Wednesday, 29 March 2023

নির্বিশেষ অদ্বৈতবাদ শূন্যবাদ হইয়া পড়ে—এইরূপ আপত্তির নিরসনঃ-

 


পূর্বপক্ষঃ- তুরীয়ে যদি কোনরূপই বিশেষ ভাব না থাকে, তাহা হইলে তাহা শূন্য হইয়া পড়ে?

উত্তরপক্ষঃ- নাতাহা শূন্য নহে; কারণ, বিনা কারণে কখনই মিথ্যাময় কল্পনা হইতে পারে না; কেননা, শুক্তি, রজ্জু, স্থাণু (কাণ্ডশাখাদিবিহীন বৃক্ষাংশ) মরুভূমি প্রভৃতি আশ্রয় ব্যতিরেকে নিরাশ্রয়ভাবে কখনই (যথাক্রমে) রজত, সর্প, মনুষ্য, মৃগতৃষ্ণাদি ভ্রমপ্রতীতি কল্পনা করিতে পারা যায় না।

আপত্তিঃ- তিনি যদি সর্ব্বকল্পনার আশ্রয়স্থান হন, তাহা হইলে ঘটাদি পদার্থ যেরূপ জলাধারাদিরূপে শব্দ-বাচ্য হয়, সেইরূপ তুরীয়ও (ভ্রমাধিষ্ঠানরূপে) শব্দবাচ্য হইতে পারেন; সুতরাং নিষেধ দ্বারা তাঁহার প্রতীতি সম্পাদনের আবশ্যক হয় না।

উত্তরঃ- না আপত্তি হইতে পারে না ; কারণ, শুক্তিকা প্রভৃতিতে কল্পিত রজতাদির ন্যায় প্রাণাদির কল্পনাও অসৎঅবস্তু; সৎ অসতের সম্বন্ধ কখনই শব্দজনিত বোধের বিষয় হইতে পারে না ; কারণ, উহা অবস্তুমিথ্যা। আর গবাদি সত্য পদার্থ যেরূপ স্বরূপতই প্রত্যক্ষাদি প্রমাণান্তরের বিষয় হয়, সেরূপও হইতে পারে না; কারণ, আত্মা বস্তুটি নিরুপাধিক। গবাদির ন্যায় জাতিবিশিষ্টও নহে, কারণ, অদ্বিতীয় পদার্থের সামান্য বিশেষভাব নাই; আর পাচকাদির ন্যায় ক্রিয়াবত্ত্বও নাই, কারণ, অবিক্রিয়; নীলাদি দ্রব্যের ন্যায় গুণবত্তাও নাই, কারণ, তিনি নির্গুণ; কাজেই তিনি শব্দ দ্বারা নির্দ্দেশযোগ্য হন না।.......

ঋণঃ- ভগবান্ শঙ্করাচার্য্যের মাণ্ডুক্য উপনিষৎ ভাষ্য।

শ্রীশুভ চৌধুরী

মার্চ ২৬, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

সমাধিঃ-

 


প্রত্যয়ের একতানতা অর্থাৎ একতত্ত্ববিষয়ে প্রবাহ। তাহাও দুই প্রকারবিচ্ছিন্ন হইয়া জাত এবং সতত (প্রবাহমান) দুইটি প্রকার যথাক্রমে ধ্যান সমাধি হয়। ইতোমধ্যে ধ্যান বিষয়ে পূর্ব লিখায় আলোচনা করিয়াছি। সেই ধ্যানই যখন তাহার বিষয়মাত্র প্রকাশে স্বরূপ-শূন্য-মতো হয়, তখন তাহা হইল সমাধি। ভগবান্ যোগসূত্রকার তাহাই বলিতেছেন

তদেবার্থমাত্রনির্ভাসং স্বরূপশূন্যমিব সমাধিঃ।।(যোগসূত্র-/)

-তাহাই যখন সমুদয় বাহ্যোপাধি পরিত্যাগ করিয়া কেবল অর্থমাত্রকে প্রকাশ করে, তখনসমাধিআখ্যা প্রাপ্ত হয়।

ভাষ্যকার ব্যাস বলিতেছেন— 'ধ্যেয়ের আকার প্রকাশক ধ্যানই যখন নিজ জ্ঞান-বৃত্ত্যাত্মক স্বরূপের দ্বারা শূন্য-মতো হইয়া যায় ধ্যাতাতে ধ্যেয় বস্তুর স্বভাবের একটানা আবেশ ঘটায়, তখন তাহাকে সমাধি বলা হইয়াছে।'

যোগবার্তিককারের মতে জীবাত্মা পরমাত্মার যে সমতা অর্থাৎ যখন জীবাত্মা মন বুদ্ধি অস্মিতার মিলন সত্ত্বা ভিন্ন অন্য পরম সত্ত্বায় অর্থাৎ কেবলমাত্র পরমাত্মায় স্থিতি (ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ) করে, তখনকার সেই অবস্থা হইল সমাধি। ভগবান্ শঙ্করাচার্য্য অপরোক্ষানুভূতিতে তাহাই বলিতেছেন—'সম্পূর্ণ বিকাররহিত বৃত্তিদ্বারা পুনরায় ব্রহ্মের সহিত একাত্ম চিন্তন দ্বারা যথাযথভাবে বৃত্তিসমুদায়ের বিস্মৃতিই জ্ঞানসংজ্ঞক সমাধি বলিয়া কথিত।'

