Friday, 23 May 2025

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

 


খৃষ্টীয় দশম একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা-শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল, তা কোন মতেই অস্বীকার করা যায় না। বিশেষকরে ন্যায় বৈশেষিকের আলোচনায় দেখা যায় যে, খৃষ্টীয় দশম শতকে বাঙ্গালী নৈয়ায়িক জয়ন্ত ভট্ট ন্যায়মঞ্জরী নামে সূক্ষ্ম বিচারবহুল গভীর গ্রন্থ রচনা করে ন্যায়মতের পুষ্টিসাধন করেন। উদয়নাচার্য আত্মতত্ত্ব-বিবেক, ন্যায়কুসুমাঞ্জলি, লক্ষণমালা, ন্যায়বার্তিক-তাৎপর্য-পরিশুদ্ধি, প্রশস্তপাদ-কৃত বৈশেষিক ভাষ্যের টীকা কিরণাবলী প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করে ন্যায় বৈশেষিকের চিন্তায় যুগান্তর আনয়ন করেন। ন্যায় বৈশেষিক আচার্যগণ দ্বৈতবাদী, জগৎ তাঁদের মতে মিথ্যা নয়, সত্য, সুতরাং অদ্বৈতবাদের সাথে ন্যায় বৈশেষিক দর্শনের বিরোধ চিরন্তন।

ঠিক সেই সময় অদ্বৈতবেদান্তের আকাশে এক নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটে। একাধারে অসামান্য কবি দার্শনিক পণ্ডিত শ্রীহর্ষাচার্য খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকে আবির্ভূত হন। শ্রীহর্ষ মিশ্রের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের প্রকরণ গ্রন্থের ধারা অবলম্বন করে "খণ্ডনখণ্ডখাদ্য" শীর্ষক গ্রন্থ প্রণয়ন। তাঁর এই খণ্ডন গ্রন্থ দিয়ে তিনি প্রতিপক্ষ মত বিধ্বস্ত করেছিলেন। শ্রীহর্ষ উদয়নকৃত লক্ষণাবলী হতে লক্ষণ উদ্ধৃত করে খণ্ডন-খণ্ডখাদ্যে খণ্ডন করেছেন। শ্রীহর্ষের আক্রমণ এতই তীব্র হয়েছিল যে, ন্যায় বৈশেষিক মত তাঁর আক্রমণ-বেগে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং প্রতিপক্ষ-বিজয়ে অদ্বৈতবাদ পূর্ণ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কবি শ্রীহর্ষ তৎকৃত মহাকাব্য নৈষধ-চরিতের (নিষধ দেশাধিপতি নল ভীমরাজ তনয়া দময়ন্তীর প্রেমকাহিনী অবলম্বনে রচিত মহাকাব্যের) প্রতি সর্গের সমাপ্তি শ্লোকে তাঁর পিতা মাতার এবং তাঁর রচিত বিবিধ গ্রন্থাবলীর পরিচয় প্রদান করেছেন। পরিচয়ের মূলে জানা যায় যে, তাঁর পিতার নাম শ্রীহীর পণ্ডিত মাতার নাম মামল্লদেবী। নৈষধের টীকাকার চাণ্ডু পণ্ডিতের উক্তি অনুসারে জানা যায় যে, শ্রীহর্ষের পিতা পণ্ডিত শ্রীহীর কোন এক সভায় উদয়নের সাথে শাস্ত্রীয় বিচারে পরাজিত হয়েছিলেন। সেই পিতৃ অবমাননার প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে এই খণ্ডন গ্রন্থে উদয়নের অনেক লক্ষণ খণ্ডিত হয়েছে।

