‘ধ্যানযোগ’
পূর্ব্ব অধ্যায়ের অন্তভাগে ২৭-২৯ ইত্যাদি শ্লোকে
সম্যগ্ দর্শনের অন্তরঙ্গ সাধন যে ধ্যানযোগের সূত্রস্থানীয় শ্লোকসকল উপদিষ্ট হইয়াছে,
তাহাদের বৃত্তিস্থানীয় (ব্যাখ্যা স্বরূপ) এই ষষ্ঠ অধ্যায় আরম্ভ হইতেছে। এখন ধ্যানযোগের
বহিরঙ্গ হইল ফলত্যাগপূর্ব্বক বাহ্য লোকহিতকর গার্হস্থ্য কর্মযোগ। যতদিন পর্যন্ত ধ্যানযোগে
আরোহনে অসমর্থ, সেই পর্য্যন্ত অধিকৃত গৃহস্থের দ্বারা কর্ম্ম কর্ত্তব্য। এইজন্য ষষ্ঠাধ্যায়ের
প্রথম শ্লোকে শ্রীভগবান্ বাহ্যকর্ম্মযোগের স্তুতি করিতেছেন। ধ্যানযোগে আরোহণেচ্ছু গার্হস্থ্যাশ্রমে
স্থিত মুনির অগ্নিহোত্রাদি কর্ম্মের ফলনিরপেক্ষ কর্ম্মযোগের অনুষ্ঠান করা হইলে চিত্তশুদ্ধি
দ্বারা ধ্যানযোগারোহন-সাধনত্ব হইতে পারে। এইজন্য নিষ্কামকর্ম্মীকে ‘তিনিই সন্ন্যাসী,
তিনিই যোগী’ বলে স্তুতি করা হইতেছে-
শ্রীভগবানুবাচ -
অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ ৷
স সংন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ ৷৷
১ ৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- কর্ম্মফলে অনাশ্রিত অর্থাৎ কর্ম্মফলতৃষ্ণারহিত
হইয়া যিনি কাম্য-বিপরীত অগ্নিহোত্রাদি নিত্য কর্ত্তব্যকর্ম্ম নির্বর্তন করেন, ঈদৃশ
কর্ম্মী কোন ইতর কাম্য কর্ম্মী হইতে বিশিষ্ট– এইরূপ অর্থে ভগবান বলিতেছেন, ‘তিনিই সন্ন্যাসী
এবং তিনিই যোগী’। সন্ন্যাস ত্যাগের অপর নাম, এইগুণ যাঁহার মধ্যে তিনিই সন্ন্যাসী, আর
চিত্তের সমাধানের নাম যোগ, ইহা যাঁহার মধ্যে আছে তিনিই যোগী অর্থাৎ ঐ কর্ম্মযোগীও এইরূপ
গুণসম্পন্ন মনে করা উচিত। কেবল নিরগ্নি অর্থাৎ অগ্নি প্রভৃতি কর্ম্মাঙ্গভূত ব্যাপারাদি
নির্গত হইলে এবং অক্রিয় অর্থাৎ অগ্নিসাধন বা যজ্ঞাদি ক্রিয়া ও সমস্ত তপোদানাদি ক্রিয়া
অবিদ্যমান হইলেই সন্ন্যাসী বা যোগী হয় এইরূপ মনে করা উচিত নহে।১
যং সংন্যাসমিতি প্রাহুর্যোগং তং বিদ্ধি পাণ্ডব
৷
ন হ্যসংন্যস্তসঙ্কল্পো যোগী ভবতি কশ্চন ৷৷ ২ ৷।
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- শ্রুতি-স্মৃতিবিদেরা সর্ব্বকর্ম্ম আর তার ফলত্যাগরূপ
যে ভাবকে পরমার্থ সন্ন্যাস বলিয়াছেন, হে পাণ্ডব! কর্ম্মানুষ্ঠানরূপ যোগকেও (নিষ্কাম
কর্মযোগকেও) তুমি ঐ পরমার্থ সন্ন্যাস বলিয়া জানিবে ৷ প্রবৃত্তিরূপ কর্মযোগের তদ্বিপরীত
নিবৃত্তিরূপ পরমার্থ-সন্ন্যাসের সহিত কিরূপ সমানতা স্বীকার করিয়া একতা বলা হইয়াছে?
এই প্রশ্নের উত্তর হইল- পরমার্থ-সন্ন্যাসের সহিত কর্ম্মযোগের কর্তৃবিষয়ক সমানতা আছে;
কেননা যিনি পরমার্থ-সন্ন্যাসী তিনি সর্ব্বকর্ম্ম-সাধনকে ত্যাগ করায় সর্ব্বকর্ম্ম আর
ফলবিষয়ক সংকল্প, যাহা প্রবৃত্তির হেতু কামের কারণ, তাহা ত্যাগ করেন ৷ আর কর্ম্মরত কর্ম্মযোগীও
ফলবিষয়ক সংকল্পকে ত্যাগ করেন। (এই দুইটীর মধ্যে এইরূপ সমানতা) এই অভিপ্রায়ে ভগবান বলিতেছেন-
যিনি ফলবিষয়ক সংকল্প অর্থাৎ ইচ্ছাকে ত্যাগ করেন নি, এইরকম কেহই কর্ম্মী বা যোগী হতে
পারে না ৷ অর্থাৎ এইরূপ পুরুষের চিত্ত সমাধিস্থ হওয়া অসম্ভব; কেননা ফলের সংকল্পই চিত্ত
বিক্ষেপের কারণ ৷ এইজন্য যে কর্ম্মী ফলবিষয়ক সংকল্পকে ত্যাগ করে দেন তিনিই যোগী ৷ অভিপ্রায়
এই যে চিত্তবিক্ষেপের কারণ যে ফলবিষয়ক সংকল্প তাহার ত্যাগেই মনুষ্য সমাধানযুক্ত অর্থাৎ
চিত্তবিক্ষেপরহিত যোগী হন ৷ ২
ফলনিরপেক্ষ যে কর্ম্মযোগ তাহা ধ্যানযোগের বহিরঙ্গ
সাধন। এই উদ্দেশ্যে তাহাকে কর্ম্মফলত্যাগরূপ সংন্যাসরূপে স্তুতি করিয়া এখন কর্ম্মযোগ
যে ধ্যানযোগের সাধন তাহা দেখান হইতেছে-
আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম কারণমুচ্যতে ৷
যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে ৷৷৩৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- ধ্যানযোগের আরূঢ়
হইতে ইচ্ছুক কর্ম্মফলসংন্যাসী মুনির কর্ম্মযোগই কারণ বা সাধন বলা হয়। পুনশ্চ সেই ব্যক্তি
যোগারূঢ় হইলে তাঁহার পক্ষে শম বা উপশম অর্থাৎ সর্ব্বকর্ম্ম হইতে নিবৃত্তিই কারণ বা
যোগারূঢ়ত্বের সাধন বলা হইয়া থাকে-এইরূপ অর্থ। যেমন যেমন কর্ম্ম হইতে উপরত হয়, তেমনি
তেমনি নিরায়াস জিতেন্দ্রিয়ের চিত্ত সমাধান হয়। এইরকম হইলে তিনি শীঘ্র ধ্যান-যোগারূঢ়
হন। মহর্ষি ব্যাস কর্ত্তৃকও এইরূপ উক্ত হইয়াছে-“ব্রাহ্মণের পক্ষে-একতা, সমতা, সত্যতা,
শীল, স্থিতি, অহিংসা, আর্জব (সরলতা) এবং সেই সেই ক্রিয়া সকল হইতে উপরম-এর সদৃশ আর বিত্ত
(গুণ) নাই।”-(মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব ১৭৫।৩৭) ৩
