কলিযুগে ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্মের পূনর্জাগরণের অগ্রপুরুষ জগৎগুরু ভগবৎপাদ্ আদি শঙ্করাচার্য্য।কলিযুগের প্রারম্ভে বেদান্তবেদ্য, সচ্চিৎ-সুখস্বরূপ, নিখিলাত্মা, বুদ্ধির অবেদ্য, অথচ অনবেদ্য, অনুভূতি রূপ, যাঁর প্রকাশে জগৎ প্রকাশ পাচ্ছে, সেই পূর্ণ পরমাত্মা লোক-শঙ্কর মহেশ্বর, লোক সকলের হিত সাধন ও বেদমত সংস্থাপন জন্য নিজ মায়াতে শঙ্করাচার্য্যরূপে অবনীতে অবতীর্ণ হয়ে অসার মত সমস্ত নিরস্ত এবং শ্রুতিসম্মত অদ্বৈতমত প্রচার ও সংস্থাপন করেছেন, আর শাস্ত্ররূপ বাগ্জাল মহারণ্যে ভ্ৰাম্যমান শ্রান্ত জনগণকে স্বধাম প্রাপ্তির সুন্দর ও সরল পথ দেখিয়ে সকল তাপ হতে বিমুক্ত করেছেন।
কলিতে লোকসকল যখন বিভিন্ন অবৈদিক দর্শনের নেতিবাচক প্রভাবে বৈদিক শ্রুতি-বিদ্বেষী পাষণ্ড হয়ে উঠছিল তখন ত্রিলোকনাথ ভগবান শিব ধর্ম্মসংস্থাপনার্থে, দুষ্টাচারের দমন ও সদাচার প্রতিস্থাপন হেতু চতুর্ভূজ
শ্রীহরির ন্যায় চতুঃশিষ্যগণ সহ অবতীর্ণ হয়ে অজ্ঞানপ্রভব বিবিধ অনর্গল দ্বৈতমূলক, বৌদ্ধ জৈনাদি সহ বিভিন্ন অবৈদিক মতবাদের
নিরস্তকরণ করতে দিগ্বীজয়ী যতিসম্রাট শংকরাচার্য্য নামে নিজলীলা প্রকাশ করলেন। এই অবতারে
শঙ্কর কর্তৃক বেদব্যাস বিরচিত ব্রহ্মসূত্র তথা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং বৈদিক মুখ্য উপনিষদসমূহের
প্রসন্ন গম্ভীর গূঢ়জ্ঞানপ্রাজ্বল্যে দীপ্তীয়মান ভাষ্যাদি, পঞ্চমতের মধ্যে পারস্পরিক
দর্শনবিরোধিতা নিরাকরণের জন্য দেড়শতাধিক স্তবস্তোত্রম্ ও প্রকরণগ্রন্থাদি সংরচিত হল।
জগন্নাথপুরীর দারুবিগ্রহ, বদরীনাথসহ ভারতবর্ষের বহু প্রাচীন মন্দির বিগ্রহ ও তীর্থাদির পুনরুদ্ধার
হল। আদিযোগী জ্ঞানগুরু শঙ্কর মনুষ্য দেহধারণ পূর্বক শঙ্করাচাৰ্য্য নামে পরমহংস
পরিব্রাজক হয়ে চারশিষ্য সমভিব্যাহারে অদ্বৈততত্ত্বজ্ঞানের
সমৃদ্ধি ও নিবৃত্তি মার্গ সন্ন্যাসধর্ম্মের পুনঃসংস্থাপন
করলেন।
‘শিবের নিকট দেবগণের বিজ্ঞাপন’
একদা, অমরবৃন্দ, সনাতন ধৰ্ম্মের গ্লানি ও সদাচারের অবসান নিবন্ধন ভারতভূমির দুরবস্থা সন্দর্শনে সাতিশয় বিষণ্নচিত্ত হয়ে, মানবগণের হিতসাধন এবং স্ব স্ব বৃত্তি রক্ষণ উদ্দেশ্যে কৈলাস-শিখরাসীন ভূতভাবন ভগবান ভবানীপতির সন্নিধানে উপস্থিত হলেন। তাঁরা ত্রিলোকনাথ হরের চরণাম্বুজে বারম্বার প্রণত হয়ে কর-পূটে দণ্ডায়মান হলে, ভূতেশ কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। সুরগণ নিবেদন করলেন, মঙ্গলময় শ্ৰীচরণ দর্শনেই সমস্ত কুশল। হে সৰ্ব্বজ্ঞ! আমাদের হিত আপনাতে অবিদিত নেই, তথাপি আৰ্ত্ত ও স্বার্থী-জনের স্বার্থ জ্ঞাপন করা চিরপ্রসিদ্ধ আছে, বিশেষ ক্ষুধাৰ্ত বালকের রোদন জননীর স্নেহ বৰ্দ্ধনের কারণ হয়। আমরা সেই জন্য ভারতবর্ষের দুরবস্থা কিঞ্চি নিবেদন করতে এসেছি, শ্রবণ করুন। বিষ্ণু বুদ্ধাবতার হয়ে ভূতলে মধ্যপন্থা ও শান্তি স্থাপন করেন।
বুদ্ধ-প্রণীত বুদ্ধাগম নামক গ্রন্থ অবলম্বন করে দৰ্শন-দূষক বৌদ্ধগণ পৃথিবী-মণ্ডলে পরিপূর্ণ হয়েছে। বর্ণাশ্রম ও তদ্ধৰ্ম্ম কৰ্ম্ম সকল ক্রমে লুপ্তপ্রায় হয়েছে । লোক সকল শ্রুতি-বিদ্বেষী পাষণ্ড হয়ে উঠেছে। দ্বিজগণ সন্ধ্যাদি ক্রিয়া রহিত এবং যাগযজ্ঞ ক্রিয়াকলাপ লোপ হয়েছে। মূর্খ সকল নৈষ্ঠিক-ধৰ্ম্ম সন্ন্যাসের নিন্দাতে নিরত রয়েছে। জ্ঞান বৈরাগ্যের বাৰ্ত্তা অধুনা দুর্লভ।
হে শম্ভু! পৃথিবীতে বৈদিক কৰ্ম্মাচার নষ্ট ও লোক সকল ভ্ৰষ্ট হওয়াতে যজ্ঞাদির নাম নেই, অতএব যজ্ঞভাগ বিনা আমরা কিরূপে স্বর্গে অবস্থিতি করব ? হে কৃপানিধে! হে লোকনাথ ! ইদানীং লোক-রক্ষার্থ ও জীবের স্বর্গ মোক্ষ লাভজন্য পুনরায় অবনী-মণ্ডলে শ্রৌত ধৰ্ম্ম (বৈদিক) সংস্থাপন করুন। ত্ৰিলোক-নাথ মহেশ্বর অমরগণের নিকট উক্ত বিবরণ শ্রবণ করে বললেন, দেবগণ! আমি ধ্যানে নিশ্চয় জেনেছি, পৃথিবীলোকে নিবৃদ্ভিমার্গ জ্ঞান ও বৈরাগ্য উচ্ছিন্ন হয়েছে। অদ্বৈতমত আমার প্রাণতুল্য প্রিয়, ভবানী, গুহ, গজাননও আমার তাদৃশ প্রিয় নয়। আমি এক মুহূৰ্তকালও তদ্ভিন্ন অবস্থিত হতে পারিনা । অতএব সেই পরমপ্রিয় তা তত্ত্বজ্ঞানের সমুদ্ধি, শ্রৌত ধৰ্ম্মের সংস্থাপন ও দুস্কৃতিদিগের নিধনসাধন জন্য অদ্য প্রতিশ্রুত হচ্ছি যে, আমি মনুষ্য দেহধারণ পূর্বক শঙ্করাচাৰ্য্য নামে পরমহংস ধুরন্ধর হয়ে ব্ৰহ্মা ও ব্রহ্মপুত্র তুল্য চারজন শিষ্য সমভিব্যাহারে ধরণী-মণ্ডলে বিচরণ করত মনোরথ পূর্ণ করব। এবং যুক্তিসহ ব্যাস প্রণীত ব্ৰহ্মত্বপর সূত্রের স্বয়ং বেদার্থবোধক ভাষ্য প্রস্তুত করব।
'শঙ্করের আবির্ভাব'
ভারতের সুদূর দক্ষিণে পশ্চিম সমুদ্রতীরে 'কেরল' প্রদেশ অবস্থিত। বর্তমানে ইহা ত্রিবাঙ্কুর, কোচিন ও মালাবার নামক প্রদেশে বিভক্ত। কেরালা প্রদেশের আলোয়াই (পূর্ণা) নদীর উত্তরতীরে ‘কালাডি’ নামক একটি ছোট্ট গ্রামে নম্বুরী জাতীয় ব্রাহ্মণকুলে আচার্য্য শঙ্করের আবির্ভাব। (শঙ্করাচার্য্যের আবির্ভাবকাল নিয়ে মতভেদ আছে, ‘শঙ্করবিজয়’ গ্রন্থে তার জন্ম সন লেখা নেই; লেখা আছে, তাঁর জন্ম সময়ে বৃহস্পতি কেন্দ্রে, রবি মেষ রাশিতে, শনি তুলা রাশিতে এবং মঙ্গল মকর রাশিতে সংস্থিত ছিলেন।কাশীদাস মিত্ৰ বলছেন-'কলির প্রারম্ভে ২০০বর্ষে জরাসন্ধনাম মগধাধিপতি ছিলেন, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ ও ভীমাৰ্জ্জুন গিয়ে তাঁকে বধ করেন, সেই বংশে বিংশতি পুরুষান্তর সুধন্বা নামা নরপতি হলে, আচার্য্য কুমারিল ভট্টপাদ বৌদ্ধক্ষয়ে এবং শঙ্করাচার্য দিগ্বিজয়ে উক্ত সুধন্বা রাজার সাহায্য প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সে সময় কলির ২০০০ দুই সহস্র বর্ষ বা কিঞ্চিৎ ন্যুনাধিক ছিল। অধুনা কলির গতাব্দ ৪৯৭৩, শকাব্দ ১৭৯৪ গণনা করিলে শঙ্করাচর্য্য অবতার কিঞ্চিৎ ন্যূনাধিক প্রায় ৩০০০ তিন সহস্ৰ বর্ষগত, লিখিত আচাৰ্য্য সকল তৎকালের স্পষ্ট প্রতীত হয়।'
সূক্ষ্মগণনায় বিখ্যাত শঙ্কর গবেষক পণ্ডিত শ্রীরাজেন্দ্রনাথ ঘোষ ৬০৮ শকাব্দে (৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দ) আচার্য্যের শঙ্করাচার্যের জন্মকাল নির্দেশ করেন। দ্বারাবতী মঠের পিণাকী-চিহ্নিত লিপি অনুসারে ২৬৩১ যুধিষ্ঠিরাব্দে আচার্য্যের আবির্ভাব এবং ২৬৬৩ যুধিষ্ঠিরাব্দে তিরোভাব। এই অনুসারে শঙ্করাচাৰ্য্য খৃষ্ট-পূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে আবির্ভুত হয়েছিলেন। শৃঙ্গেরী মঠের প্রবাদ অনুসারে আচার্য্য শঙ্কর ১৪ বিক্রমার্কাব্দে আবির্ভূত হন এবং ৪৬ বিক্রমার্কাব্দে সমাধি লাভ করেন।)
শঙ্করের পিতার নাম শিবগুরু। সৰ্ব্ব বেদ-বেদাঙ্গ-পারদর্শী বিদ্যাধিরাজ নামে জনৈক দ্বিজবরের সন্তান ছিলেন শিবগুরু। শিবগুরু স্বীয়গুরু গুরুগৃহে শাস্ত্রাধ্যয়ন করতে করতে বৈরাগ্যযুক্ত হয়ে পড়েন। পিতা বিদ্যাধর ইহা দেখে পুত্রের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর সমাবর্তন ক্রিয়া সম্পন্ন করে নিজগ্রামের অনতিদূরস্থিত একটী ক্ষুদ্রগ্রামের অধিবাসী 'মঘ' পণ্ডিতের 'বিশিষ্ঠা' নাম্নী এক কন্যার সহিত শুভলগ্নে তাঁর বিবাহ সংস্কার সম্পন্ন করলেন। দ্বিজবর-শিবগুরু, বিশিষ্টা নাম্নী সেই রূপ ও গুণবতী, সুশীলা, পতিব্ৰতা ভাৰ্য্যাকে লাভ করে তৎ সহবাসে বিবিধ দাম্পত্য সুখ সম্ভোগে কাল যাপন করতে লাগলেন। শাস্ত্রচর্চা, অধ্যাপনা এবং কুলদেবতা ভগবৎ শ্রীকৃষ্ণ আরাধনাই নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ শিবগুরুর জীবনের ব্রত ছিল। শিবগুরুর স্ত্রী বিশিষ্টা দেবীও একজন ধর্মপরায়ণা নারী ছিলেন। এই ভাবে কিয়ৎকাল অতীত হলে দম্পতীর মনে পুত্রাভিলাষ উৎপন্ন হল, কিন্তু বহুকাল গত হইলেও এই আশা ফলবতী হল না।
একদা, সাধ্বী বিশিষ্টা পুত্র দর্শনে উৎকণ্ঠিতা হয়ে পতিকে সবিনয়ে নিবেদন করলেন, হে নাথ! পুত্র যখন মধুর-স্বরে মা বলে ডাকে তখন জননীর অন্তঃকরণে যে কি অনিৰ্ব্বচনীয় সুখের আবির্ভাব হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এমত পুত্ররত্নে বঞ্চিত থেকে এ বৃথা জীবন ধারণে কি ফল? নানা প্রকার উপায় চিন্তা করলাম, কিন্তু কিছুতেই অভিষ্ট সিদ্ধ হল না। অধুনা আমার মনে এই দৃঢ় প্রত্যয় হচ্ছে, যে আমরা একান্তভাবে সৰ্ব্ব-ফলদাতা মহেশ্বরের শরণাপন্ন হয়ে পরাভক্তিতে তাঁর আরাধনা করলে সৰ্ব্বজ্ঞ ও সৰ্ব্ব-গুণসম্পন্ন সুত লাভ করতে পারব। সৰ্ব্বশাস্ত্রে শুনা যাচ্ছে, মহেশ্বরের সেবা করে কেউ কখন অভিষ্ট লাভে বঞ্চিত হয় নি।
গ্রামের অনতিদূরে বৃষ পর্বতে ছিল কেরালাধিপতি রাজশেখর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রমৌলীশ্বর শিব মন্দির।সেই মন্দিরে মহাজাগ্রত শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভূতভাবন ভগবান ভবানীপতি ভূ-বিহার অভিলাষ করে প্রথমতঃ ধৰ্ম্মাদ্রী-ভূমি কেরল-দেশে পূর্ণা তটিনীতটে স্বয়ম্ভু লিঙ্গ রূপে প্রকট হলেন, এবং তত্রত্য একদা ভূপতি রাজশেখরকে স্বপ্নে প্রত্যাদেশ করলেন যে, এই স্থানে প্রাসাদ নিৰ্ম্মাণ করে সৰ্ব্বদা প্রকটিত শিব-লিঙ্গে আমার পূজা কর। নরপতি নিদ্রাভঙ্গে বহু-ভাগ্য মেনে স্বপ্নাদিষ্ট অনুজ্ঞানুসারে মন্দির প্রস্তুত করে প্রজা নিকরের সহিত উক্ত লিঙ্গার্চ্চনার প্রচলন করলেন। তদবধি এই মহাজাগ্রত শিবলিঙ্গ ভক্তগণের মনোবাঞ্চা পূর্ণ করে আসছেন।
দ্বিজবর-শিবগুরু সেই শিবালয়ে নিত্য সংস্থিতি পূর্বক সপত্নিক শূলপাণির আরাধনাতে দৃঢ়ব্রত হলেন, এবং ঐকান্তিক ভক্তিভাবে তদগতচিত্ত হয়ে কঠোর তপস্যার সহিত কায়-মনো-বাক্যে পূর্বোক্ত স্বয়ম্ভূলিঙ্গের অর্চনা করতে লাগলেন। এইরূপে বহুদিন অতীত হল। একদা শিবগুরু তপশ্চর্য্যা করে সেই স্থানে নিদ্রিত হলে, ভক্ত-বাঞ্ছা-ফলদাতা বরদেশ্বর স্বপ্নে তাঁকে বললেন-বিপ্রবর! কি বর প্রার্থনা কর? শিবগুরুও স্বপ্নাবস্থাতেই বললেন, ভগবান! পুত্র প্রদান করুন। মহেশ্বর বললেন, সৰ্ব্বজ্ঞ এক পুত্র, নাকি নির্গুণ বহুপুত্ৰ? শিবগুরু বললেন, কৃপানিধে! তোমার সদৃশ সৰ্ব্বজ্ঞ এক পুত্র হোক, বহু পুত্র প্রার্থনা করি না। মহেশ্বর তথাস্তু বলে অন্তর্হিত হলেন। শিবগুরু-দ্বিজবরেরও নিদ্রা ভঙ্গ হল।
তখন তিনি নিজ পত্নীকে ডেকে বললেন, বিশিষ্টা! আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে, অদ্য দেবাদিদেব মহাদেব হতে বর প্রাপ্ত হয়েছি। শিবগুরু স্বীয় ভাৰ্য্যাকে এই অমৃত-স্রাবণী-বাণীতে জীবনদান করে, সেদিন দেবতা ব্রাহ্মণগণকে বিবিধ অৰ্চনাতে পরিতৃপ্ত করলেন, এবং অতিশয় আনন্দে শম্ভু তেজেতে যুক্ত হয়ে তপঃ-শোধিত-ক্ষেত্রে সেই তেজঃ সেচন করলেন। দৈবকী যেমত বিষ্ণু-তেজে তেজোযুক্ত হয়েছিলেন, সাধ্বী সতী বিশিষ্ঠাদেবীও সেইরূপ পতিসঙ্গে শিব-তেজেতে সম্পন্ন হলেন। চির-পালিত-আশা-লতাকে ফলোন্মুখী দেখে দম্পতির আনন্দের পরিসীমা রইল না।
সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্ম শিব, স্ব মায়াতে উমাকান্ত চন্দ্র-মৌলীশ্বর আচার্য্য শঙ্কররূপ হয়ে আবির্ভূত হবেন।সংবৎসর অতীত হতে না হতেই ক্রমে গর্ভের নিয়মিত কাল সম্পূর্ণ হলে, সুমুহূর্তে ও শুভলগ্নে পঞ্চ গ্রহের উচ্চাবস্থিতি কালে, সতী বিশিষ্টাদেবী বৈশাখ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে মধ্যাহ্নকালে শঙ্করাখ্য জগদগুরুকে বালক রূপে প্রসব করলেন। মেঘমণ্ডল ভেদ করে যেন পূর্ণ শরচ্চন্দ্র প্রকাশ পেল। সংসার হতে তমোরাশি এককালে অপনীত হল। গন্ধবহু শুভ সম্বাদ ছলে সুরভি-গন্ধ নিয়ে জগতে প্রবাহিত হল। মধুকর নিকর মকরন্দ পান করে হর্ষোৎফুল্লিত-চিত্তে ব্ৰহ্ম-সঙ্গীত করতে গুঞ্জমান হল। নিখিল জীবগণের হৃদয়ে অহেতুক আনন্দের সঞ্চার হতে লাগল। জনক জননীর সুখ-সিন্ধু হিল্লোলিত ও উদ্বেলিত হল।অপূর্ব এক শিশু। ভগবান শঙ্করই যে স্বয়ং অবতীর্ণ হয়েছেন তাই নবজাতকের নাম রাখা হল শঙ্কর।চন্দ্রমৌলীশ্বর ভগবান শিবের আশির্বাদে এই সর্বজ্ঞপুত্র আবির্ভূত হন।
দ্বিজরাজ শিবগুরু, পুত্ৰ জননোৎসব শ্রবণ করে তৎক্ষণাৎ সবস্ত্র অবগাহন করলেন এবং জাতকৰ্ম্ম সম্পন্নপূর্বক ব্রাহ্মণগণকে গো-হিরণ্যাদি বহুবিধ দানে পরিতুষ্ট করলেন। জন্মপত্রিকা নির্মিত হল, দেখলেন অবতার যোগ ও কর্কটলগ্নে বালকজাত। অবতার যোগটি এই-
'কেন্দ্রগৌ সিতদেবেজ্যৌ স্বোচ্চে কেন্দ্রগতেহর্কজে।
চরলগ্নে যদা জন্ম যোগোহয়মবতারজঃ।'
তদনন্তর জ্যোতিবেৰ্ত্তাগণকে আহবান করে সবিনয়ে জগত তনয়ের শুভাশুভের বিবরণ জিজ্ঞাসা করলেন। দৈবজ্ঞবৃন্দ গণনা করে বললেন, লগ্ন, নক্ষত্র ও গ্রহযোগাদি দ্বারা বালকের অসাধারণ শক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। বালক সৰ্ব্বজ্ঞ এবং অসংখ্য-গুণসম্পন্ন হবেন। ইনি বেদজ্ঞানে শম্ভুসম এবং কারুণ্যে বিষ্ণুতুল্য হয়ে অবনীতে নিষ্কলঙ্ক ও পবিত্র কীর্তি সমস্ত সংস্থাপন করবেন। শিবগুরু এই সকল বিবরণ শ্রবণ করে অসীম আনন্দে পরিপূর্ণ হলেন। অতীব হর্ষোন্মত্তে বালকের পরমায়ুর কথা কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। দৈবজ্ঞগণ ধন, দ্রব্য, বস্ত্রালঙ্কারাদি নানাবিধ পুরস্কার লাভ করে স্ব স্ব গৃহে গমন করলেন।
'শঙ্করের শৈশব'
ভগবান শঙ্কর নিজ মায়াতে দ্বিজবর-শিবগুরুর ভবনে অবতীর্ণ ও বাল্যভাব প্রাপ্ত হয়ে সিত-পক্ষীয় শশিকলার ন্যায় দিন দিন বিবৰ্দ্ধিত হতে লাগলেন। শঙ্কর আশৈশব শান্তপ্রকৃতি, অতিশয় তীক্ষ্মবুদ্ধি ও শ্রুতিধর ছিলেন। জনক-জননীর নিকট যখনই যা শুনতেন তখনই তা তাঁর কন্ঠস্থ হয়ে যেত। মাত্র তিন বছর বয়সে শিশুর বুদ্ধিবৃত্তির তীক্ষ্ণতা আর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা দেখে আশ্চর্য হয়ে যান শিবগুরু। তিনবৎসর বয়সেই শঙ্কর নিজ মালায়লম্ ভাষার গ্রন্থ অধ্যয়নে সমর্থ হলেন। তিনি এই অল্পকাল হতেই ছেলেকে পড়াতে শুরু করলেন উৎসাহের সঙ্গে। তাঁর একান্ত বাসনা পুত্রকে সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত করে তুলবেন তিনি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মরদেহ ত্যাগ করে স্বর্গলাভ করেন শিবগুরু। একদিকে স্বামীশোকে কাতর এবং অন্যদিকে সংসার চালানো ও পুত্রকে মানুষ করে তোলার চিন্তায় বিষণ্ণ বোধ করতে লাগলেন বিশিষ্টা দেবী। মা বিশিষ্টাদেবী পঞ্চম বৎসরেই বালক শঙ্করের উপনয়ন করান। ব্রাহ্মণকুমারের অষ্টম বর্ষেই উপনয়ন বিধি, কিন্তু ব্রহ্মতেজ কামনা হইলে পঞ্চমবৎসরে উপনয়ন দেবার ব্যবস্থাও আছে।
'গুরুকুলে বিদ্যার্জন'
উপনয়নের পর তাকে শাস্ত্রপাঠের জন্য গুরুগৃহে পাঠানো হলো। শঙ্কর শুধু দেখতে সুদর্শনই ছিল না, তার মেধা ছিল তীক্ষ্ণ। জন্ম থেকেই অসাধারণ মেধা, প্রজ্ঞা এবং ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন আচার্য্য শঙ্কর। মাত্র তিন বছর বয়সেই তিনি তাঁহার মাতৃভাষা মালয়ালামে লিপিপাঠের দক্ষতা অর্জন করিয়াছিলেন।গুরুমশাই তাই তাকে প্রথম থেকেই স্নেহ করতেন। টোলের একধারে বসে তার প্রাথমিক পাঠের সব পড়া তৈরী করে শঙ্কর। কিন্তু সে শুধু নিজের পড়া পড়ত না।
আচার্য
উচ্চশ্রেণীর ছাত্রদের যেসব শাস্ত্র পড়াতেন সব শুনে যেত সে। এক একদিন সে আচার্যের সামনে উচ্চশ্রেণীর পাঠ্য
শুনিয়ে দিত। তাতে আশ্চর্য হয়ে যেতেন টোলের সকলে। আচার্য
বুঝলেন, শঙ্কর সাধারন ছেলে নয়। ঈশ্বরদত্ত মহাপ্রতিভার অধিকারী সে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের
বিরাট সম্ভাবনার বীজ নিহিত আছে তার এই বাল্যজীবনের মধ্যে। সেদিন থেকে আচার্য উচ্চশ্রেণীর
পাঠক্রম নির্দিষ্ট করে দিলেন শঙ্করের জন্য। শঙ্করের বয়স তখন মাত্র পাঁচ। এরপর দু'বছরের মধ্যে
সেই টোলের সব পাঠ্য বিষয় অক্লান্ত চেষ্টায় আয়ত্ত করে ফেলল শঙ্কর। সর্বশাস্ত্র ও সর্ববিদ্যা সম্পূর্ণ রূপে হৃদয়ে
প্রভাসিত হল। তিনি বেদে ব্রহ্মা, ফল সমূহে গার্গ্য, তাৎপৰ্য্য বোধে বৃহস্পতি, বেদের
পূর্বকাণ্ডে সাক্ষাৎ স্বয়ংজৈমিনি, এবং বেদান্ত সিদ্ধান্তে ব্যাসের সমান হলেন। লোক-গুরু
বেদান্ত-সরোজ-বিভাকর শঙ্করের উপমা নেই।
'পরদুঃখমোচন'
শঙ্কর গুরু-গৃহে অবস্থান সময়ে, একদা ভিক্ষার্থ গমন করে কোন নিঃস্ব বিপ্রের ভবনে প্রবিষ্ট হয়ে “ভিক্ষা দেহু’ এই বাক্য বললেন । বিপ্ৰপত্নী তদ্বাক্য শ্রবণ করে বিষণ্ণ মনে বললেন, এই সংসারে সেই সুকৃতি জনগণের জীবন ধন্য, যাঁরা ভবাদৃশ ব্যক্তি বৃন্দকে সৰ্ব্বদা ভোজন দানে পরিতৃপ্ত করে সুখী হন। আমরা ভাগ্যহীন, দৈব কর্তৃক বঞ্চিত। এই বাক্য বলে আমলক ফল এনে ভিক্ষা দিলেন। দীন-দয়াল শঙ্কর করুণ-রস-গর্ভিণী এই বাণী শ্রবণে দয়াদ্র চিত্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ পদ্মালয়া কমলাকে স্তুতি করলেন। এই স্তুতিটি বর্তমানে 'কনকধারাস্তোত্রম্' নামে বিখ্যাত।
হরিপ্রিয়া শঙ্করের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে অবিলম্বে তৎ প্রাঙ্গণে প্রাদুর্ভূত হলেন, এবং শঙ্করকে বললেন, বটো! তোমার মঙ্গল হোক, বর গ্রহণ কর। তখন বটুবর লক্ষ্মীকে সমীপবৰ্ত্তিনী দর্শন করে পুনর্বার স্তুতি করতে লাগলেন। কমলা অধিক সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, তুমি যে নিমিত্ত স্তুতি করছ তা অবিলম্বে গ্রহণ কর, আমি স্বয়ং প্রসন্না হয়ে প্রদান করছি। তখন শঙ্কর, করুণা-রসাবিষ্ট-বুদ্ধির বাক্য শ্রবণ করে বললেন, দেবি! যদি তুমি বরদা হলে, তবে এই বিপ্ৰপত্নীর ভবনে প্রবিষ্ট হয়ে গৃহ স্বর্ণে পূর্ণ করে স্থির হও। এই প্রকার বটুবর কর্তৃক লক্ষ্মী নিয়োজিত হয়ে তৎক্ষণাৎ ব্রাহ্মণের গৃহ স্বর্ণে পূর্ণ করে অন্তর্হিতা হলেন। শঙ্করের কৃপা-দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণ অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী ও প্রভূত ধনের অধীশ্বর হয়ে সুখে কাল যাপন করতে লাগলেন। এতে বটুবরের সুপাবনী সৎকীৰ্ত্তি লোকে প্রথিত হয়ে সজ্জন সমাজে শরদিন্দু-প্রভা তুল্য প্রকাশ পেতে লাগল, এবং তদবধি তার “বেদ-মৰ্ম্ম-ভৰ্ত্তা” খ্যাতি লাভ হল। শঙ্কর ষষ্ঠ বর্ষ বয়ঃপ্রাপ্তে স্বীয় মেধা শক্তিতে বেদ সকলের গ্রন্থি-ভেদ করলেন। সপ্তম বর্ষে গুরু-গৃহ হইতে সমাবর্তন পূর্বক স্বালয়ে সমাগত হয়ে মাতৃ শুশ্রুষাতে নিরত হলেন।
'শঙ্করের অধ্যপনা ও মাতৃসেবা'
বাড়ি ফিরে এসেই সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করল শঙ্কর মাকে। এত কম বয়সে এত শাস্ত্র কখনো কেউ আয়ত্ত করতে পারে না। গর্বে ফুলে উঠল মায়ের বুক। শঙ্করের প্রতিভার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মা আনন্দের আবেগে পুত্রকে বললেন, আজ তুই তোর পিতার মুখ উজ্জ্বল করেছিস। তাঁর কত আশা ছিল তুই সব শাস্ত্রে সুপণ্ডিত হয়ে বংশের মুখ উজ্জ্বল করবি। আজ সত্যিই তুই তাই করেছিস। শঙ্কর এবার বলল, আমি এখন স্থির করেছি আমি এখন হতে ঘরে বসে অধ্যাপনা করব। আর বাকি সময়ে তোমার চরণসেবা করব। আশীর্বাদ করো যেন সফল হতে পারি।
মা ছেলেকে কোলে নিয়ে আশীর্বাদ করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িতে এক চতুষ্পাঠী খুলে
বসলেন শঙ্কর। সকলে আশ্চর্য হয়ে গেল। স্থানীয় পণ্ডিতেরা তাচ্ছিল্যভাবে বলাবলি করতে
লাগলেন, অনভিজ্ঞ বালক, শাস্ত্রের কি জানে? কি সে পড়াবে? তারা প্রথম প্রথম আমল দিতে
চাইলেন না। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারলেন না শাস্ত্রজ্ঞান, স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও
তর্কপ্রতিভার অধিকার শঙ্করের জন্মগত। ক্রমে এই সব কিছুর পরিচয়
পেয়ে তাঁরা বাধ্য হলেন বালক শঙ্করের কাছে মাথা নত করতে। শঙ্করের চতুষ্পাঠীতে ছাত্রসংখ্যা
বেড়ে যেতে লাগল দিনে দিনে। তাঁর অধ্যাপনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল দিনে দিনে। শঙ্করের মাতৃভক্তি ছিল গভীর। প্রতিদিন অধ্যাপনা
ও পূজা-অর্চনার অবশিষ্ট সময়টুকু মায়ের সেবা করে কাটাতেন তিনি।
'অলৌকিকভাবে নদীর গতিপথ পরিবর্তন'
জননী বিশিষ্টা দেবী তখন বয়সে বৃদ্ধা হলেও ধর্মপরায়ণার তৎপরতা কিছুমাত্র কমেনি তাঁর।
প্রতিদিন নিয়মিত কুলদেবতা কেশবের পূজা দিতেন। পূজার আগে রোজ গ্ৰাম হতে কিছুটা দূরে
আলোয়াই নদীতে স্নান করে আসতেন। একদিন সকালে আলোয়াই নদীতে স্নান করতে গিয়ে তাঁর ফিরে
আসতে দেরী হওয়ায় উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন শঙ্কর। তিনি তখন নিজে নদীর পথে হেঁটে যেতে
লাগলেন। দেখলেন, মাঠের ধারে অশক্ত দেহে পথ হাঁটতে হাঁটতে অবসন্ন হয়ে মূর্ছিত হয়ে
পড়ে আছেন মা। তাঁকে ঘিরে ভিড় জমে গেছে লোকের। অনেকক্ষণ
সেবা শুশ্রূষা করার পর মার জ্ঞান ফিরে এল।
শঙ্কর বুঝলেন এত দূরে রোজ নদীতে স্নান করতে আসা অসম্ভব তাঁর মায়ের পক্ষে। তাই তিনি সেদিন ভগবানের কাছে কাতর প্রার্থনা জানালেন, আমার মা বৃদ্ধা হয়েছেন। প্রতিদিন তাঁর এই পথশ্রম ও দেহকষ্ট আমায় যেন দেখতে না হয়। কৃপা করে তুমি আলোয়াই নদীর স্রোতটাকে আমাদের বাড়ির কাছে এনে দাও। এ জীবনে আমার কোন প্রার্থনাই নেই। শুধু নদীর স্রোতধারাটি বাড়ির কাছে নিয়ে এস। ভগবান এই ব্রহ্মচারী সত্যসাধক বালকের প্রার্থনা পূরণ না করে পারলেন না। দেখতে দেখতে কুল ভেঙ্গে ভেঙ্গে আলোয়াই নদী সত্যই শঙ্করের বাড়ির কাছে এসে পড়ল। বালক শঙ্করের অধ্যাপনার খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে এই অলৌকিক শক্তির কথাও ছড়িয়ে পড়ল লোকের মুখে মুখে।
'কুম্ভীর আক্রমণ'
একদিন মার সঙ্গে আলোয়াই নদীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন শঙ্কর। জলে নেমে স্নান করার সময় একটি কুমীর তাঁকে তাড়া করে তাঁর মার সামনে। নদীর জলে সাঁতার কেটে ছোটাছুটি করে বেড়াতে লাগলেন শঙ্কর আর কুমীরটা তাঁকে তাড়া করে বেড়াতে থাকে। নদীর মধ্যে ছোট একটা চড়া ছিল। ক্লান্ত হয়ে সময় সময় তার উপর উঠে দাঁড়ালেন শঙ্কর।কিন্তু কুমীরটা সেখানেও তেড়ে গেল। তিনি চীৎকার করে মাকে বলতে লাগলেন, মা, আমার মৃত্যু এবার আসন্ন। আমাকে সন্ন্যাস নেবার অনুমতি দাও। তা না হলে আমার মুক্তি হবে না। তোমার অনুমতি পেলে সন্ন্যাস নিই আমি।মা তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্ন্যাস নেবার অনুমতি দিলেন শঙ্করকে। অনুমতি দিয়েই মূর্ছিত হয়ে পড়লেন নদীর পারে।
এদিকে গোলমাল শুনে কয়েকজন জেলে বর্শা নিয়ে ছুটে এসে কুমীরটাকে মেরে ফেলে। এইভাবে
ভগবানের দয়ায় বেঁচে যান শঙ্কর। জ্ঞান ফিরে পেয়ে বিশিষ্টা দেবী পুত্রকে বিপদ থেকে
মুক্ত ও অক্ষতদেহ দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু এদিকে এক নতুন বিপদ দেখা দিল। শঙ্কর
মাকে বললেন, তিনি আর বাড়িতে বাস করবেন না। তিনি যখন সন্ন্যাস নিয়েছেন তখন আর কোন
উপায় নেই। এবার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম যা করার তা করে বাইরের জীবনেও সন্ন্যাস নিয়ে
চলে যেতে হবে। বিপদে পড়ে একবার যখন আমি সন্ন্যাস নিয়ে ফেলেছি তখন আর আমি মিথ্যাচারী
হয়ে নরকে যেতে পারি না। সুতরাং তুমি যদি সত্যি সত্যিই আমার মঙ্গল চাও তাহলে এ কাজে
আমায় বাধা দিও না মা মা।
মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি তখন তোকে সন্ন্যাস নিতে বলেছিলাম, সে শুধু কথার কথা, অন্তরের
কথা নয়। তাছাড়া তুই এখন ছেলেমানুষ, সন্ন্যাস জীবনের এত কষ্ট কি করে সহ্য করবি? শঙ্কর বললেন, যিনি আমায় কুমীরের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছেন
তিনিই আমায় রক্ষা করে চলবেন মা। তুমি সেই ভগবানের হাতেই আমাকে সঁপে দাও।
প্রভাত হলে শঙ্কর যথাবিধি সন্ন্যাস গ্রহণ করতে বসলেন। সন্ন্যাসীর নিকট হতে সন্ন্যাস
লওয়াই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু এক্ষেত্রে তার অন্যথা হল। কলিতে সন্ন্যাস নেই বলে এদেশে
তখন সন্ন্যাসীর অভাব। অগত্যা শাস্ত্রনিপূণ শঙ্কর যথাসম্ভব বিধিপূর্বক সন্ন্যাস গ্রহণ
করলেন। আত্মশ্রাদ্ধ ও বিরজাহোম প্রভৃতি সকলই অনুষ্ঠিত হল। সকলে নিরবে এ দৃশ্য দেখল।
সর্বসম্মুখে অষ্টমবৎসরের বালক শঙ্কর আজ সন্ন্যাসী হলেন।
'ভগবৎ বিগ্রহ রক্ষা'
বাটীর অদূরে শঙ্করের কূলদেবতা ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের মন্দির। তিনি জননীর নিকট বিদায় নিয়ে
প্রথমেই ভগবৎদর্শনে গমন করলেন। পশ্চাতে পাগলিনী প্রায় স্নেহময়ী জননী ও বহু জ্ঞাতিবর্গ।
তথায় শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ দর্শন করে তাঁর হৃদয় আজ এক অপূর্ব ভক্তিভাবে আপ্লুত হল। তিনি
শ্রীবিগ্রহের সস্মুখে পতিত হয়ে করজোড়ে স্তব করতে লাগলেন যা বর্তমানে 'অচ্যুতাষ্টকম্'
নামে প্রসিদ্ধ। শঙ্কর অর্চকগণে আশির্বাদ নিয়ে মন্দির ত্যাগ করে যাচ্ছিলেন এমন সময় অর্চকগণের
একজন মন্দিরের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
শঙ্কর দেখলেন, নদীর গতি পরিবর্তিত হওয়ায় মন্দির ভগ্নোন্মুখ। তিনি ভাবলেন শ্রীবিগ্রহকে যদি অচিরে নিরাপদস্থানে রক্ষা না করা হয়, তাহলে হয়ত কোনদিন তিনি জলাশয়ী হবেন। এই ভাবিয়া শঙ্কর অর্চকগণের অনুমতি নিয়ে স্বয়ং অতিযত্ন ও ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে শ্রীবিগ্রহকে নিয়ে মন্দিরের অদূরে একটি নিরাপদ স্থানে অধিষ্ঠিত করলেন এবং গ্রামবাসিকে তথায় একটি ভব্য মন্দির নির্মাণ করতে অনুরোধ করলেন। তারপরে শঙ্কর কোনদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে জননী, জ্ঞাতিবর্গ ও গ্রামবাসীকে অভিবাদন করে উত্তরাভিমুখে প্রস্থান করলেন।
'গুরু অন্বেষণে শঙ্কর'
ব্যাকরণশাস্ত্র পাঠকালে শঙ্কর যখন পতঞ্জলির মহাভাষ্য অধ্যয়ন করেন, তখন তিনি গুরুমুখে
শুনেছিলেন, স্বয়ং পতঞ্জলি সহস্রবৎসর অতিক্রম হল 'গোবিন্দযোগী' নামে অদ্যাবধি যোগবলে
নর্মদা তীরে এক গুহামধ্যে সমাধিস্থ হয়ে রয়েছেন। তদবধি শঙ্করের ইচ্ছা আহা! যদি একবার
এই মহাযোগীর দর্শন পেতাম। তাই বোধহয় শঙ্কর গৃহত্যাগ করে সেই গুরুর অন্বেষণে চললেন।
কালাডি হতে নর্মদা বহুদূর, পদব্রজে প্রায় মাসাধিক লাগে। কিন্তু সেই অষ্টমবর্ষীয় বালক
মুণ্ডিতমস্তক হয়ে গৈরিকবসন ও দণ্ডকমন্ডলু ধারণ করে রিক্তপদে উর্ধদৃষ্টি ও দৃঢ়সঙ্কল্পে
হয়ে গুরুদর্শন উদ্দেশ্যে চলিলেন। ত্রিসন্ধ্যা স্নান-আহ্নিক, মধ্যাহ্নে ভিক্ষান্নভোজন,
প্রাতে এবং অপরাহ্নে পথভ্রমণ, সন্ধ্যাসমাগমে বৃক্ষমূল বা দেবমন্দির বা পন্থশালায় বিশ্রাম
করতে করতে কতগ্রাম নগর, কতপ্রান্তর নদনদী, কত অরণ্য ভূধর এবং কত রাজ্য অতিক্রম করতে
করতে শঙ্কর নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে নর্মদার উদ্দেশ্যে চললেন।
'সর্প ও ভেকের মিত্রতা'
পরিব্রাজন করতে করতে একদিন তুঙ্গভদ্রার তীরে এসে উপনীত হলেন আচার্য শঙ্কর। তুঙ্গভদ্রা
নদীর তীরে কদম্ববন নামে এক অরণ্যপ্রদেশে প্রবেশ করলেন তিনি। তখন ভরা দুপুর। একে পথশ্রমে
ক্লান্ত তার উপর সূর্যের তেজ বড় প্রখর। শঙ্কর তাই বিশ্রামের জন্য নদীর ধারে একটি গাছের ছায়াতলে বসলেন। সহসা একটি অদ্ভুত দৃশ্য
দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি। নদীর জল হতে একদল ব্যাঙের ছানা লাফাতে লাফাতে নদীর পারে
পাথরের উপরে উঠে বসল। কিন্তু রোদের তাপে পাথরটা গরম হয়ে যাওয়ায় বসতে পারছিল না।
তাই তারা আবার নদীর জলে ফিরে যাবার জন্য উদ্যত হয়ে উঠল। এমন সময় কোথা হতে এক বিরাট একটি সাপ এসে তার চওড়া
ফণাটি বিস্তার করে ব্যাঙের ছানাগুলিকে ছায়াদান করতে লাগল। হিংসা তো দূরের কথা, সাপটি
মার মত পরম স্নেহভরে ছায়াদান করে যেতে লাগল। ছানাগুলিও সাপ দেখে কোনরূপ ভয় করল না।
যে সাপ ও ব্যাঙের মধ্যে চিরকাল এক খাদ্যখাদকের তিক্ত সম্পর্ক সেই সাপ ও ব্যাঙের মধ্যে
কি করে এমন মধুর স্নেহ ভালবাসার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তা ভেবে পেলেন না শঙ্কর।
তিনি বুঝতে পারলেন নিশ্চয় এখানে কোন মহাতপস্বী আছেন নিকটেই যার তপোপ্রভাবে সাপ তার
হিংসাভাব পরিত্যাগ করেছে। চারিদিকে চোখ মেলে তাকিয়ে তিনি দেখলেন কদম্বগিরির গায়ে এক সাধুর কুটির রয়েছে। সেই কুটির লক্ষ্য করে তিনি ধীরে ধীরে উঠে গেলেন
পাহাড়ের উপরে। গিয়ে দেখলেন এক বৃদ্ধ তপস্বী সেই কুটিরে থেকে সাধন ভজন ও তপস্যাকার্য
করেন। তপস্বী বললেন, পুরাকালে এই স্থানেই ছিল মহামুনি ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রম। শঙ্কর এবার বুঝতে পারলেন এই অঞ্চলের সাপ কেন তার
স্বাভাবিক হিংসা ও খলতার ভাব ত্যাগ করেছে। এই মনোরম নির্জন ও অরণ্যসংকুল পার্বত্য প্রদেশে
এক আশ্রম প্রতিষ্ঠার বাসনা জাগে আচার্য শঙ্করের মনে। পরবর্তীকালে এই ইচ্ছা পূরণ করেন
তিনি এবং তার ফলে গড়ে ওঠে বিখ্যাত শৃঙ্গেরী মঠ। পাহাড়
হতে নেমে এসে আবার যাত্রা শুরু করেন শঙ্কর।
'গুরুপদপ্রান্তে শঙ্কর'
দুই মাস ক্রমাগত কত পথ চলতে চলতে পুরাণপ্রসিদ্ধ মাহিষ্মতী নগর পার হয়ে উপস্থিত হন
ওঙ্কারনাথের দ্বীপশৈলে।এই ওঙ্কারনাথ পাহাড়টি নর্মদার স্রোতধারাকে দুভাগে বিভক্ত করে
মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। পুরাণে এই পাহাড়কেই বলা হয়েছে বৈদুর্যমণি পর্বত।
পুরাকালে একসময় ভক্তবীর মান্ধাতার রাজধানী ছিল এই পাহাড়ে। ওঙ্কারনাথ, মহাকাল প্রভৃতি
জাগ্রত লিঙ্গগুলি যুগ যুগ ধরে বিরাজ করছে এই পাহাড়ের কোলে। আজও ভারতের দূর-দূরান্ত
হতে অগণিত তীর্থ-যাত্রীর সমাগম হয় এই সব জাগ্রত শিবলিঙ্গ দর্শনের জন্য।
এই ওঙ্কারনাথ পাহাড়ে এসে হঠাৎ জঙ্গলে ঢাকা এক সংকীর্ণ গুহার মুখ দেখতে পেলেন শঙ্কর।
গুহার মুখে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। দেখলেন, ভিতরে এক প্রশস্থ সুড়ঙ্গপথ
সামনে প্রসারিত হয়ে আছে। কয়েকজন জটাজুটধারী প্রবীণ সন্ন্যাসী ধ্যানস্থ হয়ে আছেন।
গুহাটি একেবারে অন্ধকার নয়। বাইরে থেকে আসা স্বল্প আলোয় মোটের উপর ভিতরটা দেখা যায়।
যে কয়েকজন সন্ন্যাসী ধ্যান করছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ তপস্বীর কাছে গিয়ে
শঙ্কর সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে তাঁকে বললেন, প্রভু, আমায়
ক্ষমা করবেন। আমি মহাযোগী গোবিন্দপাদের দর্শনাভিলাসী। তিনি তাঁর করুণা চাই। বহুদূর
থেকে এই অভিলাষ নিয়ে এসেছি। কৃপা করে তাঁর সন্ধান বলে দিয়ে আমার প্রাণ রক্ষা করুন।
কিছুক্ষণ পরে মৌন সাধক চক্ষু উন্মীলন করে তাকালেন শঙ্করের মুখপানে। দেখলেন, এক বালক
নতজানু হয়ে বারবার সেই একই প্রার্থনা করছে কাতরভাবে। তার চোখ দিয়ে সমানে বেয়ে গড়িয়ে
পড়ছে অবিরল জলের ধারা। বালকের এই সকাতর প্রার্থনায় বিচলিত হলো সাধকের
অন্তর। তিনি হাত তুলে অভয় দিলেন শঙ্করকে। পাথরে পাথরে ঘষে আগুন জ্বেলে সেই আগুনে প্রদীপ
জ্বালালেন সাধক। তারপর সেই প্রদীপটি হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আমাকে অনুসরণ করো।
সেই গিরিগুহার শেষপ্রান্তে একটি গর্ভগুহা ছিল। সেই গর্ভগুহার মুখটি একটি বড় পাথর দিয়ে
বন্ধ করা ছিল। সেখানে গিয়ে থামলেন প্রবীণ সাধক। বললেন, এই গুহার মধ্যেই মহাযোগী গোবিন্দপাদ
সমাধিস্থ অবস্থায় আছেন। সাধনার দ্বারা যাদের সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি খুলেছে, যারা আত্মজ্ঞান
লাভ করেছে তারাই তাঁর কৃপালাভ করে। দীর্ঘকাল ধরে আমরা এখানে সাধনা করে চলেছি তাঁর কৃপালাভের
আশায়। কিন্তু আজও তাঁর কৃপালাভ করতে পারিনি। কবে যে এই মহাযোগী সমাধি হতে জাগবেন তা
কেউ জানে না। তোমার যা কিছু জানাবার এখান থেকেই জানাও।
শঙ্কর তেমনি কাতরভাবে বললেন, প্রভু, আমি যে যোগীরাজ গোবিন্দপাদ দর্শন করার অভিলাষেই
এসেছি। তাঁর আশ্রয় না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাব না আমি। সাধক বললেন, বৎস, বুঝেছি তুমি মহাভাগ্যবান। তাই
এই বয়সেই তোমার মধ্যে জেগেছে এই আধ্যাত্মিক আর্তি। তুমি শক্তিধর। এই পাথরটি সরিয়ে
গুহাদ্বার মুক্ত করে তোমার প্রার্থনা জানাও। অর্জিত তেজ ও আত্মপ্রত্যয়ে উদ্দীপিত হয়ে শঙ্কর
হাত দিয়ে পাথরটি সরাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। এদিকে তখন অন্যান্য সাধকদের ধ্যান ভেঙ্গে
গেছে। তাঁরাও সবাই এসে পাথরটিতে হাত দিলেন। তখন সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় পাথর সরে গেল।
গুহাদ্বার উন্মুক্ত হলো।
প্রদীপের আলোয় দেখা গেল, মহাযোগীর চক্ষুদুটি ধ্যাননিমীলিত রয়েছে তখনো। এই অলৌকিক জ্যোতির আভায় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে তাঁর তপোসিদ্ধ দেহখানি। সে দেহে প্রাণের স্পন্দন না থাকলেও মৃত্যুকে অতিক্রম করে আত্মজ্ঞানের সুউচ্চ স্তরে উন্নীত হয়ে সমাসীন হয়ে আছেন হয়ে আছেন তিনি। বালক শঙ্কর তখন মহাযোগীর স্তব করতে লাগলেন একমনে। তাঁর স্তবগান শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন সাধকেরা। তাঁরা বুঝলেন, এ বালক নিশ্চয় দৈববলে বলীয়ান, তা না হলে সমাধিস্থ গোবিন্দপাদের মত মহাযোগীর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নির্ভীকভাবে স্তবগান করতে সাহস করত না। অথবা এ হয়ত যোগীরাজের লীলা, তাই তিনি হয়ত তাঁর চিহ্নিত শিষ্যকে আকর্ষণ করে এনেছেন তাঁর কাছে। যোগীরাজ বালক শঙ্করের স্তবে তুষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন। মুমুক্ষূ বালককে অভয় ও আশ্রয় দিলেন তখনি।
গোবিন্দ শঙ্করের পরিচয় জানতে চাইলে, শঙ্কর মুখে মুখে একটি শ্লোক রচনা করেন। এই শ্লোকটিই অদ্বৈত বেদান্ত তত্ত্ব প্রকাশ করে। গোবিন্দ তা শুনে খুব খুশি হন এবং শঙ্করকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। শ্রীগুরু গোবিন্দপাদ্ সম্প্রদায়ানুসারে 'তত্ত্বমস্যাদি' বাক্য দ্বারা শাশ্বত অদ্বৈত ব্ৰহ্মতত্ত্ব উপদেশ করলেন, ব্যাসদেব যা আপন পুত্ৰ শুকদেবকে করেছিলেন। শুকদেব হতে গৌড়পাদ, গৌড়পাদ হতে গোবিন্দপাদ লাভ করেছিলেন। গোবিন্দপাদ্ হতে শঙ্কর প্রাপ্ত হলেন।
গুরু গোবিন্দভগবৎ পাদ্ শঙ্করকে প্রথমে হঠযোগের
শিক্ষা দিলেন, শঙ্কর অতিঅল্প সময়েই তাতে অভ্যস্ত হতে লাগল। দ্বিতীয় বৎসরারম্ভে গোবিন্দ
শঙ্করকে রাজযোগে দীক্ষিত করলেন। তাতেও শঙ্কর আশাতীত নিপূণতা প্রদর্শন করলেন। তৎপরে
তৃতীয় বৎসরারম্ভে গোবিন্দপাদ্ শঙ্করকে ব্রহ্মসূত্রের ব্যাসশুক-সম্প্রদায়লব্ধ অর্থ ও
পরমার্থ জ্ঞানযোগ উপদেশ করতে লাগলেন-শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের প্রকৃত রহস্য উপদেশ
করতে লাগিলেন। শুতিধর মহাপন্ডিত শঙ্কর শুনিবামাত্র তা আয়ত্ত্ব করে ফেলতেন। ধীরে ধীরে
গুরুকৃপায় শঙ্করের অপরোক্ষানুভবও হতে লাগল। তৃতীয় বৎসরান্তে গোবিন্দপাদ্ দেখলেন শঙ্করভগবদ্পাদের
সাধনা শেষ হয়েছে। শঙ্করের মুখেশরীরে এক দিব্যানন্দ প্রস্ফুটিত হয়েছে। স্বয়ং শিব পরমহংসচৰ্য্যা অঙ্গীকার করে “ব্রহ্মৈবাস্মি”
“ব্রহ্মই আমি” এই নিশ্চয় করত সর্বত্র অসঙ্গ হলেন। ব্রহ্মক্ষীর জগৎ নীর হংস বৃত্তিতে
অনুভব করিয়া ঐগুরু চরণার্চনাতে নিরত এবং নর্মদা-নদী তটে অবস্থিত হলেন।
একবার বর্ষাকালে কয়েকদিন ধরে প্রবল বর্ষণ হওয়ার ফলে নর্মদা নদীতে বন্যা দেখা দেয়।
নদীর জল ফুলে উঠতে থাকে প্রতি মুহূর্তে। নদীর জলস্রোত কূল ছাপিয়ে ওঙ্কারনাথ পাহাড়ের
গায়ে ক্রমাগত ধাক্কা মারতে থাকে। এদিকে যোগীবর গোবিন্দপাদজী তখন তাঁর নিজস্ব গুহার
মধ্যে সমাধিমগ্ন হয়েছিলেন। তাঁর কোন বাহ্যজ্ঞান ছিল না। বন্যার অবস্থা দেখে শঙ্কিত
হয়ে পড়েন শিষ্যরা। বন্যার জল বাড়তে বাড়তে গুহার মুখের কাছে এসে পড়েছে। এরপর জলস্রোত
গুহার ভিতরে ঢুকে সমাধিস্থ গুরুদেবের জীবন বিপন্ন করে তুলবে। বন্যার আগ্রাসী স্রোতের
গতি রোধ যেমন সম্ভব নয় তেমনি সমাধিস্থ গুরুদেবের ধ্যান ভাঙ্গিয়ে তাঁকে পাহাড়ের ঊর্ধ্বতন
কোন স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়।
এই সব দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন শিষ্যরা। আচার্য শঙ্কর সব কিছু লক্ষ্য করে শেষে এগিয়ে
এসে বললেন, আপনারা উদ্বিগ্ন হবেন না। আমাদের গুরু মহারাজ ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ। তার উপর
তিনি এখন সমাধিমগ্ন। এ অবস্থায় কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাঁর কোন অনিষ্ট সাধন করতে
পারবে না। মহাযোগীর সঙ্গে প্রকৃতি সহযোগিতা করতে বাধ্য। তাছাড়া তাঁর আশীর্বাদে এ বন্যার
গতিরোধ আমিই করতে পারব।
এই বলে একটি মাটির বড় কলসী এনে কাত করে গুহার মুখের কাছে রেখে দিলেন তিনি। এরপর দেখা
গেল বন্যার ঢেউগুলি প্রবল উচ্ছ্বাসে গুহাদ্বারে এগিয়ে আসতে সেই কলসীর মুখে প্রবেশ
করার সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কোথায়। স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে ঢেউগুলির সব উচ্ছ্বাস।
দেখতে দেখতে বন্যার সব জলোচ্ছ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। জলের বিপদ সীমানা থেকে আশ্চর্যভাবে
রক্ষা পেয়ে গেল সেই সাধনগুহাটি। এ ব্যাপারে কিশোর শঙ্করের যোগশক্তির পরিচয় পেয়ে
তাঁকে সাধুবাদ দিতে লাগলেন শিষ্যরা।
গুরু গোবিন্দপাদের সমাধিভঙ্গ হবার পর সব কিছু শুনে প্রসন্ন হয়ে তিনি শঙ্করকে বললেন,
আমার আশীর্বাদ তুমি লাভ করেছ। আমার আশীর্বাদে তুমি আত্মকাম হয়ে উঠেছ। সর্বশাস্ত্রের
তত্ত্ব ও সর্বজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে যোগ বিভূতি করতলগত হয়েছে তোমার। আর কিছু প্রার্থনা
থাকে তো বল। গুরুদেবকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে করযোড়ে শঙ্কর
বললেন, প্রভু, আপনার কৃপায় আমার সকল অভাব দূর হয়েছে। আমার প্রার্থনার আর কিছুই নেই।
আপনি কৃপা করে আমায় অনুমতি দিলে এবার সমাধিস্থ হয়ে এই মরদেহ ত্যাগ করে ব্রহ্মের মধ্যে
নিজেকে বিলীন করে দিতে চাই।
গোবিন্দপাদ
কিছুক্ষন গম্ভীর হয়ে চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, বৎস, দেহত্যাগের সময় তোমার এখনো
আসেনি। যে যুগ-প্রয়োজনে তুমি এসেছ সে কাজ তোমার এখনো শেষ হয়নি। অদ্বৈত ব্রহ্মের জ্ঞান নতুন করে প্রচার করতে হবে
তোমায়। লুপ্ত তীর্থগুলি উদ্ধার করতে হবে। সাধু সন্ন্যাসীদের মধ্যে যে পাপ ও অনাচার
ঢুকেছে তার সংস্কার সাধন করে এদেশের অধ্যাত্ম জীবনকে পুনর্গঠিত করে তুলতে হবে। দেশের
ঈশ্বরবিমুখ জনসমাজকে ঈশ্বরমুখী করে কল্যাণের দিকে নিয়ে যেতে হবে তোমাকে। শঙ্কর তেমনি করযোড়ে বললেন, আদেশ করুন কি করতে
হবে আমায়?
