Wednesday, 31 March 2021

অদ্বৈতানুভূতিঃ (১-১০)

 


ভগবৎপাদ্ শ্রী শঙ্করাচার্য্য বিরচিত -

॥ অদ্বৈতানুভূতিঃ ॥

অহমানন্দসত্যাদিলক্ষণঃ কেবলঃ শিবঃ ।

অনানন্দাদিরূপং যত্তেনাহমচলোঽদ্বয়ঃ ॥১॥

 অনুবাদঃ আমি আনন্দস্বরূপ, সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ ও কেবল শিবস্বরূপ। যাহা নিরানন্দস্বরূপ তাহা আমি নহি। কারণ আমি নিশ্চল, অদ্বিতীয়।।১।। 

অক্ষিদোষাদ্যথৈকোঽপি দ্বয়বদ্ভাতি চন্দ্রমাঃ ।

একোঽপ্যাত্মা তথা ভাতি দ্বয়বন্মায়য়া মৃষা ॥২।। 

অনুবাদঃ চক্ষুর দোষ ঘটিলে যেমন একটীমাত্র চন্দ্র দুইটী বলিয়া প্রতীত হয়, সেইরূপ মায়াদ্বারা মিথ্যা জ্ঞান জম্মিলে এক আত্মাই দুই বলিয়া বোধ হয়।।২।।

অক্ষিদোষবিহীনানামেক এব যথা শশী ।

মায়াদোষবিহীনানামাত্মৈবৈকস্তথা সদা ॥৩॥ 

অনুবাদঃ যাহাদের চক্ষুর দোষ ঘটে নাই, তাহারা যেমন একটীমাত্র চন্দ্র দেখিতে পায়, সেইরূপ যাঁহারা মায়াদোষে আচ্ছন্ন নহেন, তাঁহারা সর্ব্বদা একমাত্র অদ্বিতীয় আত্মার উপলব্ধি করেন।।

দ্বিত্বং ভাত্যক্ষিদোষেণ চন্দ্রে স্বে মায়য়া জগৎ ।

দ্বিত্বং মৃষা যথা চন্দ্রে মৃষা দ্বৈতং তথাত্মনি ॥৪॥

অনুবাদঃ অক্ষিদোষ দ্বারা যেমন চন্দ্রে দ্বিত্ব অনুভূত হয়, সেইরূপ এই জগতে মায়াদ্বারা আত্মাতে দ্বিত্ব অনুভূত হইতেছে। চন্দ্রেতে দ্বিত্ব যেমন মিথ্যা, সেইরূপ আত্মাতেও দ্বিত্ব মিথ্যা।

আত্মনঃ কার্যমাকাশো বিনাত্মানং ন সংভবেৎ ।

কার্যস্য পূর্ণতা সিদ্ধা কিং পুনঃ পূর্ণতাত্মনঃ ॥৫॥

অনুবাদঃ আকাশ আত্মার কার্য্য, আত্মা ব্যতীত আকাশের সম্ভব হইতে পারে না, যখন কার্য্যের পূর্ণতা সিদ্ধ হইতেছে, তখন কারণ আত্মার পূর্ণতা কি জন্য না সিদ্ধ হইবে।।৫।।

কার্যভূতো যথাকাশ এক এব ন হি দ্বিধা ।

হেতুভূতস্তথাত্মায়মেক এব বিজানতঃ ॥৬॥

অনুবাদঃ কার্য্যভূত আকাশ যেমন এক ভিন্ন দুই নহে, সেইরূপ জ্ঞানী ব্যক্তি কারণস্বরূপ আত্মাকে এক বলিয়াই বিবেচনা করেন।।৬।।

একোঽপি দ্বয়বদ্ভাতি যথাকাশ উপাধিতঃ ।

একোঽপি দ্বয়বৎপূর্ণস্তথাত্মায়মুপাধিতঃ ॥৭॥

অনুবাদঃ যেমন একমাত্র আকাশ ঘটাদিরূপ উপাধিভেদে অনেক বলিয়া প্রতীত হয়, সেইরূপ একমাত্র পূর্ণআত্মা বুদ্ধ্যাদি উপাধিভেদে অনেক বলিয়া বোধ হইতেছে।।৭।।

কারণোপাধিচৈতন্যং কার্যসংস্থাচ্চিতোঽধিকম্ ।

ন ঘটাভ্রান্মৃদাকাশঃ কুত্রচিন্নাধিকো ভবেৎ ॥৮॥ 

অনুবাদঃ কার্য্যোপাধি সমুদায়ই চৈতন্য অর্থাৎ জীব হইতে কারণোপাধি-চৈতন্য অর্থাৎ ঈশ্বর অতিরিক্ত নহেন, কারণ ঘটাকাশ হইতে মৃদাকাশ কখনও অতিরিক্ত হয় না।।৮।।

নির্গতোপাধিরাকাশঃ এক এব যথা ভবেৎ ।

এক এব তথাত্মায়ং নির্গতোপাধিকঃ সদা ॥৯॥ 

অনুবাদঃ উপাধীবিহীন আকাশ যেমন একই, সেইরূপ দেহাদিরূপ উপাধি-বিরহিত আত্মা একমাত্র অবশিষ্ট থাকেন।।৯।।

আকাশাদন্যদাকাশমাকাশস্পৃক্ যথা ন হি ।

একৎবাদাত্মনো নান্য আত্মা সিধ্যতি চাত্মনঃ ॥১০॥

অনুবাদঃ যেমন একমাত্র আকাশ অন্য আকাশ হইতে পৃথক্ নহে, সেইরূপ আত্মার একত্বহেতু অন্য আত্মা সিদ্ধ হয় না।।১০।।

.......................................................................................

বিঃদ্রঃ-ধারাবাহিক ভাবে লিখার ইচ্ছা পোষণ করছি।

 

Monday, 29 March 2021

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-‘‘সন্ন্যাসযোগ’’ (শাঙ্করভাষ্য অনুযায়ী ভাবার্থ)

 


সন্ন্যাসযোগ

 গীতায়কর্ম্মেতে যিনি অকর্ম্ম দেখেন’ (গীতা ১৮) হইতে আরম্ভ করিয়াযাঁহাদের কর্ম্ম জ্ঞানাগ্নির দ্বারা দগ্ধ হইয়া গিয়াছে’ (গীতা ১৯), ‘কেবল শরীরযাত্রা নির্বাহক কর্ম্ম করে’ (গীতা ২১), ‘যদৃচ্ছা লাভ সন্তুষ্ট’ (গীতা ২২)…….., ‘সর্বকর্ম্ম জ্ঞানেতে পরিসমাপ্ত হয়’ (গীতা ৩৩), ‘জ্ঞানাগ্নি সর্বকর্ম্ম ভস্মসাৎ করে’ (গীতা ৩৭) ‘ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা ধর্ম্মাধর্ম্ম কর্ম্ম যিনি ত্যাগ করেছেন’ (গীতা ৪১) এই পর্য্যন্ত বাক্যসকলের দ্বারা ভগবান্ সর্বকর্ম্মসন্ন্যাসের কথা বলিতেছেন

 আবারএই সংশয় ছেদ করে কর্ম্মযোগ আচরণ কর’-(গীতা ৪২) ভগবানের এই বচনের দ্বারা কর্ম্মানুষ্ঠানলক্ষণ যোগ আচরণ করার উক্তি প্রদর্শিত হইয়াছে কর্ম্মানুষ্ঠান কর্ম্মসন্ন্যাস এই উভয়ের গতিস্থিতিবৎ বিরোধহেতু একজনের দ্বারা একটির সহিত অপরটির আচরণ করা অসম্ভব বলিয়া অথবা একজনের দ্বারা কালভেদে অর্থাৎ কোন সময়ে জ্ঞান আবার কোন সময়ে কর্ম্ম অনুষ্ঠানের শাস্ত্রীয় বিধানে অভাব রহিয়াছে …..

