Thursday, 24 July 2025

আত্মানাত্মবিবেকঃ-

 


আত্মা অনাত্মা অর্থাৎ আত্মা ভিন্ন দেহের পৃথকত্বের বিবেকবোধই আত্মানাত্মবিবেক। দেহকেই আমরা 'আমি' ভাবিয়া থাকি। 'আমি' আসল সত্তা আত্মার জ্ঞান না থাকায় অজ্ঞ জীব দেহকেই আত্মবোধে পোষণাদি করিয়া বিপর্যস্ত হয় সর্বদা দুঃখ ভোগ করিতে থাকে। এই 'চিজ্জড়গ্রন্থি' ছিন্ন করিতে পারিলেই জীবের স্বরূপ প্রাপ্তি ঘটে। নিত্যানিত্য বস্তুর বিবেক জ্ঞানেই অনিত্য দেহাদির প্রতি আসক্তি চলিয়া যায়। এই আত্মানাত্মবিবেক বর্ণনা করিতে গিয়া ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য 'অপরোক্ষানুভূতিতে' বলেছেন

আত্মা বিনিষ্কলো হ্যেকো দেহো বহুভিরাবৃতঃ

তয়োরৈক্যং প্রপশ্যন্তি কিমজ্ঞানমতঃ পরম্

আত্মা নিয়ামকশ্চান্তর্দেহো বাহ্যো নিয়ম্যকঃ

তয়োরৈক্যং প্রপশ্যন্তি কিমজ্ঞানমতঃ পরম্

আত্মা জ্ঞানময়ঃ পুণ্যো দেহো মাংসময়োঽশুচিঃ

তয়োরৈক্যং প্রপশ্যন্তি কিমজ্ঞানমতঃ পরম্

আত্মা প্রকাশকঃ স্বচ্ছো দেহস্তামস উচ্যতে

তয়োরৈক্যং প্রপশ্যন্তি কিমজ্ঞানমতঃ পরম্

আত্মা নিত্যো হি সদ্রূপো দেহোঽনিত্যো হ্যসন্ময়ঃ

তয়োরৈক্যং প্রপশ্যন্তি কিমজ্ঞানমতঃ পরম্

আত্মা নিরবয়ব একস্বরূপ কিন্তু দেহ বহুতত্ত্বাদির দ্বারা গঠিত অর্থাৎ অবয়বযুক্ত। সুতরাং ইহাদের একত্ব যে দেখে তদপেক্ষা অজ্ঞান আর কি আছে! আত্মা সকল বস্তুর নিয়ামক অন্তর্বর্তী কিন্তু দেহ বাহ্য নিয়ম্য। সুতরাং ইহাদের একত্ব দর্শন অপেক্ষা অজ্ঞান আর কি আছে! আত্মা জ্ঞানময় পবিত্র কিন্তু দেহ মাংসময় অপবিত্র। ইহাদের একতাজ্ঞান অপেক্ষা অজ্ঞান আর কি আছে! আত্মা নির্মল সর্ববস্তুর প্রকাশক কিন্তু দেহ তামস বলিয়া কথিত হইয়াছে। ইহাদের একতা দর্শন অপেক্ষা অজ্ঞান আর কি আছে! আত্মা নিত্য, সৎস্বরূপ কিন্তু দেহ অনিত্য অসৎস্বরূপ, ইহাদের একতা দর্শন অপেক্ষা অজ্ঞান আর কি আছে!......

শ্রীশুভ চৌধুরী

জুলাই ২২, মঙ্গলবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

গুরুতত্ত্বঃ-



'গুরু' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কি?

গুশব্দস্ত্বন্ধকারঃ স্যাৎ রুশব্দস্তন্নিরোধকঃ

অন্ধকারনিরোধিত্বাৎ গুরুরিত্যভিধীয়তে

-(অদ্বয়তারক উপনিষৎ-১৬)

'গু' শব্দের অর্থঅজ্ঞানজাত অন্ধকার বোঝায়। 'রু' শব্দের অর্থ অজ্ঞাননাশক জ্ঞানের আলো বোঝায়। শিষ্যের অজ্ঞানজাত অন্ধকার বিনাশ করে জ্ঞানের আলো প্রকাশ করেন বলে তাকে 'গুরু' বলা হয়।

