন্তু ভগবদ্গীতার প্রকৃত তাৎপর্য্য এতে নহে। পরমার্থদর্শনই ইহার প্রকৃত তাৎপর্য্য। অতঃপর শাস্ত্রের যে বিষয় কর্ম ও জ্ঞান- ইহাদের বিভাগ দেখানোর জন্য পরবর্তী ‘এষা তেভিহিতা’ এই শ্লোকদ্বারা ঐ পরমার্থদর্শন বিষয়ের উপসংহার করা হইতেছে)-

এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধির্যোগ ত্বিমাং শৃণু।
বুদ্ধ্যা যুক্তো যয়া পার্থ কর্ম্মবন্ধং প্রহাস্যসি || ৩৯ ||

তোমাকে সাংখ্য অর্থাৎ এই সাক্ষাৎ শোকমোহাদি সংসারহেতুরূপ যে দোষ তাহার নিবৃত্তির কারণ ‘সাংখ্য’ নামক পরমার্থবস্তু বিবেক বিষয়ক বুদ্ধি বা জ্ঞান কথিত হইল। এক্ষণে (কর্ম্ম)যোগ অর্থাৎ জ্ঞাননিষ্ঠাযোগ্যতা প্রাপ্তির উপায়ে অনাসক্তি দ্বারা ঈশ্বরারাধনার্থে যে কর্মযোগ বা কর্মানুষ্ঠান; তদ্বিষয়ে এবং এর পরবর্তী অবস্থারূপ যে সমাধিযোগ বা যমনিয়মাদিলক্ষণ অন্তরঙ্গ যে কর্মযোগ সেই বিষয়ে বলিব, তাহা শ্রবণ কর। তদ্ যোগবিষয়ক বুদ্ধি দ্বারা যুক্ত হইলে, হে পার্থ! ঈশ্বরপ্রসাদ নিমিত্ত জ্ঞানপ্রাপ্তিহেতু কর্ম্মবন্ধ অর্থাৎ ধর্ম্মাধর্মরূপ কর্ম্মের যে বন্ধন তাহা হইতে মুক্ত হইবে।

নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে।
স্বল্পমপ্যস্য ধর্ম্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ || ৪০ ||

এই মোক্ষমার্গ (কর্ম্মযোগে) কৃষি প্রভৃতি কার্য্যের ন্যায় অভিক্রম অর্থাৎ প্রারম্ভের নাশ নাই কারণ যোগ বিষয়ে প্রারম্ভ ফল অনিশ্চিত নহে; প্রত্যবায় অর্থাৎ চিকিৎসাদির ন্যায় বিপরীত ফল নাই; এ ধর্ম্মের স্বল্পতেই জন্মমরণরূপ সংসারের মহাভয় হইতে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরেকেহ কুরুনন্দন।
বহুশাখা হ্যনন্তাশ্চ বুদ্ধয়োহব্যবসায়িনাম্ || ৪১ ||

হে কুরুনন্দন! এই শ্রেয়মার্গ কর্ম্মযোগে ব্যবসায়াত্মিকা অর্থাৎ নিশ্চয়স্বভাবের বুদ্ধি একনিষ্ঠ হইয়া থাকে; যাহা শাখাভেদযুক্ত অপর যে ইতরবৎ বিপরীতবুদ্ধি তাহার বাধাস্বরূপ। যেহেতু অব্যবসায়িগণের অর্থাৎ প্রমাণজনিত একনিষ্ঠ বিবেকবুদ্ধি রহিতগণের বুদ্ধি বহুশাখাযুক্ত বা বহুভেদযুক্ত এবং প্রতিশাখা ভেদে বুদ্ধিরা অনন্ত সংসারবিষয়মুখী হইয়া থাকে। এই প্রমাণজনিত একাগ্র বিবেকবুদ্ধি নিমিত্তবশতঃ অনন্তভেদবুদ্ধির অন্ত হইলে সেই সংসারও অন্ত হয়।

 যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ।
বেদবাদরতাঃ পার্থ নান্যদস্তীতিবাদিনঃ || ৪২ ||
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্ম্মফলপ্রদাম্।
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্য্যগতিং প্রতি || ৪৩ ||
ভোগৈশ্বর্য্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে || ৪৪ ||