 কর্ম্মযোগে অর্জুন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন- ‘হে জনার্দ্দন! যদি তোমার মতে কর্ম্ম হইতে জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, তবে হে কেশব! আমাকে এই ক্রুর হিংসাত্মক কর্ম্মে কেন নিযুক্ত করিতেছ?’ (গীতা ) অর্জ্জুনের প্রশ্নের প্রতিবচনে ভগবান নির্ণয় করিয়াছেন-‘ইহলোকে শাস্ত্রানুষ্ঠানে অধিকৃতগণের দ্বিবিধ নিষ্ঠা আছে, ইহা পুরাকালে অর্থাৎ সৃষ্টির প্রাক্ কালে প্রজা সৃষ্টি করিয়া তাহাদের অভ্যুদয়-নিঃশ্রেয়স-প্রাপ্তিসাধন নিবৃত্তি প্রবৃত্তিমূলক বেদার্থ সম্প্রদায়ের আবিষ্কর্তা আমাকর্তৃক অর্থাৎ সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর কর্তৃক কথিত হইয়াছে অর্থাৎ আত্ম-অনাত্ম-বিষয়-বিবেক-জ্ঞানবান, ব্রহ্মচর্য আশ্রম হইতে যাহারা কৃতসন্ন্যাসী, বেদান্ত-বিজ্ঞান-সুনিশ্চিত অর্থ, পরমহংস পরিব্রাজক এবং ব্রহ্মে অবস্থিত যাহারা, সেই সাংখ্যদিগের নিষ্ঠা হইল জ্ঞানযোগ এবং যে যোগীদিগের নিষ্কামভাবে কর্ম্ম করাই যোগ তাহাদের নিষ্ঠা কর্ম্মযোগ বলিয়াছি (গীতা )

 সত্ত্বশুদ্ধি জ্ঞানোৎপত্তিদ্বারা জ্ঞাননিষ্ঠার হেতু যজ্ঞাদি কর্ম্মসকলের অনারম্ভ অর্থাৎ প্রারম্ভ না করিয়া পুরুষ ইহজন্মে বা জন্মান্তরে নৈষ্কর্ম্যভাব অর্থাৎ কর্ম্মশুন্যতা নিষ্ক্রিয় আত্ম-স্বরূপে অবস্থিতি প্রাপ্ত হয় না আবার কেবলমাত্র সন্ন্যাস অর্থাৎ জ্ঞানশূন্য কর্ম্মত্যাগ হইতে সিদ্ধি অর্থাৎ নৈষ্কর্ম্যলক্ষণা জ্ঞানযোগনিষ্ঠা সম্যক্ রূপে অধিগত হয় না(গীতা ) ভগবানের এই বাক্য হইতে জ্ঞানসহিত সন্ন্যাসের সিদ্ধি-সাধনত্বই ইষ্ঠ অর্থাৎ অভীপ্সিত এবং চিত্তশুদ্ধির জন্য কর্ম্মযোগেরও বিধান প্রাপ্ত হওয়ায়, জ্ঞানশূন্য সন্ন্যাস শ্রেয়ঃ, কিম্বা কর্ম্মযোগ শ্রেয়ঃ এই উভয়ের বিশেষত্ব জানিবার ইচ্ছা করিয়া অর্জ্জুম প্রশ্ন করিতেছেন- 

অর্জুন উবাচ
সংন্যাসং কর্মণাং কৃষ্ণ পুনর্যোগং শংসসি
যচ্ছ্রেয় এতয়োরেকং তন্মে ব্রূহি সুনিশ্চিতম্ ৷৷

 ‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- অর্জ্জুন কহিলেন- হে কৃষ্ণ! কর্ম্মসকলের অর্থাৎ শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানবিশেষসমূহের তুমি সন্ন্যাস অর্থাৎ পরিত্যাগের উপদেশ করিতেছ আবার তাহাদের কর্ম্মযোগরূপে উপদেশ করিতেছ অর্থাৎ তাহাদের অনুষ্ঠান নিষ্কামভাবে অবশ্য কর্ত্তব্য কহিতেছ যাহা প্রশস্যতর তাহাই অনুষ্ঠেয়; সেইজন্য এই কর্ম্মসংন্যাস এবং কর্ম্মানুষ্ঠানের মধ্যে যাহা শ্রেয়ঃ অর্থাৎ প্রশস্যতর, যাঁহার অনুষ্ঠান হইতে আমার শ্রেয়ঃ প্রাপ্তি হইবে বলিয়া তুমি মনে কর, তাহার একটি আমাকে সুনিশ্চয় করিয়া বল তোমার অভিপ্রায় কি? যেকোন একটি কেন? কারণ একজনের দ্বারা কর্ম্মানুষ্ঠান কর্ম্মসন্ন্যাস এই উভয়ের একটির সহিত অপরটির আচরণ করা অসম্ভব। ১ 

শ্রীভগবান্ উবাচ
সংন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরাবুভৌ
তয়োস্তু কর্মসংন্যাসাত্কর্মযোগো বিশিষ্যতে ৷৷ ৷৷

 ‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- শ্রীভগবান্ কহিলেন- সংন্যাস অর্থাৎ কর্ম্মের পরিত্যাগ এবং কর্ম্মযোগ অর্থাৎ কর্ম্মসকলের নিষ্কামভাবে অনুষ্ঠান উভয়ই নিঃশ্রেয়সকর অর্থাৎ নিঃশ্রেয়সরূপ মোক্ষসম্পাদন করিয়া থাকে যদিও জ্ঞান উৎপত্তির হেতুত্বরূপে উভয়ই নিঃশ্রেয়সকর তথাপি তাহাদের নিঃশ্রেয়সহেতুর মধ্যে কেবল-কর্ম্মসন্ন্যাস হইতে কর্ম্মযোগ উৎকৃষ্টতর এখানে কর্ম্মযোগের স্তুতি করা হইতেছে।২ 

