Saturday, 22 October 2022

তুরীয়ব্রহ্ম

 


অদ্য আলোচ্য বিষয় তৈজসাদি পাদত্রয়াতীত তুরীয় ব্রহ্মস্বরূপ কথন। 'নেতি নেতি' শ্রুতির মত মাণ্ডুক্য শ্রুতিও নিষেধমুখেই তুরীয় ব্রহ্মের স্বরূপ নিরূপণ করিয়াছেন। অথর্ববেদীয়া মাণ্ডুক্য উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে—

নান্তঃপ্রজ্ঞং ন বহিষ্প্রজ্ঞং নোভযতঃপ্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন প্রজ্ঞং নাপ্রজ্ঞম্ । অদৃষ্টমব্যবহার্যমগ্রাহ্যমলক্ষণং অচিন্ত্যমব্যপদেশ্যমেকাত্মপ্রত্যযসারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেযঃ ..৭..

বিবেকিগণ চতুর্থকে (তুরীয়কে) মনে করেন যে, তিনি অন্তঃপ্রজ্ঞ তৈজস নহেন; বহিঃপ্রজ্ঞ বিশ্ব নহেন; জাগ্রৎও স্বপ্নের মধ্যবর্ত্তী জ্ঞানসম্পন্ন নহেন; প্রজ্ঞানঘন প্রাজ্ঞ নহেন; জ্ঞাতা নহেন; অচেতন নহেন; পরন্তু চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের অবিষয়, ‘ইহা অমুক’ ইত্যাকার ব্যবহারের অযোগ্য, কর্ম্মেন্দ্রিয়ের অগ্রাহ্য, অনুমানযোগ্য কোনরূপ চিহ্নরহিত, মানস-চিন্তার অবিষয়, শব্দ দ্বারা নির্দ্দেশের অযোগ্য; কেবল ‘আত্মা’ ইত্যাকার প্রতীতিগম্য, জাগ্রদাদি প্রপঞ্চের নিবৃত্তিস্থান, শান্ত (নির্বিকার); মঙ্গলময়, অদ্বৈত। তিনিই আত্মা; এবং তিনিই একমাত্র জ্ঞাতব্য পদার্থ।।৭।।

ভগবান শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন—

'নান্তঃপ্রজ্ঞ' এইটি 'তৈজসের' প্রতিষেধ; 'ন বহিঃপ্রজ্ঞ' এইটি 'বিশ্বের প্রতিষেধ'; 'নোভয়তঃপ্রজ্ঞ' এটা জাগ্রৎ ও স্বপ্ন, এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থার প্রতিষেধ ; ‘ন প্রজ্ঞানঘন' এটি সুষুপ্তাবস্থার প্রতিষেধ; কারণ, উহার স্বরূপটি বীজভাবাপন্ন অবিবেকাত্মক; 'ন প্রজ্ঞ' এইটি এককালে সৰ্ববিষয়ক জ্ঞানের প্রতিষেধ; আর 'ন অপ্রজ্ঞ' এইটি অচৈতন্যের প্রতিষেধ বুঝিতে হইবে।

প্রশ্ন হইতেছে যে, অন্তঃপ্রজ্ঞত্বাদি ভাবগুলি যখন আত্মাতে প্রত্যক্ষ হইতেছে, তখন কেবল প্রতিষেধ-বলে রজ্জু প্রভৃতিতে সর্পাদির ন্যায় তাদের অসত্তা বা মিথ্যাত্ব বুঝা যায় কিরূপে?

