Thursday, 21 September 2023

ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণঃ-

 


বস্তুর স্বরূপই বস্তুর স্বরূপলক্ষণ, যাহা বস্তুর স্বরূপ হইয়া অন্য বস্তু হইতে সেই বস্তুকে ভিন্নভাবে বোধ করায়, তাহাই স্বরূপলক্ষণ। যেমন"সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম" -(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-..) , ইহা ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ; কারণ সত্যাদি পদার্থ ব্রহ্মের স্বরূপ হইয়া অন্য বস্তু হইতে ব্রহ্মকে ভিন্নভাবে বোধ করায়। 'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম' এই শ্রুতিবাক্য ব্রহ্মের লক্ষণবিষয়ক। লক্ষণের সাহায্যে ব্রহ্মের পরিচয় দিতে হইলে, অপরাপর পদার্থ রাজি হইতে ব্রহ্মের পৃথক্ স্বরূপটিই দেখান আবশ্যক। বিশ্বের তাবৎ বস্তুই অসত্য, জড় এবং পরিচ্ছিন্ন। ব্রহ্ম অসত্য বা মিথ্যা বস্তু নহেন, জড় নহেন, এবং সসীম বা পরিচ্ছিন্নও নহেন। এই দৃষ্টিতেই অদ্বৈতবেদান্তে নির্বিশেষ ব্রহ্মের স্বরূপ বিচার করিতে হইবে। অর্থাৎ বিধিমুখে ব্রহ্মকে জানিবার উপায় নাই, কেননা ব্রহ্মতত্ত্ব অবাঙ্মনসগোচর। নেতি নেতি, ব্রহ্ম ইহা নহে, তাহা নহে, এইরূপ নিষেধমুখেই ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝিতে হইবে। ভগবান্ শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্য নিষেধমুখেই করিয়াছেন। যথা

সত্য অর্থাৎ যেরূপে যাহা নিশ্চিত হইয়াছে সেই স্বরূপকে যাহা লঙ্ঘন করে না তাহা সত্য। কিন্তু যেরূপে যাহা নিশ্চিত হইয়াছে সেই স্বরূপকে লঙ্ঘনকারী যে বস্তু তাহা মিথ্যা বলিয়া কথিত হয়। এইজন্য বিকার (পরিণামবিশিষ্ট বস্তু) অনিত্য, যেহেতু 'বিকার মাত্রই বাগবলম্বনে অবস্থিত নাম মাত্র, কেবল মৃত্তিকাই সত্য' এইরূপ 'সৎ' কেই (অবিকারীকেই) সত্য বলিয়া অবধারণ করা হইয়াছে। অতএব 'সত্যং ব্রহ্ম' ইহা বলিয়া শ্রুতি ব্রহ্মকে বিকার হইতে নিবৃত্ত করিতেছেন।

ইহার ফলে কিন্তু ব্রহ্মের (বিকার সমুদয়ের) কারণত্ব প্রাপ্তি হইতেছে। আর কারণের ক্রিয়াসম্বন্ধ হয় এবং সত্য পদার্থ সত্ত্বাবিশিষ্ট হওয়াতে মৃত্তিকার ন্যায় অচেতনত্ব প্রাপ্তি হইয়া যাইতেছে; এই জন্য 'জ্ঞানং ব্রহ্ম' ইহা বলা হইতেছে। এই জ্ঞানের অর্থ জ্ঞপ্তি বা অনুভূতি অর্থাৎ অনুভতিরূপ সিদ্ধিবাচক এই জ্ঞান (কিন্তু বৃত্তিজ্ঞানরূপ ক্রিয়া নহে); অর্থাৎ তিনি জ্ঞানকর্তা হন না, কারণ সত্য অনন্তের সহিত জ্ঞানও ব্রহ্মের আরেক বিশেষণ হয়। আবার যেহেতু (বৃত্তি)জ্ঞানরূপ ক্রিয়ার কর্তা হইলে ব্রহ্মের সত্যতা অনন্ততা হইতে পারে না। কেননা বৃত্তিজ্ঞানের কর্তারূপে বিক্রিয়মান হইয়া কিরূপে ব্রহ্ম সত্য অনন্ত হইবেন? কারণ যাহাকে কোন কিছু হইতে পৃথক্ করা যায় না, তাহাই অনন্ত। ব্রহ্ম জ্ঞানকর্তা হইলে জ্ঞেয় জ্ঞান হইতে পৃথক্ হইয়া গেলেন বলিয়া আর অনন্ততা সম্ভব হইবে না, যেহেতু 'যাহাতে কেহ কিছু উপলব্ধি করিতে পারে না তাহা ভূমা, আর যাহাতে কেহ কিছু উপলব্ধি করে তাহা অল্প অর্থাৎ সসীম'- এইরূপ অন্য শ্রুতি আছে।