কর্ম্মযোগের স্তুতি কেন? তাই বলিতেছেন- 

জ্ঞেয়ঃ নিত্যসংন্যাসী যো দ্বেষ্টি কাঙ্ক্ষতি
নির্দ্বন্দ্বো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাত্প্রমুচ্যতে ৷৷ ৷৷ 

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- সেই কর্ম্মযোগী নিত্যসন্ন্যাসী, যিনি দ্বেষ করেন না, কিছুর আকাঙ্ক্ষাও করেন না, দুঃখে-সুখে এবং তাহাদের সাধনরূপ কর্ম্মে যিনি সমভাবে বর্ত্তমান, তিনি কর্ম্মানুষ্ঠান করিলেও নিত্যসন্ন্যাসী বলিয়া জ্ঞেয় অর্থাৎ জ্ঞাতব্য যেহেতু তাঁহারা নির্দ্বন্দ্ব অর্থাৎ দ্বন্দ্ববর্জ্জিত সেইজন্য, হে মহাবাহো! তাঁহারা বন্ধন হইতে সুখে অর্থাৎ অনায়াসে মুক্তিলাভ করেন। ৩ 

সাংখ্যযোগৌ পৃথগ্বালাঃ প্রবদন্তি পণ্ডিতাঃ
একমপ্যাস্থিতঃ সম্যগুভয়োর্বিন্দতে ফলম্ ৷৷ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- সাংখ্য ও কর্ম্মযোগ পৃথক অর্থাৎ বিরুদ্ধস্বভাব এবং ভিন্ন-ফল প্রসবকারী একথা বালকেরা বলিয়া থাকে। পরন্তু পণ্ডিতেরা অর্থাৎ জ্ঞানীরা সাংখ্য এবং কর্ম্মযোগের একই অবিরুদ্ধফল ইচ্ছা করেন। সাংখ্য এবং যোগের একটিতে যিনি সম্যক্ রূপে অবস্থিত অর্থাৎ সম্যক্ অনুষ্ঠানবান্, তিনি উভয়েরই ফল প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। কারণ উভয়ের ফল নিঃশ্রেয়সই, এইজন্য ফলে বিরোধ নেই। সংন্যাস ও কর্ম্মযোগ উভয়ই জ্ঞান এবং তার উপায় সমবুদ্ধিত্ব প্রভৃতি ভাবের দ্বারা যুক্ত হইলে তবেই তাহারা সাংখ্য এবং কর্ম্মযোগ শব্দবাচ্য হয়-এই হইতেছে ভগবানের মত। ৪

যত্সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্যোগৈরপি গম্যতে
একং সাংখ্যং যোগং যঃ পশ্যতি পশ্যতি ৷৷ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- সাংখ্যযোগী অর্থাৎ জ্ঞাননিষ্ঠ সন্ন্যাসীগণ কর্তৃক যে মোক্ষাখ্য স্থান প্রাপ্ত হইয়া থাকে তাহা কর্ম্মযোগিগণ কর্তৃকও প্রাপ্ত হইয়া থাকে। নিজের জন্য ফলের অভিসন্ধি বা ইচ্ছা না করিয়া জ্ঞানপ্রাপ্তির উপায়স্বরূপ কর্ম্মসকল ঈশ্বরে সমর্পণ করিয়া যাঁহারা কর্ম্ম করেন তাঁহারা কর্ম্মযোগী। তাঁহাদিগেরও পরমার্থ-জ্ঞানরূপ সংন্যাসপ্রাপ্তির দ্বারা মোক্ষরূপ ফল প্রাপ্ত হয়৷ এইজন্য ফলে একত্বহেতু যিনি সাংখ্য এবং কর্ম্মযোগকে এক দেখেন তিনিই যথার্থদর্শী, সম্যক্জ্ঞানী

ব্যাখ্যাঃ- যদি তাই হয় তবে তো কর্মযোগ অপেক্ষা কর্মসংন্যাসই শ্রেষ্ঠ, তাহা হইলে শ্রীভগবানকর্তৃক কেন এইরূপ উক্ত হইয়াছে যে এই উভয়ের মধ্যে কর্মসংন্যাস অপেক্ষা কর্মযোগ শ্রেষ্ঠ? কারণ অর্জ্জুন জ্ঞানাভ্যাসরহিত কেবল কর্মসংন্যাস আর কর্মযোগকে অভিপ্রায় করিয়া প্রশ্ন করিয়াছিল যে এই দুইয়ের মধ্যে কোনটি শ্রেয়? তদনুরূপ প্রতিবচনে ভগবান কর্তৃক উক্ত হইয়াছিল যে-‘জ্ঞানকে অপেক্ষা না করে এমন অর্থাৎ জ্ঞানাভ্যাসরহিত কেবল কর্মসংন্যাস অপেক্ষা তো কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ৷ কেননা জ্ঞানকে অপেক্ষা কোরে যে জ্ঞানসহিত সংন্যাস তাহাই আমাকর্তৃক সাংখ্যবলিয়া অভিপ্রেত আর ইহাই পরমার্থযোগ

সংন্যাসস্তু মহাবাহো দুঃখমাপ্তুমযোগতঃ
যোগযুক্তো মুনির্ব্রহ্ম নচিরেণাধিগচ্ছতি ৷৷ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- পারমার্থিক সংন্যাস কর্ম্মযোগ বিনা দুঃখপ্রাপ্তির নিমিত্ত হয় ঈশ্বরসমর্পিতরূপ ফলনিরপেক্ষ বৈদিক কর্ম্মযোগের দ্বারা যুক্ত ঈশ্বর-স্বরূপের মননকারী মুনি অচিরে পরমাত্মজ্ঞানলক্ষণহেতু প্রকৃত সংন্যাসরূপ ব্রহ্ম প্রাপ্ত হন কারণন্যাসই ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ’-(মহানারায়ণ উপনিষৎ ৭৮) এইরূপ শ্রুতিতে আছে। ৬

যোগযুক্তো বিশুদ্ধাত্মা বিজিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়ঃ
সর্বভূতাত্মভূতাত্মা কুর্বন্নপি লিপ্যতে ৷৷ ৷৷ 

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- কর্ম্মযোগযুক্ত, বিশুদ্ধচিত্ত, সংযতদেহ, জিতেন্দ্রিয়, সর্বভূতাত্মভূতাত্মা অর্থাৎ ব্রহ্মাদি স্তম্ব পর্যন্ত্য সর্বভূতের আত্মাকে স্বীয় আত্মারূপে দর্শনকারী সম্যগ্দর্শী বর্তমান থাকিয়া লোকসংগ্রহের নিমিত্ত কর্ম করিয়াও লিপ্ত হন না অর্থাৎ কর্ম্মে আবদ্ধ হন না। ৭

নৈব কিংচিত্করোমীতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিৎ
পশ্যন্ শ্রৃণবন্স্পৃশঞ্জিঘ্রন্নশ্নন্গচ্ছন্স্বপন্ শ্বসন্ ৷৷ ৮৷৷

