শ্রীভগবানুবাচ
ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ৷
অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু ৷৷ ১
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- শ্রীভগবান্ বলিলেন— আমি যে বক্ষ্যমাণ বিশেষণযুক্ত পরমেশ্বর—সেই আমাতে আসক্ত-মনা, যোগযুক্ত অর্থাৎ মন-সমাধান-নিরত এবং মদাশ্রয় অর্থাৎ যে কেহ ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ কোন পুরুষার্থের জন্য অর্থী হয়, সে তাহার সাধন— অগ্নিহোত্রাদি তপঃ, দান বা অন্য কোনও কর্ম্মের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া থাকে। কিন্তু ভক্তিযোগী একমাত্র আমারই আশ্রয় গ্রহণ করিয়া থাকে এবং অন্য সাধনান্তর ত্যাগ করিয়া আমাতেই আসক্তমনা হয়। হে পার্থ! তুমি এইরূপ ভক্তিসম্পন্ন হইয়া অসংশয়ে সমস্ত বিভূতি, বল, ঐশ্বর্যাদি গুণসম্পন্ন আমাকে যে প্রকারে জানিবে তাহা শ্রবণ কর।
শ্রোতাকে শ্রোতব্য বিষয়ে অভিমুখী করিবার জন্য ভগবান্ সেই বিবক্ষিত জ্ঞানের স্তুতি করিতেছেন—
জ্ঞানং তেঽহং সবিজ্ঞানমিদং বক্ষ্যাম্যশেষতঃ৷
যজ্জ্ঞাত্বা নেহ ভূয়োঽন্যজ্জ্ঞাতব্যমবশিষ্যতে ৷৷ ২
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- আমার এই স্বরূপজ্ঞান তোমাকে আমি বিজ্ঞানের সহিত অর্থাৎ স্বানুভবের সহিত অশেষতঃ অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে বলিব৷ যে জ্ঞান জানিয়া এই সংসারে ভূয়ঃ অর্থাৎ পুনরায় আর কিছু জ্ঞাতব্য অর্থাৎ পুরুষার্থসাধন অবশিষ্ট থাকে না। এইরূপে যিনি আমার তত্ত্বজ্ঞ তিনি সর্বজ্ঞ হইয়া থাকেন। এইজন্য সর্বজ্ঞত্বরূপ বিশিষ্ট ফলত্বহেতু এই জ্ঞান দুর্লভ।
এই জ্ঞান সুদুর্লভ কেন?
মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিদ্ যততি সিদ্ধয়ে ৷
যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ ৷৷ ৩
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- সহস্র সহস্র অর্থাৎ অনেক মনুষ্যের মধ্যে কেহ কেহ সিদ্ধির (চিত্তশুদ্ধিদ্বারা জ্ঞানোৎপত্তির) নিমিত্ত প্রযত্ন করিয়া থাকে। মোক্ষের নিমিত্ত যত্নশীল সিদ্ধদের মধ্যে আবার কেহ কেহ মাত্র আমাকে তত্ত্বতঃ অর্থাৎ যথাবৎ জানিতে পারেন।
অষ্টধা অপরা প্রকৃতি-
অপরা—যাহা পরা (প্রকৃষ্ট) নহে অর্থাৎ নিকৃষ্টা, অশুদ্ধা, অনর্থকরী ও সংসার-বন্ধনাত্মিকা।
ভূমিরাপোঽনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব
চ ৷
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা ৷৷ ৪
