Wednesday, 13 August 2025

কেন শাস্ত্রে একই ব্রহ্মের সগুণ ও নির্গুণ এই দুই পরস্পর বিরোধী ভাবের পরিচয় দেয়া হয়েছে?

 


উপনিষদে ব্রহ্মের সগুণ নির্গুণ এই দ্বিবিধভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায়। এই দুটি বিভাব আলোক অন্ধকারের মত পরস্পর বিরোধী। অদ্বৈতবেদান্তের মতে নির্গুণ নির্বিশেষ ব্রহ্মই সত্য; ব্রহ্মের সগুণভাব মায়িক। স্থূলদর্শী সাধকের উপাসনার সুবিধার জন্য ব্রহ্মের সগুণ ভাবের কল্পনা করা হয়ে থাকে। বিষ্ণুপুরাণে এর স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে

প্রত্যস্তমিতভেদং যৎ সত্তামাত্রমগোচরম্।

বচসামাত্মসংবেদ্যং তজ্জ্ঞানং ব্রহ্ম সংজ্ঞিতম্।।

তচ্চ বিষ্ণোঃ পরং রূপমরূপস্যাজমক্ষরং।

বিশ্বরূপাচ্চ বৈরূপ্যলক্ষণং পরমাত্মনঃ।।

তদ্যোগযুজা শক্যং নৃপ চিন্তয়িতুং যতঃ।

ততঃ স্থূলং হরে রূপং চিন্তয়েদ্ বিশ্বগোচরম্।

-(বিষ্ণুপুরাণ-//৫৩-৫৫)

যা সর্বপ্রকার ভেদসম্পর্করহিত, কেবল সৎস্বরূপ, বাক্যের অগোচর এবং আত্মপ্রত্যয়-বেদ্য, সেই জ্ঞানই ব্রহ্ম নামে পরিচিত। রূপহীন বিষ্ণুর এটাই নিত্য পরমরূপ এবং তা সমস্ত বিশ্বরূপ হতে বিলক্ষণ। প্রথমতঃ যোগী ব্যক্তি সেই পরমরূপ চিন্তা করতে সমর্থ হন না বলেই পরমাত্মা শ্রীহরির স্থূলরূপই চিন্তা করবেন।

আত্মতত্ত্ব অতিশয় দুর্জ্ঞেয়। দুর্জ্ঞেয় বলেই ক্রমে ক্রমে ধাপে ধাপে ভারতীয় দর্শনে স্থূল হতে সূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর আত্মতত্ত্বের উপদেশ দেওয়া হয়েছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদে অন্নময়, মনোময়, প্রাণময়, বিজ্ঞানময় এবং আনন্দময়, এই পাঁচটি আত্মার কোশ বা আবরণ কল্পিত হয়েছে এবং এই স্থূল আবরণগুলো ভেদ করে চরমে আনন্দময় আত্মতত্ত্বে পৌঁছবার উপদেশ করা হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদে 'নাম' হতে আরম্ভ করে 'বৈষয়িক সুখ' পর্যন্তকে আত্মরূপে উপদেশ করে, সর্বশেষ ভূমা আত্মার বিশদ বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। উপনিষদের এরূপ উপদেশের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভগবান্ শঙ্করাচার্য বলেছেন যে, এক একখানা করে সিঁড়ি ভেঙ্গে যেমন অভ্রভেদী সৌধের উপরে উঠতে হয়, সেরূপ স্থূল হতে আরম্ভ করলেই ক্রমে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর আত্মরহস্য বুঝতে সমর্থ হবে বিবেচনা করেই, নাম হতে আরম্ভ করে আত্মতত্ত্বের উপদেশ দেওয়া হয়েছে বুঝতে হবে।

ছান্দোগ্যের অষ্টম প্রপাঠকের ভাষ্যে আচার্য শঙ্কর বলেছেন, যাঁরা উত্তম অধিকারী বলে গণ্য হবার যোগ্য তাঁরাই কেবল নির্বিশেষ আত্মতত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। ব্রহ্ম, এক অদ্বিতীয় পরমার্থ সৎ। নির্বিশেষ ব্রহ্ম অসত্য বস্তুশিষ্যদের এরূপ ভ্রম অপনোদনের জন্য গুণময় ব্রহ্ম উপাস্যরূপে বেদ উপনিষদে উপদিষ্ট হয়েছে। শ্রুতি কল্যাণময়ী জননীর ন্যায় মনে করেন যে, গুণ ধরেই এরা সত্যের পথে আসুক; সাধনার রাজ্যে প্রবেশ করুক। সবিশেষ ব্রহ্মের উপাসনা দ্বারা সৎ পথে আসলে, কর্মসন্ন্যাস বা বৈরাগ্য পরিপাকপ্রাপ্ত হলে, ক্রমে ক্রমে নির্বিশেষ ব্রহ্মের উপদেশ হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হবে। যাঁরা কর্মপ্রবণ, ভক্তহৃদয়, গুণে যাঁদের চিত্ত আসক্ত, তাঁদেরকে প্রথমেই নির্বিশেষ, নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মোপদেশ করবে না, করলেও তা এঁদের নিকট অসম্ভব বলে বোধ হবে। ঐরূপ নির্বিশেষ আত্মতত্ত্ব এঁরা ধারণায় আনতে পারবে না। বরংচ এঁদের কর্মনিষ্ঠা তা দ্বারা শিথিল হয়ে পড়বে। ফলে, ঐরূপ ব্রহ্মোপদেশের দ্বারা সুফল না হয়ে, কুফলই ফলবে বেশি। সেজন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন —' বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্ম্মসঙ্গিনাম্'।। গীতা, ৩।২৬

তথ্যসূত্রঃ-

. বিষ্ণুপুরাণ, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত।

. ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৮ম প্রপাঠক, শাঙ্করভাষ্য আনন্দগিরি টীকা, দুর্গাচরণ সাংখ্যবেদান্ততীর্থ অনুদিত সম্পাদিত।

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, তৃতীয় খণ্ড, আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

আগস্ট , ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

No comments:

জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ-

  শ্রীভগবানুবাচ ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ৷ অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু ৷৷ ১   ‘শাঙ্করভাষ্য’   অনুস...