হে পার্থ! অব্যবসায়ি অল্পমেধা অবিবেকিগণ এই পুষ্পিত বৃক্ষের ন্যায় শোভমান অর্থাৎ শ্রবণরমণীয় বাক্যসকল বলিয়া থাকেন, যাহারা বেদবাদরত অর্থাৎ যাহারা বহুঅর্থবাদ ফলসাধন প্রকাশক বেদের কর্মাঙ্গ অর্থবাক্যে রত, “স্বর্গপ্রাপ্ত্যাদি ফলসাধনরূপ কর্ম্মসকল ভিন্ন আর কিছুই নাইএইরূপ মতবাদীরা, যাহারা জন্মকর্ম্মফলপ্রদ অর্থাৎ জন্মই কর্ম্মের ফল, যাহা তাহা প্রদান করে, তাহা জন্মকর্ম্মফলপ্রদ এবং ভোগৈশ্বর্য্যের সাধনভূত ক্রিয়াবিশেষবহুল বাক্য বলিয়া থাকে, তাহারা কামাত্মা অর্থাৎ কামস্বভাব, স্বর্গপর অর্থাৎ তাহাদের নিকট স্বর্গই পরমপুরুষার্থ, ভোগৈশ্বর্য্যে আসক্ত এবং সেই ক্রিয়াবিশেষবহুল বাক্যের দ্বারা যাহাদের চিত্ত অপহৃত, তাহাদের সমাধিতে সাংখ্য বা কর্মযোগের উপযোগী যে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি তাহা বিহিত অর্থাৎ উৎপন্ন হয় না।

(উল্লেখ্য অনন্তজ্ঞানী শ্রীকৃষ্ণের ঈদৃশ উক্তি বেদের নিন্দা নহে, বৈদিক কর্ম্মবাদী পূর্বমীমাংসকদিগের নিন্দা। যাহারা বলে, বেদোক্ত অশ্বমেধাদি কর্ম্মই ধর্ম্ম, কেবল তাহাই অনুষ্ঠিতব্য ও আচরণীয়, তাহাদেরই নিন্দা। কিন্তু বেদে যে কেবল অশ্বমেধাদি যজ্ঞেরই বিধি আছে, আর কিছু নাই, এমন নহে। বেদের জ্ঞানকান্ড উপনিষদে যে অদ্বৈত ব্রহ্মজ্ঞান আছে, প্রস্থানত্রয়ীর অন্যতম ভগবদ্গীতা সেই বেদার্থ জ্ঞানের সারকথা।)

ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জ্জুন।
নির্দ্বন্দ্বো নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান্ || ৪৫ ||

হে স্বধর্মানুষ্ঠানকারী অর্জ্জুন! যাহারা এইরূপ বিবেকবুদ্ধিরহিত সেই কামাত্মাদের বেদ (কর্ম্মকান্ড) ত্রৈগুণ্যবিষয়ক অর্থাৎ ত্রিগুণাত্মক সংসাররূপ বিষয় যাহাদের প্রকাশ্য তাহারাই হইল বেদ (কর্ম্মকান্ড); তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য অর্থাৎ নিষ্কাম হও। তুমি নির্দ্বন্দ্ব অর্থাৎ সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্বরহিত হও, নিত্যসত্ত্বস্থ অর্থাৎ সদা সত্ত্বগুণাশ্রিত হও, অপ্রাপ্তবস্তুর প্রাপ্তি হইল যোগ এবং প্রাপ্তবস্তুর রক্ষণ হইল ক্ষেম অতএব তুমি যোগক্ষেমরহিত হও ও আত্মবান অর্থাৎ অপ্রমত্ত হও। সমস্ত বেদোক্ত কর্ম্মে যে সকল অনন্তফলের কথা আছে সে সকল যদি লোকে প্রতীক্ষা না করে, তাহা হইলে সেই সব কর্ম্ম কি হেতুতে ঈশ্বরের জন্য অনুষ্ঠান করা যাইতে পারে তাহা শ্রবণ কর-

(শাঙ্করভাষ্যের প্রাচীন টীকাকার আনন্দগিরি লিখিলেন, “বেদশব্দেনাত্র কর্ম্মকাণ্ডমেব গৃহ্যতে”। অর্থাৎ এখানে বেদ শব্দের অর্থে কর্ম্মকান্ড বুঝিতে হইবে। শাঙ্করভাষ্যের আরেক প্রখ্যাত টীকাকার মধুসূদন সরস্বতীও একই কথা বলিয়াছেন- “তাদৃশা বেদাঃ কর্মকান্ডাত্মকাঃ”)

যাবানর্থ উদপানে সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে।
তাবান্ সর্ব্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ || ৪৬ ||