গোবিন্দপাদ্
শঙ্করের সিদ্ধি দেখে শঙ্করকে বললেন-'শঙ্কর! তুমি বৈদিক ধর্ম রক্ষার্থে ভগবানের শিবের
কৃপায় ধরাধামে জন্মেছ। তোমার এই আগমনবার্তা আমি আমার গুরু গৌড়পাদের থেকে শ্রবণ করেছি।
তোমাকে সম্প্রদায়ক্রমে রক্ষিত অদ্বৈতব্রহ্মজ্ঞান দিবার জন্যই আমি এযাবৎকাল জীবিত ছিলাম।
এখন আমার কার্য্য শেষ, মহাসমাধির সময় হয়েছে। তুমি এক্ষণে কাশীধাম যাও এবং বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের একটি ভাষ্য লিখে অদ্বৈত
বেদান্ত প্রচার কর। সেখানে সদাশিব তোমাকে সাক্ষাৎ দর্শন দিবেন।'
এইবলে তাকে বিদায় করলেন। শঙ্করও গুরুর চরণ বন্দনা করে বারাণসী যাত্রা করলেন, এবং অচিরে
গঙ্গালঙ্কৃতা-কাশী প্রাপ্ত হয়ে প্রণাম ও ভাগীরথী-প্রবাহে অবগাহন করলেন। পরে যথাবিধি
বিশ্বেশ্বরের পূজা করে সেই মোক্ষ-প্রদ-ক্ষেত্রে সুর-তরঙ্গিন তটে অবস্থিত হলেন। শঙ্কর, বিমল-সুখ-জননী শম্ভুপুরী
কাশীতে জাহ্নবী-সলিলে মজ্জন করে, বেদান্ত বাক্যে আত্মতত্ত্ব বিচার করত অচল পদে সন্নিবিষ্ট
হলেন।
'শঙ্করের সনন্দনাদিকে শিষ্যত্বে গ্রহণ'
শ্ৰীমৎ শঙ্কর-যতি বারাণসীতে অবস্থিত হলে, একদিন, একান্তে এক বেদপারগ ও বৈরাগ্যাদি সমন্বিত ব্রাহ্মণ আগত হয়ে তাঁকে দণ্ডবৎ প্রণাম করলেন। যতীশ্বর তাঁকে উত্থাপন করে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? কোথা হতে সমাগত? দ্বিজবর পুটপাণি হয়ে বিনতভাবে স্বীয় বিবরণ নিবেদন করতে লাগলেন, চৌলদেশ বাসিন্দা, সংসারানলতাপ-সন্তপ্ত, সজ্জন দর্শনার্থী, আমি বহু দেশ ভ্রমণ করে দৈবযোগে এই কাশীপুরী প্রাপ্ত হয়েছি। পূৰ্ব্ব সঞ্চিত পুণ্যফলোদয়ে অদ্য যতি-রাজের শরণে স্নিগ্ধ হলাম। হে কৃপানিধে! অধুনা এ ভব-তাপ সন্তপ্যমানকে ঘোর সংসার হতে রক্ষা করুন। কৃত্রিম সুখে অভিলাষ হয় না। সলোকপাল লোক সকল বিনশ্বর ও নানা দোষাক্রান্ত, তাহাতে রুচি নাই। সংসারাময় শান্তি মানসে সদ্বৈদ্য যতি-রাজের শ্রীচরণ আশ্রয় করলাম। শঙ্কর-স্বামী, দ্বিজবরের এরূপ বিনয়ান্বিত ও বৈরাগ্য গৰ্ভিত বাক্য শ্রবণ করে করুণ-রসাদ্র-চিত্তে তাঁকে শিষ্যত্বে গ্রহণ করলেন, এবং সাধন সম্পন্ন, বিরক্ত ও জিতেন্দ্রিয় জেনে সন্ন্যাস প্রদান করে বেদের 'তত্ত্বমস্যাদি' বাক্যে স্বাত্মতত্ত্ব উপদেশ করলেন। শঙ্কর-গুরুর এই প্রথম শিষ্য সনন্দন (পদ্মপাদাচর্য্য) হলেন। অনন্তর যে সমস্ত বিরক্ত মুমুক্ষগণ শরণাগত হলেন, সকলে শিষ্যত্বে অনুগৃহীত হয়ে কৃতাৰ্থতা লাভ করলেন। লোক-শঙ্কর লোক সকলকে নানাবিধ শাস্ত্রোদিত শব্দ-জালে ভ্ৰমিত ও সংসার সাগরে নিমগ্ন পর্য্যাবেক্ষণ করে, কৃপাবশে ব্রহ্ম অদ্বৈত উপদেশে কৃতকৃত্য করলেন।
'শঙ্করের শিব দর্শন ও তত্ত্ব সংবাদ'
একদিন, শঙ্কর-যতীশ্বর অবগাহন মানসে উত্তর-বাহিনী সুর-তরঙ্গিণী নদীতে গমন করছিলেন। পথিমধ্যে,
এক মন্দাকৃতি চাণ্ডাল চারটী কুকুর সহিত, নয়ন গোচর হল। শঙ্কর তাঁকে
সম্মুখে দেখে “চল চল, পথ ছাড়, স্পর্শ করো না” এই বাক্য বললে। চাণ্ডাল শঙ্করের উক্তি
শ্রবণ করে হাস্য বদনে বেদান্ত সংসিদ্ধ এই ন্যায়যুক্ত বাক্য বললেন, "শ্রুতিতে নির্ণীত অদ্বিতীয়, অসঙ্গ, সৎ,
অখণ্ড, সুখরূপ যে পদার্থ তাতে তোমার ভেদ কল্পনা, আশ্চর্য্য!, যতিবর! তুমি 'গচ্ছ গচ্ছ’
কি বলছ? অন্নময় হতে অন্নময়কে, কি চৈতন্য হতে চৈতন্যকে, দূরীকৃত করতে বাঞ্ছা করেছ?
স্থুল শরীর সকল অন্নময়, তার জীব সকল চৈতন্য। অতএব অন্নময়কে অন্নময় হতে ও চৈতন্যকে
চৈতন্য হতে দূরীকরণ সম্ভব নয়। তুমি তা কিরূপে করতে চাও?
আচার্য্য
শঙ্কর জ্যোতির্ধামে এসে আবার রাজ্যশ্রী দেখতে পেলেন। এই স্থলেই বিষ্ণুগঙ্গা ও অলকানন্দা
মিলে বিষ্ণুপ্রয়াগ নামক প্রসিদ্ধ তীর্থ সৃষ্টি করেছে। উত্তরাখণ্ডে তখন কত্তুরীবংশীয়
রাজাদিগের রাজত্ব। জ্যোতির্ধাম ত্যাগ করে আচার্য্য বিষ্ণু প্রয়াগ, ধবলগঙ্গা, ব্রহ্মকুণ্ড,
বিষ্ণুকুণ্ড, ভৃঙ্গিকুণ্ড, গণেশতীর্থ, পাণ্ডুকেশ্বর, বৈখানস তীর্থ অতিক্রম করে বদরিকাশ্রমে
প্রবেশ করলেন। ভূবৈকুন্ঠ নামে প্রসিদ্ধ ভারতবর্ষের পবিত্র চারধামের একটি বদরিকাশ্রম।
পথিপতিত
এইসব তীর্থ দর্শন করতে করতে জগদ্গুরু শঙ্কর বদ্রীক্ষেত্রাধীশ্বর পরমপাবন সেই নারায়ণের
মন্দিরে আসলেন। সেখানে তপ্তকুণ্ডে স্নানাদি করে আচার্য্য সশিষ্য ভগবদ্দর্শনে গমন করলেন,
দেখলেন মন্দিরে সেই ঋষি প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ নেই। তৎপরিবর্তে শালগ্রাম শিলায় অর্চনা হচ্ছে।
আচার্য্য যথাবিধি তাঁর অর্চনা করে মন্দিরের বহির্ভাগে এসে চিন্তাকুলিত চিত্তে উপবিষ্ট
হলেন। শিষ্যগণও আচার্য্যের এই ভাবান্তর দেখে নিশ্চেষ্টভাবে অবস্থিত হলেন। স্থানীয় ব্রাহ্মণপণ্ডিত
ও অর্চকগণের আদর-অভ্যর্থনার প্রতি কারও দৃষ্টি নেই। সকলেই সসম্ভ্রমে দণ্ডায়মান।
ক্রমে
এই অপূর্বদর্শন সন্ন্যাসীগণকে দেখিবার জন্য লোক সমাগম হল। শঙ্কর কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধ
থেকে তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলেন-‘মহাত্মগণ! মন্দির ভগবদ্বিগ্রহশূন্য কেন? চারযুগেই তো
ভগবান এইস্থানে প্রতিষ্ঠা থাকবার কথা।’অর্চকগণ বললেন-‘মহাশয়! চীনদেশীয় অভিযানের ভয়ে
আমাদের পূর্বপুরুষগণ অদূরে কোন এক কুণ্ডমধ্যে ভগবদ্বিগ্রহটি রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু
পরে তাঁরা আর বিগ্রহটির পুনরুদ্ধার করতে পারেন নি। তদবধি শালগ্রাম শিলাতেই ভগবানের
পূজা হয়ে আসছে।’
শঙ্করাচার্য্য
তা শুনে ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থেকে বললেন-‘যদি সেই বিগ্রহ এখন পাওয়া যায়, তাহলে আপনারা
যথাবিধি তাঁহর পূজা করতে প্রস্তুত আছেন কি?’ অর্চকগণ হতাশহৃদয়ে বললেন-‘পূর্বে বহু চেষ্টা
হয়ে গেছে। প্রাপ্তির আশা আর আমাদের নেই। তবে যদি পাওয়া যায়, তাহলে পূজার কোনরূপ ত্রুটিই
হবে না।’
আচার্য্য
শঙ্কর তখন তাঁদেরকে কিছু না বলে নারদকুণ্ডের দিকে অগ্রসর হলেন। শিষ্যগণ ও অর্চকগণ কৌতূহল-পরবশ
হয়ে পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। আচার্য্য নারদকুণ্ডে অবতরণোদ্যত হলেন। ইহা দেখে কতিপয় ব্যক্তি
বললেন-‘মহাত্মন্! এই কুণ্ডের সহিত তলদেশে অলকানন্দা নদীর যোগ আছে। এতে অবতরণ করলে প্রাণহানি
ঘটবে-সন্দেহ নেই। স্রোতে আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে। অনেকে এখানে জলমধ্যে প্রাণ হারাইছে।’
শঙ্কর
সে কথায় কর্ণপাত না করে কুণ্ডমধ্যে অবতরণ করলেন এবং জলমধ্যে নিমজ্জিত হয়ে একটি শিলাফলক
হস্তে নিয়ে উঠলেন। দেখলেন- ফলকে পদ্মাসনবদ্ধ চতুর্বাহু বিষ্ণুমূর্ত্তি, কিন্তু দক্ষিণ
কোণটি তার ভেঙ্গে গিয়ে যেন হস্তের কয়েকটি অঙ্গুলিরও ক্ষতি করেছে। আচার্য্য এই খণ্ডিতমূর্ত্তি
দেখে ভাবলেন- বদরী নারায়ণমূর্ত্তি কখনও খণ্ডিত হতে পারেন না। অতত্রব ইহাকে পার্শ্ববর্তী
গঙ্গাজলে বিসর্জন দেয়াই শ্রেয়। বিসর্জন পরে আচার্য্য পুনরায় কুণ্ডজলে নিমজ্জিত হলেন।
কিন্তু এবারও তিনি সেই একই বিগ্রহ নিয়ে উঠলেন এবং পূর্বমূর্ত্তি চিনতে পেরে ভাবলেন
গঙ্গাস্রোতে বোধহয় সেইমূর্ত্তি পুনরায় এসে উপস্থিত হয়েছে। অগত্যা তিনি বিগ্রহটিকে এবার
গঙ্গার অধোদিকে একটু দূরে বিসর্জন দিয়ে পুনরায় জলমধ্যে নিমজ্জিত হলেন। এবারও আচার্য্য
একটি মূর্ত্তি নিয়ে পূর্ববৎ উঠলেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়, শঙ্কর দেখলেন সেই পূর্বমূর্ত্তি।
তখনই
আচার্য্য এক দৈববাণী শুনতে পেলেন-‘শঙ্কর! ভ্রান্ত হইও না, কলিতে এই মূর্ত্তিতেই পূজা
হবে!’ আচার্য্য শঙ্কর তখন ভক্তিচিত্তে সেই মূর্ত্তিটি স্বয়ং স্কন্ধে করিয়া মন্দির মধ্যে
আনলেন। দর্শকবৃন্দ সকলেই স্তম্ভিত, সকলেই বিষ্ময়বিহ্বল হৃদয়ে কখনও ভগবদ্বিগ্রহকে প্রণাম
করেন কখনও বা আচার্য্য শঙ্করের পদধূলি নিতে লাগলেন। ভগবান বদরীনারায়ণ ও আচার্য্য শঙ্করের
জয়ধ্বনিতে বদরীক্ষেত্র প্রতিধ্বনিত হল। অনন্তর আচার্য্য যথাবিধি ভগবানের অভিষেকাদি করে
অর্চকগণের হস্তে সেবাভার অর্পণ করলেন এবং কালবিলম্ব না করে অদূরে ব্যাসতীর্থ অভিমুখে
অগ্রসর হলেন। এইভাবে শঙ্কর আবির্ভাবের ফলে ভগবান বদরীনারায়ণের পূজা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত
হল।
'ব্যাসতীর্থে ভাষ্য রচনা'
বদরীনাথে
নারায়ণবিগ্রহ উদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে শঙ্করাচার্য্য ব্যাসতীর্থাভিমুখে গমন করলেন।
ব্যাসতীর্থ মহামুনি ব্যাসদেবের আশ্রম। এখানে ভগবান ব্যাস পূর্বে মহাভারত রচনা করেছিলেন।
ইহার নিম্নে কেশব প্রয়াগ। এখানে অলকানন্দার সঙ্গে কেশবগঙ্গার সঙ্গম। বদরীনারায়ণ মন্দির
অতিক্রম করে উত্তরদিকে ক্রমোচ্চ ত্রিকোণক্ষেত্রের পূর্বপশ্চিমব্যাপী একটি বাহুরূপে
অবস্থিত সেই বিশাল বিরাটকায় হিমগিরির পাদদেশে এই আশ্রম-একটি প্রকাণ্ড গুহাবিশেষ। গুহার
বহির্দেশে দক্ষিণভাগে সরস্বতীদেবীর মন্দির এবং বামভাগে গণপতি দেবের মন্দির। পূর্বে
কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাস যখন মহাভারত রচনা করেন, তখন ভগবান গণেশ লিখতেন এবং ব্যাসকূটের
অর্থ লেখক বুঝে লিখছেন কিনা-তা সাক্ষ্য দেবার জন্য সরস্বতী দেবী তথায় উপস্থিত থাকতেন।
শঙ্করাচার্য্য শিষ্য সমেত এই গুহামধ্যে অবস্থিতি করতে লাগলেন। শীতকালের ছয়মাস গুহামধ্যেই আবদ্ধ থাকেন এবং অপর ছয়মাস মনুষ্যের মুখ দেখতে পান। জ্যোতির্ধামের তৎকালীন রাজা আচার্য্যের এখানে অবস্থিতির সমুদায় ব্যবস্থা করে দিয়াছিলেন। সুতরাং নিরুপদ্রবে আচার্য্য শঙ্কর বেদান্তের ভাষ্য রচনা করতে লাগলেন। এইরূপে যতই দিন যেতে লাগল আচার্য্য-সমীপে এখানে বৌদ্ধ, জৈন, সাংখ্য, পাতঞ্জল, বৈখানস প্রভৃতি সম্প্রদায়ের পণ্ডিতেরা আসতেন, অনেকেই নিজ নিজ মতপুষ্টির জন্য আচার্য্যের সঙ্গে বাদবিচারেও প্রবৃত্ত হতেন। বিজিগীষুরা পরাস্ত হতেন, বাদীরা সত্যোপব্ধি করতেন, জিজ্ঞাসুগণ ছিন্নসংশয় হতেন, সাধকরা চরিতার্থ লাভ করতেন।
এইভাবে
ভগবপাদ্ শঙ্করাচার্য্য চার বৎসরের মধ্যে ব্রহ্মসূত্র, দ্বাদশ বৈদিক মুখ্য উপনিষদ্ এবং
মহাভারতের ভগবদ্গীতা, বিষ্ণুসহস্রনাম ও সনৎসুজাতীয় সংবাদ- এই ষোলখানি শাস্ত্রের ভাষ্য
রচনা করলেন। এতে বস্তুঃত বেদান্তের প্রস্থানত্রয়েরই ভাষ্য বিরচিত হল, যেহেতু ব্রহ্মসূত্র
গ্রন্থ ন্যায়প্রস্থান, উপনিষদ্গুলি শ্রুতিপ্রস্থান এবং ভগবদ্গীতা, বিষ্ণুসহস্রনাম ও
সনৎসুজাতীয় সম্বাদ স্মৃতিপ্রস্থান বলে পরিচিত। ভাষ্য রচনার সঙ্গে সঙ্গে ভাষ্যপাঠও হত।
আচার্য্যের সকল শিষ্যই ভাষ্য পড়তেন, তবে সনন্দন তথা পদ্মপাদাচার্য্য একাধিকবার পড়তেন। এইভাবে শঙ্করাভির্ভাবে ফলে বৈদিকপণ্ডিত সমাজ বেদান্তাদি
শাস্ত্রের প্রাচীনতম ও অপ্রতিদ্বন্দী 'শাঙ্করভাষ্য' উপহারস্বরূপ হিসেবে প্রাপ্ত হলেন।
গীতা-বেদান্তাদি শাস্ত্রের আলোচনায় শঙ্করপ্রণীত শাঙ্করভাষ্যের এতটাই অপ্রতিহত প্রভাব
ছিল যে তা শাস্ত্রার্থ বিচারে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তী কালে এই শাঙ্করভাষ্যের
উপরই অধিকাংশ প্রাজ্ঞ পন্ডিত; যেমন আনন্দগিরি, মধুসূদনসরস্বতী প্রমূখ টীকাকারদের টীকাদি
রচিত হয়েছিল।
'সনন্দনকে পদ্মপাদ নাম প্রদান'
এক সময়, শঙ্কর গঙ্গাতীরে উপবিষ্ট হয়ে, গঙ্গার অপর পার স্থিত শিষ্য সনন্দনকে আহবান করলেন। সনন্দন গুরুর আদেশে গমনোদ্যত হয়ে বিবেচনা করলেন, যিনি অপার ও দুস্তর সংসার পারাবার হতে অধীন ভক্তজনকে তারণ করছেন, তিনি সামান্য স্রোতস্বতীতে কি তারণ করবেন না? দৃঢ় ভক্তিতে এই রূপ নিশ্চয় ও নির্ভর করে জাহ্নবী জলে প্রবিষ্ট হলেন। এবং যেমত যেমত পদ বিক্ষেপ করতে লাগলেন, পদরক্ষণ জন্য জলের উপর এক একটা পদ্ম উদ্ভব হতে লাগল। সেই পদ্মে পদনিবেশ পূর্বক শ্রীগুরুর পদান্তিকে সমুপস্থিত হলেন। গুরু শিষ্যকে এইপ্রকার অদ্ভুত ব্যাপার পর্য্যবেক্ষণ করে, এবং তার পদে পদে পদ্ম প্রকাশ হয়েছিল বলে তার নাম পদ্মপাদ রাখলেন।
'শৈবগণের শঙ্করের নিকট পরাজিত'
এক
সময়, যতীশ্বর, অমাত্যবর্গ-পরিবৃত-ভূপতি তুল্য, শিষ্যগণে বেষ্ঠিত হয়ে বেদ অধ্যাপন
করছিলেন। হঠাৎ কতিপয় বেদান্ত-বিজ্ঞান-শূন্য শৈব যতিবরকে দর্শন করতে সমাগত হল। তারা
জিগীষাপর অনুভূত হওয়ায় শঙ্কর বেদান্তানুযায়ী তর্ক দ্বারা তাদের বিকল্প সকল নিরাস
ও তন্মতাভাস প্রচণ্ডাগম যুক্তিতে খণ্ড খণ্ড করেছিলেন। তারা স্বীয় পক্ষ পরিত্যাগ করে আচার্য্যে শিষ্যত্বে
প্রবিষ্ট হলেন। চারবৎসর ব্যাসগুহায় অবস্থানকালে আচার্য্যের পাণ্ডিত্য সমগ্র উত্তরাখণ্ডে
এক ধর্ম্মবিপ্লবের সৃষ্টি হল। দিকে দিকে লোক সমাগম হতে লাগল, শুরু হল পুনরায় বেদবেদান্তের
চর্চা। বহু ব্রাহ্মণপণ্ডিত নিযুক্ত করে শিষ্যগণ আচার্য্যরচিত ভাষ্যাদি গ্রন্থের প্রচার
শুরু করল। জ্যোতির্ধামের তৎকালীন মহারাজেরও তা দৃষ্টিগোচর হল। তিনি আচার্য্যের স্বাচ্ছন্দ্যবিধান
ও তীর্থগুলো সংস্কার করবার জন্য আচার্য্যের সঙ্গী হলেন। ভগবৎইচ্ছায় পুনরায় তান্ত্রিক
ও বৌদ্ধধর্ম্ম প্লাবিত উত্তরাখণ্ডে বৈদিক ধর্ম্মের গৈরিক ধ্বজা আন্দোলিত হল।
'উত্তরাখন্ডের
তীর্থাদিসমুদ্ধার'
উত্তরাখন্ডের তীর্থাদিসমুদ্ধার করিয়া শঙ্কর কেদারনাথের উদ্দেশ্যে গমন করিলেন। বদরী
হতে কেদারের পথ অতীব দুর্গম। পথিমধ্যে বহু উচ্চপর্বত ও তীর্থাদি অতিক্রম করে যেতে হয়।
রাজকর্ম্মচারীগণ আগে আগে পথ পরিস্কার করতে করতে চলছিলেন। আচার্য্য, মহারাজ ও শিষ্যগণ
পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাচ্ছেন। এইরূপে নন্দপ্রয়াগের পথ ধরে কল্পেশ্বর তীর্থে আসলেন। পঞ্চকেদারের
মধ্যে এটি পঞ্চম। অনন্তর গোপেশ্বর, অনুসূয়াদেবী, রুদ্রনাথ নামক চতুর্থকেদার এবং তুঙ্গনাথ
নামক তৃতীয় কেদারে আসলেন। তুঙ্গনাথের ব্রাহ্মণগণ আচার্য্যের সাথে শাস্ত্রচর্চা ও অদ্ভূত
জ্ঞানপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তার একটি প্রস্তরমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তুঙ্গনাথ ত্যাগ করে
সকলে বাণরাজার রাজধানী শোণিত পুরে আসলেন। বাণরাজার কন্যা ঊষার তপস্যাস্থান এটি। এইস্থানে
মান্ধাতারাজ ও তপস্যা করেছিলেন। অনন্তর সকলে তারপর গুপ্তকাশীতে আসলেন। তথায় বিশ্বনাথ
প্রভৃতি দর্শন করে কালীপীঠ, তৎপরে মধ্যমেশ্বর নামক দ্বিতীয় কেদার দর্শন করে নারায়ণস্থান, মহিষমর্দিনী, শাকম্ভরী,
ত্রিযুগীনারায়ণ, শোণপ্রয়াগ, মস্তকহীন গনেশাদি তীর্থসমূহ দর্শন করে আচার্য্য শিষ্য ও
রাজার সহিত গৌরীকুণ্ড এসে উপস্থিত হলেন। এটি জগজ্জননী গৌরীর তপস্যার স্থান। এখানে একটি
তপ্ত জলকুণ্ড ও একটি শীতল জলকুণ্ড আছে। কেদারের শীত যাঁরা সহ্য করতে পারে না, তাঁরা
এখানে নিত্য অবস্থিতি করে নিত্য কেদারেশ্বরের দর্শনাদি করে। এইস্থান হতে কেদারক্ষেত্রের
আরম্ভ। গৌরীকুণ্ড পরিত্যাগ করে চীরবাসা ভৈরব তৎপরে 'ভীমসেন স্থান' হয়ে কেদারে আসতে
হয়।
'কেদারনাথে শঙ্কর'
স্বর্গদারের পথে এটি তৃতীয় দ্বার। ইহারই পর স্বর্গারোহন পর্বত। পাণ্ডবগণের তপস্যা স্থান
এটি, এই স্থান হতেই পাণ্ডবগণ মহাপ্রস্থানে গমন করেছিলেন। ভগবান্ কেদারেশ্বর
জ্যোতির্লিঙ্গ এখানে শুদ্ধরূপে বিরাজমান। সশিষ্য আচার্য্য কেদারনাথের যথাবিধি পূজা
অর্চনা করলেন। বদরী অপেক্ষা এখানে শীত অত্যাধিক। শিষ্যদের
প্রচন্ড শীতকাঁপুনি দেখে শঙ্কর ধ্যানস্থ হলেন। যোগদৃষ্টিতে ও রাজভৃত্যগণের সহায়তায়
তপ্তবারিধারা অন্বেষনপূর্বক করুনার অবতার শঙ্কর শিষ্যদের কষ্ট দূরীভূত করলেন।
আচার্য্য কেদারে মাসাধিক কাল অবস্থান করে শঙ্কর ভাগীরথীর উৎপত্তিস্থল গোমুখী পথে অগ্রসর
হলেন। আচার্য্য পুনরায় গৌরীকুণ্ড এসে ত্রিযুগীনারায়ণ, বৃদ্ধ কেদার প্রভৃতি দুর্গম তীর্থের
ভিতর দিয়ে বহু অত্যুচ্চ শৈলশৃঙ্গ অতিক্রম করে শঙ্কর ভাগীরথীর তীরে উপস্থিত হলেন। এখানে ভাগীরথীর শোভা
অতি অপূর্ব, অতঃপর এই ভাগীরথীর তীর
ধরে ক্রমে রাজা ও ভৃত্যগণসহিত সশিষ্য আচার্য্য গঙ্গোত্রী
নামক স্থানে আসলেন। শীত এখানে কেদারনথের মতই। তথাপি সকলে গঙ্গোত্রীর দিকে অগ্রসর হলেন।
সেখানে একটু শব্দ হলে পর্বতগাত্র হতে তুষার পিণ্ড স্খলিত হয়ে পড়ে। মৃত্যুর ঝুঁকি পদে
পদে। দুঃসাহসী পরিব্রাজকাচার্য্য শঙ্করের উৎসাহে সকলে তা অতিক্রম করে গোমুখীতে এসে
উপস্থিত হলেন। আচার্য্য দেখলেন-চিরতুষারাবৃত পর্বতগাত্র ভেদ করে বহু উচ্চ হতে যেন একটি
গোমুখাকৃতি স্থানের ভিতর দিয়ে নির্মল বারিধারা নির্গত হচ্ছে। এই পর্বতের শিখরে অতিবৃহৎ
তুষারাবৃত বিন্দু সরোবর। পুরাণের বর্ণনায় আছে, এইস্থানেই স্বর্গ হতে গঙ্গা ভূপৃষ্ঠে
পতিতা হয়েছেন। যথারীতি তীর্থকৃত্য করে সকলে আবার বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করে গঙ্গোত্রীতে
ফিরলেন। গুরুসঙ্গ ও ভগবৎকৃপায় তাদের কারও প্রাণহানি ঘটল না। গঙ্গোত্রী এসে আচার্য্য
স্থির করলেন গঙ্গোত্রীতে তীর্থযাত্রিদিগের জন্য রাজার সহায়তায়
শিবলিঙ্গ ও গঙ্গাদেবীর মূর্ত্তিস্থাপন করবেন। যাতে এই পর্যন্ত এসেই তাদের মহাদেবাদি
দর্শনে গোমুখীদর্শনের ফল প্রাপ্ত হয়। অতঃপর আর যেন সাধারণ তীর্থযাত্রীদের প্রাণসংশয়ী
পথে গমন করতে না হয়। জগদ্গুরুর আদেশে ও মহারাজের ইঙ্গিতে সেইস্থনে দেবতাস্থাপন ও মন্দির
প্রতিষ্ঠিত হল। আচার্য্য কিছুদিন এখানে অবস্থান করে সকলের ইচ্ছানুসারে এবার দক্ষিণদিকে
উত্তরকাশীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
'বেদব্যাস সমাগম'
বহুপথ অতিক্রম করে আচার্য্য সকলের সঙ্গে উত্তরকাশীতে আসলেন। এখানে কাশীধামের সকল দেবদেবীই
আছেন, গঙ্গাও উত্তরবাহিনী। শঙ্করাচার্য্য, যতীশ্বর, সুর-তরঙ্গিণী তীরে অবস্থিত হয়ে,
প্রতিনিয়ত শিষ্যবৃন্দকে স্বকৃত শারীরক ভাষ্য অধ্যাপনে নিরত ছিলেন। এক দিবস মধ্যাহ্ন
সময়ে পাঠ সমাপনান্তর সুস্থিত হলে, এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তৎস্থানে সমাগত হয়ে বললেন, তুমি
কে? কোন শাস্ত্র অধ্যাপন করিতেছ? দ্বিজবরের বাক্য শ্রবণ করে শিষ্যগণ প্রত্যুক্তি করলেন,
ব্রহ্মন! এই ভগবান আমারদের গুরু অদ্বৈতবাদী, স্বয়ং শারীরক সূত্রে ভাষ্য করেছেন, তাতে
বেদান্তসম্মত অদ্বৈত মত সম্যগ্ রূপে নিণীত হয়েছে। আমরা গুরুর নিকট তাই অধ্যয়ন করছি ব্রাহ্মণ এতৎ প্রত্যুক্তি শ্রবণে ভাষ্যকারকে বললেন,
হো! এই শিষ্যগণ তোমাকে ভাষ্যকর্তা কি বলছেন? ভাষ্য কর্তৃত্ব থাকুক, বেদব্যাসের অন্তবর্ত্তী
তাৎপৰ্য্য যথার্থ রূপ বর্ণিত একটা সূত্র আমার নিকট বল। দ্বিজবরের বাক্য শ্রুতিগোচর
হলে ভাষ্যকার বললেন, আচাৰ্য্যগণকে নমঃ, ও ব্রহ্মবিৎবৃন্দকে নমস্কার, ব্রহ্মন! সূত্র
আমার উপস্থিত হয় না, আপনার যা ইচ্ছা হয় জিজ্ঞাসা করুন, যথাশক্তি তা বর্ণন করব। শঙ্করাচার্য্যের
বাক্য শ্রবণ মাত্র দ্বিজবর, শারীরকের তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম সূত্র 'তদন্তরপ্রতিপত্তৌ রংহতি সম্পরিষ্বক্তঃ প্রশ্ননিরূপণাভ্যাম্
৷৷' প্রশ্ন নিরূপণাভ্যাং, জিজ্ঞাসা করলেন;যাহাতে জীবের
সূক্ষভূত সহ পরলোক গিত নিরূপিত হয়েছে। যতীশ্বর উক্ত সূত্রে কৃতভাষ্য বিস্তার পূর্বক
সংশয় পূর্বপক্ষ সিদ্ধান্ত বললে, দ্বিজবর তাতে সহস্র প্রকার লোক-বিস্ময়-জনক কল্পনা
করে পূর্বপক্ষ করতে লাগলেন। ভাষ্যকার শত শত যুক্তি দ্বারা তা ক্রমে খণ্ডন করলেন। এরূপ
পরস্পরের বিবাদে ও প্রশ্নোত্তরে অষ্টদিবস হল। শঙ্করাচার্য্যের শ্রেষ্ঠ শিষ্য পদ্মপাদ
যতি, গুরুর অগ্রে নিবেদন করলেন, প্রভো! এই বিপ্রবর পরম গুরু ভগবান বেদব্যাস। অতএব,শঙ্কর সাক্ষাৎ শঙ্কর, ব্যাস স্বয়ং নারায়ণ
হরি, উভয়ের বিবাদস্থলে কিঙ্করেরা কি করবে? পদ্মপাদের এই উক্তিতে ভাষ্যকার, গুরু ব্যাসদেবকে
দর্শন করে প্রণাম পুরঃসর বিনীত ভাবে স্তুতিবাক্য বললেন, যদি আপনি সূত্র-সন্দর্ভে প্রতিপাদ্য
অদ্বয় ও অদ্বৈত মত প্রতিপাদন করেছেন, তবে কৃপা প্রকাশে অদ্য সেই বিষ্ণু-অংশাবতার পৈলাদি
শিষ্যবৃন্দ সেবিত স্ব স্বরূপ দর্শন করিয়ে কৃতাৰ্থ করুন। এই বাক্য বলতে বলতে দিব্যপিঙ্গ
জটাকলাপ বিভ্রাজমান শ্যামল কলেবর, দিব্যারবিন্দ নয়ন যুগল, আজানুলম্বিত করযুগ্ম, প্রসন্ন
সুস্মিতানন, কৃষ্ণাজিন পরিধান, শুক্ল যজ্ঞোপবীত বিলম্বমান, শিষ্যবৃন্দ সমাৰ্বত শ্ৰীমদ্ব্যাসদেবকে
স্বরূপত অগ্রে সাক্ষাৎ দর্শন করলেন।
শ্ৰীমদ্বেদব্যাস
ভাষ্যকার কর্তৃক এইপ্রকার সংস্তুত হয়ে আসনে উপবেশন করলেন, এবং হর্ষযুক্ত হয়ে অতি
সাদরে মধুর বাক্যে যতিবর শঙ্করকে বললেন, শঙ্কর! তুমি ধন্য, তুমি কৃতাৰ্থ, শুক সমান
আমার প্রিয়, অদ্বৈতবেদান্ত প্রকাশ করবার জন্য ইহলোকে জন্ম গ্রহণ করেছ। শম্ভু সভাতে
তোমার ভাষ্যের প্রশংসা শ্রবণ করে, সে ভাষ্য শুনবার মানসে তোমার নিকট এসেছি, তোমার মুখে
তা শ্রবণ করে অসীম হর্ষ প্রাপ্ত হলা । শঙ্কর এরূপ বেদব্যাসের বাক্য শ্রবণে বিনীত ভাবে
বললেন, প্রভু! কোথা আপনকার সূত্র মার্ত্তণ্ড ও কোথা ক্ষুদ্র দীপ
আমার ভাষ্য। তথাপি আপনি করুণাবশে এ প্রকার বলছেন। শিষ্যগণের গুরু শুশ্রুষা কৰ্ত্তব্য
বিধায়ে তা করেছি, এই ভাষ্যেতে স্বয়ং বুদ্ধি দ্বারা যে কোন সাহস করেছি, তা আপনি বিচার
করে সংশোধন ও সমীকরণ করুন। ব্যাসদেব শঙ্করের বাক্য শ্রুতি-গোচর মাত্র তার হস্ত হতে
ভাষ্য গ্রহণ করত পর্য্যবেক্ষণ করলেন। ভাষ্য অতি প্রসন্ন ও গম্ভীর, শ্রুতি সিদ্ধান্ত
যুক্তিতে সূত্রানুকারী বাক্যেতে যুক্ত নিরীক্ষণ করে, অমিত সন্তোষবশে প্রফুল্ল চিত্ত
হয়ে শঙ্করকে বরলেন, এই মহত্তর ভাষ্যে কোন স্থানে তোমার সাহস প্রসঙ্গ নেই। শঙ্কর! মীমাংসা,
ন্যায়, বেদ, ব্যাকরণ, সাংখ্য এবং যোগে স্বর্গ ভূমণ্ডলে তোমার সদৃশ কেউ নেই। তুমি প্রাকৃত
নও, গোবিন্দপাদের শিষ্য, স্বয়ং শিব। তোমার বদন হতে দুরুক্তি কিরূপে নিসৃত হবে? তোমার
কৌশলের তুলনা পৃথিবী মধ্যে কারও সহিত হয় না। আমার কৃত বহু অর্থ ও তাৎপৰ্য্য-গৰ্ভিত
সূত্র সকল তুমি বিনা কোন ব্যক্তি শ্রুতি যুক্তি দ্বারা ব্যাখ্যা করিতে সমর্থ হবে ? তুমি ভিন্ন দেবাসুর, নর, ঋষি মধ্যে আমার মনোবর্ত্তী
ভাব ও মৰ্ম্ম অবগত হয়ে, কোন জন ভাষ্য করতে যোগ্য ও সমর্থ হবে? পূর্বে অনেকে ইহার ব্যাখ্যা
করেছেন, পরে তোমার ভাষ্য হয়েছে, কিন্তু পূর্বের সে সকল তোমার ব্যখ্যার তুল্য নয়। অধিকন্তু,
তুমি বেদান্ত-বাক্য সকল অধুনা তুমি ভেদ-বুদ্ধি-মূঢ়গণকে জয় করে স্বীয়
মত প্রচার কর। তোমার মত, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্রাদির সম্মত। এই ক্ষণে আমিও কৃতকৃত্য
হলাম, যথা ইচ্ছা গমন করি।
'শঙ্করের আয়ু বৃদ্ধি'
ভাষ্যকার, গুরু ব্যাসদেবের বাক্য শ্রবণ করে বললেন, হে গুরু! আপনি মৎকৃত ভাষ্য পাঠ ও অবলোকন করলেন, যথা তথ্য সমস্ত বেদমার্গ নির্ণীত হয়েছে। অধুনা আর আমার জগতী-তলে অবশিষ্ট কর্তব্য নেই। আপনি মূহুর্ত মাত্র প্রতীক্ষা করুন, আমি আয়ু শেষান্তে মণিকর্ণিকাতে তবান্তিকে এ কলেবর পরিত্যাগ করি। ব্যাসদেব, শঙ্করের উক্তি শ্রবণে ক্ষণমাত্র ধ্যান-নিরত হয়ে বললেন, শঙ্কর! এ কৰ্ত্তব্য নয়, তোমার অবশিষ্ট কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম আছে। যারা বেদ মত অন্যথা করেছে, এমত বাদী অনেক আছে, সে সকলের মত নিরাস করবার জন্য তোমাকে পৃথিবীতে অবস্থিতি করতে হবে, নচেৎ ইহলোকে মুমুক্ষা যথার্থত দুলভ হবে। তুমি পৃথিবী পরিত্যাগ করলে বেদান্ত সকল নিরাশ্রয় হবে। তোমার আয়ুঃ দৈবকৃত অষ্টবর্ষ, স্ব বুদ্ধি যোগে আর অষ্টবর্ষ, এই ষোড়শ বর্ষ হয়েছে, অধুনা ঈশ্বরের বরে আর ষোড়শ বর্ষ হবে। ভাষ্যকার বললেন, আপনার সূত্র সম্বন্ধে আমার ভাষ্য সৰ্ব্বতোভাবে প্রচার হোক। এ বলে ব্যাসদেবের চরণ বন্দনা করলেন। ব্যাসদেব তথাস্তু বলে অভিনন্দন করে অন্তৰ্দ্ধান হলেন।
'শঙ্করের প্রয়াগ যাত্রা এবং ভট্টপাদ সমাগম ও সংবাদ'
শ্ৰীমদ্বেদব্যাস তিরোহিত হলে, শঙ্কর তাঁর নিয়োগমতে দিগ্বিজয় করবার মানসে চিন্তাবস্থিত হয়ে স্থির করলেন, বিদূষবর কুমারিল ভট্টপাদের সাথে আমার সমূহ সম্বন্ধ আছে, তদ্দ্বারা ভাষ্যেতে অনুত্তম বার্তিক করাব। এই বিবেচনা করত সশিষ্য কাশী হতে যাত্রা করে তীর্থরাজ প্রয়াগের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলেন। উত্তরকাশী পরিত্যাগ করে শঙ্কর এবার আচার্য্য যমুনা তীর ধরে এগোতে থাকলেন। এইপথে আচার্য্য কুরুক্ষেত্র ও যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপ্রস্থ প্রভৃতি দর্শন করে ক্রমে বৃন্দাবন প্রদেশে এসে উপস্থিত হলেন। পার্শ্বেই অদূরে মথুরা। ভাগবত, পাঞ্চরাত্র ও বৈখানস নামক বৈষ্ণবদেরই এখানে বাস। আচার্য্য এখানে এসে শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্র নির্মিত গোবিন্দ, মদনমোহন ও গোপীনাথমূর্তি দর্শন করলেন। আচার্র্য শঙ্কর 'গোবিন্দাষ্টকম্' স্তবটি এই স্থানেই রচনা করেছিলেন। কালীয়হ্রদ প্রভৃতি অপরাপর লীলাক্ষেত্র দর্শন করলেন। ক্রমে এই সন্ন্যাসীর দলকে দেখবার জন্য ভক্তগণের সমাগম হল। তাঁরা শঙ্করের অদ্বৈতবেদান্তসিদ্ধান্ত ও জ্ঞানমার্গের কথা শুনে বিস্মিত হলেন। কিন্তু কেউ বিচারে প্রবৃত্ত হলেন না। আচার্য্যের লক্ষ্য কুমারিল, এইজন্য শঙ্কর এদের নষ্ঠায় আঘাত না করে মথুরাভিমুখে প্রস্থান করলেন। মথুরায় এইসময় বৌদ্ধ জৈনগণের প্রাধান্য ছিল। কুমারিল ভট্টের মত বিদ্বদ্গণের প্রভাবে এরা নিষ্প্রভ হলেও ধনজনবলে প্রবল ছিল। আচার্য্যের আগমনবার্তা ও পাণ্ডিত্যে নিপূণতা শ্রবণ করে এরা আর বিচারে প্রবৃত্ত হল না। শঙ্করাচার্য্য এখানকার ভগবৎলীলাসংক্রান্ত স্থানগুলি দর্শন করে প্রয়াগের উদ্দেশ্যে প্রস্থিত হলেন এবং কয়েকদিন পথ চলে প্রাচীন কৌশাম্বী রাজ্যের মধ্যে দিয়ে প্রয়াগ তীর্থে ত্ৰিবেণী তীরে সমুপস্থিত হয়ে বিধান মত স্তুতি, নতি, করণান্তর পরমানন্দে সশিষ্য বেণী-সঙ্গমে অবগাহন করে ও কৃতাহ্নিক হয়ে বেণী তীরে স্বাশ্রমে বিশ্রাম করলেন। সেখানে লোক প্রমুখাৎ বৌদ্ধ সন্তান নাশক, কৃতিশ্রেষ্ঠ ভট্টপাদের নানাবিধ কথা শ্রবণ করলেন। যাঁর প্রসাদশ্রয়ে দেবগণ যজ্ঞ ভাগ প্রাপ্ত হচ্ছেন, সেই শ্রোত-কৰ্ম্ম ও বেদ-মার্গ প্রবর্তক বেদাম্বুজ-ভাস্কর সম্প্রতি তুষানলে প্রবেশ করছেন। ভাষ্যকার এ প্রকার জনরব শ্রুতি মাত্র অবিলম্বে সেই স্থানে গমন করলেন ও সাক্ষাৎ ভটপাদকে দেখলেন। প্রভাকরাদি শিষ্যবৃন্দে বেষ্টিত, তুষাগ্নিতে সংস্থিত তেজোনিধিকে প্রসন্ন মুখ-পঙ্কজ দৃষ্টি করে বিস্ময়াপন্ন হলেন। আহে ধৈর্য্য ! আহে। তেজঃ ! চিন্তা করত স্থিত হলেন । ভট্টপাদ, দূর হতে শঙ্করাচার্য্যকে দর্শন করে প্রণাম পুরঃসর পাদ্যার্ঘদি দ্বারা সাদরে পূজা করলেন। আচার্য্য-স্বামী প্রমোদিত মনে স্বকৃত ভাষ্য তাঁকে দেখালেন। ভট্টপাদ অতীব হর্ষে তা গ্রহণ করে পর্য্যালোচন সহ অবলোকন করত পুলোকোৎফুল্ল চিত্তে বললেন, অষ্টসহস্ৰ শ্লোক বার্তিকাখ্য মৎকর্তৃক অধ্যাস সন্দর্ভে প্রকাশ হয়েছে, অধুনা কি করি, মৃত্যু পরিগৃহীত হয়েছি, কাল দুরতিক্রম। স্বামিন! এই অসার সংসারে মহৎ সঞ্চিত পুণ্য ফল আপনার দর্শন, তা অদ্য লাভ হল। আমি বেদমার্গ প্রবর্তিত করেছি, এবং সজ্জনগণ মধ্যে সম্মান প্রাপ্ত হয়ে ইপ্সিত ভোগ্য সকল ভোগ করেছি। এখন জন্তুগণের অপরিহার্য্য, সৰ্ব্ব-সংহারক, দুৰ্দ্দান্ত কাল-কবলে পতিত হয়েছি, তার পরিহরণ সাধ্য নয়।
