Monday, 28 December 2020

চক্ষু নিজ মূলসত্তা ব্রহ্মকে গ্রহণ করিতে পারে না, পক্ষান্তরে ব্রহ্মের দ্বারা উদ্ভাসিত হইয়াই চক্ষু অন্য দৃশ্যপদার্থকে গ্রহণ করিতে পারেঃ-



সামবেদীয় কেন উপনিষদে (১।৬) বর্ণিত আছে-

যচ্চক্ষুষা ন পশ্যতি যেন চক্ষূংষি পশ্যতি। তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি....

শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- যাঁহাকে (অর্থাৎ যে ব্রহ্মকে) লোকে অন্তঃকরণের বৃত্তির সহিত সংযুক্ত চক্ষুর দ্বারা দেখিতে পায় না অর্থাৎ যাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না, কিন্তু যাঁহার নিমিত্ত অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ আত্মজ্যোতির দ্বারা চক্ষুসকলকে অর্থাৎ অন্তঃকরণের বৃত্তির ভেদানুসারে পৃথক্ পৃথক্ চক্ষুর বৃত্তিসকলকে দেখিয়া থাকে অর্থাৎ প্রকাশিত এবং ব্যাপ্ত করে। তাঁহাকেই তুমি ব্রহ্ম বলিয়া জানিবে।

Wednesday, 16 December 2020

শ্রুতি ও স্মৃতি বলে জীবের বিভুত্ব প্রতিপাদনঃ-


এক্ষণে জীব কি পরিমাণবিশিষ্ট, ইহা চিন্তা করা হইতেছে। তাহা কি অণুপিমাণ, অথবা মধ্যম পরিমাণ অথবা মহাপরিমাণ অর্থাৎ বিভু,সর্ব্বব্যাপক? কিন্তু আত্মা উৎপন্ন হয় না এবং নিত্যচৈতন্যস্বরূপ, ইহা কথিত হইয়াছে। আর সেই হেতু পরমাত্মাই জীব ইহা আসিয়া পড়িতেছে। আবার পরমাত্মার অনন্ততা শ্রুতিতে পঠিত হইয়াছে, তাহাতে জীবের পরিমাণবিষয়ক বিচারের অবতারণা কি প্রকারে হইতেছে? তদুত্তরে বলা হইতেছে হ্যাঁ ইহা সত্য, কিন্তু উৎক্রান্তি, চন্দ্রলোকাদিতে গতি এবং তথা হইতে আগমন প্রতিপাদক শ্রুতিবাক্যসকল জীবের পরিচ্ছেদ (সসীমতা) প্রাপ্ত করাইতেছে। আর কোন কোন স্থলে স্ব (-অণুপরিমাণতা) বোধক শব্দের দ্বারা জীবের অণুপরিমাণতা পঠিত হইতেছে। সেই শ্রুতি বাক্যসকলের পরস্পর অবিরোধ প্রতিপাদনের জন্য ভগবান বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত করিতেছেন-

তদ্গুণসারত্বাত্তু তদ্ব্যপদেশঃ প্রাজ্ঞবৎ ৷৷ ব্রহ্মসূত্র-২.৩.২৯৷৷
শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- ভগবাৎপাদ্ শ্রীশঙ্করাচার্য্য শারীরকভাষ্যম্ এ বলিতেছেন-সূত্রস্থ 'তু' শব্দটী (বিরোধী) পক্ষকে ব্যাবৃত্ত (খণ্ডিত) করিতেছে। আত্মা (জীব) অণু ইহা শ্রুতিতে নাই। জীবের উৎপত্তি শ্রুতিতে বর্ণিত না হওয়ায়, পরব্রহ্মেরই জীবরূপে প্রবেশ শ্রুতিতে বর্ণিত হওয়াই এবং ব্রহ্মের সহিত জীবের তাদাত্ম্য অর্থাৎ তৎস্বরূপতা বা অভিন্নতা উপদিষ্ট হওয়ায় পরব্রহ্মই জীব, ইহা কিন্তু পূর্বে কথিত হইয়াছে। আর যদি জীব পরব্রহ্মই হয়, তাহা হইলে পরব্রহ্ম যতটা জীবও ততটা হওয়া উচিত। আর পরব্রহ্মের বিভুতা শ্রুতিতে পঠিত হইয়াছে, সেইহেতু জীব বিভু। তাহা হইলে-
'স বা এষ মহানজ আত্মা যোযং বিজ্ঞানমযঃ প্রাণেষু'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৪।২২)
"সেই এই মহান জন্মরহিত আত্মা, যিনি ইন্দ্রিয়সকলের মধ্যে বিজ্ঞানময়(-বুদ্ধিরূপ উপাধিযুক্ত)", ইত্যাদি এই জাতীয় জীববিষয়ক বিভুত্বপ্রতিপাদক শ্রুতি ও স্মৃতি সকল সমর্থিত হইয়া থাকে।.......................................