গ্রন্থকার স্বয়ং তাঁর জন্মস্থান সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু উল্লেখ করেন নি। অনেকে মনে করেন যে, তিনি কান্যকুব্জীয়। কিন্তু অনেকে অনুমান করেন যে, তিনি গৌড়দেশীয় বা বঙ্গদেশীয়। বর্তমান ভারতের উত্তরবঙ্গের কিয়দংশ মিথিলার কিয়দংশ একদা 'গৌড়দেশ' নামে বিখ্যাত ছিল। তার রাজধানী লক্ষণাবতীর নিকটবর্তী কোন স্থানে শ্রীহর্ষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এটাই তাঁদের অভিমত। পরে তিনি কান্যকুব্জে গমন করে স্বীয় পাণ্ডিত্যগুণে তদ্দেশীয় নৃপতি কর্তৃক পরম সম্মাণিত হয়ে তদীয় সভাপণ্ডিতের পদ অলংকৃত করেছিলেন। এই সময়ে মহারাজ বিজয়চন্দ্র তদন্তে তৎপুত্র জয়চন্দ্র কান্যকুব্জের অধিপতি ছিলেন। শ্রীহর্ষ বিজয়চন্দ্রের প্রশংসাসূচক 'বিজয় প্রশস্তি' নামে একখানা গ্রন্থও রচনা করেছিলেন।

তাছাড়া শ্রীহর্ষ প্রণীত অন্যান্য গ্রন্থ হলনবসাহসাঙ্ক চরিতম্ (নব বিক্রমাদিত্যরূপে প্রসিদ্ধ কোন রাজার বর্ণনা), গৌড়োবীর্শকুল প্রশস্তিঃ (তৎকালীন গৌড়দেশাধিপতির বংশ বর্ণনাত্মক কাব্য), অর্ণব বর্ণনম্, শিবশক্তিসিদ্ধিঃ, ঈশ্বরাভিসন্ধিঃ, ছন্দঃ প্রশস্তিঃ, স্থৈর্যবিচারণ প্রকরণম্ (বৌদ্ধসম্মত ক্ষণভঙ্গবাদের খণ্ডন) তবে তাঁর গ্রন্থরাজির মধ্যে নৈষধচরিত এবং খণ্ডনখণ্ডখাদ্যই প্রধান। নৈষধচরিত শ্রীহর্ষের কবি প্রতিভার অপূর্ব অবদান; খণ্ডনখণ্ডখাদ্য তাঁর দার্শনিক মনীষার বিজয়-প্রশস্তি।