স্বামিন্! আমার পূর্ব বৃত্তান্ত নিবেদন করি, শ্রবণ করুন। ইতিপূর্বে সন্মার্গদূষক বৌদ্ধগণ
প্রবল হয়েছিল। তৎকর্তৃক পৃথিবী আক্রান্ত হয়ে বৈদিক ধৰ্ম্ম বিরল হলে, মানবগণের ঈশ্বর,
বেদ এবং ধৰ্ম্মে নাস্তিক্য প্রবর্তিত হল। তখন আমি রাজ-গৃহে প্রবেশ করলাম। সৌগতগণ রাজাকে
বশীভূত করে, বেদ প্রমাণ মিথ্যা বিশ্বাস করিয়ে তদ্বিষয়ক বাক্যালাপে নিরত ছিল। আমি
বৌদ্ধগণকে জয় করতে উদ্যত হলাম, কিন্তু আমি সে বেদ-দূষক নিষিধ্য মত অবগত ছিলাম না,
সুতরাং তন্মত জানবার জন্য তাঁদের শরণ গ্রহণ করলাম। যত্নসহকারে তাঁদের গ্রন্থ
অবলোকন ও পাঠ করে সন্মত-দূষণ বৌদ্ধ সিদ্ধান্ত সমস্ত জ্ঞাত হলাম। এক সময়, আমি সেই মতে
শ্রুতিতে দোষারোপ, করলাম, তখন ঐ দুষ্কৰ্ম্মে আমার নয়নাশ্রু নিপতিত হল। এতে বৌদ্ধগণ
আমাকে লক্ষ্য করে শত্রুতাচরণে প্রবর্ত্ত হল, এবং আমার বধন জন্য সমুদ্যত হয়ে পরস্পর
মন্ত্রণা করতে লাগিল, যে, এ পাঠী বলবান বিপক্ষ, নিশ্চয় আমারদের মত দোষ-দূষিত করবে,
অতএব যে প্রকারে সম্ভব একে বিনষ্ট করা অতীব কর্তব্য। এক সময়, তাঁরা আমাকে প্রমত্ত
জেনে সৌধাগ্র হতে নিপাতন করাল, পতন সময় বললাম, “যদি বেদ প্রমাণ হয় তবে জীবিত থাকব”,
“যদি” এই সংশয় বাক্যে এবং গুরু-দ্রোহিত জন্য উচ্চদেশ হতে পতনে আমার একটি চক্ষু বিনষ্ট
হল। একাক্ষর-দাতা গুরু হন, বহু পাঠকের ত কথাই নেই। আমি তাঁদের নিকট অধ্যয়ন করে পুনঃ
তাঁদের মত দূষিত করলাম এবং তাঁদের কুল সমূল নাশে সহ অপরাধী হলাম। এ সকল পাপের ফল নয়নে
উদিত হল। আর জৈমিনীয় মতে প্রবিষ্ট হয়ে ঐশ্বর মত দুষিত করেছিলাম। গুরু-দ্রোহিতা ও
ঈশ্বর অমানতা এই দোষ দ্বয়ের নিষ্কৃতি বিধিপূর্বক করতে উদ্যত হয়েছি। অনলে প্রবেশ করে
স্বামীর চরণ দর্শন করলাম। আমার অভিলাষ ছিল যে, স্বামীর কৃত এই ভাষ্যে সম্পূর্ণ বাৰ্ত্তিক করে যশস্বী হব, কিন্তু সে আশা আমার ফলবত
হল না। আমি এ জানি, আপনি মহেশ্বর শিব, অদ্বৈত সম্প্রদায় করতে অবতীর্ণ হয়েছেন, অধুনা
নয়ন পথে প্রাপ্ত হলাম। হে মহাযশে! অধিগমন করি তাদৃশ ভাগ্য হল না। এই অদ্বৈত নিষ্ঠ
ভাষ্যে বার্তিক দ্বার স্বরূপ, তা করবার আর সময় নেই।
শঙ্কর, ভট্টপাদের উক্তি শ্রবণ করে বললেন, ষড়ানন! তুমি সৌগতগণকে নির্মূল করতে অবনীতে
জন্মগ্রহণ করেছ। তোমার তৎকৰ্ম্ম সাধনে পাতক সম্বন্ধ কোথায়? আমি তোমার জীবন দান করি,
তুমি আমার ভাষ্যে বাৰ্ত্তিক কর। ভট্টপাদ, শঙ্করের কৃপা-বর্ষিণী-বাণী শ্রবণ করে বললেন,
স্বামিন! আপনি যা বললেন তা করতে সমর্থ বটেন, এ আপনার যোগ্যোক্তি তাতে সংশয় নেই। আপনি
ঈশ্বর, আপনার মাহাত্ম্য নিরঙ্কুশ। আমি জানি আপনি জগৎ সংহার করে পুনর্বার তাদৃশ সৃষ্টি
করে থাকেন, আমার জীবন দান কি বিচিত্ৰ! তথাপি ব্ৰত ভঙ্গে আমার উৎসাহ নেই, এ সময় ব্রহ্মাদ্বৈত
উপদেশ করুন, যাহাতে সংসার হতে মোক্ষ হয়। আর এক নিবেদন, যদি এই অদ্বৈত মার্গ প্রকাশ
করতে মানস করেছেন, তবে অগ্ৰে মণ্ডনাখ্য কবিকে জয় করা কৰ্ত্তব্য। তাকে জয় করলে জগৎ-জিত হবে। বেদ বেদাঙ্গের বক্তা তাদৃশ কেউ নেই।
মণ্ডন, কর্মীগণের মুখ্য আচার্য্য, গার্হস্থ্যের প্রবর্তক, নিবৃত্তিতে অকৃত-আদর। তাঁকে
স্ব বশে আনয়ন করুন। আর সরস্বতী কোন কারণ বশতঃ অভিশপ্ত হয়ে ভাৰ্য্যাভাবে মণ্ডন গৃহে
অবস্থিতি করছেন। তিনি সর্বশাস্ত্রে মণ্ডন হতে অধিকতর কৃতী ও সর্বকলা কুশলী। সেই মণ্ডনের
প্রিয়সীকে সাক্ষিণী করে তাঁকে পরাজিত এবং বশীভূত করুন। আমি যাবৎ প্রাণ পরিত্যাগ করি,
তাবৎ এক মুহূৰ্ত্ত প্রতীক্ষা করুন। ভাষ্যকার, ভট্টপাদের সদুক্তি শ্রবণ করে তাঁকে ব্ৰহ্মাদ্বৈত
উপদেশ করলেন। ভট্টপাদ্ তদগত বুদ্ধিতে তা শ্রবণ করে তৎক্ষণে স্বাত্মা সাক্ষাৎ করলেন
এবং কলেবর ত্যাগ করে মোক্ষভাব ইলেন। শঙ্কর-যতি, ভট্টপাদের বাচনিক মণ্ডনের বিবরণ ও নাম
শ্রত হয়ে, সৰ্ব্বগুণ-সম্পন্ন মণ্ডনের দর্শনেচ্ছু হলেন।
'শঙ্করের মণ্ডন-মিশ্রালয়ে গমন'
ভগবান শঙ্কর যতীশ্বর, মণ্ডন-মিশ্রের সাক্ষাৎ অভিলাষে চিত্তাকর্ষিত হয়ে প্রয়াগ হতে প্রস্থান করলেন। মাসবধিককাল পথ চলার পর রেব স্রোতস্বতী তীর-বৰ্ত্তিনী মাহিষ্মতী নামক নগরীতে এসে উপস্থিত হলেন এবং পুর-মধ্যে প্রবেশ পূর্বক পুষ্করিণী সলিলে অবগাহন করে ও কৃতাহ্নিক হয়ে মণ্ডনালয়ে প্রবেশ করলেন। পথিমধ্যে আনন্দ-নির্ভরা, পরস্পর হাস্য পরিহাস বিলাস তৎপরা প্রমোদিত-মনা দাসীগণকে সলিলানয়নার্থ গমনশীল দেখে, যতিবর, তাঁদেরকে মণ্ডনের নিকেতন-নিদর্শন জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁরা প্রত্যুক্তি করল, যে দ্বারে নীড় মধ্যে রুদ্ধা শুক পক্ষিণী সকল “স্বতঃ প্রমাণ ও পরতঃ প্রমাণ” বাক্য বলছে, সেই মণ্ডন পণ্ডিতের আলয়। তাৎপর্য্য হল যেস্থানে সৰ্ব্বদা যে সকল বাৰ্ত্তালাপ হয়, অত্রস্থ পক্ষীগণ তাই অভ্যাস করত তৎকথনে নিরত থাকে। মণ্ডনালয়ে সৰ্ব্বদা শাস্ত্র বিচার হয়ে থাকে। বাদী প্রতিবাদী মধ্যে কেহু কহে বেদ স্বতঃ প্রমাণ, অন্য পরতঃ প্রমাণ বলে। এক পক্ষের উক্তি ফলপ্রদ কৰ্ম্ম, পক্ষান্তরে ফলপ্রদ অজ (ঈশ্বর)। একের উক্তি জগৎ ধ্রুব, (সত্য), অন্য জগৎ অধ্রুব (অসত্য) বলে। পক্ষী সকল তা অভ্যাস করে উক্তি করছে। যতিবর, দাসীগণের বাক্য প্রমাণে গমন করত সেই ভবনের সান্নিধ্য সমুপস্থিত হলেন, এবং নিরুদ্ধ-দ্বার গৃহ দুষ্প্রবেশ দেখে যোগ-শক্তিতে আকাশ মার্গে গমন পূর্বক সৌধাগ্রে উপস্থিত হয়ে বিষয়ালঙ্কৃত মণ্ডন-মিশ্রকে নিকটে দেখলেন। তিনি তৎ কালোপস্থিত ব্যাসদেব ও জৈমিনিকে হর্ষোৎফুল্লচিত্তে অৰ্চনা করছেন। যতিবর সেই স্থানে আগত হয়ে যথাযোগ্য বেদব্যাস ও জৈমিনিকে নমস্কার করলেন। মুনিদ্বয়ও অভিনন্দন করলেন ।
'মণ্ডন ও শঙ্করের কৌতুহল বাক্য'
তখন প্রবৃত্তি-শাস্ত্র-নিরত মণ্ডন, আকাশ হতে উত্তীর্ণ সন্ন্যাসীকে সমীপবৰ্ত্তী অবলোকন করে রোষাবিষ্ট
হলেন। মণ্ডন ও শঙ্করের মধ্যে বাককৌশলে সন্ন্যাসী ও গৃহস্থী বিষয়ক বিতর্ক প্রশ্নোত্তর
হতে লাগল। তখন মণ্ডন-মিশ্র, জৈমিনির কটাক্ষ ইঙ্গিতে সংস্থিত
হলে, বেদব্যাস বললেন, বৎস! যোগী গণের প্রতি দুৰ্ব্বাক্য উক্তি কৰ্ত্তব্য নয়, বিশেষ
অভ্যাগত স্বয়ং বিষ্ণু, অতএব ইহাকে ঔচিত্য বিধানে নিমন্ত্রণ কর। মণ্ডন-মিশ্র ব্যাসানুশাসনে
জল স্পর্শ করে যথাশাস্ত্র যতিবরকে নিমন্ত্রণ করলেন। তখন শঙ্কর যতীশ্বর, মণ্ডনাভিধেয়
বিশ্বরূপকে বললেন, আমি বিবাদ সদ্ভিক্ষ বাঞ্ছা করে তোমার নিকট সমাগত হয়েছি, সেই শিষ্য-ভাবত্ব
ভিক্ষা দাও। অন্য লৌলিক সম্মত নয়। আমার লিপ্সিত তুমি কৰ্ম্মঠ আমার প্রিয় বেদান্ত সিদ্ধান্ত
বিনা অঙ্গ সকল তিরস্কার কর। আমি বাদী সমস্ত জয় করত অদ্য তোমাকে প্রার্থনা করছি, তুমি
আমার ব্রহ্মাদ্বৈত মত আশ্রয় কর। ব্ৰহ্মন! যদি সামর্থ্য হয় তবে যুক্তি সহ বিচার কর,
নচেৎ আমার নিকট স্পষ্ট স্বীকার কর যে “আমি পরাজিত হলাম”৷ যতিবরের এই বাক্য শ্রবণ করে
দ্বিজবর মণ্ডন প্রত্যুক্তি করলেন, যদি শেষ, কণাদ, গৌতমের সহিত বিবাদ হয়, তথাপি “আমি
পরাজিত হলাম” এমত উক্তি করিতে অনুমোদন করি না, এবং বেদ কর্ম্মমার্গ পরিত্যাগ করে অন্য মার্গ আশ্রয় করি না। আমার নিত্য সিদ্ধ রীতি এই
যে, লোকে যে কোন পণ্ডিত হোন, শ্রুতি নির্ণয়ে তাঁর সহিত বাদ করি।
বিবাদ বিষয়ে একটি বিবেচনা করা প্রয়োজন। বাদী ও প্রতিবাদী উভয়েই স্ব স্ব পক্ষ রক্ষা
করে থাকে, এ নিয়ম চিরপ্রসিদ্ধ আছে। স্বামিন! তুমি আপন পক্ষ অবশ্যই রক্ষা করবে, আমিও
নিশ্চয় স্বীয় পক্ষ রক্ষা করব, অতএব বিবাদে মধ্যস্থের আবশ্যকতা মানতে হয়। এস্থলে
আমাদের বিবাদে মধ্যবর্তী কে হইবে, যে বিবাদান্তর সপণ জয়াজয় ব্যক্ত করে ? আগামীকাল মধ্যাহ্নিক ক্রিয়া সমাপনান্তর এ বাদ
হবে। শঙ্কর তা শ্রবণ করে তথাস্তু বাক্যে অঙ্গীকার করলেন। মিশ্র বললেন, এ বিবাদে ব্যাসদেব
ও জৈমিনি মুনিদ্বয় সাক্ষী হবেন। মুনিদ্বয় তা শ্রবণে অনুজ্ঞা করলেন, মণ্ডন! তোমার
ভার্য্যা সরস্বতী নির্ণয়ে সদস্য যোগ্যা, তিনি মধ্যস্থা হবেন। মণ্ডন-মিশ্র মুনি বাক্যে
সৰ্ব্বতোভাবে কৃতচিকীর্ষু হলেন। অনন্তর মণ্ডন-মিশ্র, প্রমোদিত চিত্তে মুনিদ্বয়কে নানাবিধ
ভক্ষ্য ভোজ্য লেহ্যাদি সংযুক্ত ভোজনে পরিতৃপ্ত করলেন। ব্যাসদেব ও জৈমিনি ভোজনান্তে মুহুর্তকাল কথোপকথন
করলেন। মণ্ডন অনুজ্ঞা নিয়ে ভোজন করিে তৎস্থানে সমাগত হলে, ব্যাসদেব জৈমিনির সহিত অন্তৰ্দ্ধান
হলেন। ভাষ্যকার রেবা-নদী-তটস্থ দেবালয়ে গমন করলেন।
'শঙ্কর এবং মণ্ডনের বাদে পণ ও প্রতিজ্ঞা মতের তাৎপৰ্য্য কথন'
নিয়মিত দিবসে মণ্ডন প্রাতঃকৃত্য সমাপনাস্তে সশিষ্য পৌরজনে বেষ্টিত হয়ে উক্ত দেবালয়ে
সমুপস্থিত হলেন এবং পূলোক-প্রফুল্ল-মনে ভাষ্যকারকে প্রণাম করলেন। শঙ্কর তাঁকে অভিনন্দম
করে সশিষ্য সভা মধ্যে পরমামোদ-যুক্ত বেদার্থ নির্ণয়ে অমিত কৌতুহলকর হলেন। তখন উভয়ের
বেদার্থ-গৰ্ভিত বাৰ্ত্তা প্রবর্তী হুইল । সর্বজ্ঞা সরস্বতী সাক্ষিণী সদস্য কার্য্যে
সংস্থিত হলেন। বেদ-পরায়ণ হর্ষযুক্তা উভয়ের বিবাদ-সংবৃত্ত বিবেচনা করতে যতিবরের মহত্ব
চিন্তা করে স্থিত হলেন। তখন শঙ্করাচার্য্য আনন্দিত মনে প্রতিজ্ঞ করলেন। শ্রুতি সকলের
যুক্তি সমূহে মহাত্মাগণের স্বানুভূতি সিদ্ধ ব্রহ্মাদ্বৈত মত পরিস্কার করতে বিশ্বরূপের
প্রতি উক্তি করলেন, মণ্ডন! আমি বেদার্থ বলছি, তুমি অবহিত চিত্তে শ্রবণ কর। এক ব্রহ্ম
সচ্চিদানন্দ স্বাত্মারূপ নিরঞ্জন যে অদ্বয়, সকল বেদের প্রতিপাদ্য, তিনি অজ্ঞানাবৃত
হয়ে স্বয়ং বিশ্ব রূপে ভাসমান, যেমত রজত রূপে শুক্তি ও ভুজঙ্গ রূপে রজ্জু, ভাসিত হয়ে থাকে।
যেমত সাৰ্ব্বভৌম-মহীপাল সপত্নক স্বীয় পৰ্য্যঙ্কে সুপ্ত, নিস্বরূপ দীন দারিদ্র্য যুক্ত
ভ্ৰমেতে ভাসমান হয়, সেই রূপ এস্থলে আত্মানন্দ ব্রহ্ম স্ব মহিমাতে প্রতিষ্ঠিত অজ্ঞানাবৃত
হয়ে জীবরূপে ভাসমান হন। সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মৈক্য জ্ঞানানন্তর কার্য্য সহিত অজ্ঞান অভাব
হয়। এই প্রকার মিথ্যা জীব-জগৎ ভ্রান্তি-বাধ স্বরূপাবস্থিতি মুক্তি, এতে বেদান্ত সমস্ত
প্রমাণ। যথা পরংব্রহ্ম সত্য এবং শ্রুতি সকল প্রমাণ, তথা এ বিবাদে আমার জয়, এ বিষয়ে
কোন সংশয় নেই। মণ্ডন! শ্রবণ কর, যদি পরাজয় হয়, তবে গেরুয়াবসন পরিত্যাগ করে শুক্লবস্ত্র
পরিধান করব। ভাষ্যকারের পণ সহ প্রতিজ্ঞা-বাণী শ্রবণ করে মণ্ডনমিশ্র বললেন, ব্রহ্মাদ্ধয়ে
বেদান্ত কোন প্রকারে প্রমাণ হয় না। সাধ্যাভাব প্রযুক্ত পরব্রহ্ম বিষয় কি প্রকারে
হতে পারে? যেহেতু অক্রিয় বাক্য সকলের আনৰ্থক্য প্রসিদ্ধ আছে। প্রমাণতঃ শব্দ-সকলের-কাৰ্য্যাম্বয়ত্বে-শক্তিগত্ব
অর্থাৎ কাৰ্য্যযুক্ত শব্দের শক্তি প্রকাশ হয়, কৰ্ম্মহীন
পরংব্রহ্ম কিরূপে শ্ৰুতিতে প্রতিপাদ্য হন? আর কৰ্ম্মেতে মোক্ষ হয়, জ্ঞান ব্যর্থ, এই
মতই সম্মত। বেদে উক্ত হয়েছে যে, যাবজ্জীবন কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করবে না, অপিচ, ফলপ্রদ
কৰ্ম্ম, ঈশ্বর ফলদাতা কেউ নেই। ধৰ্ম্ম বিষয়ে সৰ্ব্বদা বেদের প্রামাণ্য, অন্যের ন ।
স্বামিন্ ! এই বাদে ন্যায়-যুক্ত-বেদ-বাক্যে যদি আমার পরাজয়
হয়, তবে গৃহাশ্রম পরিত্যাগ পূর্বক তোমার শিষ্য হয়ে দণ্ড
ধারণ করব। এতে জয়াজয় ফলপ্রদ। আমার ভার্য্যা সাক্ষিণী রইলেন। শঙ্করাচার্য্য ও মণ্ডন-মিশ্র
উভয়ে এই প্রকার কৃতপণ ও প্রতিশ্রুত হয়ে বেদ বাদে সমুদ্যত হলেন।
'শঙ্কর ও মণ্ডনের বিচার'
প্রতিদিন কৃত আহ্নিক হইয়া সমভাবে বাদ করতে লাগলেন। সরস্বতী বিজেতু-কাম উভয়ের গলদেশে
মাল্য অর্পণ করে বললেন, এই উভয়ের ধৃতমাল্য জয়াজয়ের সাক্ষিণী রইল। সরস্বতী, তদবধি
প্রতি দিবস মধ্যাহ্ন সময়ে পাকাদি কৰ্ম্ম সম্পন্ন করে, বাদ স্থানে সমাগত হয়ে, যতিবরকে
ও পতিকে আহবান করেন। যতীশ্বরকে বলেন, স্বামিন! ভিক্ষার্থ আগমন করুন। পতিকে বলেন, আর্য্যপুত্ৰ ! ভোজন জন্য গাত্ৰোথ্থান করুন। উভয়ের শ্রুতি-তাৎপর্য্যনির্ণয়
বাদ শ্রবণভিলাষে ব্ৰহ্মাদি অমর বৃন্দ ছদ্মবেশে সভাতে উপবিষ্ট ছিলেন। বেদবিৎ দুই জনের
মীমাংসা বিষয়ে বেদ-মৰ্ম্ম-রসান্বিত বাদ, ছল ক্রোধ বর্জিত, হর্ষোৎসাহ সহিত বাক্য, উভয়ের
এ বাদে নীতিযুক্ত বেদ সিদ্ধান্ত হবে, সভাস্থ জনগণ তা শ্রবণ আকাঙ্ক্ষায় সুস্থির নয়নে
বক্তার বদনে দৃষ্টি অচল করে রইলেন। মহাত্মাদ্বয়ের বাদ নানা প্রকার শ্রৌত যুক্তিযুক্ত,
শাস্ত্র মূলক, মহা বিস্ময়জনক হল। ষষ্ঠ দিবস বাদ সমভাবে হলে, সপ্তম দিবস প্রত্যুষে
মণ্ডন-মিশ্র ভাষ্যকারকে আহবান করে সভা মধ্যে উপবিষ্ট হলেন।
'শেষ বিচার ও মণ্ডন পরাজয়'
শুরু হল বাদ বিতণ্ডা। একজন কর্ম্মমীমাংসক একজন জ্ঞানকাণ্ডী নির্বিশেষ ব্রহ্মমীমাংসক।
এইরূপে দিনের পর দিন যেতে লাগল, এ এক অদ্ভূত শাস্ত্রবিচার, কোনপক্ষে জয় হচ্ছে, কোনপক্ষে
জয় হবে, কেউ বুঝতে পারছিলেন না। কেবলই বিচার, উভয়পক্ষই সমান পাণ্ডিত্যবান। এভাবে অষ্টাদশ
দিবস সমাগত হল। শঙ্কর-যতীশ্বর প্রজ্ঞান ও শ্রুতিযুক্তি সমূহ দ্বারা
পণ্ডিত মণ্ডনকে জয় করলেন। মণ্ডনও নিরুত্তর হয়ে তুষ্ণীম্ভাবে অবস্থিত ইলেন। তখন সরস্বতী
ভাষ্যকারের বৈদিক শ্রৌত-মত দৃঢ় জেনে, এবং ভর্তাকে জিত অবলোকন করে মনে মনে হর্ষ প্রাপ্ত
হলেন। প্রতিজ্ঞাবসরে পরীক্ষা জন্য যে মালা পতির কণ্ঠে অৰ্পণ করেছিলেন, সে মালিকা ভিক্ষুর
বিজয় সূচিকা ম্লানিতা প্রাপ্ত অবলোকন করে বললেন, যে, আপনার উভয়ে ভিক্ষা করুন। হে মুনে! তুমি ভর্তাকে জয় করেছ, দ্বিজবর! তুমি
জিত হয়েছ। পূর্বে আমি কোন কারণ বশতঃ ঋষি দুৰ্ব্বসা কর্তৃক
অভিশপ্ত হয়েছি। মুনে! আপনার জয় হল আমার শাপের অবধি এই, অধুনা, আমি যথা ইচ্ছা গমন
করি। সরস্বতী যতিবরকে এ বলে গমনোদ্যতা হলেন। মিশ্র তা দর্শনে মৌনাবলম্বন করে স্থিত
রইলেন। তখন ভাষ্যকার দেবীকে সাক্ষাৎ, সরস্বতী জেনে বললেন, দেবী! আমি জেনেছি, তুমি ব্রহ্মা-ভাৰ্য্যা
সরস্বতী, এখানে অবস্থিতি কর, গমন করো না। দেবী সরস্বতী ভাষ্যকার কর্তৃক এ প্রকার উক্ত
হয়ে গমনে ক্ষন্তা ও স্থিতা হলেন। যে শঙ্কর, যতীশ্বর রূপে জগতী মধ্যে অবতীর্ণ হয়ে
শ্ৰুতি প্রভৃতির অদ্ভুত ভাষ্যসকল সজ্জনগণে স্থাপন করেছেন। মণ্ডনকে পরাজয় করে তাঁর
গৃহে হর্ষ মনে স্মিত বদনে বিরাজিত হলেন। সেই করুণাসিন্ধু বেদান্ত-সরোজ-দিনবন্ধু ইন্দু-মৌলি
দীনবন্ধুর চরণ-যুগলে পুনঃপুনঃ প্রণাম করি। যিনি পৃথিবীতে নষ্ট বেদান্ত মত, শ্রুতিযুক্ত
বাক্যে উদ্ধার করে, সংস্থাপন করত দুঃখী জীবগণের ভবসিন্ধু তরণের সেতু প্রস্তুত করেছেন,
সেই অসীম গুণ কীৰ্ত্তি অখিল জীব নিবহের স্বাত্মারূপ লোকশঙ্কর শঙ্করের চরণ-প্রফুল্ল
কমল-যুগলে চিত্ত-মধুব্রত মকরন্দ পানানন্দে মত্ত হয়ে নিরন্ত তদ্গুণ গানে গুঞ্জমান
থাকুক।
'জৈমিনি
আগমন ও শঙ্করোক্তি যথার্থ কথন'
মণ্ডন মিশ্র ভাষ্যকারের এই প্রকার অশ্রুতপূৰ্ব আশ্চৰ্য্যা বাণী শ্রবণ করে তৎক্ষণে জৈমিনির ধ্যানে নিমীলিত-লোচন-দ্বয় হলেন। মণ্ডনের ধ্যানবশে জৈমিনি মুনি অবিলম্বে সেই স্থানে সমাগত হয়ে দর্শন দিলেন, এবং অর্ঘাদি দ্বারা যথোচিত সংপূজিত হয়ে মণ্ডনকে বললেন, মণ্ডন! শঙ্কর যা বলেছেন, তা সত্য সত্য। ভাষ্যকারের বাক্যে তোমার সন্দেহ কৰ্ত্তব্য নয়। বেদের তাৎপর্য্য বিষয়ে গুরু-বেদব্যাসের যে মত আমারও তাই, শঙ্কর তোমার নিকট সেই রূপ বর্ণনা করেছেন। আমার ও ব্যাসদেবের আশয় ইনি ভিন্ন কেউ অবগত নন, গুরু-ব্যাসদেবের সহিত আমার আশয় বিরুদ্ধ নয়, অস্মদাদি সকলের তত্ত্বমস্যাদি বেদান্ত সিদ্ধান্ত দ্বারা সংসাধিতা ব্রহ্মাদ্বয়াত্মাতে নিষ্ঠা। শঙ্করকে শঙ্কর মহাদেব, আর নারায়ণ হরিকে ব্যাস জানবে। আমরা ব্যাস করুণানিধির শিষ্য এবং ভক্ত। সত্যযুগে সত্বমুনি, ত্রেতাযুগে দত্তাত্রেয়, দ্বাপরে গুরুব্যাস, কলিযুগে শঙ্কর জ্ঞান-দাতা। ইনি বেদান্ত-ভাস্কর ও জ্ঞান-চন্দ্র এবং ঐশ্বৰ্য্য-সমুদ্র, শৈবপুরাণে এ বিভূর মহিমা উক্ত হয়েছে। মুনি জৈমিনি এ প্রকার বাক্য দ্বারা মণ্ডনকে বোধিত করে গমন করলেন । তখন মণ্ডন-মিশ্র যতীশ্বরকে যথেষ্ট প্ৰণিপাত করে বললেন, যতিবর! আপনি সাক্ষাৎ সচ্চিদানন্দ-বিগ্ৰহ বিদিত হলেন, মহাদেব শিব স্বয়ং আমার ভাগ্য হতে সমাগত হয়েছেন । আমি কৰ্ম্ম-যন্ত্রে সমারূঢ় হয়ে পুনঃপুনঃ ভ্ৰমমাণ দারাগার আপ্ত বিজ্ঞানী মমতাবদ্ধ মানস নানা ভোগপরায়ণ হয়ে লব্ধ-বিশ্রান্তি হইনি। আমি সংসার তাপে সন্তপ্ত, দৈবযোগে আপনার শরণাপন্ন হলাম, অধুনা আপনার পরিপাল্য।
কোথা আমি কৰ্ম্মগতিতে পতিত, নিমগ্ন ও কোথা গুরুর পাদপদ্ম, পূৰ্ব্ব জন্মার্জিত পুণ্য-সম্পত্তি
কি ছিল তা জ্ঞাত নই, যাতে প্রভুর চরণার্ক দর্শন পেলাম ও হৃদগত তামস সমস্ত এক কালে অপহৃত
হল, অতঃপর ক্রম সদাচার্য্যের চরণযুগলে এসে ধন্য হলাম। গুরো! আমি বেদবেত্তাগণের শ্রেষ্ঠ,আমার
সদৃশ নেই, ইত্যাদি নানা অহঙ্কারবান, সে সকল অভিমান পরিত্যাগ করে প্রভুর চরণে শরণাগত
হলাম, কৃপা-কটাক্ষ পাতে আমাকে শিষ্যত্বে গ্রহণ করুন। হে বেদান্ত-বিভাকর! আপনি সৰ্ব্বলোক-গুরু
শিবশম্ভু ভূত নিবহের হিত সাধন জন্য স্ব মায়াতে অবতীর্ণ হয়েছেন।
'সরস্বতীর
বাদ প্রার্থনা'
ভাষ্যকার শঙ্কর মণ্ডনের বিনীত বাক্য শ্রবণে অতীব হর্ষ প্রাপ্ত হলেন, তখন তাঁর ভাৰ্য্যার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সরস্বতী যতিবরকে বললেন, যতীশ্বর! আমার ভর্তা জিত হয়েছেন, আমি এ পর্য্যন্ত জিত৷ হই নি, আমি ভাৰ্য্যা, পতির অৰ্দ্ধ-শরীরিণী, আমাকে জয় করে আমার পতিকে শিষ্যত্বে গ্রহণ কর্তব্য, আমি জিতা না হলে এ কি প্রকারে হতে পারে? আপনি সর্বজ্ঞ সসামর্থ্য মহাদেব, যদিচ আমি স্ত্রীজাতি হীনা, তথাপি আপনার সহিত বিবাদ করব। যতীশ্বর, দেবীবাণীর বিবাদ-গর্ভিণী বাণী শ্রবণ করে বললেন, সরস্বতী! মহান্তগণ অযোগ্যে বিবাদ করেন না, কিন্তু অদ্বৈত মতে যিনি আক্ষেপ করতে উদ্যত হবেন, পুরুষ বা স্ত্রীজনের সহিত আমি জয় জন্য বাদ করব। এ প্রথাও আছে, যাজ্ঞবল্ক্য গার্গীর সহিত ও জনক সুলভার সঙ্গে বাদ করেছিলেন।
'শঙ্কর
ও সরস্বতীর বিচার'
যতিবরের বাক্যে শারদা অত্যন্ত হর্ষ প্রাপ্ত হয়ে বৈদিকী যুক্তিতে শঙ্করের সহিত বাদে প্রবূত্ত হলেন। উভয়ের বিবাদে সপ্তদশ দিবস হল। সরস্বতী মুনিকে অজেয় বিবেচনা করে মনে মনে চিন্তা করলেন, ইনি বাল্য কাল হতে যথাবিধি কৃতসন্ন্যাস, ব্রহ্মচর্য্যে দৃঢ়, শান্ত এবং সৎ সমাধি যুক্ত, কাম-শাস্ত্র অবগত নন, তদ্দারা একে জয় করব। সরস্বতী স্বীয়ান্তঃকরণে এরূপ আলোচনা করে সভা মধ্যে প্রসঙ্গত জিজ্ঞাসা করলেন, যতিবর! কামকলা কিরূপ ও কয়প্রকার, এর আধার কি ? আর কামের স্থিতি কোথায়? নারী বা নরে কি প্রকারে থাকে? শারদার এরূপ বাণী শ্রুতিগোচর হলে, যতিবর কিছুমাত্র বললেন না। নিজ চিত্তে চিন্তা করলেন, এ সন্ন্যাসীগণের ধৰ্ম্ম নয়, কিন্তু বাদে প্রবর্ত হয়ে “কৰ্ত্তব্য নয়” এমত উক্তিও উচিত হয় না। অতএব, এর উত্তর অবশ্য কর্তব্য, এ প্রকার বিচার করে সরস্বতীকে বললেন, মাসান্তরে এর উত্তর হবে। সরস্বতী স্বীকৃত হলে, যতিবর স্বাভিমত দেশে গমন করলেন।
'শঙ্করের
মৃত রাজ শরীরে প্রবেশ মানস প্রকাশ ও পদ্মপাদের নিষেধ উক্তি এবং মৎস্যেন্দ্র যোগীর
উপাখ্যান'
শঙ্কর-যতীশ্বর গমন করত মকরাখা দেশ প্রাপ্ত হলেন। সে দিবস রাজা মকরাখ্য মৃত হয়েছেন,
রাজার মৃত শরীর বৃক্ষ মূলে নানা মন্ত্রীগণেতে সমাবৃত। শঙ্কর যোগ-চক্ষু দ্বারা সমালোকন
করে তৎক্ষণে যোগিবর পদ্মপাদাখ্য শ্রেষ্ঠ শিষ্যকে বললেন, সনন্দন! শ্রবণ কর,—যোগেতে দেখলাম,
রাজা মকরাখ্য গতাসু হয়েছে, অতএব, আমি অল্প দিনের নিমিত্ত সেই শরীরে প্রবেশ করে রাজা
হয়ে পুনর্বার এ দেহে প্রবেশ করব, ইহাতে তোমারদের সন্দেহ কৰ্ত্তব্য নয়। শিষ্য পদ্মপাদ
গুরুর বাক্য শ্রবণ করে নিবেদন করলেন, গুরো ! আপনি সৰ্ব্বজ্ঞ, আপনার অবিদিত কি আছে? পূৰ্ব্বতন কালে মৎস্যেন্দ্র নামক যোগী গোরক্ষাখ্যা
শিষ্যকে দেহ রক্ষণে নিযুক্ত করে কোন রাজার মৃত শরীরে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি রাজলক্ষী
প্রাপ্ত হয়ে সিংহাসনে উপবিষ্ট, অমাত্য পরিবৃত পরম সুখে রাজ্য করতে লাগলেন। রাজার বিজ্ঞ
সুবিচক্ষণ সচিবগণ কোন যোগীকে ভূপতি শরীরে প্রৰিষ্ট অনুমান করে, তাহার বশীকরণে যত্ন-তৎপর
হলেন। নানাবিধ মনোহর রাজভোগ্য সামগ্ৰী সকল প্রস্তুত করে অহরহ তাঁর মনোরঞ্জন সাধন করতে
অনুরত হলেন। যোগীবর বিবিধ ভোগ ও সুন্দরী রাজমহিলাগণের সহবাসে ও সঙ্গীত নৃত্য কলালাপ
হাব ভাব এবং রস-সঞ্চারিণী সুধাময়ী বাণী আদিতে দিবানিশি
সমাসক্ত বুদ্ধি হয়ে যোগ সমাধি সকল বিস্মৃত হলেন।
এদিকে আশ্রমে শরীর রক্ষণে নিযুক্ত গোরক্ষ শিষ্য যোগশক্তি প্রভাবে যোগীবরের রাজভোগে
মোহাপন্নতা অবগত হয়ে গুরুর হিত সাধন মানসে যোগ দ্বারা আপনাকে দ্বিধা করে এক দেহে সেই
স্থানে অবস্থিত হয়ে গুরুর শরীর পালন করেন, দ্বিতীয় শরীরে বিদ্বদ্বেশ ধারণ করে রাজসমীপে
সমুপস্থিত হলেন, এবং মন্ত্রীতুল্য নানা শাস্ত্র উপদেশ করত ভূপতির প্রিয় পাত্র হলেন।
তিনি কোন সময়ে নির্জনে তত্ত্বজ্ঞান ও যোগ উপদেশ করে গুরুকে পূর্ব কলেবরে সমানয়ন করেছিলেন।
ভগবান! ঈদৃশ বিষয়-স্নেহ যোগীগণের পরম রিপু এবং নানা প্রকার দুঃখকর শ্রুত ও দৃষ্ট আছে।
আপনি কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়ে যথার্থত বিবেক করতে সমর্থ। গুরো! অতএব ইহাতে আপনার ক্ষান্ত
হওয়াই কর্তব্য।
'শঙ্করের
রাজদেহে প্রৰেশ'
শঙ্কর যতিবর পদ্মপাদের বাক্য শ্রবণ করে বললেন, সৌম্য! তুমি যা বললে তা নিন্দিত ও গর্হিত
বটে, কিন্তু শ্রবণ কর; কাম, অসঙ্গ জনগণকে বশ করতে প্ৰভু হয় না, শ্ৰীকৃষ্ণের গোপ-বধু-গণের
সমাগম যেমত, সেইরূপ জানবে। সনন্দন! সঙ্কল্প কাম সকলের মূল, আমি সদা এক অসঙ্গ, সে সঙ্কল্প
আমাতে কখন নেই, তা অজ্ঞানমুলক বিষয় মানব বৃন্দের দুঃখকর হয়, ব্রহ্মজ্ঞানে যাঁর সে
কারণ অজ্ঞান নষ্ট হয়েছে, সুতরাং তাঁর সঙ্কল্লাভাস সবীজ বিনাশ প্রাপ্ত হয়েছে, বিনষ্ট
সঙ্কল্পের বিষয়াসক্তি আপনি নাশ হয়, অতএব আমাদের সে সঙ্কল্প মূলাভাবে লয় প্রাপ্ত
হয়েছে। আর, সঙ্কল্প দেহাভিমানী জন নিকরের সকল দুঃখের কারণ, আত্মারাম ধীরগণের কিছুমাত্র
বাধা করেনা। স্বাত্মজ্ঞান বিহীনের সকল কৰ্ম্ম সংসার জনক হয়, ও নিত্য ব্রহ্মাত্মনিষ্ঠ
জনের সমস্ত কৰ্ম্ম সুখময়। ব্ৰহ্মাত্মজ্ঞানে যাঁর দ্বৈত বুদ্ধি অপহৃতা ( হয়েছে, সে
জ্ঞানীর ব্রহ্ম হত্যাদি পাপে এবং অশ্বমেধ জন্য পুণ্যে লিপ্ততা নেই। রাজা জনক অশ্বমেধ
যাগদ্বারা যজন করেছিলেন, বিদেহ, মোক্ষ প্রাপ্ত হয়েছেন, সে পুণ্যের সহিত জনকের সম্বন্ধ ছিলনা, ইহা বাজশেনেয় শ্রুতি
বলছেন।
অতএব কাম শাস্ত্রের অনুশীলন আমার বাধক নয়। ভিক্ষুবর ইহা বলে গিরিশৃঙ্গে গমন করলেন।
সেখানে ক্ষণমাত্র স্থিত হয়ে শিষ্যবৰ্গকে বললেন, যাবৎ আমি কামশাস্ত্র ও কামকলা জ্ঞাত
হয়ে এ ভিক্ষু-শরীরে প্রত্যাগত হই, তাবৎ তোমরা এ শরীর সাবধানে, গৌরবের সহিত পালন কর।
শঙ্কর যোগীশ্বর, শিষ্যগণকে অনুশাসন করে যোগবলে স্থুলকলেবর পরিত্যাগ করত পুৰ্য্যষ্টক
লিঙ্গদেহময় হয়ে রাজার মৃত শরীরে সমাবেশন করলেন। এখানে রাজার শরীর সপ্রাণ হয়ে, শনৈঃশনৈঃ
নয়ন প্রোন্মীলন করে, ক্রমে সবল হয়ে প্রমদাকুল ও প্রজাপুঞ্জকে হর্ষোৎফুল্ল করলেন।
মন্ত্রীগণ রাজাকে জীবিত প্রাপ্ত হতে দেখে জীবন উপলাভ করলেন, এবং সকলে মহাহৰ্ষে সহস্ৰ
সহস্ৰ শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন। আর, চতুৰ্দ্দিগ হতে জয়শব্দ ও স্বস্তিশব্দে অতিশয় কোলাহল
হল।
'শঙ্করের রাজদেহে রাজ্য-পালন ও অঙ্গনাসঙ্গ এবং কামকলা ও কামশাস্ত্র সমালোচন'
শঙ্কর মহামতি নরপতিরূপে, মন্ত্রিগণ সহ কৃতশান্তি হয়ে ভদ্রাসনে সমারোহণ করত স্বীয়
রাজ্য পালনে নিরত হলেন। রাজপুরোহিত ও সচিবগণ ভূপতিকে অপূৰ্ব্ব গুণসম্পন্ন অবলোকন করে
পরস্পর সমবেত হয়ে মন্ত্রণা করলেন, এবং বললেন পূৰ্ব্বতন সদগুণ ভূষিত ভূপতিগণ হতে এ
বর্তমান নরপতির আশ্চৰ্য্য রূপ ও গুণ দৃষ্ট হচ্ছে, দানে যযাতি তুল্য, বক্তৃতায় পৃথু
প্রায়, জয় শীলতায় অৰ্জ্জুন সম, সৰ্ব্বজ্ঞতাতে শ্রীপতি সদৃশ, একাধারে বহুগুণ সামান্য
জনে সম্ভব নয়, অতএব ইনি কোন দিব্য তেজস্বী, ইহাতে সংশয় নেই। এইক্ষণে অম্মদ্গণের মহতী
যুক্তি সহকারে এমত যত্ন ও উপায় কর্তব্য যাতে এই মহামনা পুনর্বার স্ব শরীরে গমন না
করেন। অধিকার মধ্যে যে কোন স্থানে গতাসু শরীর গুপ্ত বা প্রকট থাকে তা অবিচারে দগ্ধ
করা হয়, পূর্ব শরীর ভস্মীভূত হলে এদেহ হতে গমন সম্ভব হবেনা, সকলে একত্র হয়ে মন্ত্রণ
দ্বারা এইরূপ পরামর্শ ও যুক্তি স্থির করিে অবনীস্থ সমস্ত মৃতদেহ দগ্ধ করবার জন্য
আজ্ঞাধীন সেবক বৃন্দকে নিযুক্ত করলেন। নরপতি অমাত্যবৰ্গ প্রতি রাজ্যভার সংন্যস্ত করে
স্বয়ং মনোহর বামলোচনা সুন্দরী বহু কামিনী ভোগে নিরত ও তদগত হলেন। কামকলা ও কাম শাস্ত্রানুরোধে
বাৎস্যায়নাদি প্রণীত গ্রন্থসমূহ যথার্থ নিরীক্ষণ ও সমালোচন করতে লাগলেন, স্বয়ং তাতে
নিবন্ধ করলেন।এই প্রকার রাজ-শরীর-প্রবিষ্ট-যোগীর কামিনীগণ সহবাসে ও রমণী রঙ্গরস বিলাসে
মাস মাত্র অতিক্রান্ত হল। এখানে শৃঙ্গগিরি আশ্রমে পদ্মপাদাদি শিষ্যবৃন্দ ভাষ্যকারের
নিয়মিত কালের অতিক্রমণ অবলোকন করিয়া পরম্পর বিচার করতে লাগলেন ; মাসাবধি হল অদ্যাপি আচার্য্য স্ব শরীরে প্রত্যাগত
হয়ে অম্মদগণকে সনাথ করলেন না। আমরা অধুনা আচার্য্যের অন্বেষণে কি করব ও কোথায় বা যাব?
