অদ্য
আলোচ্য বিষয় তৈজসাদি পাদত্রয়াতীত তুরীয় ব্রহ্মস্বরূপ কথন। 'নেতি নেতি' শ্রুতির মত
মাণ্ডুক্য শ্রুতিও নিষেধমুখেই তুরীয় ব্রহ্মের স্বরূপ নিরূপণ করিয়াছেন। অথর্ববেদীয়া
মাণ্ডুক্য উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে—
নান্তঃপ্রজ্ঞং ন বহিষ্প্রজ্ঞং নোভযতঃপ্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন প্রজ্ঞং নাপ্রজ্ঞম্ । অদৃষ্টমব্যবহার্যমগ্রাহ্যমলক্ষণং অচিন্ত্যমব্যপদেশ্যমেকাত্মপ্রত্যযসারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেযঃ ..৭..
বিবেকিগণ
চতুর্থকে (তুরীয়কে) মনে করেন যে, তিনি অন্তঃপ্রজ্ঞ তৈজস নহেন; বহিঃপ্রজ্ঞ বিশ্ব নহেন;
জাগ্রৎও স্বপ্নের মধ্যবর্ত্তী জ্ঞানসম্পন্ন নহেন; প্রজ্ঞানঘন প্রাজ্ঞ নহেন; জ্ঞাতা
নহেন; অচেতন নহেন; পরন্তু চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের অবিষয়, ‘ইহা অমুক’ ইত্যাকার ব্যবহারের
অযোগ্য, কর্ম্মেন্দ্রিয়ের অগ্রাহ্য, অনুমানযোগ্য কোনরূপ চিহ্নরহিত, মানস-চিন্তার অবিষয়,
শব্দ দ্বারা নির্দ্দেশের অযোগ্য; কেবল ‘আত্মা’ ইত্যাকার প্রতীতিগম্য, জাগ্রদাদি প্রপঞ্চের
নিবৃত্তিস্থান, শান্ত (নির্বিকার); মঙ্গলময়, অদ্বৈত। তিনিই আত্মা; এবং তিনিই একমাত্র
জ্ঞাতব্য পদার্থ।।৭।।
ভগবান
শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন—
'নান্তঃপ্রজ্ঞ'
এইটি 'তৈজসের' প্রতিষেধ; 'ন বহিঃপ্রজ্ঞ' এইটি 'বিশ্বের প্রতিষেধ'; 'নোভয়তঃপ্রজ্ঞ'
এটা জাগ্রৎ ও স্বপ্ন, এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থার প্রতিষেধ ; ‘ন প্রজ্ঞানঘন' এটি সুষুপ্তাবস্থার
প্রতিষেধ; কারণ, উহার স্বরূপটি বীজভাবাপন্ন অবিবেকাত্মক; 'ন প্রজ্ঞ' এইটি এককালে সৰ্ববিষয়ক
জ্ঞানের প্রতিষেধ; আর 'ন অপ্রজ্ঞ' এইটি অচৈতন্যের প্রতিষেধ বুঝিতে হইবে।
প্রশ্ন
হইতেছে যে, অন্তঃপ্রজ্ঞত্বাদি ভাবগুলি যখন আত্মাতে প্রত্যক্ষ হইতেছে, তখন কেবল প্রতিষেধ-বলে
রজ্জু প্রভৃতিতে সর্পাদির ন্যায় তাদের অসত্তা বা মিথ্যাত্ব বুঝা যায় কিরূপে?
উত্তরে
বলা হইতেছে—বিশ্ব-তৈজসাদির স্বরূপগত চৈতন্যাংশে কিছুমাত্র বিশেষ বা পার্থক্য না থাকিলেও
ওদের একটির অবস্থিতিকালে যখন অপরটি থাকে না, তখন উহারা ইতরেতর-ব্যভিচারী অর্থাৎ প্রত্যেকেই
প্রত্যেককে ছাড়িয়া থাকে। এই কারণেই রজ্জুতে কল্পিত সর্প ও জলধারাদির ন্যায় উহারা
অসত্য – মিথ্যা; আর আত্মার জ্ঞাতৃভাবটি কোথাও ব্যভিচারী হয় না, সর্ব্বত্রই অনুস্যূত
থাকে সুতরাং উহা সত্য। যদি বল, সুষুপ্তিকালে আত্মারও তো জ্ঞাতৃভাব থাকে না : সুতরাং
উহাও ব্যভিচারী হতে পারে? না; সে সময়েও তাহার জ্ঞাতৃভাব অনুভবগোচর হইয়া থাকে; কারণ,
শ্রুতি বলিতেছেন যে, 'বিজ্ঞাতা আত্মার জ্ঞান কখনই বিলুপ্ত হয় না', আর এই কারণেই তুরীয়
অদৃশ্য (দর্শনের অযোগ্য)। যেহেতু অদৃশ্য, সেই হেতুই অব্যবহার্য্য, এবং কর্মেন্দ্রিয়ের