খণ্ডনখণ্ডখাদ্য জগৎসত্যতাবাদী নৈয়ায়িকগণের মত খণ্ডনোদ্দেশ্যে রচিত হয়েছে। এটাতে চারটি পরিচ্ছেদ আছে। প্রথম পরিচ্ছেদে নৈয়ায়িক-সম্মত বিভিন্ন প্রমান এবং হেত্বাভাস প্রভৃতির খণ্ডন করা হয়েছে। এই পরিচ্ছেদটি অতিশয় বিস্তৃত। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে নিগ্রহস্থান প্রভৃতি লক্ষণের অসারতা প্রদর্শিত হয়েছে। তৃতীয় পরিচ্ছেদে সর্বনাম পদার্থের নির্বচন-প্রক্রিয়া খণ্ডিত হয়েছে। চতুর্থ পরিচ্ছেদে ন্যায়োক্ত দ্রব্য, গুণ প্রভৃতি ভাব পদার্থ এবং অভাব পদার্থের লক্ষণ খণ্ডন করে সমস্ত বস্তুই যে অনির্বচনীয় এবং মায়াময় তা আলোচিত ব্যাখ্যাত হয়েছে। শ্রীহর্ষ এই গ্রন্থে অনির্বাচ্যবাদের ভিত্তি সুদৃঢ় করেছেন। শ্রীহর্ষের এই খণ্ডন গ্রন্থের দ্বারা কেবল যে পরমতখণ্ডনব্যসনী ব্যক্তিই উপকৃত হবেন তা নয়, পরন্তু যাঁরা নিঃস্পৃহ বীতরাগ, তাঁরাও লব্ধ তত্ত্বজ্ঞানকে রক্ষা করতে সমর্থ হবেন। এই খণ্ডন গ্রন্থই পরবর্তীকালে চিৎসুখাচার্যের 'প্রত্যক্ তত্ত্বপ্রদীপিকা' মধুসূদন সরস্বতীর 'অদ্বৈতসিদ্ধি' গ্রন্থের আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অদ্বৈতসিদ্ধি চিৎসুখী গ্রন্থের বহুস্থলে শ্রীহর্ষের মত উদ্ধৃত হয়েছে। তর্ক-কঠোর এই দুর্বোধ গ্রন্থকে সহজবোধ্য করবার জন্য পরবর্তীকালে অনেক টীকা রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে চিৎসুখাচার্যের ভাবদীপিকা টীকা, আনন্দপুর্ণ বিদ্যাসাগরের খণ্ডনফক্বিকাবিভজনী (বিদ্যাসাগরী) টীকা, পদ্মনাভের শিষ্যহিতৈষিণী টীকা, বর্ধমান উপাধ্যায়ের খণ্ডন-প্রকাশ টীকা, শঙ্কর মিশ্রের আনন্দবর্ধনী (শাঙ্করী) টীকা, রঘুনাথ শিরোমণির খণ্ডন-দীধিতি টীকা, প্রগল্ভ মিশ্রের খণ্ডনদর্পণ টীকা, শুভঙ্কর মিশ্রের শ্রীদর্পণ, চরিত্রসিংহকৃত খণ্ডন মহাতর্ক, বিদ্যাভরণ বিরচিত বিদ্যাভরণী টীকা, ভবনাথকৃত খণ্ডনমণ্ডন, পরমানন্দ বিরচিত খণ্ডনমণ্ডন, শঙ্করচৈতন্য ভারতীর শারদা টীকা সূর্যনারায়ণ শুক্লের খণ্ডনরত্নমালিকা উল্লেখযোগ্য। তবে আনন্দপূর্ণের বিদ্যাসাগরী টীকাই পণ্ডিত সমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত।....

তথ্যসূত্রঃ-

. খণ্ডন-খণ্ডখাদ্যম্, প্রমাত্ব খণ্ডন, মহামহোপাধ্যায় শ্রী মোহন ভট্টাচার্য তর্কবেদান্ত তীর্থ।

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, প্রথম খণ্ড, আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।....

শ্রীশুভ চৌধুরী

মে ২৩, শুক্রবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

Photo editing credit Thākur Vishāl

বন্ধন স্বাভাবিক না নৈমিত্তিক?

 


অবিদ্যা নিমিত্তই প্রাণিগণের বন্ধন। শিষ্য গুরুকে প্রশ্ন করছেনগুরুদেব! এই বন্ধন, স্বাভাবিক, না নৈমিত্তিক? যদি স্বাভাবিক হয়, তবে আমার মুক্তির আশা নেই, কারণ স্বভাব অবর্জনীয়, স্বভাবের কখনোই পরিত্যাগ সম্ভব না।

