বস্তুর স্বরূপই বস্তুর স্বরূপলক্ষণ, যাহা বস্তুর স্বরূপ হইয়া অন্য বস্তু হইতে সেই বস্তুকে ভিন্নভাবে বোধ করায়, তাহাই স্বরূপলক্ষণ। যেমন—"সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম" -(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২.১.১) , ইহা ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ; কারণ সত্যাদি পদার্থ ব্রহ্মের স্বরূপ হইয়া অন্য বস্তু হইতে ব্রহ্মকে ভিন্নভাবে বোধ করায়। 'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম' এই শ্রুতিবাক্য ব্রহ্মের লক্ষণবিষয়ক। লক্ষণের সাহায্যে ব্রহ্মের পরিচয় দিতে হইলে, অপরাপর পদার্থ রাজি হইতে ব্রহ্মের পৃথক্ স্বরূপটিই দেখান আবশ্যক। বিশ্বের তাবৎ বস্তুই অসত্য, জড় এবং পরিচ্ছিন্ন। ব্রহ্ম অসত্য বা মিথ্যা বস্তু নহেন, জড় নহেন, এবং সসীম বা পরিচ্ছিন্নও নহেন। এই দৃষ্টিতেই অদ্বৈতবেদান্তে নির্বিশেষ ব্রহ্মের স্বরূপ বিচার করিতে হইবে। অর্থাৎ বিধিমুখে ব্রহ্মকে জানিবার উপায় নাই, কেননা ব্রহ্মতত্ত্ব অবাঙ্মনসগোচর। নেতি নেতি, ব্রহ্ম ইহা নহে, তাহা নহে, এইরূপ নিষেধমুখেই ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝিতে হইবে। ভগবান্ শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্য ঐ নিষেধমুখেই করিয়াছেন। যথা—
সত্য
অর্থাৎ যেরূপে যাহা নিশ্চিত হইয়াছে সেই স্বরূপকে যাহা লঙ্ঘন করে না তাহা সত্য।
কিন্তু যেরূপে যাহা নিশ্চিত হইয়াছে সেই স্বরূপকে লঙ্ঘনকারী যে বস্তু তাহা
মিথ্যা বলিয়া কথিত হয়। এইজন্য বিকার (পরিণামবিশিষ্ট বস্তু) অনিত্য, যেহেতু 'বিকার মাত্রই বাগবলম্বনে অবস্থিত নাম মাত্র, কেবল মৃত্তিকাই সত্য' এইরূপ 'সৎ' কেই (অবিকারীকেই) সত্য বলিয়া অবধারণ করা হইয়াছে। অতএব 'সত্যং ব্রহ্ম' ইহা বলিয়া শ্রুতি ব্রহ্মকে বিকার হইতে নিবৃত্ত করিতেছেন।
ইহার
ফলে কিন্তু ব্রহ্মের (বিকার সমুদয়ের) কারণত্ব প্রাপ্তি হইতেছে। আর কারণের ক্রিয়াসম্বন্ধ
হয় এবং সত্য পদার্থ সত্ত্বাবিশিষ্ট হওয়াতে মৃত্তিকার ন্যায় অচেতনত্ব প্রাপ্তি হইয়া যাইতেছে; এই জন্য 'জ্ঞানং
ব্রহ্ম' ইহা বলা হইতেছে। এই জ্ঞানের অর্থ
জ্ঞপ্তি বা অনুভূতি অর্থাৎ
অনুভতিরূপ সিদ্ধিবাচক এই জ্ঞান (কিন্তু
বৃত্তিজ্ঞানরূপ ক্রিয়া নহে); অর্থাৎ তিনি জ্ঞানকর্তা হন না, কারণ
সত্য ও অনন্তের সহিত
জ্ঞানও ব্রহ্মের আরেক বিশেষণ হয়। আবার যেহেতু (বৃত্তি)জ্ঞানরূপ ক্রিয়ার কর্তা হইলে ব্রহ্মের সত্যতা ও অনন্ততা হইতে
পারে না। কেননা বৃত্তিজ্ঞানের কর্তারূপে বিক্রিয়মান হইয়া কিরূপে ব্রহ্ম সত্য ও অনন্ত হইবেন?