'জ্ঞানং ব্রহ্ম' এই জ্ঞানপদ ব্রহ্মের কর্তৃত্বাদি বিকার নিবৃত্তির জন্য এবং মৃত্তিকাদির ন্যায় অচেতনতা নিবৃত্তির জন্য প্রয়োগ করা হইয়াছে। তবে 'জ্ঞানং ব্রহ্ম' এইরূপ বলাতে ব্রহ্মের অন্তবিশিষ্ট হওয়া প্রাপ্ত হইতেছিল, কারণ লৌকিক জ্ঞানের অন্তবিশিষ্ট হওয়া দেখা যায়। এইহেতু তন্নিবৃত্তের জন্য শ্রুতি 'অনন্ত' এই বিশেষণের উল্লেখ করিতেছেন।

এখন প্রশ্ন অদ্বৈতবাদীর মতে ব্রহ্মের কোনরূপ ধর্ম নাই, ব্রহ্ম সর্ববিধ ধর্মরহিত, সত্য, জ্ঞান অনন্তস্বরূপ। এই অবস্থায় 'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম' এই তৈত্তিরীয় শ্রুতিকে অদ্বৈতবাদী ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ বলিয়া ব্যাখ্যা করেন কিরূপে? এই প্রশ্নের উত্তরে ধর্মরাজাধ্বরীন্দ্র বলেন যে, ব্রহ্মে প্রকৃতপক্ষে  ধর্ম-ধর্মিভাব না থাকিলেও, অবিদ্যা বশতঃ পরব্রহ্মেও কল্পিত ধর্ম-ধর্মিভাবের সৃষ্টি হইয়া থাকে। সেই কল্পিত ধর্মবলেই সত্যতা প্রভৃতিকে ব্রহ্মের লক্ষণ বলা যাইতে পারে। ব্রহ্মের এই কল্পিত ধর্ম-ধর্মিভাব সমর্থন করিয়া, আচার্য পদ্মপাদ্ তাঁহার পঞ্চপাদিকায় বলিয়াছেন যে,"আনন্দ, বিষয়ানুভব নিত্যত্ব, চৈতন্যের এই সকল ধর্ম আছে। উহারা বস্তুতঃ চৈতন্য হইতে পৃথক্ না হইলেও পৃথকের মতই প্রতীয়মান হইয়া থাকে।" ব্রহ্মের এই কল্পিত ধর্মগুলি প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মেরই স্বরূপ এবং ব্রহ্ম হইতে অভিন্ন। তাছাড়া সত্য, জ্ঞান, আনন্দ প্রভৃতির অভেদ লক্ষ্য করিয়াই আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনি তাঁহার 'সংক্ষেপ শারীরক' গ্রন্থে বলিয়াছেন যে, "সত্যেও জ্ঞান আছে, জ্ঞানেও সত্যতা আছে; আনন্দেও জ্ঞান আছে, জ্ঞানেও আনন্দ আছে; আনন্দেও সত্যতা আছে, সত্যতায়ও আনন্দ আছে। সত্য, জ্ঞান আনন্দ, ইহাদের পরস্পর কিছুমাত্রও ভেদ নাই। কারণ পূর্ণতত্ত্বে ইহারা বস্তুতঃ অভিন্ন।"

তথ্যসূত্রঃ-

. ভগবান শঙ্করাচার্যের তৈত্তিরীয় উপনিষদ ভাষ্য।

. আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনির সংক্ষেপ শারীরকম্।

শ্রীশুভ চৌধুরী

সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

Wednesday, 20 September 2023

নিস্কাম কর্ম চিত্তশুদ্ধির কারণ, কিন্তু জ্ঞানের ন্যায় সাক্ষাৎ অবিদ্যানিবারক হয় নাঃ-



আত্মজ্ঞান অভিলাষী মুমুক্ষুগণ কর্তৃক চিত্তশুদ্ধির জন্য সর্বদাই নিত্যনৈমিত্তিক কর্মের অনুষ্ঠান কর্তব্য। এই অর্থে সর্বজ্ঞ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বচনই প্রমাণ। যথা"আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম কারণমুচ্যতে৷ যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-/) অর্থাৎ যোগে আরোহণেচ্ছু ব্যক্তির পক্ষে কর্মই উপায়। তিনি যোগারূঢ় হলে, তাঁর পক্ষে সর্বকর্ম হতে নিবৃত্তি অর্থাৎ সন্ন্যাসই উপায়।

নিত্যকর্মানুষ্ঠানের দ্বারা ধর্মোৎপত্তি, ধর্মোৎপত্তির দ্বারা পাপহানি, তারপরে চিত্তশুদ্ধি, তারপরে সংসারের স্বভাবজ্ঞান অর্থাৎ অনিত্যত্ব প্রভৃতি দোষদর্শন, তারপরে বৈরাগ্য, তারপরে মুমুক্ষুত্ব, তারপরে উপায় অন্বেষণ, তারপরে সর্বকর্ম তৎসাধন ত্যাগ, তারপরে যোগাভ্যাস, তারপরে চিত্তের প্রত্যক্প্রবণতা, তারপরে "তত্ত্বমসি" প্রভৃতি বাক্যার্থপরিজ্ঞান, তারপরে অবিদ্যার উচ্ছেদ এবং তারপরে আত্মস্বরূপে অবস্থান। কারণ এটা শ্রত আছে যে—"ব্রহ্মৈব সন ব্রহ্মাপ্যেতি"-(বৃহদারণ্যকোপনিষৎ-//) অর্থাৎ ব্রহ্ম হয়ে ব্রহ্মকেই প্রাপ্ত হয়, "বিমুক্তশ্চ বিমুচ্যতে"-(কঠোপনিষৎ-//), বিমুক্ত হয়ে বিমুক্ত হয়।

