Thursday, 28 November 2019

রূপাদি আকাররহিত ব্রহ্মই একমাত্র সুনিশ্চিতভাবে বেদান্তের প্রধান বক্তব্যঃ-


আকারবিশিষ্টতা উপদেশকারিণী এবং নিরাকারতা উপদেশকারিণী ব্রহ্মবিষয়িণী শ্রুতিসকল থাকায় ব্রহ্ম নিরাকারই অর্থাৎ নির্বিশেষই,, কিন্তু তাহার বিপরীত নহে, ইহা কি প্রকারে অবধারণ করা হইতেছে? এইপ্রকার সংশয় হওয়ায় ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ উত্তর দিতেছেন-
'অরূপদেব হি তৎপ্রধানত্বাৎ।।'-ব্রহ্মসূত্র ৩।২।১৪।।
শারীরকভাষ্যম্ অনুসারে ভাবার্থঃ- ভগবৎপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল-'ব্রহ্মকে রুপাদি আকাররহিতরূপেই অবধারণ করিতে হইবে, তিনি রূপাদিযুক্ত নহেন। যেহেতু তাহার প্রধানতা আছে। শ্রুতি তাহা প্রদর্শন করিতেছেন এইভাবে-
'ইনি স্থুল নহেন, অণু নহেন, হ্রস্ব নহেন, দীর্ঘ নহেন'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ৩।৮।৮);

'তিনি শব্দরহিত, স্পর্শরহিত, রূপবিহীন, ক্ষয়রহিত'-(কঠ উপনিষদ্-১।৩।১৫);
'যিনি শ্রুতিতে আকাশনামে প্রসিদ্ধ, তিনিই নাম ও রূপের অভিব্যক্তিকর্ত্তা, নাম ও রূপ যাঁহার মধ্যে অবস্থিত, তিনিই ব্রহ্ম'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৮।১৪।১);
'যেহেতু দিব্য জ্যোতির্ম্ময় এবং সর্বপ্রকার মূর্ত্তিবর্জ্জিত পুরুষ শরীরের বাহিরে ও অভ্যন্তরে অবস্থিত, সেইহেতু তিনি জন্মরহিত'-(মুণ্ডক উপনিষদ্-২।১।২);
'সেই এই ব্রহ্ম অপূর্ব্ব অর্থাৎ কারণবিহীন, অনপর অর্থাৎ কার্য্যবিহীন, অনন্তর অর্থাৎ স্বগতভেদহীন, অবাহ্য অর্থাৎ ইহার বাহিরে কিছুই নাই তথা সজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদবিহীন, সর্ব্ববিষয়ের অনুভবকর্ত্তা এই আত্মাই ব্রহ্ম।'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ২।৫।১৯);
ইত্যাদি এইসকল বাক্য সর্ব্বপ্রপঞ্চাতীত ব্রহ্মাত্মতত্ত্বকে প্রধানভাবে প্রতিপাদন করে, এই বাক্যসকল দ্বারা যথাশ্রুত নিরাকার ব্রহ্মকেই অবধারণ করিতে হইবে।

কিন্তু সাকার অর্থাৎ সপ্রপঞ্চ সবিশেষ ব্রহ্মবিষয়ক অন্যান্য বাক্যসকল তৎপ্রধান নহে অর্থাৎ প্রধানভাবে সবিশেষতা প্রতিপাদন করে না, যেহেতু তাহারা প্রধানভাবে উপাসনাবিধি প্রতিপাদন করে অর্থাৎ বিধিবোধিত উপাসনার অঙ্গরূপে ব্রহ্মকে সমর্পন করে।....................................

Tuesday, 26 November 2019

অসমাহিত চিত্তের ব্যক্তি এই আত্মাকে প্রজ্ঞা দ্বারা লাভ করিতে পারে নাঃ-


চিত্তের অসমাহিত অবস্থা বর্ণনে কৃষ্ণযজুর্বেদীয় কঠশ্রুতি হইল-
নাবিরতো দুশ্চরিতান্নাশান্তো নাসমাহিতঃ ৷
নাশান্তমানসো বাহপি প্রজ্ঞানেনৈনমাপ্নুয়াৎ ৷৷ কঠ উপনিষদ্ ১.২.২৪ ৷৷

শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল-
'তবে এক কথা, যে দুশ্চরিত হইতে অর্থাৎ অর্থাৎ শ্রুতি ও স্মৃতিতে অবিহিত নিষিদ্ধ পাপকর্ম্ম হইতে যে অবিরত অর্থাৎ নিবৃত্ত নহে, ইন্দ্রিয়ের চঞ্চলতাবশতঃ যে অশান্ত বা উপরতিশূন্য এবং যে অসমাহিত-যাঁহার চিত্ত একাগ্র নহে অর্থাৎ যে বিক্ষিপ্ত চিত্ত, আর একাগ্রচিত্ত হইয়াও এই একাগ্রতার ফলকামনায় যে অশান্তচিত্ত অর্থাৎ ফলবিষয়ে ব্যাপৃতচিত্ত, সেই জনও ব্রহ্মতত্ত্বের পরোক্ষজ্ঞানের সহায়ে প্রস্তাবিত যাঁহার প্রকরণ সেই প্রত্যাগাত্মাকে প্রাপ্ত হইতে পারে না।

পক্ষান্তরে যিনি দুশ্চরিত্রতা ও ইন্দ্রিয়ের চঞ্চলতা হইতে বিরত, একাগ্রচিত্ত এবং ঐ একাগ্রতার ফল হইতেও যাঁহার মন নিবৃত্ত এবং উপদেশপরম্পরাপ্রাপ্ত আচার্য্য কর্তৃক উপদিষ্ট, তিনি ব্রহ্মতত্ত্বের পরোক্ষজ্ঞান সহায়ে নির্বিশেষ প্রত্যাগাত্মাকে প্রাপ্ত হন।'

Thursday, 21 November 2019

ভেদদর্শনের নিন্দাপূর্বক অদ্বৈততত্ত্ব প্রতিপাদিত হওয়ায় নির্বিশেষ ব্রহ্মই শ্রুতি প্রতিপাদ্যঃ-




শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ উত্তর মীমাংসা বেদান্তদর্শনে বর্ণিত আছে-
'অপি চৈবমেকে।।'-ব্রহ্মসূত্র ৩।২।১৩।।

ভগবৎপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ-
আর দেখ-'মনের দ্বারা ইহাকে প্রাপ্ত হইতে হইবে, ইঁহাতে কিছুমাত্রও নানাত্ব নাই, যিনি ইঁহাতে নানার ন্যায় অল্পমাত্রও ভিন্নতা দর্শন করেন, তিনি মৃত্যু হইতে মৃত্যুকে অর্থাৎ পুনঃ পুনঃ জন্মমরণকে প্রাপ্ত হন'-(কঠ উপনিষদ-২।১।১১), ইত্যাদি এইপ্রকারে ভেদদর্শনের নিন্দাপূর্ব্বক অভেদ দর্শনই কোন কোন শাখাধ্যায়িগণ পাঠ করেন।

এইপ্রকারে অন্য শাখাধ্যায়িগণও 'ব্রহ্মবিদ্গণ কর্তৃক কথিত ভোক্তা অর্থাৎ জীব, ভোগ্য অর্থাৎ শব্দাদি নিখিল বিষয় এবং প্রেরয়িতা অন্তর্যামী এই ত্রিবিধ সমুদয়কে ব্রহ্মরূপে অবগত হইয়া, জ্ঞানী উক্ত ব্রহ্মকে সর্ব্বদা নিজের আত্মরূপে জানিবেন'-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-১।১২), এই প্রকারে ভোগ্য ভোক্তা ও নিয়ন্তৃরূপ জগৎপ্রপঞ্চের একমাত্র ব্রহ্মস্বরূপতা পাঠ করেন।
এই প্রকারে ভেদদর্শনের নিন্দাপূর্বক অদ্বৈততত্ত্ব প্রতিপাদিত হওয়ায় নির্বিশেষ ব্রহ্মই শ্রুতি প্রতিপাদ্য, ইহা সিদ্ধ হয়।

Thursday, 7 November 2019

'আত্মষট্কম্'



