বাচস্পতি মিশ্র একজন ভারতীয় দার্শনিক ও অদ্বৈতবেদান্তের একটি স্তম্ভ বিশেষ। তাঁর রচিত "ভামতী" শাঙ্করভাষ্যের অতি অপূর্ব টীকা। তিনি মিথিলার বরপুত্র। তিনি একাধারে বৈদান্তিক ও নৈয়ায়িক ছিলেন। খৃষ্টীয় নবম শতকের প্রথম ভাগে (৮০১-৮৮১খৃঃ) তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। বাচস্পতি মিশ্র কেবল বেদান্তেরই টীকা রচনা করেছেন, এমন নয়। তিনি সাংখ্যদর্শনের টীকা "সাংখ্যতত্ত্ব-কৌমুদী", পাতঞ্জলের টীকা "তত্ত্ববৈশারদী", ন্যায়দর্শনের "ন্যায়-বার্তিক তাৎপর্য" ও "ন্যায়সূচি-নিবন্ধ", মীমাংসাদর্শনের ভট্টমতের "তত্ত্ববিন্দু", মণ্ডনমিশ্রের বিধিবিবেকের টীকা "ন্যায়-কণিকা", ব্রহ্মসিদ্ধির টীকা "তত্ত্ব-সমীক্ষা" প্রভৃতি রচনা করে ষড়দর্শনের টীকাকার বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। ঐ সকল টীকায় বাচস্পতিমিশ্র বিভিন্ন দর্শনশাস্ত্রে অসামান্য পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর টীকার বিশেষত্ব এই যে, তিনি যখন যেই দর্শনের টীকা রচনা করেছেন, তখন সেই দর্শনের যা প্রকৃত সিদ্ধান্ত, তাই তদীয় টীকায় লিপিবদ্ধ করেছেন। অপরাপর দর্শনের বিভিন্নমুখী চিন্তার ধারা তাঁর সিদ্ধান্তকে কলুষিত করে নি। ষড়দর্শনের টীকাকারের পক্ষে এরূপ চিন্তার স্বাতন্ত্র্য কদাচিৎ দৃষ্ট হয়। এজন্য ষড়দর্শন টীকাকার বাচস্পতিমিশ্র "সর্বতন্ত্র-স্বতন্ত্র" বলে পণ্ডিতমণ্ডলীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন।
তবে
তাঁর সকল গ্রন্থাবলীর মধ্যে
কালজয়ী গ্রন্থ হল বেদান্তের শাঙ্করভাষ্যের
প্রসিদ্ধ টীকা "ভামতী"। তাই তিনি
ভামতীকার নামেই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। বাচস্পতি মিশ্র তার সহধর্মিণীর নাম
অনুসারে তদীয় শাঙ্করভাষ্যের টীকার নাম করেছিলেন বলে
একটি আখ্যায়িকা এদেশে শুনতে পাওয়া যায়। একদিন গভীর রজনীতে শাস্ত্রচিন্তায়
তন্ময় হয়ে বাচস্পতি যখন
ভামতী টীকা রচনা করছিলেন,
তখন হঠাৎ প্রদীপটি নিভে
যায়। বাচস্পতির সহধর্মিণী গৃহান্তর হতে এসে প্রদীপটি
জ্বেলে দিলেন এবং তাঁর পতিকে
কিছু বলবার জন্য অপেক্ষা করতে
লাগলেন। শাস্ত্র-সাধনায় তন্ময় বাচস্পতি তখন বাহ্যজ্ঞানরহিত। তিনি
তাঁর সহধর্মিণীকে চিনতে পর্যন্ত পারলেন না, জিজ্ঞাসা করলেন,
ললনা! তুমি কে? এটা
শোনামাত্র স্ত্রীর নয়ন জলে ভরে
গেল। তিনি উত্তর করলেন,
আমি আপনার শ্রীচরণের দাসী। আমার দুর্ভাগ্য, আপনি
আমাকে চিনতে পারেন না, পরে আমাকে
কে চিনবে? আমার পুত্র হলো
না, পিণ্ডলোপ তো হলোই, মৃত্যুর
পর আমার নাম পর্যন্ত
চিরতরে বিলুপ্ত হবে। সহধর্মিণীর এই
করুণ উক্তি বাচস্পতির হৃদয় স্পর্শ করল। তিনি বললেন,
সাধ্বি! তুমি হিন্দুরমণীর আদর্শস্থানীয়া।
তুমি তোমার স্মৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে
আক্ষেপ করছো? আমি তোমাকে বিদ্বন্মণ্ডলীর
চিরস্মরণীয় করে রাখবো। আমার
এই শাঙ্করভাষ্যের টীকা, তোমার নাম অনুসারে "ভামতী"
বলে প্রসিদ্ধি লাভ করবে। তোমার
নাম দার্শনিক সাহিত্য-ফলকে স্বর্ণাক্ষরে চিরকালের
জন্য অঙ্কিত থাকবে। বাচস্পতির এই উক্তি সার্থক
হয়েছে। তিনি তাঁর সহধর্মিণী
ভামতীকে বাস্তবিকই অমর করেছেন।
ভামতী
টীকায় বাচস্পতি ন্যায় ও মীমাংসার যে
সকল সূক্ষ্ম বিচারের অবতারণা করেছেন, তা অন্য কোন
টীকায় পাওয়া যায় না। এইজন্য
ভামতীর স্থান বহু উর্ধ্বে। ভামতী
টীকাকে অবলম্বন করে পরবর্তীতে অদ্বৈতবেদান্তের
ভামতী-প্রস্থান নামে একটি স্বতন্ত্র
প্রস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। ভামতীর উপর অমলানন্দ স্বামী
"বেদান্তকল্পতরু"
টীকা এবং ঐ বেদান্তকল্পতরুর
উপর অপ্পয়দীক্ষিত "কল্পতরু-পরিমল" নামে টীকা রচনা
করে বাচস্পতির সংক্ষিপ্ত এবং সারগর্ভ উক্তির
তাৎপর্য জিজ্ঞাসুর নিকট সুগম করে
দিয়েছেন। ভামতীর দার্শনিক রহস্য বুঝতে হলে কল্পতরু ও
পরিমলের বিচারশৈলী এবং মতবাদের সহিতও
পরিচিত হওয়া আবশ্যক। ধর্মজীবনে বাচস্পতি নিষ্কাম কর্মযোগী ছিলেন। অভিমান তাঁর ছায়াও স্পর্শ
করতে পারে নি। তিনি
তাঁর সমস্ত দার্শনিক গ্রন্থরাজি ভগবানের রাঙাচরণে উপহার অর্পণ করে আত্মপ্রসাদ লাভ
করেছেন।....
তথ্যসূত্রঃ-
১.
"অদ্বৈতসিদ্ধি"
মধুসূদন সরস্বতী, শ্রীব্যোমকেশ ভট্টাচার্য, ভাগবতরত্ন।
২.
"বেদান্তদর্শন—অদ্বৈতবাদ", প্রথম খণ্ড, আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী, বিদ্যাবাচস্পতি।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
দোল
পূর্ণিমা, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।