অতঃপর ইদানীং কখন সাধক ঠিক্ ঠিক্ ধ্যানযোগারূঢ়
হন তাহাই বলা হইতেছে-
যদা হি নেন্দ্রিয়ার্থেষু ন কর্মস্বনুষজ্জতে ৷
সর্বসঙ্কল্পসংন্যাসী যোগারূঢস্তদোচ্যতে ৷৷ ৪ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- যখন সমাধীয়মানচিত্ত
যোগী ইন্দ্রিয়ার্থেতে অর্থাৎ ইন্দ্রিয় সকলের অর্থ শব্দাদিতে এবং নিত্য-নৈমিত্তিক-কাম্য
ও নিষিদ্ধ কর্ম্মে প্রয়োজন-অভাব-বুদ্ধি হেতু অনুষঙ্গ বা আসক্ত হয় না অর্থাৎ কর্ত্তব্যতা
বুদ্ধি করে না তখন ঐ সর্ব্ব সংকল্পত্যাগী অর্থাৎ ইহলোক আর পরলোকের ভোগকামনার কারণরূপ
সর্ব্বসংকল্প ত্যাগ করা যাঁহার স্বভাব হইয়া গিয়াছে, এইরূপ সর্বসঙ্কল্পসন্ন্যাসী যোগারূঢ়
অর্থাৎ ধ্যানযোগ প্রাপ্ত হইয়াছেন-এইরূপ বলা হইয়া থাকে ৷ সমস্ত কামনাই সংকল্প মূলা।
“কাম মাত্রই সংকল্প মূল, যজ্ঞসকল সংকল্পসম্ভব”-(মনুস্মৃতি-২।৩); “হে কাম! তোমার মূল
জানি, তুমি সংকল্প হইতে জন্মাও। আমি তোমাকে কখনও সংকল্প করিব না, তাহা হইলে তুমি আর
আমাতে জন্মাতে পারিবে না”-(মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব-১৭৭।২৫)-ইত্যাদি স্মৃতিতে আছে। সর্ব্বকামনা
পরিত্যাগ করিলে সর্ব্বকর্ম্মসন্ন্যাস সিদ্ধ হইয়া থাকে, “যে যেমন কামনাবান্ হয়, সে সেইরূপ
নিশ্চয়বান্ হয়; যে যেমন নিশ্চয়বান হয়, সে সেইরূপ কর্ম্ম করে”-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৪।৫)
ইত্যাদি শ্রুতিসকল হইতে পাওয়া যায় এবং “লোকে যা যা কর্ম্ম করে, তা তা কামেরই চেষ্টা
বলিয়া জানিবে”-(মনুস্মৃতি-২।৪) -ইত্যাদি স্মৃতি হইতে পাওয়া যায়। সেইজন্য ‘সর্বসঙ্কল্পসংন্যাসী’
এইরূপ বচন আছে বলিয়া বুঝিতে হইবে ভগবান্ এখানে সন্ন্যাসীর সমস্ত কামনা এবং কর্ম্ম ত্যাগ
করাইতেছেন। ৪
যখন সাধক এইরূপ যোগারূঢ় হন, তখন সেই যোগারূঢ় আত্মা
(বিবেকযুক্ত মন) দ্বারা আত্মা অনর্থসমূহপূর্ণ সংসার হইতে উদ্ধৃত হইয়া থাকেন, এইজন্য-
উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ ৷
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ ৷৷
৫ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- সংসার-সাগরে নিমগ্ন
আত্মাকে আত্মা (বিবেকযুক্ত মন) দ্বারা উদ্ধার করা উচিত অর্থাৎ যোগারূঢ় অবস্থা প্রাপ্ত
হওয়া উচিত ৷ আত্মাকে অবসন্ন করিবে না অর্থাৎ আত্মার অধোগতি করিবে না। কারণ বিবেকযুক্ত
মনই আত্মার বন্ধু, যেহেতু আত্মার সংসার-মুক্তির নিমিত্ত হন, এমন অন্য কোনও বন্ধু নাই।
সাংসারিক বন্ধু যে দেখিতে পাওয়া যায় তা স্নেহাদি বন্ধনের ক্ষেত্র হওয়ায় মোক্ষের প্রতি
প্রতিকূল হইয়া থাকে; সেইজন্য ভগবানের এই সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত-‘আত্মাই (বিবেকযুক্ত
মনই) আত্মার বন্ধু’। আবার বিষয়াসক্ত মনই আত্মার শত্রু। যে কেহ অন্য অপকারী বাহ্যশত্রু
তাহাও আত্মপ্রযুক্তই হইয়া থাকে, সেই জন্য ঠিকই বলা হইয়াছে যে, ‘আত্মাই (বিষয়াসক্ত মনই)
আত্মার শত্রু’।৫
এখন কি লক্ষণ বিশিষ্ট আত্মা আত্মার বন্ধু এবং কি
লক্ষণ বিশিষ্ট আত্মা আত্মার শত্রু-তাই বলা হইতেছে-
বন্ধুরাত্মাত্মনস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ ৷
অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ ৷৷
৬ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- যে বিবেকযুক্ত
মন দ্বারা দেহেন্দ্রিয়াদি বশীভূত হইয়াছে, সেই সংযত মনই আত্মার বন্ধু, কারণ উচ্ছৃঙ্খল
প্রবৃত্তি রহিত হইয়া সেই মনই মুক্তির সহায়ক হয় । কিন্তু অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তির বিবেকশূন্য
মন উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তিবশে শত্রুর ন্যায় স্বীয় অনিষ্টসাধনে প্রবৃত্ত হয় । ৬
জিতাত্মনঃ প্রশান্তস্য পরমাত্মা সমাহিতঃ ৷
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু তথা মানাপমানয়োঃ ৷৷ ৭ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- যিনি মন, ইন্দ্রিয়াদি
সংঘাতরূপ এই দেহ জিত হইয়াছেন এইরূপ জিতাত্মা আর যিনি প্রশান্ত অর্থাৎ যাঁহার অন্তঃকরণ
সদা প্রসন্ন থাকে এইরূপ সন্ন্যাসী পরমাত্মা সমাহিত অর্থাৎ সাক্ষাৎ আত্মভাবেই বর্তমান
থাকেন। এইরূপ ব্যক্তি শীত ও উষ্ণে, সুখ ও দুঃখে এবং সম্মান ও অপমানে অর্থাৎ পূজা ও
তিরস্কারে সমভাবে অবস্থিতি করেন।৭
জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ
৷
যুক্ত ইত্যুচ্যতে যোগী সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ ৷৷ ৮
৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- শাস্ত্রোক্ত পদার্থ
বোধগম্য হওয়ার নাম 'জ্ঞান' আর শাস্ত্র হইতে জ্ঞাত ভাবকে স্বীয় অন্তঃকরণে প্রত্যক্ষ
অনুভব করার নাম 'বিজ্ঞান', এইরূপ 'জ্ঞান' ও 'বিজ্ঞান' এ যাঁহার অন্তঃকরণ তৃপ্ত অর্থাৎ
যাঁহার অন্তঃকরণে এই বিশ্বাস উত্পন্ন হইয়াছে যে আর কিছুই জানিবার অবশিষ্ট নাই, এইপ্রকার
যিনি জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা তথা যিনি কূটস্থ অর্থাৎ অবিচল আর জিতেন্দ্রিয়, তিনি যুক্ত
অর্থাৎ সমাহিত, এইরূপ বলা হইয়া থাকে। সেই যোগী মৃৎখণ্ড, প্রস্তর ও স্বর্ণে সমদর্শী
(হেয়-উপাদেয়-বুদ্ধিশূন্য) অর্থাৎ উনার দৃষ্টিতে মাটি, পাথর আর সোনা সবই সমান।৮
সুহৃন্মিত্রার্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু ৷
সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে ৷৷ ৯ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- সুহৃৎ অর্থাৎ
যিনি প্রত্যুপকারের অপেক্ষা না করে উপকার করে, মিত্র অর্থাৎ স্নেহবান, শত্রু, উদাসীন
অর্থাৎ যিনি কাহারও ভজনা করেন না, মধ্যস্থ অর্থাৎ যিনি বিরুদ্ধ উভয়পক্ষেরই হিতৈষী,
দ্বেষ্য অর্থাৎ নিজের অপ্রিয়, বন্ধু অর্থাৎ কুটুম্ব, সাধু অর্থাৎ শাস্ত্রানুবর্তী ও
নিষিদ্ধকর্ম্মকারী পাপী প্রভৃতি সকলেতেই যাঁহার সমবুদ্ধি অর্থাৎ লোকটী কিরূপ বা তাঁহার
কর্ম্ম কিরূপ এইসব বিচারবুদ্ধি যাঁহার নাই, সমস্ত যোগারূঢ়দের মধ্যে তিনিই উত্তম।৯
অতএব এইরূপ উত্তম ফল প্রাপ্তির জন্য-
যোগী যুঞ্জীত সততমাত্মানং রহসি স্থিতঃ ৷
একাকী যতচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ ৷৷ ১০ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- যোগী (ধ্যানী)
একান্তে গিরিগুহাদিতে একাকি (অসহায়ভাবে) স্থিত হইয়া, নিরাশী (বীততৃষ্ণ) ও পরিগ্রহরহিত
সন্ন্যাসী হইয়া দেহ ও মন সংযমপূর্বক অন্তঃকরণকে সর্বদা সমাহিত করিবেন। ১০
অতঃপর ইদানীং ধ্যানযোগীর আসন, আহার, বিহারাদির
যোগসাধনত্ব হেতু নিয়ম বলা হইবে এবং যোগপ্রাপ্ত পুরুষের লক্ষণ এবং তাহার ফলাদিও কীর্ত্তন
করা হইবে; তাহার মধ্যে প্রথমে আসন কি বলা হইতেছে-
শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ ৷
নাত্যুচ্ছ্রিতং নাতিনীচং চৈলাজিনকুশোত্তরম্ ৷৷
১১ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- স্বভাবতঃ (প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যবিশিষ্ট) বা সংস্কারতঃ (পরিস্কৃত দেবালয়াদিতে) শুদ্ধ স্থানে যোগী প্রথমে কুশ,
তদুপরি যথাক্রমে মৃগব্যাঘ্রাদির চর্ম ও বস্ত্রদ্বারা রচিত নাতি উচ্চ বা নাতি নিম্ন
স্বীয় স্থির (অচল) আসন স্থাপন করিবেন।
ব্যাখ্যা- উপাসনা
বা ধ্যান আসনে উপবেশন করিয়াই সম্ভব। বেদান্তমীমাংসা
শাস্ত্রের আসীনাধিকরণের প্রতিপাদ্য বিষয় হইল উপাসনাকালে #আসন বা উপবেশনের আবশ্যকতা।
অনেকে মনে করেন আসনাদি নিয়মের আবশ্যকতা নাই কারণ উপাসনা মানস ব্যাপার হওয়ায় শরীর
স্থিতির নিয়ম নাই, যেহেতু শরীর হইতে মন ভিন্ন পদার্থ। ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত
করিতেছেন-
"আসীনঃ
সম্ভবাৎ"-(ব্রহ্মসূত্র- ৪/১/৭) শঙ্করাচার্য
শারীরক মীমাংসা ভাষ্যে বলিতেছেন- আসনে উপবিষ্ট হইয়াই উপাসনা করিবে। তাহাতে হেতু কি?-
যেহেতু তাহা সম্ভব। সমানাকারা মানসবৃত্তির যে প্রবাহকরণ তাহার নাম উপাসনা। তাহা কিন্তু
যিনি গমন করেন, বা যিনি ধাবিত হন, তাঁহার পক্ষে সম্ভব নহে; যেহেতু গতি প্রভৃতি চিত্তের
বিক্ষেপকারক। যিনি দণ্ডায়মান থাকেন তাঁহার পক্ষেও দেহধারণে ব্যাপৃত মন সূক্ষ্মবস্তু
নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হয় না। আর যিনি শয়ান থাকেন, তাঁহারও মন অকস্মাৎ নিদ্রার দ্বারা
অভিভূত হইয়া পড়ে। যিনি
আসনে উপবিষ্ট থাকেন, তাঁহার পক্ষে কিন্তু এই জাতীয় বহুদোষ সহজে পরিহৃত হইয়া থাকে,
এইহেতু তাঁহার পক্ষে উপাসনা সম্ভব।
আসন সিদ্ধেরই ধ্যান সিদ্ধ হয়। পতঞ্জলি যোগসূত্রে বলছেন- স্থিরসুখামাসনম্ ।।-(পাতঞ্জল যোগসূত্র, সাধনপাদ্- ৪৬) অর্থাৎ যেভাবে অনেকক্ষণ স্থিরভাবে সুখে বসিয়া থাকা যায়, তাহার নাম আসন। ভাষ্যকার ব্যাস বলছেন- "তা যেমন পদ্মাসন, বীরাসন, ভদ্রাসন স্বস্তিক (আসন), দণ্ডাসন সোপাশ্রয়, পর্যঙ্ক, ক্রৌঞ্চ-নিষদন, হস্তি-নিষদন, উষ্ট্র-নিষদন ও সমসংস্থান এগুলি স্থির সুখজনক ও যথা সুখকারক হলেই হলো আসন। যেভাবে উপবেশন করলে শরীর অক্লেশে স্থৈর্যসম্পন্ন হয় তাকে স্থিরসুখ বা যথাসুখ বলে।"
আসন প্রতিষ্ঠা করিয়া কি করিতে হইবে?