প্রলপন্বিসৃজন্গৃহ্ণন্নুন্মিষন্নিমিষন্নপি
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্ ৷৷ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- দর্শনে, শ্রবণে, স্পর্শে, আঘ্রাণে, ভোজনে, গমনে, নিদ্রায়, নিঃশ্বাস-গ্রহণে, কথনে, মলমূত্রাদি ত্যাগে, গ্রহণে, চক্ষুর উন্মেষে এবং নিমিষেও ইন্দ্রিয়গণ স্ব স্ব বিষয়ে প্রবৃত্ত - এইরূপ দৃঢ় ধারণা করিয়া আমি পরমার্থত কিছুই করি নাএইরূপ যুক্ত অর্থাৎ সমাহিত হয়ে তত্ত্ববিৎ মনন অর্থাৎ চিন্তা করেন যিনি আত্মার যাথাত্ম্য তত্ত্ববেত্তা অর্থাৎ পরমার্থদর্শী এবং যে সম্যগ্ দর্শী সর্ব্বকার্য্য ইন্দ্রিয়চেষ্টারূপ কর্ম্মে অকর্ম্ম দর্শন করেন তিনিই তত্ত্ববিৎ তাঁহার সর্ব্বকর্ম্মসন্ন্যাসে অধিকার, কারণ আত্মাতে তিনি কর্ম্মের অভাব দর্শন করেন। ৮,৯ 

কিন্তু যিনি অতত্ত্ববিৎ তিনি কিভাবে কর্ম্মযোগে প্রবৃত্ত হন?

ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ
লিপ্যতে পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা ৷৷১০৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- ব্রহ্মে (ঈশ্বরে) কর্ম্মফল নিক্ষেপ করেতাঁহার জন্য করছিএইরূপ ভৃত্যের মত স্বামীর প্রতি দাস্যভক্তি অবলম্বনপূর্ব্বক সর্ব্বকর্ম্ম করেন অর্থাৎ মোক্ষফলেও আসক্তি ত্যাগ করে যিনি দাস্যভক্তিতে সর্ব্বকর্ম্ম করেন তিনি পাপের দ্বারা লিপ্ত বা বদ্ধ হন না, ঠিক যেমন পদ্মপত্র জলের দ্বারা লিপ্ত হয় না। ১০

কায়েন মনসা বুদ্ধ্যা কেবলৈরিন্দ্রিয়ৈরপি
যোগিনঃ কর্ম কুর্বন্তি সঙ্গং ত্যক্ত্বাত্মশুদ্ধয়ে ৷৷১১৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- কেবল অর্থাৎ মমত্ববর্জ্জিত দেহ, মন, বুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারাঈশ্বরের সেবার নিমিত্ত কর্ম্ম করিতেছি, আমার নিজের ফলের জন্য নহে”, এইরূপ ফলবিষয়ক আসক্তি ত্যাগ করিয়া নিষ্কাম কর্ম্মযোগীরা আত্মশুদ্ধি অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত কর্ম্ম করিয়া থাকেন এইজন্য তোমার কর্ম্মেতেই অধিকার, সেইজন্যতুমি কর্ম্মই কর”। ১১

যুক্তঃ কর্মফলং ত্যক্ত্বা শান্তিমাপ্নোতি নৈষ্ঠিকীম্৷
অযুক্তঃ কামকারেণ ফলে সক্তো নিবধ্যতে ৷৷ ১২ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- যুক্ত অর্থাৎঈশ্বরের নিমিত্ত কর্ম্মসকল, আমার ফলের নিমিত্ত নহে’-এইরূপ সমাহিত হইয়া অর্থাৎ কর্ম্মফল পরিত্যাগ করিয়া কর্ম্মযোগী মোক্ষাখ্য জ্ঞানে নৈষ্ঠিকী শান্তি প্রাপ্ত হইয়া থাকেন কর্ম্মযোগহেতু চিত্তশুদ্ধি, তারপর জ্ঞানপ্রাপ্তি, তারপর সর্ব্বকর্ম্মসন্ন্যাসরূপ জ্ঞাননিষ্ঠালক্ষণ পরমশান্তি লাভ হয় পুনশ্চ যে অযুক্ত অর্থাৎ অসমাহিত ব্যক্তি কামকারের দ্বারা প্রেরিত হইয়া, ‘আমার ফলের জন্য এইরূপ কর্ম্ম করিবএইরূপ ভাবনার দ্বারা ফলেতে আসক্তিরূপ বন্ধন প্রাপ্ত হয় অতএবতুমি যুক্ত অর্থাৎ সমাহিত হও’-এইরূপ অর্থ। ১২

সর্বকর্মাণি মনসা সংন্যস্যাস্তে সুখং বশী৷
নবদ্বারে পুরে দেহী নৈব কুর্বন্ন কারয়ন্ ৷৷ ১৩ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- আর যাঁহারা পরমার্থদর্শী তাঁহারা নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য, প্রতিষিদ্ধ যাবতীয় কর্ম্ম মন অর্থাৎ বিবেকবুদ্ধি দ্বারা অর্থাৎ কর্ম্মাদি ভ্রান্তিহেতু তাহাতে অকর্ম্ম দর্শনের দ্বারা সর্ব্বকর্ম্ম সংন্যাস অর্থাৎ পরিত্যাগ করে, ত্যক্ত বাক্য-মনঃ-কায়-চেষ্ট, নিরায়াস, প্রসন্নচিত্ত অর্থাৎ আত্মা ব্যতীত অন্যত্র সর্ব্ববাহ্য বস্তু হইতে সমস্ত প্রয়োজন নিবৃত্ত হইয়াছে এমন যে চিত্তভাবরূপ সুখ, তাহাতে পরমার্থদর্শীরা অবস্থান করেন এইরূপ বশী অর্থাৎ জিতেন্দ্রিয় কোথায় এবং কিভাবে অবস্থান করেন? তদুত্তরে বলিতেছেন- নবদ্বারযুক্ত পুরে অর্থাৎ মস্তকস্থ দুই চক্ষু, দুই কর্ণ, দুই নাসিকা এবং মুখ এই সাতটি আত্মার রূপ, শব্দ, গন্ধ এবং রস উপলব্ধির দ্বার, বাকি দুইটী নিম্নাঙ্গে মুত্র পুরীষ ত্যাগের জন্য উপস্থ এবং পায়ু; সর্ব্বসমেত এই নয়টী দ্বার হেতু দেহকে নবদ্বারযুক্ত পুর বলা হয় শরীর পুরের অর্থাৎ গৃহের মত বলিয়া তাহাকে পুর বলা হয়, যাহার স্বামী বা প্রভু একমাত্র আত্মা, এবং যাহা প্রভু স্থানীয় সেই আত্মার ভোগের সাধন, অনেক ফল বিজ্ঞানের উৎপাদক ইন্দ্রিয়, মন এবং বুদ্ধির বিষয় শব্দস্পর্শাদিও পুর-বাসিগণের ন্যায় এই দেহপুরে অবস্থিত থাকে এই নবদ্বারবিশিষ্ট পুরে জিতেন্দ্রিয় দেহী সর্ব্বকর্ম্ম ত্যাগ করে অবস্থান করেন। ১৩