যেইরূপ কূপ,তড়গাদি ক্ষুদ্র জলাশয়ে যাবৎ পরিমাণ স্নানপানাদিরূপ অর্থ,ফল বা প্রয়োজন লাভ হয়, সে সমস্ত অর্থ সর্বত্র জলপ্লাবনের জলরাশিতে তাবৎপরিমাণই সম্পন্ন হয় অর্থাৎ উহাতে উহার অন্তর্ভাব হয়, সেইরূপ বেদোক্ত কর্মকান্ডে যে অর্থ বা কর্মফল সাধিত হয়;  ব্রাহ্মণ অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞ সন্ন্যাসীর পরমার্থতত্ত্বরূপ যে বিজ্ঞানফল তাহাতে তাবৎ পরিমাণই সম্পন্ন হয় অর্থাৎ বেদোক্ত কর্মসকল সর্বত্র জলপ্লাবন অর্থস্থানীয় ব্রহ্মজ্ঞানে অন্তঃপ্রবিষ্ট হয়। এই ভগবদ্গীতাতেই অন্যত্র বলা হইয়াছে সৰ্ব্বকৰ্ম্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে জ্ঞানেতেই সর্বকর্ম্মের পরিসমাপ্তি হয়। সুতরাং জ্ঞাননিষ্ঠায় অধিকার প্রাপ্তির পূর্বে, কর্ম্মে অধিকৃতগণ কর্তৃক বেদোক্ত কর্মসকল কূপতড়গাদি অর্থস্থানীয় হইলেও উহা কর্ত্তব্য।

(ভাষ্যে শঙ্করাচার্য্য বেদের কর্ম্মকান্ড উপেক্ষা করেন নি বরংচ জ্ঞাননিষ্ঠা অধিকার প্রাপ্তির পূর্বে কর্ম্মে অধিকারীদের বেদোক্ত কর্মসকল কর্ত্তব্য বলিয়াছেন।)

কর্ম্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্ম্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্ম্মণি || ৪৭ ||

কর্ম্মে তোমার অধিকার, জ্ঞান নিষ্ঠাতে নহে কিন্তু ফলে কদাচ অধিকার না থাকুক অর্থাৎ কর্ম্মফলতৃষ্ণা কোন অবস্থাতেই না হউক। যদি কর্ম্মফলে তোমার তৃষ্ণা থাকে তা হইলে কর্ম্মফল প্রাপ্তির হেতু হইবে, এইজন্য তুমি কর্ম্মফলহেতু হইও না; কারণ যখন মনুষ্য কর্ম্মফলতৃষ্ণায় প্রেরিত হইয়া কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়  তখন সে কর্ম্মফলরূপ পুনর্জন্মের হেতু হইয়া যায়৷ যদি কর্মফল ইপ্সিতই না হয় তাহইলে দুঃখরূপ কর্ম্মে কি আবশ্যকতা? এই প্রকার অকর্ম্মে বা আলস্যেও যেন তোমার প্রীতি না হয়।

যোগস্থঃ কুরু কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে || ৪৮ ||

যদি কর্মফলে প্রেরিত হইয়া কর্ম্ম কর্ত্তব্য না হইয়া থাকে তাহলে কি প্রকারে কর্ত্তব্য? তাহা শ্রবণ কর-
হে ধনঞ্জয়! যোগস্থ হইয়া কেবল ঈশ্বরার্থ কর্ম্ম করিবে, কিন্তু ‘ঈশ্বর তজ্জন্য আমার প্রতি তুষ্ট হোন’, এইরূপ আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া কর্ম্ম করিবে। ফলতৃষ্ণাশূন্য পুরুষের কর্ম্ম করার পর সত্ত্বশুদ্ধিজাত জ্ঞানপ্রাপ্তিরূপ যে সিদ্ধি ও তার বিপরীত যে অসিদ্ধি; এই উভয়কে সম অর্থাৎ তুল্য জ্ঞান করিয়া কর্ম্ম কর। এই যোগ কি, যাহাতে স্থিত হইয়া ভগবান ‘কর্ম্ম কর’ বলিয়াছেন? ইহা এইরূপ- সিদ্ধি এবং অসিদ্ধিতে সমত্বকেই যোগ বলে।

দূরেণ হ্যবরং কর্ম বুদ্ধিযোগাদ্ধনঞ্জয়।
বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণাঃ ফলহেতবঃ৷৷ ৪৯৷৷

হে ধনঞ্জয়, প্রকৃত লক্ষ্য হইতে অতিদুরত্ব হেতু ফলার্থীদিগের দ্বারা ক্রিয়মান সকামকর্ম সমত্ববুদ্ধিযুক্ত নিষ্কামকর্ম অপেক্ষা নিতান্ত নিকৃষ্ট কেননা সকাম কর্ম্ম জন্ম মরণাদির হেতুসেইজন্য তুমি কর্ম্মযোগবিষয়াবুদ্ধি বা তৎ-পরিপাকজাত সাংখ্যবুদ্ধি শরণ বা আশ্রয় গ্রহণ কর অর্থাৎ শ্রুতি অনুসারে যাহা অভয় প্রাপ্তির কারণ সেই পরমার্থজ্ঞানের অন্বেষণ বা প্রার্থনা কর; কারণ ফলাকাঙ্ক্ষীরা অতি কৃপণ তথা দীন।

বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে৷
তস্মাদ্যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্৷৷ ৫০৷

সমত্ববুদ্ধিযুক্ত হইয়া স্বধর্ম অনুষ্ঠান করিলে যে ফলপ্রাপ্তি হয় তাহা শ্রবণ কর- যিনি সমত্ববিষয়ক বুদ্ধিযুক্ত, ইহলোকে তিনি সুকৃত দুষ্কৃত অর্থাৎ পূণ্য ও পাপ উভয়ই সত্ত্বশুদ্ধিজ্ঞান প্রাপ্তি দ্বারা পরিত্যাগ করেন। তজ্জন্য তুমি সমত্ব বুদ্ধিযুক্ত যোগের অনুষ্ঠান কর। যেহেতু যোগ হইতেছে কর্ম্মের কৌশল। স্বধর্ম্মাখ্য কর্ম্মে যিনি বর্ত্তমান তাহার ঈশ্বরার্পিত চিত্ততাহেতু সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে সমত্ববুদ্ধি তাহাই কৌশল অর্থাৎ কুশলভাব। এই কৌশল হইতেছে- যাহা বন্ধস্বভাব কর্ম্ম সকলকে সমত্ববুদ্ধি দ্বারা তাহাদের স্বভাব হইতে নিবর্তিত করে; সেইহেতু তুমি সমত্ববুদ্ধিযুক্ত হও।

কর্ম্মজং বুদ্ধিযুক্তা হি ফলং ত্যক্ত্বা মনীষিণঃ।
জন্মবন্ধবিনির্ম্মুক্তাঃ পদং গচ্ছন্ত্যনাময়ম্ || ৫১ ||

সমত্ববুদ্ধিযুক্ত মনীষী অর্থাৎ জ্ঞানিগণ ইষ্টানিষ্ট দেহপ্রাপ্তিরূপ কর্ম্ম হইতে জাত যে কর্ম্মজ ফল; তাহা ত্যাগ করিয়া, জীবন্ত অবস্থাতেই জন্মরূপ যে বন্ধন তাহা হইতে বিমুক্ত হইয়া শ্রীবিষ্ণুর মোক্ষরূপ পরমপদ প্রাপ্ত হন; যাহা অনাময় অর্থাৎ সর্ব্ব উপদ্রবরহিত এইরূপ অর্থ।

যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি।
তদা গন্তাসি নির্ব্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ || ৫২ ||

কর্ম্মযোগানুষ্ঠানজনিত সত্ত্বশুদ্ধি হইতে উৎপন্ন বুদ্ধি কখন প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহা বলছি শ্রবণ কর- যেইসময় তোমার বুদ্ধি মোহকালুষ্য অর্থাৎ যদ্দারা আত্মানাত্ম বিবেকবোধ কলুষিত হইয়া বিষয়ের প্রতি প্রবর্ত্তিত হয়; সেই অবিবেকরূপ মোহাত্মক কালুষ্য অতিক্রম করিবে অর্থাৎ যখন তোমার বুদ্ধি শুদ্ধিভাব প্রাপ্ত হইবে, সেইসময় তুমি নির্ব্বেদ অর্থাৎ বৈরাগ্য প্রাপ্ত হইবে। তখন শ্রোতব্য ও শ্রুত কর্ম্মসকল তোমার নিকট নিষ্ফল প্রতিপন্ন হইবে

শ্রুতিবিপ্রতিপন্না তে যদা স্থাস্যতি নিশ্চলা।
সমাধাবচলা বুদ্ধিস্তদা যোগমবাপ্‌স্যসি || ৫৩ ||

যদি তুমি জিজ্ঞেস কর যে মোহরূপ কালুষ্য অতিক্রমের দ্বারা লব্ধ আত্মবিবেকজ প্রজ্ঞা প্রাপ্ত হইয়া আমি কবে কর্ম্মযোগজ ফলরূপ পরমার্থযোগ প্রাপ্ত হইব? তবে তাহা শ্রবণ কর- তোমার শ্রুতিবিপ্রতিপন্না অর্থাৎ অনেক সাধ্য (স্বর্গাদি), সাধন (যজ্ঞাদি) ও সম্বন্ধ (উপকারাদি) প্রকাশক কর্ম্মকান্ডীয় প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি-লক্ষণ শ্রুতি শ্রবণের দ্বারা নানাপ্রতিপন্না অর্থাৎ বিক্ষিপ্তা তোমার বুদ্ধি যখন সমাধিতে অর্থাৎ আত্মাতে নিশ্চলা অর্থাৎ অচলা হইয়া থাকিবে, তখন তুমি যোগ অর্থাৎ বিবেক প্রজ্ঞারূপ নির্বিকল্প সমাধি প্রাপ্ত হইবে।

