Sunday, 12 October 2025

তুরীয় ব্রহ্মের স্বরূপঃ-

 


মাণ্ডুক্য উপনিষদে তুরীয় ব্রহ্মতত্ত্বের উপদেশ রয়েছে। দুর্জ্ঞেয় তুরীয় তত্ত্ব বুঝানোর জন্য ওঁকার বা প্রণবকে ব্রহ্মের প্রতীকরূপে কল্পনা করা হয়েছে। ওঁকারের যেমন , , এবং নাদবিন্দু () এই চারটি মাত্রা আছে, সেরূপ ঈশান তুরীয় ব্রহ্মকেও শ্রুতি চতুষ্পাদ বা চতুষ্কল বলে বর্ণনা করেছেন। বিশ্ব, তৈজস প্রাজ্ঞ, এটাই সর্বব্যাপী ব্রহ্মের পাদত্রয়, আর, এই পাদত্রয়ের অতীত ঈশান বা নির্বিশেষ ব্রহ্মই তুরীয়পাদ। প্রণবের দৃষ্টান্তে নাদবিন্দু তুরীয়পাদ। নাদবিন্দু যেমন পৃথগ্ভাবে উচ্চারিত বা ব্যক্ত হতে পারে না, সেরূপ ব্রহ্মের তুরীয়পাদও অবাঙ্মনস্-গোচর, ভাষার সাহায্যে বা মনে মনেও তুরীয় ব্রহ্মের স্বরূপ নিরূপণ করা যায় না। কেবল নিষেধ মুখে 'নেতি নেতি' বলে তুরীয় তত্ত্বের উপদেশ সম্ভব হয়। এইজন্যই শ্রুতি 'নান্তঃপ্রজ্ঞং বহিঃপ্রজ্ঞং' ইত্যাদি বলে তুরীয় তত্ত্বকে বুঝানোর জন্য '' এর বহুল প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ তুরীয় ঈশান তত্ত্ব বিশ্বও নন, তৈজসও নন, প্রজ্ঞ বা জ্ঞাতাও নন, অপ্রজ্ঞ বা অজ্ঞাতাও নন। তুরীয় অব্যক্ত, অচিন্ত্য, অজ্ঞেয়, অনির্দেশ্য, শান্ত, শিব, অদ্বিতীয়, আত্মা।

অথর্ববেদীয়া মাণ্ডুক্য উপনিষদে বর্ণিত হয়েছে

নান্তঃপ্রজ্ঞং বহিঃপ্রজ্ঞং নোভয়তঃপ্রজ্ঞং প্রজ্ঞানঘনং প্রজ্ঞং নাপ্রজ্ঞম্ অদৃষ্টমব্যবহার্যমগ্রাহ্যমলক্ষণং অচিন্ত্যমব্যপদেশ্যমেকাত্মপ্রত্যয়সারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে আত্মা বিজ্ঞেয়ঃ।।৭।।

বিবেকিগণ চতুর্থকে (তুরীয়কে) মনে করেন যে, তিনি অন্তঃপ্রজ্ঞ তৈজস নন; বহিঃপ্রজ্ঞ বিশ্ব নন; জাগ্রৎ স্বপ্নের মধ্যবর্তী জ্ঞানসম্পন্ন নন; প্রজ্ঞানঘন প্রাজ্ঞ নন; জ্ঞাতা নন; অচেতন নন; পরন্তু চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের অবিষয়, ‘এটা অমুকইত্যাকার ব্যবহারের অযোগ্য, কর্ম্মেন্দ্রিয়ের অগ্রাহ্য, অনুমানযোগ্য কোনরূপ চিহ্নরহিত, মানস-চিন্তার অবিষয়, শব্দ দ্বারা নির্দ্দেশের অযোগ্য; কেবলআত্মাইত্যাকার প্রতীতিগম্য, জাগ্রদাদি প্রপঞ্চের উপশম (অর্থাৎ আত্মাতে জাগ্রৎ-স্বপ্নাদি স্থানধর্ম্মেরও অভাব বা প্রতিষেধ) কথিত হচ্ছে, শান্ত (নির্বিকার); মঙ্গলময়, অদ্বৈত অর্থাৎ ভেদ-কল্পনারহিত। তিনিই আত্মা; এবং তিনিই একমাত্র জ্ঞাতব্য পদার্থ।