সকলে স্ব স্ব বুদ্ধিতে উপায় চিন্তা কর, কিরূপে গুরুর তত্ত্ব প্রাপ্ত হতে পারা যায়,
এবং জানা যায় কোন স্থানে কি রূপে বিলাস করছেন? পদ্মপাদ সকলকে বললেন, আমরা কি নিমিত্ত
এত শোচনা করি? অন্বেষণ করলে অবশ্যই গুরুর তত্ত্ব প্রাপ্ত হব, তাহার গুণ গোপন থাকবার
নয়।
'শিষ্যগণের গায়ক বেশে রাজ সমীপে গমন ও গান ছলে স্মরণ দেওন'
স্বতীর্থগণ পদ্মপাদের নয়যুক্ত বাক্যে নিশ্চয় করে, কেউ কেউ সেই স্থানে গুরুর শরীর
রক্ষণে নিযুক্ত রইলেন, আর সকলে দক্ষিণ দিশায় গমন করে লোকমুখে শ্রবণ করলেন যে, এতদ্দেশের
ভূপতি মৃত হয়ে পুনর্বার উথিত হয়েছেন, এবং সৰ্ব্বদা তরণীগণেতে সংসত্ত আছেন। ইহা অবগত
হয়ে সকলে গায়কের বেশ ধারণ করে গীতকুশল সকলে তৎপুরে প্রবেশ করলেন। সঙ্গীত-রস-তত্ত্ববিৎ
গায়কগণ ভূপতির অনুমতি লব্ধ হয়ে সমীপে গমন করত, সভা মধ্যে সিংহাসনোপবিষ্ট, চামরে ব্যজ্যমান,
তরণীগণেতে পরিবৃত ও যুবতীবৃন্দে বেষ্টিত নরপতিকে দর্শন করে নমস্কার করলেন। রাজাজ্ঞা
মতে সভা প্রবিষ্ট হলেন। সঙ্গীতালাপন আরম্ভ করলেন। প্রথমে ভৃঙ্গ সম্বোধনে গিরিশৃঙ্গের
পাদপগণের সঙ্গ পরিত্যাগ ইত্যাদি গীত ব্যাজে প্রকৃত ভাব অবগতি করিয়া, তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা
স্মরণ করালেন। গায়ক বেশধারী পদ্মপাদাদির ব্রহ্মাদ্বয় তত্ত্বামৃত
স্বাত্মানন্দ রসান্বিত গীতাবলি নরপতি তদগত চিত্তে শ্রবণ করে, আপন সিদ্ধার্থ ত্যাগ অবগত
হয়ে, বিস্মিত প্রায় হলেন। পদ্মপাদাদি ভূপতির উদ্দেশ্য তত্ত্বাবগতি নিশ্চয় জ্ঞান
করে সত্বর গিরিশৃঙ্গে স্বাশ্রমে গমন করলেন।
'শঙ্করের স্ব দেহে প্রবেশ'
ভূপতি, গায়কগণের গমনান্তর অন্তর্বুদ্ধ হয়ে স্বয়ং মূর্চ্ছাশ্রয় করত রাজ-শরীর হতে
নির্গত হয়ে স্ব দেহে প্রবিষ্ট হলেন। তখন, গিরিশৃঙ্গে ভিক্ষু কলেবরে সংজ্ঞা প্রাপ্ত
হয়ে উত্থান করত নয়নদ্বয় উন্মীলন করে গিরি গহবরে দৃষ্টি করলেন, রাজ-ভৃত্যগণ মন্ত্রীবর্গের
আদেশে গতাসু শরীর দাহার্থে গিরি কন্দরে অনল প্রজ্জ্বলিত
করেছে। যতিবর, চতুর্দিগে অগ্নি বিস্তৃত ও বিবৰ্দ্ধিত অবলোকন করে তার শাস্তি জন্য ভগবান
নৃসিংহদেবকে স্মরণ করত স্তুতি পাঠ করলেন। সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের নিয়ন্তা নৃসিংহদেব ভাষ্যকারের
স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে সাক্ষাৎ দর্শন দিলেন, এবং গুহার চতুঃপার্শ্ববর্তী জ্বলন্ত হুতাশন প্রাশন করে শঙ্করকে বললেন, যতিবর!
তুমি অধুনা ইষ্ট বর প্রার্থনা কর; শ্রুতি মতে নিরত মৎপদ্ ধ্যানশীল সজ্জন বৃন্দের দর্শন
আমার এই সফল। তোমার কৃত স্তব ভক্তিভাবে পাঠ করলে আমার প্রিয় হয়ে মৎ প্রসাদে আমার
বিমল পদ প্রাপ্ত হবে। বিমলমতি যতিবর, নৃসিংদেবের প্রসাদ বাক্য শ্রবণ করযে গম্ভীরভাব
স্তুতি ও বিনয় বিশিষ্ট বাক্যে প্রার্থনা করলেন, প্রভো ! আমার বর এই বেদান্ত সম্মত ব্ৰহ্মমার্গ শ্রুতিযুক্তি
দ্বারা মৎকৃত ভাষ্য সত্জনগণ মধ্যে প্রচার হয়। শ্ৰীনৃসিংহ দেব ভাষ্যকারের বচন শ্রবণ
করে প্রসন্ন বদনে বললেন, যতিবর! তোমার অভিপ্রেত মত হবে, তুমি শঙ্করাচার্য্য আমা হতে
ভিন্ন নও, শ্রুতির অভিপ্রায় আমি ও তুমি অবগত। তোমার প্রাজ্ঞমেধাশক্তি সম্পন্ন ভাষ্য
আমার বর ব্যতীতই শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হবে। ইহা বলে অখিলাত্মা নরহরি গিরিশৃঙ্গে
অদৃশ্য হলেন।
'ভাষ্যকারের পূনরায় মণ্ডনালয়ে গমন ও শারদান্তৰ্ধান'
তদনন্তর ভাষ্যকার শিষ্যবৃন্দে পরিবৃত হইয়া মণ্ডনমিশ্রালয়ে প্রস্থান করলেন। মণ্ডন-মিশ্র
সমুপস্থিত যতীশ্বরকে সন্দর্শন করত অমিত হর্ষে ভাৰ্য্যার সহিত যথাবিধি অৰ্চনা করলেন। সরস্বতী, শঙ্কর-যতীশ্বরকে প্রাপ্ত হয়ে অর্চ্চনা
করে হৰ্ষোৎফুল্ল মনে বললেন, ব্রহ্মন। আপনি সাক্ষাৎ সদাশিব, সমস্ত বিদ্যার ঈশান, সকল
দেহীগণের ঈশ্বর, ব্রহ্মার অধিপতি, আমাকে সভা মধ্যে জয় না করে কাম শাস্ত্র শিক্ষার্থ
তোমার রাজ-শরীরে প্রবেশ লোক বিড়ম্বনা মাত্র, আমি মহেশ্বর হতে সদুত্তর লব্ধ হয়েছি।
ব্রহ্মন! আমি স্ত্রীজাতি, চঞ্চলত আমাদের স্বভাব সুলভ, আমি শিক্ষাভিলাষে প্রশ্ন করেছিলাম,
স্ত্রীগণের কায়মন বাক্যে পতিপক্ষানুসারিত্বই ধৰ্ম্ম, ইহা নিশ্চিত আছে, আমার স্বামী
হতে বিজিত হয়েছি, অধুনা অনুজ্ঞা করুন স্ব ধামে গমন করি। শঙ্কর বাণীর বাণী-কৌশলে সন্তোষিত
হয়ে বললেন, আমি অবগত আছি, তুমি ব্রহ্ম-ভাৰ্য্যা সরস্বতী দেবী, বিশ্বের কল্যাণ মানসে
অনুগ্রহ প্রকাশ করে মহীতলে অবতীর্ণ হয়েছ। অতএব, আমার কৃত স্থানে ফলকামী জন নিকরের
অর্চ্চ্যমানা হয়ে সদা হৃষ্ট ভাবে ইষ্ট ফলপ্রদাত্রী রইবে। সরস্বতী, শঙ্করকে তথাস্তু
বলে, মণ্ডন গৃহে সভা মধ্যে অন্তর্ধান হলেন। তত্রস্থ সৰ্ব্বজন ইহা চাক্ষুস দর্শন করে
বিস্ময়াপন্ন হলেন। আর সরস্বতী ব্রহ্ম ধমে গমন করত ব্ৰহ্মপাশে স্থিত হলেন।
'মণ্ডনের সন্ন্যাস ও তত্তোপদেশ'
প্রভাতে মণ্ডন-মিশ্র সমস্ত বিষয় পরিত্যাগ পূর্বক সন্ন্যাসে কৃতসঙ্কল্প হয়ে ন্যায়োপার্জিত
বিত্ত সকল বাগ দক্ষিণারূপ সৎপাত্র বিপ্রগণকে প্রদান করে সন্ন্যাসচরণ করলেন। দেশিকেন্দ্র,
যতীশ্বর শঙ্করাচাৰ্য্যকে আশ্রয় করিয়া তত্ত্বমসি বাক্য বিধিবৎ শ্রবণ করলেন। গুরু ভাষ্যকার হতে মণ্ডন দ্বিজবর 'তত্ত্বোপদেশ'
নামক ব্রহ্মজ্ঞান বোধিত হলেন। মণ্ডনমিশ্র ভাষ্যকারের উপদেশ শ্রবণ করে স্বীয়
বুদ্ধিতে আপনাকে কৃতঘ্ন সম নিলেন, এবং আচার্য্যকে বিনয়ন্বিত বাক্য বললেন, গুরো! আপনআর
প্রসাদে আমি ধন্য এবং কৃতকৃত্য হলাম, ইহা বলে অত্যন্ত ভক্তিতে ভাষ্যকারের চরণকমলযুগল
গ্রহণ করে আপন মস্তকে ন্যস্ত করলেন, তখন শঙ্কর গুরু, শিষ্য-বাৎসল্য স্বভাবে বললেন সুরাঃ
(দেবসকল) স্বাত্মারাম হন, তন্মধ্যে তুমি শ্রেষ্ঠ অতএব আমার অনুগ্রহে তুমি 'সুরেশ্বর'
নাম প্রাপ্ত হলে। শঙ্করাচার্য্য এই প্রকার কৃতিত্বর মণ্ডনমিশ্রকে জয় করে তাঁকে যথাবিধি
পরম তত্ত্ব উপদেশ করলেন, সুরেশ্বর শুদ্ধ ব্ৰক্ষাদ্বয় সাক্ষাৎ করে জীবন্মুক্ত মুনি
হয়ে ভাষ্যকারের প্রধন শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম হলেন ।
'আচার্য্যের দিগ্বিজয় যাত্রা'
মণ্ডন-পরাজয়ে শিষ্যগণের হৃদয়ে দিগ্বিজয়ের বাসনা বলবতী হল। তাঁরা কেবলই আচার্য্যকে দিগ্বিজয়ের
জন্য প্রবৃত্তি দেন। আচার্য্য কেবল শুনেন আর হাস্য করেন আর কেবল মধ্যে মধ্যে বলেন-"
যশ-আকাঙ্ক্ষা জ্ঞানীর মহাশত্রু।" কিন্তু সে কথা শুনে কে? অবশেষে শিষ্যগণর অনুরোধে
মহাপ্রাজ্ঞ পণ্ডিত শঙ্কর দিগ্বিজয়ের উদ্দেশ্যে দক্ষিণাভিমুখে অগ্রসর হলেন। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া শুধুমাত্র শাস্ত্রার্থে মেধাশক্তি
দিয়ে দিগ্বিজয় ইতিহাসে বিরল। অদ্বিতীয় তত্ত্বজ্ঞানী এই জগদ্গুরুর আবির্ভাব না হলে বেদোক্তধর্মের
পরিণতি কি হত বলা দুষ্কর। আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করে দিগ্বীজয়ী এই অদ্বৈতবেদান্ত
দার্শনিক তৎকালীন ভিন্নমতাবলম্বী পন্ডিতদিগকে শাস্ত্রার্থ বিচারে পরাজিত করে বৈদিক
ধর্মের বিজয়কেতন উড্ডীন করেছিলেন। তিনি স্বীয় পান্ডিত্য ও মেধা দ্বারা সেই সময় চতুর্দিকে
ব্যাপ্ত জৈন ও বৌদ্ধ মত সহ তৎকালীন ৭২টি অবৈদান্তিক দর্শন খণ্ডন করে উপনিষদ সিদ্ধ গুরুপরম্পরার
অদ্বৈতবেদান্ত স্থাপন করেছিলেন।
আদি শঙ্কর দিগ্বিজয় যাত্রায় তাঁর শিষ্যদের সাথে নিয়ে নর্মদার দক্ষিণে মহারাষ্ট্র দেশ
ভ্রমণ করতে করতে গোদাবরী তীরে পঞ্চবটি বা নাসিক নামক তীর্থে আসলেন। এখানেই সীতাহরণ
হয়েছিল। এখানে পূর্বে দণ্ডকারণ্য ছিল। ভগবান রামচন্দ্রের মন্দির এখানে বিখ্যাত। কিন্তু
ধর্ম ও রাষ্ট্রবিপ্লববশতঃ এখানে ভগবানের পূজা প্রভৃতি উত্তমরূপে হত না। আচার্য্য এখানে
আগমন করায় আবার শ্রীরামচন্দ্রের পূজদি পুনঃপ্রবর্তিত হল, মন্দিরের সংস্কার হল এবং কিছুদিন
পর আচার্য্যের শিষ্যগণ এখানে মন্দিরের পার্শ্বে একটী মঠ স্থাপন করেন।
নাসিক হতে আচার্য্য বহির্গত হয়ে নানা স্থান ভ্রমণ করতে করতে সশিষ্য পাণ্ডারপুর নামক
স্থানে আগমন করলেন। এখানে চন্দ্রভাগাতীরে চতুর্বাহু বিষ্ণুবিগ্রহ মহাসমারোহে পূজিত
হন। আচার্য্য এখানে এসে 'পাণ্ডুরঙ্গাষ্টক' নামক একটী স্তোত্র রচনা করে ভগবানের পূজা
করেন এবং স্থানীয়দের স্বধর্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত করেন।
তৎপরে আচার্য্য শ্রীশৈলম্ নামক প্রসিদ্ধ তীর্থে আগমন করেন। শ্রীশৈল
কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রার সঙ্গমতটে অবস্থিত। প্রাচীনকাল থেকেই সাধুসন্ন্যাসীদের সাধন স্থান
এটি। শৃঙ্গোপরি মধ্যে মধ্যে মল্লিকা-কানন। পর্বতপাদদেশে পাতালগামিনী গঙ্গা প্রবাহিতা।
শৃঙ্গোপরি একটি শিবমন্দির। মধ্যস্থলে এক শিবলিঙ্গ, তৎপার্শ্বে শিবের শক্তি ভ্রমরাদেবী।
অর্জ্জুন এই শিবলিঙ্গ দর্শন করেছিলেন এবং প্রস্ফুটিত মল্লিকা-কুসুম দ্বারা পূজা করে
সিদ্ধমনোরথ হয়েছিলেন। আর তদবধি এই শিবলিঙ্গটি মল্লিকার্জ্জুন নামে প্রসিদ্ধ। শ্রীশৈলে
তিনি শিবের প্রতি ভক্তিমূলক স্তোত্রগীত শিবানন্দলাহিড়ী রচনা করেন। আচার্য্যের আগমনে
স্থানীয়রা দলে দলে দর্শনার্থে আসতে লাগলেন। ভাষ্যকার পদ্মপাদাদি শিষ্যগণে পরিবৃত হয়ে যথাসুখে
শৈল-পৃষ্ঠে বিচরণ করতে লাগলেন, আর সৎ যতিগণকে বেদান্ত-ভাষ্য সমুহ দ্বারা অদ্বৈতমতে
প্রবৃত্ত করত নিবৃত্তিমার্গ সন্ন্যাস ধৰ্ম্মে স্থাপন করলেন, দ্বৈতসাধক বাদীগণের পক্ষ
এককালে বিলীন হয়ে গেল, অবনীতে শিষ্টজনগণ মধ্যে অদ্বৈতবেদান্ত বিশেষরূপে প্রচার হল।
কাণাদ, কাপালিক, বীরাচারী, শৈব, পাশুপত, মাহেশ্বর, বৈষ্ণবমত সমস্ত নিরস্ত হয়ে মানব
সকল আচার্য্যোক্তি মত বেদান্তে নিরত হলেন, যে ভগবান শঙ্কর নিখিল জনগণের নিরবধি সুখহেতু
এবং দুঃখাকর সমুল বিনাশক, জন্ম-মৃত্যুভয় হন্তা, তিনি করুণাবশে মনুষ্য বেশ ধারণ করে
শিষ্যগণ সহ ভূতলে বিহার করত ব্ৰহ্মজ্ঞানানন্দ নিবন্ধ বিস্তার করলেন তাঁর জয় পুনঃ পুনঃ
তাঁর জয়।
'দুষ্ট কাপালিক কর্তৃক শঙ্করের মস্তকভিক্ষা এবং আচার্যের অঙ্গীকার'
এইভাবে অতি অল্পদিনেই শঙ্করাচার্য্যের প্রভাব এখানে অতিবিস্তৃত হয়ে পড়ল। দেশীয় রাজন্যবর্গরা
ধীরে ধীরে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে লাগলেন। এতে ভিন্নমতাবলম্বীদের মধ্যে আচার্য্যের
প্রতি প্রবল হিংসার উদয় হল। তন্মধ্যে কাপালিক সম্প্রদায়ের ক্রোধ কিছু অত্যাধিক হয়ে
উঠল। অদূর দক্ষিণে কর্ণাটদেশীয় কাপালিক রাজ 'ক্রকচ' এই সংবাদ পেয়ে বিচলিত হলেন। তিনি
আচার্য্যের বধ উদ্দেশ্যে লোক নিযুক্ত করলেন। ক্রকচের শিষ্য উগ্রভৈরব একজন কাপালিক-সম্প্রদায়ের
অতিবৃদ্ধ সাধক এবং শ্রীশৈলে কাপালিক সম্প্রদায়ের নেতা।
এক সময় শঙ্করাচার্য্য নির্জন স্থানে উপবিষ্ট ছিলেন, বেশান্তর ধারী দুষ্ট কাপালিক সমীপবৰ্ত্তী
হয়ে দম্ভভক্তি প্রকাশ করত নিবেদন করল, আমার মহৎ ভাগ্য, যে আপনার সন্দর্শন প্রাপ্তিতে
চরিতার্থ হলাম, আপনার গুণসমূহ শ্রবণ করে চিরদিবস দর্শনের উৎকণ্ঠ প্রবল ছিল, তৎঅভিলাষে
এখানে আসিয়া ভাগ্যবশে তা লাভ ও মানস সফল হল,আপনি পরোপকার ব্রতী, শান্ত, এহেতু যতিবরের
শরণাগত হলাম, সাধু ও সজ্জনগণের দয়া স্বভাবে হীনও বঞ্চিত হয় না, আমি যে নিমিত্ত এসেছি
সে আত্মবৃত্তান্ত বিজ্ঞাপন করি। মুনে, এক সময় দৈবযোগে আমার অন্তঃকরণে সঙ্কল্প উদয়
হল, যে, এই শরীরে কৈলাসে গমন করে শূলপাণি মহেশ্বরের সহিত যথাভিলাষে ক্রীড়া করি, তৎসাধন
মানসে অনেক দিবস মহাদেবের তপস্যা করলাম, কৃপানিধি তপাচরণে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে আদেশ
করলেন, হে তাপস, তোমার মনোরথ সিদ্ধ হবে যদি অগ্ৰে কোন সৰ্ব্বজ্ঞ বা রাজার মস্তক উপহার
দিতে সক্ষম হও, তবে তুমি সিদ্ধ হবা অন্যথা নয়, ইহা বলে অন্তর্ধান হলেন। তদবধি আমি সে অনুজ্ঞা সাধনে বহুল প্রকার প্রযত্ন
করলাম,কিন্তু কোন রাজার বা সৰ্ব্বজ্ঞের মস্তক প্রাপ্ত হলাম না। অদ্য ভাগ্যোদয়ে সৰ্ব্বগুণাকর
আপনাকে লব্ধ হলাম। মুনে, আমার এ অভীষ্ট সিদ্ধি আপনার সাধ্যায়ত্ত, অধুনা আমার আর বক্তব্য
কি, মস্তকটি প্রদান করলে আপনার মহতী সৎকীৰ্ত্তি লাভ হবে। মুনে তোমা ভিন্ন সৰ্ব্বজ্ঞ
বা রাজার শিরঃ দুর্লভ, যাচকের ভিক্ষা অধম পুরুষেও নিস্ফল হয় না। আপনি সর্বগুণাধিক,
আপনার নিকট আমার যাঞ্চা ও আশা ফলবতী হবে ইহার সংশয় নেই, যেহেতু আপনি মমতাশূন্য ও নিরহঙ্কার
এবং রাগরহিত। এ ক্ষণভঙ্গুর নশ্বর কলেবরে তোমার অহং ভাব নেই, অতএব নশ্বর মস্তকটা আমাকে
প্রদান করয়ে চিরস্মরণীয়া সৎকীৰ্ত্তি লাভ করুন। দধিচি প্রভৃতি সন্তগণ শরীরকে নশ্বর
জেনেয তৎক্ষণে ক্ষণভঙ্গুর দেহ পরোপকার নিমিত্ত পরিত্যাগ করে পরম কীর্তি লাভ করেছেন।
আপনার শরীরে বা জীবিতে কোন প্রয়োজন নেই,ও কো ভোগেচ্ছাও নেই। সৎ উপকারীগণের সাধ্যায়ত্ত
বিষয় ভবাদৃশ উদার সাধুগণের কি দেহ দুস্ত্যজ্য। স্বামিন তোমার শরণ, ইহা বলে ভূতলে পতিত
হল। শঙ্কর করুণানিধি, কাপালিকের কপট কাতরোক্তি শ্রবণে করুণরসাদ্রীভূতচিত্ত হয়ে কাপালিকে
বৈরাগ্যগৰ্ভিত ও আশ্বাসান্তরিত বাক্যে বললেন, এ শরীর স্বকৰ্ম্মেতে অবশ্য স্বয়ং কালে
পতিত হবে, যদি ইহাতে তোমার প্রয়েtজন সিদ্ধ হয়, তবে ইহা অবশ্য প্রদান করব, তুমি সাবধানে
নির্জনে আসবা, যেন শিষ্যগণ ইহা অবগত হতে না পারে, কারণ
আমি তাদের অতি প্রিয়। কাপালিক শঙ্কর হতে এই আশ্বাস-বাক্য শ্রবণ করযে উল্লাসমনে স্বাশ্রমে
গমন করল।
'নৃসিংহদেবের আবির্ভাব ও কাপালিক নিধন'
এক দিবস যে সময়ে ভাষ্যকারের শিষ্যবৰ্গ স্ব স্ব শারীরিক কার্য্যে নিজনিজাশ্রমে অবস্থিত
ছিলেন, দুষ্ট কাপালিক আচাৰ্য্যকে নির্জনে একাকী উপবিষ্ট অবগত হয়ে তদন্তিকে সমুপস্থিত
হইল। গুরুভক্ত, আজানসিদ্ধ পদ্মপাদ, দাম্ভিকের সৰ্ব্বচেষ্টিত উপলব্ধি করত স্বশরীর আচ্ছাদিত
করে গুরুর নিকটবৰ্ত্তী স্থানে গুপ্তভাবে রইলেন, তা দাম্ভিক কাপালিক জানতে পারে নি।
কাপালিক, শূলধারী ত্রিপুণ্ড্র, সম্পন্ন শিরোমালা বিভূষিত কালপ্রেরিত হয়ে শঙ্করাগ্রে
সমাগত হল। যতিবর তাঁকে অবলোকন করে প্রতিশ্রুতি স্মরণে দেহত্যাগ মানসে আত্মমনঃ সংযোগে
নির্বিকল্প সমাধিতে স্থিত হলেন। কাপালিক তাঁকে তদ্ভাবে অবস্থিত দর্শন করে তৎক্ষণে শূলোদ্ভূত
করত হনন করতে সমুদ্যত হল। পদ্মপাদ, গোপনে কাপালিকে শূলহস্ত তদ্ভাবে সমালোকন করে তৎকালে
উপায়ান্তর না দেখে শ্রীনৃসিংহদেবকে স্মরণ করতে করতে গুরুর অগ্ৰে স্থিত হয়ে আত্মমনঃ
সংযোগে সিদ্ধমন্ত্র জপে প্রবৃত্ত হলেন। মন্ত্রারাধিত ভক্তবৎসল নরহরি তৎক্ষণে আবির্ভূত
হয়ে অধম কাপালিকে সম্মুখে দেখে হিরণ্যকশিপু তুল্য নখাগ্র দ্বারা বিদীর্ণ করৃ ঘোর নাদসহ
অট্টহাসে ভূতল ত্ৰাসিত করলেন। সে শব্দ শ্রবণে অন্য শিষ্যগণ ভীত ও ধাবিত হলেন। তৎস্থানে
সমাগত হয়ে গুরুকে সমাধিস্থ এবং অগ্রে শ্রীনৃসিংহদেবকে দর্শন করে বিস্ময়াপন্ন হয়ে
ভীতিযুক্ত ভক্তিভাবে প্রণাম করলেন। শ্রীনৃসিংহ দেব এ প্রকার সকলের ভক্তিভাবদর্শনে
সাহ্লাদ মনে মহা গর্জন করলেন সেই গর্জনের শব্দে শঙ্কর সমাধি হতে বিরাম প্রাপ্ত হয়ে
নেত্রদ্বয় প্রোন্মীলন করে সম্মুখে নৃসিংহদেবকে দর্শন করলেন যে বিশ্বম্ভর গর্জ্জন করছেন,
শঙ্কর তাঁর দর্শনোৎসবে আনন্দিত হয়ে তাঁকে স্তব দ্বারা সন্তুষ্ট করলেন যা লক্ষ্মী-নরসিংহ স্তোত্র নামে প্রসিদ্ধ। ইতোমধ্যে
শ্রীশৈলে সর্বত্র এই কথা প্রচারিত হয়ে পড়েছে। কাপালিকগণ এই অদ্ভূত ঘটনা শুনে দলে দলে
আচার্য্যের শিষ্য হতে লাগলেন। সকলেরই মুখে আচার্য্যের উদারতা, স্বার্থত্যাগ ও পরহিতপরায়ণতার
কথা। পণ্ডিতগণ আচার্য্যকে মহামুনি দধীচির সহিত তুলনা করতে লাগলেন।
'গোকর্ণে শঙ্কর ও শৈব নীলকন্ঠের সহিত বিচার'
সুবিখ্যাত সৎকীৰ্ত্তি শঙ্কর যতীশ্বর শিষ্যগণ সমভিব্যাহারে তীর্থস্থান সকল পর্য্যটন
করত গোকৰ্ণাখ্য শিবালয়ে সমুপস্থিত হলেন। তীর্থ-সলিলে অবগাহন ও শিব দর্শন করে ভক্তিভাবে
স্তুতি নতি করলেন। সে স্থানে ত্রিরাত্রি অবস্থিতি করলেন। বস্তুতঃ গোকর্ণ কিন্তু বিচারমল্ল
সম্প্রদায়-প্রবর্তক পণ্ডিতহীন ছিল না। এসময় এখানে পাশুপতমতাবলম্বী শৈব নীলকন্ঠ নামক
বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন, তিনি ব্রহ্মসূত্রের 'শিবতৎপর' নামক ভাষ্যরচনা করে পণ্ডিতসমাজে
লব্ধপ্রতিষ্ঠ হয়েছিলেন। দিগ্বিজয়ী আচার্য্যের আগমন শুনে তিনি স্বয়ং এসে বিচার করা উচিত
বিবেচনা করলেন না, তিনি বিচারার্থ তাঁর হরদত্ত নামক এক শিষ্যকে প্রেরণ করলেন। হরদত্ত
বিচার তো দূরে থাক আচার্য্যের অদ্বৈতসিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা শুনে মুগ্ধ হয়ে নিজগুরু নীলকন্ঠের
সম্মুখে এসে শঙ্করের ভূয়সী প্রশংসা কতে শুরু করলেন। নীলকণ্ঠ আর কালবিলম্ব না করে স্বয়ংই
শিষ্য সমেত বিচারার্থ গমন করলেন। বিচার শুরু হল, নীলকন্ঠ শৈবমতের ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত
হলেন আর সঙ্গে সঙ্গে অদ্বৈতমতের দোষারোপ করতে লাগলেন। পদ্মপাদ মৃদু মৃদু হাস্য করছিলেন।
আচার্য্য উদাসীনতায় উপবিষ্ট রইলেন। সুরেশ্বর তা দেখে নিজেই বিচারে প্রবৃত্ত হতে চাইলেন।
কিন্তু নীলকন্ঠ বললেন আপনি নিঃসন্দেহে পণ্ডিত কিন্তু আপনি তো ইঁহার নিকট পরাজিত, তিনি
থাকতে আপনার সঙ্গে বিচার করব কেন? সুরেশ্বর ইহা শুনে ইষৎ হাস্য করে আচার্য্যের প্রতি
দৃষ্টিপাত করলেন। আচার্য্যের সাথে বিচার প্রারম্ভ হল। ক্রমে বিচার গুরুতর হয়ে উঠল।
একপর্যায়ে পাশুপত সিদ্ধান্ত ছেড়ে নীলকন্ঠ আপত্তিমুখে কখন কপিলমত অবলম্বন করেন কখনও
বা বৈশেষিকমত অবলম্বন করেন। কিন্তু কিছুতেই সুবিধা করতে পারলেন না। অবশেষে ব্যোমশিবের
সপ্তপদার্থী অবলম্বনে তিনি তর্ক করতে লাগলেন। কিন্তু মহাপ্রাজ্ঞ আচার্য্যের সম্মুখে
পরাস্ত হলেন। অগত্যা নীলকন্ঠ নিরুত্তর হয়ে আচার্য্যের অদ্বৈত সিদ্ধান্ত শ্রবণেচ্ছু
হলেন। শঙ্কর অতি প্রসন্নভাবেই অদ্বৈতবাদের প্রকৃতরহস্যসমুদয় বিবৃত করতে লাগলেন। নীলকন্ঠ
মুগ্ধ হয়ে বললেন-'যতিবর! আমি বুঝলাম আপনার সিদ্ধান্তই যথার্থ। উপাসকের
পক্ষে আমাদের মত বহুদূর উপকার সাধন করতে পারে কিন্তু ব্রহ্মাত্মৈকত্ব জ্ঞান ভিন্ন নিঃশ্রেয়স
লাভ অসম্ভব।' এই বলে নীলকন্ঠ আচার্য্যের পদধূলি গ্রহণ করলেন এবং গৃহে এসে তাঁর 'শিবতৎপর'
ভাষ্যগ্রন্থখানি জলে বিসর্জন দিলেন। গোকর্ণে আচার্য্যের জয়জয়কার বিঘোষিত হল। ইহাদের
শিষ্যবর্গ অনেকেই আচার্য্যের অদ্বৈতমত গ্রহণ করলেন, অনেকেই আবার নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক
নিষ্ঠায় ভগবানের উপসনায় রত রইলেন। যেহেতু অদ্বৈতসিদ্ধান্ত কারও উপসনাকালে দ্বৈতভাবের
বিরোধী নয়।
'শঙ্করের তীর্থপর্যটন, মৃত বালকের জীবনদান ও হস্তামলক উপাখ্যান'
গোকর্ণ পরিত্যাগ করে আচার্য্য শঙ্কর পূর্বাভিমুখে হরি-শঙ্করপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা
করলেন। চালুক্যরাজ বিক্রমাদিত্যের ভ্রাতা আদিত্যবর্মনের ইহা রাজধানী। হরি ও হরের ভেদবুদ্ধি অপনয়নের জন্য পুরাকাল হতে
হরি ও হর এখানে অভিন্নবেশে বিরাজমান। সেখানে হরিহরালয়ে উপনীত হয় হরিহরকে দর্শন ও প্রণাম
করে সুললিত ভাবপূর্ণ স্তোত্র দ্বারা ভগবানের পূজা
করলেন। হরিশঙ্করপুর হতে শঙ্কর মূকাম্বিকা নামক তীর্থে আগমন করলেন। এখানে অম্বিকা দেবীর কৃপায় মূকেরও
বাক্যস্ফুর্তি হয় বলে ইহা 'মূকাম্বিকা' নামে প্রসিদ্ধ। আচার্য্য দেবীদর্শনের উদ্দেশ্যে
যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে এক দম্পতী পুত্র ক্রোড়ে করে বহুবিধ বিলাপ
ও রোদন করছিল, শঙ্কর দয়ানিধি তা সমবলোকনে করুণারসাদ্র হয়ে বললেন, বৎস তোমরা শোক সম্বরণ
কর, শ্রীনৃসিংহদেব রক্ষাকৰ্ত্ত আছেন। যতীশ্বর ইহা বলে ভক্তি মানসে নরহরিকে স্মরণ করলেন,
শঙ্করের মুখাম্বুজ হতে নৃসিংহ রক্ষা কৰ্ত্তা এই সুধা-সঞ্চারিণী বাণী নির্গত হওয়ামাত্র
তৎক্ষণে মৃতশিশু সুপ্তজাগ্ৰৎ তুল্য মাতৃক্রোড় হতে সমুথ্থিত হল। তখন স্থানীয়রা যতীশ্বরের
অদ্ভুত চরিত দর্শন করে বিস্ময়াপন্ন হয়ে শঙ্করের বিস্তর স্তুতি করলেন। শঙ্কর তথা হতে
মুকাম্বিকা ভবন প্রাপ্ত হয়ে বিধিবৎ পূজাদি সম্পন্ন করণান্তর শ্রীবেলী ক্ষেত্রে যাত্রা
করলেন। সেস্থানে সমুপস্থিত হয়ে কৰ্ম্মমার্গপরায়ণ ব্রাহ্মণগণকে দেখলেন। প্রায়
দুইসহস্র সঙ্খ্যক মুখ্য শাস্ত্রবিশারদ দ্বিজগণ বেদ পাঠক ও অগ্নিহোত্রি ছিলেন। সেই ক্ষেত্রে
(আকাশে পূর্ণসুধাকর সদৃশ) শিব সজ্জননিকরের চিত্ত আহ্লাদিত করত বিরাজ করছিলেন। সে স্থানে
প্রভাকর নামা দ্বিজবর বেদবেদাঙ্গ পারগ, প্রবৃত্তি শাস্ত্র নিরতকৃতী ধনাঢ্য বাস করেন।
তাঁর এক পুত্র অন্তর্জ্ঞানী ব্রহ্মবিদ্বর, বহির্মুখ জড় মূকাকৃতি হয়েছিল। তিনি কিছুমাত্র
বলেন না ও শুনেন না ও না বেদ পাঠ করেন। প্রভাকর আপন তনয়কে জড় সদৃশ সন্দর্শন করে সীমামিত
চিন্তাকুলিত-চিত্ত হয়েছিলেন। বরং অপুত্রত্ব শ্রেয়, মূক পুত্র কিছু নয়। সৰ্ব্বদা
মনে মনে আলোচনা করেন, যে সংসারে এমত কি উপায় আছে, যাতে এ পুত্র পণ্ডিত হয়। ইতিমধ্যে
লোকপ্রমুখাৎ এই বার্তা শ্রুতিগোচর হল, যে শঙ্করাচার্য্যাখ্য কোন সন্ন্যাসী ভিক্ষু সৰ্ব্বজ্ঞ
সৰ্ব্বশক্তিমান সকল গুণের আকর, জ্ঞানের সাগর, বেদবেদাঙ্গ পারগ, তাদৃশ শিষ্যগণেতে যুক্ত,
এ স্থানে সমাগত হয়েছেন। প্রভাকর এই সম্বাদ শ্রবণে হৰ্ষনির্ভারান্তঃকরণে পুত্র নিয়ে
পৌরজনে সমাৰ্বত হয়ে আচার্য্যের উদ্দেশ্যে গমন করলেন, এবং দূর হতে সপুত্র ভাষ্যকারকে
দর্শন করে ভূমিষ্ঠ হয়ে দণ্ডবৎ প্রণাম করলেন। পুনঃ পুনঃ প্রণতি করতে করতে পদদ্বয়ে
নিপতিত হলেন, আর ভক্তিপূর্বক ভাষ্যকারের চরণ যুগল গ্রহণ করয়ে বালকের মস্তকোপরি ন্যস্ত
করত বারম্বার প্রণিপাত করলেন। প্রভাকরের পুত্র অতি মেধাবী ব্রহ্মানন্দৈকতৎপর ভগবৎপূজ্য-পাদের
পদযুগলে ভূমিতলে নিপতিত হয়ে রইলেন; স্বয়ং উথ্থান না হলে শঙ্কর কৃপাবশে অবশেষে স্বহস্তে
ধৃত করত উথ্থাপন করে আপন সমীপে উপবেশন করালেন। প্রভাকর করুণাকর শঙ্করকে এরূপ কৃপাচ্ছন্ন
দেখে বিনীতভাবে সবিনয়ে পুত্রের বিবরণ নিবেদন করলেন, ভগবন! এ বালকের বয়ক্রম ত্রয়োদশ
বর্ষ হল, বেদাধ্যায়ন করে না ও না বালকবৃন্দের সহিত কখন ক্রীড়া করে, কভু ভোজন করে
কখনো বা না করে, কারও সহিত কোন বাক্য কহে না, কি বলিব ঠিক যেন জড়পদার্থ। প্রভাকর পুত্রের
বৃত্তান্ত বলে বিরত হলে শ্ৰীশঙ্করাচার্য্য অতি যত্নে বালককে জিজ্ঞাসা করলেন, শিশু,
তুমি কে ? কি নিমিত্ত জড়রূপ হয়ে আছ?
