Tuesday, 11 March 2025

অন্তর্যামীর স্বরূপ—

 


শ্রুতিতে যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন"যঃ পৃথিব্যাং তিষ্ঠন্পৃথিব্যা অন্তরো যং পৃথিবী বেদ যস্য পৃথিবী শরীরং যঃ পৃথিবীমন্তরো যময়ত্যেষ আত্মাঽন্তর্যাম্যমৃতঃ॥" -(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-..)

যিনি পৃথিবীতে অবস্থিত পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ এবং পৃথিবী যাকে জানে না; পৃথিবী যার শরীর, এবং যিনি অভ্যন্তরে থেকে পৃথিবীকে পরিচালিত করছেন; তিনিই তোমার জিজ্ঞাসিত অবিনাশী অন্তর্যামী আত্মা।

ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলেছেনদেবতার যে, শরীর ইন্দ্রিয়বর্গ, সাক্ষিস্বরূপ ঈশ্বর-সান্নিধ্যই সে সমুদায়ের প্রবৃত্তি নিবৃত্তি ঘটিয়ে থাকে; ঈদৃশ শক্তিসম্পন্ন, নারায়ণনামক যে ঈশ্বর পৃথিবীকেপৃথিবীর দেবতাকে অন্তরে থেকে যথানিয়মে কর্তব্যবিষয়ে নিয়মিত বা পরিচালিত করছেন; তিনি তোমার, আমার এবং সর্বভূতের আত্মা। তিনিই তোমার জিজ্ঞাসিত অন্তর্যামী অমৃত অর্থাৎ জন্মমরণাদি সর্বপ্রকার সংসারধর্ম-বর্জিত অবিনাশী আত্মা।

যিনি জলে, অগ্নিতে, অন্তরিক্ষে, বায়ুতে, দ্যুলোকে, আদিত্যে, চতুর্দিকে, চন্দ্র তারকামণ্ডলে এবং আকাশে অবস্থিত। যিনি তমেআবরণস্বভাব বাহ্য অন্ধকারে, তেজে অর্থাৎ সমস্ত প্রকাশময় বস্তুতে সাধারণতঃ বিদ্যমান তিনিই অন্তর্যামী অমৃতাত্মা। এতক্ষণ অন্তর্যামী বিষয়ে অধিদৈবত অর্থাৎ দেবতা বিষয়ক বিজ্ঞান বলা হল, অতঃপর শ্রুতিতে অধিভূত অর্থাৎ ব্রহ্মাদি স্থাবরান্ত ভূতবিষয়ে অন্তর্যামী-বিজ্ঞান বর্ণিত হচ্ছে"যঃ সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্সর্বেভ্যো ভূতেভ্যোঽন্তরো সর্বাণি ভূতানি বিদুর্যস্য সর্বাণি ভুতানি শরীরং যঃ সর্বাণি ভূতান্যন্তরো যময়ত্যেষ আত্মাঽন্তর্যাম্যমৃত।"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-..১৫)

যিনি সমস্ত ভূতে আছেন, সমস্ত ভূতের অভ্যন্তর, সমস্ত ভূত যাকে জানে না; সমস্ত ভূত যার শরীর, এবং যিনি সমস্ত ভূতের অভ্যন্তরে থেকে সমস্ত ভূতকে পরিচালিত করেন, তিনি তোমার অন্তর্যামী অবিনাশী আত্মা।

অতঃপর শ্রুতিতে অধ্যাত্ম (দেহ-সম্বন্ধী) অন্তর্যামীর কথা বলা হচ্ছে। যিনি প্রাণে অর্থাৎ প্রাণসংযুক্ত ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে, যিনি বাগিন্দ্রিয়ে, চক্ষুতে, শ্রবণেন্দ্রিয়ে, মনে, ত্বকে, বিজ্ঞানেবুদ্ধিতে, রেতে অর্থাৎ প্রজননে বর্তমান তিনিই অন্তর্যামী অবিনাশী আত্মা।

"আত্মাঽন্তর্যাম্যমৃতোঽদৃষ্টো দ্রষ্টাঽশ্রুতঃ শ্রোতাঽমতো মন্তাঽবিজ্ঞতো বিজ্ঞাতা। নান্যোঽতোঽস্তি দ্রষ্টা নান্যোঽতোঽস্তি শ্রোতা নান্যোঽতোঽস্তি মন্তা নান্যোঽতোঽস্তি বিজ্ঞাতৈষ আত্মাঽন্তর্যাম্যমৃতোঽতোঽন্যদার্তং।"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-..২৩)

অর্থাৎ তিনি অদৃষ্ট অর্থাৎ চাক্ষুষ দর্শনের বিষয়ীভূত নন, কিন্তু নিজে স্বপ্রকাশস্বরূপে সর্বদা চক্ষুতে বিদ্যমান থাকেন বলে দ্রষ্টা; সেরূপ, অশ্রুত অর্থাৎ শ্রবণেন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত নন, অথচ তাঁর নিজের শ্রবনশক্তি কখনও বিলুপ্ত হয় না; সকল শ্রবণেন্দ্রিয়ে তাঁর সন্নিধান আছে বলে তিনি শ্রোতা। এরূপ তিনি মানসিক সংকল্প বিকল্পের বিষয়ীভূত নন; কারণ, যা চক্ষু দ্বারা দৃষ্ট কিম্বা শ্রবণ দ্বারা শ্রুত হয়, মন তদ্বিষয়েই সংকল্প করতে পারে, কিন্তু অন্তর্যামী যখন অদৃষ্ট এবং অশ্রুত, তখন তদ্বিষয়ে মনের সংকল্প করবার ক্ষমতা নেই; কাজেই তিনি অমত; তাঁর মনন শক্তি কখনও বিলুপ্ত হয় না, এবং নিখিল মনেতেই তাঁর নিত্য সন্নিধান রয়েছে; কারণে তিনি মন্তা (মননকর্তা); সেরূপ তিনি অবিজ্ঞাত, অর্থাৎ বাহ্য রূপরসাদির ন্যায় এবং আন্তর সুখ-দুঃখাদির ন্যায় নিশ্চয়াত্মক জ্ঞানের বিষয়ীভূত হন না, অথচ তাঁর জ্ঞানশক্তি কখনও বিলুপ্ত না হওয়ায় এবং নিরন্তর বিজ্ঞান-ক্ষেত্র বুদ্ধিতে সন্নিহিত থাকায় তিনি নিজে বিজ্ঞাতা।

উক্ত অন্তর্যামীর অতিরিক্ত কোন দ্রষ্টা নেই, এবং এর অতিরিক্ত অপর শ্রোতাও নেই, এর অতিরিক্ত অপর কেউ মন্তামননকর্তা নেই এবং এতদতিরিক্ত আর বিজ্ঞাতাও নেই। যার অতিরিক্ত দ্রষ্টা শ্রোতা মন্তা বিজ্ঞাতা নেই, যিনি স্বয়ং অপরের অদৃষ্ট অথচ দ্রষ্টা; অপরের অশ্রুত অথচ শ্রোতা; অপরের অমত অথচ মন্তা, এবং অন্যের অবিজ্ঞাত হয়েও বিজ্ঞাতা, তিনিই তোমার অন্তর্যামী অমৃত আত্মা। এই অন্তর্যামিসংজ্ঞক আত্মস্বরূপ ঈশ্বরের অতিরিক্ত সমস্ত বস্তুই আর্ত (বিনাশশীল)......

তথ্যসূত্রঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ভাষ্য।

শ্রীশুভ চৌধুরী

মার্চ , ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...