আমরা আমাদের জাগ্রৎ, স্বপ্ন সুষুপ্তি এই তিন অবস্থায়ই আত্মাকে প্রত্যক্ষ করি। জাগরিত অবস্থায় আমরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্থূল জগৎকে প্রত্যক্ষ করি এবং প্রত্যক্ষের অন্তরালবর্তী বিষয়দ্রষ্টা আত্মাকেও অনুভব করি। এই বিষয়দ্রষ্টা আত্মাই 'স্থূলভুক্' বিশ্ব আত্মা। স্থূল বিষয়সমূহ ভোগ করেন বলে তাকে স্থূলভুক্ বলা হয়। স্বপ্ন অবস্থায় আমাদের ইন্দ্রিয় সকল বাহ্য বিষয় হতে বিরত হয়, তখন কেবল মন ক্রিয়াশীল থাকে। মন যা আমাদের কাছে উপস্থিত করে তাই তখন আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। এইজন্য স্বপ্নদৃক্ এই আত্মাকে বলা হয়েছে 'প্রবিবিক্তভুক্', প্রবিবিক্ত শব্দের অর্থ স্থূল দৃশ্য বিষয় হতে নিবৃত্ত, কেবল মানস-সঙ্কল্প-জাত; স্বপ্নাবস্থায় মনে যেরূপ সঙ্কল্প বা বাসনার উদয় হবে, আত্মা তদনুরূপই বিষয় ভোগ করবে। এই আত্মা শ্রুতির ভাষায় তৈজস আত্মা অর্থাৎ এই অবস্থায় আত্মা স্থূল শব্দাদি বিষয়কে পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র তেজোময় অন্তঃকরণকে দর্শন করে বলে, তাকে তৈজস বলা হয়ে থাকে। সুষুপ্তি অবস্থায় মনও নিষ্ক্রিয় হয়ে বিলীন হয়ে যায়। এখানে আত্মার স্থূল বা সূক্ষ্ম কোনরূপ বিষয় ভোগ্য থাকে না, একমাত্র নিদ্রার আনন্দই সে ভোগ করে। সেজন্য সুষুপ্ত আত্মাকে 'আনন্দভুক্' প্রাজ্ঞ আত্মা বলা হয়। সুষুপ্তি অবস্থায় এই প্রাজ্ঞ আত্মা সচ্চিদানন্দ পরম ব্রহ্মে বিলীন হয়ে তাঁর সাথে সম্পূর্ণ অভিন্ন হয়ে যায়। আনন্দঘন প্রাজ্ঞ আত্মার তখন কোন দ্বৈত বস্তুর জ্ঞান থাকে না। তুরীয় আত্মারও কোন দ্বৈত জ্ঞান নেই। এই বিষয়ে প্রাজ্ঞ তুরীয় উভয় আত্মাই তুল্য, পার্থক্য এই যে, সুষুপ্ত প্রাজ্ঞ আত্মার তমঃ বা নিদ্রারূপ অবিদ্যা-বীজ বর্তমান থাকে, সুতরাং সুষুপ্তি অবস্থা ভেঙ্গে গেলে তাকে আবার মন ইন্দ্রিয়ের বন্ধনে বদ্ধ হয়ে মায়ার চক্রে ঘুরতে হয়।

কিন্তু তুরীয় আত্মা নিত্য প্রকাশ-স্বরূপ। তাঁর কোনরূপ তমঃ বা অজ্ঞান নেই। আত্মার বিশ্ব, তৈজস প্রাজ্ঞ এই পাদত্রয় অজ্ঞান-কল্পিত, একমাত্র তুরীয় ঈশানই অজ্ঞানাতীত এবং নিত্য বোধ স্বরূপ। অনাদি মায়ার ক্রোড়ে সুপ্ত জীব এই তুরীয় নিত্য, জ্ঞানময়, আনন্দঘন আত্মার স্বরূপ বুঝতে পারে না, কিন্তু যখন শাস্ত্র আচার্য উপদেশে তাঁর অজ্ঞান বিদূরিত হয়, বিবেকচক্ষু উন্মীলিত হয় তখনই সে আনন্দময় আত্মাকে উপলব্ধি করে। অবিদ্যাবশতঃই আত্মার বিশ্ব, তৈজস প্রাজ্ঞ প্রভৃতি স্থূল, সূক্ষ্ম বিভাব উৎপন্ন হয়ে থাকে। ব্যষ্টিরূপে যা বিশ্ব, তৈজস প্রাজ্ঞ, সমষ্টিরূপে তাই বৈশ্বানর, হিরণ্যগর্ভ, সূত্রাত্মা, ঈশ্বর অন্তর্যামী বলে প্রসিদ্ধ। বস্তুতঃ সমস্তেরই মূলে রয়েছে সেই অনাদি মায়া। কি ব্যষ্টি, কি সমষ্টি, সমস্ত বিভেদই মায়াকল্পিত। আত্মার যে পাদত্রয়ের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যেও বস্তুতঃ কোন ভেদ নেই, এক আত্মাই তিন অবস্থাতে অবস্থাত্রয়ের সাক্ষি-রূপে প্রতিভাত হয়ে থাকেন। যে আমি জেগে থাকি, সেই আমিই স্বপ্ন দেখি এবং সুষুপ্তির আনন্দ অনুভব করি। একই আমি ত্রিবিধ অবস্থার অন্তরালে অবস্থিত আছি। অবস্থাত্রয়ের (জাগ্রৎ, স্বপ্ন সুষুপ্তি) মধ্যবর্তী হয়েও আমি নির্মল, সঙ্গী হয়েও অসঙ্গ, ভোক্তা জীব ভোগ্য জগতের অন্তরে নিত্য বিরাজমান থেকেও প্রপঞ্চাতীত, শুদ্ধ, চিন্ময় এবং আনন্দঘন।