অর্জ্জুন উবাচ।
স্থিতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা সমাধিস্থস্য কেশব।
স্থিতধীঃ কিং প্রভাষেত কিমাসীত ব্রজেত কিম্ || ৫৪ ||

যাহারা সমাধিজাত প্রজ্ঞা লাভ করিয়াছেন তাঁহাদের লক্ষণ জানিবার ইচ্ছায় অর্জ্জুন বলিলেন-
হে কেশব! যিনি সমাধিস্থ হইয়া স্থিতপ্রজ্ঞ অর্থাৎ অহম্ অস্মি পরং ব্রহ্মএই প্রজ্ঞা হইয়াছে যাহার, তাঁহার কি লক্ষণ? স্থিতধী ব্যক্তির সম্বন্ধে অপর লোকের কিরূপ ভাষণ, স্বয়ং স্থিতপ্রজ্ঞের কিরূপ প্রভাষণ, তাহার আসন এবং ব্রজন অর্থাৎ গতিবিধিই বা কিরূপ?

শ্রীভগবানুবাচ।
প্রজহাতি যদা কামান্ সর্ব্বান্ পার্থ মনোগতান্।
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে || ৫৫ ||

অর্জ্জুনের প্রশ্নোত্তরে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির কৃতার্থ লক্ষণ এবং যত্নসাধ্য সাধন বর্ণনা প্রসঙ্গে
 শ্রীভগবান বলিলেন-
হে পার্থ, যিনি সমস্ত মনোগত অর্থাৎ হৃদয়ে প্রবিষ্ট পুত্রবিত্ত ও স্বর্গলোকাদি কামনা বা ইচ্ছাভেদ সকল প্রকৃষ্টরূপে পরিত্যাগ করেন, যিনি বাহ্যলাভে নিরপেক্ষ ও পরমার্থদর্শন অমৃতরস লাভহেতু আত্মাতেই অর্থাৎ প্রত্যগাত্মস্বরূপেই তুষ্ট এবং অন্য অনাত্মবস্তু হইতে কি প্রয়োজন এইরূপ বুদ্ধিবিশিষ্ট যিনি; যাঁহার আত্মানাত্ম বিবেকজাত প্রজ্ঞা হইয়াছে, সেই আত্মারাম আত্মক্রীড় সন্ন্যাসীই স্থিতপ্রজ্ঞ অর্থাৎ বিদ্বান বলিয়া উক্ত হন 

দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্ম্মুনিরুচ্যতে || ৫৬ ||

তাছাড়া আধ্যাত্মিকাদি ত্রিবিধ দুঃখপ্রাপ্তিতে যিনি অনুদ্বিগ্নমনা অর্থাৎ উদ্বিগ্ন নন, সুখপ্রাপ্তিতে যিনি বিগতস্পৃহ অর্থাৎ শুকনো কাঠ ইত্যাদি ইন্ধন প্রদানে যেইরূপ অগ্নি বৃদ্ধি পায় সেইরূপ সুখের সহিত যাহার স্পৃহা বা তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায় না তিনিই বিগতস্পৃহ যাঁহার অনুরাগ, ভয় ও ক্রোধ আর নাই, তাঁহাকে স্থিতধী মুনি বা সন্ন্যাসী বলা হয়।

(উল্লেখ্য মহর্ষি কপিলের সাংখ্য দর্শনমূলক গ্রন্থ ঈশ্বরকৃষ্ণের ‘সাংখ্যকারিকা-১’ “দুঃখত্রয়াভিঘাতাজ্জিজ্ঞাসা…” অনুসারে দুঃখ ত্রিবিধ। সাংখ্যকারিকার গৌড়পাদ ভাষ্যানুসারে দুঃখত্রয় হইল,—আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখ দ্বিবিধ—শারীরিক অর্থাৎ বাতপিত্তশ্লেষ্মাজ্বরাদি ইত্যাদি রোগজনিত ও মানসিক অর্থাৎ প্রিয়বিয়োগাদি ইত্যাদি জাত দুঃখ। আধিভৌতিক দুঃখ মনুষ্য, পশু, পক্ষী ও স্থাবরাদি ভূত পদার্থ হইতে উৎপন্ন হয়। আধিদৈবিক দুঃখ দৈব প্রকোপে অথবা অতি শীতোষ্ণবর্ষাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উৎপন্ন হয়।)