গুরু বললেন, বৎস! বন্ধন স্বাভাবিক নয়, এটা নৈমিত্তিক। কি নিমিত্ত এটা হয় তা অবহিতচিত্তে শ্রবণ কর। অবিদ্যা নামে একটি পদার্থ আছে, এটা আত্মাকে আশ্রয় করে থাকে, আত্মাই এটার বিষয়, এটা আত্মার অনুভবগম্য এবং আত্মার দ্বারা প্রকাশ্য। এই অবিদ্যা অবস্তু অর্থাৎ এটার পারমার্থিক সত্তা নেই, এবং অনির্বচনীয়, এটাকে সৎ বা অসৎ বলে নির্দেশ করা যায় না। এই অবিদ্যা আত্মার আশ্রিতা এবং আত্মবিষয়া; এই বলে প্রবল হওয়ায় এটা সৎ, চিৎ, আনন্দ, অনন্ত এবং অদ্বিতীয়স্বভাব আত্মাকে আবৃত করে। যেমন গৃহাভ্যন্তরস্থিত অন্ধকার দ্বারা গৃহের অভ্যন্তর সমাচ্ছন্ন হয়, তদ্রূপ অবিদ্যা চিৎস্বরূপ কুটস্থ আত্মাকে আচ্ছাদনীয় বস্তুর ন্যায় আচ্ছাদিত করে বিক্ষিপ্ত অন্যরূপে প্রকাশ করে। অন্যরূপে প্রকাশমান ব্রহ্ম অর্থাৎ জীব, অনাত্মভূত দেহ-ইন্দ্রিয়াদিকে আত্মা বলে অভিমান করে, সুতরাং সমস্ত পুরুষার্থ হতে বঞ্চিত হয়ে অশেষ অনর্থজালে জড়িত হয় এবং অবিদ্যা-কল্পিত বিবিধ সাধন সহায়ে ইষ্টবিষয়ের প্রাপ্তি এবং অনিষ্টবৃত্তিবিষয়ে আকাঙ্ক্ষা যুক্ত হয়ে লৌকিক, বৈদিক এবং স্বাভাবিক নানাপ্রকার অনুষ্ঠানের দ্বারা কেবলমাত্র বিষয়সুখের আকাঙ্ক্ষা করে, সুতরাং মোক্ষবাসনা হৃদয়ে স্থান পায় না, ঈদৃশ জীব রাগ-দ্বেষাদি দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে মনুষ্য, তির্যগাদি পৃথক্ পৃথক্ নানা যোনিতে জন্মগ্রহণ করত মোহমুগ্ধ হয়ে সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এটাই শ্রুতি স্মৃতিতে নির্দিষ্ট হয়েছে। শ্রুতিতে বর্ণিত আছে

তং বিদাথ ইমা জজানান্যৎ যুষ্মাকমন্তরং বভূব। নীহারেণ প্রাবৃতা জল্প্যাঃ চাসুতৃপউক্থশাসশ্চরন্তি।।

-(ঋগ্বেদ সংহিতা, ১০ম মণ্ডল, ৮২ সুক্ত, মন্ত্র)

অর্থাৎ যিনি এই সমস্ত সৃষ্টি করেছেন, তোমরা তাঁকে জান না; যেহেতু তিনি তোমাদের পক্ষে অন্তর অর্থাৎ অভ্যন্তরস্থ হলেও অন্য হয়ে আছেন, অর্থাৎ যদ্যপি তিনি সর্বান্তর, তথাপি তোমরা তাঁকে আপনা হতে ভিন্ন করে রেখেছ। (এরূপ ভেদভ্রমের কারণ)— জল্প্যগণ, অর্থাৎ আমি দেবদত্ত, আমি মৈত্র, ইত্যাদি বাক্য ব্যবহারের বিষয়ীভূত জীবমাত্রেই কুজ্ঝটিকাবৎ সৎ বা অসৎ রূপে অনির্বচনীয় অজ্ঞানে আচ্ছন্ন হয়ে বিষয়সুখে মত্ত হয় সেই সুখাশাতেই 'উক্থ' নামক বিশেষ বৈদিক স্তোত্র পাঠরত হয়ে বিচরণ করেন।

স্মৃতিতে বর্ণিত আছে

পুরুষঃ প্রকৃতিস্থো হি ভুঙ্ক্তে প্রকৃতিজান্গুণান্

কারণং গুণসঙ্গোস্য সদসদ্যোনিজন্মসু ৷৷

-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ১৩/২২)

পুরুষ (ভোক্তা, ক্ষেত্রজ্ঞ) অবিদ্যালক্ষণা প্রকৃতিতে অবস্থিত হয়ে  সুখ-দুঃখ-কার্য-করণরূপে পরিণত মোহাকারে অভিব্যক্ত প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন এই সকল গুণেতে আত্মভাবই পুরুষের দেবাদি সৎ জন্ম পশ্বাদি অসৎ জন্ম সদসদ্যোনিরূপ মনুষ্য-জন্ম-গ্রহণের প্রধান কারণ।......