'শৃঙ্গেরীতে মঠ নিৰ্ম্মাণ'
'গিরি
নামক শিষ্য প্রতি সৰ্ব্ববিদ্যানিয়োগ এবং তোটকাচার্য্য খ্যাতি'
যতীশ্বরের কোন শিষ্য গিরিনামধেয় সুধী, বীতরাগ, নিঃসঙ্গ, গুরুভক্ত, এবং গুরুপ্রিয় ছিলেন। দন্তকাষ্ঠাদি দ্বারা অতি সাদরে গুরুশুশ্রষাতে নিরত থাকিতেন । এমন কি গুরু গমন করলে গমন করতেন, স্থিত হলে স্থিত হতেন গুরুর অনুজ্ঞাভিন্ন বাক্য বলতেন না। গুরু-পাদপদ্মে একান্ত রত ও অবিচলিতচিত্ত এবং নিষ্ঠাযুক্ত ছিলেন। এক সময় পদ্মপাদাদি শিষ্যগণ ভাষ্য পাঠের প্রারম্ভে প্রথম শান্তি পাঠে সমুদ্যত হলে ভাষ্যকার বললেন, কিঞ্চিৎ বিলম্ব কর, ভক্তিমান গিরি ক্ষণমধ্যে আসছে। গুরুর এই বাক্য শ্রবণ করিয়া পদ্মপাদ বললেন, গুরো, গম্ভীর ভাষার্থে মন্দবুদ্ধির কি প্রতীক্ষা করছেন। শঙ্কর যতিবর পদ্মপাদের বাক্য শ্রুতিগোচর হলে চিন্তা করলেন, অহো, ইহার মহাগৰ্ব্ব নষ্ট করা আমার ধৰ্ম্ম। ইহা বিবেচনা করে গিরিশিষ্যের প্রতি চতুর্দশ বিদ্যা নিয়োজিত করলেন। তখন গিরি শ্ৰীগুরুর করুণা প্রভাবে সমস্ত বিদ্যাতে অধিগত হয়ে অতি সন্তুষ্টমনে গুরুভক্তি-সমন্বিত তোটকছন্দে স্তুতি করতে করতে সমাগত হলেন। অদ্যাপি তার প্রণীত ব্ৰহ্মাত্মৈক্য-পরায়ণ রচনা অবনীমণ্ডলে প্রসিদ্ধ ও প্রথিত আছে। তৎকালে পদ্মপাদাদি সকলে গিরির বাগ্বিলাস শ্রবণ করে বিষ্ময়াপন্ন ও ত্যক্ত গৌরব হলেন।
অহো, যার প্রতি গুরুর কৃপালেশ হয়, সেই বাচস্পতি, ইহার সংশয় নেই;
পদ্মপাদাদি ইহা কহিয়া গৰ্বশূন্য খৰ্বাভিমান হলেন। অদ্যাবধি পণ্ডিত-সমাজে গিরি তোটক
আখ্য বিখ্যাত আছেন। তৎপরে গুরুসেবায় মুগ্ধ হয়ে মূর্খে বিদ্যা সঞ্চার
পূর্বক এই ব্রাক্ষণ কুমারকে শঙ্কর তাঁর শিষ্য পদে নিযুক্ত করেন। গিরি পূৰ্ব্বে শাস্ত্রানভিজ্ঞ ও বিদ্যাপরাঙ্মুখ
ছিলেন, অধুনা গুরু-কৃপা-বশে সর্ব্বশাস্ত্রসম্পন্ন এবং পাণ্ডিত্যে পদ্মপাদাদির সমকক্ষ
হলেন। পদ্মপাদ, সুরেশ্বর, গিরি, এবং হস্তামলক এই চারজন ভাষ্যকারের শিষ্য মধ্যে প্রধানরূপে
প্রথিত ছিলেন। যেমত সনকাদি ঋগবেদাদি বেত্তা ছিলেন, সেমত এ মহাত্মাগণ বেদান্তার্থে সুনিপুন
ও কুশলীভূত ছিলেন।
'সুরেশ্বরের
শারীরকভাষ্যের উপর বার্ত্তিক করণে ইচ্ছা'
বেদবেত্তাগণের
শ্রেষ্ঠ সুরেশ্বর যতি স্বীয়ান্তঃকরণে আচার্য্যের সূত্রভাষ্য বাৰ্ত্তিক করণেচ্ছু হয়ে
শিষ্যগণ মধ্যে সংস্থিত গুরুকে প্রণাম করে বিনয়ে নিবেদন করলেন, ভগবন, শিষ্যগণের শ্রীগুরুপাদপদ্মের
শুশ্ৰষা সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য, এ অকিঞ্চনের প্রতি কিঞ্চিৎ অনুজ্ঞা প্রকাশ করুন। ভাষ্যকার,
সুরেশ্বরের বিনয়রসগৰ্ভিত বাক্য শ্রবণে তার অভিসন্ধি উপলব্ধি করে বললেন, সুরেশ্বর,
তুমি ধন্য ও প্রতিযোগ্য এবং ভক্তিমান, শারীরক ভাষ্যে তোমার বাৰ্ত্তিক করা কৰ্ত্তব্য।
যেমত সূত্র ও যে প্রকার ভাষ্য সেরূপ উৎকৃষ্ট বাৰ্ত্তিক কর। যৎকালে শারীরকে ভাষ্য করেছি,
তদবধি আমার এই মানস যে শারীরক ভাষ্যে যথার্থরূপ বার্তিক করতে পারবে এমত প্রতিভানিৰ্ম্মল
পণ্ডিত ইহলোকে কে আছে, ইহাই চিন্তা করি। সংপ্রতি এবিষয়ে তোমার প্রতিভা সমর্থ আমার
বোধ হচ্ছে। অতএব তুমি সুন্দর যুক্তি-বাক্যার্থ সহিত উৎকৃষ্ট বাৰ্ত্তিক নিৰ্ম্মাণ কর।
ভাষ্যকারের অনুজ্ঞা শ্রবণে সুরেশ্বর হৃষ্টমনা গুরুভক্তিতে সন্নিবিষ্ট হয়ে বারম্বার
প্রণাম করযে বিনীতভাবে নিবেদন করলেন, বিভো, ভাষ্য-তাৎপৰ্য্য-বোধনী তাদৃশী শক্তি কোথায় ? তথাপি আপনার বিস্তুৃত কৃপালেশ প্রভাবে যথাশক্তি সাধ্যায়ত্তমত যত্ন করব। গুরু
তথাস্তু বললে সুরেশ্বর লব্ধানুজ্ঞ হয়ে অতীব হর্ষে স্বাশ্রমে গমন করলেন।
সুরেশ্বরের
গমনান্তর চিৎসুখাদি সন্ন্যাসিগণ, আচার্যের শিষ্যবৰ্গ, পরস্পর ঐক্যমতে সমবেত হয়ে গুরুর
নিকট আগমন করে নিবেদন করলেন, ভগবান, আপনি সৰ্ব্বজ্ঞ, কিছু মাত্র শ্রীচরণে অবিদিত নেই,
তথাপি আমরা কিঞ্চিৎ বিজ্ঞাপন করবার মানসে অনুজ্ঞ প্রার্থনা করছি। গুরু বললেন, কি বলতে
বাসনা বল। তখন শিষ্যবৃন্দ বললেন, প্রভো, সুরেশ্বর ভিক্ষু যে প্রযত্নে প্রবর্ত হয়েছেন,
তা নিঃসন্দেহে হিতকর ও শ্রেয়ঃসাধ্য বোধ হচ্ছে না; কারণ অতি গম্ভীর বেদান্তার্থে উহার
যথোচিত প্রবৃত্তি নেই। যে কৰ্ম্মমার্গ শ্রুতি-স্মৃতি-প্রসিদ্ধ সর্বভূত-নিয়ন্তা পরমেশ্বরকে
নিরাকরণ করেছে, যার কৰ্ম্মান্বিত বুদ্ধি ও শব্দশক্তি আগ্রহ-হেতু সিদ্ধবস্তুতে নেই বুদ্ধি
হয়েছে, সে ব্যক্তি শারীরকভাষ্যে বাৰ্ত্তিক করণে কি প্রকারে সুযোগ্য হতে পারে। গুরু-পক্ষ
সমাশ্রয় করে অদ্বৈতমত অবলম্বন করবে, ইহাই সঙ্গত বোধ হয়, বিরোধে বিধেয় নয়। প্রভো,
বেদান্তাম্বুজ-বিভাকর মহর্ষি ভগবান বেদব্যাস সমস্ত বেদের তাৎপর্য্য কেবল ব্রহ্মেতে
প্রতিপাদন করেছেন। কিন্তু জৈমিনি, তার শিষ্য, সকল বেদের তাৎপর্য্য গুরুপক্ষবিরুদ্ধ
কৰ্ম্মেতে সুত্ৰিত করেছেন। শ্ৰীমৎ কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ পুরাণ-বেদ-সংসিদ্ধ যুক্তি উক্তি করেছেন।
যৈমিনি তদ্বিরুদ্ধ যুক্তির ভাব বলেছেন। তাদের এরূপ মতভেদে কিরূপে গুরু শিষ্যতা সম্মত
হয়। মতের ঐক্যতাতে গুরু শিষ্যত্ব তাই মানবগণের সুখপ্রদ হতে পারে। অপিচ ইনি আজন্ম কৰ্ম্মেতে
স্থিত ও বিরুদ্ধ নৈষ্কৰ্ম্ম্য ব্রহ্মপরতা কি কোন প্রকারে সঙ্গত হতে পারে। প্রত্যুত
ভাষ্যকে কৰ্ম্মেতেই সংযোজিত করবেন, ও নির্ণীতাৰ্থ নিমিত্ত সংশয়ে সংযোগ কৃত হবে, তার
সংশয় নেই। বুদ্ধি পূর্বক সংন্যাস গ্রহণ হয় নি, পরাজিত হয়ে অবলম্বন করেছেন, ইহার
মত আমাদের বিশ্বাস স্থল বোধ হয় না । আরো (কৰ্ম্মে প্রবৃত্ত জনগণ সংন্যাসে অধিকারী
নয়) এরূপ দুরাগ্ৰহ যার সে ব্যক্তি কিপ্রকারে বাৰ্ত্তিকে যোগ্য বিবেচিত হতে পারে? অতএব
সনন্দনযতি শ্রীমানের কৃত ভাষ্যে বাৰ্ত্তিক করবার যোগ্য পাত্র, ইনি সিদ্ধ এবং বেদান্তপারগ।
পূর্বে আমরা জাহ্নবীপারে আপনার আজ্ঞামতে সমীপ গমনে ইহার মহান মহিমা প্রত্যক্ষ অবলোকন
করেছি, যাতে পদ্মপাদখ্যাতি প্রাপ্ত হয়েছেন, আর যাকে স্বয়ং শ্রীনৃসিংহদেব সাক্ষাৎ প্রসন্ন
ও বরপ্রদ এরূপ আছেন যে স্মরণ মাত্রই সমীপস্থ হয়ে থাকেন। অথবা শ্রীআনন্দগিরি সাক্ষাৎ
বৃহস্পতি, ভায্যে বাৰ্ত্তিক করণে যোগ্য, যাকে স্বয়ং শারদা প্রসন্ন সমীপবৰ্ত্তিনী আছেন।
এই মুনি সৰ্ব্বপ্রকারে বাৰ্ত্তিক করণের উপযুক্ত পাত্র। পরে পদ্মপাদ সাদরে গুরুকে নিবেদন
করলেন, ভগবন, আর্য সদৃদ্ধি বেদ-গুহাৰ্থ-বিভাকর শ্রীমান হস্তামলকাচাৰ্য ভায্যে বাৰ্ত্তিক
করণে সমর্থ, যিনি পূর্বে বেদান্তসিদ্ধান্ত প্রকাশ করে বলেছেন, যথা ব্যাসদেব সাক্ষাৎ
নারায়ণও আপনি ভগবান শম্ভু উভয়ে সূত্র ও ভাষ্য প্রণেতা তথা ইনি বাৰ্ত্তিক বিষয়ে ধীশক্তি
সম্পন্ন হযন। ভাষ্যকার পদ্মপাদের বচন শ্রবণ করে প্রসন্ন বদনে বললেন, সত্য বটে, ইহার
এবিষয়ে নৈপুণ্য বিলক্ষণ আছে, কিন্তু ইনি প্রতিপত্তি ভাজন নহেন। বাল্যে পিতা কর্তৃক
অক্ষর পাঠে নিয়োজিত হন নি এবং আচাৰ্য্য দ্বারা উপনীত হয়ে বেদাধ্যায়ন করেন নি, আমার
নিকট আগত হয়ে জিজ্ঞাসামতে বেদান্তশাস্ত্র সিদ্ধান্ত রহস্য যা বলেছেন, তোমরা শ্রবণ
করেছ, যে ইনি সতত জ্ঞান দ্বারা অদ্বৈতানন্দ সিন্ধুতে নিমগ্ন তিনি এমহত্তর প্রবন্ধ বিষয়ে
কিরূপে প্রবৃত্ত হবেন?
পদ্মপাদ গুরুবাক্য শ্রবণে সংশয়াবিষ্ট মনে বিনয়ান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, গুরো, শ্রবণাদি বিনা ইহার কি প্রকারে জ্ঞানোৎপন্ন হল। গুরু বললেন, বৃত্তান্ত শ্রবণ কর, পূৰ্ব্বে কোন সিদ্ধ যমুনা স্রোতস্বতী-তীরে কুটারে অবস্থিত হয়ে জীবনযাপন করতেন। তিনি বিরক্ত শ্ৰৌতজ্ঞানসম্পন্ন, ব্রহ্মতৎপর, যোগসিদ্ধ ও তপঃসিদ্ধ এবং বিদ্যাসিদ্ধ ছিলেন। এক দিবস কোন ব্রাহ্মণতনয় স্বীয় শিশুপুত্র ক্রোড়ে নিয়ে স্নানার্থিনী সেই স্থানে সমাগত হলেন। এবং উক্ত মহাত্মার সমীপগত হয়ে বালকটী তদন্তিকে রেখে বললেন, মুনে, ক্ষণকাল শিশুকে রক্ষা করবেন। ইহা বলে সখীগণ সমভিব্যাহারে স্নানজন্য অন্য ঘাটে গমন করলেন। ইতিমধ্যে বালক চাঞ্চল্য স্বভাববশতঃ নদীতে পতিত হয়ে ত্যক্ত-প্রাণ হয়েছে, মুনি তা অবগত নন। বিপ্ৰনন্দিনী স্নানক্রিয়াবসানে সখীগণসঙ্গে সিদ্ধের কুটীরান্তিকে প্রত্যাগত হয়ে শিশুকে মৃত দেখে শোকাকুল বিহবল বিলাপ করত সখীগণ সহ উচ্চৈঃস্বরে হাহাকার করত ক্ৰন্দন করতে লাগলেন। সিদ্ধ তাদের অবস্থা সন্দর্শন ও রোদন শ্রবণে করুণারসাদ্রিত হলেন। কোন উপায় না দেখেয যোগ দ্বারা আপন শরীর পরিত্যাগ করে বালকের মৃত কলেবরে প্রবেশ করলেন। বিপ্রতনয়া শিশুকে সুপ্তোথ্থিত-প্রায় অবলোকন করে সীমামিত হর্ষ সম্পন্ন ও আনন্দোৎফুল্লমন হয়ে বালককে নিয়ে সখীসঙ্গে সত্বর স্বভবনে গমন করলেন, ইনি সেই সিদ্ধ জ্ঞানিগণ-শ্রেষ্ঠ হস্তামলক নাম প্রাপ্ত হয়েছেন। বামদেব সদৃশ ইহার শ্রবণ বিনা জ্ঞান, ইনি পূৰ্ব্বাভ্যাসবশে সিদ্ধ, এবিষয়ে শঙ্কার অবকাশ নেই। সমস্ত বেদান্তের বাৰ্ত্তিক করণে ইহার বিলক্ষণ সামর্থ্য, ইহা অবগত আছি, কিন্তু এপ্রবৃত্তিতে কোন মতে অভিরুচি জন্মিবে না।
'সুরেশ্বরের
নৈষ্কৰ্ম্ম্যসিদ্ধ গ্রন্থ নিৰ্ম্মাণ'
ভাষ্যকার বললেন- সৰ্ব্ববিৎ সুরেশ্বর ভাষ্যে বাৰ্ত্তিক করণে সৰ্ব্বতোভাবে ক্ষমতাবান। তৎকৃত সদ্ধাৰ্ত্তিকে তোমাদের রুচি হচ্ছে না। সুতরাং যা অনেকের অনভিমত তা আমি কিপ্রকারে উলঙ্ঘন করব। পদ্মপাদ সুত্র ভাষ্যে এক নিবন্ধন করুন, বাৰ্ত্তিক কৰ্ত্তব্য বিহিত হয় না, যেহেতু পূর্বে এবিষয়ে সুরেশ্বরকে প্রতিশ্রুত হয়েছি। যদিচ তিনি না করুন তথাপি আজ্ঞা প্রদত্ত হয়েছে, অন্যে তা কিপ্রকারে করতে পারেন। শঙ্কর শিষ্যগণকে এ প্রকার আদেশ করে নির্জনে উপবিষ্ট হয়ে সুরেশ্বরকে আহ্বান করে বললেন, সুরেশ্বর তুমি ভাষ্যে বাৰ্ত্তিক করিবে না, সকলে বলছে তুমি কর্ম্মকাণ্ডে কুশল, ভাষ্যের বাৰ্ত্তিকে অন্যথা ব্যাখ্যা করিবে। চিৎসুখাদি তোমাকে এরূপ বলে থাকেন, যে তোমার সন্ন্যাস সম্মত নয় ইত্যাদি স্মরণ কর। তুমি অগ্ৰে ব্ৰহ্মাদ্বৈতপর কোন গ্রন্থ স্বয়ং রচনা করে অবলোকন করাও, যাতে সকল্পের প্রত্যয় জন্মে, এবং তোমার অন্তর্বর্তী ভাব প্রকাশ হয়। সূরেশ্বর সৰ্ব্বশাস্ত্রবেত্তা সুকবি গুরুর আদেশে সমাদিষ্ট হয়ে আজ্ঞাপালনে যত্ন তৎপর হলেন। নিষ্কৰ্ম্মগোচরা নৈষ্কৰ্ম্ম্যসিদ্ধ গ্রন্থ প্রস্তুত ও সংশোধন করে গুরুর পদে অপর্ণ করলেন। ভাষ্যকার উক্তগ্রন্থ পূর্বাপর বিভাগ-ক্রমে নিরবদ্য (অনিন্দিত) সমালোচন ও সমীক্ষণ করে অত্যন্ত হর্ষযুক্ত হয়ে আনন্দপ্রফুল্ল মনে সকল শিষ্যবৰ্গকে অবলোকন করতে দিলেন। তারা সকলে গ্রন্থ আদ্যোপান্ত পর্য্যবেক্ষণ করে গ্রন্থমধ্যে কৰ্ম্মের গন্ধমাত্র প্রাপ্ত হলেন না, অন্য কৰ্ম্মের তো কোন কথা নাই, অহং ব্রহ্মাস্মিবান বাক্য উক্ত হয়েছে, চিন্তাদি রহিত কাৰ্য্যশূন্য সহজভাব নিবিকল্প-স্বভাব ব্রহ্ম-স্বরূপ কথিত দৃষ্টি করে গ্রন্থ নির্দোষ ও সুরেশ্বর যথার্থ তত্ত্ববিৎ বিচার করলেন, এবং সুরেশ্বরকে সর্বশ্রেষ্ঠ উৎকৃষ্ট গ্রন্থকর্তা স্বীকার করে মান্য করলেন।
সুরেশ্বরে ইহা বিচিত্র নয়, স্বয়ং ব্রহ্মা শঙ্করের সাহায্যার্থ অবতার, এজন্য আচাৰ্য সৰ্ব্বজ্ঞ তাকে সুরেশ্বর নাম প্রদান করেছেন, শম্ভু আদেশে প্রথম গৃহস্থ হয়ে তদ্ধৰ্ম্মরক্ষাপুরঃসর কৰ্ম্মকাণ্ড বিস্তার করেছিলেন। পরে সন্ন্যাস গ্রহণে সৰ্ব্ব কৰ্ম্ম সংন্যাস করত ব্ৰহ্মাত্মাদ্বৈতপর হয়েছেন, শঙ্করের প্রিয় ছিলেন। সুরেশ্বর যা বলেছেন, তাই প্রামাণ্য অন্যথা করণের সাধ্য কারও ছিল না, এবং নেই। অবশেষে ভাষ্যকার শিষ্যগণকে বললেন, আমার সম্যক চিরাভীষ্ট ভাষ্যে বাৰ্ত্তিক হয় তা হল না। ইহা কহিয়া নিরব রইলেন। তখন সুরেশ্বর বাৰ্ত্তিকে বিঘ্নকারীগণের প্রতি উক্তি করলেন, সকলকে বলছি, ভাষ্যে বাৰ্ত্তিক কারও কৰ্ত্তব্য নয়, যদ্যপি কেউ তাষ্যে বাৰ্ত্তিক করেন তা অবনি মণ্ডলে প্রচার হবে না। সুরেশ্বর এপ্রকার অভিশাপ প্রদান করে সময় প্রাপ্ত হয়ে বিনীত ভাবে গুরুকে নিবেদন করলেন, খ্যাতি বা লাভাভিলাষে এ নিবন্ধ করি নি, শ্ৰীমদাচার্য্যের আজ্ঞা অলঙ্ঘনীয় এজন্য ইহা কৃত হয়েছে। লোকের গার্হস্থ্যে যে স্বভাব থাকে, তা জ্ঞানবৈরাগ্য যুক্ত হলে সম্ভব হয় না। ইহা অন্যথা অতিপ্রসঙ্গ বলতে হয়। বাল্যকালের বালত্ব ভাব যৌবনে থাকে না, সেরূপ অজ্ঞানাবস্থার যে স্বভাব তা কি জ্ঞানাবস্থায় থাকবার সম্ভব, তা কখনই থাকে না। অন্যথা স্বীকারে মানববৃন্দের শাস্ত্র জন্য বোধ ব্যর্থ হয়। গৃহীর মন বন্ধনে ও ভিক্ষুর মন মোক্ষে নিরত, তজ্জন্য স্বভাবের নিয়তি কালত কখনো নয়। আমি আপনার পাদপদ্ম অবলম্বন করে সংন্যাস গ্রহণ করেছি, এবং তত্ত্বোপদেশে যথার্থ স্বাত্মতত্ত্বজ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছি। অতঃপর আমার বুদ্ধি প্রভুর শ্রীচরণসেবনে অনুরত হয়েছে। ইহা বলে সুরেশ্বর উপরত হলে, গুরু প্রসন্ন মনে তাকে বললেন, বৎস, সত্য বলেছ, তুমি যথার্থ আমার আজ্ঞ পালক। তুমি তৈত্তিরীয়ক ভাষ্যে, বৃহদারণ্যক ভায্য ও মৎকৃত পঞ্চীকরণসূত্রের সুন্দর রূপ বাৰ্ত্তিক নিৰ্ম্মাণ কর। এ নিবন্ধদ্বয় প্রস্তুত করে কৃতিত্ব লাভ কর। আমার এই বাক্য স্মরণ রাখবা পূৰ্ব্ববৎ বিঘ্নশঙ্কা করবা না।
'সুরেশ্বরের
শ্রুতিভাষ্যদ্বয়ে বাৰ্ত্তিক করণ ও অন্যান্য শিষ্যগণের ভাষ্যে পৃথক পৃথক নিবন্ধকরণ'
সুরেশ্বর শ্রীগুরুর অনুজ্ঞা শিরোধাৰ্য্য করে পূর্বোক্ত শ্রুতিভাষ্যদ্বয়ে বাৰ্ত্তিক প্রস্তুত করে শঙ্কর গুরুর নয়নগোচর করলেন। ভাষ্যকার তা প্রসন্ন অতি গম্ভীর পদবাক্যার্থ সুন্দররূপ বিচারপূর্বক সমবেক্ষণ করে সীমামিত হর্ষ প্রাপ্ত হলেন। সনন্দনও গুরুবাক্যানুসারে শারীরকভাষ্যে অর্থগৰ্ভিত টীকা করে গুরুকে দেখালেন। শঙ্কর তা সমালোচন করে সুরেশ্বরকে বললেন, এ পঞ্চাস্যচরণা টীকা অধিক প্রচার হবে না, তত্ৰাপি ব্রহ্মনিষ্ঠ স্পষ্ট যে চারিটা সুত্র তা অপ্রচার রইবে। ভাষ্যকার পুনৰ্ব্বার একান্তে সুরেশ্বরকে বললেন, সুরেশ্বর, তুমি প্রারব্ধ কৰ্ম্মবশে পুনবর্বার বাচম্পাতি পণ্ডিত হয়ে আমার প্রিয়ভাষ্যের টীকা করবা, সেই টীকা বাৰ্ত্তিক খ্যাতি প্রাপ্ত হবে। এস্থলে প্রারব্ধ কৰ্ম্মবশে দেহান্ত হবার যে প্রসঙ্গ তা অনেকে অসঙ্গত বোধ করতে পারেন কারণ প্রারব্ধ বর্তমান শরীর পোষক মাত্র হয়; কিন্তু ইহাতে বিবেচনা করতে হবে, যে ইহার ভাবী শরীর পর্যন্ত দীর্ঘ প্রারদ্ধ ছিল, তজ্জন্য ভাষ্যকার সর্বজ্ঞ এরূপ অনুজ্ঞা করেছেন, যেমত ভরতের তিনজন্ম ও বামদেবের দুই জন্ম নিয়ে দীর্ঘ প্রারদ্ধ ছিল। ভাষ্যকার সুরেশ্বরকে এ প্রকার আশ্বাসিত করে ভাবী বৃত্তান্ত বলে আনন্দগিরি প্রভৃতি অন্য অন্য যতিবৃন্দকে আজ্ঞা করলেন, তোমরা সকলে স্ব স্ব বুদ্ধি অনুসারে সুত্র ভাষ্যাদি ভাষ্যে ব্ৰহ্মতৎপর নিবন্ধ নিৰ্ম্মাণ কর। আনন্দগিরিপ্রমুখ বুধগণ গুরুর আজ্ঞা প্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মাদ্বৈত নিষ্ঠাবভাসক গৃঢ়ার্থবিবোধক নিবন্ধ সূত্র ভাষ্যাদিভাষ্যে প্রস্তুত করলেন। আনন্দগিরি স্বকৃত টীকা গুরুকে সমালোচন করতে দিলেন। ভাষ্যকার তা পর্যাবলোকন করে প্রসন্ন হয়ে বললেন, আনন্দগিরে, তুমি ধন্য কৃতাৰ্থ হয়েছ।
পরে চিৎসুখাদি বেদান্তে সৎনিবন্ধ করে সাদরে গুরুকে দেখালেন, এমতে সকল শিষ্যের পৃথক্ পৃথক্ নিবন্ধ হবার ভায্যের টীকা অনেক প্রকার হল। যতীশ্বর জনগণের মোক্ষ হেতু আগ্রহ হয়ে স্বয়ং শ্রুতিবিষয়-বিচার-গর্ভিত ভাষ্যবৰ্গ দ্বারা উপায় নিৰ্দ্ধারণ করে পুনঃ সজ্জনবৃন্দের হিত মানসে সযুক্তি বাৰ্ত্তিক নিবন্ধ আদি প্রচার করালেন। জিজ্ঞাসু ব্ৰহ্মপরায়ণগণ সকলে মিলিত হয়ে অতি গহন পদার্থবেদান্ত সুত্র ভাষ্য দ্বারা সতত বিচার করতঃ অনুভবসিদ্ধ বিষয়ে বাৰ্ত্তিকাদি অবেক্ষণ করে বুদ্ধিযোগে অমল-সুখ পরমাত্মা অবগত হবেন।
'পদ্মপাদ
যতির তীর্থযাত্রার্থ গমন'
এক সময় পদ্মপাদ যতিবর শ্ৰীশঙ্করাচার্য্য গুরু সন্নিধানে উপস্থিত হয়ে ভক্তিসহকারে বদ্ধপুটাঞ্জলি হয়ে সবিনয়ে প্রার্থনা করলেন, ভগবন করুণাসিন্ধু, স্বামির শ্রীচরণাযুগল সমাশ্রয় করে আমি কৃতাৰ্থ হয়েছি,ইহার সংশয় নেই; কিন্তু মধ্যে মধ্যে আমার অন্তঃকরণে তীর্থযাত্রার সঙ্কল্প উদয় হয় পরন্তু গুরুপাদপদ্ম পরিত্যাগে মনে উৎসাহ জন্মে না, যদি সে সঙ্কল্প নিবৃত্তি নিমিত্ত শ্ৰীমুখের আজ্ঞা হয়, তবে তীর্থযাত্রা হতে নিবৃত্ত হয়ে সত্বর ঐ গুরুচরণ-সন্নিধানে সমাগত হই। শঙ্করাচার্য্য পদ্মপাদের বিজ্ঞপ্তি শ্রবণ করে বললেন, পদ্মপাদ, তুমি উৎকৃষ্ট অনুষ্ঠান করেছ বটে, কিন্তু যাত্রার বিক্ষেপ কারিত্ব বিচার কর নি। প্রাতে উথান করে গমন, মধ্যাহ্লে ক্ষুধাদির প্রপীড়ন, কায়িক শ্রম জন্য বস্তুর অনভ্যাস, সমাধির অবসর কোথা হবে? তবে, সে যাত্রামধ্যে সৎসমাগমের সম্ভবতা আছে, গুরুক্ষেত্ৰ তাঁর চরণযুগল সলিল, ও উপদেশজনিত দৃষ্টি দেবদর্শন উক্ত হয়েছে। সনন্দন গুরুবাক্য শ্রবণ করে পুনর্বার নিবেদন করলেন, গুরো, প্রভু যা আজ্ঞা করলেন, তা সত্য কিন্তু তীর্থষাত্রা বিনা আমার চিত্তের যে অতি তীব্র উৎকণ্ঠা, তাহা শাম্য হয় না। যার হৃৎপদ্মে শ্ৰীগুরু বিরাজমান তার সর্বদা গুরুদর্শন হয়, মনুষ্য দৈবযোগে সুখদুঃখ ভোগ করে, ব্রহ্মানন্দে নিমগ্ন সজ্জনবৃন্দের সর্বদাই সমাধি হয়ে থাকে। ভাষ্যকার শিষ্যের এরূপ বাক্য শ্রবণ করে বললেন, সনন্দন, তোমার এ বিষয়ে যে আগ্রহ, তা আমি নিবারণ করি না, বক্তব্য এই যে সজ্জন সঙ্গে গমন কৰ্ত্তব্য, যেহেতু উহারা সুখপ্রদ হন, নিজানন্দে নিমগ্ন সন্তগণ সমস্ত সন্তাপ নিরাস করেন। সনন্দন এপ্রকার গুরুবাক্য শ্রবণে লব্ধানুজ্ঞ জ্ঞানে শ্ৰীগুরুচরণে বিধিবৎ প্রণাম করে সশিষ্য তীর্থযাত্রার্থ দক্ষিণাভিমুখে রামেশ্বরের পথে গমন করিলেন। আত্মারাম শঙ্কর, সুরেশ্বর প্রভৃতি শিষ্যগণে সমাবৃত হয়ে শৃঙ্গশিখরে অবস্থিতি করত কিয়ৎকাল অতিবাহিত করলেন।
'শঙ্করের
জননীসমীপে গমন ও মাতার মোক্ষার্থ বিষ্ণুস্তুতি'
এরপর শঙ্কর হঠাৎ যোগবলে জিহ্বায় মাতৃস্তন দুগ্ধের স্বাদ পেলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন মাতা বিশিষ্টাদেবীর অন্তিম সময় উপস্থিত। সন্ন্যাস গ্রহণকালে করা প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে শঙ্কর ছুটিলেন কালাডির পথে। মাতাকে সন্দর্শন করে সানন্দে প্ৰণাম করলেন, জননী ও চিরদিনান্তে প্রিয়তম পুত্র প্রাপ্ত হয়ে সুতমুখাবলোকনে মনোগত সন্তাপ সকল বিস্মৃত হয়ে হৰ্ষ সম্পন্ন ও প্রমোদিতমন পুত্রকে সম্বোধন করে বললেন, পুত্র, তুমি কুশলী যতিরূপধারী তোমাকে চাক্ষুষ দেখলাম, এ আনন্দের সীমা নেই, এ অবস্থাতে তোমার দর্শন দূর্লভ. তোমার অদর্শন জন্য যে দুঃখ তা অদ্য বিনাশিত হল। এ স্বপ্নাবস্থা কি জাগ্রৎ আমার অনুভূত হচ্ছে না। যাহোক, এইক্ষণে আপন মনোগত ভাব তোমাকে বলছি, বৎস, ইদৃশ জীর্ণ কলেবর আর বহন করতে পারি না, যথাশাস্ত্র ইহার সংস্কার করে সদ্গতি প্রাপ্ত করাও। শঙ্কর মাতার বাক্য শ্রবণ করে ব্ৰহ্মাত্মাদ্বৈতজ্ঞান উপদেশ করলেন। তিনি ব্রহ্মজ্ঞান শুনে বললেন, পুত্র, ইহাতে আমার প্রবেশতা ও অবগতি হয় না, তখন শঙ্কর বিবেচনা করে ভগবান শঙ্করের স্তুতি করলেন। বিশ্বনাথ সন্তুষ্ট হয়ে তৎক্ষণে নিজ প্রমথগণ প্রেরণ করলেন। মাতা বললেন আমি শিবলোক নয়, আমার কুলআরাধ্য ভগবান বাসুদেবের বৈকুন্ঠে যেতে আগ্রহী পুত্র। শঙ্কর তো জানে হরিহর অভেদ তিনি তৎক্ষণাৎ বিষ্ণুস্তুতি করতে লাগলেন যা বর্তমানে 'কৃষ্ণাষ্টকম্' নামে প্রসিদ্ধ। অখিলাত্মা নারায়ণ এ প্রকার শঙ্কর কর্তৃক আরাধিত হয়ে মাতৃমোক্ষার্থ চিন্তিত যতিবরের সম্মুখে শ্রীযুক্ত ও স্বীয়গণেতে আবৃত শঙ্খচক্ৰগদাপদ্মধারী নারায়ণ অতি প্রসন্ন আনন্দরূপ আবির্ভূত হলেন। শঙ্কর যতীশ্বর যজ্ঞেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে সাক্ষাৎ দর্শন করে ভক্তি রসাদ্রিত হয়ে পুনর্বার স্তুতি করলেন। সৃষ্টির পূর্বে প্রকৃতি পুরুষ অদ্বয় শরীর ছিলেন, চিদা—ভাসরূপে আপন মায়াতে প্রবিষ্ট হয়ে যে মহেশ্বর এই চরাচর উচ্চাবচ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তিনি এই কৃষ্ণ আমার চক্ষুর বিষয় হয়েছেন, অর্থাৎ চাক্ষুষ দর্শন দিয়াছেন, ইনি জয়যুক্ত হোন।
'শঙ্কর-মাতার
বৈকুণ্ঠ গমন এবং তাঁর মৃতদেহ দাহ, তত্ৰত বিপ্রগণ প্রতি শঙ্করের শাপ প্রদান'
যতীশ্বর কর্তৃক এই প্রকার বেদ বাক্যাদি দ্বারা পরমাত্মা কৃষ্ণ সংস্তুত হয়ে সম্মুখস্থিত যতিবরকে বললেন, যতিবর, তোমার চিত্ত আমাতে অর্থাৎ ঈশ্বরে মায়াবী নির্গুণব্রহ্মে, যেখানে মায়া নেই সেই কেবল আত্মাতে স্থিতি প্রাপ্ত হয়েছে। তুমি অদ্বৈতমার্গ পরিস্কার করেছ, আর ভ্রমহীন বুদ্ধিতে বেদার্থ সমালোচন করে যে প্রধান ভাষ্য রচনা করেছ তা জিজ্ঞাসুগণ মধ্যে প্রচার হবে। তোমার জননী এই সতী আমি পরমেশ্বর বাসুদেবে রত এবং ভক্তিযুক্ত, বিমান আরোহণ করে আমার সঙ্গে আমার বৈকুণ্ঠ ধামে গমন করুন। নারায়ণ এই বাক্য বললে ভিক্ষু-জননী তৎক্ষণে জরাযুক্ত মনুজ দেহ পরিত্যাগ করিয়া দিব্য রুচির শরীর ধারণ করত বিষ্ণুগণের সহিত সুন্দর বিমল বিমানে সমারোহণ করলেন। তখন সতী পুত্রকে বললেন, হে প্রাণপ্রিয় শঙ্কর, তুমি কৃতাৰ্থ ধন্য ধন্য পুত্র ইহলোকে তোমার মত পুত্র পেয়ে আমার জীবন স্বার্থক।আমি তোমা হতে ইষ্ট লোকে গমন করলাম। ইহা বলতে বলতে শ্ৰীমধুসুদন লক্ষ্মী ও গণ বিমান সহ অন্তৰ্ধান হলেন। শঙ্করাচার্য্য আপন জননীকে বৈকুণ্ঠে হরি সান্নিধ্যে প্রেরণ করিয়ে স্বয়ং সেই অঙ্গনে স্থিত হয়ে মাতার ত্যক্ত কলেবর সংস্কার করতে বাসনা করলেন।
বন্ধুবর্গকে আহবান করাতে সকলে সেই স্থানে সমাগত হলেন। তাঁরা হৃদয়মালিন্য দোষে ভাষ্যকারকে নিন্দা করলেন, কিন্তু ভাষ্যকারের প্রার্থনামতে অগ্নি প্রদান করলেন না। অনন্তর শঙ্কর যতীশ্বর স্বয়ং কাষ্ঠ সঞ্চয় করে নদীতটে আপন দক্ষিণ বাহু মন্থণ করলেন। তাতে অগ্নি নিঃসৃত হল। সৰ্ব্বশক্তিমান সেই অগ্নিতে মাতার ত্যক্ত দেহ দাহ করলেন, এবং তত্রত্য বন্ধু বিপ্রগণের প্রতি অভিশাপ প্রদান করলেন, তোমরা বেদাগ্নি বহিষ্কৃত শূদ্রাচার ভিক্ষাশূন্য সংন্যাসী হবা তোমাদের গৃহ শ্মশানে পরিণত হবে। শঙ্কর বিপ্রগণকে এরূপ শাপ প্রদান করাতে অদ্যাবধি সে স্থানে দ্বিজগণ বেদহীন বহ্নিশূন্য ব্রাহ্মণ বাক্যমাত্র রয়েছেন ; পরমহংসকে অবহেলন করবার এই ফল তাঁদের প্রকাশ হয়েছে। বিশিষ্টা পরমগতি লাভ করলে শঙ্কর জ্ঞাতিবর্গের সম্পত্তিলোভ ও ষড়যন্ত্ররূপ দুর্ব্যবহারের স্বীকার হলেন। শঙ্কর কেরলের রাজা রাজশেখর কর্তৃক জ্ঞাতিবর্গের বিচার করলেন এবং রাজার সহায়তায় স্বদেশ সংস্কার করলেন। তদনন্তর শঙ্কর যোগশক্তিতে শৃঙ্গপৰ্ব্বতে গমন করলেন।
'শঙ্করের সুধন্বা রাজার সহিত সাক্ষাৎ ও দিগ্বিজয়ে সাহায্য গ্রহণ'
দৈৰযোগে
একসময় ভাষ্যকার যতীশ্বর কর্ণাট ও উজ্জয়িনীর রাজা সুধন্বা ভূপতির সাক্ষাৎ কৃত হলে নরপতি
কর্তৃক সশিষ্য ভক্তিসহ অর্চ্চিত হয়ে শিষ্যবর্গে সংযুক্ত তদ্দেশে অবস্থিত হলেন। ভাষ্যকার
দিগ্বিজয়েচ্ছু হয়ে নরেশ্বরকে বললেন, রাজন্য এই অবনিমণ্ডলে বেদান্ত-তত্ত্ব প্রচার
করবার বাসনা করেছি যেরূপে বেদান্ত-মার্গ প্রচারতা প্রাপ্ত হয়, তদ্বিষয়ে তুমি সাহায্য
করতে সমর্থ। সুধন্বা নরপতি ভাষ্যকারের বাক্য শ্ৰুতিগোচর হওয়ামাত্র অবনতভাবে নিবেদন
করলেন, ভগবন করুণাসিন্ধে!, আপনি বেদপদ্ম বিভাকর। আমি শ্ৰীচণের দাস অবশ্য চরণযুগলের
শুশ্রুষা সাধ্যায়ত্তমত করব। স্বামি! সমগ্র পৃথিবী জয় করুন, এ ভূত্য সসৈন্য অনুগত থাকিবে। শঙ্কর রাজার রাজধৰ্ম্মকুশলতা ও অতুল সাহস বাক্য
শ্রবণে হৃষ্টচিত্ত হলেন। অনন্তর শিষ্যগণে পরিবৃত আচাৰ্য্য সসৈন্য ভূপতির সহিত দিগ্বিজয়ে
যাত্রা শুরু করে প্রথমে রামেশ্বরে গমন করলেন।
আচার্য্যের সশিষ্য রামেশ্বর যাত্রা শুনে অনেক গৃহস্থী, বানপ্রস্থী, ধনী, দরিদ্র সহস্রাধিক লোক আচার্য্যের অনুগামী হল। আচার্য্যের শিষ্যবর্গও বড় অল্প নয় সুরেশ্বর, পদ্মপাদ, হস্তামলক, সমিৎপাণি, চিদ্বিলাস, জ্ঞানকন্দ, বিষ্ণুগুপ্ত, শুদ্ধকীর্তি, ভানুমরীচি, কৃষ্ণদর্শন, বুদ্ধিবিরিঞ্চি, পাদশুদ্ধান্ত, এবং আনন্দগিরি ও তাঁদের শিষ্যবর্গ নিয়ে একটী বৃহৎ দল হল। সুধন্বারাজ সৈন্যবর্গ সহ তাঁদের পশ্চাৎবর্তী হলেন। শঙ্কর দিগ্বিজয়ী বাহিনী এ এক অপূর্বদৃশ্য, অনেকে গৈরিক ধ্বজা, শঙ্খ, ঘন্টা, মৃদঙ্গ বাদ্যাদিসহকারে ভগবান্নাম কীর্ত্তন, মোহমুদ্গর ও শঙ্কর বিরচিত স্তোত্রম্ সমূহ আবৃত্তি করতে লাগলেন।
'মধ্যার্জুনে
শঙ্কর ও শিবাবির্ভাব'
কিছুদিন এইভাবে পথ চলতে চলতে আচার্য্য মধ্যার্জুন নামক শৈবতীর্থে এসে উপস্থিত। এখানে কালী, তাঁরা, মহাবিদ্যাদ্বয়, এবং ষোড়শী, ভূবনেশ্বরী বিদ্যাসকল মধ্যার্জুন নামক শিববিগ্রহের পাদপদ্ম পূজা করছেন। আচার্য্য এখানে এসে জ্ঞানস্বরূপ উপাচার দ্বারা মহেশ্বরের পূজা করলেন। শঙ্কর সশিষ্য মন্দির প্রাঙ্গনেই আসন গ্রহণ করলেন। স্থানটি ব্রাহ্মণপ্রধান এবং ব্রাহ্মণদের অধিকাংশই কর্মকাণ্ডী। এখানকার ব্রাহ্মণ পণ্ডিতবর্গ আচার্য্য শঙ্করের দিগ্বিজয় যাত্রায় এখানে আগমন শুনে শাস্ত্রবিচারে প্রবৃত্ত হলেন। কিন্তু সবাই পরাভূত হলেন প্রাজ্ঞ শঙ্করের অদ্বৈতবেদান্তের বিপরীতে। বহু আলোচনার পর স্থির হল- পরদিন বিচার স্বভায় শঙ্কর যদি মধ্যার্জুন শিব দ্বারা সর্বসমক্ষে 'অদ্বৈত সত্য' ইহা বলাতে পারেন তাহলে তাঁর মত গ্রাহ্য হবে নচেৎ নহে। পরদিন শিবসম্মুখে আবার মহাসভা। সহস্রাধিক লোক সমবেত। আচার্য্যের বুদ্ধিদীপ্ত, হৃদয়গ্রাহী তত্ত্বব্যাখ্যা সমবেত শ্রোতারা স্তব্ধ হয়ে শুনছেন। বহুক্ষণ আচার্য্যের বাক্য শ্রবণের পর মধ্যার্জুনবাসী ব্রাহ্মণপন্ডিতগণের একজন আচার্য্যকে সম্বোধন করে বললেন-যতিবর! সভাবিচার দ্বারা সত্য নির্ণয় হয় না, যাঁর বাকচাতুর্য অধিক তিনি জয়লাভ করে মাত্র। আপনি যদি ঐ মধ্যার্জুন শিববিগ্রহের মুখ দিয়ে বলাতে পারেন যে 'অদ্বৈতই সত্য' তাহলে এইমত গ্রহণ করতে পারি, নচেৎ নহে। প্রতিপক্ষের এরূপ বাক্য শ্রবণ করে আচার্য্য একটু বিস্ময়ভাবাপন্ন হয়ে স্তম্ভিত হলেন। আচার্য্যের শিষ্যগণের মধ্যেও বিস্ময় আর উদ্বেগ দেখা দিল। পণ্ডিতমণ্ডলী সহাস্যবদনে পরস্পরের দিকে দৃষ্টি করতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁদের দৃষ্টি পড়ল আচার্য্যের দিকে। আচার্য্য শঙ্কর হঠাৎ ভাবাবিষ্ট হয়ে মন্দির দ্বারে আসলেন এবং নতজানু হয়ে ভগবানের স্তব করতে লাগলেন। সহসা মন্দিরের অভ্যন্তরে সহস্র সূর্য্যালোক সমুদ্ভাসিত হল, ভগবান ভবানীপতি সর্বসম্মুখে দিব্যমূর্ত্তিতে আবির্ভূত হলেন, তিনবার গম্ভীরস্বরে বললেন-'অদ্বৈত সত্য', অদ্বৈত সত্য, অদ্বৈত সত্য।' দর্শকবৃন্দের মধ্যে যাঁর যেমন পূণ্য তাঁর তেমন দর্শন হল, কেউ শুধু তেজ দেখল, কেউ শুধু আকৃতি দেখল, কতিপয় ভাগ্যবান ভক্তবৃন্দ ভগবানের দিব্যরূপ দর্শন করল, কিন্তু সকলেই শুনল- অদ্বৈত সত্য।' অসম্ভব সম্ভব হল। জীবনে যা না ঘটবার আজ সকলের ভাগ্যে ঘটল। সকলে আচার্য্যের চরণস্পর্শ নিয়ে ব্যস্ত। 'অদ্বৈতের জয়' আর 'আচার্য্যের জয়' এই ধ্বনিতে সমগ্র মধ্যার্জুন নগরী প্রকম্পিত হল। আচার্য্যকে ঘিরে প্রবল একটা আলোড়নের সৃষ্টি হোল। বহু ব্রাহ্মণ পন্ডিত আচার্য্যের নিকট অদ্বৈতমতে দীক্ষা নিলেন।এই ঘটনার পর আচার্য্য শঙ্কর যেখানেই গিয়েছেন--জনসাধারণের মধ্যে উদ্দীপনার ঝড় বয়ে গিয়েছে। আচার্য্য মধ্যার্জুনে কিছুদিন অবস্থান করে, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতবর্গের মধ্যে ভাষ্যাদি বিতরণ করে শঙ্করাচার্য্য রামেশ্বর অভিমুখে যাত্রা করলেন।
'তুলাভবানীতে
শঙ্কর'
আচার্য্য মধ্যার্জুন পরিত্যাগ করে তুলাভবানী নামক তীর্থে আসলেন। পথিমধ্যে সুরাসক্ত ভবানী উপাসক শাক্ত, সমূহকে পরাজয় করে কুমার্গ পরিত্যাগ করিয়ে সৎমার্গে সংস্থাপন করলেন। এই স্থানে বহু বামাচারী সাধক বাস করতেন। মদ্য, মাংস এবং নারী সহযোগে তামসিক সাধনার দ্বারা তাঁরা স্থানীয় জনসাধারণের নৈতিক চরিত্র কলুষিত করে আসছিলেন। অদ্বৈতবাদী আচার্য্য শঙ্করের আগমন সংবাদ শুনে তাঁরা শাস্ত্রবিচারের অজুহাতে এসে বললেন—আপনি বন্ধ্যার পুত্রলাভের মত অলীক অদ্বৈতজ্ঞানের কথা বলছেন। প্রলয় কালেও যখন ভেদজ্ঞান দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই তখন অদ্বৈতজ্ঞানের কথা প্রচারের স্বার্থকতা কোথায়? আপনি বরং শক্তিরূপিনী ভবানীর উপাসনা প্রচার করুন। এতে আপনার এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণ হবে। শান্তভাবে তাঁদের বক্তব্য শোনার পর আচার্য্য বললেন-অচেতন প্রকৃতির শক্তি-উপাসনা দ্বারা চৈতন্যলাভ সম্ভব নয়। আপনারা শক্তিসাধনার নামে ইন্দ্রিয়ের সেবা করছেন। ধর্মের নামে ব্যাভিচার করে আপনারা ব্রাহ্মণত্ব হতে ভ্রষ্ট হয়েছেন। জন্ম জন্মান্তরের পশুজীবনের ক্লেশ হতে যদি পরিত্রাণ পেতে চান, তা হলে প্রায়শ্চিত্ত করে পরমাত্মার শরণ নিয়ে পাপমুক্তির চেষ্টা করুন। আচার্য্যের ভর্ৎসনাপূর্ণ জ্বলন্ত বাক্য শুনে তাঁরা দমে গেলেন। তাঁদের মনে অপরাধবোধ জেগে উঠলো। অনেকেই আচার্য্যের নির্দেশানুসারে প্রায়শ্চিত্ত করে বর্ণাশ্রমোচিত বৈদিককর্ম অনুষ্ঠানে ব্রতী হলেন। কিন্তু আচার্য্য তুলাভবানী ত্যাগ করার পরেই অনেকে ইন্দ্রিয়ের অভ্যস্ত টানে বামাচার সাধনায় ফিরে গেলেন।
'রামেশ্বর
তীর্থে অদ্বৈতমত প্রচার'
যথাধিকারে পৃথক জনগণকে সংস্থাপিত করণান্তর আচার্য্য রামেশ্বরে সমুপস্থিত হন। রামেশ্বর শিব ভগবান রামচন্দ্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রাচীন তীর্থ। শঙ্করাচার্য্য এখানে এসে যথাবিধি রামেশ্বর শিবের পূজা করলেন। ইতোমধ্যে পদ্মপাদের রামেশ্বর আগমনে শৈবাদি সহ বিভিন্ন উপাসক সম্প্রদায়গণ অদ্বৈতবেদান্তের পরিচয় পেয়েছিলেন। ভগবান শঙ্করাচার্য্য সশিষ্য দিগ্বিজয় বাহিনী সহ রামেশ্বর তীর্থে অবস্থান করছেন শুনে দূরদূরান্ত থেকে লোকসমাগম হতে লাগল। এখানকার শৈবরা আচার্য্যের সাথে শাস্ত্রবিচারে প্রবৃত্ত হলেন এবং শ্রুতিসিদ্ধ অদ্বৈতবেদান্তের বিপরীতে শৈবমত পরাভূত হল। শৈবভক্তের মধ্যে প্রধান ছিলেন বিদ্বেষনীর। আচার্য্যের সঙ্গে তর্কে তিনি পরাজিত হন এবং অদ্বৈতমত অবলম্বন করে চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত শিবভক্ত থেকে যান এবং তাত্ত্বিকভাবে অদ্বৈতবাদী হয়ে উঠলেন।
'শ্রীরঙ্গমে
আচার্য্য শঙ্কর'
রামেশ্বর
পরিত্যাগ করে শঙ্করাচার্য্য শ্রীরঙ্গমে এসে উপস্থিত হলেন। আচার্য্য শ্রীরঙ্গমে এসে অনন্তশয়নে শায়িত বিষ্ণুর
মন্দিরে গিয়ে ভগবানের অর্চনা করে ভাবাবিষ্ট হলেন। এখানে বৈষ্ণবসমাজ ছয়টি সম্প্রদায়ে
বিভক্ত ছিল। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবগণ নিজ নিজ মতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার আশায়
আচার্য্যের নিকট আসতে লাগলেন। একদিন এক সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব-নেতা আচার্য্যের নিকট এসে
নিজ অঙ্গে চিত্রিত শঙ্খ, চক্র, পদ্ম ইত্যাদি বিষ্ণুচিহ্ন দেখিয়ে বললেন-দেহে শাস্ত্রানুমোদিত
চিহ্নাদি ধারণ না করলে বৈকুন্ঠে প্রবেশলাভ সম্ভব নয়। আপনি কেন বিষ্ণুচিহ্ন ধারণ করেন
না?