যঃ সর্ব্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্।
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা || ৫৭ ||

যে মুনি দেহে বা জীবনে সর্ব্বত্রই অর্থাৎ সর্ব্ববিষয়ে অভিস্নেহ তথা আসক্তিবর্জ্জিত এবং সেই সেই বিষয়ের শুভপ্রাপ্তিতে অভিনন্দিত বা অশুভপ্রাপ্তিতে দ্বেষযুক্ত হন না, এইরূপ হর্ষবিষাদবর্জ্জিত তাঁহার বিবেকজাত প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে

যদা সংহরতে চায়ং কূর্ম্মোহঙ্গানীব সর্ব্বশঃ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠাতা || ৫৮ ||

 কূর্ম্ম (কচ্ছপ) যেমন সকল বস্তু হইতে ভয়হেতু আপনার অঙ্গসকল সংহরণ করিয়া লয় অর্থাৎ গুটাইয়া লয়, তেমনি এই জ্ঞাননিষ্ঠায় প্রবৃত্ত যতিরা যখন ইন্দ্রিয়সকল ইন্দ্রিয়দের অর্থ হইতে তথা রূপরসাদি সর্ব্ববিষয় হইতে উপসংহরণ বা প্রত্যাহার করেন, তখন সেই জ্ঞাননিষ্ঠদের প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে বুঝিতে হইবে।

বিষয়া বিনিবর্ত্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ।
রসবর্জ্জং রসোহপ্যস্য পরং দৃষ্ট্বা নিবর্ত্ততে || ৫৯ ||

আতুর ব্যাধিগ্রস্ত লোকদের ইন্দ্রিয়সকলও তো কূর্মাঙ্গের মত বিষয় গ্রহণ না করিয়া উপসংহৃত হয়, কিন্তু তা বলিয়া তাহাদের তদ্ বিষয়ক রাগ বা আসক্তি তো সংহৃত না? তাহলে সেই জ্ঞানী কি প্রকারে ইন্দ্রিয় সকল বিষয় হইতে উপসংহার করিয়া থাকেন তাহা বলা হইতেছে-
নিরাহার দেহীর অর্থাৎ যাঁহারা বিষয় আহরণ করে না এইরূপ কষ্টে তপস্যায় স্থিত দেহীর ইন্দ্রিয়াদির বিষয় নিবৃত্ত হয়, কিন্তু তৎপ্রতি রস তথা অনুরাগ যায় না। কেবল পরমার্থতত্ত্ব ব্রহ্মদর্শন করিয়া অহম্ এব তৎএইরূপ উপলব্ধিতে সেই রস অর্থাৎ রঞ্জনরূপ সূক্ষ্ম আসক্তি নিবৃত্ত তথা নির্বীজ বিষয়বিজ্ঞান সম্পন্ন হইয়া থাকে।

যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ।
ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ || ৬০ ||

যেইহেতু সম্যগদর্শন না হইলে বিষয়রস উচ্ছেদ হয় না, সেইহেতু সম্যগদর্শনাত্মিকা প্রজ্ঞায় পুনঃ পুনঃ অভ্যাসের দ্বারা স্থৈর্য্য কর্তব্য। সেই সম্যগদর্শনরূপ প্রজ্ঞাতে স্থৈর্য্য ইচ্ছুক জ্ঞানীদের পূর্ব্বে ইন্দ্রিয়সকল স্ববশে স্থাপন করা উচিত কিন্তু- হে কৌন্তেয়! প্রমথনশীল অর্থাৎ চিত্তবিক্ষেপকারী ইন্দ্রিয়গণ প্রযত্নশীল মেধাবী কিন্তু বিষয়াভিমুখী পুরুষের মনকেও চিত্তাকুলপূর্ব্বক প্রসভ অর্থাৎ বলপূর্ব্বক বিষয়াভিমুখে হরণ করিয়া থাকে

তানি সর্ব্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ।
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা || ৬১ ||

যেহেতু ইন্দ্রিয়সকল প্রবল, সেইজন্য সেই সকল ইন্দ্রিয় সংযম করিয়া যুক্ত অর্থাৎ সমাহিত হইয়া; মৎপর অর্থাৎ আমি বাসুদেব সর্ব্বপ্রত্যাগাত্মা যাঁহার নিকট পর তথা সর্ব্বোৎকৃষ্ট; 'ন অন্যোহং তস্মাত্'  এইরূপ আত্মস্থ হইয়া যিনি অবস্থান করেন, যাঁহার ইন্দ্রিয়সকল বশীভূত হইয়াছে, অভ্যাসের বলে তাঁহার প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।