তথ্যসূত্রঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বিরচিত "অজ্ঞানবোধিনী" পণ্ডিতপ্রবর পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত শিবাবতার শঙ্করাচার্যের গ্রন্থমালা দ্বিতীয় খণ্ড।

শ্রীশুভ চৌধুরী

মে ১৬, শুক্রবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

Photo editing credit Thākur Vishāl

আচার্য বিমুক্তাত্মন্ ও ইষ্টসিদ্ধি—

 


খৃষ্টীয় নবম-দশম শতকে অব্যয়াত্ম ভগবানের শিষ্য বিমুক্তাত্মন্ ইষ্টসিদ্ধি নামক এক অতি উপাদেয় গ্রন্থ রচনা করেন। ইষ্টসিদ্ধি অদ্বৈতবেদান্তের সিদ্ধি নামাঙ্কিত চারখানা প্রসিদ্ধ গ্রন্থের (মণ্ডনমিশ্রের ব্রহ্মসিদ্ধি, সুরেশ্বরাচার্যের নৈষ্কর্মসিদ্ধি, বিমুক্তাত্মনের ইষ্টসিদ্ধি এবং মধুসূদন সরস্বতীর অদ্বৈতসিদ্ধি) মধ্যে একটি। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী যামুনাচার্য তাঁর আত্ম-সিদ্ধিতে আত্মার স্বরূপবিচার-প্রসঙ্গে ইষ্টসিদ্ধির প্রথম শ্লোকটি উদ্ধৃত করেছেন। আচার্য রামানুজ তদীয় শ্রীভাষ্যে অনুভূতিই আত্মার স্বরূপ, অনুভূতি এক, নিত্য অমেয় এবং স্বপ্রকাশ, এই অদ্বৈতমতের বিবরণে (পূর্বপক্ষের বিশ্লেষণে) ইষ্টসিদ্ধির ব্যাখ্যা বিচারশৈলীর অনুসরণ করেছেন বলে বেদান্তদেশিকাচার্য তৎকৃত তত্ত্বটীকায় উল্লেখ করেছেন। যামুনাচার্য দশম-একাদশ শতকে বিদ্যমান ছিলেন। রামানুজাচার্য একাদশ শতকে শ্রীভাষ্য রচনা করেন। সুতরাং আচার্য বিমুক্তাত্মন্ যে কোনমতেই দশম শতকের পরবর্তী হতে পারেন না, এটা নিঃসন্দেহ। বিমুক্তাত্মন্ ইষ্টসিদ্ধিতে সুরেশ্বরাচার্যের বার্তিক ভাস্কর-বেদান্ত-মতের উল্লেখ করেছেন। সুরেশ্বরাচার্য ভগবান্ শঙ্করাচার্যের সাক্ষাৎ শিষ্য। ভাস্করাচার্য ভগবান্ শঙ্করের কিছু পরবর্তী। তিনি খৃষ্টীয় নবম শতকের প্রথম ভাগে বিদ্যমান ছিলেন। এটা হতে বিমুক্তাত্মনের আবির্ভাবকাল যে নবম শতকের পূর্ব হতে পারে না এটাও নিঃসঙ্কোচে বলা যায়।

