মাণ্ডুক্য উপনিষদে তুরীয় ব্রহ্মতত্ত্বের উপদেশ রয়েছে। ঐ দুর্জ্ঞেয় তুরীয় তত্ত্ব বুঝানোর জন্য ওঁকার বা প্রণবকে ব্রহ্মের প্রতীকরূপে কল্পনা করা হয়েছে। ওঁকারের যেমন অ, উ, ম এবং নাদবিন্দু (ঁ) এই চারটি মাত্রা আছে, সেরূপ ঈশান তুরীয় ব্রহ্মকেও শ্রুতি চতুষ্পাদ বা চতুষ্কল বলে বর্ণনা করেছেন। বিশ্ব, তৈজস ও প্রাজ্ঞ, এটাই সর্বব্যাপী ব্রহ্মের পাদত্রয়, আর, এই পাদত্রয়ের অতীত ঈশান বা নির্বিশেষ ব্রহ্মই তুরীয়পাদ। প্রণবের দৃষ্টান্তে নাদবিন্দু ঐ তুরীয়পাদ। নাদবিন্দু যেমন পৃথগ্ভাবে উচ্চারিত বা ব্যক্ত হতে পারে না, সেরূপ ব্রহ্মের তুরীয়পাদও অবাঙ্মনস্-গোচর, ভাষার সাহায্যে বা মনে মনেও তুরীয় ব্রহ্মের স্বরূপ নিরূপণ করা যায় না। কেবল নিষেধ মুখে 'নেতি নেতি' বলে তুরীয় তত্ত্বের উপদেশ সম্ভব হয়। এইজন্যই শ্রুতি 'নান্তঃপ্রজ্ঞং ন বহিঃপ্রজ্ঞং' ইত্যাদি বলে তুরীয় তত্ত্বকে বুঝানোর জন্য 'ন' এর বহুল প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ ঐ তুরীয় ঈশান তত্ত্ব বিশ্বও নন, তৈজসও নন, প্রজ্ঞ বা জ্ঞাতাও নন, অপ্রজ্ঞ বা অজ্ঞাতাও নন। তুরীয় অব্যক্ত, অচিন্ত্য, অজ্ঞেয়, অনির্দেশ্য, শান্ত, শিব, অদ্বিতীয়, আত্মা।
অথর্ববেদীয়া
মাণ্ডুক্য উপনিষদে বর্ণিত হয়েছে—
নান্তঃপ্রজ্ঞং
ন বহিঃপ্রজ্ঞং নোভয়তঃপ্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন
প্রজ্ঞং নাপ্রজ্ঞম্ । অদৃষ্টমব্যবহার্যমগ্রাহ্যমলক্ষণং অচিন্ত্যমব্যপদেশ্যমেকাত্মপ্রত্যয়সারং
প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে স আত্মা স
বিজ্ঞেয়ঃ।।৭।।
—বিবেকিগণ চতুর্থকে
(তুরীয়কে) মনে করেন যে,
তিনি অন্তঃপ্রজ্ঞ তৈজস নন; বহিঃপ্রজ্ঞ
বিশ্ব নন; জাগ্রৎ ও
স্বপ্নের মধ্যবর্তী জ্ঞানসম্পন্ন নন; প্রজ্ঞানঘন প্রাজ্ঞ
নন; জ্ঞাতা নন; অচেতন নন;
পরন্তু চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের অবিষয়, ‘এটা অমুক’ ইত্যাকার
ব্যবহারের অযোগ্য, কর্ম্মেন্দ্রিয়ের অগ্রাহ্য, অনুমানযোগ্য কোনরূপ চিহ্নরহিত, মানস-চিন্তার অবিষয়,
শব্দ দ্বারা নির্দ্দেশের অযোগ্য; কেবল ‘আত্মা’ ইত্যাকার প্রতীতিগম্য, জাগ্রদাদি প্রপঞ্চের উপশম (অর্থাৎ আত্মাতে জাগ্রৎ-স্বপ্নাদি স্থানধর্ম্মেরও অভাব বা প্রতিষেধ)
কথিত হচ্ছে, শান্ত (নির্বিকার); মঙ্গলময়, অদ্বৈত অর্থাৎ ভেদ-কল্পনারহিত। তিনিই
আত্মা; এবং তিনিই একমাত্র
জ্ঞাতব্য পদার্থ।
আমরা
আমাদের জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই
তিন অবস্থায়ই আত্মাকে প্রত্যক্ষ করি। জাগরিত অবস্থায়
আমরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্থূল জগৎকে প্রত্যক্ষ করি এবং ঐ
প্রত্যক্ষের অন্তরালবর্তী বিষয়দ্রষ্টা আত্মাকেও অনুভব করি। এই বিষয়দ্রষ্টা
আত্মাই 'স্থূলভুক্' বিশ্ব আত্মা। স্থূল বিষয়সমূহ ভোগ করেন বলে
তাকে স্থূলভুক্ বলা হয়। স্বপ্ন
অবস্থায় আমাদের ইন্দ্রিয় সকল বাহ্য বিষয়
হতে বিরত হয়, তখন
কেবল মন ক্রিয়াশীল থাকে।
মন যা আমাদের কাছে
উপস্থিত করে তাই তখন
আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। এইজন্য
