"মোহমুদগর" ও ইহার ভাবার্থঃ-
আচার্য্য শঙ্কর ভগবৎপাদের 'মোহমুদগর' রচনাটি একটি মোহনাশক জ্ঞানবৈরাগ্যমূলক রচনা। আচার্য্য সকল জ্ঞাননিষ্ঠ সংসার বিরাগী সন্ন্যাসী শিষ্যদের প্রতি মোহনাশের উপদেশ ও বিবেকজাত জ্ঞানবৈরাগ্যের স্তুতি করিতেছেন এইভাবে-
মুঢ় জহীহি ধনাগমতৃষ্ণাম কুরু তনুবুদ্ধে মনসি বিতৃষ্ণাম্।
যল্লভতে নিজকর্ম্মোপাত্তম্ বিত্তং তেন বিনোদয় চিত্তম্॥১॥
অর্থ- হে মূঢ় জন কেবলমাত্র অর্থ উপার্জনের তৃষ্ণা পরিত্যাগ কর। এই ধরনের চিন্তা তোমার মনকে কেবলমাত্র জাগতিক করে দেবে সুতরাং মনে এর জন্য বিতৃষ্ণা সৃষ্টি কর। তোমার উত্তম কর্ম্মের দ্বারা উপার্জিত যে অর্থ তোমাকে স্বচ্ছল রাখে তার দ্বারাই তোমার মনকে খুশী রাখো।
কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ সংসারোহয়মতীববিচিত্রঃ।
কস্য ত্বং বা কুতঃ আয়াতঃ তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভাতঃ॥২॥
অর্থ- কে তোমার স্ত্রী? কেই বা তোমার সন্তান? এই সংসার হল অতীব বিচিত্র। তুমি কার? তুমি কোথা থেকে এসেছ? তত্ত্ব সহকারে এই বিষয়ে চিন্তা করে দেখ।
মা কুরু ধনজনযৌবনগর্বম্ হরতি নিমেষাৎ কালঃ সর্ব্বম্।
মায়াময়মিদমখিলং হিত্বা ব্রহ্মপদং প্রবিশাশু বিদিত্বা॥৩॥
অর্থ- ধন, জন ও যৌবনের গর্ব না করাই ভাল কারন সময় এই সকলকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলে। এই অখিল জগতকে মায়াময় জেনে সেই পরম ব্রহ্ম পরমপুরুষের চরণে আশ্রয় গ্রহন করাই তোমার পক্ষে ভালো।
নলিনীদলগতজলমতিতরলং তদ্বজ্জীবনমতিশয়চপলং।
ক্ষণমিহ সজ্জনসঙ্গতিরেকা ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা॥৪॥
অর্থ- পদ্মপত্রের উপর জলবিন্দু যে রকম অস্থির প্রাণীর মধ্যে প্রাণও সেই রকম অস্থির। তাই এই ক্ষণজীবনে যদি ক্ষণকালের জন্যও সাধুসঙ্গ করে থাকো তাহলে এই ভব সাগরে হতে সেই সাধু সঙ্গ নৌকা হয়ে তোমাকে পার করে দেবে।
যাবজ্জনমং তাবন্মরনণং তাবজ্জননীজঠরে শয়নং।
ইহ সংসারে স্ফূটতরদোষঃ কথমিহ মানব তব সন্তোষঃ॥৫॥
অর্থ- প্রাক প্রসব অবস্থা, জন্ম, মৃত্যু এগুলি ক্রমাগত, এই সংসারের এই ক্ষণ ভঙ্গুর রূপ তুমি স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাও। তাহলে হে মানুষ তুমি কিসে সন্তুষ্ট থাকো?