বৈষ্ণবের বক্তব্য শুনে আচার্য্য বললেন--আপনার ধারণার স্বপক্ষে বেদের কোন প্রমাণ আছে কি? চণ্ডাল যেমন যজ্ঞোপবীত ধারণ করলেই ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হয় না, তেমনি শরীরে বিষ্ণুচিহ্ন ধারণ করার কোন সার্থকতা নেই। বেদ বলেছে--ভগবানের উপাসনার দ্বারা অজ্ঞানতারূপ পাপ ক্ষয় হয়ে চিত্তশুদ্ধি ঘটে। অবশেষে ‘আমি ব্রহ্ম’--অনুক্ষণ এইরূপ চিন্তা করতে করতে ভেদবোধ লুপ্ত হয় এবং ব্রহ্মাত্মবোধের জাগরণ ঘটে। এটাই মোক্ষ। আপনিও ভগবান বিষ্ণুর উপাসনা করে পাপ ক্ষয় করুন এবং আমি বিষ্ণুর স্বরূপ অনুক্ষণ এই চিন্তা করে বিষ্ণুত্ব প্রাপ্ত হোন। আচার্য্যের অভিনব উপদেশ কিছু কিছু বৈষ্ণবের চিত্ত স্পর্শ করলো। শ্রীরঙ্গমে এক মাস অবস্থানকালে আচার্য্য শঙ্কর ভক্তসম্প্রদায় ব্রহ্মগুপ্ত দলের ধর্মমতের সংস্কার, ভাগবত, পাঞ্চরাত্র, বৈখানস ইত্যাদি বৈষ্ণব সম্প্রদায়সমূহের সাথে শাস্ত্রবিচার ও তাঁদের আচারাদির সংস্কার করেন এবং অদ্বৈতবেদান্ত প্রচার করেন।
'সুব্রহ্মণ্য
দেশে অদ্বৈতমত প্রচার'
অনন্তশয়ন পরিত্যাগ করে আচার্য্য সশিষ্য কুমারস্থান সুব্রহ্মণ্য দেশে গমন করলেন। এখানে অনন্তরূপী কার্ত্তিকেয় পূজিত হন। আচার্য্য সশিষ্য কুমারধারা নদীতে স্নান করে ভক্তিসহকারে তাঁর অর্চ্চনা করলেন এবং নির্জন স্থান দেখে সেখানে উপবিষ্ট হলেন। সুধন্বা রাজ আর অপরাপর লোকজন আচার্য্যের নির্জন প্রিয়তা দেখে দূরে অবস্থান করতেন। সন্ন্যাসের আচার অনুসারে আচার্য্য নিত্য গৈরিক বস্ত্রপরিধান, দণ্ডকমণ্ডলুধারণ এবং সর্বাঙ্গে বিভূতিলেপন করিয়া সাক্ষাৎ মহাদেবের ন্যায় শোভা ধারণ করেন। আজও আচার্য্য এই দিব্যরূপ ধারণ করে উপবিষ্ট আছেন, এমন সময় হিরণ্যগর্ভ সম্প্রদায়ভূক্ত কয়েকজন ব্রাহ্মণ আচার্য সমীপে এসে উপস্থিত হলেন। শুরু করে দিলেন হিরণ্যগর্ভ বিষয়ক বেদ বচন আর বিতর্ক, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞ আচার্য্যের সম্মুখে কেউ বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। সবাই পরাস্ত হয়ে আচার্য্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। এরপর কয়েকজন বহ্নিমতাবলম্বী আচার্য্যের সহিত বিচারে পরাজিত হইয়া অদ্বৈত মত গ্রহণ করলেন।
অতঃপর সুহোত্র ও দিবাকর নামক দুজন সুর্যোপাসক আচার্য্যের সহিত তর্ক বিচারার্থ প্রবৃত্ত হলেন। একে একে সবাই পরাস্ত হয়ে ভগবান শঙ্করের শ্রীচরণে উপবিষ্ট হয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ রলেন।
'শুভগণবরপুরে
তিনসহস্রশিষ্য সহ আচার্য্য'
সুব্রহ্মণ্যদেশে এসে আচার্য্যের শিষ্য সংখ্যা প্রায় তিনসহস্রে পরিণত হল। শুভগণবরের পথে শিষ্যগণের শঙ্খ, বাদ্য , ঘন্টা আর শঙ্কর জয় ধ্বনিতে দিগ্বিদিক্ প্রকম্পিত হল। এখানে কৌমুদী নামক একটী নদী প্রবাহিতা, নদীতটে গণপতি দেবের একটী মন্দির বিরাজমান। আচার্য্য এই নদীতে স্নান করিয়া অনুচরবর্গের সহিত গণপতি দেবের পূজার্চনা করে নিরুপদ্রপ স্থানে আসন গ্রহণ করলেন। সায়ংকালে আচার্য্যদেবকে দ্বাদশ বার প্রণাম করে ঢক্কার তাল দিয়ে শিবের স্তুতি করতে করতে নৃত্য করতে লাগলেন। অনন্তর মহাগণপতি উপাসক মতাবলম্বীর গিরিরাজাসুত নামক একজন আচার্য্য সমীপে এসে বিচারে প্রবৃত্ত হলেন। অদ্বৈতব্রহ্মজ্ঞানের বিপরীতে গণপতি দর্শন পরাস্ত হল। এরপর গণকুমার নামক হরিদ্রাগণপতি উপাসকগণ তর্কবিচারে প্রবৃত্ত হলে তিনিও পরাস্ত হলেন এবং জ্ঞানগর্ভ আচার্য্যের পদানত হলেন। গণকুমার আচার্য্যের শিষ্যত্ব গ্রহণের পর হেরম্বসূত নামক একজন উচ্ছিষ্টগণপতি উপাসক আচার্য্যের নিকট পরাস্ত হয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এরপর একে একে নবনীত গণপতি, স্বর্ণগণপতি, সন্তানগণপতি সহ শৈবাগমের ছয়প্রকার গণপতি উপাসকগণকে তর্কবিচারে পরাস্ত করে অদ্বৈতবেদান্তের বিজয়পতাকা উড্ডীন করলেন।
কাঞ্চিপুরমে
আচার্য্য শঙ্কর
এরপর আচার্য্য কাঞ্চিপুরমে এলেন। শঙ্করাচার্য্যের আগমনসংবাদ পেয়ে পল্লববংশীয় রাজা নন্দী বর্মণ সপারিষদ অগ্রসর হয়ে অগণিত ভক্ত ও শিষ্য পরিবৃত আচার্য্যকে রাজোচিত সম্বর্ধনা জানালেন। আচার্য্যের উপস্থিতিতে নাগরিকদের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল। রাজা নগরের বাইরে একটা বিশাল আমবাগানে সশিষ্য আচার্য্যের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। এই অঞ্চলে বহু তন্ত্রসাধক ছিলেন। আচার্য্য শঙ্কর এখানে কামাক্ষীদেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠার সংকল্প করলেন। আচার্য্যের ইচ্ছানুযায়ী রাজা নন্দী বর্মণ তৎপরতার সঙ্গে মন্দির নির্মাণ করে দিলেন। শাক্তধর্মের প্রতি আচার্য্য শঙ্করের এই আনুকূল্য দেখে স্থানীয় তান্ত্রিকসমাজ আচার্য্যের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হলেন।
প্রাচীন তীর্থ কাঞ্চীপুরম্-শিবকাঞ্চী ও বিষ্ণুকাঞ্চী এই দুই ভাগে বিভক্ত। আচার্য্য তীর্থস্থানদুটির শোচনীয় দুরবস্থা দেখে রাজার অর্থানুকূল্যে উভয় ভাগের ভগ্নদশাপ্রাপ্ত শিব মন্দির এবং বিষ্ণু মন্দিরের সংস্কার সাধন করেন। সুচারু ভাবে নিত্য দেবসেবার বন্দোবস্ত করে দেন। এখানে তিনি বহু কৃপাপ্রার্থী মানুষকে অদ্বৈতবোধে উপনীত হওয়ার সোপানস্বরূপ দ্বৈত উপাসনার দীক্ষা দিলেন এবং কিছু সংখ্যক মানুষকে সরাসরি অদ্বৈতমার্গের দীক্ষা দিলেন। কাঞ্চী থেকে থেকে আচার্য্য অন্ধ্রদেশ অভিমুখে যাত্রা করলেন। কাঞ্চী হতে অন্ধ্রদেশ যেতে পথে তিরুপতি বা বেঙ্কটচল তীর্থে ভগবানের প্রাচীন বিগ্রহ দর্শনাদি করে বিদর্ভরাজধানীতে এসে উপস্থিত হলেন। এখানে চালুক্যবংশের বিজয়াদিত্যের রাজত্ব। আচার্য্য রাজার আতিথ্য অভ্যর্থনাদি গ্রহণ করলেন।
'কাপালিগণের
সহিত রাজার যুদ্ধ ও কাপালি ধ্বংস'
ইতিপূর্বে
আমরা জেনেছি-উজ্জয়িনীর রাজা সুধম্বা কেরলে আচার্য্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁর রক্ষীবাহিনী
সহ শঙ্করের ধর্মবিজয়যাত্রার অনুগমন করেছিলেন। তিনি এবার তাঁর রাজ্যে গিয়ে আচার্য্যকে
ধর্ম প্রচারের অনুরোধ জানালেন। তৎকালে উজ্জয়িনীতে কাপালিকদের প্রভাব প্রতিপত্তি এতটা
ছিল যে রাজা সুধম্বা পর্য্যন্ত কাপালিকদের সমীহ করে চলতে বাধ্য হতেন। কাপালিক গুরু ক্রকচের নেতৃত্বে এই স্থান সারা ভারতের
তান্ত্রিকদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
রাজা উপাধিধারী কাপালিক ক্রকচ সিদ্ধাইয়ের অধিকারী ছিলেন। তন্ত্রগুরু ক্রকচ নানা আসুরিক অনুষ্ঠান করতেন। উল্লেখযোগ্য একটা বিষয়-তৎকালে ভারতের নানা প্রান্তে বহুল প্রচলিত তন্ত্রমতের সাধকদের অনেককেই আচার্য্যের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হতে দেখা গেছে। আচার্য্যের সঙ্গে বিবাদের এই ঘটনাগুলির সঙ্গে তান্ত্রিকদের নানা অলৌকিক ক্ষমতার কাহিনী জনশ্রুতি হিসাবে প্রচলিত আছে। উজ্জয়িনীতেও এই ধরণের একটা ঘটনা ঘটেছিল বলে প্রবাদ আছে।
আচার্য্যের
খ্যাতি এবং জনমানসে তাঁর প্রতিষ্ঠা সহ্য করতে না পেরে একদিন রক্তাম্বর পরিহিত কাপালিক
ক্রকচ এক হাতে নরকপাল, অন্য হাতে উদ্যত ত্রিশূল নিয়ে সংহারমূর্তিতে আচার্য্যের সামনে
উপস্থিত হয়ে উত্তেজিত কন্ঠে ভণ্ড, পাপিষ্ট ইত্যাদি বিশেষণে আচার্য্যকে অপমান করতে লাগলেন। আচার্য্য নির্বিকার থাকলেন। গুরুদেবের অপমানে বিচলিত
হয়ে রাজা সুধম্বা ব্রকচকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেন। অপারক হয়ে অবশেষে দুরাচারীকে বহিস্কার
করে দেওয়ার জন্য রক্ষীবাহিনীকে নির্দেশ দিলেন। অপমানিত ক্রকচ প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা
করে স্থান ত্যাগ করলেন।
দুষ্ট
ক্রকচ ইহা বলে স্বনগরে ফিরে শক্তিশালী হয়ে বিপ্রবধে কৃতসঙ্কল্প ও সমুদ্যত হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল তান্ত্রিকরাজ ক্রকচের
ভৈরববাহিনী ত্রিশূল ও খড়্গ হস্তে উন্মত্ত হুংকারে দশদিক প্রকম্পিত করে ধেয়ে আসছে। তাদের
দেখে আচার্য্যের শিষ্য ও অনুগামীরা শঙ্কিত হয়ে আচার্য্যকে ঘিরে দাঁড়ালেন। রাজা সুধম্বা ভৈরববাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য সেনাদের
আদেশ দিলেন।
ক্রকচবাহিনী রোষ-পরবশে যুদ্ধোদ্দেশে রাজসৈন্য প্রতি ধাবিত হল। সুধন্বা নরপতি কাপালিগণের সসজ্জা সমারোহ সন্দর্শনে কোপাবিষ্ট-প্রকৃতি হয়ে তৎক্ষণে সসৈন্য যুদ্ধে অগ্রসর হলেন। রণতুর্যনির্ঘোষে ও রণবাদ্য শব্দে দিক সকল পূর্ণিত হল। রণকৃতী সেনাশ্রেণী যুদ্ধোৎসবে সাহস প্রকাশ করত ঘোরনাদ করাতে লাগল। কাপালিসকল ক্রোধাকৃষ্টচিত্ত রোষকলুমীকৃত-লোচন সমাগমন করত সংগ্রামে অগ্রসর হয়ে ত্রিশূল পরশু শরধনু দ্বারা বিপ্রগণের সংহননে ধাবিত হল। কেউ ভূপতির সহিত অতি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আরম্ভ করল, আর কেউ বিবশীকৃত-বুদ্ধি বিপ্রগণের নিধনে নিযুক্ত হইল। দ্বিজবৃন্দ প্রাণভয়ে ভীত পলায়নপরায়ণ হয়ে 'শরণ্য শঙ্কর আমাদের শরণ্যঃ' এই বাক্য ও ত্ৰাহি ত্ৰাহি বলতে বলতে শঙ্করের শরণাগত হলেন। শঙ্করবিপ্রগণের পশ্চাৎ ধাবমান বিপ্ৰ হননে সমাসক্ত দুষ্ট কাপালিগণকে অবলোকন করে স্বয়ং হুঙ্কার দ্বারা সকলকে ভস্মসাৎ করলেন, এবং ভূপতির ঘোর সংগ্রামে অনেক দুষ্ট কাল কবলিত হয়ে প্রায় নির্মূল হল। ক্রকচ কাপালি স্বপক্ষ ক্ষয় অবলোকন করে বলল, তুমি কুমতাশ্রিত তোমাকে ভৈরব বিনাশ করবেন। এই উক্তি করে কপাল-পাত্র হস্তে নিয়ে সুরাতে পূর্ণিত করে দ্রুতগামী হল। পরে তা অৰ্দ্ধপান করে নিজ ইষ্টদেব ভৈরবকে এক চিত্তে স্মরণ কর। ভৈরবদেব স্তুত হয়ে তথায় আবিভূর্ত হলেন। ক্রকচ ভৈরব দেবকে দর্শন করে কোপকলুষিতচিত্তে ভৈরবকে বলল, প্রভো, তোমার ভক্তদ্বেষী এই ভিক্ষুককে হনন কর। দুষ্ট ভৈরবকে এরূপ নিয়োগ করলে ভৈরবদেব ক্রোধাভিভূত হয়ে বললেন, আরে, পাপ দুরাচার দুষ্ট অধম কাপালি, এই সাক্ষাৎ শিবাবতার শঙ্কর, তুমি অপরাধ করেছ, অতএব তুমিই বধ্য তোমাকে বিনষ্ট করি। এই উক্তি করে স্বহস্তে তাঁর মস্তক ছেদন করলেন, তখন ভৈরবদেব শঙ্কর কর্তৃক সংস্তুত হয়ে অন্তৰ্হিত হলেন। শঙ্কর ব্রাহ্মণগণকে রক্ষা আর দুৰ্ম্মতি কাপালিগণকে পরাস্ত করে সশিষ্য হর্ষে স্থিত হলেন। কর্ণাট দেশে এই সময় দোষযুক্ত মতের অভাব ছিল না। আচার্য্য একে একে চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন, সৌগত, ও ক্ষপণক নামক প্রাচীন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের পরাস্ত করে বৈদিক মতের পুনঃস্থাপন করলেন।
যতীশ্বর আসমুদ্র জয় করে মল্লপুর হয়ে মরুঙ্ঘনগরে প্রবেশ করলেন। সেস্থানে সমুপস্থিত হয়ে সরিৎ-সলিলে অবগাহনান্তে সুস্থিত হয়ে ব্ৰহ্মাদ্বৈত-পরায়ণ বেদান্ত-ভাষ্য সকল যতিবৃন্দকে অধ্যাপন করতে নিরত হলেন। এমন সময় ক্রৌঞ্চবিৎ প্রমুখ কামদেব ভক্ত আচার্যের সমীপে এসে নিজমত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে শঙ্কর যতির ব্রহ্মজ্ঞানের সমীপে কাম দর্শন ভষ্মীভূত হল।
'পুরীর
জগন্নাথ বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা'
মরুঙ্ঘ পরিত্যাগ করে আচার্য্য শঙ্কর অন্ধ্রপ্রদেশের
নানা স্থানে ভ্রমণ করতে করতে কতিপয় কলিঙ্গদেশবাসীর অনুরোধে ক্রমে ক্রমে পুরীধামে এসে
উপস্থিত। এসময় কেশরীবংশীয় রাজগণ পুরীধামে রাজত্ব করিতেছিলেন। ইঁহারা কখন মগধের অধীনতা
স্বীকার করে, কখন বা পূর্বচালুক্যগণের অধীনতা স্বীকার করে একপ্রকার স্বাধীনতা রক্ষা
করে আসছিলেন।
এখানে
এসে আচার্য্য জগন্নাথ দেবের মন্দিরেই অবস্থান করতে লাগলেন এবং তাঁর সেই বিশাল শাস্ত্রার্থে
দিগ্বিজয় বাহিনী পুরীর সমুদ্রতীরে অবস্থিতি করতে লাগলেন। পদ্মপাদাদি শিষ্য সমেত শাস্ত্রার্থ
ও হিতোপদেশ দিতে প্রবৃত্ত হলেন।
আচার্য্য
দেখলেন এইখানে পূর্ববর্তী বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বেশি, জগন্নাথ মন্দিরে পূজাদি হয় বটে
কিন্তু কোন বিগ্রহ নেই। পরে শুনলেন পূর্বে কালযবনের অত্যাচারকালে লুন্ঠনভয়ে মন্দিরের
সেবায়েত পাণ্ডাগণ জগন্নাথ বিগ্রহের উদর প্রদেশ স্থিত রত্নপেটিকা চিল্কা হ্রদের তীরে
ভূগর্ভে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় কালক্রমে উক্ত স্থানের লোকেরা ভুলে যান রত্নপেটিকা
রাখার স্থানটিকে। আর সেইকারণে পূর্বপ্রচলিত দারুময় বিগ্রহেরও প্রতিষ্ঠা হয় নি। শালগ্রাম
শিলা প্রভৃতিতে ভগবানের পূজা হতে থাকে।
পুরীবাসী
কতিপয় ব্যক্তি আচার্য্য শঙ্করের নিকট নিবেদন করলেন-'ভগবন্। আপনার কীর্ত্তিকলাপ বর্ত্তমানে
ভারতবর্ষে প্রখ্যাত, আপনি যোগবলে জগন্নাথের রত্নপেটিকা রাখার স্থানটিকে নির্ধারণ করে
দেন, আমরা তাঁর পূজা করে ধন্য হয়।' শঙ্কর প্রফুল্ল চিত্তে বললেন-'আপনাদের সৎ সঙ্কল্প
ভগবৎ ইচ্ছায় পূর্ণ হবে।'
এই
বলে আচার্য্য স্নানাদি সমাপনপূর্বক গভীর ধ্যানমগ্ন হলেন। তৎপর 'জগন্নাথ স্বামী নয়নপথগামী
ভবতু মে।'-এইরূপ মনোমুগ্ধকর প্রখ্যাত শ্রীজগন্নাথাষ্টকম্ রচনা করেন। যোগবলে অবিলম্বে
আচার্য্যের মানসপটে চিল্কা হ্রদের তীরে ভূগর্ভে রত্নপেটিকার বিস্মৃত স্থানটি প্রতিফলিত
হল। আচার্য্য পুরীবাসীদের বললেন-'আপনারা যে হ্রদের কথা বলছেন তার তীরে একটি সর্বাপেক্ষা
বৃহৎ বটবৃক্ষ দেখবেন, তারই তলে মৃত্তিকা গর্ভে রত্নপেটিকা আছে, খননপূর্বক উদ্ধার করুন।'
জগদ্গুরুর
উপদেশে রাজপুরুষগণ ঐ দিনই হ্রদতীরবর্তী যেটা বৃহৎ বটবৃক্ষ তার তলে খননপূর্বক রত্নপেটিকা
উদ্ধার করলেন। পুরীবাসীগণ আশ্চর্য্য হলেন এবং আনন্দিত হয়ে মহাসমারোহে আচার্য্য সমীপে
আসলেন। আচার্য্য শঙ্কর যথারীতি শুভতিথিতে মন্দিরে ভগবান জগন্নাথদেবের পুনঃপ্রতিষ্ঠা
করলেন ও আচার অনুসারে শ্রীভগবানে পূজাঅর্চনাদি সম্পন্ন করলেন। এই ঘটনার পর শঙ্করের
প্রভাবে বৈদিক ধর্মের শ্রীবৃদ্ধি হল পুরীধামে। অনন্তর শঙ্করাচার্য্য পুরীতে অদ্বৈতবেদান্ত,
পঞ্চদেবতার পূজা এবং বেদোক্ত পঞ্চমহাযজ্ঞের প্রবর্তন করিয়া মগধ রাজ্যের অভিমুখে প্রস্থান
করলেন।
বৌদ্ধযুগের পররতীতে শ্রীক্ষেত্র নীলাদ্রি বিজয় করিয়া দিগ্বিজয়ী শঙ্কর শ্রীক্ষেত্র স্থিত ভগবান পুরুষোত্তম জগন্নাথদেবের রথযাত্রার পুনঃ সূচনা করেন। আচার্য্যপাদ্ শঙ্কর প্রতিষ্ঠিত পুরী গোবর্ধন মঠে স্বীয় শিষ্যপ্রবর পদ্মপাদাচার্য্যকে এই পীঠের দায়িত্ব দেন। তখন থেকে বর্তমানকাল অবধি গুরুশিষ্য পরম্পরায় পুরীর রথযাত্রা চলে আসছে।
কলিঙ্গ ত্যাগ করে আচার্য্য মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মগধে তখন বৌদ্ধধর্মের যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। বৌদ্ধাচার্য্যগণ কেউ আচার্য্যের সঙ্গে ধর্মবিচারে অগ্রসর হলেন না। কিন্তু হিন্দুধর্মের নানা ভ্রান্ত মতাবলম্বীদের সঙ্গে বিচারের সুযোগ আচার্য্য পেয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে কুবের উপাসক, ইন্দ্রোপাসক উল্লেখযোগ্য। মাগধপুরে তাঁদের সংস্কার করিয়া আচার্য্য যমপ্রস্থপুরে এসে উপস্থিত হলেন।
'যমপ্রস্থপুরে
যমোপাসকগণের সংস্কার'
যমপ্রস্থপুর
নামক স্থানে যম-উপাসকদের সঙ্গে আচার্য্যের বিচার হয়েছিল। যমোপাসকেরা ছিলেন ভীষণাকৃতি বিশিষ্ট এবং সর্বদাই
নৃত্যপরায়ণ। তপ্ত লৌহ শলাকা দ্বারা অঙ্কিত মহিষের চিত্র তাঁরা বাহুতে ধারণ করতেন। একদিন
যমউপাসকদের ব্রাহ্মণগুরু সদলবলে নৃত্য করতে করতে আচার্য্যের সামনে হাজির হয়ে বললেন--যতিবর!
আমরা যমের উপাসনা করি। যমই সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের কর্তা। একমাত্র তাঁর কৃপাতেই জীব
মুক্ত হতে পারে। ভগবান যম মানুষকে মুক্তিরপথে পরিচালনার জন্য মহিষারূঢ় হয়ে দন্ডহস্তে
সর্বত্র বিচরণ করে বেড়ান। যমের উপাসনায় অজ্ঞানের নাশ হয়ে যমই সর্বত্র বর্তমান--এই
জ্ঞানের উদয় হলেই মানুষের মোক্ষ লাভ হয়। তাই আমরা কৃষ্ণবর্ণ যমের উপাসনা করি। যেহেতু
আপনারাও মোক্ষকামী, অনন্য মনে যমের উপাসনা করুন। আপনাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হবে।
ধৈর্য্যের সঙ্গে যমোপাসকদের বক্তব্য শুনে আচার্য্য বললেন--বেদ, উপনিষদ, পুরাণের কোথাও
প্রমাণ নেই--নিখিল ভুবনের কর্তৃত্ব যমের হাতে। তিনি মুক্তদাতা হতে পারেন না। আপনারা
এই ভ্রান্ত ধারণা ত্যাগ করুন। ইচ্ছা করলে আপনারা দেবতাজ্ঞানে নিষ্কামভাবে যমের উপাসনা করতে পারেন। এর দ্বারাও আপনাদের
চিত্তশুদ্ধি ঘটতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন--কেবলমাত্র দেবোপাসনার দ্বারা মুক্তিলাভ
হয় না। চিত্তশুদ্ধির পর নিরন্তর ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ এই ভাবনায় ভেদবুদ্ধি লুপ্ত হয়ে ব্রহ্মাত্মবোধের
জাগরণ ঘটলে মোক্ষলাভ সম্ভব হয়। আচার্য্যের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা শুনে তাঁরা নিজেদের ভ্রান্তি উপলদ্ধি করেন এবং আচার্য্য
নির্দেশিত পথ অনুসরণের জন্য সচেষ্ট হন।
উপরোক্ত ঘটনায় আমরা বুঝতে পারি-শঙ্করের আবির্ভাবের সময় কর্মকাণ্ড বহুল হিন্দুধর্মে বৈদিকআদর্শ চ্যুতির কারণে নানা কাল্পনিক মতবাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। এর প্রধান কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের বেদ-বিরোধিতা। তাঁরা বেদের নিন্দা করতেন। ফলে জনসাধারণ বেদানুগত্য হারিয়ে ফেলেছিল। বৈদিক যোগসূত্র লুপ্ত হওয়ায় হিন্দুধর্মের নানা সম্প্রদায় ভ্রান্তি ও আবিলতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।
'প্রয়াগে
আচার্য শঙ্কর'
কয়েক বৎসর পূর্বে কুমারিল ভট্টকে দিয়ে ব্যাসসূত্র ভাষ্যের বার্তিক রচনা করানোর উদ্দেশ্যে আচার্য্য শঙ্কর একবার প্রয়াগে এসেছিলেন। এবার তিনি এলেন জনসাধারণের ধর্মীয় ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় জন্য। হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির এই সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন কেন্দ্রে নানা মতাবলম্বী ধর্মপ্রাণ হিন্দুগণ মুক্তিলাভের আকাঙ্খায় সাধন ভজনে কালাতিপাত করতেন। আচার্য্যের আগমন সংবাদ পেয়ে বরুণ, বায়ু, তীর্থ, ভূমি উপাসকসহ বিভিন্ন মতের সাধক পন্ডিতগণ আচার্য্যের সঙ্গে মিলিত হতে লাগলেন। আকাশোপাসক, বরাহমন্ত্রোপাসক ইত্যাদি যে সকল সম্প্রদায়ের সঙ্গে আচার্য্যের বিচার হয়েছিল, তার মধ্যে সাংখ্যমতালম্বীদের সঙ্গে বিচার উল্লেখযোগ্য। সাংখ্যবাদীদের প্রধান আচার্য্যকে সসম্মান অভিবাদন জানিয়ে মনুসংহিতার প্রমাণ উল্লেখ করে বললেন--প্রকৃতিই জগতের আদি কারণ। ত্রিগুণের সাম্য অবস্থাতে প্রকৃতি অব্যক্ত থাকেন। ত্রিগুণের বৈষম্য ঘটলে মহত্তত্ত্বাদির বিকাশের ফলে প্রকৃতি ব্যক্ত হন। এই জগৎ প্রকৃতিরই অভিব্যক্তি। প্রকৃতির প্রসন্নতায় জীবের মুক্তিলাভ হয়।সাংখ্যগুরুর মতবাদ শুনে আচার্য্য বললেন--বেদের মতে প্রকৃতি জগতের কারণ হতে পারেন না। জড় প্রকৃতির পক্ষে জগৎ সৃষ্টি সম্ভব নয়। আপনি স্মৃতির যে প্রমাণ উল্লেখ করেছেন--সে বিষয়ে আমার মত--শ্রুতিবিরোধী (বেদ) স্মৃতির প্রমাণ গ্রাহ্য নয়। অহং ব্রহ্মাস্মি, আমি ব্রহ্মস্বরূপ--এই উপলব্ধি না হওয়া পর্য্যন্ত মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। এরপর গৌতমীয় ন্যায় মত অনুসারী 'ধীরশিব' নামক এক পরমাণুকারণবাদীকেও আচার্য্য শঙ্কর পরাস্ত করেন।
তিন মাস প্রয়াগধামে অবস্থান কালে আচার্য্য শঙ্কর সকল শ্রেণীর দ্বৈতমতাবলম্বীদের বক্তব্য শুনেছিলেন এবং শাস্ত্রীয় যুক্তির সাহায্যে তাঁদের ভ্রান্তিগুলি চিহ্নিত করে এই সকল মতবাদের অসঙ্গতি দূর করেছিলেন। তিনি তাঁদের বলেছিলেন--সগুণব্রহ্মের প্রতীকস্বরূপ বিভিন্ন দেবদেবীর উপাসনা সকামভাবে অনুষ্ঠিত হলে কামনা অনুসারে বিভিন্ন লোকপ্রাপ্তি ঘটতে পারে। এই লোকপ্রাপ্তি নিত্যকালের জন্য নয়। শুভকর্মের ফলভোগ শেষ হলে পুনরায় দেহধারণ করে ধরাধামে আসতে হয় মোক্ষসাধনের জন্য। কামনার বীজ সম্পূর্ণভাবে দগ্ধ না হওয়া পর্য্যন্ত মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন--প্রতিটি মতের সাধনার আসল লক্ষ্য মোক্ষস্বরূপ অদ্বৈত ব্রহ্মবোধে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
'পুনরায়
কাশীধামে শঙ্কর'
সনাতন বেদান্তধর্মের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা এবং অনন্য প্রতিনিধিরূপে আচার্য্য শঙ্কর দীর্ঘ বার বছর পর সহস্র ভক্ত ও শিষ্য পরিবেষ্টিত হয়ে পুনরায় কাশীধামে প্রবেশ করলেন। ভারতপূজ্য আচার্য্যকে দর্শনের জন্য পথিমধ্যে স্থানে স্থানে বিপুল জনসমাগম ঘটেছিল। প্রচণ্ডভাবে কর্মব্যস্ত আচার্য্যের মধ্যে কোন কর্মব্যস্ততা লক্ষ্য করা যেতো না। এখানে আসার পর হতে তাঁকে দেখে মনে হোত--তিনি যেন সংসার সলিলের উপর পদ্মপাতায় ভাসছেন, যে কোন সময় গড়িয়ে পড়তে পারেন।এখানে প্রায় সকল মতবাদীর সঙ্গেই আচার্য্যের বিচার হয়েছিল। অতি সংক্ষেপে দু একটি বিচারের বিষয় উল্লেখ করা হচ্ছে।
মহালক্ষ্মী উপাসক সম্প্রদায়ের প্রধান একদিন আচার্য্যের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন—মহাত্মন! আপনার রচিত গ্রন্থসমূহে আপনার অদ্বৈতসিদ্ধান্ত অবগত হয়েছি, কিন্তু একমত হতে পারছি না। অনুগ্রহ করে আমাদের মত শুনুন। ত্রিলোক জননী, অমলতনু মহালক্ষ্মী নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের জন্মদাত্রী। ব্রহ্মাদি দেবগণ এই আদ্যাপ্রকৃতি হতেই উৎপন্ন হয়েছেন। আমরা সৃষ্টির আদি কারণ মহালক্ষ্মীকেই একমাত্র মুক্তিদাত্রী মনে করি।
সব শুনে আচার্য্য ধীরভাবে বললেন--আপনাদের বক্তব্য শুনলে আপাতদৃষ্টিতে সত্য বলেই মনে
হয়। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন--প্রকৃতি স্বাধীন বা স্বতন্ত্র নন। অদ্বিতীয়,
সৎস্বরূপ, জ্ঞানময় পরমাত্মাই সৃষ্টির আদি কারণ। প্রকৃতি তাঁরই অধীন। কাজেই প্রকৃতি
মুক্তিদাত্রী হতে পারেন না। ব্রহ্মাত্মবোধটাই মোক্ষস্বরূপ। অহং ব্রহ্মাস্মি--এই মহামন্ত্র
শ্রবণ, মনন ও নিধিধ্যাসনের দ্বারা সমাধিযোগে ব্রহ্মাত্মবোধের জাগরণ ঘটে।
মহালক্ষ্মীর উপাসনা ভুল নয়। নিষ্কামভাবে এই দেবীর উপাসনার দ্বারা নিম্ন অধিকারীগণের
চিত্তশুদ্ধি হতে পারে, কিন্তু মোক্ষকামীদের জন্য এ পথ নয়। আপনারা যদি জন্ম মৃত্যুর
প্রহেলিকা হতে চিরতরে মুক্ত হতে চান--ব্রহ্মাত্মজ্ঞান লাভের পথে অগ্রসর হোন।
একদিন কয়েকজন সুপণ্ডিত কর্মবাদী মিমাংসক আচার্য্যের নিকট উপস্থিত হয়ে সসম্মান অভিবাদন জানিয়ে বললেন--আমরা আপনার গ্রন্থসমূহে অদ্বৈততত্ত্বের বিষয়ে পড়েছি, কিন্তু আপনার অদ্বৈত সিদ্ধান্তটিকে একমাত্র সত্য বলে মেনে নিতে পারছি না। আমরা বিশ্বাস করি—মোক্ষকামী কর্মের অনুষ্ঠান দ্বারাই মোক্ষপ্রাপ্ত হতে পারেন। শুভ কর্মের দ্বারা শুভ ফল এবং অশুভ কর্মের দ্বারা অশুভ ফল উৎপন্ন হয়। কর্মই একমাত্র ফলদাতা। ফলদাতা হিসাবে ঈশ্বর বা ব্রহ্মের অস্তিত্ব কল্পনা করার কোন সার্থকতা নেই।
কর্মবাদীদের বক্তব্য শুনে আচার্য্য বল্লেন--বেদের মতে এই জগৎপ্রপঞ্চ ব্রহ্মের কার্য্য। কার্য্যের নয়, জগৎকারণের ধ্যান করার উপদেশ দিয়েছেন বেদ। কর্ম অনিত্য। শুভ কর্মের দ্বারা প্রাপ্ত স্বর্গাদি লোকও অনিত্য। কাজেই একমাত্র কর্মের উপাসনা দ্বারা জীবের পরমপ্রাপ্তি মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। নিষ্কাম কর্মের গুরুত্ব আছে। এর দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হয় এবং মোক্ষের কারণ ব্রহ্মাত্ম-বোধে প্রতিষ্ঠিত হতে সামর্থ যোগায়।
কাশীধামে গন্ধর্বোপাসক, সূর্য্যোপাসক, শনি মঙ্গলাদি গ্রহ উপাসক, বেতাল উপাসক, চার্বাকপন্থী ইত্যাদি বহু ভ্রান্ত মতবাদীর সঙ্গে আচার্য্যের বিচার হয়েছিল। প্রায় সকল মতবাদীই নিজের নিজের মতের অসম্পূর্ণতা অনুভব করেছিলেন এবং অদ্বৈত সত্যের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
পদ্মপাদ, সুরেশ্বরাচার্য্য, হস্তামলক ইত্যাদি আচার্য্যের প্রধান শিষ্যগণও অনেক ভ্রান্ত মতবাদীর সঙ্গে বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন এবং তাঁদের অদ্বৈতমতের অনুবর্তী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অনেক নৈয়ায়িক পণ্ডিত আচার্য্য শঙ্করের ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য খন্ডনের প্রাণপণ চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছিলেন। গুপ্ত মিশ্র, ভাস্কর, দিব্যেন্দু ইত্যাদি তৎকালীন কাশীধামের প্রখ্যাত পণ্ডিত আচার্য্যের নিকট বিচারে পরাস্ত হয়েছিলেন। কাশীধামের পণ্ডিতসমাজ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আচার্য্যের অদ্বৈত-সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ব্রহ্মই ঈশ্বর-স্বরূপ উপাস্য--এই অভিনব মতবাদ চারিদিকে প্রচারিত হয়েছিল। দ্বৈতবাদীদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ-বিশ্বাসের মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেছিলেন। অনেক ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আচার্য্য শঙ্কর অদ্বৈত-সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কাশীধামের দার্শনিক ও পণ্ডিত সমাজ প্রবল উৎসাহে বেদান্ত চর্চা আরম্ভ করলেন। নানা স্থানে টোল ও চতুষ্পাঠীতে বেদান্ত অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা শুরু হোল। অল্প দিনের মধ্যেই কাশীধামের পণ্ডিত সমাজের চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। আচার্য্য শঙ্কর অদ্বৈত দর্শনের অধ্যাপনা ও প্রচারের জন্য অবস্থাপন্ন হিন্দুদের আর্থিক সহায়তায় বহু স্থানে টোল এবং চতুষ্পাঠী স্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই সকল টোল ও চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনার কাজে তাঁর অনুগামী পণ্ডিতদের নিযুক্ত করেছিলেন। তৎপরে আচার্য্য সৌরাষ্ট্র অভিমুখে যাত্রা করিলেন।
'শঙ্করের
অবন্তীপুরী গমন ও ভাস্কর সহ বিচার'
শঙ্কর
যতিবর, অবন্তী পুরীতে প্রবিষ্ট হয়ে পাৰ্ব্বতীপতি মহেশ্বরকে বন্দনা করলেন। শিবালয়ে
অবস্থিত হয়ে পদ্মপাদকে বললেন,পদ্মপাদ! তুমি ভাস্করের নিকট গমন করে আমার প্রবৃত্তি
সে প্রাজ্ঞাভিমানিকে জ্ঞাপন কর। পদ্মপাদ শ্রীগুরুর আজ্ঞা পালন করতে ভাস্কর গৃহে গমন করলেন
এবং ভগবান্ শঙ্করাচার্য্যের সহিথ শাস্ত্রবিচারে আহবান করলেন। ভাস্কর তৎক্ষণাৎ আহবান
স্বীকার করে শঙ্করের নিকট আসলেন। শঙ্করাচার্যাকে সমালোকন করে বললেন, আমি জনগণের
বাচনিক এবং আপনার শিষ্য-প্রমুখাৎ থেকে শ্রুত হলাম, ষে আপনি ব্রহ্মসূত্রের শারীরকে ব্ৰহ্মাদ্বৈতপর
ভাষ্য করেছেন, তাতে কি প্রকারে অদ্বৈতমার্গ আপনার সম্মত, তা আমার নিকট ব্যক্ত করুন।
শঙ্করাচার্য্য
ভাস্করের তাৎপৰ্য্য-গৰ্ভিত বাক্য শ্রবণ করে শ্রতিসম্মত ব্ৰহ্মাদ্বৈত মত তত্ত্বমস্যাদি
বাক্য দ্বারা এ প্রকার প্রতিপাদন করলেন এক এবং অদ্বিতীয় সৎ পরব্ৰহ্ম বস্তু মাত্র আছেন,
তিনি অসঙ্গ অমল জ্যোতি, কুটস্থ নিৰ্ব্বিকম্প, অবিদ্যাতে অনেক প্রকার জীব-ভাব প্রাপ্ত
হয়েছেন। সেই অবিদ্যা কর্তৃক ঈশ্বরত্ব ও প্রপঞ্চ আত্মাতে কম্পিত হয়েছে! তাঁর কল্পনাতে
জীবরূপে এই ভ্রান্তি কম্পিত অনাদি সংসারে জন্ম মৃত্যু জরাদি দুঃখ সমূহে আপন সম্বন্ধ
অনুভব করছেন, এবং পুণ্য পাপ কল্পনা করে উভয়ের ফল-স্বরূপ কল্পিত নানা দুঃখ ভোগ করছেন
এবং ভ্রান্তি বুদ্ধিতে দ্বৈতভ্রম পর্যালোচনা করত তাঁতে নিমগ্ন ও আসক্ত রয়েছেন। এ অবনিমণ্ডলে
কুত্ৰাপি বিশ্রান্তি প্রাপ্ত হন না, তবে কদাচিৎ স্ববর্ণাশ্রমোচিত কৰ্ম্ম দ্বারা ভগবৎ
সেবনে সাধন-সম্পত্তি প্রাপ্ত হয়ে মুমুক্ষুত্ব লাভ করে শ্ৰীগুরু-চরণাশ্রয় গ্রহণে অদ্বৈত-বোধক
তত্ত্বমস্যাদি বেদান্ত-বাক্যে চিদদ্বয় আত্মা শ্রবণ করত পরব্রহ্মাদ্বৈত তত্ত্ব নিশ্চয়
করে মুক্ত হযন, এরূপ বেদান্তবাক্যের এক অদ্বয়মত,আমি সুত্র ভাষ্যে বেদান্ত নির্ণয়ে
নির্ণীত করেছি।
এরপর থেকে ভাস্করের প্রশ্নবাণ আর তত্ত্ববিচার শুরু। প্রাজ্ঞ শঙ্কর একের পর এক পাণ্ডিত্যপূর্ণ উত্তর দিচ্ছিলেন।শ্ৰীশঙ্করাচার্য্য যোগিরাট শত শত যুক্তিতে ভাস্করের মুখবন্ধ করে জয়যুক্ত হলেন। ভাস্কর পরাজিত হয়ৈ সশিষ্য প্ৰণতি করে আপন মত ফলশূন্য বিবেচনা করতঃ শ্রতিসন্মত শঙ্করাচার্যের মত সশিষ্য শ্রবণ করে একত্র একান্ত শ্রদ্ধাযুক্ত হলেন।
'সৌরাষ্ট্রদেশে
আচার্য্য শঙ্কর'
সৌরাষ্টমধ্যে গির্ণার, সোমনাথ ও প্রভাসতীর্থ অতি প্রসিদ্ধ স্থান। আচার্য্য একে একে এসকল স্থান দর্শন করতে লাগলেন। গির্ণারে এসে শৃঙ্গোপরি অম্বিকাদেবীকে দর্শন করলেন এবং স্তবদ্বারা পূজার্চনাদি সম্পন্ন করলেন। অনন্তর তৎপার্শ্ববর্তী গোরক্ষনাথশৃঙ্গ ও দত্তাত্রেয়শৃঙ্গ দর্শন করে গির্ণারবাসিগনের মধ্যে অদ্বৈতসিদ্ধান্ত প্রচার করলেন। এরপর আচার্য্য দক্ষিণাভিমুখে সোমনাথের দিকে অগ্রসর হলেন। এখানে সেই অতিপ্রাচীনকাল থেকে পূজিত সোমনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের যথাবিধি পূজা করিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগ স্থান সহ প্রভৃতি পূণ্যস্থান দর্শন করতে করতে দেশের অধিবাসীগণের মধ্যে অদ্বৈতমত প্রচার করলেন। এখানে বৈষ্ণবগণের সংখ্যাই অধিক, আচার্য্যের উপদেশ অনুসারে সকলেই অদ্বৈতসিদ্ধান্ত অনুসারে উপাসনাপরায়ণ হলেন। এরপর প্রভাসতীর্থ দর্শন করে আচার্য্য দ্বারাবতীর উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেন।
'শঙ্করের
দ্বারাবতী গমন শ্ৰীকৃষ্ণের পূজা মহত্ত্বঘোষণা ও বৈষ্ণবগণের পরাজয়'
ভিক্ষুরাজ
শঙ্কর সৌরাষ্ট্রাদি দেশে নিজ ভাষ্যসমুহ বিস্তার করে বিষ্ণুপুরী দ্বারাবতীতে গমন করলেন।
সে স্থানে ভুজদ্বয়ে শঙ্খচক্রাদি তপ্তচিহ্ণকৃত পাঞ্চরাত্রি বৈষ্ণবগণ শঙ্করের শিষ্য
হতে পরাজিত হলেন। যতিবর তৎস্থানে অবস্থিত হয়া শ্ৰীকৃষ্ণের পূজা করলেন, এবং নারায়ণ
ধ্যেয়, ইহা সৰ্ব্বত্র ঘোষণা করলেন। যাঁর সংসার-সন্তাপ নিবারণের অভিলাষ হয় সে শ্ৰীকৃষ্ণ ভক্তিতে নিরত হয়ে শ্ৰীহরিকে ভাবনা করবে। যাঁর
নরক-যাতনা বাধিকা বোধ হয়, তাহার কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ মনে বাক্য দ্বারা স্মরণীয়। যাঁর
অন্তরে প্রবল দেহাভিমান নিবৃত্ত না হয়, সে শরণ্য শ্ৰীকৃষ্ণকে আশ্রয় করে ভগবানের চিন্তনে
স্থিত হবে। অবিদ্যা কাম কৰ্ম্মাদি হেতু বন্ধন হয়, তা নিবারণের বাসনা যাঁর, হৃদিস্থিত
কৃষ্ণ তাঁর ধ্যেয়।
কৃষিশব্দ ভুবাচক, তাতে হরি সত্যপ্রদ ও ণকার আনন্দবাচক, অতএব সৰ্ব্বানন্দকর সত্তাকে আশ্রয় করে ভূত সকল জাত হয়, ও সুখলেশে আনন্দে জীবিত থাকে, জ্ঞান আনন্দ পৃথক নয়। সত্যজ্ঞান সুখরুপ, শ্ৰীকৃষ্ণাখ্য পরমেশ্বর সমস্ত দেহির আত্মা,প্রিয়, সুহৃৎ, সাক্ষী; ইহলোকে অসত্য জড় দুঃখাত্মক দেহাদিতে আসক্ত মূঢ়গণ, কৃষ্ণকে বিস্মরণ করে মায়াবশে পুনঃ পুনঃ ভ্ৰমিত হয়, অতএব দেবাদি ভূতগণের মোক্ষের জন্য সৰ্ব্ব-বন্ধন-হর শ্ৰীকৃষ্ণ ধ্যেয় ও অচ্চনীয় হন। যতীশ্বর, এরূপ সদুপদেশ দ্বারা ঘোষণা করে কৃষ্ণভক্তি দৃঢ়করণানন্তর অবন্তী পুরীতে যাত্রা করলেন।
'কঙ্কন
ও গুর্জররাজ্যে শঙ্কর'
এরপর আচার্য্য দ্বারকা হইতে পূর্বাভিমুখী হয়ে সশিষ্য আবার উত্তরাভিমুখে চলতে লাগলেন এবং ক্রমে কঙ্কনরাজ্যের (বর্তমান সিদ্ধপুর) মধ্যদিয়া গুর্জর রাজ্যের (বর্তমান রাজপুতানা) মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন। কঙ্কনরাজ্যে শিলারস বংশীয় রাজগণ তখন রাজত্ব করছিলেন এবং গুর্জর রাজ্যে তৃতীয় জয়ভট্ট রাজা ছিলেন। আচার্য্য সেখানে রুদ্রদেবোপাসক গণের মধ্যে অদ্বৈতজ্ঞান দান করেন। গুর্জবরাজ্যের রাজধানী এ সময় শ্রীমাল। ইহার কিঞ্চিৎ দক্ষিণপুর্বে আরাবল্লী পর্বতশৃঙ্গে আবু পর্বত অবস্থিত। এখানে জৈনগণের তখন প্রবল প্রভাব। আচার্য্য শঙ্করের কীর্ত্তিকলাপ শুনে জৈনগণ সাহস করলেন না বিচারে প্রবৃত্ত হতে। তাছাড়া ইতোপূর্বে মীমাংসক কুমারিল ভট্টের দিগ্বিজয় তাঁরা এখনও বিস্মৃত হন নি। আচার্য্য এখানে অদ্বৈত বেদান্ত প্রচার করে পুস্করতীর্থাভিমুখে গমন করলেন।
পুষ্করতীর্থে
আচার্য্য শঙ্কর
পুস্করতীর্থে ব্রহ্মার উপাসকবহুল লোকের বাস। এখানে মরুভূমি বেষ্টিত শৈলমালা পরবেষ্টিত কয়েকটি হ্রদ বিদ্যমান। বিকশিত কমলদল এই হ্রদগুলোর শোভাবর্ধন করে। ব্রহ্মা, সাবিত্রী ও গায়ত্রীদেবীর পূজা এখানে মহাসমারোহে হয়ে থাকে। আচার্য্য ইহাদের পূজা অর্চনা করে অধিবাসীগণের মধ্যে অদ্বৈতব্রহ্মতত্ত্ব প্রচার করলেন। ইহাতে তদ্দেশীয় সকলেই অদ্বৈতমতানুসারে পঞ্চদেবতার উপাসনা এবং পঞ্চমহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান পরায়ণ হলেন।
তৎপরে আচার্য্য শঙ্কর একটী নদীর তীর ধরে আবার দক্ষিণ পশ্চিমাভিমুখে প্রস্থিত হলেন এবং ধীরে ধীরে সিন্ধুসাগর সঙ্গমস্থল সিন্ধুদেশে এসে উপস্থিত হলেন। এ সময় এখানে একজন শূদ্র রাজা। বৌদ্ধ ও জৈনগণের প্রভাব ছিল বেশি, কিন্তু তাদের কেউ বিদ্বান ছিলেন না, যে জ্ঞানসম্রাট শঙ্করের সম্মুখীন হওয়ার সামর্থ্য রাখেন। আচার্য্য তথাপি সমাগত ব্যক্তিগণকে বৈদিক ধর্মজ্ঞান প্রদান করলেন। সিন্ধুসঙ্গম পরিত্যাগ করে, সিন্ধু নদীর তীর ধরে উত্তরাভিমুখে নানা তীর্থ পর্যটনপূর্বক গান্ধারদেশের পুরুষপুর(বর্তমান পেশওয়ারে এসে উপস্থিত হলেন। এখানেও বৌদ্ধগণ প্রবল ছি, কিন্তু আচা্য্য শঙ্করের প্রতাপে বৈদিকধর্ম্মের বিজয়ধ্বজা উড্ডীন হল। পুরুষপুর অবস্থিতি কালে আচার্য্য বাহ্লীক দেশবাসিগণ কর্তৃক নিমন্তিত হন, যাহা পুরুষপুর হতে উত্তরপশ্চিমে কিছুদূরে অবস্থিত। এখানে তখন কাশ্মীরাধিপতি কার্কোতকবংশীয় রাজগণ আধিপত্য বিস্তার করছেন। কারণ, অক্ষনদীর তীরবাসী হূনগণের রাজা মিহিরকূল, শকীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগে মগধের গুপ্তরাজ বালাদিত্য এবং মালবরাজ যশোবর্মার নিকট পরাজিত হয়ে ভারতসাম্রাজ্য হারিয়েছেন। ধর্মরাজ্যে শকজাতীয় বৈদিক ধর্মালম্বিগণ বৌদ্ধ ও জৈনগণের প্রভাবে ম্রিয়মাণ। আর এইজন্যই ইহারা আচার্য্যকে স্বদেশে আহবান করেছেন। পরিব্রাজক আচার্য্য সত্ত্বর দিগ্বিজয়ী বাহিনী সহিত সেখানে উপস্থিত হলেন। কুমারিল স্বামীর দ্বিগ্বিজয় প্রভাব এতদূরে তখনও ইঁহাদের তাদৃশ ভীতি উৎপাদন করতে পারে নাই। আচার্য্য এখানে প্রথমে জৈনগণকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করলেন। তৎপরে মাধ্যমিক বৌদ্ধ, বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধগণের সহিত বিচারে প্রবৃত্ত হলেন এবং বৌদ্ধগণ পরাস্ত হয়ে অন্তরে অন্তরে বেদান্তী হয়ে গেলেন। বাহ্লিকদেশ হতে আচার্য্য শঙ্কর সশিষ্য তিব্বতের পশ্চিমপ্রান্তে কাম্বোজ দেশে আসলেন। সেখানে বোদ্ধ তান্ত্রিকদের প্রবল প্রতাপ। কিন্তু কেহ বিচারার্থ সাহস করলেন না। আচার্য সমাগত জিজ্ঞাসুগণকে ধর্মতত্ত্বোপদেশ দিতে দিতে দরদদেশে এসে উপস্থিত হলেন। কাশ্মীর রাজ চন্দ্রাপীঠ এসময় এ দেশের রাজা। শকজাতীয় বৌদ্ধগণের প্রভাব থাকলেও আচার্য্য এখানে বর্ণাশ্রমোচিত বৈদিক ধর্মের পুনঃপ্রচার করলেন।
'শঙ্করের
কাশ্মীর গমন ও বাদিগণের কৃত প্রশ্নে সদুত্তরদান এবং বিদ্যাভদ্রাসনে আরোহণ'
ইতিমধ্যে
কাশ্মীর দেশের স্তুতিগর্ভিত বার্তা শ্রুতিগোচর হল। কোন
ব্যক্তি বললেন, এ অবনিমণ্ডল মধ্যে জম্ভুদ্বীপ অত্যুৎকৃষ্ট, তন্মধ্যে ভারতবর্ষ শ্রেষ্ঠ
স্থান, তাতে কাশ্মীরমণ্ডল, যেখানে সর্ব-বিদ্যা-প্রকাশিনী শারদা-দেবী বিরাজমান রয়েছেন।
বেদান্ত সমান শাস্ত্র নেই, মেরু সদৃশ গিরি নেই, তত্ত্বজ্ঞান হতে তীর্থ নেই, হরির পর
দেবতা নেই, কাশ্মীরতুল্য সুন্দর মণ্ডল ইহলোকে নেই, এই বাৰ্ত্তা শ্রবণে প্রবিষ্ট হলে
ভাষ্যকার সশিষ্য কাশ্মীর গমনে মনোনিবেশ করে যাত্রা করলেন ভিক্ষুবর শিষ্যগণ-সমভিব্যাহারে গমন করে কাশ্মীরমণ্ডলে
উপনীত হলেন। দক্ষিণদ্বার বাদিনিচয়ে সমাবৃত প্রবেশপথ রোধিত ছিল ; একব্যক্তি বল, ভিক্ষুবর, বিনাবাদে বিজীগিষুর
এতে প্রবেশ হয় না। ইত্যবসরে কোন বৈশেষিক মতাবলম্বী কাণাদ বাদ-মানসে এসে বলল, তুমি
কে ভিক্ষুবেশে কাশ্মীরমগুলে প্রবেশ করেছ? যদি সৰ্ব্বজ্ঞ হও তবে আমার প্রশ্নের উত্তর
প্রদান কর, আমাদের মতে দুই পরমাণুতে দ্ব্যণুক হয়েছে, তদাশ্রিত অণুত্ব কাহা হতে জন্মে?