Monday, 7 December 2020

উপদেশসাহস্রী (১-৩)



পরমহংস পরিব্রাজক ভগবৎপাদ্ শ্রী শঙ্করাচার্য্য বিরচিত উপদেশসাহস্রী প্রারম্ভ-
গদ্যবন্ধঃ প্রথমো ভাগঃ ।
শিষ্যপ্রতিবোধবিধিপ্রকরণম্ ॥
অথ মোক্ষসাধনোপদেশবিধিং ব্যাখ্যাস্যামো মুমুক্ষূণাং শ্রদ্দধানানামর্থিনামর্থায় ॥ ১॥
বঙ্গানুবাদঃ- অনন্তর শ্রদ্ধালু মুক্তিকাম অধিকারীদিগের উপকারের নিমিত্ত মুক্তির উপায়ভূত তত্ত্বজ্ঞানের উপদেশবিধি বিশদরূপে ব্যাখ্যা করব।১
তদিদং মোক্ষসাধনং জ্ঞানং
সাধনসাধ্যাদনিত্যাৎসর্বস্মাদ্বিরক্তায় ত্যক্তপুত্রবিত্তলোকৈষণায়
প্রতিপন্নপরমহংসপারিব্রাজ্যায় শমদমদয়াদিয়ুক্তায়
শাস্ত্রপ্রসিদ্ধশিষ্যগুণসম্পন্নায় শুচয়ে ব্রাহ্মণায়
বিধিবদুপসন্নায় শিষ্যায় জাতিকর্মবৃত্তবিদ্যাভিজনৈঃ পরীক্ষিতায়
ব্রূয়াৎপুনঃপুনঃ যাবদ্গ্রহণং দৃঢ়ীভবতি ॥ ২॥
বঙ্গানুবাদঃ- আচার্য্য অনিত্য সমূদয় (ব্রহ্মলোক পর্যন্ত) দৃষ্ট ও অদৃষ্টসাধন ঐহিক ও পারলৌকিক ভোগসমূহ হতে বিরক্ত, পুত্রৈষণা, বিত্তৈষণা, লোকৈষণা-পরিত্যাগী, পরমহংসপরিব্রাজ্যাশ্রমী সন্ন্যাসী, শমদমাদি-বিশিষ্ট, শাস্ত্রপ্রসিদ্ধ শিষ্যগুণ সম্পন্ন, শৌচশীল, যথাশাস্ত্র পাদবন্দনাদিপূর্বক বিদ্যাগ্রহণার্থ গুরুসমীপবর্ত্তী, জাতি-কর্ম্ম-স্বভাব, বেদবিদ্যা ও কুল দ্বারা পরীক্ষিত বিপ্র শিষ্যকে শাস্ত্রপ্রসিদ্ধ এই মোক্ষসাধন তত্ত্বজ্ঞানের উপদেশ প্রদান করিবেন, যে পর্য্যন্ত শিষ্য দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করিতে না পারে ততক্ষণ গুরু পুনঃ পুনঃ বলিবেন।২
টীকাঃ- এষণা শব্দের অর্থ কামপ্রযুক্ত প্রবৃত্তি। পুত্রের নিমিত্ত পত্নীসংগ্রহে প্রবৃত্তির নাম পুত্রৈষণা, কর্মাদি অনুষ্ঠানের নিমিত্ত বিত্তসংগ্রহের নাম বিত্তৈষণা, পুত্র,কর্ম্ম ও অপরবিদ্যাসাধ্য পৃথিবীলোক, পিতৃলোক ও দেবলোকে প্রবৃত্তির নাম লোকৈষণা।
শ্রুতিশ্চ--- ' পরীক্ষ্য লোকান্ ...তত্ত্বতো ব্রহ্মবিদ্যাম্ '
ইতি । দৃঢগৃহীতা হি বিদ্যা আত্মনঃ শ্রেয়সে সন্তত্যৈ চ ভবতি ।
বিদ্যাসন্ততিশ্চ প্রাণ্যনুগ্রহায় ভবতি নৌরিব নদীং তিতীর্ষোঃ ।
শাস্ত্রং চ---' যদ্যপ্যস্মা ইমামদ্ভিঃ পরিগৃহীতাং ধনস্য পূর্ণাং
দদ্যাদেতদেব ততো ভূয়ঃ ' ইতি ।
অন্যথা চ জ্ঞানপ্রাপ্ত্যভাবাৎ---' আচার্যবান্ পুরুষো বেদ ' ,
'আচার্যাদ্ধৈব বিদ্যা বিদিতা', 'আচার্যঃ প্লাবয়িতা ',
'সম্যগ্জ্ঞানং প্লব ইহোচ্যতে ' ইত্যাদিশ্রুতিভ্যঃ, ' উপদেক্ষ্যন্তি
তে জ্ঞানং, ' ইত্যাদিস্মৃতেশ্চ ॥ ৩॥
বঙ্গানুবাদঃ-গুরু শিষ্যকে উপদেশ প্রদান করিবেন এই বিষয়ে শ্রুতিও আছে-“বিপ্র কর্ম্মের দ্বারা সম্পাদিত স্বর্গাদিলোকসমূহ পরীক্ষা করিয়া কর্ম্মদ্বারা মোক্ষলাভ হয় না বলিয়া বৈরাগ্য লাভ করিবেন। যাহা অভয়, মঙ্গলময়, অকৃত, নিত্যলক্ষ্যবস্তু সেই ব্রহ্মকে বিশেষভাবে বুঝিবার জন্য তিনি গুরুকেই অর্থাৎ শমদমদয়াদিসম্পন্ন আচার্য্যকেই আশ্রয় করিবেন। শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন