Saturday, 27 September 2025

শ্রীধর স্বামী—

 


শ্রীমদ্ভাগবতের প্রাচীনতম প্রসিদ্ধ টীকাকার ছিলেন শ্রীধর স্বামী। শ্রীধর স্বামীকৃত ভাগবতের এই অপূর্ব টীকাই ব্যাস-বিরচিত শ্রীমদ্ভাগবতকে আরও মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছিল। তাঁর রচিত এই টীকার নাম 'ভাবার্থদীপিকা' তিনি ভাগবতের পাশাপাশি বিষ্ণুপুরাণের 'আত্মপ্রকাশ' টীকা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার 'সুবোধিনী' টীকা রচনা করেন। তাঁকে ভট্টিকাব্যের রচয়িতা বলা হয়। তিনি 'ব্রজবিহার' প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা বলেও কথিত হয়। এতদ্ব্যতীত শ্রীধর স্বামী রচিত শ্রীকৃষ্ণ নাম প্রেম মাহাত্ম্য সূচক কয়েকটি শ্লোক শ্রীরূপগোস্বামী শ্রীপদ্যাবলীতে আহরণ করেছেন।

শ্রীধর স্বামীর টীকায় চিৎসুখাচার্যের নাম বিদ্যারণ্য মুনীশ্বরের বৃহদারণ্যক বার্তিকসারের উদ্ধৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়, তাই তাঁর সময়কাল খৃষ্টীয় ১৪শ শতকে বলা যেতে পারে। তিনি গুর্জর দেশবাসী মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ। তিনি ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি। একদা গৃহে প্রত্যাবর্তন কালে দস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ধনুর্ধারী শ্রীধর তাঁকে রক্ষা করেন। প্রভুর লীলা দর্শনে তিনি হরি ভজনার্থ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তৎকৃত গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, তিনি কেবলাদ্বৈতবাদী কাশীবাসী দণ্ডী সন্ন্যাসী ছিলেন। তাঁর গুরুর নাম পরমানন্দ পুরী। ভাগবতের টীকার মঙ্গলাচরণে তিনি শ্রীগুরুর নাম উল্লেখ করেছেন

"মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্।

যৎ কৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দ মাধবম্।"

যাঁর কৃপা মূককে বাচাল করে, পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করায়, সেই পরমানন্দরূপী গুরুদেব ইষ্টদেব  মাধবকে আমি বন্দনা করি।

তিনি ভগবান্ নৃসিংহদেবের উপাসক ছিলেন। কাশীতে বিন্দুমাধবের মন্দিরে অবস্থানকরতঃ তাঁর সন্তোষার্থ অদ্বৈতবাদী চিৎ-সুখাচার্যের ব্যাখ্যা আলোচনা করে বিষ্ণুপুরাণের 'আত্মপ্রকাশ' টীকা রচনা করেন। তিনি এই টীকার মঙ্গলাচরণে স্পষ্ট বলেছেন

শ্রীবিন্দুমাধবং বন্দে পরমানন্দবিগ্রহম্।

বাচং বিশ্বেশ্বরং গঙ্গাং পরাশরমুখান্ মুনীন্।।

শ্রীমচ্চিৎসুখযোগিমুখ্যরচিতব্যাখ্যাং নিরীক্ষ্য স্ফুটং

তন্মার্গেণ সুবোধসংগ্রহবতীমাত্মপ্রকাশাভিধাম্।

পরমানন্দমূর্তি শ্রীবিন্দুমাধবকে বন্দনা করছি। সরস্বতী, বিশ্বেশ্বর শিব, গঙ্গা, পরাশরাদি মুখ্য মুনীদেরও বন্দনা করছি। শ্রীমদ্ চিৎসুখযোগী রচিত মুখ্য ব্যাখ্যা নিরীক্ষণ করে তদ্দ্বারা স্ফুটিত মার্গের দ্বারা সুবোধ সংগ্রহবতী এই ব্যাখ্যা প্রকাশ করাই অভিধেয়।