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- ভূমি, অপ্ (জল), অনল (অগ্নি), বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার এই আমার অষ্টবিধা ভিন্না প্রকৃতি। 'ভূমি' শব্দে এখানে পৃথিবী তন্মাত্রের কথা বলা হইতেছে, স্থূল পৃথিবীর কথা নহে। 'অপ' প্রভৃতি ভূতসকল সম্বন্ধে তাহাদের তন্মাত্রকে লক্ষ্য করেই বলা হইতেছে। এইখানে 'মনঃ' শব্দের অর্থে মনের কারণ অহঙ্কারকে লক্ষণার দ্বারা গ্রহণ করিতে হবে। 'বুদ্ধি' শব্দের অর্থ অহঙ্কারের কারণ মহত্তত্ত্বকে গ্রহণ করিতে হইবে। 'অহঙ্কার' পদের দ্বারা অবিদ্যাসংযুক্ত অব্যক্তকে বুঝিতে হইবে। যেমন বিষসংযুক্ত অন্নকে বিষই বলা হয়, সেইরূপ অহঙ্কার বাসনাবৎ অব্যক্ত মূল কারণকে অহঙ্কারই বলা হইতেছে, কারণ অহঙ্কারেরই সর্বকার্যের প্রবর্তকত্ব আছে। লোকে দেখাও যায়, অহঙ্কারই সকলের প্রবৃত্তি-বীজরূপ। এই প্রকারে আমার পূর্বোক্ত প্রকৃতি অর্থাৎ আমার ঐশ্বরী মায়াশক্তি অষ্টপ্রকার ভিন্না অর্থাৎ ব্যবহারিক ভেদ প্রাপ্ত হইয়াছেন।
পরা প্রকৃতি-
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্ ৷
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ৷৷ ৫
"শাঙ্করভাষ্য" অনুসারে ভাবার্থঃ- 'অপরা'— যা পরা নহে অর্থাৎ নিকৃষ্টা, অশুদ্ধা, অনর্থকারী, সংসারবন্ধনাত্মিকা এই যথোক্তা অপরা প্রকৃতি হইতে অন্যা কিন্তু বিশুদ্ধা প্রকৃতি, যাহা আমার আত্মস্বরূপ, তাহাকে অবগত হও। ইহা আমার পরা অর্থাৎ প্রকৃষ্টা, জীবভূতা অর্থাৎ ক্ষেত্রজ্ঞলক্ষণা চেতনদেহের প্রাণধারণনিমিত্তভূতা জীবজগতের অন্তর্যামিনিরূপা প্রকৃতি। হে মহাবাহো! যে অন্তঃপ্রবিষ্টা প্রকৃতি কর্তৃক এই জগৎ ধৃত হইয়া রহিয়াছে, তাহাই আমার পরা প্রকৃতি।
তিনিই যে জগৎকারণ তাথা বলিতেছেন-
এতদ্যোনীনি ভূতানি সর্বাণীত্যুপধারয় ৷
অহং কৃৎস্নস্য জগতঃ
প্রভবঃ প্রলৎস্তথা ৷৷
মত্তঃ পরতরং নান্যৎকিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় ৷
ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব ৷৷ ৬,৭
‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- এই যে পরা
ও অপরা অর্থাৎ ক্ষেত্রজ্ঞ
ও ক্ষেত্র লক্ষণা প্রকৃতিদ্বয় সর্বভূতের যোনি অর্থাৎ কারণ,
ইহা ধারণা কর। যেহেতু আমার
উভয় প্রকৃতি হইতেছে যোনি অর্থাৎ সর্বভূতের
কারণ, এইজন্য আমিই জগতের উৎপত্তি
ও প্রলয়ের কারণ। অর্থাৎ এই প্রকৃতিদ্বয়কে দ্বারস্বরূপ
করিয়া সর্বজ্ঞ ঈশ্বর আমিই জগতের কারণ
হইয়া থাকি। আমি যে পরমেশ্বর,
সেই আমা হইতে পরতর
অন্য কারণান্তর আর কিছুই নাই।
অর্থাৎ আমিই জগৎ-কারণ।
হে ধনঞ্জয়! আমি যে পরমেশ্বর
আমাতে সকল ভূত অর্থাৎ
এই সমস্ত জগৎ, সূত্রে মণিমালার
ন্যায় অনুস্যূত বা অনুগত বা
অনুবিদ্ধ বা গ্রথিত।