দিনযামিন্যৌ সায়ম্প্রাতঃ শিশিরবসন্তৌ পুনরায়াতঃ।
কালঃ ক্রীড়তি গচ্ছত্যায়ুঃ তদপি ন মুঞ্চত্যাশাবায়ুঃ॥৭॥
অর্থ- দিন-রাত্রি, সন্ধ্যা-সকাল, শীত-বসন্ত কতবার আসে কতবার চলে যায়, সময়ের এই খেলা দেখতে দেখতে আয়ু শেষ হয়ে যায় কিন্তু তবুও এই বায়ুর মত অফুরন্ত আশা মানুষের আর ফুরায় না।
অঙ্গং গলিতং পলিতং মুণ্ডম্ দন্ত-বিহীনং জাতং তুণ্ডম্।
করধৃতকম্পিতশোভিতদণ্ডম্ তদপি ন মুঞ্চত্যাশাভাণ্ডম্॥৭॥
অর্থ- অঙ্গ সকল কুঁচকে গিয়ে এমন হয় যেন গলে গলে পড়ছে, মাথা থেকে সব চুল উঠে যায়, দাঁত পড়ে গিয়ে মুখ বিবর চুপসে যায়, ঠুকরে ঠুকরে হাঁটে, হাতে ধরে থাকা লাঠিটাও যখন থর থর করে কাঁপতে থাকে তখনো মানুষ এই আশা নামক ফাঁকা মাটির হাঁড়িটা ছাড়তে চায় না।
সুরবরমন্দিরতরুতলবাসঃ শয্যাভূতলমজিনং বাসঃ।
সর্ব্বপরিগ্রহভোগত্যাগঃ কস্য সুখং ন করোতি বিরাগঃ॥৮॥
অর্থ- সেই দেবতাদের মন্দির স্বরূপ তরুতলে যদি বাস করা হয়, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ কে শয্যা করা হয় এবং অজিন বসন যদি পরিধান করা হয় এবং সংসারের সকল ভোগে ত্যাগে আগ্রহ না রেখে সব কিছু পরিত্যাগ করে দেওয়ার এই বৈরাগ্যভাব কাকে না খুশি করে।
শত্রৌ মিত্রে পুত্রে বন্ধৌ মাকুরু যত্নং বিগ্রহসন্ধৌ।
ভব সমচিত্তঃ সর্ব্বত্র ত্বং বাঞ্ছস্যচিরাদ্ যদি বিষ্ণুত্বং॥৯॥
অর্থ- শত্রু-মিত্র পুত্র-বন্ধু বান্ধব আদি যা কিছু সম্পর্ক আছে এদের সাথে এবং ঝগড়া সন্ধি ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ যত্ন করার কোন দরকার নেই। ভগবান চারিপাশে ব্যাপ্ত আছেন এই কথাটি মনে রেখে সকলের প্রতি সমান যত্ন নেওয়ার চেষ্টা সব সময়েই করা উচিত।
অষ্টকুলাচলসপ্তসমুদ্রাঃ ব্রহ্মাপুরন্দরদিনকররুদ্রাঃ।
ন ত্বং নাহং নায়ং লোকঃ তদপি কিমর্থং ক্রিয়তে শোকঃ॥১০॥
অর্থ- এই মহাদেশ সপ্তসাগরা জগৎ সংসার ব্রহ্মা (সৃষ্টি কর্তা), ইন্দ্র (ভোগ কর্তা), সূর্য্যনারায়ণ (পালন কর্তা), রুদ্র (সংহার কর্তা) কতৃক পরিচালিত হয়। তুমি-আমি এই লোক সমূহে ক্ষণ ভঙ্গুর পদার্থ মাত্র। তাহলে কিসের জন্য তুমি দুখঃ শোকে জর্জরিত হয়ে থাকো!
