Saturday, 30 January 2021

স্বপ্রকাশ পরমাত্মার স্বগুণাবৃত শক্তিই জগতের মূল কারণঃ-


কৃষ্ণযজুর্বেদীয় শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ এ বর্ণিত আছে-

তে ধ্যানয়োগানুগতা অপশ্যন্
দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈর্নিগূঢাম্ ।
যঃ কারণানি নিখিলানি তানি
কালাত্ময়ুক্তান্যধিতিষ্ঠত্যেকঃ ॥-(শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ-১।৩)
ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- প্রত্যক্ষাদি কোন প্রমাণে যাহাকে জানিতে পারা যায় না, সেই মূলকারণ বস্তুটির জানিবার আর উপায়ান্তর না দেখিয়া ব্রহ্মবাদিগণ ধ্যান যোগের অনুশীলনে প্রবৃত্ত হইলেন। ধ্যান অর্থ চিত্তের একাগ্রতা, তাহাই যোগ। যাহা দ্বারা চিত্তসংযোজন করা যায়, তাহাই যোগ শব্দের অর্থ। ব্রহ্মবাদিরা সেই ধ্যানযোগের অনুগত অর্থাৎ সমাহিত হইয়া জগতের মূল কারণ রূপে দেবাত্মশক্তিকে দর্শন করিলেন।
পূর্ব শ্রুতিতে কথিত প্রশ্ন পরিহারর সূত্ররূপে যাহা উক্ত হইয়াছে, এক্ষণে তাহাই একটী একটী করিয়া বর্ণিত হইবে। সেই উক্তিগুলোর সংক্ষেপার্থ এইরূপ- ব্রহ্মই কি জগৎকারণ অথবা কাল প্রভৃতি কারণ? দ্বিতীয় প্রশ্ন-ব্রহ্ম কি কারণ, না কার্য্য-কারণভাব রহিত?
তৃতীয় প্রশ্ন-ব্রহ্ম কি কারণ, না অকারণ? চতুর্থ প্রশ্ন হইল- কারণ হইলেও উপাদান কারণ না নিমিত্তকারণ? নাকি উভয় কারণই? পঞ্চম প্রশ্নঃ- ব্রহ্ম কারণ হইলেই বা তাহার লক্ষণ বা স্বরূপ কি? আর অকারণ হইলেই বা তাহার লক্ষণ কিরূপ?
এইসকল প্রশ্নের পরিহার বা সমাধান এইরূপ-ব্রহ্ম কারণ নহে, অকারণও নহে, উভয়রূপও নহে অনুভয়রূপও নহে এবং তিনি নিমিত্ত নহে উপাদানও নহে অথবা উভয়াত্মকও নহে। এই কথা বলা হইতেছে যে-অদ্বিতীয় পরমাত্মার স্বরূপতঃ কারণতা বা উপাদান নিমিত্তভাব কিছুই নাই। সে সমস্তই ঔপাধিক।
যে উপাধিসহযোগে ব্রহ্মের কারণত্বাদি ঘটে, বস্তুতঃ তাহাই নিমিত্তকারণ। একথা সমর্থনপূর্বক তাহারই প্রযোজকতা পৃথক করিয়া দেখাইতেছেন-'দেবাত্মশক্তিম্' ইত্যাদি । স্বপ্রকাশ মায়াধীশ্বর পরমেশ্বর পরমাত্মার আত্মভূতা -অস্বতন্ত্রা, কিন্তু সাংখ্য শাস্ত্রোক্ত প্রধান বা প্রকৃতির ন্যায় স্বতন্ত্রা নহে, পরন্তু পরমেশ্বরের অধীনা শক্তিকে (মায়াকে) তাহারা কারণরূপে দর্শন করিয়াছিলেন।
এই উপনিষদেই পরবর্তীতে -'মায়াকে প্রকৃতি (জগৎকারণ) বলিয়া জানিবে, এবং মায়ীকে (মায়াযুক্তকে) মহেশ্বর বলিয়া জানিবে।'-(শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ-৪।১০) এইরূপ শ্রুতিবাক্য দ্বারা প্রদর্শিত হইবে।
ব্রহ্মপুরাণে কথিত আছে-'মহত্তত্ত্ব প্রভৃতি চতুর্বিংশতি ভাগে বিভক্ত। এই মায়াই পরাপ্রকৃতি।'
শ্রীভগবানও বলিতেছেন- 'হে কৌন্তেয়! সর্বতোভাবে দ্রষ্টামাত্রস্বরূপ এবং স্বরূপতঃ বিকাররহিত আমি যে অধ্যক্ষ-আমার দ্বারা প্রেরিত হইয়া আমার ত্রিগুণাত্মিকা মায়া অর্থাৎ অবিদ্যালক্ষণা প্রকৃতি এই চরাচর জগৎ উৎপাদন করে।'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, রাজযোগ-১০)
সেই শক্তিটী স্বগুণে সত্ত্বরজস্তমোনামক স্বকীয়গুণে ও স্বীয় কার্য্য (প্রকৃতিজাত) পৃথিব্যাদি দ্বারা নিগূঢ়া অর্থাৎ আবৃতা বা আচ্ছাদিতা। কারণ মাত্রই স্বীয় কার্য্য দ্বারা আবৃত থাকে, কারণের আকারটী কার্য্যের আকারে লুকায়িত থাকে, সেইকারণে কার্য্যবস্তু হইতে কারণ বস্তুটিকে পৃথক করিয়া ধরিতে পারা যায় না। গুণসমূহ যে প্রকৃতিজাত, তাহা ভগবান বেদব্যাস দেখাইয়াছেন-
'সত্ত্ব, রজঃ, ও তমগুণত্রয় ভগবন্মায়া প্রকৃতি হইতে সম্ভূত।'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, গুনত্রয়বিভাগযোগ-৫)
আচ্ছা এই 'দেবাত্মশক্তি' র দেবতাটি কে? যাঁহার এই বিশ্বজনীন শক্তির স্বীকার করা হইতেছে? তদুত্তরে বলিতেছেন-'যঃ কারণানি' ইত্যাদি। যে এক অদ্বিতীয় পরমাত্মা পূর্বোক্ত কালাত্মযুক্ত -কাল ও আত্মসহকৃত অর্থাৎ কাল ও পুরুষসমন্বিত 'কালঃস্বভাবঃ' ইত্যাদি মন্ত্রোক্ত সমস্ত কারণের অধিষ্ঠাতা অর্থাৎ ঐ সকল কারণকে যিনি যথানিয়মে পরিচালিত করেন, তাঁহার শক্তিকে ব্রহ্মবাদিগণ দর্শন করিয়াছিলেন। ইহাই উক্ত শ্রুতি বাক্যের অর্থ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...