তত্রৈকাগ্রং মনঃ কৃত্বা যতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ
৷
উপবিশ্যাসনে যুঞ্জ্যাদ্যোগমাত্মবিশুদ্ধয়ে ৷৷ ১২
৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- সেই আসনে উপবেশন
করিয়া ইন্দ্রিয়সকলকে সমস্ত বিষয় হইতে মনে গুটাইয়া নিয়া অর্থাৎ মনকে একাগ্র করিয়া, চিত্ত
ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সংযমপূর্বক আত্মবিশুদ্ধির জন্য অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধির জন্য যোগাভ্যাস
করিবেন। ১২
বাহ্য আসনের কথা বলা হইয়াছে, এক্ষণে ধ্যানকালে
কিরূপে শরীরকে ধারণ করিতে হইবে তাহাই বলা হইতেছে-
সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ ৷
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্ ৷৷
১৩ ৷৷
প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ
৷
মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ ৷৷ ১৪ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- কায় (শরীর), শিরঃ
ও গ্রীবা সমান ও অচলভাবে ধারণ করে, (সমান দণ্ডাকারে ধারণ করিলেও দেহ দুলিতে পারে, এইজন্য
‘অচল’ এই বিশেষণটি বলিতেছেন), স্থির হইয়া স্বীয় নাসিকাগ্রে দৃষ্টি রাখিয়া অর্থাৎ অন্তঃকরণের
সমাধান করিয়া (কারণ চিত্ত একাগ্র হইলেই স্বতঃই চক্ষু নাসাগ্রদৃষ্টি হইয়া যায়) এবং অপর
কোন দিশা অবলোকন না করিয়া প্রশান্তাত্মা (প্রকৃষ্টরূপে অন্তঃকরণ যাঁহার), বিগতভয়, গুরুশুশ্রূষা-ভিক্ষাভোজনাদি
ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিত, মৎপর (অর্থাৎ আমিই যাঁহার মতে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ), মনঃসংযম অর্থাৎ
মনের বৃত্তিসকলকে উপসংহার করিয়া আমি যে পরমেশ্বর, সেই আমাতে চিত্ত যাঁহার সেই এই মচ্চিত্ত
সমাহিত হইয়া যোগে আসীন হইবেন অর্থাৎ উপবেশন করিবেন। ১৩,১৪
অতঃপর ধ্যানযোগের ফল বলা হইতেছে-
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তমানসঃ ৷
শান্তিং নির্বাণপরমাং মত্সংস্থামধিগচ্ছতি ৷৷ ১৫
৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- নিয়তমানস অর্থাৎ
সংযত মন যাঁহার সেই সদাসংযতমানস যোগী আত্মাকে (মনকে) এইরূপ যথোক্ত বিধানে সমাধান করিয়া
মোক্ষে পরমা নিষ্ঠা (সর্ববৃত্তির উপরতিরূপা) যে শান্তি তাহাই নির্বাণপরমা, সেই মদাধীনা
(মদাত্মিকা) অর্থাৎ মৎস্বরূপ পরমানন্দরূপা নিষ্ঠা প্রাপ্ত হন।১৫
অতঃপর যোগীদের আহারাদির নিয়ম বলা হইতেছে-
নাত্যশ্নতস্তু যোগোঽস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ ৷
ন চাতিস্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জুন ৷৷ ১৬
৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- আত্মসংযমিত অর্থাৎ
নিজের যতটুকু অন্ন প্রয়োজন তা অতিক্রম করিয়া যিনি অতিভোজন করেন তাঁহার যোগ হয় না। আবার
যাঁহারা একেবারে ভোজন করন না তাঁহাদেরও যোগ হয় না। শ্রুতিতেও আছে-“যিনি নিজের শরীরের
শক্তির অনুযায়ী অন্ন ভক্ষণ করিয়া থাকেন, সেই অন্ন তাঁহাকে রক্ষা করেন, কষ্ট দেন না।
যিনি তাঁহার অধিক ভোজন করেন সেই অন্ন তাঁহাকে কষ্ট দেন। আর যিনি যাহা দরকার তাহা থেকে
কম খান, ঐ অন্ন তাঁহাকে রক্ষা করেন না।”-(শতপথ ব্রাহ্মণ।। বৌধায়ন সূত্র ২।৭।২২) সেইজন্য
যোগী নিজের উপযুক্ত অন্ন হইতে অধিক বা অল্প অন্ন ভোজন করিবেন না। যোগীরা যোগশাস্ত্রে
উপদিষ্ট অন্নের পরিমাণ হইতে অতিমাত্র ভোজন করিলে যোগ হইবে না। যোগশাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে-“যোগী
উদরের অর্ধভাগ ভুক্ত ব্যঞ্জনের সহিত অন্নের দ্বারা ও তৃতীয়ভাগ জলের দ্বারা পূর্ণ করিবে
এবং চতুর্থভাগ বায়ু সঞ্চরণের জন্য অবশিষ্ট রাখিবে।” হে অর্জুন! সেইরূপ অতিনিদ্রালুরও
যোগ হয় না, আবার অতিমাত্র জাগরণশীলেরও যোগ হয় না। ১৬
তাহা হইলে পুনরায় কি হইলে যোগ হয়, তাহাই বলা হইতেছে-
যুক্তাহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্মসু ৷
যুক্তস্বপ্নাববোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা ৷৷ ১৭ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- যিনি পরিমিত আহার
(অন্ন) ও বিহার (পাদক্রম বা পাইচারী) করেন এবং প্রণবজপ, উপনিষদ্ প্রভৃতি শাস্ত্রপাঠাদি
কর্মে নিয়ত প্রচেষ্টা করেন, যাঁহার স্বপ্ন (নিদ্রা) ও অববোধ (জাগরণ) নিয়মিত (অর্থাৎ
কালে ও পরিমাণে নির্দিষ্ট, যথা- রাত্রির আদি ও অন্ত ভাগে জাগরণ এবং মধ্যভাগে নিদ্রা),
তাঁহার ধ্যানযোগ সর্বসংসারদুঃখের হরণ করে বলিয়া দুঃখহা। ১৭