স্বপ্নদৃক্ এই আত্মাকে বলা
হয়েছে 'প্রবিবিক্তভুক্', প্রবিবিক্ত শব্দের অর্থ স্থূল দৃশ্য
বিষয় হতে নিবৃত্ত, কেবল
মানস-সঙ্কল্প-জাত; স্বপ্নাবস্থায় মনে
যেরূপ সঙ্কল্প বা বাসনার উদয়
হবে, আত্মা তদনুরূপই বিষয় ভোগ করবে। এই
আত্মা শ্রুতির ভাষায় তৈজস আত্মা অর্থাৎ
এই অবস্থায় আত্মা স্থূল শব্দাদি বিষয়কে পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র তেজোময়
অন্তঃকরণকে দর্শন করে বলে, তাকে
তৈজস বলা হয়ে থাকে।
সুষুপ্তি অবস্থায় মনও নিষ্ক্রিয় হয়ে
বিলীন হয়ে যায়। এখানে
আত্মার স্থূল বা সূক্ষ্ম কোনরূপ
বিষয় ভোগ্য থাকে না, একমাত্র
নিদ্রার আনন্দই সে ভোগ করে।
সেজন্য সুষুপ্ত আত্মাকে 'আনন্দভুক্' প্রাজ্ঞ আত্মা বলা হয়। সুষুপ্তি
অবস্থায় এই প্রাজ্ঞ আত্মা
সচ্চিদানন্দ পরম ব্রহ্মে বিলীন
হয়ে তাঁর সাথে সম্পূর্ণ
অভিন্ন হয়ে যায়। আনন্দঘন
প্রাজ্ঞ আত্মার তখন কোন দ্বৈত
বস্তুর জ্ঞান থাকে না। তুরীয়
আত্মারও কোন দ্বৈত জ্ঞান
নেই। এই বিষয়ে প্রাজ্ঞ
ও তুরীয় উভয় আত্মাই তুল্য,
পার্থক্য এই যে, সুষুপ্ত
প্রাজ্ঞ আত্মার তমঃ বা নিদ্রারূপ
অবিদ্যা-বীজ বর্তমান থাকে,
সুতরাং সুষুপ্তি অবস্থা ভেঙ্গে গেলে তাকে আবার
মন ও ইন্দ্রিয়ের বন্ধনে
বদ্ধ হয়ে মায়ার চক্রে
ঘুরতে হয়।
কিন্তু
তুরীয় আত্মা নিত্য প্রকাশ-স্বরূপ। তাঁর কোনরূপ তমঃ
বা অজ্ঞান নেই। আত্মার বিশ্ব,
তৈজস ও প্রাজ্ঞ এই
পাদত্রয় অজ্ঞান-কল্পিত, একমাত্র তুরীয় ঈশানই অজ্ঞানাতীত এবং নিত্য বোধ
স্বরূপ। অনাদি মায়ার ক্রোড়ে সুপ্ত জীব এই তুরীয়
নিত্য, জ্ঞানময়, আনন্দঘন আত্মার স্বরূপ বুঝতে পারে না, কিন্তু
যখন শাস্ত্র ও আচার্য উপদেশে
তাঁর অজ্ঞান বিদূরিত হয়, বিবেকচক্ষু উন্মীলিত
হয় তখনই সে আনন্দময়
আত্মাকে উপলব্ধি করে। অবিদ্যাবশতঃই আত্মার
বিশ্ব, তৈজস ও প্রাজ্ঞ
প্রভৃতি স্থূল, সূক্ষ্ম বিভাব উৎপন্ন হয়ে থাকে। ব্যষ্টিরূপে
যা বিশ্ব, তৈজস ও প্রাজ্ঞ,
সমষ্টিরূপে তাই বৈশ্বানর, হিরণ্যগর্ভ,
সূত্রাত্মা, ঈশ্বর ও অন্তর্যামী বলে
প্রসিদ্ধ। বস্তুতঃ সমস্তেরই মূলে রয়েছে সেই
অনাদি মায়া। কি ব্যষ্টি, কি
সমষ্টি, সমস্ত বিভেদই মায়াকল্পিত। আত্মার যে পাদত্রয়ের কথা
বলা হয়েছে তার মধ্যেও বস্তুতঃ
কোন ভেদ নেই, এক
আত্মাই তিন অবস্থাতে অবস্থাত্রয়ের
সাক্ষি-রূপে প্রতিভাত হয়ে
থাকেন। যে আমি জেগে
থাকি, সেই আমিই স্বপ্ন
দেখি এবং সুষুপ্তির আনন্দ
অনুভব করি। একই আমি
ত্রিবিধ অবস্থার অন্তরালে অবস্থিত আছি। অবস্থাত্রয়ের (জাগ্রৎ,
স্বপ্ন ও সুষুপ্তি) মধ্যবর্তী
হয়েও আমি নির্মল, সঙ্গী
হয়েও অসঙ্গ, ভোক্তা জীব ও ভোগ্য
জগতের অন্তরে নিত্য বিরাজমান থেকেও প্রপঞ্চাতীত, শুদ্ধ, চিন্ময় এবং আনন্দঘন।
তথ্যসূত্রঃ-
১.
মাণ্ডুক্য উপনিষৎ, গৌড়পাদীয় কারিকা, ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্য সমেত, মহামহোপাধ্যায় দুর্গাচরণ সাংখ্যবেদান্ততীর্থ অনূদিত।
২.
বেদান্তদর্শন—অদ্বৈতবাদ্, প্রথম খণ্ড, কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
অক্টোবর
১০, শুক্রবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।