ধ্যায়তো বিষয়বান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষুপজায়তে।
সঙ্গাৎ সংজায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে || ৬২ ||
ক্রোধাদ্ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতি ভ্রংশাদ্বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি || ৬৩ ||

ইদানীং পরাভবোন্মুখ ব্যক্তিগণকে সকল অনর্থের মূল প্রসঙ্গে বলা হইতেছে- ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে ধ্যান অর্থাৎ চিন্তা করিতে করিতে সেই সব বিষয়ে পুরুষের আসক্তি উপজাত হয়। আসক্তি হইতে কাম বা তৃষ্ণার উৎপত্তি হয়, কোন কারণে ঐ ভোগতৃষ্ণা প্রতিহত হইলে কাম হইতে ক্রোধ অভিজাত হয়। ক্রোধ হইতে সম্মোহ অর্থাৎ কার্য্য ও অকার্য্য বিষয়ে অবিবেক উপস্থিত হয়, সম্মোহ হইতে স্মৃতিভ্রংশ অর্থাৎ শাস্ত্রাচার্য্য উপদেশজনিত সংস্কারের স্মৃতিবিভ্রম হয়, স্মৃতিভ্রংশ হইতে বুদ্ধিনাশ, বুদ্ধিনাশ হইলে ঐ ব্যক্তি প্রণষ্ট হয় অর্থাৎ পুরুষার্থের অযোগ্য হইয়া পড়ে।

রাগদ্বেষবিযুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রয়ৈশহচরন্।
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি || ৬৪ ||

বিষয়চিন্তা সর্ব অনর্থের মূল বলা হইয়াছে, মোক্ষের কারণ প্রসঙ্গে বলা হইতেছে- যিনি বিধেয়াত্মা অর্থাৎ ইচ্ছানুসারে বিধেয় তথা বশ্যাত্মা যাঁহার, তিনি রাগ ও দ্বেষজনিত স্বাভাবিক ইন্দ্রিয়প্রবৃত্তি হইতে মুক্ত এবং আত্মবশীভূত ইন্দ্রিয়গণের দ্বারা অবর্জ্জনীয় অর্থাৎ দেহস্থিতিহেতু অপরিহার্য্য বিষয়সকলে বিচরণ অর্থাৎ উপভোগ করিয়াও প্রসাদ অর্থাৎ প্রসন্নতা প্রাপ্ত হন

প্রসাদে সর্ব্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে।
প্রসন্নচেতসো হ্যাশু বুদ্ধিঃ পর্য্যবতিষ্ঠতে || ৬৫ ||

সেই প্রসাদে এই যতির  সকল দুঃখের হানি অর্থাৎ বিনাশ জন্মে। যিনি প্রসন্নচিত্ত অর্থাৎ সুস্থ অন্তঃকরণ যাঁহার, আশু তথা শীঘ্রই তাঁহার বুদ্ধি স্থির হয় অর্থাৎ আকাশের মত সর্ব্বব্যাপীরূপে আত্মস্বরূপে নিশ্চল হইয়া থাকে।

নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা।
ন চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম্ || ৬৬ ||

সেই প্রসন্নচিত্ততার স্তব করা হইতেছে এইভাবে- অযুক্তের অর্থাৎ অসমাহিত অন্তঃকরণ ব্যক্তির আত্মস্বরূপবিষয়ক বুদ্ধি নাই। অযুক্তের ভাবনা অর্থাৎ আত্মজ্ঞানাভিনেশ নাই। যাহার ভাবনা নাই, তাহার শান্তি নাই; যাহার শান্তি নাই, তাহার সুখ কোথায়?

ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যন্মনোহনুবিধীয়তে।
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিবাম্ভসি || ৬৭ ||

অযুক্তের কেন বুদ্ধি নাই তাই বলা হইতেছে- ঘূর্ণায়মান বায়ু যেমন জলস্থিত নৌকাকে উন্মার্গগামী করে, সেইরূপ স্ব স্ব বিষয়ে প্রবর্তমান ইন্দ্রিয়গণের যেটিকে মন অনুসরণ করে, সেই ইন্দ্রিয়টিই অসংযত ব্যক্তির প্রজ্ঞা অর্থাৎ আত্মানাত্মবিবেকবুদ্ধি হরণ করে তাহার মনকে বিষয়াভিমুখী করে

তস্মাদ্যস্য মহাবাহো নিগৃহীতানি সর্ব্বশঃ
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠাতা || ৬৮ ||

 যেইহেতু ইন্দ্রিয়গণের প্রবৃত্তিতে দোষ উপপাদিত হইয়াছে- সেইহেতু হে মহাবাহো, যাঁহার সর্বপ্রকারে মানসাদি ভেদের সহিত ইন্দ্রিয়গণ ইন্দ্রিয়ার্থ শব্দাদি বিষয় হইতে নিগৃহীত অর্থাৎ নিবৃত্ত হইয়াছে, তাঁহার প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে 

