Wednesday, 25 December 2024

দৃগ্দৃশ্যবিবেকঃ

 


অদ্বৈতবেদান্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকরণ হল এই দৃগ্দৃশ্যবিবেক। বাক্যসুধা অবলম্বনে এটির সারমর্ম প্রকাশের চেষ্টা করব। সংসারে সকল রূপই কেবল দৃশ্য। সেই রূপের গ্রাহক চক্ষু, নিজ বিষয় রূপের সাথে সম্বন্ধ ধরে দ্রষ্টা হয়। নানাত্বই দৃশ্যত্বের হেতু এবং একত্বই দ্রষ্টৃত্বের হেতু। সেই কারণে রূপসমূহ নীল, পীত ইত্যাদি অনেকপ্রকার ভেদবশতঃ নানাত্বহেতু দৃশ্য বলে গণ্য হয়। বহুপ্রকার দৃশ্য হতে তাদের দ্রষ্টৃরূপে অবধৃত সেই চক্ষুও সাক্ষাৎ দ্রষ্টা নয়। কেননা, চক্ষুর দ্রষ্টা মনের বাইরে চক্ষুর অস্তিত্বই নেই। একই পুরুষে নেত্রেন্দ্রিয় এক অবস্থায় থাকে না। তা কখনো অন্ধ, কখনো মন্দ ইত্যাদি অবস্থান্তর প্রাপ্ত হয়ে বিকৃত হয় এবং যা বিকারী, তার পক্ষে স্বকীয় বিকারের দ্রষ্টা হওয়া সম্ভব নয়। সেই চক্ষুরও যে দ্রষ্টা, তার অন্বেষণ করতে গেলে পাওয়া যায়, মন তার দ্রষ্টৃরূপে তার সাথে সম্বদ্ধ। সেই প্রকারে আবার সেই চক্ষু ইন্দ্রিয় নিজের অপেক্ষা আভ্যন্তর মনের দৃশ্য হয় এবং মন নিজপ্রকাশ্য চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্বন্ধ ধরে দ্রষ্টা হয়।

আবার চক্ষুরাদির ন্যায় মনও অন্য কারও দৃশ্য। বৃহদারণ্যক শ্রুত্যোক্ত কাম, সঙ্কল্প, সন্দেহ, শ্রদ্ধা, অশ্রদ্ধা, ধৃতি, অধৃতি, লজ্জা, প্রজ্ঞা, ভয় ইত্যাদি মনোবৃত্তিসমূহ অবিদ্যার কার্য বলে জড়স্বরূপ, সেহেতু তারা দৃশ্য। কেননা 'আমার মন অন্যত্র গিয়েছে', এরূপ অনুভব হয়, আর শ্রুতিও বলছেন'অন্যত্রমনা অভূবং নাদর্শম্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-//) লোকে বলে 'আমি অন্যমনস্ক ছিলাম, দেখি নি' এর দ্বারা সিদ্ধ হলো মনের অস্তিত্বও অন্য দ্রষ্টার অধীন। সেই মন বা মনোবৃত্তিসমূহের 'সাক্ষী' চিদাত্মাই হল 'দৃক'—দ্রষ্টা বা প্রকাশক। সেই সাক্ষী বা কূটস্থচৈতন্য কিন্তু দ্রষ্টাই থাকে, কখনো কারো দৃশ্য হয় না। এই চৈতন্যের উদয় (জন্ম) নেই, অস্ত (তিরোভাব) নেই, বৃদ্ধি নেই, ক্ষয় নেই; যা স্বয়ংপ্রকাশ এবং সাধননিরপেক্ষ হয়ে অপর সকল বস্তুকে প্রকাশ করে থাকে।

কূটস্থচৈতন্য সর্বাপেক্ষা আভ্যন্তর বলে এবং তার অভ্যন্তরে সেই কূটস্থকে দৃশ্য করবার মতো অন্য কোন দ্রষ্টা নেই বলে কূটস্থে যে দ্রষ্টৃত্ব বর্তমান রয়েছে, তাই চরম দ্রষ্টৃত্ব। সেহেতু চক্ষু মনে যে আপেক্ষিক দ্রষ্টৃত্ব বর্তমান, কূটস্থের দ্রষ্টৃত্ব তা হতে বিলক্ষণ। সাক্ষী বা কূটস্থের দৃশ্যত্ব কোন প্রমাণগোচর নয়; সেহেতু কূটস্থ ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমানএই তিন কালেই দ্রষ্টা, দ্রষ্টৃত্বই তার স্বরূপ। 'তদ্বা এতদক্ষরং গার্গ্যদৃষ্টং দ্রষ্ট্রশ্রুতং শ্রোত্রমতং মন্ত্রবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতৃ...' (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-//১১)সে- এই অক্ষর হচ্ছেন অপরের অদৃষ্ট (দৃষ্টিগোচর হন না) অথচ নিজে সকলের দ্রষ্টা; অপরের অশ্রুত (শ্রুতিগোচর হন না), অথচ নিজের সকলের শ্রোতা, এরূপ অপরের মনোবৃত্তির অগোচর, কিন্তু নিজে সকলকে মনন করেন। বুদ্ধিবৃত্তির অগোচর বলে অবিজ্ঞাত, অথচ নিজে সকলের বিজ্ঞাতা। আরও বলা হয়েছে