ব্যাখ্যাঃ- দেহ ইন্দ্রিয়াদি সংঘাত হইতে আত্মা ভিন্ন' এইরূপ বিবেকীর 'আমি শরীরে থাকি' এইরূপ প্রত্যয় হইতে পারে পরাত্মাতে অবিদ্যা দ্বারা অধ্যারোপিত অপরের অর্থাৎ দেহেন্দ্রিয়াদি জাত কর্ম্মসকলের, বিবেকজ্ঞানরূপ বিদ্যাবিশিষ্ট মনের দ্বারা তত্ত্বজ্ঞানীর সংন্যাস উৎপন্ন হয় উৎপন্ন-বিবেকজ্ঞান সর্ব্বকর্ম্ম সংন্যাসীরও দেহেই বিশেষ বিজ্ঞান হওয়ায়, গৃহের মত নবদ্বার যুক্ত দেহপুরে তাঁহার থাকা কেবল প্রারব্ধ কর্ম্মের অবশিষ্ট সংস্কার সকলের ফলভোগের অনুবৃত্তিহেতু

কর্তৃত্বং কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ
                                 ন কর্মফলসংযোগং স্বভাবস্তু প্রবর্ততে ৷৷ ১৪ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- সেই প্রভু আত্মাতুমি অমুক কর্ম্ম করএই বলিয়া মনুষ্যের কর্তৃত্ব সৃজন করেন না, আবার রথ, ঘট, প্রাসাদাদি নির্ম্মাণরূপ ঈপ্সিততম কর্ম্মসকলও সৃজন বা উৎপাদন করেন না এবং যাহারা রথাদি নির্ম্মাণ করে তাহাদের সেই ফলের সহিত সংযোগ অর্থাৎ কর্ম্মফলসংযোগও করেন না যদি দেহী আত্মা স্বয়ং কিছুই করেন না বা করান না তাহা হইলে কে কর্ম্মে প্রবর্তিত হন বা করান? উত্তর হইল-‘স্বভাবঅর্থাৎ নিজভাব অর্থাৎ অবিদ্যালক্ষণা প্রকৃতি বা মায়া, তিনিই জীবকে কর্ম্মে প্রবর্তিত করেন। ১৫

নাদত্তে কস্যচিত্পাপং চৈব সুকৃতং বিভুঃ
অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ ৷৷ ১৫ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- পরমার্থত বিভু আত্মা কোন ভক্তের পাপও গ্রহণ করেন না, অথবা ভক্তের দ্বারা অর্পিত সুকৃতি বা পুণ্যও গ্রহণ করেন না তাহা হইলে ভক্তগণকর্তৃক পূজাদিলক্ষণ যাগ, দান, হোমাদি, সুকৃত কর্ম্মের যে পূণ্যফল কি নিমিত্ত তাঁহাতে অর্পণ করিবে? বলা হইতেছে- অজ্ঞানের দ্বারা বিবেকবিজ্ঞান আবৃত, সেইহেতু জীবগণ মোহপ্রাপ্ত হয় এইরূপে মোহপ্রাপ্ত হয় বলে, ‘আমি করি করাই, ভক্ষণ করি বা ভোজন করাই’-এইভাবে নিষ্ক্রিয় আত্মায় ক্রিয়ার আরোপ করে অবিবেকী সংসারী জীবগণ মোহপ্রাপ্ত হয়। ১৬

জ্ঞানেন তু তদজ্ঞানং যেষাং নাশিতমাত্মনঃ ৷
তেষামাদিত্যবজ্জ্ঞানং প্রকাশযতি তত্পরম্ ৷৷ ১৬ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- কিন্তু যে অজ্ঞানের দ্বারা আবৃত হইয়া জীবগণের মোহপ্রাপ্তি হয়, আত্ম-বিষয়ক বিবেক জ্ঞানদ্বারা সেই অজ্ঞান বিনষ্ট হয়। তাহাদিগের সেই আত্মজ্ঞান আদিত্যবৎ অর্থাৎ সূর্য যেইরূপ সমস্ত রূপজাত বস্তুকে অবভাসিত করে সেইরূপ এই পরমার্থতত্ত্বজ্ঞান সর্ব্বজ্ঞেয় বস্তুকে প্রকাশ করে।  ১৬

তদ্বুদ্ধযস্তদাত্মানস্তন্নিষ্ঠাস্তত্পরায়ণাঃ ৷
গচ্ছন্ত্যপুনরাবৃত্তিং জ্ঞাননির্ধূতকল্মষাঃ ৷৷ ১৭৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- সেই পরমাত্মাতে গত হইয়াছে বুদ্ধি যাহাদের তাহারা ‘তদ্বুদ্ধি’, ‘তদাত্মা’ অর্থাৎ সেই পরব্রহ্মই আত্মা যাহাদের তাহারা ‘তদাত্মা’ এবং ‘তন্নিষ্ঠা’ অর্থাৎ নিষ্ঠা বা অভিনিবেশ বা তৎপরতা, অর্থাৎ সর্ব্বকর্ম্ম সন্ন্যাস করে ব্রহ্মতেই অবস্থান যাহাদের তাহারা তন্নিষ্ঠ। ‘তৎপরায়ণ’ অর্থাৎ সেই ব্রহ্মই হন যাহাদের পরম অয়ন বা পরাগতি, তাহারা তৎপরায়ণ অর্থাৎ কেবল আত্মরতি এইরূপ অর্থ। যাঁহাদের জ্ঞানের দ্বারা আত্মার আবরক অজ্ঞান নাশ হইয়াছে এইরূপ তত্ত্বজ্ঞানীরা অপুনর্দেহ সম্বন্ধরূপ পরিনির্বাণাখ্য অপুনরাবৃত্তিতে গমন করেন অর্থাৎ সেই দেহসম্বন্ধরহিত অবস্থা ব্রহ্মস্বরূপতা প্রাপ্ত হন। তাঁহাদের আর পুনরায় দেহধারণ করিতে হয় না অর্থাৎ পুনর্জন্ম  হয় না। যথোক্ত জ্ঞানের দ্বারা পাপাদি সংসার-কারণ-দোষ নাশ হইয়াছে যাঁহাদের তাঁহারাই জ্ঞান-নির্ধূত-কল্মষ যতি। ১৭ 

যাঁহাদের জ্ঞানের দ্বারা আত্মার অজ্ঞান নাশ হইয়াছে, সেই পণ্ডিতেরা কিভাবে তত্ত্বদর্শন করেন-তাই বলা হইতেছে- 