উত্তরে বলা হইতেছে—বিশ্ব-তৈজসাদির স্বরূপগত চৈতন্যাংশে কিছুমাত্র বিশেষ বা পার্থক্য না থাকিলেও ওদের একটির অবস্থিতিকালে যখন অপরটি থাকে না, তখন উহারা ইতরেতর-ব্যভিচারী অর্থাৎ প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ছাড়িয়া থাকে। এই কারণেই রজ্জুতে কল্পিত সর্প ও জলধারাদির ন্যায় উহারা অসত্য – মিথ্যা; আর আত্মার জ্ঞাতৃভাবটি কোথাও ব্যভিচারী হয় না, সর্ব্বত্রই অনুস্যূত থাকে সুতরাং উহা সত্য। যদি বল, সুষুপ্তিকালে আত্মারও তো জ্ঞাতৃভাব থাকে না : সুতরাং উহাও ব্যভিচারী হতে পারে? না; সে সময়েও তাহার জ্ঞাতৃভাব অনুভবগোচর হইয়া থাকে; কারণ, শ্রুতি বলিতেছেন যে, 'বিজ্ঞাতা আত্মার জ্ঞান কখনই বিলুপ্ত হয় না', আর এই কারণেই তুরীয় অদৃশ্য (দর্শনের অযোগ্য)। যেহেতু অদৃশ্য, সেই হেতুই অব্যবহার্য্য, এবং কর্মেন্দ্রিয়ের অগ্রাহ্য ( গ্রহণযোগ্য নয় )। অলক্ষণ অর্থ—জ্ঞানোপযোগী লিঙ্গরহিত, অর্থাৎ অনুমানের অবিষয়; অচিন্তনীয় বলেই শব্দ দ্বারা নির্দেশের যোগ্য নয়। ‘একাত্ম-প্রত্যয়সার' অর্থ—জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি, এই স্থানত্রয়ে অনুভূয়মান আত্মা এক—অভিন্ন ; এই প্রকার যে প্রতীতি, তাহা দ্বারা তাহার অনুসরণ বা অনুসন্ধান করিতে হয়; অথবা, আত্ম-প্রত্যয় অর্থ—'আত্মা' ইত্যাকার প্রতীতিই যার তুরীয়ের অনুভব-বিষয়ে একমাত্র প্রমাণ ; সেই তুরীয় পদার্থ 'একাত্ম-প্রত্যয়সার' পদবাচ্য; কেননা, ‘তাকে কেবল ‘আত্মা' বলিয়াই উপাসনা করিবে,' এইরূপ শ্রুতি রয়েছে।

এ পর্যন্ত, জাগ্রদাদি স্থানবর্ত্তী আত্মার অন্তঃপ্রজ্ঞত্বাদি ধর্মের (স্থানিধর্মের) প্রতিষেধ কথিত হইয়াছে। এখন 'প্রপঞ্চোপশম’ ইত্যাদি কথায় আত্মাতে জাগ্রৎ-স্বপ্নাদি স্থানধর্ম্মেরও অভাব (প্রতিষেধ) কথিত হইতেছে। যেহেতু প্রপঞ্চোপশম, অর্থাৎ জাগ্রদাদি সম্বন্ধশূন্য, অতএব, শান্ত অর্থাৎ নির্বিকার ও শিব (মঙ্গলময়) ; (জ্ঞানিগণ) অদ্বৈত অর্থাৎ ভেদ-কল্পনারহিত চতুর্থ—তুরীয় বলিয়া মনে করেন; কেননা, পূর্ব্বোক্ত পাদত্রয়ের যা স্বরূপ, এই চতুর্থ তাহা হইতে বিলক্ষণ বা বিভিন্নপ্রকার। সেই তুরীয়ই প্রকৃত আত্মা, এবং তাহাই বিশেষরূপে জ্ঞেয়। রজ্জু যেমন প্রতীয়মান সর্প, দণ্ড ও ভূ-রেখা প্রভৃতি হইতে পৃথক্, তেমনি 'তুমি তৎস্বরূপ' ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য-প্রতিপাদ্য যে আত্মা – কেবলই 'দ্রষ্টা, কিন্তু দৃষ্টির বিষয় নহে,' এবং ‘দ্রষ্টার দৃষ্টির কখনই বিলোপ হয় না' ইত্যাদি বাক্যে বর্ণিত হইয়াছে; তাহাকেই জ্ঞাতব্য বলিয়া উপদেশ করা হইয়াছে। 'জানিতে হইবে' এই কথাটি 'ভূতপূর্ব্ব-গতি' নিয়মানুসারে কথিত হইয়াছে। কেননা, জ্ঞানের পর আর দ্বৈত-প্রপঞ্চ থাকে না বা থাকিতে পারে না; সুতরাং তখন আর কিছুই বিজ্ঞেয় থাকিতে পারে না।

শ্রুতি আরো বলিতেছেন—

অমাত্রশ্চতুর্থোঽব্যবহার্যঃ প্রপঞ্চোপশমঃ শিবোঽদ্বৈত

এবমোঙ্কার আত্মৈব সংবিশত্যাত্মনাঽঽত্মানং য এবং বেদ .. ১২..