ভাষ্যকার কাণাদপ্রতি হাস্য করে বললেন, পরমাণুনিষ্ঠা দ্বিত্বসঙ্খ্যা তার কারণ, কণাদ
সদুত্তর প্রাপ্ত হয়ে পূজা করে মার্গ পরিত্যাগ করল। পরে নৈয়ায়িক অগ্রসর হয়ে উক্তি
রিল, কণাদ পক্ষ হতে গৌতমীয়মতে মুক্তির বিশেষ কি? শঙ্কর উত্তর করলেন, একবিংশতি সঙ্খ্যক
দুঃখাত্মিকা হয়।
কোন
মীমাংসানুবৰ্ত্তী গৌতমীয়গণের কিঞ্চিৎ বিশেষ আশ্রয় করে বিলক্ষণা সম্মত হয়, সে মুক্তি
অন্তর্দুঃখপুরঃসর সানন্দরূপা জ্ঞান নিরুপদ্রব হয়। গৌতমীয় ইহা শ্রতমাত্র প্রণাম করে
প্রস্থান করল। তখন কাপিল আগত হয়ে প্রশ্ন করল, ভিক্ষুবর,কাপিলে যে মূলযোনি প্রকৃতি
জগতের কারণ সাঙ্খ্যতন্ত্র সম্মত হয়, অথবা অপর জগন্নিদান তা বল, অন্যথা প্রবেশ হবে
না, শঙ্কর হাস্য করিে বললেন, কাপিলে প্রধানাখ্য ত্ৰিগুণ মূলযোনি স্বতন্ত্র জগতের কারণ
হঠপূর্বক সাঙ্খ্যে সম্মত যে প্রকৃতি জগতের কারণ মূলযোনি, সে বেদান্ত মতে পরতন্ত্রা
পরব্রহ্ম সমাশ্রয়া। কাপিল ইহা শ্রবণে যতিবরের পূজা করে গমন করল। পরে সৌগত অর্থাৎ বৌদ্ধ
নাস্তিক সমাগত হয়ে বলল, আমাদের মতে দ্বিধা পদাৰ্থ বাদ-সম্মত, তার অন্তর বল, অন্যথা
প্রবেশ নেই, ভাষ্যকার তাঁকে বললেন, বৌদ্ধশিশো, শ্রবণ কর, এক প্রত্যক্ষবেদ্য বস্তুজাত,
দ্বিতীয় লিঙ্গগম্য বস্তুজাত বলেন। বৌদ্ধ, পুনর্বার বলল, বিজ্ঞানবাদ ও বেদান্তবাদ এ
উভয়ের অন্তর কি,তাহবল। শঙ্করাচার্য্য ইহা শুনে শিষ্যপ্রতি নেত্রপাত করতঃ হাস্য করে
বললেন, অধম বিজ্ঞানবাদী আত্মাকে ক্ষণিক অঙ্গীকার করে, আর বেদান্তবাদী সচ্চিদানন্দ প্রত্যগভিন্ন
শুদ্ধ অদ্বয় আত্মা মানে, এই অন্তর। পরব্রহ্ম বস্তুরূপ সুখাত্মক অধিষ্ঠান, তাতে স্বময়া
দ্বারা প্রপঞ্চের অধ্যারোপ হয়। জড়বুদ্ধি বৌদ্ধগণ, ভ্রান্তিবশতঃ সমস্ত ক্ষণিক বলে,
অপিচ বৌদ্ধগণ নিরধিষ্ঠান ভ্রম স্বীকার করে। কোথা শ্রুতিবাহ্য অধম ক্ষণিক-বিজ্ঞানবাদী
বৌদ্ধ, আর কোথা সুমেধাবী বেদান্তী পুরুষোত্তম। বৌদ্ধ এরূপ তিরস্কারগর্ভিত বাক্য শ্রবণে
তিরস্কৃত হয়ে প্রস্থান করল।
তখন
দৈগম্বর অর্থাৎ দিগম্বর মতাবলম্বী সমাগত হয়ে বাগাড়ম্বর সহ জিজ্ঞাসা করল, যতে, জৈনসম্মত
কায়াদি শব্দের অর্থ কি? শঙ্কর বললেন, জীবাদি পঞ্চ শব্দতে বাচ্য হয়। সে ইহা শুনে গমনে
সত্বর হল। পরে জৈমিনীয় কর্মমীমাংসাবাদী সমুপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, মুনিবর জৈমিনীয়
মতে শব্দ, দ্রব্য অথবা গুণ নিত্য বা অনিত্য, অবিলম্বে বর্ণন করুন, নচেৎ প্রবেশে সমর্থ
হবেন না। শঙ্কর বললেন, জৈমিনীয় মতে বর্ণ নিত্য দ্রব্য শব্দব্যাপক, শব্দত্ব হেতু বেদশব্দবৎ
বেদশব্দের নিত্যত্ব ব্যাপকত্ব সম্মত। জৈমিনীয় ইহা শ্রবণ করে গমনপর হল। শঙ্কর ভিক্ষুরাট
বাদী-কণ্টকসঙ্কুল দ্বার-দেশ পরিষ্কৃত দেখে সশিষ্য অন্তর্গৃহে প্রবেশ করলেন, এবং বিদ্যাভদ্রাসনে
অধিরোহণেচ্ছু হলেন। এমত সময়ে শারদা অশরীরিণী বাণী শঙ্করকে বললেন, হে যতি সৰ্ব্বজ্ঞ!
তিষ্ঠ তিষ্ঠ, তাবৎ আমার বাক্য শ্রবণ কর, পূর্ব হতে তোমার সর্বজ্ঞত্ব বিদিত আছে, যে
হেতু বিশ্বরূপ দ্বিজ সাক্ষাৎ প্রজাপতি স্বয়ং ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্ত্তা প্ৰভু তোমার শিষ্য
হয়েছেন,তিনি বিনা সাৰ্ব্বজ্ঞ্য কেন শিষ্যভাব অবলম্বন করবেন, কিন্তু এ পীঠ সমারোহণে
তোমার সর্বজ্ঞত্ব কারণ নয়, এ বিষয়ে সংশুদ্ধি হেতু, অধুনা বিচাৰ্য্য তা আছে কি না।
ভিক্ষুবর, সাহস করিও না, আপন পূর্ববৃত্তান্ত স্মরণ কর, অঙ্গনা উপভোগ করে কামকলা কামশাস্ত্র
শিক্ষা করেছ। তোমা হতে ভিক্ষুবেশে এ শুদ্ধিতা সাধন করা হয়েছে। প্রভো, এ বিদ্যা-ভদ্রাসন
সৎগুণাশ্রিত শুদ্ধ সিদ্ধপুরুষের জন্য, ঈদৃশ পদ সমারোহে কিপ্রকারে আপনি যোগ্য হবেন?
যতীন্দ্র ভারতীর বাণী শ্রুতিগোচর হলে শারদাকে বললেন, মাতা! আমি আজন্ম এ দেহে কোন পাপ করি নি, অন্য শরীরে যা কৃত হয়েছে, তাতে আমার অশুচি হতে পারে না। অন্যথা পূৰ্ব্বদেহে জন্মতঃ শূদ্র ব্যক্তি সুকৃতিবশে পরজন্মে বিপ্রতা প্রাপ্ত হলে সে কি বেদে অনধিকৃত হবে? অতএব বিবেকতঃ আমি শুদ্ধই আছি, শুদ্ধিতাভাব নেই। শারদা শঙ্করের উক্তিতে নিরুত্তরা হলেন। তখন শ্রীশঙ্করাচাৰ্য্য হর্ষযুক্ত হয়ে, বিদ্যা-ভদ্রাসনে সমারোহণ করে সভামধ্যে যেন নিৰ্ম্মল রজনীতে পূর্ণ দ্বিজরাজ বিরাজমান হলেন।
বেদান্ত মত ভাস্কর সর্বজ্ঞ শঙ্কর পীঠ সমারোহণান্তর অদ্বৈত্যমার্গনিষ্ঠ শিষ্যবৃন্দকে আজ্ঞা করলেন, হে শিষ্যগণ, মানবনিকরের মোক্ষকর বেদান্ত সম্মত অদ্বৈত মত সম্প্রদায় মতে লোকে প্রচার কর, ইহা আজ্ঞা করে শিষ্যবৃন্দকে কাশ্মীর-মণ্ডলে সন্নিবেশিত করলেন।
'কাশ্মীর
শ্রীনগরে আচার্য্য শঙ্কর'
আচার্য্য শারদাক্ষেত্র পরিত্যাগ করে একটী অত্যুচ্চ শৈলশ্রণী অতিক্রম করে কাশ্মীরক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন। পথ চলিতে চলিতে ভূস্বর্গের অপরূপ শোভা দেখে 'অনাত্মাশ্রীবিগর্হন' নামক কতকগুলি কবিতা রচনা করেন এবং ক্রমে শ্রীনগরে এসে উপস্থিত হলেন। এখানে বৌদ্ধগণ বুদ্ধের উচ্চাদর্শ না বুঝে তান্ত্রিক সিদ্ধির জন্য লালায়িত। বৌদ্ধগণের অত্যাচারে বৈদিক যাগযজ্ঞ একপ্রকার বিলুপ্ত। হিন্দুদের মধ্যে শাক্ত, শৈবদের কিয়দংশ ছিল। রাজা চন্দ্রাপীড় রাজকার্যেই অধিক ব্যস্ত। আচার্য্য এখানে শৈলশৃঙ্গোপরি একটী শিবমন্দির দেখে সেখানে আসনগ্রহণ করলেন ও বেদান্ত শিক্ষা দিতে লাগলেন।। এই শৈলতলে একটী কুণ্ড ভগবতীর স্থান বলে প্রসিদ্ধ ছিল। আচার্য্য এখানে এসে ভগবতীর একটী অপূর্ব স্তব রচনা করলেন এবং ভগবতীর আরাধনায় রত হলেন। অতঃপর ইহাই 'সৌন্দর্যলহরী' বা 'আনন্দলহরী' নামে জগৎপ্রসিদ্ধ হল। কয়েকদিনের মধ্যেই পথভ্রষ্ট বৌদ্ধগণ আচার্য্যের নিকট পরাস্ত হয়ে পুনরায় বৈদিকধর্মে ফিরে এলেন। আচার্য্যের উপর সমগ্র দেশবাসীর শ্রদ্ধা এতই বৃদ্ধি পেল যে, এই শৈলশৃঙ্গটী 'শঙ্করাচার্য্য' পর্বত নামে অভিহিত হলে।
'তক্ষশিলায়
শঙ্করাচার্য্য'
শ্রীনগর
হতে আচার্য্য দিগ্বিজয়ীবাহিনী সহ চন্দ্রভাগা নদীর তীর অবলম্বন করে ধীরে ধীরে ভারতের
সমতল ক্ষেত্রাভিমুখে গমন করলেন। এইসময় তক্ষশিলা বৌদ্ধ আচার্য্য পণ্ডিতবর্গের স্থান
ছিল, বৌদ্ধবিহারগুলোতে বিদ্যা গ্রহণে বহু বিদ্যার্থী সমাগত হত। যে স্থানটী একদিন ভগবান
শ্রীরামচন্দ্রের ভ্রাতা ভরতের পুত্র তক্ষের রাজধানী ছিল। পদ্মপাদাদি শিষ্যদের এই তক্ষশিলায়
পুনরায় বৈদিক ধর্মের বিজয় পতাকা উড্ডীনের ইচ্ছা হল। আচার্য্য প্রকাণ্ড দিগ্বিজয়ী বাহিনী
সহ তক্ষশিলায় প্রবেশ করলেন। বৌদ্ধপণ্ডিতগণ আচার্য্যের পাণ্ডিত্য আর দিগ্বিজয় বিষয়ে
অবগত ছিলেন। তারা ভাবলেন এ স্রোত রুদ্ধ করবার সামর্থ্য তাদের নেই, যে স্রোতের অধিনায়ক
স্বয়ং মহাগুরু ভগবান শঙ্কর। বৌদ্ধপণ্ডিতবর্গ আচার্য্যের চরণপদ্ম বন্দনাপূর্বক সম্যক্
অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করলেন। পদ্মপাদাদি শিষ্যবর্গ এখানে চতুর্দিকে অদ্বৈতবেদান্তের প্রচার
করলেন এবং জনসাধারণকে পুনরায় মূল বৈদিকপথের দিকে আনয়ন করলেন। আচার্য্য তৎপশ্চাৎ হিমালয়ের
পাদদেশ হয়ে পূর্বাভিমুখে প্রস্থিত হলেন।
আচার্য্য শঙ্কর পূর্বাভিমুখ আসতে আসতে ক্রমে জ্বালামুখী তীর্থে জ্যোতির্ময়ী দেবীদর্শন করে পূণ্যতীর্থ হরিদ্বার এসে উপস্থিত হলেন। হরিদ্বার বাসীগণ শিবাবতার জ্ঞানে আচার্য্যের পদধূলি নিতে লাগলেন। জয় জয় শঙ্কর হর হর শঙ্কর ধ্বনিতে হরিদ্বার প্রকম্পিত হল।
'নৈমিষারণ্যে
আচার্য্য শঙ্কর'
আচার্য্য এই হরিদ্বারে গঙ্গা অতিক্রম করে হিমালয়ের পাদদেশস্থ জনপদসমূহের মধ্য দিয়ে পথ চলতে চলতে শৌনকাদি ঋষির সেই পুরাণবর্ণিত স্থান নৈমিষারণ্যে এসে উপস্থিত হলেন। এখানে বহুতীর্থপর্যটন করলেন। বৌদ্ধপ্রভাবে এ অঞ্চলে আর যজ্ঞধূমের পবিত্রগন্ধে চারদিকে আমোদিত করে না, বেদধ্বনি আর চারদিকে মুখরিত হয় না। বুদ্ধদেব যে জ্ঞানকাণ্ডের প্রচার করেছেন, তাহা গ্রহণে অসমর্থ হয়ে লোকে উপাসনাকাণ্ডের আশ্রয়গ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে ভ্রষ্ট তান্ত্রিক আচারে পরিণত হয়। আচার্য্য এখানে সঠিক জ্ঞানকাণ্ড বেদান্তের প্রচার করলেন। কর্ম ও জ্ঞান সমুচ্চয়বাদ খণ্ডন করে জ্ঞানমার্গে সকলকে দীক্ষিত করে অযোধ্যাভিমুখে প্রস্থান করলেন।
'অযোধ্যা
ও মিথিলায় শঙ্কর'
অযোধ্যা
ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম ও লীলাভূমি। আচার্য্য ভগবৎলীলা স্থলগুলো একে একে দর্শন
করতে লাগলেন। এখানে বৌদ্ধগণ কিভাবে আর্য্যকীর্তি দমিত করে নিজপ্রভাব বিস্তৃত করেছিলেন
এবং তৎপরে শুঙ্গ ও কণ্ববংশীয় রাজগণ এবং উজ্জয়িনীর বিক্রমাদিত্য রাজ কিভাবে তাহার প্রতিবিধান
চেষ্টা করেছিলেন, সেসকলই আচার্য্যের চিত্ত আকর্ষণ করল। তথাপি এখানে বৌদ্ধপ্রভাব ছিল।
তবে বৌদ্ধগণ আর বিচারে প্রবৃত্ত হলেন না। আচার্য্য শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থানে ভগবৎবিগ্রহ
যথাবিধি পূজা করলেন এবং সুলোলিত স্তব রচনা করলেন যা 'শ্রীরামভুজঙ্গস্তোত্র'
নামে বর্তমানে প্রসিদ্ধ। এখানে ভগবানের সেবক বেশিরভাগই বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী। তাঁরা আচার্য্য
শঙ্করের শ্রুতিসিদ্ধ গুরুপরম্পরার অদ্বৈতব্রহ্মজ্ঞান আর চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত নিষ্কাম
কর্ম ও অহৈতুকী ভগবৎভক্তির সাথে পুনঃ পরিচিত হয়ে ধন্য হলেন এবং নিজেদের ভ্রান্ত ধারণা
পরিত্যাগ করলেন।
শ্রীভগবান
রামচন্দ্রের রাজ্য পরিত্যাগ করে আচার্য্য ক্রমে রাজর্ষি জনকের বিদেহ রাজ্যে প্রবেশ
করলেন এবং পথিমধ্যে তীর্থাদি পর্যটন করে মিথিলা নগরীতে এসে উপস্থিত হলেন। যেখানে মহর্ষি
গৌতম ন্যায়শাস্ত্র প্রচার করেছিলেন, যেখানে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য অদ্বৈতজ্ঞান বিতরণ করেছিলেন,
যেখানে শুকদেব জনকের নিকট অধ্যাত্মশাস্ত্রের শেষ উপদেশ লাভ করেছিলেন, অষ্টাবক্রমুনির
অদ্বৈতজ্ঞান প্রচার করেছিলেন, আচার্য্য আজ সেইস্থানে এসে এইসব ব্যাপার দিব্যচক্ষে দেখতে
লাগলেন।
এসময় মিথিলায় স্বাধীন বা কোন প্রবল রাজা ছিল না। কিছুদিন ইহা কখন লিচ্ছবীবংশীয় রাজগণের পদানত, কখনও বা মগধের অধীন, আবার কখনওবা গৌড়াধীপের করায়ত্ত ছিল। অল্পদিনপূর্বে কর্ণসুবর্ণের রজা শশাঙ্ক নরেন্দ্রবর্মন ইহার উপর আধিপত্য বিস্তার করেছেন। এখানে বৌদ্ধপ্রভাবে তান্ত্রিকতার প্রাধান্য হলেও মীমাংসক ও নৈয়ায়িকগণ নিজ নিজ শাস্ত্রীয় চিন্তায় ব্যাপৃত রয়েছেন। বেদবিরোধী ও নাস্তিকমতসমূহের বিরুদ্ধে মহর্ষি গৌতম যে ন্যায়শাস্ত্র রচনা করেন, বৌদ্ধপ্রভাবে তা ম্রিয়মান হলে মহর্ষি বাৎস্যায়ণ তা নিবারণ করেন। বহুপরে বসুবন্ধুশিষ্য বৌদ্ধ দিঙ্নাগ্ তাতে দোষারোপ করলে পাশুপাতাচার্য উদ্যোতকর অবিলম্বে তার উদ্ধার সাধন করেন। এক্ষণে দিঙ্নাগশিষ্য শঙ্করস্বামী, ধর্মপাল ও কর্মকীর্তি প্রভৃতি তাতে পূনরায় আবার আপত্তি করায় মিথিলার পণ্ডিতকূল তার উত্তর নির্ণয়ের জন্য সমাহিত। যা প্রায় তিনশতবৎসর পরে বাচস্পতিমিশ্রের লেখনীনিঃসৃত হবে এবং তৎপরে উদয়ন ও গঙ্গশাদির গ্রন্থে পূর্ণতা প্রাপ্ত হবে, মিথিলার পণ্ডিতকূল আজ সেই চিন্তার বীজ সংগ্রহ করছিলেন। ঐদিক বৈশেষিক সম্প্রদায়ও নিরব নন, প্রশস্তপাদের ভাষ্যাবলম্বনে ব্যোমশিব প্রভৃতি যেরূপ সপ্তপদার্থমূলক জ্ঞান ও বিচারপদ্ধতি প্রচার করেছেন তাঁর সহিত ন্যায়ের সংমিশ্রণচিন্তাও এইসময় এইসকল পণ্ডিতকূলের মনে উদিত হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধ, জৈন ও মীমাংসকগণের বিচার পদ্ধতি আত্মসাৎ করে আত্মপুষ্টির চেষ্টা চলছিল। এর মধ্যে এই সময় শঙ্করাবির্ভাব সে স্থানে আলোড়ন সৃষ্টি হল। আচার্য্য পণ্ডিতমণ্ডলীর এইরূপ উদ্যম দেখে বেদান্তের সিদ্ধান্ত এবং বিচার পদ্ধতি তাঁদের সামনে উপস্থাপন করলেন। তাঁরা ইহার উপযোগিতা এবং উপাদেয়তা অনুভব করে অবনতমস্তকে ইহা গ্রহণ করলেন। সকলেই বৌদ্ধতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছেড়ে আবার বৈদিকমার্গ অবলম্বন করলেন। তৎপরে আচার্য্য মগধে প্রবেশ করে মহারাজ বিষ্ণুগুপ্তের অভ্যর্থনা গ্রহণ করে দক্ষিণাভিমুখে বৌদ্ধগণের স্থান নালন্দায় এসে উপস্থিত হলেন। বিনীতদেব, চন্দ্রগোমিন, চন্দ্রকীর্তি, রবিগুপ্ত, শান্তরক্ষিত প্রভৃতি বৌদ্ধ পণ্ডিত তথায় বাস করতেন। আচার্য্যের দিগ্বিজয় বিশ্রুত হয়ে বৌদ্ধগণ আর বিচারার্থী হলেন না। এখানে আচার্য্য অদ্বৈতব্রহ্মজ্ঞান প্রচার করে গয়াভিমুখে যাত্রা করলেন।
'গয়াধামে
শঙ্কর'
আচার্য্য
শঙ্কর ভারতের প্রাচীন পিতৃতীর্থ গয়াধামে এসে উপস্থিত হলেন। গয়ার নিকটবর্তী বুদ্ধগয়ায়
বুদ্ধদেব নির্বাণ লাভ করেছিলেন। সম্রাট অশোক এখানে একটি বিশাল মন্দির নির্মাণ করে বুদ্ধদেবের
মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বুদ্ধগয়া কালক্রমে সমগ্র ভারতের বৌদ্ধসমাজের পবিত্র
তীর্থে পরিণত হয়। বুদ্ধগয়াকে কেন্দ্র করেই রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম সারা ভারতে
প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। আচার্য্য শঙ্করের আগমনকালেও এখানে বৌদ্ধদের প্রভাব প্রতিপত্তি
যথেষ্ট ছিল। বুদ্ধমন্দিরে প্রবেশ করে আচার্য্য ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের অন্যতম অবতাররূপে
বুদ্ধদেবের বন্দনা করলেন।
গয়াবাসী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সঙ্গে আচার্য্যের আলোচনার ফলস্বরূপ তাঁরা হিন্দুসমাজে ভগবান বিষ্ণুর অবতাররূপে বুদ্ধদেবের পূজার প্রচলন করেন। তাছাড়া আচার্য্য শঙ্কর ভগবান বিষ্ণুর যে 'দশাবতার স্তোত্রম্' রচনা করেছিলেন, তাতে ভগবান বুদ্ধেরও স্থান ছিল। হিন্দু দেবদেবীর সঙ্গে ঘরে ঘরে বুদ্ধদেবের মূর্তিও পূজিত হতে লাগলো। অন্যদিকে বৌদ্ধ জনসাধারণ স্বধর্ম ত্যাগ না করেও ক্রমশঃ নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিতে লাগলেন। জনমানসের উপর ক্রমে বৌদ্ধধর্মের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে আসতে লাগলো। গয়াবাসী ব্রাহ্মণগণের মধ্যে কপিল ও দত্তাত্রেয় সম্প্রদায়ের প্রাধান্য বেশি ছিল। তাঁরা আচার্য্যের উপদেশ শুনে এতটাই উৎফুল্ল হলেন যে তাঁরা মহর্ষি কপিল ও দত্তাত্রেয়ের চরণচিহ্নের পার্শ্বে আচার্য্য শঙ্করের চরণচিহ্ন স্থাপন করে পূজা করতে লাগলেন। ধর্মপদে ভগবান সিদ্ধার্থ গৌতমবুদ্ধ বলেছেন, ‘বৈরিতার দ্বারা বৈরিতা, শত্রুতার দ্বারা শত্রুতা কখনো প্রশমিত হয় না, অবৈরিতা ও মৈত্রীর দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়’- বুদ্ধের এই উপদেশই আজ ভগবান শঙ্করাচার্য্য কর্তৃক কার্যতঃ অনুষ্ঠিত হল।
'বঙ্গদেশে
আচার্য শঙ্কর'
গয়াধামে অবস্থিতিকালে আচার্য বঙ্গদেশে বৈদিকধর্মের দুরবস্থার কথা বিশেষরূপে শুনিলেন। শুনিলেন—বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধপ্রভাবাপন্ন তান্ত্রিকতাই প্রায় সর্বত্র প্রবল। শৈব ও শাক্তধর্ম স্থলে স্থকর প্রবল হইলেও তাহা বিকৃত। বেদ কাহাকে বলে—তাহা স্থানে স্থানে দুই চারিটি পণ্ডিতই কেবল জানেন, তাহাও অধ্যয়ন অধ্যাপনা করা হয় না। জনসাধারণ বুদ্ধিমান কিন্তু শাস্ত্র ও আচার্যাভাবে বৌদ্ধাদি শাস্ত্রে কৃতবিদ্য। ইহা শুনিয়া আচার্য বলিলেন “পদ্মপাদ! তাহা হইলে এ দেশেও একবার যাওয়া আবশ্যক। পদ্মপাদ তো এ বিষয়ে সততই উদ্যত। সুতরাং গয়াধাম পরিত্যাগ করিয়া আচার্য তাঁহার দিগ্বিজয়বাহিনীসহ বঙ্গদেশাভিমুখে অগ্রসর হইলেন। এ সময় বঙ্গদেশের দক্ষিণপশ্চিমে তাম্রলিপ্ত, পূর্বদক্ষিণে সমতট, উত্তরপশ্চিমে গৌড় এবং উত্তরপূর্বে পৌণ্ড্রবর্ধন প্রদেশ বিশেষ সমৃদ্ধিশালী ছিল।
তাম্রলিপ্ত
গঙ্গানদীর শাখা রূপনারায়ণ নদীর তীরে অবস্থিত। বিষ্ণুর কালীরূপ ধারণ করিয়া অসুরবধকালে
এইস্থানে ঘর্মবিন্দু পতিত হয়। তদবধি ইহা পবিত্র তীর্থরূপে পরিগণিত হয়। এখানে কালী
ও জিষ্ণুহরির মূর্তি পূজিত হইয়া আসিতেছেন। এতদ্ব্যতীত বাণিজ্যের জন্য এই স্থানটি এ
দিকের মধ্যে অতি প্রসিদ্ধ। বৌদ্ধগণের বিহারাদি যথেষ্ট পরিমাণে বর্তমান।
আচার্য
গয়াধাম হইতে পূর্বাভিমুখে বিরাটরাজের গোগৃহপ্রভৃতি নানা স্থানের মধ্য দিয়া ক্রমে
এই তাম্রলিপ্ত নগরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং জনসাধারণের মধ্যে বৈদিকধর্মের উচ্চ আদর্শ
প্রচার করিলেন। বৌদ্ধপ্রভাব সত্ত্বেও ইহার ফলে এতদ্দেশবাসী অনেকে আবার বৈদিকধর্মানুরাগী
হইলেন।
তাম্রলিপ্ত পরিত্যাগ করিয়া আচার্য ভাগীরথী পার হইয়া সমতটের অভিমূখে অগ্রসর হইলেন। এখানে তখন বৌদ্ধ ও জৈনগণের বেশ প্রভাব বিদ্যমান। পৌরাণিক তীর্থের মধ্যে এখানে এখন লাঙ্গলবন্ধ, পঞ্চমীঘাট, পরশুরামতলা এবং ত্রিবেণী প্রসিদ্ধ। এখানেই বৈদিক বা পৌরাণিক ধর্মের চিহ্ন কিঞ্চিৎ বিদ্যমান।
লাঙ্গলবন্ধে
বলরাম লাঙ্গলদ্বারা ব্রহ্মপুত্রকে এই স্থান পর্যন্ত আনিবার পর তাঁহার লাঙ্গল আবদ্ধ
হইয়া যায়। এখানে কালী ও অন্নপূর্ণারও পূজা হয়। পঞ্চমীঘাটে পাণ্ডবগণ বনবাসকালে যখন
লৌহিত্যতীর্থ দর্শন করিতে যান, তখন স্নান অর্চনাদি করিয়াছিলেন।
পরশুরামতলা পরশুরামের বিশ্রামস্থান বলিয়া প্রসিদ্ধ। ত্রিবেণী–মেঘনাদ, ধলেশ্বরী ও লাক্ষানদীর সঙ্গমস্থল। ইহা যযাতি রাজার ষষ্ঠপুত্র্য দ্রুহ্য রাজার রাজধানী ছিল। রামপাল এ সময় এই সমতটের রাজধানী। মহারাজ আদিশূর এ দেশের এখন রাজা। আচার্য এখানে আসিয়া বৈদিকধর্ম প্রচার করিলে জনসাধারণকে বেদপ্রামাণ্যে শ্রদ্ধান্বিত করিলেন। মহারাজ আদিশূর বেদান্তসিদ্ধান্ত শ্রবণ করিয়া তাহার উপাদেয়তা এতই হৃদয়ঙ্গম করিলেন যে পরে কান্যকুব্জ হইতে সদ্ ব্রাহ্মণ আনাইয়া দেশে আবার বৈদিক ক্রিয়াকলাপের প্রবর্তনে বদ্ধপরিকর হইলেন।
সমতট পরিত্যাগ করিয়া উত্তরদিকে আচার্য ক্রমে ঢবাক্ প্রদেশে আসিলেন। এখানেও বৌদ্ধ ও জৈনগণের প্রভাব যথেষ্ট দেখিলেন। শুনিলেন—– এই প্রদেশ হইতে শীলভদ্রের ন্যায় অনেক বৌদ্ধাচার্যের আবির্ভাব হইয়াছে এবং তখনও বৌদ্ধশাস্ত্রে পণ্ডিতগণ অপ্রচুর নহে। কিন্তু আচার্যের ভাষ্য ব্যাখ্যাদি শুনিয়া সকলেই বিস্মিত হইলেন। এতদিন এ জাতীয় কথা ইহাদের কর্ণগোচর হয় নাই। অগত্যা বৌদ্ধধর্মই ইহাদের অবলম্বন হইয়াছিল। এক্ষণে আচার্য-সম্প্রদায়ের আচারব্যবহার ও উপদেশাদি শ্রবণ করিয়া ইঁহারা সকলেই বৈদিক ধর্মে আস্থাসম্পন্ন হইলেন। পঞ্চদেবতার পূজা ও পঞ্চমহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান আবার আরম্ভ হইল। অনন্তর আচার্য এখানে ব্রহ্মপুত্র নদতীরে সাধারণ জনগণের আগ্রহে একটি বিশ্বনাথ শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করিয়া স্থানীয় তীর্থসমূহ দর্শন করিতে করিতে কামরূপ যাত্রা করিলেন।
'কামরূপ
কামাক্ষ্যায় শঙ্কর'
অতঃপর আচার্য্য শঙ্কর প্রাগ্জ্যোতিষপুর এবং আসামে বৈদিকধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেন। কামরূপকে কেন্দ্রকরে সমগ্র আসামে তখন তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মের ব্যাপক প্রচলন ছিল। তান্ত্রিকগুরুদের অনেকেই মারণ, উচাটন, বশীকরণ ইত্যাদি নানা অলৌকিক সিদ্ধাইয়ের অধিকারী ছিলেন। মারণ, উচাটন, বশীকরণাদি তান্ত্রিক ক্রিয়ায় সিদ্ধ হওয়ার অভিলাষে ভারতের নানা স্থান হতে বহু তন্ত্রসাধক কামরূপে উপস্থিত হতেন এবং স্থানীয় তান্ত্রিক-গুরুর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করে ঐ সকল বিদ্যা অভ্যাস করতেন।
তান্ত্রিক
ক্রিয়ায় পারদর্শী হয়ে তাঁরা নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়ে তন্ত্রগুরু সেজে তান্ত্রিক ক্রিয়াকাণ্ড
প্রচার করতেন।তৎকালে ভারতের নানা অঞ্চলে তন্ত্রসাধন একটা বিশিষ্ট সাধন-প্রণালী হিসাবে
স্বীকৃত ছিল। চৈতন্যের জাগরণ এবং জীব-মুক্তি তন্ত্রসাধনার আসল লক্ষ্য হলেও অধিকাংশ
ক্ষেত্রে তন্ত্র-সাধকগণ অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐ সাধনায় আত্মনিয়োগ
করতেন। যাইহোক, আচার্য্য তাঁর ভক্ত শিষ্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে প্রাগ্জ্যোতিষপুরের
নিকটবর্তী হলে কামরূপের রাজা তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন।
সশিষ্য
আচার্য্য শৈলোপরি কামাখ্যা-মন্দিরে প্রবেশ করে বহুক্ষণ ধ্যানমগ্ন রইলেন। সৌম্য আচার্য্যের
ধ্যানী মূর্তি দর্শণ করে এবং তাঁর মুখে অদ্বৈত-বেদান্তের কথা শুনে শত শত ধর্মানুরাগী
মানুষ তাঁর প্রতি অনুরক্ত হলেন।
পক্ষান্তরে
জনমানসের উপর আচার্য্যের ক্রমবর্ধমান প্রভাব লক্ষ্য করে কামরূপের তান্ত্রিকসমাজ চঞ্চল
হয়ে উঠলেন। তাঁরা ভাবলেন—এই প্রতিভাবান তরুণ সন্ন্যাসীর বেদান্ত প্রচার অব্যাহত থাকলে
তন্ত্রমতের সর্বনাশ ঘটবে।
তান্ত্রিক
গুরুগণ নিজেদের মধ্যে সলাপরামর্শ করে তন্ত্রগুরু অভিনব গুপ্তের নেতৃত্বে বিচারপ্রার্থী
হয়ে আচার্য্যের নিকট উপস্থিত হলেন। অভিনব গুপ্ত ছিলেন বিভূতিসম্পন্ন শক্তিমান তান্ত্রিক।
তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতিও যথেষ্ট ছিল।ব্যাসদেবের ব্রহ্মসূত্রের একটি তন্ত্রভাষ্যও তিনি
রচনা করেছিলেন। কিন্তু আচার্য্য শঙ্করের অলোকসামান্য প্রতিভার নিকট হতমান হয়ে তিনি
আচার্য্যের প্রাণ নাশের জন্য কৃত-সংকল্প হলেন।
আচার্য্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রদর্শণ করে অভিনব গুপ্ত তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। নিষ্ঠা সহকারে গুরুসেবার সাথে সাথে তিনি আচার্য্যের উপর অভিচারক্রিয়া প্রয়োগ করতে লাগলেন।
'শঙ্করের
ভগন্দর রোগ উৎপত্তি ও শান্তি'
হিংসাত্মক
দৃষ্টি সম্পন্ন অভিনবগুপ্তের কপটভাবে অভিচারের কারণে শঙ্করের ভগন্দর রোগ হয়েছিল। সে সময় তোটক-গ্রন্থ-কর্তা গিরি যতি শঙ্কর গুরুর
পরিচর্যা করেছিলেন। শিষ্যবৃন্দ সকলে গুরুর স্বরূপ অবেক্ষণ করে জ্ঞাপন করলেন, স্বামিন!