বিদ্যাবিনয়সংপন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি ৷
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ ৷৷১৮৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- পণ্ডিতেরা ‘বিদ্যাবিনয়সম্পন্ন’- বিদ্যা অর্থাৎ আত্মার বোধ, বিনয় অর্থাৎ উপশম বা শান্তস্বভাব সম্পন্ন বিদ্বান ব্রাহ্মণে, গাভীতে, হস্তীতে, কুক্কুরে এবং চণ্ডালে সমদর্শী। বিদ্যাবিনয়সম্পন্ন উত্তম সংস্কারবান সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণে, মধ্যম প্রাণী রাজসিক প্রকৃতিসম্পন্ন গাভীতে, অত্যন্ত সংস্কারহীন কেবল তামস হস্তী প্রভৃতি জীবের মধ্যে অবস্থিত হইয়াও যিনি সত্ত্বাদি গুণসকল হইতে আর তাহাদিগ হইতে জাত সংস্কার সকল হইতে তথা রাজস এবং তামস সংস্কারের দ্বারা অত্যন্তই অস্পৃষ্ট, সেই সম, এক অবিক্রিয় ব্রহ্ম দর্শনই স্বভাব যাঁহাদের, সেই পণ্ডিতেরা সমদর্শী ।১৮ 

ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ ৷
নির্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ্ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ ৷৷ ১৯ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- এখানেই অর্থাৎ জীবিত অবস্থাতেই সেই সমদর্শী পণ্ডিতগণ এই জন্মকে জয় অর্থাৎ বশীভূত করিয়াছেন। পণ্ডিতদের লক্ষণ কি?-সাম্যে অর্থাৎ যাঁহাদের মন (অন্তঃকরণ) সর্ব্বভূতস্থ সমভাবে বর্তমান ব্রহ্মে স্থিত অর্থাৎ নিশ্চলীভূত হইয়াছে। যদিও মূঢ়েড়া চণ্ডালাদিতে অবস্থিত ব্রহ্মকে তদ্দোষের দ্বারা দোষবৎ ভাবনা করে তথাপি ব্রহ্ম চণ্ডালাদির দোষে অষ্পৃষ্ট। যেহেতু চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্ম নির্গুণ, নির্দোষ বা দোষ বর্জ্জিত। সর্ব্বব্যাপী ব্রহ্ম এক এবং সেই জন্য তাঁহারা ব্রহ্মতেই অবস্থিত। কারণ তাঁহাদের বুদ্ধিতে দেহাদি সংঘাতকে আত্মারূপে দর্শন করার অভাব আছে। ১৯

ন প্রহৃষ্যেত্প্রিযং প্রাপ্য নোদ্বিজেত্প্রাপ্য চাপ্রিয়ম্ ৷
স্থিরবুদ্ধিরসম্মূঢ়ো ব্রহ্মবিদ্ব্রহ্মণি স্থিতঃ ৷৷ ২০ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- ব্রহ্মবিৎ প্রিয় অর্থাৎ ইষ্ট প্রাপ্ত হইয়া প্রহৃষ্ট হন না অর্থাৎ হর্ষ লাভ করেন না, অথবা অপ্রিয় বা অনিষ্ট লাভ করিয়া উদ্বেগ প্রাপ্ত হন না। মাত্র দেহেই আত্মদর্শী যাহারা তাহারাই প্রিয় এবং অপ্রিয় প্রাপ্তিতে হর্ষবিষাদে প্রহৃষ্ট বা উদ্বিগ্ন হইয়া থাকেন, পরন্তু কেবল আত্মদর্শী যাঁহারা তাঁহারা নন। কারণ কেবল আত্মদর্শী যিনি তাঁহার পক্ষে প্রিয় ও অপ্রিয় প্রাপ্তি অসম্ভব। আরও কি-‘সর্বভূতে এক এবং সমভাবে বর্ত্তমান নির্দোষ আত্মা’ এইরূপ সংশয়শূন্য স্থিরবুদ্ধি যাঁহার এবং অসংমূঢ় অর্থাৎ সম্মোহবর্জ্জিত যিনি তিনিই যথোক্ত ব্রহ্মবিৎ অর্থাৎ ব্রহ্মে স্থিত অকর্ম্মকৃৎ সর্ব্বকর্ম্মসন্ন্যাসী-এইরূপ অর্থ। ২০

বাহ্যস্পর্শেষ্বসক্তাত্মা বিন্দত্যাত্মনি যত্সুখম্৷
স ব্রহ্মযোগযুক্তাত্মা সুখমক্ষযমশ্নুতে ৷৷২১৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- যা ইন্দ্রিয়কে স্পর্শ করে তাই শব্দাদি বাহ্যস্পর্শ, সেই বাহ্যবিষয়ে অনাসক্ত আত্মা অর্থাৎ অন্তঃকরণ যাঁহার, সেই ব্রহ্মে স্থিত অসক্তাত্মা বিষয়ে প্রীতিবর্জ্জিত হইয়া শাশ্বত সুখ লাভ করেন। ব্রহ্মে যে যোগ বা সমাধি তাহাই ব্রহ্মযোগ, সেই ব্রহ্মযোগের দ্বারা যুক্ত অর্থাৎ সমাহিত বা সমাধিতে ব্যাপৃত আত্মা বা অন্তঃকরণ যাঁহার; সেই ব্রহ্মযোগযুক্ত আত্মা অক্ষয় সুখ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। সেই জন্য বাহ্যবিষয়প্রীতি ক্ষণিক বলে, আত্মাতে অক্ষয় সুখার্থী যাঁহারা তাহাদের উচিত ইন্দ্রিয়সকলকে বিষয় হইতে নিবর্তিত করা-এইরূপ অর্থ। ২১

যে হি সংস্পর্শজা ভোগা দুঃখযোনয় এব তে ৷
আদ্যন্তবন্তঃ কৌন্তেয় ন তেষু রমতে বুধঃ ৷৷ ২২ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- যে সব ভোগ বা ভুক্তিরা সংস্পর্শ, অর্থাৎ বিষয়েন্দ্রিয় সংস্পর্শ হইতে জাত তা দুঃখ-যোনি বা দুঃখহেতুই, কেননা তাহারা অবিদ্যাকৃত। দেখাও যায়, আধ্যাত্মিকাদি দুঃখসকলও সেই নিমিত্তই হইয়া থাকে। যেমন ইহলোকে দুঃখ তেমনি পরলোকেও দুঃখ প্রাপ্ত হওয়া যায়। বিষয়ভোগ কেবল দুঃখ-যোনি নয়, আদি এবং অন্তবানও বটে। বিষয় ও ইন্দ্রিয়ের সংযোগই ভোগসকলের আদি, আর বিষয় ও ইন্দ্রিয়ের বিয়োগ হল ভোগসকলের অন্ত। অতএব বিষয়ভোগ উৎপত্তি ও বিনাশের মাঝখানে থাকে বলে আদি এবং অন্তবন্ত অর্থাৎ অনিত্য। হে কৌন্তেয়! সেই ভোগেতে বুধেরা অর্থাৎ পরমার্থতত্ত্ব অবগত বিবেকীরা কখন বিহার করেন না। অত্যন্ত মূঢ়দেরই বিষয়ে রতি দেখা যায়, যেমন পশুপ্রভৃতিদের। ২২