শঙ্করাচার্য ভাষ্যে বলিতেছেন— "অমাত্র অর্থ—যাহার মাত্রা নাই; সেই অমাত্র নির্ব্বিশেষ ওঙ্কার তুরীয় আত্মস্বরূপই বটে; অভিধান (বাচক) শব্দ ও অভিধেয় (তদবাচ্য) মন, এতদুভয়ই ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় অব্যবহার্য; প্রপঞ্চোপশম (জগতসম্বন্ধরহিত), শিব ও অদ্বৈতভাবসম্পন্ন, কথিতানুরূপ জ্ঞানসম্পন্ন পুরুষপ্রযুক্ত, এই ত্রিমাত্র অর্থাৎ পাদত্রয়যুক্ত ওঙ্কার আত্মস্বরূপই বটে। যিনি এইরূপ জানেন, তিনি স্বয়ংই স্বীয় পারমার্থিক আত্মস্বরূপে প্রবেশ করেন, অর্থাৎ উক্ত ব্রহ্মবিৎ পুরুষ পরমার্থ-দর্শনের বলে তৃতীয় বীজভাব দগ্ধ করিয়া আত্মাতে প্রবিষ্ট হন; এই কারণে আর পুনর্জ্জন্ম লাভ করেন না; কেননা, তুরীয়ে কোনরূপ জন্মাদিবীজ নিহিত নাই। কারণ, রজ্জু ও সর্পের বিবেক-জ্ঞান উপস্থিত হইলে, কল্পিত সর্পটি রজ্জুতে প্রবিষ্ট হইয়া (বিলীন হইয়া) পূর্ব্বসংস্কারবশতঃ কখনই বিবেকিগণের নিকট পুনর্ব্বার প্রাদুর্ভূত হয় না।"

Sunday, 9 October 2022

নির্গুণ, নির্বিশেষ ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ হইবেন কিরূপে? আর ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ হইলে তিনি নির্গুণ ও নির্বিশেষ রহিবেন কিরূপে?

 

সর্বপ্রপঞ্চাতীত নির্বিশেষ ব্রহ্মকে বিধিমুখে অর্থাৎ 'তিনি এইরূপ' এইভাবে প্রকাশ করা যায় না, নিষেধমুখে অর্থাৎ 'অথাত আদেশ নেতি নেতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।৬) 'অথ (-সত্যের অর্থাৎ প্রপঞ্চের বর্ণনার অনন্তর) অতঃ (-যাহা সত্যেরও সত্য, তাহার বর্ণনা অবশিষ্ট থাকায়) নেতি নেতি অর্থাৎ 'ইহা নহে', 'ইহা নহে', এইরূপ সত্যের সত্য ব্রহ্মের আদেশ নির্দ্দেশ করা হইতেছে; এই নির্দ্দেশবাক্য হইতে ভিন্ন ব্রহ্মের শ্রেষ্ঠ নির্দ্দেশ অবশ্যই নাই', এইভাবেই তাহাকে জানিতে পারা যায়। 