গুরু বিনা জ্ঞানলাভ হতে পারে না। 'আচার্যবান্ পুরুষো বেদ '-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।১৪।২) অর্থাৎ আচার্যযুক্ত পুরুষই জ্ঞান লাভ করে। আচার্যই যে সংসারসাগর হতে উদ্ধারকর্ত্তা এবং তত্ত্বজ্ঞানই যে ভেলাস্বরূপ এই শ্রুতিসমূহ তার প্রমাণস্বরূপ। স্বয়ং ভগবান্ গীতায় স্পষ্ট বলেছেন

তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া৷

উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ৷৷ -(শ্রীগীতা-৪।৩৪)

অর্থাৎ আচার্যের নিকট গমন করে প্রকৃষ্টরূপে সর্বাঙ্গ নিম্নকরণের দ্বারা প্রণিপাত অর্থাৎ দীর্ঘ নমস্কারের দ্বারাবন্ধন কি?’, ‘মোক্ষ কি?’, ‘বিদ্যা কি?’, ‘অবিদ্যাই বা কি?’ ইত্যাদি পরিপ্রশ্ন এবং সেবা অর্থাৎ গুরুশুশ্রূষার দ্বারা সেই ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায়। এইরূপ বিনয়াদির দ্বারা প্রসন্নভূত তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী আচার্যেরা তোমাকে তত্ত্বদর্শনরূপ জ্ঞান উপদেশ প্রদান করবেন।

বিশ্বসার তন্ত্রের গুরুগীতায় পরাৎপর জগদ্গুরু সদাশিব মহাদেব জগন্মাতা পার্বতীকে এই গুরুতত্ত্ব প্রদান করেছিলেন। ভগবান্ শঙ্কর বলেছেনযার দেবতার প্রতি পরাভক্তি, দেবতার ন্যায় গুরুর প্রতিও পরাভক্তি, তারই নিকট কথিত শাস্ত্রার্থ প্রকাশিত হয়ে থাকে। "যস্য দেবে পরা ভক্তিঃ যথা দেবে তথা গুরৌ। তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ"-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৬।২৩), যেমন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ভোজন ভিন্ন আর শান্তির উপায় নেই, তেমনি গুরুকৃপা ব্যতিরেকে ব্রহ্মবিদ্যাও দুর্লভ।

যে সমস্ত ব্যক্তি গুরুতত্ত্ব বিদিত নয়, কি বেদ, কি পুরাণ, কি স্মৃতি, কি ইতিহাস ইত্যাদি শাস্ত্রপাঠে তার কোন ফল লাভ হয় না। গুরুতত্ত্বে অনভিজ্ঞ ব্যক্তির যজ্ঞ, ব্রত, তপস্যা, দান, জপ, তীর্থসেবা ইত্যাদি নিষ্ফল হবেইএতে কোন সংশয় নেই। যিনি পরমভক্তিযুক্ত হয়ে শ্রদ্ধার সহিত শ্রীগুরুর পাদসেবা করেন, তিনি সর্বপাপ হতে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধত্মা হন। তিনি যে সমস্ত তীর্থস্নানের পুণ্য প্রাপ্ত হন,  এটা নিশ্চিত।

'কাশীক্ষেত্রং নিবাসশ্চ জাহ্নবী চরণোদকম্

গুরুবিশ্বেশ্বরঃ সাক্ষাৎ তারকং ব্রহ্মনিশ্চয়ঃ '

-(গুরুগীতা)

অর্থাৎ গুরু যে স্থানে বাস করেন, সে স্থান কাশীক্ষেত্র এবং তার চরণামৃত গঙ্গাজল হয়ে যায়। গুরু সাক্ষাৎ বিশ্বেশ্বর তারকব্রহ্ম, এটা নিশ্চিত। গুরুর মূর্তি সদা চিন্তা করবে, গুরুর নাম সদা জপ করবে, গুরুর আদেশ বিনা দ্বিধায় শ্রদ্ধার সাথে পালন করবে। গুরু ভিন্ন অন্য কারো ভাবনা করবে না। 'গুরুবক্ত্রে স্থিতং ব্রহ্ম প্রাপ্যতে তৎপ্রসাদতঃ' অর্থাৎ গুরুবাক্য ব্রহ্মবাক্য, তার প্রসাদে ব্রহ্মপদ প্রাপ্ত হওয়া যায়। শ্রীগুরুর মুখে ব্রহ্মবিদ্যা বিদ্যমান। ভক্তি সহকারে গুরু সেবার দ্বারা তা লাভ করা যায়।

