সদানন্দযোগীন্দ্র সরস্বতী বেদান্তসারে বলিতেছেন-"পণ্ডিতেরা সেই প্রথমোৎপন্ন আকাশাদি পঞ্চভূতকে সূক্ষ্মভূত, তন্মাত্রা ও অপঞ্চীকৃত মহাভূত বলিয়া থাকেন।"-(বেদান্তসারঃ, ৫৯)
অপঞ্চীকৃত
পঞ্চ সূক্ষ্মভূতকে পণ্ডিতেরা তন্মাত্র বলেন কেন?
ভগবান
শঙ্করাচার্যের "অহংকারাৎ পঞ্চতন্মাত্রাণি" এই পঞ্চীকরণ সূত্রের বার্ত্তিকাভরণম্
এ অভিনবনারায়ণেন্দ্র সরস্বতী বলছেন-
বিষ্ণুপুরাণেও এইরূপ উক্ত হয়েছে- 'শব্দ স্পর্শাদি বিশেষ বিশেষ ধর্ম আকাশাদি পৃথক্ পৃথক্ ভূত সকলে তাদাত্ম্য সম্বন্ধেই থাকে, অন্যত্র থাকে না। অর্থাৎ শব্দ আকাশেই থাকে, স্পর্শ বায়ুতেই থাকে ইত্যাদি। এইজন্য স্মৃতি শাস্ত্রে উহাদের নাম তন্মাত্র বলা হয়েছে।'
সূক্ষ্মশরীর কি?
সদানন্দযোগীন্দ্র
সরস্বতী বেদান্তসারে বলিতেছেন- "আকাশাদি এইসকল পাঁচটি সূক্ষ্মভূত থেকে সূক্ষ্মশরীর
সকল উৎপন্ন হয়। সতেরটি অবয়ব বিশিষ্ট লিঙ্গশরীরকে সূক্ষ্মশরীর বলে। পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়,
পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, পাঁচটি বায়ু, মন ও বুদ্ধি- এই সতেরোটি অবয়ব নিয়ে সূক্ষ্মশরীর
গঠিত।"-(বেদান্তসার,৬০-৬২)
লিঙ্গশরীর
কেন বলা হয়?
তদুত্তরে
বলিব, ইহার দ্বারা আত্মা জ্ঞাপিত হয় বলিয়া ইহাকে বলা হয় 'লিঙ্গ'।
আনন্দ গিরি পঞ্চীকরণ বিবরণে তাহাই বলিতেছেন- "এই লিঙ্গ কোন প্রকারে প্রত্যাগাত্মার জ্ঞাপক- এইকারণে ইহাকে 'লিঙ্গ' এইরূপে ব্যাখ্যা করা হয়। এই লিঙ্গের কার্য্যত্ব বলিয়া ফলতঃ ভৌতিকত্ব বলায় লিঙ্গে অহম্ অভিমান অর্থাৎ 'লিঙ্গই আমি' এইরূপ অভিমান অপ্রামাণিক- ইহাই মনে করিতেছেন। অতএব এই অপঞ্চীকৃত ভূতপঞ্চক্বই লিঙ্গ। এই পূর্বোক্ত সপ্তদশ অবয়বযুক্ত লিঙ্গ ভূতকার্য বলিয়া ভৌতিক।"-(পঞ্চীকরণ বিবরণ-১৩)
বেদান্ত
মীমাংসা শাস্ত্রের প্রাণোৎপত্ত্যধিকরণের প্রতিপাদ্য বিষয় পরমেশ্বর হইতে আকাশাদির ন্যায়
ইন্দ্রিয়াদিও উৎপন্ন হইয়াছে। এক্ষণে সেই আকাশাদি মহাভূত হইতে লিঙ্গশরীরের উৎপত্তি
বিষয়ক আলোচনার সূচনা হইবে। ইন্দ্রিয়সকল কি অনাদি অথবা পরমেশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হয়?
এই প্রশ্নের উত্তরে ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ বলিতেছেন-
তথা
প্রাণাঃ ৷৷ ব্রহ্মসূত্র ২.৪.১৷৷
ভগবান
ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য শারীরক মীমাংসা ভাষ্যে বলিতেছেন- এই স্থলে প্রাণ সকলের (-মুখ্য
প্রাণ ও ইন্দ্রিয়সকলের) উৎপত্তিবোধক শ্রুতি বাক্যসকলই উদাহরণ, যথা-
'এতস্মাদাত্মনঃ
সর্বে প্রাণাঃ সর্বে লোকাঃ সর্বে দেবাঃ সর্বাণি ভূতানি ব্যুচ্চরন্তি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২।১।১০)
"এই
আত্মা হইতে সকল প্রাণ, সকল লোক, সকল দেবতা এবং সকল প্রাণী নানাভাবে উদ্গত হয়।"
উক্ত
শ্রুতিবাক্যে যেমন লোক প্রভৃতি পরব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন হয়, 'তথা'(-তদ্রূপ) প্রাণসকলও
উৎপন্ন হয়, ইহাই অর্থ।
এইপ্রকারে
'এতস্মাজ্জায়তে প্রাণো মনঃ সর্বেন্দ্রিয়াণি চ৷ খং বায়ুর্জ্যোতিরাপঃ পৃথিবী বিশ্বস্য
ধারিণী'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২।১।৩)
"ইঁহা
হইতে প্রাণ, মন, ইন্দ্রিয়সকল, আকাশ, বায়ু, বহ্নি, জল এবং সকলের আধারভূতা পৃথিবী উৎপন্ন
হয়।"
ইত্যাদি
এইসকল শ্রুতিবাক্যেও আকাশাদির ন্যায় প্রাণ সকলের উৎপত্তি শ্রুত হয়। সুতরাং প্রাণসকল
যে বিকার (-কার্য্য বস্তু) শ্রুতিপ্রমাণ হেতু তাহা সিদ্ধ হইল।
আবার
ছান্দোগ্য শ্রুতিতে স্পষ্টতই বুঝাইতেছে যে, যে-ভূতবর্গ স্বয়ং ব্রহ্ম হইতে জাত সেই
ভূতবর্গ হইতেই ইন্দ্রিয়াদি উৎপন্ন হইয়াছে। ছান্দোগ্যের এই প্রকরণেই বাগিন্দ্রিয়,
প্রাণ ও মনের যথাক্রমে তেজঃ, জল ও ক্ষিতি হইতে উৎপত্তি পঠিত হইতেছে, যথা-
'অন্নময়ং হি সোম্য মন আপোময়ঃ প্রাণস্তেজোময়ী বাক্'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।৫।৪)
"হে সৌম্য, মন অন্নের বিকার (-কার্য্য), প্রাণ জলের বিকার এবং বাগেন্দ্রিয় তেজের বিকার" ইত্যাদি। এইস্থলে ক্ষিত্যাদি পরম্পরাতে প্রাণসকলের (-মুখ্য প্রাণ ও ইন্দ্রিয়সকলের) ব্রহ্মকার্য্যতাই সিদ্ধ হয়।........