Tuesday, 11 March 2025

ব্যাবহারিক জীব, প্রাতিভাসিক জীব ও পারমার্থিক জীবঃ-

 


অনাদিকাল হতে আরম্ভ করে মোক্ষ প্রাপ্তির পূর্বপর্যন্ত, এই জীব জগৎ ব্যবহারকে আশ্রয় করে অবস্থান করে। সেহেতু তদুভয়কে ব্যাবহারিক বলে। জীব জগৎ উভয়ই অনির্বচনীয় মায়ার কার্য বলে মোক্ষদশায় থাকে না। এই দুইটি কেবলমাত্র ব্যবহারকালে থাকে। আবরণবিক্ষেপশক্তিরূপিণী নিদ্রা চিদাভাসে অবস্থিত থেকে ব্যাবহারিক জীব এবং জগৎকে আবৃত করে নূতন প্রাতিভাসিক জীবজগৎ সৃজন করে। স্বপ্নকালে অনুভূয়মান জীব এবং জগতের প্রতীতিকালেই অর্থাৎ স্বপ্নজ্ঞানকালেই মাত্র স্থিতি হয়ে থাকে বলে জীব এবং জগৎ প্রাতিভাসিক। কারণ, একবার স্বপ্ন হতে যে ব্যক্তি প্রবুদ্ধ হয়েছে, সেই ব্যক্তির স্বপ্নদৃষ্ট জীব এবং জগৎ পুনঃ স্বপ্নাবস্থায় স্থিতি অনুভূত হয় না। এরূপে অর্থাৎ প্রাতিভাসিকরূপে বর্ণিত হওয়াতে স্বপ্নের জীব জগৎ প্রতীতিকালেই থাকে এবং পুনঃ স্বপ্নকালে থাকে না বলে তারা মিথ্যা। যেরূপ স্বপ্নের জীব জগৎ নিদ্রার কার্য, সেরূপ ব্যাবহারিক জীব জগৎ মায়ার কার্য।

যে জীব স্বপ্নকল্পিত প্রাতিভাসিক, সে সেই প্রাতিভাসিক জগৎকে সত্য বলে জানে। কিন্তু অপর অর্থাৎ ব্যাবহারিক জীব তাকে মিথ্যা বলে জানে। যে জীব ব্যাবহারিক, সে সেই মায়াকল্পিত ব্যাবহারিক জগৎকে সত্য বলে জানে, কিন্তু অন্য অর্থাৎ পারমার্থিক জীব তাকে মিথ্যা বলে জানে। ব্যাবহারিক জীব জগৎ অনাদি হলেও, "গতাঃ কলাঃ পঞ্চদশ প্রতিষ্ঠাঃ" (মুণ্ডক উপনিষৎ-//)এই শ্রুতিবচনানুসারে বর্তমান দেহরাহিত্যরূপ কৈবল্যদশায় সেই ব্যাবহারিক জীব জগতের প্রতীতিরও আত্যন্তিক নাশ নিশ্চিত এবং শ্রুতি আচার্যের উপদেশ অনুভব করবার ফলে স্বভাবসিদ্ধ ব্রহ্মাত্মস্বরূপতার সাক্ষাৎকার লাভ হলে, ভাবিদেহনিবৃত্তিরূপ যে জীবন্মুক্তিদশা লাভ হয়, তাতে সেই ব্যাবহারিক জীব জগতের কখনো কখনো প্রতীতি হয় বটে। তদুভয়ের সত্তার আত্যন্তিক নাশ শ্রুতি, যুক্তি অনুভব সিদ্ধ বলে প্রাতিভাসিক জীব এবং জগৎ যেমন মিথ্যা, ব্যাবহারিক জীব জগৎ ঠিক সেইরূপই মিথ্যা। পারমার্থিক জীব সচ্চিদানন্দস্বরূপ ব্রহ্মকেই নিজের স্বরূপ এবং পারমার্থিক সত্য বলে জানেন। তিনি আপনাভিন্ন (ব্রহ্মভিন্ন) অন্য কিছুই দেখেন না। প্রারব্ধবশতঃ ব্যুত্থানকালে জীব জগৎ দৃষ্ট হলে তৎসমুদয়কে মিথ্যা বলে দেখেন। যে জীব শাস্ত্রের তাৎপর্য অনুভবসহিত সম্যক অবধারণ করে বুঝেন যে, কার্যকারণভাব পারমার্থিক নয়, কিন্তু আকাশে তলমলিনতাদির প্রতীতির ন্যায় পূর্ণব্রহ্মে জীবত্ব ভ্রান্তিবশতই প্রতীত হয়, সেই জীব পারমার্থিক জীবএটা শাস্ত্রতত্ত্ববিদ্গণের উক্তি। কেননা শ্রুতি বলছেন'যত্র নান্যৎ পশ্যতি'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-/২৪/)—

ভূমার স্বরূপ নির্দেশ করে বলছেন যে, ভূমাতে তিনি অন্য কিছু দর্শন করেন না। 'যত্র ত্বস্য (বা অস্য ) সর্বমাত্মৈবাভূৎ' (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-//১৪/, //১৫)—পক্ষান্তরে সাধকের যে অবস্থায় সমস্তই (জগৎই) আত্মস্বরূপ হয়ে যায়, আত্মাতিরিক্ত কোন বস্তুর সত্তাস্ফূর্তি হয় না তখন কিসের দ্বারা কাকে আঘ্রাণ করবে? প্রবল প্রারব্ধবশে স্বরূপাবস্থান হতে চিদাভাসের আকারে ব্যুত্থিত হয়ে যদি কোন সময়ে জীব, জগৎ প্রভৃতি দেখেন, তাহলে মিথ্যা বলেই দেখেন; কখনোই সত্য বলে দেখেন না, এটাই তাৎপর্য।........

তথ্যসূত্রঃ- ভগবান্ শঙ্করাচার্য (মতান্তরে ভারতী তীর্থ) বিরচিত "দৃগ্দৃশ্যবিবেক" (বাক্যসুধা), আনন্দ গিরি ব্রহ্মানন্দ ভারতীর টীকা সমেত।

শ্রীশুভ চৌধুরী

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...