গুরুই ব্রহ্মা, গুরুই বিষ্ণু এবং গুরুই শিবস্বরূপ। গুরুকেই পরমব্রহ্ম বলে জ্ঞান করবে। 'গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুর্গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ। গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ॥' যিনি জ্ঞানরূপ অঞ্জনশলাকাযোগে জীবের অজ্ঞানরূপ অন্ধকার দূর করে, জ্ঞাননেত্র উন্মীলিত করে দেন, তিনিই গুরু। যিনি এই অখিল চরাচর বিশ্বকে অখণ্ডরূপে ব্যাপ্ত করে অধিষ্ঠান করছেন, সেই পরমব্রহ্মকে যিনি নেত্রগোচর করেছেন, তিনিই গুরু। যিনি জ্ঞানশক্তি সমারূঢ় অর্থাৎ জ্ঞানচক্ষু ব্যতীত যাঁকে দেখা যায় না, যিনি তত্ত্বরূপ মাল্য দ্বারা বিভুষিত এবং যিনি ভক্তি মুক্তিদায়ী তিনিই গুরু। দেহীগণ কর্মবিপাক নিবন্ধন অনেক অনেক জন্ম পরিগ্রহ করে ভবচক্রে পরিভ্রমণ করে থাকে। যিনি আত্মজ্ঞান প্রদান দ্বারা সেই কর্মরূপ পাশে আবদ্ধ, সংসারচক্রে বিভ্রান্ত জীবগণকে পরিত্রাণ করেন, তিনিই গুরু। গুরুতত্ত্ব হতে প্রধান কোন তত্ত্ব নেই, তপশ্চরণও গুরু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নয়। ' গুরোরধিকং তত্ত্বং গুরোরধিকং তপঃ।' বেদান্তীগণ 'নেতি নেতি' শ্রুতি দ্বারা এই তত্ত্বই বলেন।

যিনি দ্বিনেত্র, দ্বিভুজধারী, শান্তপ্রকৃতি মস্তকোপরিস্থ শুভ্রবর্ণ সহস্রদলপদ্মে উপবিষ্ট এবং যাঁর হস্তদ্বয়ে বর অভয় বিদ্যমান, যিনি দিব্যমূর্তিধারী, শ্বেতাম্বর শ্বেত বিলেপনে চর্চিত, মুক্তাফল অলঙ্কৃত, যাঁর বামদিকে দিব্যশক্তি সমাসীনা, যিনি কৃপার একমাত্র আধার, আনন্দময়, আনন্দপ্রদ, প্রসন্ন জ্ঞানস্বরূপ, নিজ বোধযুক্ত, যোগীন্দ্রস্বরূপ, পূজ্য সংসাররোগের একমাত্র বৈদ্যস্বরূপ সেই গুরুদেবকে নমস্কার করি। এরূপ গুরুমূর্তিই ধ্যানের মূল, গুরুর পাদপদ্মই অর্চনার মূল, গুরুর বাক্যই মন্ত্রের মূল এবং গুরুকৃপাই মুক্তির মূল। গুরুদেবের নির্দেশিত মার্গ অবলম্বন করে মনকে শুদ্ধ করবে। এই জগৎ অনিত্য মনে করে সমস্ত বিষয় বাসনা পরিত্যাগ করে আত্মসাধনায় মগ্ন থাকবে। এরূপ শ্রীগুরুর ধ্যান করতে করতে সাধকের মধ্যে 'আমিই ব্রহ্মস্বরূপ' এইরূপ ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হয়। তখন গুরুকৃপায় আমি মুক্ত হলামএরূপ ভাবনা করবে। গুরুর অগ্রে বাক্য বলবে না, গুরুর সম্মুখে অসত্য কপট বাক্য বলা উচিত নয়। প্রাজ্ঞ শিষ্য কখনও গুরুর সম্মুখে বিদ্যা-বুদ্ধির অহঙ্কার করবে না। যে ব্যক্তি হুঙ্কার সহকারে গর্জন করে বিচার দ্বারা গুরুদেবকে পরাভূত করে, তাকে ব্রহ্মরাক্ষসরূপে জন্মপরিগ্রহ করে জনশূন্য বনমধ্যে বাস করতে হয়। গুরু যাকে অভিশাপ দেন, কি সুরগণ, কি ঋষিবর্গ, কেউই তাকে পরিত্রাণ করতে সক্ষম হন না। সেই ব্যক্তি ক্ষীণ হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। অতএব কেবল গুরুকৃপাতেই আত্মারামত্ব প্রাপ্ত হওয়া যায়।........