কামক্রোধাদিই শ্রেয়োমার্গের প্রতিদ্বন্দী, অতিকষ্টকর দোষ, সর্ব্বঅনর্থ প্রাপ্তির হেতু এবং দুর্নিবার্য। তাহাদের পরিহারের জন্য যত্নাধিক্য কর্ত্তব্য। তাহাই দেখাবার জন্য ভগবান বলিতেছেন-

শক্নোতীহৈব যঃ সোঢ়ুং প্রাক্ শরীরবিমোক্ষণাৎ ৷
কামক্রোধোদ্ভবং বেগং স যুক্তঃ স সুখী নরঃ ৷৷ ২৩ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- শরীর বিমোক্ষণের পূর্ব পর্য্যন্ত অর্থাৎ মরণের আগ পর্য্যন্ত ইহজীবনেই যিনি সেই কামক্রোধ হইতে উদ্ভূত বেগ সহ্য করিতে উৎসাহ সম্পন্ন হন সেই নরই যুক্ত অর্থাৎ যোগী ও সুখী। পূর্বে অনুভূত সুখদায়ক ইষ্ট-বিষয়কে ইন্দ্রিয়গোচর হইয়া যাওয়ার পর, বা শুনিয়া যাওয়া পর বা স্মরণ হইয়া যাওয়ার পর উহা পাওয়ার যে লালসা বা তৃষ্ণা হইয়া থাকে, উহার নাম কাম। ঠিক তদ্রূপ নিজের প্রতিকূল দুঃখদায়ক বিষয়কে দেখিয়া, শুনিয়া বা স্মরণ হওয়ার পর উহাতে যে দ্বেষ হয়, তাহাকেই ক্রোধ বলে। এই কাম এবং ক্রোধ থেকে যে বেগের উদ্ভব হয় তাহাকেই কামক্রোধোদ্ভব বেগ বলে। কামবেগের চিহ্ন হল শরীরে রোমাঞ্চ, হৃষ্টনেত্র ও হৃষ্টবদনাদি। ক্রোধবেগের লক্ষণ হইল শরীরে কম্প, প্রস্বেদ, অধরোষ্ঠের দংশন ও রক্তনেত্র প্রভৃতি। ২৩

যোন্তঃসুখোন্তরারামস্তথান্তর্জ্যোতিরেব যঃ ৷
স যোগী ব্রহ্মনির্বাণং ব্রহ্মভূতোধিগচ্ছতি ৷৷ ২৪ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- ব্রহ্মে স্থিত কিরূপ ব্যক্তি ব্রহ্ম প্রাপ্ত হন? তাহাই ভগবান বলিতেছেন- যিনি অন্তঃসুখ অর্থাৎ যিনি অন্তরাত্মাতে সুখী, যিনি অন্তরারাম অর্থাৎ অন্তরাত্মাতে আরাম বা আক্রীড়া (বিচার, ধ্যান, ধারণা ইত্যাদি) যাঁহার, সেইরূপই অন্তরাত্মাতেই জ্যোতিঃ বা প্রকাশ যাঁহার তিনি অন্তর্জ্যোতি। ঈদৃশ যোগী ব্রহ্মনির্বাণ অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় ব্রহ্মপ্রাপ্ত হন অর্থাৎ ব্রহ্মে নির্বৃতিরূপ তথা ব্রহ্ম পরমানন্দরূপ মোক্ষ প্রাপ্ত হন ৷ ২৪

লভন্তে ব্রহ্মনির্বাণমৃষয়ঃ ক্ষীণকল্মষাঃ ৷
ছিন্নদ্বৈধা যতাত্মানঃ সর্বভূতহিতে রতাঃ ৷৷ ২৫ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- ক্ষীণপাপাদিদোষ, ছিন্নসংশয়, সংযতেন্দ্রিয়, সর্বভূতের হিতে অর্থাৎ আনুকূল্যে রতা অহিংসক ঋষি তথা সম্যগদর্শী সন্ন্যাসীরা ব্রহ্মনির্বাণ অর্থাৎ মোক্ষলাভ করিয়া থাকেন। ২৫

কামক্রোধবিযুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম্ ৷
অভিতো ব্রহ্মনির্বাণং বর্ততে বিদিতাত্মনাম্ ৷৷ ২৬ ৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- কাম এবং ক্রোধ হইতে বিযুক্ত যতি অর্থাৎ যাঁহারা সংযত অন্তঃকরণ সন্ন্যাসী এবং বিদিত অর্থাৎ জ্ঞাত হইয়াছে আত্মা যাঁহাদের সেই সম্যগ্দর্শী বিদিতাত্মগণের উভয়ত অর্থাৎ জীবিতকালে ও মৃত্যুর পর ব্রহ্মনির্বাণরূপ মোক্ষ বর্তমান থাকে। ঈশ্বরে সর্বভাব অর্পণপূর্বক ঈশ্বরব্রহ্মে সকল কর্ম্মফল সমর্পণ দ্বারা অনুষ্ঠিত কর্মযোগ- চিত্তশুদ্ধি, জ্ঞান-প্রাপ্তি ও সর্বকর্ম-সন্ন্যাস এই ক্রমত্রয়ে মোক্ষপ্রদত্ত এবং সম্যগ্‌দর্শননিষ্ঠ সন্ন্যাসীদের সদ্যোমুক্তির কথা বলা হইয়াছে; যে কথা ভগবান্ গীতার পদে-পদে বলিয়াছেন আর পরবর্তীতেও বলবেন। সদ্যোমুক্তি হইল জ্ঞানলাভকালেই জীবিতাবস্থায় ব্রহ্মরূপে অবস্থান এবং দেহান্তে অপুনর্জন্ম। ২৬

অতঃপর ইদানীং শ্রীভগবানের অভিপ্রায় এই যে, “আমি ষষ্টাধ্যায়ে, সম্যগ্ দর্শনের অন্তরঙ্গ সাধন যে ধ্যানযোগ তাই বিস্তার করে বলবো।” তার প্রারম্ভে ধ্যানযোগের সূত্রস্থানীয় শ্লোকসকল উপদেশ করেছেন-

স্পর্শান্কৃত্বা বহির্বাহ্যাংশ্চক্ষুশ্চৈবান্তরে ভ্রুবোঃ ৷
প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা নাসাভ্যন্তরচারিণৌ
৷৷২৭

যতেন্দ্রিয়মনোবুদ্ধির্মুনির্মোক্ষপরায়ণঃ ৷
বিগতেচ্ছাভয়ক্রোধো যঃ সদা মুক্ত এব সঃ ৷৷২৮৷
                     

