Thursday, 24 July 2025

গুরুতত্ত্বঃ-



'গুরু' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কি?

গুশব্দস্ত্বন্ধকারঃ স্যাৎ রুশব্দস্তন্নিরোধকঃ

অন্ধকারনিরোধিত্বাৎ গুরুরিত্যভিধীয়তে

-(অদ্বয়তারক উপনিষৎ-১৬)

'গু' শব্দের অর্থঅজ্ঞানজাত অন্ধকার বোঝায়। 'রু' শব্দের অর্থ অজ্ঞাননাশক জ্ঞানের আলো বোঝায়। শিষ্যের অজ্ঞানজাত অন্ধকার বিনাশ করে জ্ঞানের আলো প্রকাশ করেন বলে তাকে 'গুরু' বলা হয়।

গুরু বিনা জ্ঞানলাভ হতে পারে না। 'আচার্যবান্ পুরুষো বেদ '-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।১৪।২) অর্থাৎ আচার্যযুক্ত পুরুষই জ্ঞান লাভ করে। আচার্যই যে সংসারসাগর হতে উদ্ধারকর্ত্তা এবং তত্ত্বজ্ঞানই যে ভেলাস্বরূপ এই শ্রুতিসমূহ তার প্রমাণস্বরূপ। স্বয়ং ভগবান্ গীতায় স্পষ্ট বলেছেন

তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া৷

উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ৷৷ -(শ্রীগীতা-৪।৩৪)

অর্থাৎ আচার্যের নিকট গমন করে প্রকৃষ্টরূপে সর্বাঙ্গ নিম্নকরণের দ্বারা প্রণিপাত অর্থাৎ দীর্ঘ নমস্কারের দ্বারাবন্ধন কি?’, ‘মোক্ষ কি?’, ‘বিদ্যা কি?’, ‘অবিদ্যাই বা কি?’ ইত্যাদি পরিপ্রশ্ন এবং সেবা অর্থাৎ গুরুশুশ্রূষার দ্বারা সেই ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায়। এইরূপ বিনয়াদির দ্বারা প্রসন্নভূত তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী আচার্যেরা তোমাকে তত্ত্বদর্শনরূপ জ্ঞান উপদেশ প্রদান করবেন।

বিশ্বসার তন্ত্রের গুরুগীতায় পরাৎপর জগদ্গুরু সদাশিব মহাদেব জগন্মাতা পার্বতীকে এই গুরুতত্ত্ব প্রদান করেছিলেন। ভগবান্ শঙ্কর বলেছেনযার দেবতার প্রতি পরাভক্তি, দেবতার ন্যায় গুরুর প্রতিও পরাভক্তি, তারই নিকট কথিত শাস্ত্রার্থ প্রকাশিত হয়ে থাকে। "যস্য দেবে পরা ভক্তিঃ যথা দেবে তথা গুরৌ। তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ"-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৬।২৩), যেমন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ভোজন ভিন্ন আর শান্তির উপায় নেই, তেমনি গুরুকৃপা ব্যতিরেকে ব্রহ্মবিদ্যাও দুর্লভ।

যে সমস্ত ব্যক্তি গুরুতত্ত্ব বিদিত নয়, কি বেদ, কি পুরাণ, কি স্মৃতি, কি ইতিহাস ইত্যাদি শাস্ত্রপাঠে তার কোন ফল লাভ হয় না। গুরুতত্ত্বে অনভিজ্ঞ ব্যক্তির যজ্ঞ, ব্রত, তপস্যা, দান, জপ, তীর্থসেবা ইত্যাদি নিষ্ফল হবেইএতে কোন সংশয় নেই। যিনি পরমভক্তিযুক্ত হয়ে শ্রদ্ধার সহিত শ্রীগুরুর পাদসেবা করেন, তিনি সর্বপাপ হতে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধত্মা হন। তিনি যে সমস্ত তীর্থস্নানের পুণ্য প্রাপ্ত হন,  এটা নিশ্চিত।

'কাশীক্ষেত্রং নিবাসশ্চ জাহ্নবী চরণোদকম্

গুরুবিশ্বেশ্বরঃ সাক্ষাৎ তারকং ব্রহ্মনিশ্চয়ঃ '

-(গুরুগীতা)

অর্থাৎ গুরু যে স্থানে বাস করেন, সে স্থান কাশীক্ষেত্র এবং তার চরণামৃত গঙ্গাজল হয়ে যায়। গুরু সাক্ষাৎ বিশ্বেশ্বর তারকব্রহ্ম, এটা নিশ্চিত। গুরুর মূর্তি সদা চিন্তা করবে, গুরুর নাম সদা জপ করবে, গুরুর আদেশ বিনা দ্বিধায় শ্রদ্ধার সাথে পালন করবে। গুরু ভিন্ন অন্য কারো ভাবনা করবে না। 'গুরুবক্ত্রে স্থিতং ব্রহ্ম প্রাপ্যতে তৎপ্রসাদতঃ' অর্থাৎ গুরুবাক্য ব্রহ্মবাক্য, তার প্রসাদে ব্রহ্মপদ প্রাপ্ত হওয়া যায়। শ্রীগুরুর মুখে ব্রহ্মবিদ্যা বিদ্যমান। ভক্তি সহকারে গুরু সেবার দ্বারা তা লাভ করা যায়।