তথ্যসূত্রঃ-

. বিশ্বসার তন্ত্রে 'গুরুগীতা'

. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা 'শাঙ্করভাষ্য'

. অদ্বয়তারক শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্।

. ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের 'উপদেশসাহস্রী'

শ্রীশুভ চৌধুরী

গুরু পূর্ণিমা, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ।

Monday, 7 July 2025

অনাত্মশ্রীবিগর্হণম্

 



লব্ধা বিদ্যা রাজমান্যা ততঃ কিং

প্রাপ্তা সম্পৎ প্রাভবাঢ্যা ততঃ কিম্

ভুক্তা নারী সুন্দরাঙ্গী ততঃ কিম্

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি স্বকীয় আত্মার সাক্ষাৎকার লাভ করতে পারে নাই, তার রাজমান্য বিদ্যালাভ করেই কি ফল? প্রভুশক্তিযুক্ত সম্পৎ লাভে কি ফল? এবং সুন্দরী রমণী উপভোগ করেই বা কি ফল? ||||

কেয়ূরাদ্যৈর্ভূষিতো বা ততঃ কিং

কৌশেয়াদ্যৈরাবৃতো বা ততঃ কিম্

তৃপ্তো মৃষ্টান্নাদিনা বা ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করতে পারে নাই, তার কেয়ূর, কঙ্কণ, হার, বলয় প্রভৃতি অলঙ্কারের দ্বারা ভূষিত হয়েই বা কি ফল? কৌশেয় প্রভৃতি বহুবিধ বস্ত্রের দ্বারা আবৃত হয়েই কি ফল এবং বিশুদ্ধ অন্নাদির দ্বারা পরিতৃপ্ত হয়েই বা কি ফল? ||||

দৃষ্টা নানা চারুদেশাস্ততঃ কিং

পুষ্টাশ্চেষ্টা বন্ধুবর্গাস্ততঃ কিম্

নষ্টং দারিদ্র্যাদিদুঃখং ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি নিজ আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করে নাই, তার বিবিধ মনোহর দেশ পরিভ্রমণ করেই বা কি ফল? অভীষ্ট বন্ধুবর্গের পোষণ করেই বা কি ফল? এবং দারিদ্র্যাদি দুঃখ দূরীভূত করেই বা কি ফল? ||||

স্নাতস্তীর্থে জহ্নুজাদৌ ততঃ কিং

দানং দত্তং দ্ব্যষ্টসংখ্যং ততঃ কিম্

জপ্তা মন্ত্রাঃ কোটিশো বা ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||||

অনুবাদ - যে পুরুষ স্বীয় আত্মস্বরূপের সাক্ষাৎকার করে নাই, তার গঙ্গাদি তীর্থে স্নান করে কি ফল? ষোড়শ দান করেই বা কি ফল এবং কোটিসংখ্যক মন্ত্র জপ করেই বা কি ফল? ||||

গোত্রং সম্যগ্ ভূষিতং বা ততঃ কিং

গাত্রং ভস্মাচ্ছাদিতং বা ততঃ কিম্

রুদ্রাক্ষাদিঃ সদ্ধৃতো বা ততঃ কিম্

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি নিজ আত্মস্বরূপের অনুভব করে নাই, তার বংশ অথবা গোত্র ভূষিত হলেই বা কি ফল? গাত্র ভস্মদ্বারা আচ্ছাদিত করেই কি ফল এবং উত্তমরূপে রূদ্রাক্ষাদিধারণে বা কি ফল? ||||

অন্নৈর্বিপ্রাস্তর্পিতা বা ততঃ কিং

যজ্ঞৈর্দেবাস্তোষিতা বা ততঃ কিম্

কীর্ত্যা ব্যাপ্তাঃ সর্বলোকাস্ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||||