হইলেও নিজে স্বতন্ত্রভাবে ব্রহ্মবিষয়ক বিদ্যার নিমিত্ত আকাঙ্খা করিবে না। তিনি হোমীয় কাষ্ঠভার গ্রহণ করিয়া, শ্রোত্রিয় অর্থাৎ বেদাধ্যয়নে ও বেদার্থে পারদর্শী এবং সর্বকর্ম পরিত্যাগ করিয়া কেবল অদ্বয় ব্রহ্মেতে নিষ্ঠা যাহাঁর এইরূপ ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরুর নিকট গমন করিবেন। তিনি ঐ গুরুর নিকট যথাবিধি উপস্থিত হইয়া, তাহাঁকে প্রসন্ন করিয়া অব্যয় চিরন্তন পুরুষের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিবেন।“-(মুণ্ডক উপনিষদ্-১.২.১২)
“সেই বিদ্বান সমীপস্থিত সম্পূর্ণরূপ প্রশান্তচিত্ত শমবিশিষ্ট সেই শিষ্যের উদ্দেশ্যে সত্যস্বরূপ অক্ষরপুরুষের জ্ঞানের উপায়ভূত ব্রহ্মবিদ্যা যথাযথ রূপে বর্ণন করিবেন।”(মুণ্ডক উপনিষদ্-১.২.১৩)
যেহেতু বিদ্যা দৃঢ়ভাবে গৃহীত হইলে তাহা আত্মার (পুরুষের) কল্যাণের (অবিদ্যাদোষ ও সংসারের নিবৃত্তের) এবং শিষ্য প্রশিষ্য ক্রমে বিদ্যার অবিচ্ছেদের নিমিত্ত হইয়া থাকে। নদী হইতে উত্তীর্ণ হইবার উপায়স্বরূপ নৌকার ন্যায় অবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যা প্রাণীর অনুগ্রহের (সংসার সমুদ্র হইতে উত্তীর্ণ হইবার) নিমিত্ত হইয়া থাকে।
এইবিষয়ে শাস্ত্রেও উদ্ধৃত আছে-“যদি কোন লোক সমুদ্রপরিবৃত ধনপূর্ণা পৃথিবী কাহাকেও প্রদান করে, তাহা হইলেও সে তাহাকে ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করিবে না, কারণ তাহা হইতেও ব্রহ্মজ্ঞান উৎকৃষ্টতর।“-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৩।১১।৬)
অন্যপ্রকারে অর্থাৎ আচার্য্যের অপেক্ষা না করিয়া জ্ঞানলাভ হতে পারে না। “আচার্য্যযুক্ত পুরুষ জ্ঞান লাভ করে।“-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।১৪।২)
'ভগবৎসদৃশ আচার্য্যগণের নিকটেই আমি ইহা বিদিত আছি যে, গুরুমুখে বিজ্ঞাত বিদ্যাই কল্যাণতম হইয়া থাকে।-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৪।৯।৩)
আচার্য্যই যে সংসারসাগর হইতে উদ্ধারকর্ত্তা এবং তত্ত্বজ্ঞানই যে ভেলাস্বরূপ ইত্যাদি শ্রুতিসমূহ প্রমাণস্বরূপ।
“সেই বিশিষ্ট জ্ঞান যে বিধির দ্বারা পাওয়া যায় তাহা জান। আচার্য্যের নিকট গমন করে প্রকৃষ্টরূপে সর্বাঙ্গ নিম্নকরণের দ্বারা প্রণিপাত অর্থাৎ দীর্ঘ নমস্কারের দ্বারা ‘বন্ধন কি?’, ‘মোক্ষ কি?’, ‘বিদ্যা কি?’, ‘অবিদ্যাই বা কি?’ ইত্যাদি পরিপ্রশ্ন এবং সেবা অর্থাৎ গুরুশুশ্রূষার দ্বারা সেই ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায়। এইরূপ বিনয়াদির দ্বারা প্রসন্নভূত তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী আচার্য্যেরা তোমাকে যথোক্ত-বিশেষণ অর্থাৎ তত্ত্বদর্শনরূপ জ্ঞান উপদেশ প্রদান করিবেন।“-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪।৩৪) ইত্যাদি স্মৃতিতেও তাহা স্পষ্ট

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...