তথ্যসূত্রঃ-

. মাণ্ডুক্য উপনিষৎ, গৌড়পাদীয় কারিকা, ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্য সমেত, মহামহোপাধ্যায় দুর্গাচরণ সাংখ্যবেদান্ততীর্থ অনূদিত।

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ্, প্রথম খণ্ড, কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।

শ্রীশুভ চৌধুরী

অক্টোবর ১০, শুক্রবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

Saturday, 27 September 2025

অমলানন্দ স্বামী—

 


অদ্বৈতবেদান্তের আরেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হলো অমলানন্দ স্বামী। বেদান্ত কল্পতরুর রচয়িতা অমলানন্দ স্বামী খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে দক্ষিণ ভারতে জন্মগ্রহণ করেন। আচার্যের অপর নাম ব্যাসাশ্রম। যাদববংশীয় রাজা শ্রীকৃষ্ণের সময় অমলানন্দ কল্পতরু রচনা করেন। তিনি কল্পতরুর আরম্ভে গ্রন্থের রচনাকাল নির্দেশ করেছেন। তিনি রাজা শ্রীকৃষ্ণ বলে সম্ভবতঃ যাদবরাজ রামচন্দ্রকে গ্রহণ করেছেন। রাজা রামচন্দ্র মহাদেবের ভ্রাতা। রামচন্দ্রের পূর্বে মহাদেব দেবগিরির রাজা ছিলেন মহাদেবের নামও অমলানন্দ কল্পতরুর আরম্ভ শ্লোকে উল্লেখ করেছেন। এটা দ্বারা অমলানন্দ উভয়ের রাজত্বকালেই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, এরূপ মনে করা অস্বাভাবিক নয়। মহাদেব ১২৬০ থেকে ১২৭১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন, পরে রামচন্দ্র রাজা হন। এটা হতে অমলানন্দ স্বামীর আবির্ভাবকালও খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষ ভাগ বলে নিশ্চয় করা যায়।

অমলানন্দের গুরুর নাম অনুভবানন্দ, আর বিদ্যাগুরু সুখপ্রকাশ। সুখপ্রকাশ চিৎসুখাচার্যের শিষ্য, সুতরাং অমলানন্দ চিৎসুখাচার্যের প্রশিষ্য ছিলেন। অমলানন্দ বাচস্পতি মিশ্রের ভামতী টীকার উপর 'বেদান্তকল্পতরু' নামে এক পূর্ণাঙ্গ টীকা প্রণয়ন করেন। কল্পতরু ব্যতীত অমলানন্দ 'শাস্ত্রদর্পণ' নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। শাস্ত্রদর্পণে ব্রহ্মসূত্রের প্রত্যেক অধিকরণের বাচস্পতি-মতানুযায়ী তাৎপর্য অতি প্রাঞ্জল ভাষায় অমলানন্দ বিবৃত করেছেন। তাছাড়া পদ্মপাদাচার্যের পঞ্চপাদিকার উপর 'পঞ্চপাদিকা-দর্পণ' নামে একখানা টীকা রচনা করে অমলানন্দ স্বামী ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্যধারার বিশেষ পুষ্টিসাধন করেছিলেন বলে জানা যায়। এই কল্পতরুর উপর অপ্পয় দীক্ষিত 'কল্পতরু-পরিমল' খৃষ্টীয় ১৭শ শতকে কোণ্ডভট্টের পুত্র লক্ষ্মীনৃসিংহ 'আভোগ' নামে টীকা রচনা করে কল্পতরুর দানভাণ্ডার পূর্ণ করেছেন। লক্ষ্মীনৃসিংহ তদীয় টীকা রচনায় অনেক স্থলে অপ্পয় দীক্ষিতের বেদান্ত-কল্পতরু-পরিমলের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বলে মনে হয়।.....