যা নিশা সর্ব্বভূতানাং তস্যাং জাগর্ত্তি সংযমী
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনোঃ || ৬৯ ||

সর্বভূতের পক্ষে যাহা তমঃস্বভাবহেতু নিশা বা রাত্রিস্বরূপ, সেই পরমার্থতত্ত্বলক্ষণা প্রজ্ঞাতে, অজ্ঞান নিদ্রা হইতে প্রবুদ্ধ সংযমী জিতেন্দ্রিয় যোগী জাগ্রত থাকেন। আর, যে অবিদ্যারূপ নিশাতে প্রসুপ্ত ভূতগণ জাগ্রত থাকে, পরমার্থদর্শী মুনির পক্ষে সেই রাত্রি অবিদ্যাস্বরূপ। যেমন সূর্য উদিত হইলে শর্বরীর তমঃ প্রনষ্ট হয়, সেইরূপ বিদ্যা উদিত হইলে অবিদ্যা পলায়ন করে।

আপূর্য্যমাণচলপ্রতিষ্ঠং
সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্বৎ
তদ্বৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্ব্বে
শান্তিমাপ্নোতি কামকামী || ৭০ ||

যেমন জলরাশি পরিপূর্যমাণ সমুদ্রে প্রবেশ করিলেও উহা অচলপ্রতিষ্ঠ অর্থাৎ স্বীয় বেলাভূমি অতিক্রম না করিয়া অবিক্রিয় থাকে, সেইরূপ কামনাসকল অর্থাৎ বিষয় সন্নিধি প্রাপ্তিতে সমস্ত ইচ্ছাবিশেষ যে পুরুষে প্রবেশ করিয়া আত্মাতে প্রলয়প্রাপ্ত তথা লীন হয়, তাহারা আর তাঁহাকে বশীভূত করিতে পারে না, সেই পুরুষই শান্তি অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করেন কিন্তু যিনি বিষয় কামনা করেন, তিনি শান্তিলাভ করেন না

বিহায় কামান্ যঃ সর্ব্বান্ পুমাংশ্চরতি নিস্পৃহঃ
নির্ম্মমো নিরহঙ্কারঃ শান্তিমধিগচ্ছতি || ৭১ ||

যেইহেতু কামনার বিলয়েই শান্তি সেইহেতু- যে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্রহ্মবিৎ সন্ন্যাসী নিঃশেষরূপে সমস্ত কামনা পরিত্যাগ করেন, শরীর ও জীবনধারণমাত্র নির্ব্বাহের জন্য আবশ্যক যে পরিগ্রহ তাহাতেমমত্ব’-ভাববর্জিত অর্থাৎ ইহা আমার এইরূপ অভিনিবেশ বর্জ্জিত ও বিদ্যাবত্তাদি অহঙ্কাররহিত হন এবং শরীরে ও জীবনে স্পৃহাশূন্য এবং জীবনধারণমাত্রে চেষ্টাযুক্ত হইয়া পর্যটন করেন, তিনি সকল সংসারদুঃখের নিবৃত্তিরূপ নির্বাণাখ্য পরম শান্তি লাভ করেন অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপই হইয়া থাকেন। শ্রুতিও (মুন্ডক উপনিষদ-৩।২।৯) তাই বলছে-"যে কেহ সেই পরব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রহ্মই হইয়া যান।"


এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি
স্থিত্বাহস্যামন্তকালেহপি ব্রহ্মনির্ব্বাণমৃচ্ছতি || ৭২ ||

এই জ্ঞাননিষ্ঠার স্তুতি করা হইতেছে- হে পার্থ (পৃথাপুত্র), এই অবস্থাই ব্রাহ্মী স্থিতি অর্থাৎ সর্ব্বকর্মসন্ন্যাসপূর্ব্বক ব্রহ্মস্বরূপে অবস্থান এই অবস্থা লাভ করিলে আর কেহ মোহগ্রস্ত হন না অন্তিম বয়সেও যিনি এই অবস্থা লাভ করেন, তিনি ব্রহ্মনির্বাণ অর্থাৎ ব্রহ্মাবস্থানরূপ মোক্ষ প্রাপ্ত হন 

ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসম্বাদে সাংখ্যযোগ
নাম দ্বিতীয়োঽধ্যায়ঃ।

নমো ভগবতে বাসুদেবায়
শ্রীবেদব্যাসায় নমঃশ্রীশঙ্করভগবত্পাদাচার্যস্বামিনে নমঃ






No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...