Monday, 20 November 2023

অদ্বৈতবেদান্তে জগৎ মিথ্যা ঠিক কোন অর্থে?

 


আমরা এই জগৎটাকে সর্বদা আমাদের ইন্দ্রিয়-পথে বিস্তারিত দেখতে পাই। অসংখ্য নাম-রূপাত্মক বিকার নিয়েই এই জগৎ। এই বিকারগুলোকে আমরা দেশে কালে অভিব্যক্ত দেখতে পাই। বিকার-গুলো সর্বদা পূর্ববর্তী একটা অবস্থা ত্যাগ করে পরবর্তী অপর একটা অবস্থান্তর গ্রহণ করছে, দেখতে পাই। এরূপে এরা পরস্পর কার্য-কারণ-সূত্রে আবদ্ধ হয়ে ক্রিয়া করে। সুতরাং আমরা এই নাম-রূপাত্মক জগৎকে স্বাধীন স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু বলেই বিবেচনা করি।

কিন্তু এই জগৎ যখন দেশে কালে অভিব্যক্ত, তখন এটা অবশ্যই এমন একটা বস্তুর বিকাশ, যে বস্তুটি দেশ কালের অতীত। জগৎটা যখন আমাদের সামনে অভিব্যক্ত দেখছি, তখন এটা অবশ্যই কোন বস্তু হতেই অভিব্যক্ত হয়েছে। এটা 'শূন্য' হতে আসে নি।এই প্রকাণ্ড কথাটা আমরা একেবারে ভুলে যাই। কথাটা ভুলে গিয়ে আমরা জগৎটাকে একটা স্বতন্ত্র বস্তু, স্বাধীন বস্তু, স্বতঃসিদ্ধ বস্তু বলেই গ্রহণ করি।

ভগবান শঙ্করাচার্য আমাদের বলে গেছেন যে জগৎকে যদি এরূপ স্বাধীন, স্বতন্ত্র স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু বলে গ্রহণ কর, তাহলে তুমি প্রকাণ্ড ভুল করলে। এপ্রকার স্বাধীন জগৎ 'অসত্য', 'মিথ্যা' এই জগৎ ব্রহ্ম হতে অভিব্যক্ত। ব্রহ্মই এই জগতের কারণ। যিনি দেশ-কালাতীত, এই জগৎ তাঁরই দেশ-কালে বিকাশ। এই জগৎ তাঁরই স্বরূপের অভিব্যক্তি; সুতরাং এই জগৎ ব্রহ্ম হতে স্বতন্ত্র হয়ে, তাঁকে ছেড়ে স্বাধীন-ভাবে থাকতে পারে না। অর্থাৎ শঙ্করাচার্য এই জগৎকে স্বাধীন, স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু বলে গ্রহণ করতে পারেন নি। এই জগৎ যাঁর অভিব্যক্তি, তাঁ হতে এই জগৎকে 'স্বতন্ত্র' বলা যায় না। "মরুভূমি হতে স্বতন্ত্র করে নিয়ে কি মরিচিকাকে ভাবতে পারা যায়?

যিনি দেশ-কালাতীত ব্রহ্ম, এই জগৎ তাঁর কার্য। ভগবান শঙ্করাচার্য এই কারণ কার্যের সম্বন্ধকে "অনন্য" শব্দে নির্দেশ করেছেন। জগৎ যখন ব্রহ্ম হতে 'স্বতন্ত্র' বা 'অন্য' কোন স্বাধীন স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু হতে পারছে না, এজন্য এই জগৎব্রহ্ম হতে 'অনন্য' জগৎকে ব্রহ্ম হতে স্বতন্ত্র করে নিলে তা মিথ্যা হল। এরূপেই ভাষ্যকার সর্বত্র জগৎকে মিথ্যা বলেছেন। "কার্য বা বিকার-গুলো ওদের কারণ হতে স্বতন্ত্র নয়", —শঙ্কর বলে দিয়েছেন যে কার্য কারণের সম্বন্ধ বুঝতে হলে,—এই একটা অংশ মনে রাখতে হবে। আবার, আরও একটা অংশ মনে রাখতে হবে যে—"কারণ, ওর কার্যগুলো হতে স্বতন্ত্র" এই দুটি কথা একত্র মনে রাখতে হবে। শঙ্করের এই সিদ্ধান্তটা মনে রাখলে বেদান্তের সর্বত্র ব্যবহৃত "সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম", "ব্রহ্মৈবেদং সর্ব্বং" এই সকল শ্রুতিবাক্যগুলোর সঠিক অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারব।