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ-  বাহ্য শব্দাদি স্পর্শ সকলকে মন থেকে বাহির করিয়া দিয়া, অর্থাৎ শ্রোত্রাদি দ্বারের মধ্য দিয়া অন্তরদেশে বুদ্ধিতে প্রবেশ করিয়া এমন যে বাহ্যবিষয়, তাহাদের চিন্তা না করিলেই তাহাদের মন হইতে বহিষ্কার করা হয়। তাহাদের বহিষ্কার করিয়া চক্ষুতারাকে ভ্রূযুগলের মধ্যে স্থাপন করিয়া এবং নাসিকার অভ্যন্তরচারী প্রাণ এবং অপান বায়ুকে কুম্ভকের দ্বারা সমান করিয়া যাহার ইন্দ্রিয়, মন আর বুদ্ধি সংযত, যিনি ব্রহ্মতত্ত্ব মনন করেন তিনি মুনি অর্থাৎ সণ্ন্যাসী, যিনি এই দেহেতে অবস্থানকালেই মোক্ষপরায়ণ, অর্থাৎ মোক্ষকে পরম আশ্রয় পরম গতি হিসেবে জ্ঞাত মুনি তথা যিনি ইচ্ছা, ভয় আর ক্রোধ রহিত অর্থাৎ যাহার ইচ্ছা, ভয় আর ক্রোধ বিগত হইয়াছে,যিনি এই প্রকার সদা বর্তমান সণ্ন্যাসী, তিনি সদা মুক্ত, তাহার মোক্ষ ছাড়া অন্য কোন কর্তব্য নাই। ২৭, ২৮

ব্যাখ্যাঃ- এখানে শ্রীভগবান যোগদর্শনের প্রত্যাহার, ধারণা ও প্রাণায়াম বিষয়গুলি স্পষ্ট করিতেছেন। পাতঞ্জলযোগসূত্রের ব্যাসভাষ্যে বর্ণিত আছে-‘নিজ নিজ শব্দাদি বিষয়ের প্রতি সংযোগের অভাবে চিত্তের স্বরূপের অনুকরণ মতো ইন্দ্রিয়গুলি চিত্ত মতোই নিরুদ্ধ হইয়া যায়। যেমন উড়ে যাচ্ছে এমন মধুকররাজের পিছনেই অন্য মৌমাছি উড়ে চলে, আবার মৌমাছি রাজ যেখানে নেমে আসিয়া বসে অন্য মৌমাছিগুলোও তাহাকে অনুসরণ করে সেখানে আসিয়া বসে, ঠিকসেইভাবে ইন্দ্রিয়গুলিও চিত্তের নিরুদ্ধতায় নিরুদ্ধ হয়। এই হল প্রত্যাহার।’-(পাতঞ্জলযোগসূত্র, সাধনপাদ-৫৪) 

‘নাভিচক্রে, হৃদয়পুণ্ডরীকে, ব্রহ্মরন্ধ্রে স্থিত জ্যোতিতে, নাসিকার অগ্রভাগে, জিহ্বার অগ্রভাগে এইভাবে শরীরের ভিতরের দেশগুলিতে অথবা বাহ্য বিষয়ে (দেবতামূর্ত্তি বা ওঙ্কারে) চিত্তের বৃত্তিমাত্র সহায়ে সম্যক্ স্থিতিই ধারণা।’-(পাতঞ্জলযোগসূত্র, বিভূতিপাদ-১) ‘আসন জয় হইলে পর, বাইরের বায়ুগ্রহণ হইল শ্বাস, কোষ্ঠগত ভিতরের বায়ুর ত্যাগ হইল প্রশ্বাস, এইদুইটীর গতিরোধ অর্থাৎ উভয়ের অভাব হইতেছে (তাহা হইল কুম্ভক) প্রাণায়াম।’--(পাতঞ্জলযোগসূত্র, সাধনপাদ-৪৯) 

প্রাণায়াম হইল প্রাণের আয়াম-প্রাণের সংযম। ব্রহ্মসূত্র (২.৪.১২) এর ভাষ্যে ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য্য বলিতেছেন- মুখ্য প্রাণের বিশেষকার্য্য বর্ত্তমান আছে, যেহেতু ইহা ক্রিয়াভেদে পঞ্চবৃত্তিযুক্ত তাহা শ্রুতি বলিতেছে - 'প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান।-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১।৫।৩) সম্মুখভাগে যাহার বৃত্তি উচ্ছাস (প্রশ্বাস এবং দেহধারণ) প্রভৃতি যাহার কর্ম্ম, তাহা প্রাণ। অধোঃভাগে যাহার বৃত্তি এবং নিঃশ্বাসাদি (-শ্বাস গ্রহণ ও অধোবায়ু ত্যাগ) যাহার কর্ম্ম, তাহা অপান। প্রাণ ও অপাণের সন্ধিস্থলে (নাভিতে) বর্তমান যাহা বলসাধ্য কর্মের হেতু তাহা ব্যান। উর্ধদিকে যাহার বৃত্তি এবং উৎক্রমণ (গতি অগতি ও উদ্গার) প্রভৃতির যাহা হেতু তাহা উদান। অন্নরসকে যাহা সকল অঙ্গে সমানভাবে নিয়ে যায়, তাহা সমান। 

এইরূপ সমাহিতচিত্তে কাকে জানা যায় তাই বলা হইতেছে-

ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোকমহেশ্বরম্ ৷
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি ৷৷২৯৷৷

‘শাঙ্করভাষ্য’ অনুসারে ভাবার্থঃ- কর্তা ও দেবতারূপে যজ্ঞ এবং তপস্যার ভোক্তা, সর্ব্বলোকের মহান ঈশ্বর, সর্ব-ভূতের সুহৃদ, সর্ব্বপ্রাণীর কোন প্রত্যুপকার অপেক্ষা না করেই তিনি তাহাদের উপকারী, সর্ব্বভূতের হৃদয়েশ্বর বা হৃদয়শায়ী, সর্ব্বকর্ম্মের ফলাধ্যক্ষ, সর্ব্বপ্রত্যয় অর্থাৎ সর্ব্বসঙ্কল্প বা বুদ্ধিবৃত্তির সাক্ষিস্বরূপ আমি যে নারায়ণ সেই আমাকে জানিয়া মোক্ষপরায়ণ মুনিরা শান্তিলাভ অর্থাৎ সর্বসংসার উপরতি (নিবৃত্তি) প্রাপ্ত করিয়া থাকেন। ২৯


ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং

ভীষ্মপর্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে

শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসম্বাদে সন্ন্যাসযোগো নাম পঞ্চমোঽধ্যায়ঃ।

 

নমো ভগবতে বাসুদেবায়।

॥ শ্রীবেদব্যাসায় নমঃ॥ শ্রীশঙ্করভগবত্পাদাচার্যস্বামিনে নমঃ ॥

 

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...