অনুবাদ - যে পুরুষ আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করে নাই, তার অন্নের দ্বারা তৃপ্তি লাভ করে কি ফল? নানাবিধ যজ্ঞের দ্বারা দেবগণের সন্তোষ বিধান করে কি ফল? এবং সমস্ত লোক অর্থাৎ চতুৰ্দ্দশ ভুবন কীর্তির দ্বারা ব্যাপ্ত হলেই বা কি ফল? ||||

কায়ঃ ক্লিষ্টশ্চোপবাসৈস্ততঃ কিং

লব্ধাঃ পুত্রাঃ স্বীয়পত্ন্যাস্ততঃ কিম্

প্রাণায়ামঃ সাধিতো বা ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করে নাই, তার বিবিধ উপবাসের দ্বারা শরীরের ক্লেশ প্রদান করায় কি ফল? নিজ পত্নী হতে বহুপুত্র লাভ করে কি ফল? এবং প্রাণায়াম অনুষ্ঠান করেই বা কি ফল? ||||

যুদ্ধে শত্রুর্নির্জিতো বা ততঃ কিং

ভূয়ো মিত্রৈঃ পূরিতো বা ততঃ কিম্

যোগৈঃ প্রাপ্তাঃ সিদ্ধয়ো বা ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করে নাই, তার যুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করেই কি লাভ? বিবিধ মিত্রবর্গের দ্বারা পূর্ণ হয়ে কি ফল এবং যোগের দ্বারা অষ্টসিদ্ধি লাভ করেই বা কি ফল?||||

অব্ধিঃ পদ্ভ্যাং লঙ্ঘিতো বা ততঃ কিং

বায়ুঃ কুম্ভে স্থাপিতো বা ততঃ কিম্

মেরুঃ পাণাবুদ্ধৃতো বা ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি আত্মস্বরূপের সাক্ষাৎকার লাভ করে নাই, তাহার দুই চরণের দ্বারা সমুদ্র লঙ্ঘন করে কি ফল? কুম্ভে বায়ু স্থাপন করে অর্থাৎ কুম্ভক করেই কি ফল এবং সুমেরু পর্বত উত্তোলন হস্ত দ্বারা করেই বা কি ফল? ||||

ক্ষ্বেলঃ পীতো দুগ্ধবদ্বা ততঃ কিং

বহ্নির্জগ্ধো লাজবদ্বা ততঃ কিম্

প্রাপ্তশ্চারঃ পক্ষিবৎ খে ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||১০||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করে নাই, তার দুগ্ধের ন্যায় ( অনায়াসে ) বিষপান করে তা জীর্ণ করে বা কি ফল? লাজের( খৈ ) ন্যায় অগ্নিভক্ষণ করে বা কি ফল? এবং আকাশে পক্ষীর ন্যায় ভ্রমণ করেই বা কি ফল? ||১০||

বদ্ধাঃ সম্যক্ পাবকাদ্যাস্ততঃ কিং

সাক্ষাদ্ বিদ্ধা লোহবর্য্যাস্ততঃ কিম্

লব্ধো নিক্ষেপোঽঞ্জনাদ্যৈস্ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||১১||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করে নাই, সে যদি অগ্নিপ্রভৃতিকে আবদ্ধ করে থাকে, তাতে বা তার কি লাভ হলো? সুদৃঢ় লোহাসকল যদি বিদ্ধ করে থাকে, তাতে তার কি প্রয়োজন সাধিত হলো? অঞ্জনাদি দ্বারা ন্যস্তধন লাভ করলেই বা কি ফল? ||১১||

ভূপেন্দ্রত্বং প্রাপ্তমুর্ব্যাং ততঃ কিং

দেবেন্দ্রত্বং সম্ভৃতং বা ততঃ কিম্

মুণ্ডীন্দ্রত্বং চোপলব্ধং ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||১২||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি আত্মার স্বরূপ সাক্ষাৎকার করে নাই, তার পৃথিবীতে রাজশ্রেষ্ঠত্ব প্রাপ্ত হয়েই বা কি ফল? দেবেন্দ্রত্ব প্রাপ্ত হয়ে কি ফল এবং মুণ্ডিগণের অর্থাৎ যতিগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বলাভে বা কি ফল? ||১২||