ব্যাখ্যা- আহারশুদ্ধি বস্তুতঃ কি? এই বিষয়ে সামবেদীয় ছান্দোগ্য শ্রুতি বলিতেছেন-"আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ, স্মৃতিলম্ভে সর্বগ্রন্থীনাং বিপ্রমোক্ষঃ"-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭।২৬।২) শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন-'যাহা আহৃত বা আহরণ করা যায়, তাহাই আহার অর্থাৎ শব্দাদিবিষয়ক জ্ঞান যাহা ভোক্তার ভোগের নিমিত্ত আহৃত হইয়া থাকে। শব্দাদি ভোগ্যবিষয়ের উপলব্ধিরূপ যে বিজ্ঞান তাহার শুদ্ধিকেই আহারশুদ্ধি বলে, অর্থাৎ রাগদ্বেষ মোহ প্রভৃতি দোষ দ্বারা অসংস্পৃষ্ট বিষয়রূপ ভোগ্যবিষয়সমূহের বিজ্ঞান বা উপলব্ধি বা অনুভূতি। সেই আহার বিশুদ্ধ হইলে তদ্বিশিষ্ট জ্ঞানীর সত্ত্বশুদ্ধি অর্থাৎ অন্তঃকরণের নির্মলতা সিদ্ধ হয়। সত্ত্বশুদ্ধি হইলে ভূমানামক আত্মার স্বরূপ, যাহা একবার ধারণা করা গিয়াছে, সে সম্বন্ধে ধ্রুব বা অবিচ্ছিন্ন স্মৃতি-ধারা উপস্থিত হয় অর্থাৎ জ্ঞাত বিষয়ের আর কখনও ভুল হয় না। সেই ধ্রুবা স্মৃতি লাভ হইলে অবিদ্যাকৃত সর্বানর্থপাশরূপ জন্মজন্মান্তরীয় অনুভব এবং ভাবনার দ্বারা কঠিনীকৃত হৃদয়াশ্রিত গ্রন্থিসকলের বিপ্রমোক্ষ অর্থাৎ বিশেষভাব মোক্ষণ বা বিনাশ হইয়া থাকে। যেহেতু আহারশুদ্ধি উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত এই সমস্ত সাধনের মূল, এইজন্য আহারশুদ্ধি বিশেষরূপে কর্ত্তব্য।
এক্ষণে যোগী কখন সমাধিস্থ হইয়া থাকেন তাহা বলা
হইতেছে-
যদা বিনিয়তং চিত্তমাত্মন্যেবাবতিষ্ঠতে ৷
নিঃস্পৃহঃ সর্বকামেভ্যো যুক্ত ইত্যুচ্যতে তদা ৷৷
১৮ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- যখন বিনিয়ত-চিত্ত
অর্থাৎ বিশেষভাবে নিয়ত, সংযত, একাগ্রতা সম্পন্ন চিত্ত বাহ্য চিন্তা ত্যাগ করিয়া কেবল
আত্মাতেই অবস্থান করে অর্থাৎ স্বীয় আত্মাতেই স্থিতি লাভ করে, সেই সময়ে সর্ব্বকামনা
হইতে নিস্পৃহ অর্থাৎ দৃষ্ট ও অদৃষ্ট বিষয় হইতে যে যোগীর স্পৃহা বা তৃষ্ণা নির্গত হইয়াছে
তিনিই যুক্ত সমাহিত, এইরূপ বলা হইয়া থাকে। ১৮
সেই যোগীর যে সমাহিত চিত্ত তাহার উপমা বলা হইতেছে-
যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপমা স্মৃতা ৷
যোগিনো যতচিত্তস্য যুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ ৷৷ ১৯ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- নিবাতস্থ অর্থাৎ
বায়ুপ্রবাহ বর্জিত স্থানে অবস্থিত প্রদীপ যেমন কম্পিত হয় না, সংযত অন্তঃকরণের অর্থাৎ
আত্মার সমাধিতে অবস্থানকারী যোগীর একাগ্রীভূত চিত্তেরও সেই উপমা জানিবে, সেই উপমা চিত্ত-গতির
প্রত্যক্ষদর্শী যোগবেত্তাগণ কর্ত্তৃক স্মৃত বা চিন্তিত হইয়াছে। ১৯
এইরূপ যোগাভ্যাসবলহেতু একাগ্রীভূত নিবাত প্রদীপকল্প
হইয়াছে এমন যে-
যত্রোপরমতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগসেবয়া ৷
যত্র চৈবাত্মনাত্মানং পশ্যন্নাত্মনি তুষ্যতি ৷৷
২০ ৷৷
সুখমাত্যন্তিকং যত্তদ্বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম্
৷
বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ ৷৷
২১ ৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- যখন যোগানুষ্ঠানের
দ্বারা চিত্ত উপরতি প্রাপ্ত হয় এবং নিরুদ্ধ অর্থাৎ সর্বতোভাবে তাহার প্রচার বা চঞ্চলতা
নিবারিত হয় এবং যখন সমাধিপরিশুদ্ধ অন্তঃকরণের দ্বারা পরম চৈতন্য জ্যোতিঃস্বরূপ আত্মাকে
উপলব্ধি করিয়া যোগী নিজের আত্মাতেই তুষ্ট হন, তথা যে সুখ অত্যন্ত অর্থাৎ অন্তরহিত অনন্ত,
সেই আত্যন্তিক সুখ বাহ্য ইন্দ্রিয় ব্যতিরেকে কেবলমাত্র বুদ্ধিদ্বারা গৃহীত হয় ও ইন্দ্রিয়গোচরাতীত
অর্থাৎ অবিষয়জনিত ঈদৃশ সুখ যখন যোগী অনুভব করেন, তখন আত্মস্বরূপে স্থিতিহেতু এই বিদ্বান
তত্ত্বস্বরূপে সংস্থিতি হইতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না। ২০, ২১
পূর্ব্বের ‘যত্রোপরমতে’-(গীতা ৬।২০) শ্লোক হইতে
আরম্ভ করিয়া এই শ্লোকদ্বয় পর্য্যন্ত যাবতীয় বিশেষণ দ্বারা বিশিষ্ট আত্মার অবস্থাবিশেষকে
যোগ বলা হইয়াছে-
যং লব্ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ ৷
যস্মিন্স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ৷৷
২২ ৷৷
তং বিদ্যাদ্ দুঃখসংযোগবিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম্ ৷
স নিশ্চয়েন যোক্তব্যো যোগোনির্বিণ্ণচেতসা ৷৷ ২৩
৷৷
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- যাহা লাভ করিয়া
অর্থাৎ যে আত্মলাভ করিয়া যোগী অন্য লাভ তদপেক্ষা অধিক মনে করেন না, কারণ আত্মলাভ অপেক্ষা
পুরুষার্থভূত লাভ্যান্তর নাই। এবং যে আত্মতত্ত্বে স্থিত হইয়া শস্ত্রনিপাতাদিরূপ মহাদুঃখেও
বিচলিত হন না সেই দুঃখসংযোগের বিয়োগ অর্থাৎ দুঃখের আত্যন্তিক নিরোধরূপ সেই আত্মস্থিতিকে
যোগ বলিয়া জানিবে। নির্বেদশূন্য চিত্তে অধ্যবসায় সহকারে এই যোগাভ্যাস করা উচিত। ‘এতকালেও
তো আমার যোগসিদ্ধি হইল না, ইহা অপেক্ষা কষ্টের কি আছে’- এইরূপ যে অনুতাপ তাহাই নির্বেদ।
এইরূপ নির্বেদরহিত চিত্তে এবং ‘ইহজন্মেই হোক অথবা জন্মান্তরেই হোক, অবশ্যই যোগসিদ্ধি
হইবে, ত্বরায় প্রয়োজন কি’-এইরূপ ধৈর্য্যযুক্ত মনে যোগাভ্যাস করিতে হয়। ২২, ২৩
এক্ষণে যোগের পরম বিধি বলিতেছেন—
সঙ্কল্পপ্রভবান্কামাংস্ত্যক্ত্বা সর্বানশেষতঃ ৷
মনসৈবেন্দ্রিয়গ্রামং বিনিয়ম্য সমন্ততঃ ৷৷২৪।।
শনৈঃ শনৈরুপরমেদ্ বুদ্ধ্যা ধৃতিগৃহীতয়া ৷
আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ ৷৷
২৫ ৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- সঙ্কল্পজাত সমস্ত
কামনা নিঃশেষে নির্লিপ্তভাবের দ্বারা পরিত্যাগ করিয়া বিবেকযুক্ত মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহকে
সর্ব্বদিক হইতে নিয়মিত করিয়া, ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধি দ্বারা মনকে ধীরে ধীরে উপরত করিবে
(অর্থাৎ সহসা চিত্তকে উপরত করিবার চেষ্টা করিবে না) এবং 'আত্মাতে যিনি সংস্থিত অর্থাৎ