সমাধি দুই প্রকার। একটিকেসম্প্রজ্ঞাত অপরটিকেঅসম্প্রজ্ঞাতবলে।

#সম্প্রজ্ঞাত

যোগসূত্রের সমাধিপাদে বর্ণিত আছে"বিতর্কবিচারানন্দাস্মিতানুগমাৎ সম্প্রজ্ঞাতঃ" অর্থাৎ যে সমাধিতে বিতর্ক, বিচার, আনন্দ অস্মিতা অনুগত থাকে, তাহাকে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলে। ধ্যানাভ্যাসের উৎকর্ষ হলে অহঙ্কার বর্জিত  ব্রহ্মাকারা মনোবৃত্তির প্রবাহ হয়, তাকে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলে। শ্রুতি তাহাই বলিতেছেন

ব্রহ্মাকারমনোবৃত্তিপ্রবাহোঽহঙ্কৃতং বিনা।সম্প্রজ্ঞাতসমাধিঃ স্যাদ্ধ্যানাভ্যাসপ্রকর্ষতঃ॥-(মুক্তিকোপনিষৎ-/৫৩)

#অসম্প্রজ্ঞাত

 "বিরাম-প্রত্যয়াভ্যাসপূর্বঃ সংস্কারশেষোহন্যঃ" অর্থাৎ অন্যপ্রকার সমাধিতে সর্বদা সমুদয় মানসিক ক্রিয়ার বিরাম অভ্যাস করা হয়, কেবল চিত্তের দৃঢ় সংস্কার-মাত্র অবশিষ্ট থাকে। ইহাই পূর্ণ জ্ঞানাতীতঅসম্প্রজ্ঞাত সমাধি’; এই সমাধি পরমানন্দদায়ী। শ্রুতি তাহাই বলিতেছেন

প্রশান্তবৃত্তিকং চিত্তং পরমানন্দদায়কম্।

অসম্প্রজ্ঞাতনামায়ং সমাধির্যোগিনাং প্রিয়ঃ -(মুক্তিকোপনিষৎ-/৫৪)

যখন এই অসম্প্রজ্ঞাত অর্থাৎ জ্ঞানাতীত অবস্থা লাভ হয়, তখন সমাধি নির্বীজ হইয়া যায়।.....

শ্রীশুভ চৌধুরী

মার্চ ১৭, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

Saturday, 18 March 2023

ব্রহ্ম শাস্ত্রপ্রমাণগম্য, অনুমানাদিগম্য নহেনঃ-

 


ব্রহ্ম বেদৈকবেদ্য। একমাত্র বেদরূপ প্রমাণের দ্বারাই জগতের কারণাদিরূপে ব্রহ্মকে জানা যায় বলিয়া, ব্রহ্ম বেদমাত্রগম্য। ভগবান্ বাদরায়ণ বলিতেছেনশাস্ত্রযোনিত্বাৎ৷৷- (ব্রহ্মসূত্র- ১।১।৩)

ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য শারীরক-মীমাংসা ভাষ্যে বলিতেছেন

প্রদীপের ন্যায় সর্বার্থপ্রকাশক মহৎ যে ঋগ্বেদাদি শাস্ত্র, যাহা বেদাঙ্গ, পুরাণ, ন্যায়, মীমাংসা, স্মৃতি ধর্ম্মশাস্ত্র প্রভৃতি অনেক বিদ্যাস্থান দ্বারা পুষ্ট এবং যাহা সর্বজ্ঞকল্প অর্থাৎ সর্ব্বপ্রকার জ্ঞানের আকর হইলেও অচেতন হওয়াই যাহাকে প্রায় সর্বজ্ঞ বলা যায়, তাহার যোনি অর্থাৎ উপাদান এবং নিমিত্ত কারণ ব্রহ্ম।

'অস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিতং যদেতদৃগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অর্থবাঙ্গিরসঃ।'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ..১০)

অর্থাৎ এই যে ঋগ্বেদাদি চতুর্বেদ ইহারা এই মহৎভূতের নিঃশ্বসিত তথা নিঃশ্বাসের ন্যায় ব্রহ্মের বিনাপ্রযত্নে অভিব্যক্ত।

এই প্রকার শ্রুতি আছে বলিয়া ঋগ্বেদাদি শাস্ত্র সর্ব্ববিধ জ্ঞানের আকর স্বরূপ, তাহা বিনাপ্রযত্নে লীলান্যায়ে পুরুষের নিঃশ্বাসের ন্যায় মহৎ ভূত ব্রহ্মরূপ যোনি কারণ হইতে উৎপন্ন। এই ব্রহ্মের যথার্থ স্বরূপ অবগতির প্রতি পূর্ব্ব কথিত ঋগ্বেদাদি শাস্ত্র হয় যোনি, অর্থাৎ কারণ অর্থাৎ প্রমাণ। শাস্ত্ররূপ প্রমাণ হইতেই জগতের জন্মাদির কারণরূপে ব্রহ্ম অধিগত হন, ইহাই অভিপ্রায়।

শ্রীভারতী তীর্থ বৈয়াসিক ন্যায়মালাতে বলিতেছেন

রূপ এবং লিঙ্গরহিত হওয়ায় ইঁহার অন্য প্রমাণযোগ্যতা নাই। কোনপ্রকার রূপ-রসাদি না থাকায় ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নহেন এবং লিঙ্গ (—জ্ঞাপক চিহ্ন) সাদৃশ্যাদি রহিত হওয়ায় তিনি অনুমান উপমানাদি প্রমাণেরও বিষয় নহেন। "তং তু ঔপনিষদং পুরুষং পৃচ্ছামি"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-..২৬) অর্থাৎ সেই উপনিষৎপ্রতিপাদ্য পুরুষের বিষয় জিজ্ঞাসা করিতেছি", ইত্যাদি শ্রুতিতে পরব্রহ্মরূপ পুরুষ উপনিষদ্গম্য, ইহা প্রতীত হইতেছে।.....

শ্রীশুভ চৌধুরী

মার্চ , ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

 

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...