' দৃষ্টের্দ্রষ্টারং পশ্যের্ন শ্রুতেঃ শ্রোতরং শৃণুয়া মতের্মন্তারং মন্বীথা বিজ্ঞাতের্বিজ্ঞাতারং বিজানীয়াঃ।'(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-//)

অতএব দৃষ্টির অর্থাৎ চক্ষুরিন্দ্রিয়জজ্ঞানের যিনি দ্রষ্টা (প্রকাশক) তাঁকে কেউ দেখতে পারেন না, শ্রবণেন্দ্রিয়জজ্ঞানের প্রকাশককে কেউ শ্রবণ করতে পারেন না; মনোবৃত্তিরসংশয়াদির প্রকাশককে মনের দ্বারা কেউ প্রকাশ করতে পারেন না এবং কর্তব্যাকর্তব্য নির্ধারক বুদ্ধিবৃত্তির বোদ্ধাকে বুদ্ধি দ্বারা কেউ জানতে পারেন না।

এরূপ সহস্র সহস্র শ্রুতিবচনের তাৎপর্য দ্বারা উক্ত অর্থই প্রতিপাদিত হয়েছে। এই হেতু 'তুমি' বা 'এই' এরূপ জ্ঞানের আলম্বন অন্তঃকরণ প্রভৃতি বস্তু দৃশ্যই; আর 'আমি' এরূপ জ্ঞানের আলম্বন স্বরূপ প্রত্যক্চৈতন্য (কূটস্থচৈতন্য) স্বরূপত দ্রষ্টা; সেহেতু প্রত্যক্চৈতন্যই পরমব্রহ্ম, এটাই অভিপ্রেতার্থ।।.........

তথ্যসূত্রঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যকৃত (মতান্তরে ভারতী তীর্থ) বাক্যসুধা (দৃগ্দৃশ্যবিবেকঃ) আনন্দ গিরি ব্রহ্মানন্দ ভারতীর টীকা সমেত।

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ১৯, বৃহস্পতিবার, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

Sunday, 15 December 2024

নিরালম্ব শ্রুতিপ্রমাণ ব্যতিরেকে ন্যায় অনুসারে জগৎ মিথ্যাত্বে প্রমাণ কি?

 


জাগতিক প্রপঞ্চের মিথ্যাত্বসাধনে প্রধানতঃ অনুমানই প্রমাণ। এই অনুমানের প্রয়োগ বাক্যটি কিরূপ, তা দেখাতে গিয়ে চিৎসুখাচার্য বলেছেন

অয়ং পটঃ (পক্ষ), এতত্তন্তু নিষ্ঠাত্যন্তাভাবপ্রতিযোগী (সাধ্য), দৃশ্যত্বাৎ (হেতু), ঘটবৎ (দৃষ্টান্ত)

এই পটের (বস্ত্রের) অবয়ব এই যে তন্তু বা সূতা, তাতে এই পটের অত্যন্তাভাব আছে, এবং এই পট সেই অত্যন্তাভাবের প্রতিযোগীও বটে, যেহেতু এটা দৃশ্য, যেমন ঘট। তন্তু বা সূতাগুলো তো আর পট বা বস্ত্র নয়। সূতায় বস্ত্রের অত্যন্তাভাব চিরকালই আছে এবং থাকবে। এইজন্যই আলোচ্য অনুমানে পট বা বস্ত্রকে সাধ্যের আধার অর্থাৎ পক্ষ করে বলা হয়েছে যে, এই পটের উপাদান তন্তুতে এই পটের অত্যন্তাভাব আছে, যেহেতু এই পট দৃশ্য পদার্থ। দৃশ্য পদার্থমাত্রেরই সূক্ষ্ম উপাদানে সকল স্থূল দৃশ্যবস্তুর অত্যন্তাভাব দেখতে পাওয়া যায়। ঘটের উপাদান মাটিতে ঘটের অভাব, কাঞ্চনময় কণ্ঠহারের উপাদান কাঞ্চনে কণ্ঠহারের অভাব, লৌহকুঠারের উপাদান লোহায় কুঠারের অভাব কে না প্রত্যক্ষ করেন? পটে দৃশ্যত্ব থাকায়, দৃশ্যত্ব হেতুর পক্ষ পটে অবস্থিতি (হেতুর পক্ষবৃত্তিত্ব) বুঝা গেল। ঘটেও দৃশ্যত্ব (হেতু) আছে এবং পটের অবয়ব তন্তুতে পটের অত্যন্তাভাবও (উক্ত অনুমানের সাধ্যও) আছে। ঘটেও এইরূপ নিশ্চিত সাধ্য থাকায়, আলোচ্য অনুমানে ঘটকে দৃষ্টান্তরূপে উপন্যাস করা হয়েছে বুঝতে হবে।.......

তথ্যসূত্রঃ- "বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ", তৃতীয়খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী, কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

নভেম্বর ২৪, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...