গুরুই ব্রহ্মা, গুরুই বিষ্ণু এবং গুরুই শিবস্বরূপ। গুরুকেই পরমব্রহ্ম বলে জ্ঞান করবে। 'গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুর্গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ। গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ॥' যিনি জ্ঞানরূপ অঞ্জনশলাকাযোগে জীবের অজ্ঞানরূপ অন্ধকার দূর করে, জ্ঞাননেত্র উন্মীলিত করে দেন, তিনিই গুরু। যিনি এই অখিল চরাচর বিশ্বকে অখণ্ডরূপে ব্যাপ্ত করে অধিষ্ঠান করছেন, সেই পরমব্রহ্মকে যিনি নেত্রগোচর করেছেন, তিনিই গুরু। যিনি জ্ঞানশক্তি সমারূঢ় অর্থাৎ জ্ঞানচক্ষু ব্যতীত যাঁকে দেখা যায় না, যিনি তত্ত্বরূপ মাল্য দ্বারা বিভুষিত এবং যিনি ভক্তি মুক্তিদায়ী তিনিই গুরু। দেহীগণ কর্মবিপাক নিবন্ধন অনেক অনেক জন্ম পরিগ্রহ করে ভবচক্রে পরিভ্রমণ করে থাকে। যিনি আত্মজ্ঞান প্রদান দ্বারা সেই কর্মরূপ পাশে আবদ্ধ, সংসারচক্রে বিভ্রান্ত জীবগণকে পরিত্রাণ করেন, তিনিই গুরু। গুরুতত্ত্ব হতে প্রধান কোন তত্ত্ব নেই, তপশ্চরণও গুরু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নয়। ' গুরোরধিকং তত্ত্বং গুরোরধিকং তপঃ।' বেদান্তীগণ 'নেতি নেতি' শ্রুতি দ্বারা এই তত্ত্বই বলেন।

যিনি দ্বিনেত্র, দ্বিভুজধারী, শান্তপ্রকৃতি মস্তকোপরিস্থ শুভ্রবর্ণ সহস্রদলপদ্মে উপবিষ্ট এবং যাঁর হস্তদ্বয়ে বর অভয় বিদ্যমান, যিনি দিব্যমূর্তিধারী, শ্বেতাম্বর শ্বেত বিলেপনে চর্চিত, মুক্তাফল অলঙ্কৃত, যাঁর বামদিকে দিব্যশক্তি সমাসীনা, যিনি কৃপার একমাত্র আধার, আনন্দময়, আনন্দপ্রদ, প্রসন্ন জ্ঞানস্বরূপ, নিজ বোধযুক্ত, যোগীন্দ্রস্বরূপ, পূজ্য সংসাররোগের একমাত্র বৈদ্যস্বরূপ সেই গুরুদেবকে নমস্কার করি। এরূপ গুরুমূর্তিই ধ্যানের মূল, গুরুর পাদপদ্মই অর্চনার মূল, গুরুর বাক্যই মন্ত্রের মূল এবং গুরুকৃপাই মুক্তির মূল। গুরুদেবের নির্দেশিত মার্গ অবলম্বন করে মনকে শুদ্ধ করবে। এই জগৎ অনিত্য মনে করে সমস্ত বিষয় বাসনা পরিত্যাগ করে আত্মসাধনায় মগ্ন থাকবে। এরূপ শ্রীগুরুর ধ্যান করতে করতে সাধকের মধ্যে 'আমিই ব্রহ্মস্বরূপ' এইরূপ ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হয়। তখন গুরুকৃপায় আমি মুক্ত হলামএরূপ ভাবনা করবে। গুরুর অগ্রে বাক্য বলবে না, গুরুর সম্মুখে অসত্য কপট বাক্য বলা উচিত নয়। প্রাজ্ঞ শিষ্য কখনও গুরুর সম্মুখে বিদ্যা-বুদ্ধির অহঙ্কার করবে না। যে ব্যক্তি হুঙ্কার সহকারে গর্জন করে বিচার দ্বারা গুরুদেবকে পরাভূত করে, তাকে ব্রহ্মরাক্ষসরূপে জন্মপরিগ্রহ করে জনশূন্য বনমধ্যে বাস করতে হয়। গুরু যাকে অভিশাপ দেন, কি সুরগণ, কি ঋষিবর্গ, কেউই তাকে পরিত্রাণ করতে সক্ষম হন না। সেই ব্যক্তি ক্ষীণ হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। অতএব কেবল গুরুকৃপাতেই আত্মারামত্ব প্রাপ্ত হওয়া যায়।........

তথ্যসূত্রঃ-

. বিশ্বসার তন্ত্রে 'গুরুগীতা'

. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা 'শাঙ্করভাষ্য'

. অদ্বয়তারক শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্।

. ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের 'উপদেশসাহস্রী'

শ্রীশুভ চৌধুরী

গুরু পূর্ণিমা, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ।

No comments:

জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ-

  শ্রীভগবানুবাচ ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ৷ অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু ৷৷ ১   ‘শাঙ্করভাষ্য’   অনুস...