ত্বয়ি ময়ি চান্যত্রৈকোবিষ্ণুঃ ব্যর্থং কুপ্যসি ময্যসহিষ্ণুঃ।
সর্ব্বং পশ্য আত্মনাত্মানং সর্ব্বতোৎসৃজ ভেদজ্ঞানম্॥১১॥
অর্থ- তুমি আমি আর কেউ নই আমরা সেই এক সর্ব্বঘটে পরিব্যাপ্ত ব্যাপ্তময় বিষ্ণু এর জন্য ব্যর্থই আমার প্রতি অসিহষ্ণুতা বশত রাগ করে থাকো। চেয়ে দেখ চারিদিকে যা কিছু দেখতে পাচ্ছ সব তোমারই আত্মারই অংশ, আত্মার আত্মীয়। সুতারং যত্ন সহকারে মন থেকে এই ভেদজ্ঞান দূর করে দাও।
বালস্তাবৎ ক্রীড়াসক্ত-স্তরুণস্তাবৎ তরুনীরক্তঃ।
বৃদ্ধস্তাবচ্চিন্তামগ্নঃ পরমে ব্রহ্মণি কোহপি ন লগ্নঃ॥১২॥
অর্থ- বালকেরা যেরকম খেলার প্রতি আসক্ত, তরুনরা যেরকম তরুনীদের প্রতি আসক্ত, বৃদ্ধেরা যে রকম বিষয় চিন্তার প্রতি আসক্ত থাকে, পরম ব্রহ্মেকে জানার জন্য সেই রকম আকুল করা আসক্তি দেখ কারো মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
অর্থমনর্থং ভাবয় নিত্যং নাস্তি ততঃ সুখলেশঃ সত্যং।
পুত্রাদপি ধনভাজাং ভীতিঃ সর্ব্বত্রৈষা কথিতা নীতিঃ॥১৩॥
অর্থ- অনর্থকারী অর্থ চিন্তায় সব সময়ে ডুবে আছো কিন্তু জেনে রাখো তাতে লেশ মাত্র সত্যিকারের সুখ নেই। হে ধনী, সংসারের লোকেরা এমনকী নিজের সন্তানরাও তোমাকে যে শ্রদ্ধা ভক্তি প্রদর্শন করে তা তোমার ধন প্রাপ্ত করার জন্য। সব সময় এমনি হয়ে থাকে নীতিকথাতে তাই বলা আছে।
যাবদ্বিত্তোপার্জ্জনশক্তঃ তাবন্নিজপরিবারো রক্তঃ।
তদনু চ জরয়া জর্জ্জরদেহে বার্ত্তাং কোহপি ন পৃচ্ছতি গেহে॥১৪॥
অর্থ- যতদিন তুমি অর্থ উপার্জন করতে পারবে ততদিন তোমার পরিবারের সকলে তোমার খুব অনুরক্ত থাকবে। তুমি যা বলবে তাই হবে, তোমার কথায় সবাই ওঠা বসা করবে। তারপরে যখন সময়ের চক্রে জরা ব্যাধি ইত্যাদি এসে তোমার দেহে বাসা বাধবে, নড়বড়ে হয়ে তুমি বিছানায় শুয়ে থাকবে, তোমার বাড়িতেই তোমারই পরিবারের কেউ আর তোমার কথা জিজ্ঞেস করবে না, তোমার সাথে কথা বলবে না।
কামং ক্রোধং লোভং মোহং ত্যক্ত্বাত্মানং পশ্যতি কোহহং।
আত্মজ্ঞানবিহিনা মূঢ়া স্তে পচ্যন্তে নরকে নিগূঢ়াঃ॥১৫॥
অর্থ- কাম, ক্রোধ, লোভ ও মোহ চেষ্টা করে পরিত্যাগ কর। নিজের আত্মাকে জানার চেষ্টা কর, তুমি কে? এই আত্মজ্ঞান না হলে তুমি মূর্খই রয়ে যাবে। এই জীবন-মৃত্যু নরকময় সংসারে জন্ম জন্মান্তর ধরে পঁচতে হবে।
ষোড়শপজ্ঝটিকাভিরশেষঃ শিষ্যানাং কথিতোহভ্যুপদেশঃ।
যেষাং নৈব করোতি বিবেকং তেষাং কঃ কুরুতে মতিরেকং॥১৬॥
অর্থ- এই ষোলটি পদের দ্বারা শিষ্যদের সবাইকে আমি উপদেশ প্রদান করলাম। কিন্তু এতেও যার বিবেক জাগ্রত হয় না তার সেই এক পরব্রহ্মে মতি কিভাবে হবে?
No comments:
Post a Comment