ব্রহ্ম নির্বিশেষ বলেই তো শ্রুতি কেবল "নেতি নেতি" দ্বারা অর্থাৎ "ইহা ব্রহ্ম নহে", "উহা ব্রহ্ম নহে", এইরূপে নিষেধমুখে নির্বিশেষ ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন ; ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাইবার জন্য নিষেধসূচক 'ন'-এর অসংখ্য প্রয়োগ করিয়াছেন। ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ হলে বিধিমুখেই তো শ্রুতি ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাইতে পারিতেন? শ্রুতি তাহা করেন নাই কেন? এর উত্তরে নির্বিশেষ ব্রহ্মবাদী অদ্বৈত বেদান্তী বলেন যে, ব্রহ্মের সদ্‌ভাব, চিদ্ভাব ও আনন্দভাব ব্যাখ্যা করায় আপাতদৃষ্টিতে ব্রহ্মকে সগুণ, সবিশেষ বলিয়া মনে হইলেও ব্রহ্ম সেরূপ নহেন। সৎ, চিৎ, আনন্দ এই পদত্রয় বস্তুতঃ 'নেতি'রই প্রতিরূপ, অভাবের সূচক মাত্র। সৎ শব্দের অর্থ মিথ্যা নহে, চিৎ শব্দের অর্থ জড় নহে, আনন্দ শব্দের অর্থ দুঃখরূপ নহে। পরব্রহ্মকে সৎ বলিলে বুঝায় যে, জগৎ যেমন ভঙ্গুর ও মিথ্যা, সেইরূপ মিথ্যা নহে। চিদ্ বলিলে বুঝায়, জড়বস্তু যেমন অপ্রকাশ এবং তমঃস্বভাব, ব্রহ্মবস্তু সেরূপ নহে, ব্রহ্ম স্বয়ংজ্যোতিঃ এবং স্বপ্রকাশ; আনন্দ বলিলে বুঝায় যে, ব্রহ্ম সুখস্বরূপ, দুঃখস্বরূপ নহে। এইরূপে সৎ, চিৎ, আনন্দ এই তিনটি পদ অভাব পরিচয়েই ব্রহ্মের স্বরূপ প্রতিপাদন করে; এবং ব্রহ্ম যে অন্য সকল জাগতিক পদার্থ হইতে বিলক্ষণ তাহা বুঝাইয়া দেয়। এই অভাবও এখানে একটি অতিরিক্ত পদার্থ বা বিশেষ ধর্ম নহে, ইহা সচ্চিদানন্দেরই স্বরূপব্যাখ্যামাত্র। যেমন সাদা বলিলে স্বভাবতঃই বুঝায় যে কালা নহে, এই কৃষ্ণতার অভাব যেমন শুক্লতারই স্বরূপ, কোন অতিরিক্ত বস্তু নহে, সেইরূপ ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ বলিলে স্বভাবতঃ ব্রহ্ম মিথ্যা, ও দুঃখ স্বভাব নহে, ইহাই বুঝা যায়। সৎ, চিৎ, আনন্দ এই পদত্রয় যথাক্রমে ব্রহ্মে মিথ্যাত্ব, জড়তা ও দুঃখস্বরূপের অভাব সাধন করে বলিয়া সার্থকও বটে। বাস্তবিক পক্ষে ব্রহ্ম সৎও নহে, অসৎও নহে, জড়ও নহে, অজড়ও নহে, আনন্দও নহে, নিরানন্দও নহে। ইহা সদসতের অতীত, জ্ঞান ও অজ্ঞানের অতীত, ব্রহ্ম বিজ্ঞান। ব্রহ্ম অজ্ঞেয় হইলেও অজ্ঞাত তত্ত্ব নহে, জ্ঞানবিজ্ঞানের উপরিতনবর্তী 'প্রজ্ঞানের' সাহায্যে ব্ৰহ্মকে জানা যায় সাধারণ জ্ঞানের তিনি অগম্য হইলেও যোগদৃষ্টির সাহায্যে তাঁহাকে দেখা যায়। যোগদৃষ্টিকে লক্ষ্য করেই উপনিষদ্ বলেন যে, অধ্যাত্মবোধ অধিগত হইলে সেই দেবকে জানিয়া ধীরব্যক্তি সাংসারিক সুখদুঃখ অতিক্রম করেন।

তথ্যসূত্রঃ- "বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।

ব্রহ্মের প্রাজ্ঞ-সংজ্ঞক তৃতীয় পাদঃ-

 


আজকের আলোচ্য বিষয় ব্রহ্মের প্রাজ্ঞ-সংজ্ঞক তৃতীয় পাদ নিরূপণ এবং তাহারই সর্ব্বান্তর্য্যামিত্ব ও সর্ব্বকারণত্ব কথন। অথর্ববেদীয়া মাণ্ডুক্য উপনিষদে বর্ণিত আছে—

সুষুপ্ত পুরুষ যে স্থানে বা অবস্থায় কোনরূপ ভোগ্য বিষয় প্রার্থনা করে না; কোনরূপ স্বপ্ন দর্শন করে না; তাহাই ‘সুষুপ্ত’। এই সুষুপ্ত যাহার স্থান, (বাহ্য ও আন্তর সর্ব্বপ্রকার বিষয় বিজ্ঞান না থাকায়) যিনি একীভাবপ্রাপ্ত, যিনি কেবলই প্রকৃষ্ট জ্ঞানমূর্ত্তি, প্রচুর আনন্দপূর্ণ ও আত্মানন্দভোজী এবং স্বীয় বোধশক্তি যাঁহার মুখস্বরূপ, সেই প্রাজ্ঞ আত্মা ইহার তৃতীয় পাদ। শ্রুতি আরো বলিতেছেন—"এষ সর্বেশ্বরঃ এষ সর্বজ্ঞ এষোঽন্তর্যাম্যেষ যোনিঃ সর্বস্য প্রভবাপ্যযৌ হি ভূতানাম্"  অর্থাৎ 'ইনি (প্রাজ্ঞ) সকলের ঈশ্বর, ইনি সর্ব্বজ্ঞ, ইনি অন্তর্যামী (যিনি অভ্যন্তরে থাকিয়া সকলকে নিয়মিত করেন), এবং যেহেতু ইনিই সমস্ত ভূতের উৎপত্তি ও বিলয় স্থান, অতএব ইনিই সর্ব্ব জগতের কারণ।'

ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন—"উপাধির প্রাধান্য বিলুপ্ত হইয়া যখন কেবল চৈতন্যেরই  প্রাধান্য হয়, তাহাই স্বরূপাবস্থা, সেই অবস্থাপন্ন এই প্রাজ্ঞই সর্ব্বেশ্বর, অর্থাৎ আধিদৈবিকের সহিত সমস্ত কার্য্যজগতের ঈশ্বর—ঈশিতা অর্থাৎ শাসনকর্ত্তা। ঈশ্বর পদার্থটি অপরাপরের ন্যায় ইহা হইতে পৃথক পদার্থ নহে (তৎস্বরূপই বটে)। 'হে সোম্য, প্রাণশব্দাভিহিত ব্রহ্মই মনের অর্থাৎ মন-উপাধিক আত্মার বন্ধন বা পর্য্যবসান-স্থান।' এই শ্রুতিও এই অর্থের গ্রাহক। সর্ব্বপ্রকার বিভাগাপন্ন এই প্রাজ্ঞই সকলের জ্ঞাতা; এই কারণে সর্ব্বজ্ঞ; ইনিই অন্তর্যামী, অর্থাৎ ইনিই সর্ব্বভূতের অন্তরে প্রবেশপূর্ব্বক নিয়মনকারীও বটে;  এবং যেহেতু ইনিই সমস্ত ভূতের উৎপত্তি ও বিলয়স্থান; অতএব, ইনিই বিভিন্ন প্রকার জগৎ প্রসব করেন;  সেইজন্য সমস্ত জগতের যোনি বা উৎপত্তি-স্থানও ইনিই।"

Saturday, 1 October 2022

জীবন্মুক্ত কে?

 


ভগবান্ দত্তাত্রেয় জীবন্মুক্তি গীতায় বলেছেন

জীবঃ শিবঃ সর্বমেব ভূতেষ্বেবং ভূতে ভূতে ব্যবস্থিতঃ।এবমেবাভিপশ্যন্ হি এবমেব পশ্যতি যো জীবন্মুক্তঃ স উচ্যতে। এবং ব্রহ্ম জগত্সর্বমখিলং ভাসতে রবিঃ। সংস্থিতং সর্বভূতানাং জীবন্মুক্তঃ স উচ্যতে। একধা বহুধা চৈব দৃশ্যতে জলচন্দ্রবৎ। আত্মজ্ঞানী তথৈবৈকো জীবন্মুক্তঃ স উচ্যতে। সর্বভূতে স্থিতং ব্রহ্ম ভেদাভেদো ন বিদ্যতে। একমেবাভিপশ্যংশ্চ পশ্যতি জীবন্মুক্তঃ স উচ্যতে। ২-৫

অর্থাৎ এই যে জীব, ইনিই শিব। ইনি সর্বভূতে বিরাজমান। ইনি সর্বব্যাপী। এই জীবনে এই জীবকে যিনি এইভাবে দেখতে পেরেছেন, তিনিই জীবন্মুক্ত। অর্থাৎ গগনে রবির উদয়ে বিশ্বচরাচর প্রকাশিত হয়। সেইভাবেই চৈতন্যস্বরূপ পরমাত্মা পরব্রহ্ম জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যে বিরাজ করে ব্রহ্মাণ্ডকে প্রকাশ করছেন। এইরকম জ্ঞানলাভ করে যিনি জ্ঞানী হতে পেরেছেন তাঁকেই বলা যায় জীবন্মুক্ত। অর্থাৎ আকাশের বুকে একটি মাত্র চাঁদ স্নিগ্ধ কিরণ নিয়ে ভাসমান। স্রোতের মালা নিয়ে জলে সেই এক চাঁদকে অনেক, অনেক রূপে দেখা যায়। সেই রকম এক পরমাত্মা প্রতিটি জীবের বুদ্ধিতে এক-একভাবে প্রকাশিত। এইরকম আত্মজ্ঞানীই জীবন্মুক্ত বলে অভিহিত হন। অর্থাৎ সমুদয় জীবের অন্তঃকরণেই সেই এক ব্রহ্ম বিরাজ করছেন। স্থাবর-জঙ্গম ভেদে জীবদেহ পৃথক পৃথক হলেও, তিনিই সেই এক। তার মধ্যে ভেদও নেই, অভেদও নেই। এইরকম জ্ঞানে যিনি জ্ঞানী হতে পেরেছেন, তিনিই জীবন্মুক্ত।..........