আত্মাই সব, তদ্ভিন্ন আর কিছুই নাই'— মনকে এইরূপ আত্মসংস্থ করিয়া অন্য কিছুই চিন্তা
করিবে না— এই হইতেছে যোগের পরম বিধি। ২৪,২৫
এই প্রকারে মনকে আত্মসংস্থ করিবার জন্য প্রবৃত্ত
যোগী—
যতো যতো নিশ্চরতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্ ৷
ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশং নয়েৎ ৷৷ ২৬ ৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- চঞ্চল ও অস্থির
মন স্বভাবদোষবশতঃ যে যে শব্দাদি বিষয়ে ধাবিত হয় সেই সেই বিষয় হইতে নিবৃত্ত করিয়া ইহাকে
আত্মাতেই বশীভূত করেন। শব্দাদি বিষয়ের যাথাত্ম্য অর্থাৎ তাহাদের স্বরূপ নিরূপণের দ্বারা
তাহাদিগকে মিথ্যা প্রমাণ করিয়া বৈরাগ্য ভাবনা দ্বারা মনকে আত্মবশে আনিতে হয়। এইরূপ
যোগাভ্যাস বলে যোগিগণ আত্মাতেই মনকে প্রশমিত করিয়া থাকেন। ২৬
প্রশান্তমনসং হ্যেনং যোগিনং সুখমুত্তমম্ ৷
উপৈতি শান্তরজসং ব্রহ্মভূতমকল্মষম্ ৷৷২৭৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- প্রশান্তচিত্ত, মোহাদি ক্লেশরূপ রজোবৃত্তিশূন্য, নিষ্পাপ (ধর্ম্মাধর্ম্মাদিবর্জ্জিত) ও জীবন্মুক্ত অর্থাৎ 'ব্রহ্মই সব'—এইরূপ নিশ্চয়বন্ত যোগীই উত্তম (নিরতিশয়) সুখ প্রাপ্ত হন। ২৭
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী বিগতকল্মষঃ ৷
সুখেন ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমশ্নুতে ৷৷২৮৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- এইভাবে যথোক্তক্রমে মনকে সদা যোগস্থ করিয়া যোগান্তরায়-বর্জ্জিত নিষ্পাপ যোগী অনায়াসে ব্রহ্মসংস্পর্শজনিত অর্থাৎ পরব্রহ্মের সহিত স্পর্শ অর্থাৎ তাদাত্ম্য (অভিন্নতা) যাহাতে আছে বা বিষয়সংস্পর্শবিহীন ব্রহ্মস্বরূপে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট নিরতিশয় সুখ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। ২৮
ব্যাখ্যাঃ- এখানে ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য 'যোগান্তরায়বর্জ্জিত' শব্দটি উল্লেখ করেছেন। যোগসূত্রকার
ভগবান পতঞ্জলি যোগান্তরায়গুলি বলিতেছেন- 'ব্যাধিস্ত্যানসংশয়প্রমাদালস্যাবিরতিভ্রান্তিদর্শনালব্ধ-ভূমিকাত্বানবস্থিতত্বানি
চিত্তবিক্ষেপাস্তেহন্তরায়াঃ।।' (পাতঞ্জল যোগসূত্র-১/৩০) অর্থাৎ রোগব্যাধি, চিত্তের অকর্মণ্যতা অর্থাৎ মানসিক জড়তা, সংশয়, প্রমাদ
(উদ্যমরাহিত্য) অর্থাৎ সমাধির সাধনের অননুষ্ঠান, আলস্য, অবিরতি বা বিষয়তৃষ্ণা, ভ্রান্তিদর্শন
অর্থাৎ বিপর্যয়জ্ঞান, একাগ্রতা লাভ না করা, ঐ অবস্থা লাভ হইলেও তাহা হইতে পতিত হওয়া-এইগুলিই
চিত্তবিক্ষেপকর অন্তরায়।
চিত্ত-বিক্ষেপগুলির প্রতিষেধক কি? ভগবান পতঞ্জলি যোগদর্শনের সমাধিপাদে বলেছেন—তৎপ্রতিষেধার্থমেকতত্ত্বাভ্যাসঃ।।৩২।।-ইহা প্রতিষেধার্থ ‘এক-তত্ত্ব’ অভ্যাস আবশ্যক। যোগসূত্রের ভাষ্যকার ব্যাস বলেছেন— "চিত্ত-বিক্ষেপগুলি প্রতিষেধের জন্য এক-তত্ত্বের অবলম্বন অভ্যাস করতে হবে।" এক-তত্ত্ব অভ্যাস বিষয়ে বাচষ্পতিজী বলেছেন, 'তা ঈশ্বরই তত্ত্ব হিসেবে প্রধান আলম্বন।' ভোজরাজ লিখেছেন— 'যেকোনো একটি অভিমত তত্ত্বে অভ্যাস, অর্থাৎ বারংবার একটি তত্ত্বে চিত্তের নিবেশন বা স্থাপন।'
এখন প্রশ্ন অভ্যাস কি? ভগবান পতঞ্জলি সমাধিপাদেই বলেছেন— তত্র স্থিতৌ যত্নোহভ্যাসঃ ।।১৩।। -ঐ বৃত্তিগুলিকে সম্পূর্ণরূপে বশে রাখিবার যে নিয়ত চেষ্টা, তাহাকে ‘অভ্যাস’ বলে। ভগবান ভাষ্যকার ব্যাস বলেছেন—"বৃত্তিশূন্য হয়েছে এমন চিত্তের প্রশান্তবাহিতা বিমলধারার মত অবস্থান হল স্থিতি। সেই স্থিতির জন্য অদম্য চেষ্টা, বীর্য ও উৎসাহ চাই। সেই স্থিতি সম্পাদনের ইচ্ছায়, তার জন্য সাধনাত্মক অনুষ্ঠান হল অভ্যাস।" এখন প্রশ্ন শাস্ত্রসহায়ে এই যে চিত্তের পরিষ্কার ধারার নির্দেশ অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধ করার প্রণালী তা কিভাবে? ভগবান পতঞ্জলি সমাধিপাদেই বলেছেন—মৈত্রী-করুণা-মুদিতোপেক্ষাণাং সুখদুঃখপুণ্যা-পুণ্যবিষয়াণাং ভাবনাতশ্চিত্তপ্রসাদনম্ ।।৩৩।। -সুখী, দুঃখী, পুণ্যবান্ ও পাপীর প্রতি যথাক্রমে বন্ধুতা, দয়া, আনন্দ ও উপেক্ষার ভাব ধারণ করিতে পারিলে চিত্ত প্রসন্ন হয়।
ইদানিং যোগের যে ফল ব্রহ্মৈকত্বদর্শন, যাহা সর্ব্বসংসার
বিচ্ছেদের কারণ তাহাই প্রদর্শিত হইতেছে—
সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি৷
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ৷৷২৯৷৷
"শাঙ্করভাষ্য" অনুসারে ভাবার্থঃ—সর্বত্র
সমদর্শী যোগযুক্তাত্মা অর্থাৎ সমাহিত অন্তঃকরণ যাঁহার এইরূপ যোগযুক্ত পুরুষ সর্বভূতে
স্থিত স্বীয় আত্মাকে এবং ব্রহ্মাদিস্থাবর পর্য্যন্ত সর্বভূতসকলকে স্বীয় আত্মাতে একতাপ্রাপ্ত
দর্শন করেন। ব্রহ্মাদিস্থাবরান্তে বিভক্ত সর্বভূতে সম অর্থাৎ নির্বিশেষ ব্রহ্মাত্মৈকত্ব
(জীব ও ব্রহ্মের একত্ব) বিষয়ক দর্শনরূপ জ্ঞান যাঁহার তিনিই সর্বত্র সমদর্শী। ২৯
এই আত্মৈকত্ব দর্শনের ফল বলা হইতেছে—
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি৷
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি ৷৷ ৩০
৷।
"শাঙ্করভাষ্য" অনুসারে ভাবার্থঃ—যিনি
আমাকে (বাসুদেবকে) সর্ব্বত্র সর্ব্বভূতে সকলের আত্মস্বরূপে দর্শন করেন এবং সর্ব্বাত্মা
