Tuesday, 17 September 2024

শ্রুতিতে রথের প্রতীকি কল্পনায় তত্ত্বজ্ঞানঃ-

 


শ্রুতিতে এই শরীরকে রথ, আত্মাকে রথী, বুদ্ধিকে সারথী মনকে ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বগণের লাগামরূপে কল্পনা করা হয়েছে।

আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।

বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।।

ইন্দ্রিয়াণি হয়ানাহুর্বিষয়াঁ স্তেষু গোচরান্

আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তং ভোক্তেত্যাহুর্মনীষিণঃ॥

-(কঠ উপনিষদ্-১।৩।৩,)

সেই আত্মাকে অর্থাৎ কর্ম্মফলভোক্তা সংসারীকে রথী অর্থাৎ রথের স্বামী বলে জানবে। আর শরীরকে রথ বলে জানবে, কেননা যেহেতু রথে বদ্ধ অশ্বসদৃশ ইন্দ্রিয়গণ কর্তৃক শরীর পরিচালিত হয়। এবং নিশ্চয়াত্মক বুদ্ধিকে সারথি বলে জানবে। কেননা দেহের প্রায় সকল কার্যই যেহেতু বুদ্ধির দ্বারা নির্ধারিত হয়। আর সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক মনকে প্রগ্রহ অর্থাৎ লাগাম বলে জানবে। কারণ রশনা অর্থাৎ লাগামের দ্বারা অশ্বগণ যেভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলে সেইরূপ মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়গণও নিজ নিজ বিষয়ে ব্যাপৃত হয়। রথকল্পনায় কুশল মনীষিগণ চক্ষু প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গণকে অশ্ব বলে থাকেন এবং অশ্বরূপে কল্পিত ইন্দ্রিয়সমূহে সংযুক্ত রূপাদি বিষয়সকলকে ইন্দ্রিয়গণের বিচরণ পথ বলে জানবে। আর শরীর, ইন্দ্রিয় মনের সহিত সংযুক্ত আত্মাকে বিবেকিগণ "ইনি ভোক্তা অর্থাৎ সংসারী" এরূপ বলে থাকেন। কারণ কেবল উপাধিরহিত আত্মার তো ভোক্তৃত্ব নেই, বুদ্ধি প্রভৃতি উপাধির দ্বারাই তাঁর ভোক্তৃত্ব সৃষ্ট হয়ে থাকে। আবার শ্রুতি বলছেন

যস্ত্ববিজ্ঞানবান্ভবত্যযুক্তেন মনসা সদা

তস্যেন্দ্রিয়াণ্যবশ্যানি দুষ্টাশ্বা ইব সারথেঃ

যস্তু বিজ্ঞানবান্ভবতি যুক্তেন মনসা সদা

তস্যেন্দ্রিয়াণি বশ্যানি সদশ্বা ইব সারথেঃ

- (কঠ উপনিষদ্-১।৩।৫,)

রথী স্বরূপতঃ অসংসারী হলেও যে বুদ্ধিরূপ সারথি বাস্তব রথচালনায় নিযুক্ত অধম সারথির মত অবিজ্ঞানবান্ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বের প্রবৃত্তি নিবৃত্তি বিষয়ে বিবেকশূন্য হয় এবং সর্বদা একাগ্রতাশূন্য লাগামস্থানীয় মনের সহিত যুক্ত হয়, সেই অনিপুণ বুদ্ধিসারথির ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বসকল অধম রথসারথির দুষ্ট অশ্বের ন্যায় অবশীভূত অর্থাৎ দুর্দমনীয় হয়ে থাকে। পরন্তু যে বুদ্ধিসারথি তদ্বিপরীত অর্থাৎ বিজ্ঞানবান্ এবং সর্বদা সংযতমনা, সমাহিতচিত্ত অর্থাৎ একাগ্রচিত্ত হয়, তার অশ্বস্থানীয় ইন্দ্রিয়সকল লৌকিক সারথির বশীভূত ধীর অশ্বগণের ন্যায় বশীভূত থাকে।

শ্রুতি পরবর্তীতে সেই পূর্বোক্ত অবিবেকি বুদ্ধিসারথি যার সেই রথস্বামীর কি ফল হয় তা বলছেন

যস্ত্ববিজ্ঞানবান্ভবত্যমনস্কঃ সদাঽশুচিঃ

তৎপদমাপ্নোতি সংসারং চাধিগচ্ছতি

যস্তু বিজ্ঞানবান্ভবতি সমনস্কঃ সদা শুচিঃ

তু তৎপদমাপ্নোতি যস্মাদ্ভূয়ো জায়তে

-(কঠ উপনিষদ্-১।৩।৭,)

যে রথী অবিবেকবুদ্ধিযুক্ত অসংযতমনবিশিষ্ট তিনি সেই কারণেই সর্বদাই অশুচি হন। সেই রথী যা পরমলক্ষ্যরূপ অক্ষরব্রহ্ম, তা অবিবেকী সেই বুদ্ধিসারথির নিমিত্ত প্রাপ্ত হতে পারেন না, অধিকন্তু জন্মমরণরূপ সংসারকে প্রাপ্ত হন। কিন্তু অপর যিনি বিজ্ঞানবান্ অর্থাৎ নিপুণ বুদ্ধিসারথিবিশিষ্ট রথী অর্থাৎ নিত্যানিত্যবিবেকযুক্ত এবং সমাহিতচিত্ত, তন্নিমিত্ত সেই রথী সর্বদা শুচি হন। ফলে তিনিই সেই লক্ষ্যবস্তু ব্রহ্ম হতে অভিন্নরূপে থেকে আর সংসারে জন্মগ্রহণ করেন না। সেই লক্ষ্যবস্তুটি কি? শ্রুতি স্পষ্ট বলেছেন

বিজ্ঞানসারথির্যস্তু মনঃ প্রগ্রহবান্নরঃ

সোঽধ্বনঃ পারমাপ্নোতি তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্

-(কঠ উপনিষদ্-১।৩।৯)

যে বিদ্বান পূর্বোক্ত বিজ্ঞানসারথি বিশিষ্ট অর্থাৎ বিবেকসম্পন্ন বুদ্ধিসারথির সহিত যুক্ত এবং সংযতমনরূপ লাগামযুক্ত, তিনি সংসারগতির পার সেই বিষ্ণুর অর্থাৎ বাসুদেবসংজ্ঞক সর্বব্যাপী পরব্রহ্ম পরমাত্মার যে পদ বা স্থান অর্থাৎ স্বরূপ, তা প্রাপ্ত হন।

তথ্যসূত্রঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের কঠ উপনিষদ্ ভাষ্য।

শ্রীশুভ চৌধুরী

রথযাত্রা, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...