Sunday, 9 October 2022

নির্গুণ, নির্বিশেষ ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ হইবেন কিরূপে? আর ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ হইলে তিনি নির্গুণ ও নির্বিশেষ রহিবেন কিরূপে?

 

সর্বপ্রপঞ্চাতীত নির্বিশেষ ব্রহ্মকে বিধিমুখে অর্থাৎ 'তিনি এইরূপ' এইভাবে প্রকাশ করা যায় না, নিষেধমুখে অর্থাৎ 'অথাত আদেশ নেতি নেতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।৬) 'অথ (-সত্যের অর্থাৎ প্রপঞ্চের বর্ণনার অনন্তর) অতঃ (-যাহা সত্যেরও সত্য, তাহার বর্ণনা অবশিষ্ট থাকায়) নেতি নেতি অর্থাৎ 'ইহা নহে', 'ইহা নহে', এইরূপ সত্যের সত্য ব্রহ্মের আদেশ নির্দ্দেশ করা হইতেছে; এই নির্দ্দেশবাক্য হইতে ভিন্ন ব্রহ্মের শ্রেষ্ঠ নির্দ্দেশ অবশ্যই নাই', এইভাবেই তাহাকে জানিতে পারা যায়। 

ব্রহ্ম নির্বিশেষ বলেই তো শ্রুতি কেবল "নেতি নেতি" দ্বারা অর্থাৎ "ইহা ব্রহ্ম নহে", "উহা ব্রহ্ম নহে", এইরূপে নিষেধমুখে নির্বিশেষ ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন ; ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাইবার জন্য নিষেধসূচক 'ন'-এর অসংখ্য প্রয়োগ করিয়াছেন। ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ হলে বিধিমুখেই তো শ্রুতি ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাইতে পারিতেন? শ্রুতি তাহা করেন নাই কেন? এর উত্তরে নির্বিশেষ ব্রহ্মবাদী অদ্বৈত বেদান্তী বলেন যে, ব্রহ্মের সদ্‌ভাব, চিদ্ভাব ও আনন্দভাব ব্যাখ্যা করায় আপাতদৃষ্টিতে ব্রহ্মকে সগুণ, সবিশেষ বলিয়া মনে হইলেও ব্রহ্ম সেরূপ নহেন। সৎ, চিৎ, আনন্দ এই পদত্রয় বস্তুতঃ 'নেতি'রই প্রতিরূপ, অভাবের সূচক মাত্র। সৎ শব্দের অর্থ মিথ্যা নহে, চিৎ শব্দের অর্থ জড় নহে, আনন্দ শব্দের অর্থ দুঃখরূপ নহে। পরব্রহ্মকে সৎ বলিলে বুঝায় যে, জগৎ যেমন ভঙ্গুর ও মিথ্যা, সেইরূপ মিথ্যা নহে। চিদ্ বলিলে বুঝায়, জড়বস্তু যেমন অপ্রকাশ এবং তমঃস্বভাব, ব্রহ্মবস্তু সেরূপ নহে, ব্রহ্ম স্বয়ংজ্যোতিঃ এবং স্বপ্রকাশ; আনন্দ বলিলে বুঝায় যে, ব্রহ্ম সুখস্বরূপ, দুঃখস্বরূপ নহে। এইরূপে সৎ, চিৎ, আনন্দ এই তিনটি পদ অভাব পরিচয়েই ব্রহ্মের স্বরূপ প্রতিপাদন করে; এবং ব্রহ্ম যে অন্য সকল জাগতিক পদার্থ হইতে বিলক্ষণ তাহা বুঝাইয়া দেয়। এই অভাবও এখানে একটি অতিরিক্ত পদার্থ বা বিশেষ ধর্ম নহে, ইহা সচ্চিদানন্দেরই স্বরূপব্যাখ্যামাত্র। যেমন সাদা বলিলে স্বভাবতঃই বুঝায় যে কালা নহে, এই কৃষ্ণতার অভাব যেমন শুক্লতারই স্বরূপ, কোন অতিরিক্ত বস্তু নহে, সেইরূপ ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ বলিলে স্বভাবতঃ ব্রহ্ম মিথ্যা, ও দুঃখ স্বভাব নহে, ইহাই বুঝা যায়। সৎ, চিৎ, আনন্দ এই পদত্রয় যথাক্রমে ব্রহ্মে মিথ্যাত্ব, জড়তা ও দুঃখস্বরূপের অভাব সাধন করে বলিয়া সার্থকও বটে। বাস্তবিক পক্ষে ব্রহ্ম সৎও নহে, অসৎও নহে, জড়ও নহে, অজড়ও নহে, আনন্দও নহে, নিরানন্দও নহে। ইহা সদসতের অতীত, জ্ঞান ও অজ্ঞানের অতীত, ব্রহ্ম বিজ্ঞান। ব্রহ্ম অজ্ঞেয় হইলেও অজ্ঞাত তত্ত্ব নহে, জ্ঞানবিজ্ঞানের উপরিতনবর্তী 'প্রজ্ঞানের' সাহায্যে ব্ৰহ্মকে জানা যায় সাধারণ জ্ঞানের তিনি অগম্য হইলেও যোগদৃষ্টির সাহায্যে তাঁহাকে দেখা যায়। যোগদৃষ্টিকে লক্ষ্য করেই উপনিষদ্ বলেন যে, অধ্যাত্মবোধ অধিগত হইলে সেই দেবকে জানিয়া ধীরব্যক্তি সাংসারিক সুখদুঃখ অতিক্রম করেন।

তথ্যসূত্রঃ- "বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...