এরূপে পরম্পরাদ্বারা কর্ম অবিদ্যানিবৃত্তির কারণ হয়। কিন্তু জ্ঞানের ন্যায় সাক্ষাৎ অবিদ্যানিবারক হয় না। কারণ ওটা অবিদ্যার বিরোধী নয়। ক্রিয়াফল চার প্রকার, যথাউৎপাদ্য, আপ্য, সংস্কার্য বিকার্য। মুক্তি এদের অন্যতম নয় বলে, কর্ম সাক্ষাৎ মুক্তির সাধন নয়। অবিদ্যা-অধ্যারোপিত মিথ্যা কর্তৃত্বাদি-অভিমানের সহিত কর্ম সম্বন্ধ, কিন্তু জ্ঞান পরমার্থ আত্মবস্তুবিষয়ক, অতএব কর্মের বিরোধী। সুতরাং সূর্যালোক অন্ধকারের ন্যায় তাদের সমুচ্চয় হয় না।.....

তথ্যসূত্রঃ-জ্ঞানোত্তমকৃত চন্দ্রিকা টীকা অবলম্বনে ভগবান্ শঙ্করাচার্যের শিষ্য শ্রীসুরেশ্বরাচার্য প্রণীত "নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি"

শ্রীশুভ চৌধুরী

সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

পরমার্থতাঃ-

 


আচার্য গৌড়পাদ্ মাণ্ডুক্য কারিকার বৈতথ্য প্রকরণে বলেছেন—" নিরোধো চোৎপত্তির্ন বদ্ধো সাধকঃ। মুমুক্ষুর্ন বৈ মুক্ত ইত্যেষা পরমার্থতা॥" এই কারিকাটি স্বয়ংই একটি শ্রুতি। কৃষ্ণযজুর্বেদীয় ব্রহ্মবিন্দূ উপনিষদে এটির হুবুহু উদ্ধৃতি পাওয়া যায়।

ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য এই কারিকার ভাষ্যে বলেছেনযখন দ্বৈত মিথ্যা এবং আত্মাই একমাত্র সত্যবস্তু বলে সাক্ষাৎ উপলব্ধি হয় তখন এইরূপ হয়ে থাকে সমস্ত লৌকিক এবং বৈদিক ব্যবহার অবিদ্যার বিষয়ীভূত অর্থাৎ অজ্ঞান কল্পিত বলে অনুভূত হয়, তখন নিরোধ থাকে না। 'নিরোধ' অর্থ নিরোধন অর্থাৎ প্রলয়, 'উৎপত্তি' অর্থ সৃষ্টি বা জন্ম, 'বদ্ধ' অর্থাৎ সংসারী জীব, 'সাধক' অর্থ মোক্ষপোযোগী সাধন সম্পন্ন ব্যক্তি, 'মুমুক্ষু' অর্থাৎ মোক্ষার্থী মুক্ত অর্থ বন্ধন বিমুক্ত। উৎপত্তি প্রলয়ের অভাবহেতু বদ্ধ, মুক্ত, সাধক, মুমুক্ষু কেউই থাকে না। এটাই পরমার্থতা।

উৎপত্তি প্রলয়ের অভাব কেন হয়? তদুত্তরে বলা হচ্ছেদ্বৈতের অসত্তাহেতু দ্বৈতের বাস্তব সত্তা নেই বলে উৎপত্তি প্রলয়ের অভাব হয়ে থাকে। "যত্র হি দ্বৈতমিব ভবতি", অর্থাৎ যে অবস্থায় দ্বৈতের ন্যায় হয়; " ইহ নানেব পশ্যতি", অর্থাৎ যিনি এই ব্রহ্মে নানার ন্যায় দর্শন করেন; "আত্মৈবেদং সর্বম্", অর্থাৎ এই সমস্তই আত্মা; "ব্রহ্মৈবেদং সর্বম্", অর্থাৎ এই সমস্ত ব্রহ্মই; "একমেবাদ্বিতীয়ম্", অর্থাৎ তিনি এক অদ্বিতীয়; "ইদং সর্বং, যদয়মাত্মা", অর্থাৎ এই যা কিছু তৎসমস্তই আত্মাইত্যাদি শ্রুতিবাক্য হতে দ্বৈতের অসত্যত্ব প্রমাণিত হয়।.......

শ্রীশুভ চৌধুরী

সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...