কেবল প্রারব্ধবশেই জীবন্মুক্তের ব্যবহার সম্পাদিত হয়ে থাকেঃ-

 


অষ্টাবক্র মুনি অষ্টাবক্র-গীতার শান্তিশতকম্ প্রকরণে বলছেন—

কৃত্যং কিমপি নৈবাস্তি ন কাপি হৃদিরঞ্জনা।

যথা জীবনমেবেহ জীবন্মুক্তস্য যোগিনঃ।।১৩।।

অনুবাদঃ- জীবন্মুক্ত জ্ঞানীর সঙ্কল্পবশে কিছুই করার নেই। তাঁর মনেও কোন বিষয়ের প্রতি বিন্দুমাত্রও অনুরাগ হয় না। কারণ আসক্তির হেতু অবিদ্যা তাঁর বিনষ্ট হয়ে গেছে। তথাপি জীবনহেতু অদৃষ্ট অর্থাৎ প্রারব্ধ অনুসারেই তাঁর সর্ব কর্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে।

সংসারদৃশ্য দর্শন করলেও অহংকাররাহিত্যবশতঃ জীবন্মুক্তের সদা ব্রাহ্মীস্থিতি অব্যাহত থাকে। অষ্টাবক্র মুনি অষ্টাবক্র-গীতার শান্তিশতকম্ প্রকরণে বলছেন

"যস্যান্তঃ স্যাদহঙ্কারো ন করোতি করোতি সঃ।

নিরহঙ্কার ধীরেণ ন কিঞ্চিদকৃতং কৃতম্।।২৯

অর্থাৎ অন্তঃকরণে অহংকারাধ্যাসবিশিষ্ট পুরুষ বাহ্য দৃষ্টিতে কিছু না করলেও কর্তৃত্বাভিমানবশতঃ সঙ্কল্পাদি করে থাকে। কর্তৃত্বাধ্যাস-বিরহিত জ্ঞানী লোকদৃষ্টিতে কর্ম করেও স্বদৃষ্টিতে বস্তুতঃ তিনি কিছুই করেন না।

পুনশ্চ সেই সুমতি কে, যিনি সম্যকদর্শন করেন? তদুত্তরে শ্রীভগবান্ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলছেন"যস্য নাহংকৃতো ভাবো বুদ্ধির্যস্য ন লিপ্যতে৷"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮/১৭) অর্থাৎ 'যাঁর অহংকৃত অর্থাৎ 'আমি কর্তা' এরূপ ভাব নেই তাঁর বুদ্ধি লিপ্ত হয় না।' ভগবান শঙ্করাচার্য এই শ্লোকের ভাষ্যে বলছেন

শাস্ত্র এবং আচার্যের উপদেশ ও ন্যায়ের দ্বারা সংস্কৃত আত্মার  অহংকৃত অর্থাৎ "আমি কর্তা" এইরূপ ভাব অর্থাৎ ভাবনা বা প্রত্যয় হয় না। "অধিষ্ঠানাদি পাঁচটি অবিদ্যাদ্বারা আত্মাতে কল্পিত, সর্বকর্মের কর্তা আমি নই, আমি সেই সকল ব্যাপারের সাক্ষী মাত্র, "অপ্রাণো হ্যমনাঃ শুভ্রো হ্যক্ষরাত্পরতঃ পরঃ"-(মুণ্ডক উপনিষৎ- ২৷১৷২) 'অপ্রাণ (প্রাণরহিত) অমন (মনরহিত), শুভ্র (শুদ্ধ), কূটস্থ অক্ষর হতেও পর অর্থাৎ পুরুষোত্তম', কেবল এবং অবিক্রিয়", যিনি এইরূপ দর্শন করেন;—এইরূপ অর্থ।

আত্মার উপাধিস্বরূপ বুদ্ধি অর্থাৎ অন্তঃকরণ যাঁর লিপ্ত হয় না অর্থাৎ "আমি এই কাজ করেছি তার জন্য আমি নরকে যাব"—এইরূপ বুদ্ধিকৃত কর্মে অনুতাপ করেন নাএইরূপ যাঁর বুদ্ধি লিপ্ত হয় না, তিনিই সুমতি, তিনিই যথার্থদর্শী।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...