অতএব শ্রীধর স্বামী যে ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্যধারার অনুগামী তা সুস্পষ্ট। বিষ্ণুপুরাণের টীকায় চিৎসুখাচার্যের নামের পাশাপাশি তাঁর রচিত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সুবোধিনী টীকায় সুরেশ্বরাচার্যের নৈষ্কর্মসিদ্ধি, বিদ্যারণ্য মুনীশ্বরের বৃহদারণ্যক বার্তিকসারের উদ্ধৃতির স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া তিনি 'সুবোধিনী' টীকার মঙ্গলাচরণে স্পষ্ট বলেছেন ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য তদীয় পরম্পরার ব্যাখ্যাকারীর মত অবগত হয়ে এই গীতা শাস্ত্রের ব্যাখ্যা তিনি প্রারম্ভ করেছেন।

ভাষ্যকারমতং সম্যক্ তদ্ব্যাখ্যাতুর্গিরস্তথা।

যথামতি সমালোক্য গীতাব্যাখ্যাং সমারভে ।।

আমি ভাষ্যকারের (শঙ্করাচার্যের) মত তাঁর ব্যাখ্যাকারীর বাক্য যথাযথভাবে অবগত হয়ে এই গীতাশাস্ত্রের ব্যাখ্যা আরম্ভ করলাম। 

তবে উল্লেখ্য যে, শ্রীধর স্বামী কি শঙ্কর পরম্পরার কেবলাদ্বৈতবাদী ছিলেন? না বিষ্ণুস্বামী পরম্পরার শুদ্ধাদ্বৈতবাদী ছিলেন?—এটা নিয়ে সম্প্রদায়ভিত্তিক বাদবিতণ্ডা রয়েছে। সর্বোপরি তিনি নিঃসন্দেহে ভারতের অদ্বিতীয় পণ্ডিত ছিলেন। অদ্যাবধি তাঁর টীকার উপর মন্তব্য করার সাহস কারও হয় নি। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব ভাগবতের টীকার ক্ষেত্রে শ্রীধরস্বামীর টীকাকেই অভ্রান্তভাবে অনুমোদন করে গেছেন তাকে গুরুপদে মেনেছিলেন। শ্রীধরস্বামীর অনুগত ভাষ্য না লেখায় তিনি বল্লভাচার্যকে তিরস্কার করে বলেছিলেন

"শ্রীধরস্বামী প্রসাদেতে ভাগবত জানি।

জগৎগুরু শ্রীধরস্বামী গুরু করি মানি।।

শ্রীধর উপরে গর্বে যে কিছু লিখিবে।

অর্থ-ব্যস্ত লিখন সেই, লোকে না মানিবে।।

শ্রীধরের আনুগত্যে যে করে লিখন।

সব লোক মান্য করি করিবে গ্রহণ।।

শ্রীধরানুগত্যে কর ভাগবতব্যাখ্যান্।

অভিমান ছাড়ি ভজ কৃষ্ণ ভগবান।।"

-(চৈতন্য চরিতামৃত)...

তথ্যসূত্রঃ-

. "অদ্বৈতসিদ্ধি মধুসূদন সরস্বতী", শ্রীব্যোমকেশ ভট্টাচার্য, ভাগবত-রত্ন।

. "অদ্বৈতসিদ্ধিঃ", প্রথমভাগ,পণ্ডিত রাজেন্দ্রনাথ ঘোষের ভূমিকা।

. শ্রীমদ্ভাগবতম্ শ্রীধরী টীকা সমেত, প্রথম স্কন্ধ, উদ্বোধন কার্যালয়।

শ্রীশুভ চৌধুরী

সেপ্টেম্বর ১৫, সোমবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

Photo editing credit Thākur Vishāl

No comments:

তুরীয় ব্রহ্মের স্বরূপঃ-

  মাণ্ডুক্য উপনিষদে তুরীয় ব্রহ্মতত্ত্বের উপদেশ রয়েছে। ঐ দুর্জ্ঞেয় তুরীয় তত্ত্ব বুঝানোর জন্য ওঁকার বা প্রণবকে ব্রহ্মের প্...