অগ্রাহ্য ( গ্রহণযোগ্য নয় )। অলক্ষণ অর্থ—জ্ঞানোপযোগী লিঙ্গরহিত, অর্থাৎ অনুমানের অবিষয়;
অচিন্তনীয় বলেই শব্দ দ্বারা নির্দেশের যোগ্য নয়। ‘একাত্ম-প্রত্যয়সার' অর্থ—জাগ্রৎ,
স্বপ্ন ও সুষুপ্তি, এই স্থানত্রয়ে অনুভূয়মান আত্মা এক—অভিন্ন ; এই প্রকার যে প্রতীতি,
তাহা দ্বারা তাহার অনুসরণ বা অনুসন্ধান করিতে হয়; অথবা, আত্ম-প্রত্যয় অর্থ—'আত্মা'
ইত্যাকার প্রতীতিই যার তুরীয়ের অনুভব-বিষয়ে একমাত্র প্রমাণ ; সেই তুরীয় পদার্থ
'একাত্ম-প্রত্যয়সার' পদবাচ্য; কেননা, ‘তাকে কেবল ‘আত্মা' বলিয়াই উপাসনা করিবে,' এইরূপ
শ্রুতি রয়েছে।
এ
পর্যন্ত, জাগ্রদাদি স্থানবর্ত্তী আত্মার অন্তঃপ্রজ্ঞত্বাদি ধর্মের (স্থানিধর্মের) প্রতিষেধ
কথিত হইয়াছে। এখন 'প্রপঞ্চোপশম’ ইত্যাদি কথায় আত্মাতে জাগ্রৎ-স্বপ্নাদি স্থানধর্ম্মেরও
অভাব (প্রতিষেধ) কথিত হইতেছে। যেহেতু প্রপঞ্চোপশম, অর্থাৎ জাগ্রদাদি সম্বন্ধশূন্য,
অতএব, শান্ত অর্থাৎ নির্বিকার ও শিব (মঙ্গলময়) ; (জ্ঞানিগণ) অদ্বৈত অর্থাৎ ভেদ-কল্পনারহিত
চতুর্থ—তুরীয় বলিয়া মনে করেন; কেননা, পূর্ব্বোক্ত পাদত্রয়ের যা স্বরূপ, এই চতুর্থ
তাহা হইতে বিলক্ষণ বা বিভিন্নপ্রকার। সেই তুরীয়ই প্রকৃত আত্মা, এবং তাহাই বিশেষরূপে
জ্ঞেয়। রজ্জু যেমন প্রতীয়মান সর্প, দণ্ড ও ভূ-রেখা প্রভৃতি হইতে পৃথক্, তেমনি 'তুমি
তৎস্বরূপ' ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য-প্রতিপাদ্য যে আত্মা – কেবলই 'দ্রষ্টা, কিন্তু দৃষ্টির
বিষয় নহে,' এবং ‘দ্রষ্টার দৃষ্টির কখনই বিলোপ হয় না' ইত্যাদি বাক্যে বর্ণিত হইয়াছে;
তাহাকেই জ্ঞাতব্য বলিয়া উপদেশ করা হইয়াছে। 'জানিতে হইবে' এই কথাটি 'ভূতপূর্ব্ব-গতি'
নিয়মানুসারে কথিত হইয়াছে। কেননা, জ্ঞানের পর আর দ্বৈত-প্রপঞ্চ থাকে না বা থাকিতে পারে
না; সুতরাং তখন আর কিছুই বিজ্ঞেয় থাকিতে পারে না।
শ্রুতি
আরো বলিতেছেন—
অমাত্রশ্চতুর্থোঽব্যবহার্যঃ প্রপঞ্চোপশমঃ শিবোঽদ্বৈত
এবমোঙ্কার আত্মৈব সংবিশত্যাত্মনাঽঽত্মানং য এবং বেদ .. ১২..
শঙ্করাচার্য
ভাষ্যে বলিতেছেন— "অমাত্র অর্থ—যাহার মাত্রা নাই; সেই অমাত্র নির্ব্বিশেষ ওঙ্কার
তুরীয় আত্মস্বরূপই বটে; অভিধান (বাচক) শব্দ ও অভিধেয় (তদবাচ্য) মন, এতদুভয়ই ক্ষয়প্রাপ্ত
হওয়ায় অব্যবহার্য; প্রপঞ্চোপশম (জগতসম্বন্ধরহিত), শিব ও অদ্বৈতভাবসম্পন্ন, কথিতানুরূপ
জ্ঞানসম্পন্ন পুরুষপ্রযুক্ত, এই ত্রিমাত্র অর্থাৎ পাদত্রয়যুক্ত ওঙ্কার আত্মস্বরূপই
বটে। যিনি এইরূপ জানেন, তিনি স্বয়ংই স্বীয় পারমার্থিক আত্মস্বরূপে প্রবেশ করেন, অর্থাৎ
উক্ত ব্রহ্মবিৎ পুরুষ পরমার্থ-দর্শনের বলে তৃতীয় বীজভাব দগ্ধ করিয়া আত্মাতে প্রবিষ্ট
হন; এই কারণে আর পুনর্জ্জন্ম লাভ করেন না; কেননা, তুরীয়ে কোনরূপ জন্মাদিবীজ নিহিত
নাই। কারণ, রজ্জু ও সর্পের বিবেক-জ্ঞান উপস্থিত হইলে, কল্পিত সর্পটি রজ্জুতে প্রবিষ্ট
হইয়া (বিলীন হইয়া) পূর্ব্বসংস্কারবশতঃ কখনই বিবেকিগণের নিকট পুনর্ব্বার প্রাদুর্ভূত
হয় না।"