আমাতে ব্রহ্মাদি যাবতীয় ভূতসমূহকে দর্শন করেন, সেই বিদ্বান আত্মৈকত্ব-দর্শীর নিকট
আমি (ঈশ্বর) কখন প্রণষ্ট হই না অর্থাৎ কখনও পরোক্ষ বা অদৃশ্য হই না এবং তিনিও আমার
নিকট প্রণষ্ট (অদৃশ্য) হন না। কেন? তাঁহার ও আমার একাত্মতা হেতু। ইহা সর্ব্বজনসিদ্ধ
যে আত্মা আত্মার প্রিয়ই হইয়া থাকে; কারণ সর্ব্বাত্মৈক্যদর্শী আমা হইতে ভিন্ন নহেন।
৩০
পূর্ব্বশ্লোকার্থ যে সম্যগ্ দর্শন বর্ত্তমান শ্লোকে
তাহারই অনুবাদ করিয়া তাহার ফল যে মোক্ষ ইহার বিধান করিতেছেন—
সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ৷
সর্বথা বর্তমানোপি স যোগী ময়ি বর্ততে ৷৷ ৩১ ৷৷
"শাঙ্করভাষ্য" অনুসারে ভাবার্থঃ—যিনি
সর্বভূতে প্রত্যগাত্মরূপে অবস্থিত আমাকে স্বীয় আত্মরূপে অভেদজ্ঞানে ভজনা করেন, অর্থাৎ
'আমিই সেই' - এইরূপ অপরোক্ষানুভব করেন, সেই সম্যগ্দর্শী যোগী সর্বথা অর্থাৎ সর্ব্বপ্রকার
অবস্থার সহিত বর্ত্তমান থাকিয়াও আমাতে অর্থাৎ বৈষ্ণব পরম পদে বর্ত্তমান থাকেন। তিনি
নিত্য মুক্তই, তাঁহার মোক্ষের প্রতিবন্ধক কিছুই হইতে পারে না । ৩১
আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং
পশ্যতি যোর্জুন ৷
সুখং বা যদি বা দুঃখং সঃ
যোগী পরমো মতঃ৷৷ ৩২ ৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- আত্ম ঔপম্যের দ্বারা অর্থাৎ আত্মা নিজেই তুলিত
হন নিজের দ্বারা এই জন্য আত্মা নিজেই নিজের উপমা, সেই উপমার ভাব ঔপম্য;
হে
অর্জুন! এই আত্মঔপম্যের দ্বারা যিনি সর্বত্র অর্থাৎ সর্বভূতে সম অর্থাৎ তুল্য দেখেন, যেমন আমার সুখ অনুকূল ও আমার দুঃখ প্রতিকূল, তেমনি সকল প্রাণীর সুখ অনুকূল ও দুঃখ
প্রতিকূল - ইহা জানিয়া তিনি সকল প্রাণীর সুখ আকাঙ্ক্ষা করেন এবং কোন প্রাণীর দুঃখ
ইচ্ছা করেন না। সুতরাং তাঁহার প্রবৃত্তি অন্যের দুঃখের কারণ হয় না; বরং অন্যের দুঃখের নিবৃত্তির কারণ হয়। যিনি
এইরূপ অহিংসক সম্যগ্ দর্শননিষ্ঠ,
সেই
যোগীই সমস্ত যোগীদের মধ্যে পরম অর্থাৎ উৎকৃষ্ট, ইহাই আমার মত অর্থাৎ অভিপ্রায়।
এই যথোক্ত
সম্যগ্দর্শনলক্ষণ যোগের দুঃখসম্পাদ্যতা দেখে তার প্রাপ্তির নিশ্চিত উপায়
শ্রবণেচ্ছু—
অর্জুন উবাচ
যোয়ং যোগস্ত্বয়া
প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন ৷
এতস্যাহং ন পশ্যামি
চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্ ৷৷ ৩৩ ৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- অর্জ্জুন কহিলেন— সাম্য অর্থাৎ সমত্বযুক্ত এই যে যোগ তোমাকর্তৃক
প্রকৃষ্টরূপে বলা হইল, হে মধুসূদন! এই
যোগের সমাধান আমি দেখছি না অর্থাৎ উপলব্ধি করিতে পারিতেছি না। কেন?— মনের চঞ্চলতাহেতু। কি সমাধান দেখিতে পারিতেছ
না?—স্থির অচলা স্থিতি; কারণ মনের এই চঞ্চলতা প্রসিদ্ধ।
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্ ৷
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্ ৷৷ ৩৪ ৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- হে কৃষ্ণ, মন
অতি চঞ্চল, প্রবল এবং শরীর ও
ইন্দ্রিয়াদির বিক্ষেপ-উৎপাদক । ইহাকে বিষয়বাসনা
হইতে নিবৃত্ত করা অতিশয় কঠিন
। সেইজন্য উহার নিরোধ আকাশস্থ
বায়ুকে পাত্রবিশেষে আবদ্ধ করার ন্যায় দুঃসাধ্য
মনে করি । ৩৪
শ্রীভগবানুবাচ—
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলং৷
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ
চ গৃহ্যতে৷৷ ৩৫ ৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- শ্রীভগবান্ কহিলেন— "হে মহাবাহো! মন
যে দুর্নিরোধ ও চঞ্চল তাহাতে
কোন সংশয় নাই। কিন্তু হে
কৌন্তেয়! অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা
ইহার নিগ্রহ সম্ভব হইতে পারে। অভ্যাস
বলিতে চিত্তভূমিতে চিত্তের কোন বৃত্তির একই
প্রত্যয়ের অর্থাৎ একজাতীয় বুদ্ধিবৃত্তির বারংবার আবৃত্তি। বৈরাগ্য বলিতে দৃষ্ট, অদৃষ্ট ও ইষ্ট ভোগে
দোষদর্শনের অভ্যাসহেতু বিতৃষ্ণা। সেই বৈরাগ্যের দ্বারা
বিক্ষেপরূপ চিত্তের প্রচারকে অর্থাৎ সঙ্কল্পবিকল্পকে গ্রহণ করা যায়। অর্থাৎ
এই প্রকারে মনের চাঞ্চল্যকে নিগ্রহ
অর্থাৎ নিরোধ করা যায়।" ৩৫
অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি
মে মতিঃ ৷
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোবাপ্তুমুপায়তঃ৷।
৩৬।।
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- অসংযতাত্মা অর্থাৎ অভ্যাস এবং বৈরাগ্যের দ্বারা
সংযত নহে এমন যে
আত্মা অর্থাৎ অন্তঃকরণ যাহার, তাহার দ্বারা যোগ দুষ্প্রাপ্য অর্থাৎ
দুঃখের দ্বারা প্রাপ্ত হইয়া থাকে—ইহাই আমার
অভিমত। পুনশ্চ যিনি বশ্যাত্মা অর্থাৎ
অভ্যাস এবং বৈরাগ্যের দ্বারা
যাঁহার আত্মা (মন) বশ্যত্ব প্রাপ্ত
হইয়াছে, যিনি পুনঃপুনঃ প্রযত্নশীল,
তিনি যথোক্ত উপায়ের দ্বারা যোগ প্রাপ্তিতে সমর্থ।
অর্জুন
উবাচ
অযতিঃ
শ্রদ্ধযোপেতো
যোগাচ্চলিতমানসঃ ৷
অপ্রাপ্য
যোগসংসিদ্ধিং
কাং
গতিং
কৃষ্ণ
গচ্ছতি ৷৷৩৭৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- হে কৃষ্ণ! যিনি
শ্রদ্ধাবান্ অর্থাৎ আস্তিক্যবুদ্ধিযুক্ত অথচ যোগমার্গে যত্নের
শিথিলতাবশতঃ যোগ হইতে ভ্রষ্টচিত্ত হওয়ায় সম্যগ্ দর্শনরূপ যোগসিদ্ধি লাভে অসমর্থ হন, তিনি কি প্রকার গতি
প্রাপ্ত হন?