ইষ্টসিদ্ধির চিন্তার মৌলিকতা আছে। বিমুক্তাত্মনের পূর্ব পর্যন্ত আমরা যে সকল অদ্বৈতবাদী আচার্যের দার্শনিক মতের পরিচয় পেয়েছি, তন্মধ্যে মণ্ডনমিশ্র ব্যতীত অপর সকলই ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্য-ধারার ব্যাখ্যাতা মাত্র। স্বাধীনভাবে তর্কের ভিত্তিতে শঙ্করোক্ত অদ্বৈতবাদ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা ইষ্টসিদ্ধিতেই প্রথম দেখতে পাওয়া যায়। অনির্বাচ্যবাদের প্রতিষ্ঠা করাই বিমুক্তাত্মনের ইষ্ট। এই স্বাভীষ্ট তাঁর গ্রন্থে সিদ্ধি বা চরম পূর্ণতা লাভ করেছে বলেই তদীয় গ্রন্থকে ইষ্টসিদ্ধি বলা হয়ে থাকে। ইষ্টসিদ্ধি পরবর্তী দার্শনিকগণের চিন্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। খৃষ্টীয় দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতকে শ্রীহর্ষ, আনন্দবোধ, চিৎসুখাচার্য প্রভৃতির অবদানে অদ্বৈতবেদান্তে যে খণ্ডন-মণ্ডনযুগের বিকাশ হয়েছিল, বিমুক্তাত্মনই ছিলেন তার অগ্রদূত। চিৎসুখাচার্য তৎকৃত তত্ত্বপ্রদীপিকায়, অমলানন্দ স্বামী তদীয় বেদান্ত-কল্পতরুতে, বিদ্যারণ্য মুনীশ্বর তৎকৃত বিবরণ-প্রমেয়-সংগ্রহে, বেঙ্কটদেশিক সর্বার্থসিদ্ধিতে, পণ্ডিত রামাদ্বয় বেদান্ত-কৌমুদীতে ইষ্টসিদ্ধির উল্লেখ করেছেন। আনন্দবোধ ভট্টারকাচার্য তৎকৃত ন্যায়মকরন্দে বিভিন্ন দার্শনিকগণের স্বীকৃত খ্যাতিবাদ বা ভ্রমবাদের যে বিস্তৃত সমালোচনা করেছেন এবং অনির্বচনীয় মায়ার ব্যাখ্যায় যে মৌলিকতা প্রদর্শন করেছেন, তা বিমুক্তাত্মনের ইষ্টসিদ্ধিতে পূর্ণরূপেই দেখতে পাওয়া যায়। বিমুক্তাত্মনের নিকট আনন্দবোধের ঋণ অপরিশোধ্য। ইষ্টসিদ্ধির উপর আনন্দানুভবের জ্ঞানোত্তমের ইষ্টসিদ্ধি-বিবরণ নামে টীকা আছে। ইষ্টসিদ্ধি আটটি অধ্যায় বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত। গ্রন্থের আয়তনও বড় কম নয়। আট পরিচ্ছেদের মধ্যে প্রথম পরিচ্ছেদটিই অতি বিস্তৃত, গ্রন্থের অর্ধেকেরও বেশী। অপরাপর পরিচ্ছেদগুলো স্বল্পায়তন। এটা গদ্যে পদ্যে লিখিত। অনুষ্ঠুভ্ ছন্দে সংক্ষেপে যে দার্শনিক সমস্যার আলোচনা করা হয়েছে, তাই গদ্যে বিস্তৃতভাবে বিচার করে প্রতিপক্ষের মতের অসারতা প্রদর্শনপূর্বক সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইষ্টসিদ্ধির বিচারের গভীরতা গ্রন্থকারের সর্বতোমুখী প্রতিভা সুধীমাত্রেরই হৃদয় স্পর্শ করে। ইষ্টসিদ্ধি পাঠে জানা যায় যে বিমুক্তাত্মন্ প্রমাণবৃত্ত-নির্ণয় নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থের এখন আর কোন পরিচয় পাওয়া যায় না।...

তথ্যসূত্রঃ- "বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ", প্রথম খণ্ড, আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

এপ্রিল , ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

Photo editing credit Thakur Vishal

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...