কারণ যাহাকে কোন কিছু হইতে পৃথক্ করা যায় না, তাহাই অনন্ত। ব্রহ্ম জ্ঞানকর্তা হইলে জ্ঞেয় ও জ্ঞান হইতে
পৃথক্ হইয়া গেলেন বলিয়া আর অনন্ততা সম্ভব
হইবে না, যেহেতু 'যাহাতে কেহ কিছু উপলব্ধি করিতে পারে না তাহা ভূমা,
আর যাহাতে কেহ কিছু উপলব্ধি করে তাহা অল্প অর্থাৎ সসীম'- এইরূপ অন্য শ্রুতি আছে।
'জ্ঞানং ব্রহ্ম'
এই জ্ঞানপদ ব্রহ্মের কর্তৃত্বাদি বিকার নিবৃত্তির জন্য এবং মৃত্তিকাদির ন্যায় অচেতনতা নিবৃত্তির জন্য প্রয়োগ করা হইয়াছে। তবে 'জ্ঞানং ব্রহ্ম' এইরূপ বলাতে ব্রহ্মের অন্তবিশিষ্ট হওয়া প্রাপ্ত হইতেছিল, কারণ লৌকিক জ্ঞানের অন্তবিশিষ্ট হওয়া দেখা যায়। এইহেতু তন্নিবৃত্তের জন্য শ্রুতি 'অনন্ত' এই বিশেষণের উল্লেখ
করিতেছেন।
এখন
প্রশ্ন অদ্বৈতবাদীর মতে ব্রহ্মের কোনরূপ ধর্ম নাই, ব্রহ্ম সর্ববিধ ধর্মরহিত, সত্য, জ্ঞান ও অনন্তস্বরূপ। এই
অবস্থায় 'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম' এই তৈত্তিরীয় শ্রুতিকে
অদ্বৈতবাদী ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ বলিয়া ব্যাখ্যা করেন কিরূপে? এই প্রশ্নের উত্তরে
ধর্মরাজাধ্বরীন্দ্র বলেন যে, ব্রহ্মে প্রকৃতপক্ষে ধর্ম-ধর্মিভাব না থাকিলেও, অবিদ্যা
বশতঃ পরব্রহ্মেও কল্পিত ধর্ম-ধর্মিভাবের সৃষ্টি হইয়া থাকে। সেই কল্পিত ধর্মবলেই সত্যতা প্রভৃতিকে ব্রহ্মের লক্ষণ বলা যাইতে পারে। ব্রহ্মের এই কল্পিত ধর্ম-ধর্মিভাব সমর্থন করিয়া, আচার্য পদ্মপাদ্ তাঁহার পঞ্চপাদিকায় বলিয়াছেন যে,"আনন্দ, বিষয়ানুভব ও নিত্যত্ব, চৈতন্যের
এই সকল ধর্ম আছে। উহারা বস্তুতঃ চৈতন্য হইতে পৃথক্ না হইলেও পৃথকের
মতই প্রতীয়মান হইয়া থাকে।" ব্রহ্মের এই কল্পিত ধর্মগুলি
প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মেরই স্বরূপ এবং ব্রহ্ম হইতে অভিন্ন। তাছাড়া সত্য, জ্ঞান, আনন্দ প্রভৃতির অভেদ লক্ষ্য করিয়াই আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনি তাঁহার 'সংক্ষেপ শারীরক' গ্রন্থে বলিয়াছেন যে, "সত্যেও জ্ঞান আছে, জ্ঞানেও সত্যতা আছে; আনন্দেও জ্ঞান আছে, জ্ঞানেও আনন্দ আছে; আনন্দেও সত্যতা আছে, সত্যতায়ও আনন্দ আছে। সত্য, জ্ঞান ও আনন্দ, ইহাদের
পরস্পর কিছুমাত্রও ভেদ নাই। কারণ পূর্ণতত্ত্বে ইহারা বস্তুতঃ অভিন্ন।"
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান শঙ্করাচার্যের তৈত্তিরীয় উপনিষদ ভাষ্য।
২.
আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনির সংক্ষেপ শারীরকম্।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
সেপ্টেম্বর
১৬, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।