দুরারোগ্য, আৰ্ত্তিকর এ রোগ উপেক্ষণীয় নয়। যদিচ শ্রীগুরুর এ কলেবরে অধ্যাস অর্থাৎ
দেহে আত্মস্বরূপ ভ্রম নেই, তথাপি আমাদের সুখার্থে ভেষজ বিধান করুন, এজন্য আমরা যত্ন
করি। গুরু শিষ্যগণের বিজ্ঞপ্তি শ্রবণ করে বৈরাগ্য-বিবেক-গর্ভিণী বাণী বললেন, এ পতনশীল
শরীর, কৰ্ম্মক্ষয়ে স্বয়ং পতিত হবে, তার অন্যথা নেই। অদ্যই বা, কল্পান্তে বা নিপতিত
হোক, তাতে আমার কোন বৃদ্ধি ক্ষতি নেই। কোথা আমি নিত্য চিদানন্দ, আর কোথা এ তুচ্ছ কলেবর,
ইহাতে স্বার্থ ও প্রয়োজনাভাব, যেহেতু আমি সদা অসঙ্গাদ্বয়াত্মা তোমাদের ও শরীরে আগ্রহ
কৰ্ত্তব্য নয়। শিষ্যবৃন্দ এ প্রকার লোকশিক্ষার্থযুক্ত গুরূক্তি শ্রুত হয়ে পুনর্বার
ভক্তিবিনয়-সহ নিবেদন করলেন, স্বামিন্! সত্য বটে আপনার শরীর পরিরক্ষণে লাভ নেই,কিন্তু
আপনার জীবন আমাদের জন্য মূল্যবান, এ হেতু শরীর-স্বাচ্ছন্দ্য জন্য আমরা যত্ন করব। শিষ্যগণ
নানা প্রকার বাক্যে হঠপূর্বক আচার্য্যের অনুজ্ঞা লাভ করে,সকলে বিচক্ষণ চিকিৎসকগণ আনয়নার্থ
রাজ-ভবনে গমন করলেন।
রাজার নিকট বিবরণ জ্ঞাপন করে ভূপতির অনুমতিক্রমে বিলক্ষণ বিচক্ষণ চিকিৎসাকুশল ভিষকগণকে নিয়ে আচার্য্যের নিকট প্রত্যাগত হলেন। অতি দক্ষ শ্রেষ্ঠ ভিষকবৃন্দ অনেক সুকৌশল সহকারে নানাবিধ সৎক্রিয়া করলেন, কিন্তু সে সকল রোগবিয়োগের কিছুমাত্র কার্যকর হল না। ব্যাধির অণুমাত্র উপশম উপলব্ধি না হওয়ায় তাঁরা তুষ্ণীস্তাব অবলম্বন করলেন, এবং অন্যান্য বৈদ্যগণ সমাগত ও গত হলেন, কিন্তু রুগ্নতা গত হল না। মুনিবরের শারীরিক মমতা অভাব জন্য দুঃখ ছিল না, শিষ্যগণের রোগ শান্তি বিষয়ে বিশেষরূপ যত্ন অবেক্ষণ করিয়া অশ্বিনীকুমারদ্বয় সমাগত হয়ে আচাৰ্য্যকে যুক্তিযুক্ত বাক্য বললেন, এ রোগ অভিচারে উৎপন্ন হয়েছে, ইহা পরকার্য্যকৃত, ইহা বলে গমন করলেন। তখন আজানসিদ্ধ সনন্দন গুরুর ক্লেশ পরকৃত্য শ্রবণ করে গুরুর রোগ নিবারণে সিদ্ধমন্ত্র জপ করতে প্রবৃত্ত হলেন। মন্ত্রজপ প্রভাবে তৎক্ষণে স্বামির রোগ কৃত্য সহ তৎ কৰ্ত্তাতে প্রতিগত হল, তাতে অভিনবগুপ্ত মৃত্যুমুখে প্রবেশ করল। মহতের প্রতি বুদ্ধিপূর্বক কৃত দোষ সুখের নিমিত্ত হয় না। ভাষ্যকার আরোগ্যপ্রাপ্ত ও সুস্থ হয়ে পরব্রহ্মাত্মধ্যানে একাগ্রস্থিত হলেন, যদিচ উহার ধ্যান সমাধি আদি কোন কৰ্ম্ম ছিল না, তথাচ লোকসংগ্রহ ও শিক্ষাজন্য সকল করতেন। শঙ্করের অভিচার জন্য রোগোৎপত্তি বিষয়ে অনেকের আশঙ্কা হতে পারে, শিবশরীরে কি রূপে অভিচার উপগত হল? ইহাতে ধীরগণের সিদ্ধান্ত এই যে, আগমে (তন্ত্রে) অভিচারাদি শিবোক্ত, স্বীয় বাক্য ও শাস্ত্র রক্ষার্থে স্বয়ং তা গ্রহণ করেছিলেন।
আনন্দে
উৎফুল্ল শিষ্যগণ আচার্য্যকে ঘিরে বসে তাঁর কথামৃত শুনছেন—এমন সময় একজন এসে সংবাদ দিলেন
অভিনব গুপ্তের দেহান্ত ঘটেছে।অভিনব গুপ্তের মৃত্যুসংবাদ শুনে আচার্য্য দুঃখ প্রকাশ
করতে লাগলেন। উপরোক্ত ঘটনায় কামাখ্যাবাসী তান্ত্রিকগণ ভীত হয়ে পড়লেন। অনেকে আচার্য্যের
নিকট উপদেশ-প্রার্থী হয়ে এলেন।
আচার্য্য তাঁদের তন্ত্রমতে নিষ্কাম ভাবে দেবী কামাখ্যার উপাসনার উপদেশ দিলেন। বললেন—নিষ্কাম উপাসনায় দেবী প্রসন্ন হন। তাঁর কৃপায় সাধকের চিত্ত নির্মল হয়। নির্মল চিত্তে চৈতন্যের জাগরণ ঘটে। ক্রমশঃ সাধক ব্রহ্মাত্মবোধের অধিকারী হন এবং তাঁর মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে। সকাম সাধকদের চিত্তশুদ্ধির জন্য ফলাকাঙ্খাহীন কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন আছে।
'গৌড়দেশে মুরারীমিশ্রের সঙ্গে শাস্ত্রবিচার'
সম্পূর্ণ
সুস্থ হয়ে আচার্য্য শঙ্কর পুনরায় গৌড়ের (উত্তর বঙ্গ) উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। গৌড়ের
মীমাংসক-প্রধান মুরারী মিশ্র এবং ধর্মগুপ্তের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি আচার্য্য শুনেছিলেন।
তাঁরাও আচার্য্যের আগমন সংবাদ পেয়ে উৎসাহিত ছিলেন। মীমাংসক-শ্রেষ্ঠ মণ্ডন মিশ্র আচার্য্যের
সঙ্গে আসছেন জেনে তাঁরা বিচারপ্রার্থী হতে সাহসী হলেন না। মুরারী মিশ্র একদিন আচার্য্যের নিকট উপস্থিত হয়ে
বেদান্ত সিদ্ধান্ত ও মীমাংসা সিদ্ধান্তের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের বিষয়ে জানতে
চাইলেন।
জিজ্ঞাসিত হয়ে আচার্য্য বললেন-পুণ্যকর্মের ফলে স্বর্গাদি লোকপ্রাপ্তি যেহেতু অনিত্য, সেই হেতু কর্ম মোক্ষের কারণ হতে পারে না। অদ্বৈত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাধক স্বীয় ব্রহ্ম-স্বরূপে লীন হয়ে মোক্ষ প্রাপ্ত হন। আচার্য্যের যুক্তির সারবত্তা হৃদরঙ্গম করে মুরারী মিশ্র তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আচার্য্যের প্রচারে প্রভাবিত হয়ে এই অঞ্চলের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের অনেকেই বেদান্তের জ্ঞানমার্গের অনুবর্তী হয়েছিলেন। স্থানীয় জনসাধারণ বৈদিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহী হন। আচার্য্যের প্রচেষ্টায় পঞ্চ দেবতার পূজা এবং পঞ্চ যজ্ঞের অনুষ্ঠান বাঙ্গালী সমাজে প্রচলিত হয়।
তৎসময়ে বিখ্যাত ন্যায়শাস্ত্র-বেত্তাগণের শ্রেষ্ঠ উদ্দয়নাভিধেয়কে বেদসিদ্ধান্ত দ্বারা জয় করলে তিনি বশী হলেন, এবং নানাশাস্ত্র-বিশারদ মিশ্রধৰ্ম্ম গুপ্তাখ্যকে জিত করে শঙ্কর অমরকীৰ্ত্তি লাভ করলেন, এবং নানা প্রকার উপাসক যাঁরা স্ব স্ব উপাস্য দেবতাতে ব্ৰহ্মত্ব প্রতিপাদন ও নিশ্চয় করেছিলেন এবং অন্যান্য স্বমতশ্রেষ্ঠ নিশ্চয়ী, যাঁরা শ্রুতির তাৎপৰ্য্য কল্পিত মতে সংস্থাপন করেছিল,শ্ৰীশঙ্করাচার্যের সমীপে সমাগত হয়ে বাদে পরাজিত হলেন, এবং শঙ্করের চরণে শরণ গ্রহণ করলেন। যেমত সহস্ররশ্মি প্রভাকরের উদয়ে নক্ষত্রমণ্ডল অদর্শন হয় সেরূপ লোকশঙ্কর শাঙ্করমত প্রকাশে নানাবিধ সমস্ত মত এককালে বিলুপ্ত হল ইহা সত্য, সত্যপ্রভা প্রদীপ্ত হলে অসত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সমর্থ হয় না। যদি মহেশ্বর বেদান্ত-সিদ্ধান্ত-মার্গ প্রচার করতে শঙ্করাচাৰ্য্য নামে অবনিমগুলে অবতরণ না করতেন, তবে ইহলোকে পাষণ্ডমার্গে গমন করে সমস্ত মানব বিনষ্ট হত।
'গৌরপাদ
স্বামির সমাগম ও সম্বাদ'
গৌঢ়ের
বিভিন্ন স্থানে প্রচার করতে করতে একদিন আচার্য্য শঙ্কর শিষ্যদের নিয়ে গঙ্গাতীরে উপস্থিত
হন। এক সময় শ্ৰীশঙ্করাচার্য্য সুরতরঙ্গিণী তটে হৃদিস্থিত
ব্ৰহ্মাত্মধ্যানে নিরত ছিলেন, এমত সময়ে গৌরপাদ স্বামিকে আকাশপথে অবতরণ করতে অবলোকন
করলেন। শঙ্কর সত্বর প্রত্যুত্থিত হয়ে পরম গুরুকে প্রণাম
করে কৃতাঞ্জলিবদ্ধ অগ্ৰে স্থিত হলেন। গৌরপাদ স্বামী বিদ্যা-বিনয়সম্পন্ন লোকশঙ্কর শঙ্করকে
সমবেক্ষণ করে তাঁকে কুশল বাক্য বললেন, শঙ্কর! তুমি সশিষ্য কুশল তো? তুমি গোবিন্দ নাথ
হতে কোন সদ্বিদ্যা প্রাপ্ত হয়েছ? কখন সংসার সন্তাপে উদ্বেগ প্রাপ্ত হয়ে নির্গত হয়েছে?
তুমি কখন বৈরাগ্যাশ্রয়ে গুরুর নিকট অভিগত হয়েছ? কায়মনোবাক্য এবং কৰ্ম্ম দ্বারা তাঁদের
শুশ্রুষা করেছ? বৎস,বেদ্যসার সচ্চিদানন্দ কখন বিজ্ঞাত হয়েছে? অখণ্ডাত্মাতে কোন সন্নিষ্ঠা
লাভ করেছ? দুঃখদায়ক কাম ক্রোধাদি অরাতিগণ জিত হয়েছে? কখন সুখপ্রদ শমদমাদি সদগুণ লব্ধ
হয়েছ? কোন যোগ সংসাধিত ও চিত্ত স্থিরীকৃত হয়েছে, ও তোমার শ্রদ্ধানুশান্ত দাস্য শিষ্যগণ পর্যুপাসনা করছেন?
অদ্বৈতনিষ্ঠ সৰ্ব্বলোকহিতৈষী প্রেমদয়াদ্র চিত্ত গৌরপাদ কর্তৃক শঙ্কর এ প্রকার অভিহিত হয়ে শ্রদ্ধাভক্তিপুরঃসর বললেন, ভগবন! আপনি করুণাসিন্ধু, সদগুরু ব্রহ্মদেশিক, যা যা জিজ্ঞাসা করলেন, তা সমস্ত সুসম্পাদিত হবে, কৃপাসিন্ধু গুরু প্রাপ্ত হলে মানবগণের কি দুর্লভ হয়? গুরুর অখিল মহিমা বর্ণন করতে কোন ব্যক্তি সমুৎসাহী হতে পারে? অতএব স্বামির চরণযুগলে সৰ্ব্বদা প্ৰণিপাত করি। আমার কি। ভাগ্য, যে শ্ৰীগুরু দর্শন হল। গৌরপাদ স্বামী শঙ্করের এই প্রকার বিনয়গর্ভিণী বাণী শ্রবণ করযে বললেন, শঙ্কর! তোমার গুণসন্দোহের সৌন্দর্য্য ও নিৰ্ম্মলতা শ্রবণ করে আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। গোবিন্দমুখে শ্রবণ করেছি, তুমি ভাষ্য নিবন্ধ করেছ। পূর্বে মৎকর্তৃক মাণ্ডুক্যকারিকা কৃত হয়েছে, তাতে তুমি ভাষ্য করেছ, ইহা শ্রত হয়ে তা শ্রবণ করতে এসেছি। শঙ্কর সদগরু গৌরপাদের এরূপ কৃপাপ্রকাশ বাক্য শ্রবণ কর হৰ্ষসম্পন্ন-চিত্তে মাণ্ডুক্য-বাৰ্ত্তিকে কৃত ভাষ্য সত্বর আনয়ন করতঃ শ্রবণ করালেন, তথা ব্রহ্ম-সুত্র-গীতা উপনিষৎ সকল তত্তৎ-কৃত-ভাষ্য সম্যক শ্রবণ করিয়ে পুনৰ্ব্বার মাওক্যে কৃত ভাষ্য শ্রুতিগোচর করালেন। সমস্ত ভাষ্য বিশেষ মাণ্ডুক্যভাষ্য শ্রবণ করে গৌরপাদ গুরু সীমাহীন হর্ষান্বিত হয়ে শঙ্করকে কহিলেন, আমার কারিকার আশয়যুক্ত ভাষ্য অদ্ভুক্তরূপ শ্রত হইবায় অমিত আনন্দ লাভ হল, তুমি সত্বর বর গ্রহণ কর আমি প্রসন্ন মনে প্রদান করছি। ভাষ্যকার গুরুবাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন,স্বামিন আপনি অদ্বৈতাচাৰ্য্য গুরু আপনার শ্রীচরণ দর্শন করলাম, ইহার পর আর বর কি আছে? যদি বর দেযন, তবে এই দেন যে শুদ্ধ আত্মাতে আমার মন যেন সদা নিমগ্ন থাকে। গৌরপাদ তথাস্তু বলে অন্তর্হিত হলেন। শঙ্কর স্বামী গুরুর সহিত কৃতসংবাদ শিষ্যগণকে শ্রবণ করালেন, ইহাতে নিশি ব্যতিত হল। প্রাতে উত্থান করে সশিষ্য গঙ্গাসলিলে অবগাহন করলেন, এবং মহামনা ভাষ্যকার একান্তে পরব্রহ্ম নিদিধ্যাসন লালসাতে সুস্থিরমানস জাহ্লবীতীরে উপবিষ্ট হলেন।
'নেপালের
প্রসিদ্ধ পশুপতিনাথ মন্দিরে শঙ্কর'
আচার্য্য
শুনেছিলেন-বৌদ্ধ-প্রাধান্যের ফলে নেপালের প্রাচীন পশুপতিনাথের মন্দির অবহেলায় পরিত্যক্ত
অবস্থায় আছে। তিনি নেপালে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। স্বাপদ-সংকুল বনভূমি এবং দুর্লঙ্ঘ
পর্বতমালা অতিক্রম করে আচার্য্য নেপালে উপস্থিত হলেন। নেপালের হিন্দুরাজা সশিষ্য আচার্য্যকে সসম্মানে
অভ্যর্থনা জানালেন। অনুপম প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত পার্বত্যভূমির শান্ত নির্জন পরিবেশ
আচার্য্যের মনকে স্পর্শ করলো। তিনি বিশ্রাম না করেই পশুপতিনাথের মন্দিরের উদ্দেশ্য
রওনা হলেন। দীপ্তিমান সন্ন্যাসীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে শত শত নরনারী তাঁকে অনুসরণ করে মন্দির-প্রাঙ্গনে
সমবেত হলেন।
সংস্কারের
অভাবে জীর্ণ মন্দির এবং অপরিচ্ছন্ন মন্দিরপ্রাঙ্গন দেখে আচার্য্য মর্মবেদনা অনুভব করলেন।
আচার্য্য শিষ্যদের নির্দেশ দিলেন—মন্দির এবং মন্দিরপ্রাঙ্গন পরিস্কার করে পূজার আয়োজন
করার। আচার্য্য মন্দিরে প্রবেশ করে পশুপতিনাথের উদ্দেশ্যে
স্তব করলেন। তারপর ধ্যানে মগ্ন হলেন। এদিকে ব্রাহ্মণ শিষ্যগণ পশুপতিনাথের পূজায় রত হলেন।
আনন্দে উদ্বেলিত উপস্থিত দর্শনার্থীগন পশুপতিনাথের জয়-ধ্বনিতে মন্দির-প্রাঙ্গণ মুখরিত
করে তুললেন। পশুপতিনাথের পূজার পুনঃ প্রচলনের সংবাদ প্রচারিত
হওয়ায় নেপালের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ঘটতে লাগলো। আচার্য্য
মন্দিরপ্রাঙ্গণে অবস্থান করে সকলকে বেদান্তের মর্মবাণী শোনাতে লাগলেন। নেপালবাসীর আগ্রহে
আচার্য্যের শিষ্যগণ নেপালের নানা প্রান্তে গিয়ে বেদান্তের তাৎপর্য্য শোনাতে লাগলেন।
নেপালের
রাজা আচার্য্য শঙ্করের ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে অভিভূত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।
আচার্য্যের ইচ্ছানুযায়ী রাজঅর্থ ব্যয়ে নেপালের জীর্ণ মন্দির সমূহের সংস্কার এবং স্থানে
স্থানে দেবদেবীর নূতন মন্দির স্থাপিত হোল। রাজানুকূল্যে বেদ, উপনিষদাদির অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার
জন্য টোল চতুষ্পাঠী স্থাপিত হোল। কথিত আছে--আচার্য্য শঙ্করের আগমনে নেপালের বৌদ্ধ
ভিক্ষুগণ এতটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন এবং বিপন্নবোধ করেছিলেন যে তাঁরা নেপাল ত্যাগ করে
অন্যত্র চলে যান। প্রবাদ আছে—বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা সিদ্ধাই প্রয়োগ করে আচার্য্যের যাতায়াতের
পথে নানা দৈব-উৎপাত সৃষ্টি করে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। হিমালয়ের ধ্যানগম্ভীর পরিবেশ আচার্য্যকে গভীরভাবে
আত্মমগ্ন করে তুলেছিল। নেপাল হতে প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি এতটাই বাহ্য সম্বিতশূন্য
হয়ে চলছিলেন যে শিষ্যদের অতি সতর্কতার সঙ্গে তাঁর দেহকে রক্ষা করে চলতে হয়েছিল।
'শঙ্করের বদরী বনে গমন'
শ্ৰীশঙ্করাচার্য
কিয়ংকাল পার্বত্যপথ অতিক্রম করে অব্দ মধ্যে সশিষ্য বদরী কাননে যাত্রা করলেন।বদরিকার পথে আচার্য্য জ্যোতির্ধামে উপস্থিত হলেন।
অনেক দিন পরে গুরুদেবকে কাছে পেয়ে জ্যোতির্ধামের রাজা আনন্দে আত্মহারা হলেন। ইতিপূর্বে যাঁরা আচার্য্যের দর্শন পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন,
পুনরায় আচার্য্যকে পেয়ে তাঁরা বাঁধভাঙ্গা উদ্দীপনায় আচার্য্যের প্রচারকার্য্যে সহযোগিতা
করতে লাগলেন।জ্যোতির্ধাম আনন্দ-মুখরিত উৎসব-নগরীতে পরিণত হোল। এই প্রকার বহুল শুদ্ধ চরিত্র দ্বারা জগদগুরু শঙ্করের
বত্রিশ বর্ষ পূর্ণ হল। মহাগুরু গৌড়পাদের দর্শনলাভের পর হতে আচার্য্যের
অন্তর্মুখী মন সর্বদা সমাধিতে নিমগ্ন থাকতে চাইছিল। ক্রমশঃ অন্তর্মুখীনতা বৃদ্ধি পাওয়ায়
শিষ্যেরা আচার্য্যের মনকে কর্ম-ভূমিতে ধরে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন।
তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন--গুরুদেব স্ব-স্বরূপে লীন হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়েছেন।
আচার্য্য শঙ্কর একদিন চিন্তাভারাক্রান্ত শিষ্যদের ডেকে বললেন--এ দেহ ধারণের প্রয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছে। যে কাজ অবশিষ্ট আছে তা তোমরাই সম্পন্ন করবে। তোমাদের ভবিষ্যৎ করনীয় কর্ত্তব্য বিষয়ে আজ বলবো। তার আগে তোমাদের কারোর যদি কিছু জানার থাকে আমাকে জিজ্ঞাসা কর। পদ্মপাদ সজল নয়নে করজোড়ে বললেন--আপনার কৃপায় আমাদের জানার কিছু অবশিষ্ট নেই। আশীর্বাদ করুন--আমরা যেন আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আপনার আদর্শের পতাকা বহন করে চলতে পারি।আচার্য্য ক্ষণকাল মৌন থেকে অভয়বানী উচ্চারণ করলেন--তোমরা চিন্তা করো না। যাঁর ইচ্ছায় এ দেহের জন্ম হয়েছে, সেই বিরাট পুরুষের ইচ্ছাশক্তি তোমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যের পথে পরিচালিত করবে। আর্ত মানুষের বন্ধন-মোচনের উপায়স্বরূপ বেদান্তের আদর্শকে স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য ভারতের চার প্রান্তে চারটি মঠের স্থাপনা হবে।
দক্ষিণে
রাঁমেশ্বরের অন্তর্গত শৃঙ্গেরীতে ইতিমধ্যে একটা মঠ স্থাপিত হয়েছে। এই মঠের দায়িত্বে
থাকবে আচার্য্য সুরেশ্বর। পশ্চিমে দ্বারকায় সারদামঠের অধ্যক্ষ হবে আচার্য্য হস্তামলক।
পূর্বে পুরীধামে গোবর্ধন মঠের স্থাপনা এবং পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে আচার্য্য পদ্মপাদ।
উত্তরে জ্যোতির্ধামে জ্যোতিমঠের অধ্যক্ষ হবে আচার্য্য তোটক।
সারদা মঠে সামবেদ, গোবর্ধন মঠে ঋগ্বেদ, জ্যোতিমঠে অথর্ববেদ এবং শৃঙ্গেরীমঠে যজুর্বেদের প্রাধান্য থাকবে। সারদা মঠকে কেন্দ্র করে ‘তত্বমসি’, গোবর্ধন মঠকে কেন্দ্র করে ‘প্রজ্ঞানাং ব্রহ্ম’, জ্যোতি মঠকে কেন্দ্র করে ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ এবং শৃঙ্গেরী মঠকে কেন্দ্র করে ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’-বেদের এই চারটি মহাবাক্যের অনুশীলন এবং প্রচার চলবে। তোমরা দশটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত সন্ন্যাসীসংঘ গড়ে তুলবে। গিরি, পুরী, ভারতী, তীর্থ, বন, অরণ্য, পর্বত, আশ্রম, সাগর ও সরস্বতী এই হল বিশ্বগুরু শঙ্করাচার্য্য প্রতিষ্ঠিত দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়।
ভারতের পশ্চিমে পশ্চিমাম্নায় দ্বারকা সারদা মঠে গোমতী তীর্থ, দেবতা সিদ্ধেশ্বর, দেবী ভদ্রকালী। স্বরূপ ব্রহ্মচারী, তীর্থ আশ্রম নামা সন্ন্যাসী। কীটবার সম্প্রদায়, সামবেদ, তত্বমসি মহাবাক্য, অত্রি বা অবগত বা অবিগত গোত্র। শ্রীকুল, আম্নায়াধিষ্ঠাত্রী দেবী কুব্জিকা।
ভারতের পূর্বে পূর্বাম্নায় পুরী গোবর্ধন মঠ। মহোদধি তীর্থ, জগন্নাথ দেব, বিমলা দেবী। প্রকাশ ব্রহ্মচারী, বন অরণ্য নামা সন্ন্যাসী, ভোগবার সম্প্রদায়। ঋগ্বেদ। প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম মহাবাক্য, কাশ্যপ গোত্র। শ্রীকুল , আম্নায়াধিষ্ঠাত্রী দেবী ভুবনেশ্বরী।
ভারতের উত্তরে উত্তরাম্নায় বদ্রীনারায়ণ জ্যোতির্মঠ বা জোশি মঠ। আলকানন্দা তীর্থ, বদ্রীনারায়ণ দেবতা, পূর্ণাগিরি বা পুণ্যাগিরি দেবী, আনন্দ ব্রহ্মচারী, গিরি পর্বত সাগর নামা সন্ন্যাসী, আনন্দবার সম্প্রদায়, অথর্ববেদ, অয়মাত্মাব্রহ্ম মহাবাক্য, ভৃগু গোত্র। কালীকুল, আম্নায়াধিষ্ঠাত্রী দেবী গুহ্যকালী।
ভারতের দক্ষিণে
রামেশ্বরমে দক্ষিণাম্নায় শৃঙ্গেরী মঠ বা সারদা মঠ। তুঙ্গভদ্রা তীর্থ, আদিবরাহ দেব,
কামাক্ষী দেবী, চৈতন্য ব্রহ্মচারী, সরস্বতী ভারতী পুরী নামা সন্ন্যাসী, ভূরিবার
সম্প্রদায়, যজুর্বেদ, অহং ব্রহ্মাস্মি মহাবাক্য, ভূর্ভূব গোত্র। শ্রীকুল, আম্নায়াধিষ্ঠাত্রী
দেবী দক্ষিণাকালিকা।
পরবর্তীতে বৈদিকধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই চারটি মঠের অধীনে আরও অনেক মঠ গড়ে উঠেছে। এই চতুর্মঠের বাইরেও আরো দুটি মঠ আছে যা আদি শঙ্কর প্রতিষ্ঠিত। যথা কাশীর সুমেরুমঠ ও কাঞ্ছীকামকোটিমঠ। তবে কাশী কাঞ্ছীর শেষোক্ত দুই মঠ মূল আম্নায় পীঠের অন্তর্গত নয়। এগুলি জ্ঞানপীঠ ও সাধনপীঠ। কাঞ্ছীর আম্নায় পরিচয় দক্ষিণাম্নায়ের মত হওয়াই বাঞ্ছনীয় তবে এখানের সন্ন্যাসীগণ সরস্বতী নামা হলেও তারা ইন্দ্র সরস্বতী ব্যবহার করেন জ্ঞানপীঠের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক হিসাবে। ভূকৈলাস কৈবল্য ক্ষেত্র কাশী ধাম স্থিত ঊর্ধাম্নায় সুমেরু মঠ। যদিও এটিকে সারদা মঠের শাখা বলা হয়, তবে দ্বারকা সারদা না শৃঙ্গেরী সারদা তা নিয়ে মত ভেদ আছে।
আচার্য্য শঙ্কর প্রধান চারটি মঠের এলাকা ভিত্তিক কর্মক্ষেত্র নির্দিষ্ট করে দেন। সিন্ধু, সৌরাষ্ট্র, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি ভারতের পশ্চিমভাগ সারদা মঠের অধীনে থাকবে। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ ইত্যাদি ভারতের পূর্বাঞ্চল গোবর্ধন মঠের অধীন। পাঞ্জাব, কাশ্মীর এবং হিমালয়ের পার্বত্যঅঞ্চল জ্যোতি মঠের অন্তর্ভূক্ত থাকবে। শৃঙ্গেরী মঠের অধীনে থাকবে অন্ধ্র, কর্ণাটক, কেরল ইত্যাদি ভারতের দক্ষিণাঞ্চল।
মঠের
কার্যাবলী সুষ্ঠভাবে পরিচালনার স্বার্থে মঠাধীশদের জন্য শঙ্করাচার্য্য যে নিয়ম ও অনুশাসনের
প্রবর্তন করেছিলেন তা ‘মঠাম্নায়’ নামে পরিচিত। তাঁর নির্দেশ ছিল-মঠের অধ্যক্ষকে নানা
সদ্গুণে ভূষিত আদর্শ-সন্ন্যাসী হতে হবে। তিনি জিতেন্দ্রিয়, পবিত্রহৃদয় এবং বেদ-বেদান্তাদি
শাস্ত্রে পারঙ্গম হবেন। যদি তিনি এই সকল সদ্গুণে ভূষিত না হন, অথবা যদি তাঁর কোন পদস্খলন
ঘটে তাঁকে পদচ্যুত করে অন্য কাউকে মঠাধ্যক্ষের পদে নির্বাচন করিতে হবে।
পরিবার
প্রতিপালনের দায়িত্বমুক্ত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের উপর বৈদিকধর্মের সংরক্ষণ
ও সম্প্রসারণের দায়িত্ব ন্যস্ত করে শঙ্করাচার্য্য সনাতন হিন্দুধর্মকে সুদৃঢ়-ভিত্তির
উপর স্থাপন করে গিয়েছিলেন।
জ্যোতির্ধামে অবস্থানকালে আচার্য্য শঙ্কর তাঁর শিষ্যমণ্ডলীকে যেমন ভবিষ্যত কর্ম-পরিকল্পনার বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশ দিয়েছিলেন, তেমনি সন্ন্যাস-জীবনের সুউচ্চ আদর্শ-‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ বিষয়ে তাঁদের সচেতন করেছিলেন, যা সুধন্বারাজ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু জ্ঞানী সুধন্বারাজ তাতে মুগ্ধ হলেন না, তিনি রাজস্বভাবসূলভ দূরদর্শিতা হতে বলে বসলেন-'হে ভগবন! আপনার এই অনুশাসন মধ্যে অনুশাসনকর্তার স্বরূপ বা যোগ্যতা কীর্ত্তন থাকা আবশ্যক; আর তাহা তাঁহারই নিজের হওয়াই উচিত। বেদ যে নিত্য ও স্বতঃপ্রমাণ তাহা বেদ নিজেই বলছেন।"
আচার্য্য শঙ্কর ইষৎ হাস্য করে বললেন-"সত্যযুগে ব্রহ্মা বিশ্বগুরু, ত্রেতাযুগে মহর্ষি বশিষ্ঠ বিশ্বগুরু, দ্বাপরে ব্যাসই বিশ্বগুরু আর এই কলিতে আমিই হয়েছি।"
এইভাবে তিনি তাঁর জীবনের সমস্ত কর্তব্যের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মহাপ্রস্থানের জন্য প্রস্তুত হলেন।
'আচার্য্যের
অন্তর্ধান'
অন্তর্মুখ আচার্য্য বদরিক্ষেত্রে কয়েক দিন অবস্থান করে পুনরায় কেদারনাথের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেন।কেদারক্ষেত্রে পৌঁছে আচার্য্যের ধ্যান-তন্ময়তা অনেক বেড়ে গেল। আচার্য্যের এই অবস্থা দেখে শিষ্যমণ্ডলীর মনে নির্বেদের সঞ্চার হোল। তাঁরাও অধিকাংশ সময় ধ্যানমগ্ন হয়ে অতিবাহিত করতে লাগলেন। আচার্য্য ও তাঁর শিষ্যমণ্ডলীর ধ্যান-তন্ময়তার প্রভাবে সমগ্র কেদারক্ষেত্রটাই যেন ধ্যানীমূর্তি ধারণ করলো। কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন আচার্য্য সকল শিষ্যদের কাছে ডেকে বললেন--এ দেহের কাজ ফুরিয়েছে। তোমাদের কারো যদি কোন অপূর্ণ ইচ্ছা থেকে থাকে আমাকে বল। কারো মুখে বাক্যস্ফূর্তি হয় না। আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় তাঁরা বিহ্বল। অবশেষে পদ্মপাদ বললেন-আপনার অশেষ কৃপায় আমরা পূর্ণ-মনস্কাম হয়েছি। আমাদের প্রাপ্য বা জ্ঞাতব্য কিছু নেই। আমাদের প্রার্থনা শুধু একটাই-আমরা যেন আপনার আদর্শের মর্য্যদা রেখে চলতে পারি। প্রসন্ন-মুখে আচার্য্য বললেন-পরমাত্মার নিকট প্রার্থনা করছি তোমরা সিদ্ধকাম হও।
এরপর আচার্য্য সমাধিমগ্ন হলেন। বেশ কিছ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি স্বীয় শিব-স্বরূপে লীন হয়ে গেলেন। যোগাবলম্বনে ৬৪০ শকাব্দে আচার্য্যের অন্তর্দ্ধান হল। যেমন নিদ্রাভঙ্গে স্বপ্নকল্পিত শরীর হতে স্বদেহ প্রাপ্তি হয়, তদ্রুপ ভিক্ষুকলেবর শিবশরীর প্রকট হল। রজতাচল রত্ন সমুজ্জল সুচারুরুচির কলেবর চন্দ্রকলাবিভূষিত, জটাজুটমণ্ডিত মস্তকোপরি ফণিগণ-ফণা-মণি-রাজি বিরাজিত, ভূজঙ্গ-কৃত-যজ্ঞাপবীত, ত্রিশূল-পিনাক-ডমুরুধারী, মরকতঃ-প্রভা-সমুদ্ভাসিত-শ্যামল-গরলছায়া-প্রকাশিত কণ্ঠদেশ, শ্বেত-ভষ্মধারী, ব্যাঘ্রচৰ্ম্মাম্বর, পূর্ণব্ৰহ্মানন্দ-স্বরূপ শিব প্রকাশিত হলেন। অমরগণ পরমানন্দে স্তুতিপরায়ণ হলেন, দেবর্ষি ও ব্রহ্মর্ষিবৃন্দের পরমানন্দ বোধ হল। শিবগণ, অগ্রপশ্চাতে নৃত্যপরায়ণ এইরূপে শঙ্কর মহেশ্বর পরমানন্দে কৈলাসে বৃষভবাহনে গমন করলেন, সকলে জয় জয় শঙ্কর! হর হর শঙ্কর! বলে জয়ধ্বনি করতে লাগলেন। পশুপতি মহেশ্বর স্বেচ্ছামতে মায়াতে ভূতলে আবির্ভূত হয়ে বেদান্তার্থ নির্ণয় করতঃ শ্রুতিসিদ্ধ অদ্বৈত বেদান্তমার্গ প্রচার করে অন্তে স্বেচ্ছাপুরঃসর নিজলোকে গমন করলেন।
জগতে জগদ্গুরু শঙ্করের লীলান্তে এক শঙ্কর বহু শঙ্করে পরিণত হলেন। আচার্য্য গুরুশিষ্য পরম্পরা অনুসারে চতুর্মঠের পরবর্তী মঠাধ্যক্ষরা 'জগদ্গুরু শঙ্করাচার্য্য' পদবীতে নিযুক্ত হলেন।
শঙ্করাচার্য্যের গুরু সম্প্রদায়ঃ-
শঙ্কর-সম্প্রদায়ে
আচার্য্যের গুরুপরম্পরা সম্বন্ধে সকলে একমত নয়। শঙ্করাচার্য্য বিরচিত সন্ন্যাস পদ্ধতি
মতে-
'ভগবান্
ব্রহ্মা, ভগবান্ বিষ্ণু, ভগবান্ রুদ্র, বশিষ্ঠ, শক্ত্রি, পরাশর, ব্যাস, শুক, গৌড়পাদ,
গোবিন্দপাদ, ভগবৎপাদ শঙ্করাচার্য।'
কাশীর
সন্ন্যাসীগণ মধ্যে প্রচলিত আছে-
'ভগবান্
নারায়ণ, ভগবান্ ব্রহ্মা, বশিষ্ঠ, শক্ত্রি, পরাশর, ব্যাস, শুক, আচার্য গৌড়পাদ, আচার্য্য
গোবিন্দপাদ, ভগবৎপাদ শঙ্করাচার্য।'
দাক্ষিণাত্যে
প্রচলিত মতে,
'ভগবান্
মহেশ্বর, ভগবান্ নারায়ণ, ভগবান্ ব্রহ্মা, বশিষ্ঠ, শক্ত্রি, পরাশর, ব্যাস, শুক, গৌড়পাদ,
গোবিন্দপাদ, ভগবৎপাদ শঙ্করাচার্য।'
দক্ষিণ
মার্গ-তন্ত্র মতে—
'কপিল,
অত্রি, বশিষ্ট, সনক, সনন্দন, ভৃগু, সনৎসুজাত, বামদেব, নারদ, গৌতম, শৌণক, শক্ত্রি, মার্কণ্ডেয়,
কৌশিক, পরাশর, শুক, অঙ্গিরা, কণ্ব, জাবালি, ভারদ্বাজ, বেদব্যাস, ঈশান, রমণ, কপর্দী,
ভূধর, সুভট, জলজ, ভূতেশ, পরম, বিজয়, ভরণ, পদ্মেশ, সুভগ, বিশুদ্ধ, সমর, কৈবল্য, গণেশ্বর,
সুযাত, বিবুধ, যোগী, বিজ্ঞান, নগ, বিভ্রম, দামোদর, চিদাভাস, চিন্ময়, কলাধর, বীরেশ্বর,
মন্দার, ত্রিদশ, সাগর, মৃড়, হর্ষ, সিংহ, গৌড়, বীর, ঘোর, ধ্রুব, দিবাকর, চক্রধর, প্রমথেশ,
চতুর্ভুজ, আনন্দভৈরব, ধীর, গৌড়, পাবক, পরাচার্য সত্যনিধি, রামচন্দ্র, গোবিন্দ, শংকরাচার্য'।
রামেশ্বরের
শৃঙ্গেরীমঠে শঙ্করাচার্য শিষ্য শ্রীসুরেশ্বরাচার্য্য, তৎপর শ্রীনিত্যবোধঘন, শ্রীজ্ঞানঘন,
শ্রীজ্ঞানোত্তম, শ্রীজ্ঞান গিরি, শ্রীসিংহ গিরি, শ্রীঈশ্বর তীর্থ, শ্রীনৃসিংহ তীর্থ,
শ্রীবিদ্যা তীর্থ, শ্রীভারতী তীর্থ, শ্রীবিদ্যারণ্য। এই মঠের বিখ্যাত শঙ্করাচার্য্য
ছিলেন এই বিদ্যারণ্য স্বামী (মাধবাচার্য্য) যিনি কর্নাটক সিংহাসনাধিপতিত্ব পান এবং
সার্বভৌম জগদগুরুত্ব লাভ করেন। এছাড়া শেষ কিছু শঙ্করাচার্য্য হলেন- অভিনব সচ্চিদানন্দ
ভারতী, নৃসিংহ ভারতী, সচ্চিদানন্দ শিবাভিনব নৃসিংহ ভারতী (আদি জগদগুরুর জন্মস্থানের
আবিষ্কারক ও প্রতিষ্ঠাতা), চন্দ্রশেখর ভারতী, অভিনব বিদ্যাতীর্থ, ভারতী তীর্থ, বিধুশেখর
ভারতী।
দ্বারকার
সারদামঠে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শিষ্য শ্রীহস্তামলকাচার্যের পর শ্রীচিৎসুখাচার্য,
সর্বজ্ঞানাচার্য, ব্রহ্মান্দতীর্থ, স্বরূপাভিজ্ঞানাচার্য, মঙ্গলভূত্ত্যাচার্য, ভাস্করাচার্য,
প্রজ্ঞানাচার্য, ব্রহ্মজ্যোৎস্নাচার্য.........ক্রমানুসারে ইত্যাদি আচার্য্যগণ পরবর্তীতে
'শঙ্করাচার্য্য' পদে আসীন হন। এই মঠের সাম্প্রতিক দুই জন শঙ্করাচার্য হলেন অভিনব সচ্চিদানন্দ
তীর্থ ও স্বরূপানন্দ সরস্বতী।
বদরীর
জ্যোতির্মঠে শঙ্করশিষ্য শ্রীতোটকাচার্য্য পরে শ্রীবিজয়, কৃষ্ণ, কুমার, গড়ুর, শুক, বিন্ধ্য,
বিশাল, বকুল, বামন, সুন্দর, অরুণ, শ্রীনিবাস, সুখানন্দ, বিদ্যানন্দ, শিব, গিরি, বিদ্যাধর,
গুণানন্দ, নারায়ণ এবং উমাপতি সহ অনেক যতিবৃন্দ এই মহান গুরুপরম্পরার অধীন ছিলেন। এর
মূল পরম্পরার সাম্প্রতিক কিছু শঙ্করাচার্য্য হলেন ব্রহ্মানন্দ সরস্বতী, কৃষ্ণবোধ আশ্রম,
স্বরূপানন্দ সরস্বতী।
পুরীর
গোবর্ধন মঠে শ্রীপদ্মপাদাচার্য্যের পরে অনন্তশ্রী শুলপাণি, নারায়ণ, বিদ্যারণ্য, বামদেব,
পদ্মনাভ, জগন্নাথ, মধুরেশ্বর, গোবিন্দ, শ্রীধর, মাধবানন্দ, কৃষ্ণব্রহ্মানন্দ, রামানন্দ
থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক দামোদর তীর্থ, মধুসূদন তীর্থ, ভারতীকৃষ্ণ তীর্থসহ.......
অনেক মহাত্মা গুরুপরম্পরায় মঠাধীশ ছিলেন। এই মঠের সাম্প্রতিক কিছু শঙ্করাচার্য্য হলেন
সিদ্ধ মাতৃ সাধক মধুসূদন তীর্থ (কাশী কামরূপ মঠের সাধক), ভারতী কৃষ্ণ তীর্থ (শৃঙ্গেরীর
সচ্চিদানন্দ শিবাভিনব নৃসিংহ ভারতী স্বামীর শিষ্য), নিরঞ্জনদেব তীর্থ (কাশীর কামরূপ
মঠের সাধক), নিশ্চলানন্দ সরস্বতী(জ্যোতির্মঠের শঙ্করাচার্য্য ব্রহ্মানন্দ সরস্বতী জির
শিষ্য ধর্মসম্রাট হরিহরানন্দ সরস্বতী করপাত্র স্বামী জির শিষ্য)
চতুর্মঠের
পরম্পরা ছাড়াও অধিকাংশ হিন্দুসন্ন্যাসী সম্প্রদায় ও সংগঠনের আদি সংগঠক এই জগদ্গুরু
শঙ্কর অর্থাৎ এই সম্প্রদায়গুলোর গুরুপরম্পরা শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত দশনামী সম্প্রদায়
থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যদিও তাদের মধ্যে দার্শনিক মতভেদ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ-ব্রহ্মমাধ্ব
সম্প্রদায়ের দ্বৈতবাদী বৈষ্ণব মধ্বাচার্যও আদি জগদগুরু শঙ্করাচার্য্যের পরম্পরার পশ্চিমাম্নায়
দ্বারকা শারদা মঠের তীর্থ নামা দশনামী একদন্ডী বৈদিক সন্ন্যাসী পরম্পরার অন্তর্গত।
শ্রীমধ্ব অচ্যুতপ্রেক্ষ তীর্থ নামক এক গুরুর নিকট দীক্ষিত হয়ে সন্ন্যাসাশ্রমে প্রবিষ্ট
হন। শঙ্করের শিষ্য পদ্মপাদের শিষ্যকুল থেকে এদের গুরুপরম্পরা এসেছে যথা~ পদ্মপাদ→জ্ঞাননিধি তীর্থ→গরূড়বাহন তীর্থ→কৈবল্য
তীর্থ→জ্ঞানেশ তীর্থ→পর তীর্থ→ সত্যপ্রজ্ঞ তীর্থ→প্রাজ্ঞ তীর্থ→অচ্যুতপ্রেক্ষ
তীর্থ→আনন্দ তীর্থ (মাধ্বাচার্য্য) এইরূপ পরম্পরা এবং
তৎপরবর্তীকালে তৎপ্রতিষ্ঠিত একাধীক মঠ এই শুদ্ধ তীর্থ নামা একদন্ডী সন্ন্যাস বজায় রেখেছে।
গুরুপরম্পরা
সূত্রে গৌড়ীয় ধারার দুই দিকপাল অদ্বৈতাচার্য্য প্রভু ও নিত্যানন্দ প্রভু এই সম্প্রদায়ের
অন্তর্গত। যদিও এখন প্রশ্ন হতে পারে যে তারা তো দশনামীর পুরী সম্প্রদায়ের শিষ্য ছিলেন
তাহলে সেই গুরুপরম্পরার সামান্য উল্লেখ না করে পারছিনা। মাধ্বাচার্য্যের পর পদ্মনাভ
তীর্থ→নরহরি তীর্থ→অক্ষোভ্য
তীর্থ→জয় তীর্থ→জ্ঞানসিন্ধু
তীর্থ→ দয়ানিধি তীর্থ→ বিদ্যানিধি
তীর্থ→ রাজেন্দ্র তীর্থ→জয়ধর্ম তীর্থ→ পুরুষোত্তম তীর্থ→ব্রাহ্মণ্য তীর্থ→ ব্যাস তীর্থ→লক্ষ্মীপতি
পুরী (ইনি ব্যাস তীর্থ স্বামীর থেকে ভজন সাধন দীক্ষাদি প্রাপ্ত হলেও সন্ন্যাস পাননি
তাই পরে শঙ্করপন্থী পুরী সম্প্রদায়ের থেকে সন্ন্যাস নেন) লক্ষ্মীপতীর দুই শিষ্য শঙ্করারণ্য
পুরী (শ্রীচৈতন্যের গৃহত্যাগী অগ্রজ বিশ্বরূপ) এবং মাধবেন্দ্র পুরী। শঙ্করারণ্য পুরীর
ব্যাক্ত অবধূত শিষ্য হলেন প্রভু নিত্যানন্দ এবং মাধবেন্দ্র পুরীর শিষ্য হলেন ব্যাক্তাবধূত
শিষ্য ঈশ্বর পুরী এবং গুপ্তাবধূত শিষ্য হলেন অদ্বৈতাচার্য্য। পরে এদের থেকে সম্প্রদায়
আরো এগিয়েছে। ঈশ্বর পুরীর কাছ থেকে শ্রীমন্মহাপ্রভু দশাক্ষর গোপালমন্ত্রে গয়ায় দীক্ষা
পান এটা সর্বজন বিদিত। পরে তিনি কেশব ভারতীর কাছে উচ্চসংস্কার পান এটাও সর্বজন বিদিত।
তাহলে মহাপ্রভু ঈশ্বর পুরীর সূত্রে মাধ্ব সম্প্রদায়ের শিষ্য হলেন তবে পরে কেশব ভারতীর
সূত্রে তিনি নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হয়েছিলেন।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সন্ন্যাসগুরু কেশবভারতী ও দীক্ষাগুরু ঈশ্বরপুরী দশনামী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী। কাটোয়ার গঙ্গাতীরে দশনামী ভারতী সম্প্রদায়ের কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাসদীক্ষা নিয়ে নবদ্বীপের বিশ্বম্ভর মিশ্র বা নিমাই পরিচিত হলেন 'শ্রীচৈতন্য ভারতী' নামে আখ্যায়িত হন, এমনকি এই 'চৈতন্য' নামটি শৃঙ্গেরীমঠভূক্ত ব্রহ্মচারীর উপাধি। নিম্বার্ক পরম্পরা সম্পর্কে বলা যে সুদর্শনচক্রাবতার ভগবান নিম্বার্কের পরম্পরা আদি জগদগুরু শঙ্করাচার্য্য প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণাম্নায় শৃঙ্গেরী শারদা পীঠের ভারতী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছিল। কেশব ভারতী নিম্বার্কের পর ৩০নং মোহন্ত পদে আসীন হয়েছিলেন তা নিম্বার্ক গুরু প্রণালীতেই পাওয়া যায়। চৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণের যে শ্রীধরস্বামী টীকা এবং শ্রীধরীটীকার অনুগত ব্যাখ্যাই কেবলমাত্র মান্য বলেছেন এবং যাঁকে স্বীয়গুরু বলে মেনেছেন সেই পূজ্যপাদ স্বামী শ্রীধরতীর্থও দশনামি সন্যাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সন্ন্যাসগুরু পরিব্রাজক বৈদান্তিক সন্ন্যাসী তোতাপুরীও এই দশনামী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত ছিল। ত্রৈলঙ্গস্বামী ভগীরথানন্দ সরস্বতী নামক এক যোগীর নিকট পুষ্কর তীর্থে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর ত্রৈলঙ্গ স্বামীর নাম হয় গণপতি সরস্বতী। পরমহংস নিগমানন্দ সরস্বতীর গুরু ছিলেন সচ্চিদানন্দ সরস্বতী, নিগমানন্দ শৃঙ্গেরী মঠের অধীনে "সরস্বতী" উপাধির সাথে সংশ্লিষ্ট সন্ন্যাসী হওয়ায় তিনি তার মঠের নাম রাখেন "সারস্বত মঠ"। তাছাড়া চট্টগ্রামের ঋষিধামের অদ্বৈতানন্দ পুরী, সীতাকুণ্ডের শঙ্কর মঠের জ্যোতিশ্বরানন্দ গিরি সহ অনেক আধুনিক সংগঠনও শঙ্কর পরম্পরার অন্তর্ভূক্ত।
এই
জ্ঞানসূর্য্য ব্রহ্মজ্ঞ জগদ্গুরু ভগবৎপাদ্ শ্রীশঙ্করাচার্যকে জানাই শতকোটি প্রণাম।
জগদ্গুরু শ্রীশঙ্করভগবত্পাদাচার্যস্বামিনে নমঃ।
তথ্যসুত্রঃ-
১. আচার্য শঙ্কর ও রামানুজ, লেখক- রাজেন্দ্রনাথ ঘোষ (স্বামী চিদ্ঘনানন্দ পুরী), উদ্বোধন কার্যালয় কলকাতা।
বিখ্যাত শঙ্কর গবেষক পন্ডিত রাজেন্দ্রনাথ ঘোষ (স্বামী চিদ্ঘনানন্দ পুরী) তাহার
জীবনকালের ভ্রমণ ও গবেষণার ফল হিসেবে রচিত "আচার্য্য শঙ্কর ও রামানুজ" শীর্ষক
বই। এই বইটিতে মাধবাচার্য্যের সটীক শঙ্কর বিজয়ম, চিদ্বিলাসযতি রচিত শঙ্কর বিজয় বিলাস,
অনন্তানন্দগিরি বিরচিত শঙ্কর-দ্বিগ্বিজয়, শঙ্কর জন্মভূমিতে প্রাপ্ত শঙ্করের কোন জ্ঞাতিপন্ডিত
বিরচিত শঙ্করচরিত, সদানন্দ বিরচিত শঙ্করজয় অনুসারে অসংখ্য তথ্য দেয়া হয়েছে।
২. শঙ্কর-বিজয়-জয়ন্তী গ্রন্থ, লেখক- কাশীদাস মিত্র,
প্রকাশসাল, ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ (১২৭৮ বঙ্গাব্দ)
কবি সদানন্দ সাধারণের উপকার মানসে, সরল ভাবে ও কোমল শব্দে যে শম্ভুচরিত্র প্রকাশ করিয়া “দিগ বিজয়সার” আখ্যা প্রদান করিয়াছেন, অকিঞ্চন সেই সার গ্রন্থ অবলম্বন করিয়া বঙ্গভাষায় “শঙ্কর-বিজয়-জয়ন্তী” লিখিত।
৩. কাশীর সুমেরু মঠ বিষয়ক তথ্যসংগ্রহ ও আরো বেশকিছু তথ্যে সহায়তা ও কৃতজ্ঞতায় দাদাশ্রী শুভম্ মণ্ডল।
শ্রীশুভ চৌধুরী।
No comments:
Post a Comment