কচ্চিন্নোভয়বিভ্রষ্টশ্ছিন্নাভ্রমিব
নশ্যতি ৷
অপ্রতিষ্ঠো
মহাবাহো
বিমূঢ়ো ব্রহ্মণঃ
পথি
৷৷ ৩৮ ৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- হে মহাবাহো! ব্রহ্মপ্রাপ্তির
পথে কর্মমার্গ ও যোগমার্গ হইতে
বিভ্রষ্ট, বিমূঢ় ও নিরাশ্রয় যোগী
ছিন্ন অভ্র মেঘখণ্ডের ন্যায় কি বিনষ্ট হন?
এতন্মে
সংশয়ং
কৃষ্ণ
ছেত্তুমর্হস্যশেষতঃ
৷
ত্বদন্যঃ
সংশয়স্যাস্য
ছেত্তা
ন
হ্যুপপদ্যতে
৷৷ ৩৯ ৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- হে কৃষ্ণ! আমার
এই সংশয় নিঃশেষে দূর করিতে একমাত্র আপনিই সমর্থ। কারণ আপনি ভিন্ন অন্য কোনও ঋষি বা দেবতা আমার
এই সংশয় দূর করিতে পারিবেন না।
শ্রীভগবানুবাচ—
পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে ৷
নহি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্দুর্গতিং তাত গচ্ছতি ।। ৪০।।
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ-শ্রীভগবান্ বলিলেন—হে পার্থ! যোগভ্রষ্ট
ব্যক্তির ইহলোকে কি পরলোকে কুত্রাপি
বিনাশ নাই অর্থাৎ পূর্বজন্ম
হইতে হীনজন্ম প্রাপ্তি সেই যোগভ্রষ্টের হয় না। কারণ, হে তাত (বৎস)!
কল্যাণকৃৎ অর্থাৎ শুভকর্মকারী পুরুষ কখনও দুর্গতি প্রাপ্ত হন না। ৪০
সেই শ্রদ্ধাবান অথচ যত্নহীন যোগভ্রষ্টের দেহত্যাগের পর কিরূপ গতি
হয়ে থাকে?
প্রাপ্য পুণ্যকৃতাং লোকানুষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ ৷
শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোভিজায়তে ৷৷ ৪১ ।।
'শাঙ্করভাষ্য' অনুযায়ী ভাবার্থঃ- যোগমার্গে প্রবৃত্ত সন্ন্যাসী (অল্পকাল যোগাভ্যাসী) সামর্থ্যহেতু পুণ্যকৃৎ অশ্বমেধাদি যাজীদের লোকসকলে গমন করিয়া তথায় বহু বৎসর বাস করেন, সেই ভোগক্ষয়ে পুনরায় শুচি অর্থাৎ শাস্ত্রানুমোদিত কর্ম্মকারী এবং শ্রীমান্ অর্থাৎ বিভূতিমানদের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। ৪১
অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্ ৷
এতদ্ধি দুর্লভতরং লোকে জন্ম যদীদৃশম্ ।।৪২।।
'শাঙ্করভাষ্য' অনুযায়ী ভাবার্থঃ- অথবা, যোগভ্রষ্ট পুরুষ বুদ্ধিমান্ যোগিগণের কুলে জন্মগ্রহণ করেন। ঈদৃশ জন্ম জগতে অতি
দুর্লভ। কারণ ধনীর গৃহাপেক্ষা দরিদ্র যোগিগণের কুলে জন্ম সত্যিই দুর্লভ। ৪২
তত্র তং বুদ্ধিসংযোগং লভতে পৌর্বদেহিকম্ ৷
যততে চ ততো ভূয়ঃ সংসিদ্ধৌ কুরুনন্দন ৷৷ ৪৩ ৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুযায়ী ভাবার্থঃ- হে কুরুনন্দন, যে
কারণে সেই যোগিগণের কুলে
বুদ্ধিসংযোগ অর্থাৎ পূর্ব্ব জ্ঞানের সংস্কার লাভ করিয়া থাকে; ঐ সংস্কার কি প্রকার?
পৌর্ব্বদেহিক অর্থাৎ পূর্ব্বজন্মের দেহে উৎপন্ন, সেই কারণে সেই সংস্কারের বশে যোগসিদ্ধি লাভ করিবার নিমিত্ত বহুতর প্রযত্ন করিয়া
থাকেন। ৪৩
পূর্ব্বদেহের বুদ্ধিসংযোগ কি প্রকারে
হয়?
পূর্বাভ্যাসেন তেনৈব হ্রিযতে হ্যবশোপি সঃ ৷
জিজ্ঞাসুরপি যোগস্য শব্দব্রহ্মাতিবর্ততে ৷৷ ৪৪ ।৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুযায়ী ভাবার্থঃ- তিনি (যোগভ্রষ্ট) পূর্বজন্মের অভ্যাসবশে যেন অবশ হইয়াও
যোগসাধনে প্রবৃত্ত হন । যোগের
স্বরূপ জানিতে ইচ্ছুক হইয়া যোগমার্গে প্রবৃত্ত
যোগভ্রষ্টও বেদোক্ত যজ্ঞানুষ্ঠানের ফল অতিক্রম করেন
। আর যিনি যোগের
স্বরূপ জানিয়া তন্নিষ্ঠ হইয়া যোগাভ্যাস করেন,
তাঁহার সাফল্যের নিশ্চয়তা বলাই বাহুল্য ।
৪৪
কেন যোগিত্ব শ্রেয়?
প্রযত্নাদ্যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিল্বিষঃ৷
অনেকজন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্ ৷ ৷৪৫ ৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুযায়ী ভাবার্থঃ- যোগী ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত
যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্ন করিয়া পাপমুক্ত
হইয়া পূর্ব পূর্ব জন্মের সাধনসঞ্চিত সংস্কার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করিয়া মোক্ষপ্রাপ্ত হন ।
তপস্বিভ্যোধিকো যোগী জ্ঞানিভ্যোপি মতোধিকঃ৷
কর্মিভ্যশ্চাধিকো যোগী তস্মাদ্যোগী ভবার্জুন৷৷ ৪৬
যোগিনামপি সর্বেষাং মদ্গতেনান্তরাত্মনা৷
শ্রদ্ধাবান্ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ৷৷ ৪৭
শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- যোগী কৃচ্ছ্র চান্দ্রায়ণাদি
তপোনিষ্ঠ ব্যক্তিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণ অপেক্ষা এবং অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞপরায়ণ
কর্মিগণ অপেক্ষাও যোগী শ্রেষ্ঠ। অতএব
হে অর্জুন! তুমি যোগী হও।
যিনি শ্রদ্ধার সহিত মদ্গত চিত্তে
অর্থাৎ বাসুদেব আমাতে সমাহিত অন্তঃকরণের দ্বারা আমার ভজনা করেন
অর্থাৎ সেবা করেন, তিনি
রুদ্রাদিত্যাদি দেবতাগণের ধ্যানপরায়ণ সকল যোগীর মধ্যে
অতিশয় যুক্ত, ইহা আমার অভিপ্রায়।
ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসম্বাদে সন্ন্যাসযোগো নাম ষষ্ঠোঽধ্যায়।
ॐ নমো ভগবতে বাসুদেবায়।
॥ শ্রীবেদব্যাসায় নমঃ ॥ শ্রীশঙ্করভগবত্পাদাচার্যস্বামিনে নমঃ ॥