তথ্যসূত্রঃ-

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, প্রথম খণ্ড, আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।

. অদ্বৈতসিদ্ধি মধুসূদন সরস্বতী, শ্রীব্যোমকেশ ভট্টাচার্য, ভাগবত-রত্ন।

শ্রীশুভ চৌধুরী

সেপ্টেম্বর ১৯, শুক্রবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

শ্রীধর স্বামী—

 


শ্রীমদ্ভাগবতের প্রাচীনতম প্রসিদ্ধ টীকাকার ছিলেন শ্রীধর স্বামী। শ্রীধর স্বামীকৃত ভাগবতের এই অপূর্ব টীকাই ব্যাস-বিরচিত শ্রীমদ্ভাগবতকে আরও মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছিল। তাঁর রচিত এই টীকার নাম 'ভাবার্থদীপিকা' তিনি ভাগবতের পাশাপাশি বিষ্ণুপুরাণের 'আত্মপ্রকাশ' টীকা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার 'সুবোধিনী' টীকা রচনা করেন। তাঁকে ভট্টিকাব্যের রচয়িতা বলা হয়। তিনি 'ব্রজবিহার' প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা বলেও কথিত হয়। এতদ্ব্যতীত শ্রীধর স্বামী রচিত শ্রীকৃষ্ণ নাম প্রেম মাহাত্ম্য সূচক কয়েকটি শ্লোক শ্রীরূপগোস্বামী শ্রীপদ্যাবলীতে আহরণ করেছেন।

শ্রীধর স্বামীর টীকায় চিৎসুখাচার্যের নাম বিদ্যারণ্য মুনীশ্বরের বৃহদারণ্যক বার্তিকসারের উদ্ধৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়, তাই তাঁর সময়কাল খৃষ্টীয় ১৪শ শতকে বলা যেতে পারে। তিনি গুর্জর দেশবাসী মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ। তিনি ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি। একদা গৃহে প্রত্যাবর্তন কালে দস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ধনুর্ধারী শ্রীধর তাঁকে রক্ষা করেন। প্রভুর লীলা দর্শনে তিনি হরি ভজনার্থ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তৎকৃত গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, তিনি কেবলাদ্বৈতবাদী কাশীবাসী দণ্ডী সন্ন্যাসী ছিলেন। তাঁর গুরুর নাম পরমানন্দ পুরী। ভাগবতের টীকার মঙ্গলাচরণে তিনি শ্রীগুরুর নাম উল্লেখ করেছেন

"মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্।

যৎ কৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দ মাধবম্।"

যাঁর কৃপা মূককে বাচাল করে, পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করায়, সেই পরমানন্দরূপী গুরুদেব ইষ্টদেব  মাধবকে আমি বন্দনা করি।

তিনি ভগবান্ নৃসিংহদেবের উপাসক ছিলেন। কাশীতে বিন্দুমাধবের মন্দিরে অবস্থানকরতঃ তাঁর সন্তোষার্থ অদ্বৈতবাদী চিৎ-সুখাচার্যের ব্যাখ্যা আলোচনা করে বিষ্ণুপুরাণের 'আত্মপ্রকাশ' টীকা রচনা করেন। তিনি এই টীকার মঙ্গলাচরণে স্পষ্ট বলেছেন

শ্রীবিন্দুমাধবং বন্দে পরমানন্দবিগ্রহম্।

বাচং বিশ্বেশ্বরং গঙ্গাং পরাশরমুখান্ মুনীন্।।

শ্রীমচ্চিৎসুখযোগিমুখ্যরচিতব্যাখ্যাং নিরীক্ষ্য স্ফুটং

তন্মার্গেণ সুবোধসংগ্রহবতীমাত্মপ্রকাশাভিধাম্।

পরমানন্দমূর্তি শ্রীবিন্দুমাধবকে বন্দনা করছি। সরস্বতী, বিশ্বেশ্বর শিব, গঙ্গা, পরাশরাদি মুখ্য মুনীদেরও বন্দনা করছি। শ্রীমদ্ চিৎসুখযোগী রচিত মুখ্য ব্যাখ্যা নিরীক্ষণ করে তদ্দ্বারা স্ফুটিত মার্গের দ্বারা সুবোধ সংগ্রহবতী এই ব্যাখ্যা প্রকাশ করাই অভিধেয়।