মন্ত্রৈঃ সর্বঃ স্তম্ভিতো বা ততঃ কিং

বাণৈর্লক্ষ্যো ভেদিতো বা ততঃ কিম্

কালজ্ঞানং চাপি লব্ধং ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||১৩||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করে নাই, তার মন্ত্রের দ্বারা সমস্ত বস্তু স্তম্ভিত করে বা কি ফল? বাণের দ্বারা লক্ষ্য ভেদ করে বা কি ফল এবং কালজ্ঞান লাভ করেই বা কি ফল? ||১৩||

কামাতঙ্কঃ খণ্ডিতো বা ততঃ কিং

কোপাবেশঃ কুণ্ঠিতো বা ততঃ কিম্

লোভাশ্লেষো বর্জিতো বা ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||১৪||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করে নাই, তার কামভীতি খণ্ডন করে বা কি ফল? ক্রোধবেগ দমন করে বা কি ফল? এবং লোভসম্বন্ধ ত্যাগ করে বা কি ফল? ||১৪||

মোহধ্বান্তঃ পেষিতো বা ততঃ কিং

জাতো ভূমৌ নির্মদো বা ততঃ কিম্

মাৎসর্য্যার্তির্মীলিতা বা ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||১৫||

অনুবাদ - যে ব্যক্তি আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করে নাই, তার মোহান্ধকার দূরীভূত করে কি ফল? পৃথিবীতে গর্ববিহীন হয়ে বা কি ফল? এবং মাৎসর্য্যরূপ পীড়া প্রশমিত করে বা কি ফল? ||১৫||

ধাতুর্লোকঃ সাধিতো বা ততঃ কিং

বিষ্ণোর্লোকো বীক্ষিতো বা ততঃ কিম্

শম্ভোর্লোকঃ শাসিতো বা ততঃ কিং

যেন স্বাত্মা নৈব সাক্ষাৎকৃতোঽভূৎ ||১৬||

অনুবাদ - যিনি আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করেন নাই, তার ব্রহ্মলোক পেয়ে বা কি লাভ? বিষ্ণুলোক দর্শন করে বা কি ফল? এবং শিবলোকের আধিপত্য পেয়েও বা কি ফল? ||১৬||

যস্যেদং হৃদয়ে সম্যগনাত্মশ্রীবিগর্হণম্

সদোদেতি এবাত্মসাক্ষাৎকারস্য ভাজনম্ ||১৭||

অনুবাদ - যার হৃদয়ে সম্যক্রূপে এই অনাত্মবস্তুসৌন্দর্য্যের নিন্দা সর্বদা উদিত হয়, তিনিই আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করার উপযুক্ত পাত্র ||১৭||

অন্যে তু মায়িকজগদ্ভ্রান্তিব্যামোহমোহিতাঃ

তেষাং জায়তে ক্বাপি স্বাত্মসাক্ষাৎকৃতির্ভুবি ||১৮||

অনুবাদ - আর যারা মায়াকল্পিত জগৎভ্রান্তিরূপ অজ্ঞানের দ্বারা মোহিত হয়েছে, তাদের সংসারে কখনও আত্মসাক্ষাৎকার হবে না ||১৮||

|| ইতি শ্রীমৎপরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যস্য শ্রীগোবিন্দ ভগবৎ পূজ্যপাদ শিষ্যস্য শ্রীমচ্ছঙ্কর ভগবতঃ কৃতৌ অনাত্মশ্রীবিগর্হণ প্রকরণং সম্পূর্ণম্ ||

ইতি শ্রীমৎপরমহংস পরিব্রাজকাচার্য শ্রীগোবিন্দ ভগবৎ পূজ্যপাদ শিষ্য শ্রীমদ্ শঙ্কর ভগবৎ বিরচিত অনাত্মশ্রীবিগর্হণ প্রকরণ সমাপ্ত

.

তথ্যসূত্রঃ শিবাবতার শঙ্করাচার্যের গ্রন্থমালা, পণ্ডিতপ্রবর পঞ্চানন তর্করত্ন বিভূতি ভূষণ ন্যায়াচার্য অনুদিত, স্বামী চিদ্ঘনানন্দ সম্পাদিত।

আত্মানাত্মবিবেকঃ-

  আত্মা ও অনাত্মা অর্থাৎ আত্মা ভিন্ন দেহের পৃথকত্বের বিবেকবোধই আত্মানাত্মবিবেক। দেহকেই আমরা ' আমি ' ভাবিয়া থাকি। ...