শঙ্করাচার্য্য বিরচিত 'আত্মষট্কম্' ও ইহার ভাবার্থঃ-


ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্য বিরচিত বেদান্তের অদ্বৈত আত্মজ্ঞান বিষয়ক এই ষট্কম্ প্রখ্যাত ও অতুল্য। আমি কে? এই প্রশ্নোত্তরে শ্রুতিজ্ঞান অনুসারে স্বয়ং বেদান্তমূর্ত্তি জগদ্গুরু শঙ্করাচার্য্য বলিতেছেন-

আত্মষট্কম্ , নির্বাণষট্কম্ সার্থম্
মনোবুদ্ধ্যহংকারচিত্তানি নাহং
ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে ।
ন চ ব্যোমভূমিঃ ন তেজো ন বায়ুঃ
চিদানংদরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥ ১॥

আমি না মন, না বুদ্ধি, না অহং, না চিত্ত; না কর্ণ ও জিহ্বা, না নাসিকা ও চক্ষু; না ভূমি, না আকাশ, না অগ্নি, না বায়ু; আমি শাশ্বত জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ শিব, আমি শিব।১
ন চ প্রাণসংজ্ঞো ন বৈ পংচবায়ুঃ
ন বা সপ্তধাতুর্ন বা পংচকোশঃ ।
ন বাক্ পাণিপাদৌ ন চোপস্থপায়ূ
চিদানংদরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥ ২॥

আমি না প্রাণনামধারী, না পঞ্চবায়ু (প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান ও উদান), না সপ্তধাতু (রস, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, মজ্জা ও শুক্র);আমি না পঞ্চকোশ (অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় ও আনন্দময়রূপ কোশ); না বাগিন্দ্রিয় হস্ত ও পদ, না জননেন্দ্রিয় ও মলদ্বার; আমি শাশ্বত জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ শিব, আমি শিব।২
ন মে দ্বেষরাগৌ ন মে লোভমোহৌ
মদো নৈব মে নৈব মাত্সর্যভাবঃ ।
ন ধর্মো ন চার্থো ন কামো ন মোক্ষঃ
চিদানংদরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥ ৩॥

আমার না আছে দ্বেষ বা রাগ; না আছে লোভ বা মোহ; আমার না আছে অহঙ্কার, না আছে মাৎসর্যভাব অর্থাৎ হিংসা, না আছে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ; আমি শাশ্বত জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ শিব, আমি শিব।৩
ন পুণ্যং ন পাপং ন সৌখ্যং ন দুঃখং
ন মংত্রো ন তীর্থং ন বেদা ন য়জ্ঞাঃ ।
অহং ভোজনং নৈব ভোজ্যং ন ভোক্তা
চিদানংদরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥ ৪॥

আমার না আছে পুণ্য, না পাপ, না সুখ, না দুঃখ; না মন্ত্র, না তীর্থ, না বেদ, না যজ্ঞ , আমি না ভোজন, না ভোজ্য না ভোক্তা; আমি শাশ্বত জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ শিব, আমি শিব।৪
ন মে মৃত্যুশংকা ন মে জাতিভেদঃ
পিতা নৈব মে নৈব মাতা ন জন্ম ।
ন বংধুর্ন মিত্রং গুরুর্নৈব শিষ্য-
শ্চিদানংদরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥ ৫॥

না আছে আমার মৃত্যু না মৃত্যু ভয়, না জাতিভেদ, না আছে আমার জন্ম, না পিতা, না মাতা; না আছে বন্ধু, না মিত্র, না গুরু, না শিষ্য; আমি শাশ্বত জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ শিব, আমি শিব।৫
অহং নির্বিকল্পো নিরাকাররূপো
বিভুর্ব্যাপ্য সর্বত্র সর্বেন্দ্রিয়াণাম্ ।
ন চাসঙ্গতং নৈব মুক্তির্ন মেয়-
শ্চিদানংদরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥ ৬॥

আমি না ইন্দ্রিয়বর্গের সহিত সম্বন্ধযুক্ত, আমি না মুক্তি, না জ্ঞে­য়; আমি নির্বিকল্প. নিরাকার এবং সর্বব্যাপী বলিয়া সর্বত্র বিরাজমান, আমি অদ্বৈত জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ শিব, আমি শিব।৬
॥ ইতি শ্রীমচ্ছঙ্করাচার্যবিরচিতং আত্মষট্কং সম্পূর্ণম্ ॥
ইতি শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য বিরচিত 'আত্মষট্কং' সম্পূর্ণ।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...