ভাষ্যকার এই শ্রুতিগুলোর ভাষ্যে বলে দিয়েছেন যে, এই শ্রুতিগুলোর এই অর্থ নয় যে, —ব্রহ্মই এই বিশ্ব বা জগৎ; ব্রহ্মে জগতে কোন ভেদ নেই। এই শ্রুতিগুলোর তাৎপর্য এই যে, এই জগৎ ব্রহ্মেরই অবস্থান্তর, ইহা ব্রহ্ম হতে কোন স্বতন্ত্র স্বাধীন বস্তু নয়। কিন্তু এই জগদাকার ধারণ করাতেও, এই জগতের মধ্যে ব্রহ্ম, আপন স্বাতন্ত্র্য একত্ব হারান নি। যাঁরা ব্রহ্ম জগৎকে এক মনে করে তারা অবিদ্যাচ্ছন্ন। ব্রহ্ম আপন স্বরূপ পরিত্যাগ করে, এই নাম-রূপাদি বিকারের সম্পর্কে, একটি স্বতন্ত্র বস্তু হয়ে উঠেন নি। নাম-রূপাদি বিকারগুলো, ব্রহ্ম হতেই অভিব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু এদের সম্পর্কে, তাঁর স্বরূপের কোন হানি হয় নি। নাম-রূপাত্মক বিকার সকল পরিবর্তনের মধ্যে ব্রহ্মের স্বরূপটি ঠিক থাকছে।

এই অভিপ্রায়েই ভগবৎপাদ্ বলেছেন—"দর্শকবর্গকে অভিনয় দেখানোর সময়, একটি নট একবার দশরথ চরিত্রের ভূমিকা নিয়ে দেখা দেয়; একবার কৌশল্যা চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করে; পরক্ষণেই আবার রামের ভূমিকা নিয়ে দেখা দেয়; —এই জগতের মূল কারণ ব্রহ্মও তদ্রূপ, জগতের কার্য-বর্গের মধ্যে ক্রমে ক্রমেএক অবস্থা হতে অপর অবস্থায় নিজেকে অভিব্যক্ত করছেন। অথচ তিনি আপন স্বরূপে ঠিকই রয়েছেন।"

শঙ্কর-মতে পরিণামবাদকে রেখেই বিবর্তবাদের প্রাধান্য কীর্তিত হয়েছে। শঙ্কর ব্রহ্মকে পারমার্থিক সত্য বলে নির্দেশ করেছেন এবং এই পারমার্থিক সত্য ব্রহ্মের সহিত তুলনায় জগতের বিকার-গুলোকে অসত্য শব্দে নির্দেশ করা যেতে পারে বলেছেন। ব্রহ্ম যেমন নিয়ত কূটস্থ সত্য, জগৎ কেবল সেভাবে সত্য নয়। এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মবিজ্ঞান উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ব্যবহারিক জগতের সত্যতা অবশ্য স্বীকার্য। শঙ্করাচার্য শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে জগতের ব্যবহারিক সত্যতা স্পষ্টবাক্যেই স্বীকার করেছেন, যথা

"প্রাক্চাত্মৈকত্বাবগতেরব্যাহতঃ সর্বঃ সত্যানৃতব্যবহারো লৌকিকো বৈদিকশ্চেত্যবোচাম"-(ব্রহ্মসূত্র, শাঙ্করভাষ্য-..১৪) অর্থাৎ 'আত্মার একত্ব অবগতির পূর্বে লৌকিক এবং বৈদিক সকলপ্রকার সত্য এবং মিথ্যা ব্যবহার অব্যাহত থাকে।' .......

তথ্যসূত্রঃ-

. ভগবান শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা ভাষ্য উপনিষদ ভাষ্য।

. শ্রীকোকিলেশ্বর শাস্ত্রী বিদ্যারত্ন প্রণীত "অদ্বৈত-বাদ" শীর্ষক গ্রন্থ।

শ্রীশুভ চৌধুরী

নভেম্বর ১৫, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...