পূর্ব্বের লিখায় শ্রুতি ও স্মৃতিবলে জীবের বিভুত্ব প্রতিপাদিত হইয়াছে। এখন শঙ্কা হইল-আচ্ছা তাহা হইলে শ্রুতিতে জীবের অণুতা প্রভৃতির বর্ণনা আছে কেন? এইহেতু ভগবান সুত্রকার বাদরায়ণ বলিতেছেন-
অর্থাৎ
বুদ্ধির গুণসকল জীবে প্রধানভাবে প্রতীয়মান হয় বলিয়া তাহাকে অণু বলা হইয়াছে।
ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য্য ভাষ্যে সূত্রাক্ষর যোজনা করিতেছেন-তাহার-বুদ্ধির যে গুণ, তাহা তদ্গুণ, যথা- ইচ্ছা দ্বেষ সুখ দুঃখ ইত্যাদি এই সকল, সেই গুণসকল সার- প্রধান, যে আত্মার সংসারিত্ব হইলে সম্ভব হয়, তিনি তদ্গুণসার, তাহার যে ভার (-সত্তা) তাহাই তদ্গুণসারত্ব। বুদ্ধির গুণসকল ব্যতিরেকে কেবল (-শুদ্ধ) আত্মার সংসারিত্ব নিশ্চয় সম্ভব নহে। অকর্ত্তাঅভোক্তাঅসংসারী ও নিত্যমুক্ত সৎস্বরূপ আত্মার কর্ত্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্বাদিরূপ যে সংসারিত্ব, তাহা বুদ্ধি-রূপ উপাধির ধর্ম্মের অধ্যাসবশতঃই হইয়া থাকে। সেইহেতু সেই গুণসকলের প্রাধান্যবশতঃ বুদ্ধির (অণুতারূপ) পরিমাণের দ্বারা ইহার পরিমাণের কথন হইতেছে। আর বুদ্ধির উৎক্রান্তি প্রভৃতির দ্বারা জীবের উৎক্রান্তি প্রভৃতি বর্ণনা হইতেছে, কিন্তু স্বতঃ নহে। যেমন দেখ-
'বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য
চ৷ ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেযঃ স চানন্ত্যায কল্পতে' -(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৫।৯)
অর্থাৎ
কেশাগ্রের শতভাগের এক ভাগকে পুনঃ শতভাগ কল্পনা করিলে তাহাকে জীবের ভাগরূপে (-পরিমাণরূপে)
অবগত হইতে হবে, আর সেই জীবই অনন্তপদের বাচ্য হইবার যোগ্য',
এইপ্রকারে জীবের অণুতার কথা বলিয়া পুনরায় তাহারই অনন্ততার কথা শ্রুতি বলিতেছেন। জীবের সেই অনন্ততা এইপ্রকার হইলেই সমঞ্জস হয়।, যদি জীবের অণুতা হয় ঔপচারিক এবং অনন্ততা হয় পারমার্থিক। উভয়কেই মুখ্যরূপে কল্পনা করা যাইবে না। আর জীবের অনন্ততা গৌণ, ইহা অবগত হইতে পারা যায় না, যেহেতু সকল উপনিষদে ব্রহ্মাত্মভাব (-জীবের ব্রহ্মস্বরূপতা) প্রতিপাদন করিতে ইচ্ছা করা হইয়াছে। আর এই প্রকারে অন্য অপ্রকৃষ্টপরিমাণবোধক বাক্যেও
'বুদ্ধের্গুণেনাত্মগুণেন চৈব আরাগ্রমাত্রো হ্যবরোপি দৃষ্টঃ' -(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৫।৮)
অর্থাৎ
বুদ্ধির ইচ্ছাদি গুণরূপ নিমিত্তবশতঃ(-সেই গুণসকল আত্মাতে অধ্যস্ত হওয়ায়, সেই অধ্যস্ত
আত্মনিষ্ঠ গুণসকলের দ্বারাই জীব আরার অগ্রভাগের ন্যায় পরিমাণবিশিষ্ট রূপে এবং অত্যন্ত
ক্ষুদ্র পরিমাণযুক্তরূপে পরিদৃষ্ট হয়',
এই-প্রকারে
বুদ্ধিনিষ্ঠ গুণের সম্বন্ধবশতঃ শ্রুতি জীবের আরাগ্রমাত্রতা উপদেশ করিতেছেন; কিন্তু
স্বস্বরূপে নহে। আবার অন্য শ্রুতি-
'এষোণুরাত্মা চেতসা বেদিতব্যঃ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-৩।১।৯)
এই অণু আত্মাকে বিশুদ্ধ চিত্তের দ্বারা অবগত হইতে হইবে',ইত্যাদি এই স্থলেও জীবের অণুপরিমাণতা উপদিষ্ট হইতেছে না, যেহেতু ইহার অব্যবহিত পূর্ব্বেই মুণ্ডক উপনিষৎ ৩।১।৮ শ্রুতিতে পরমাত্মাই চক্ষুরাদির দ্বারা গ্রহণের অযোগ্যরূপে এবং জ্ঞানপ্রসাদগম্যরূপে অর্থাৎ রাগাদিদোষরহিত শুদ্ধ ও স্থির বুদ্ধির দ্বারা প্রাপ্তব্যরূপে প্রস্তাবিত হইয়াছেন। আর পরমাত্মার সহিত অভিন্ন বলিয়া জীবেরও মুখ্য অণুপরিমাণতা যুক্তিসঙ্গত না হওয়ায় অণুত্ববোধিকা শ্রুতিতে ঔপাধিক অণুত্বের জ্ঞাপিকারূপে অবগত হইতে হইবে।
সেইহেতু
ব্রহ্মাভিন্ন জীবের মুখ্য অণুতা সম্ভব না হওয়ায় এই অণুতাপ্রতিপাদক বচনকে পরমাত্মার
দুর্জ্ঞেয়তার অভিপ্রায়ে, অথবা জীবের বুদ্ধিরূপ উপাধির অভিপ্রায়ে বুঝিতে হইবে।...
No comments:
Post a Comment