অতএব শ্রীধর স্বামী যে ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্যধারার অনুগামী তা সুস্পষ্ট। বিষ্ণুপুরাণের টীকায় চিৎসুখাচার্যের নামের পাশাপাশি তাঁর রচিত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সুবোধিনী টীকায় সুরেশ্বরাচার্যের নৈষ্কর্মসিদ্ধি, বিদ্যারণ্য মুনীশ্বরের বৃহদারণ্যক বার্তিকসারের উদ্ধৃতির স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া তিনি 'সুবোধিনী' টীকার মঙ্গলাচরণে স্পষ্ট বলেছেন ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য তদীয় পরম্পরার ব্যাখ্যাকারীর মত অবগত হয়ে এই গীতা শাস্ত্রের ব্যাখ্যা তিনি প্রারম্ভ করেছেন।

ভাষ্যকারমতং সম্যক্ তদ্ব্যাখ্যাতুর্গিরস্তথা।

যথামতি সমালোক্য গীতাব্যাখ্যাং সমারভে ।।

আমি ভাষ্যকারের (শঙ্করাচার্যের) মত তাঁর ব্যাখ্যাকারীর বাক্য যথাযথভাবে অবগত হয়ে এই গীতাশাস্ত্রের ব্যাখ্যা আরম্ভ করলাম। 

তবে উল্লেখ্য যে, শ্রীধর স্বামী কি শঙ্কর পরম্পরার কেবলাদ্বৈতবাদী ছিলেন? না বিষ্ণুস্বামী পরম্পরার শুদ্ধাদ্বৈতবাদী ছিলেন?—এটা নিয়ে সম্প্রদায়ভিত্তিক বাদবিতণ্ডা রয়েছে। সর্বোপরি তিনি নিঃসন্দেহে ভারতের অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন। অদ্যাবধি তাঁর টীকার উপর মন্তব্য করার সাহস কারও হয় নি। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব ভাগবতের টীকার ক্ষেত্রে শ্রীধরস্বামীর টীকাকেই অভ্রান্তভাবে অনুমোদন করে গেছেন তাকে গুরুপদে মেনেছিলেন। শ্রীধরস্বামীর অনুগত ভাষ্য না লেখায় তিনি বল্লভাচার্যকে তিরস্কার করে বলেছিলেন

"শ্রীধরস্বামী প্রসাদেতে ভাগবত জানি।

জগৎগুরু শ্রীধরস্বামী গুরু করি মানি।।

শ্রীধর উপরে গর্বে যে কিছু লিখিবে।

অর্থ-ব্যস্ত লিখন সেই, লোকে না মানিবে।।

শ্রীধরের আনুগত্যে যে করে লিখন।

সব লোক মান্য করি করিবে গ্রহণ।।

শ্রীধরানুগত্যে কর ভাগবতব্যাখ্যান্।

অভিমান ছাড়ি ভজ কৃষ্ণ ভগবান।।"

-(চৈতন্য চরিতামৃত)...

তথ্যসূত্রঃ-

. "অদ্বৈতসিদ্ধি মধুসূদন সরস্বতী", শ্রীব্যোমকেশ ভট্টাচার্য, ভাগবত-রত্ন।

. "অদ্বৈতসিদ্ধিঃ", প্রথমভাগ,পণ্ডিত রাজেন্দ্রনাথ ঘোষের ভূমিকা।

. শ্রীমদ্ভাগবতম্ শ্রীধরী টীকা সমেত, প্রথম স্কন্ধ, উদ্বোধন কার্যালয়।

শ্রীশুভ চৌধুরী

সেপ্টেম্বর ১৫, সোমবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

Photo editing credit Thākur Vishāl

তুরীয় ব্রহ্মের স্বরূপঃ-

  মাণ্ডুক্য উপনিষদে তুরীয় ব্রহ্মতত্ত্বের উপদেশ রয়েছে। ঐ দুর্জ্ঞেয় তুরীয় তত্ত্ব বুঝানোর জন্য ওঁকার বা প্রণবকে ব্রহ্মের প্...