ইতঃপূর্বে বৌদ্ধ শূন্যবাদের সাথে অদ্বৈতবেদান্তের যে আকাশ-পাতাল বৈসাদৃশ্য রয়েছে তা মাণ্ডুক্যকারিকার শাঙ্করভাষ্য ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্ অবলম্বনে আলোচনা করা হয়েছে। এবার প্রসঙ্গ বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদ। এই প্রসঙ্গে আপত্তি এই যে বিজ্ঞানবাদীরা যাকে বিজ্ঞান বলে অদ্বৈতবাদীরা তারই স্থানে স্বয়ংভব জ্যোতিঃস্বরূপ সাক্ষি-চৈতন্যকে এনে দাঁড় করালেন। সুতরাং বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদের সিদ্ধান্তই তো অদ্বৈতবাদীরা গ্রহণ করেছেন, শুধু বলার ভঙ্গিটুকুই আলাদা। এই আপত্তির প্রত্যুত্তরে বলব, না; শুধু কেবল কথার তফাৎই নয়, বস্তুতত্ত্বের বিচারেও উভয় মতের মধ্যে গুরুতর পার্থক্য বিদ্যমান। বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদীদের বিজ্ঞান ক্ষণিক; উৎপত্তি ও বিনাশ ওটার স্বভাব ধর্ম। কাজেই ওটা এক নয়, বহু। কিন্তু আমাদের (অদ্বৈতবাদীদের) ব্রহ্মবিজ্ঞান এক অদ্বিতীয় শাশ্বত চৈতন্যস্বরূপ। ভগবান শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের 'নাভাব উপলব্ধেঃ' সূত্রভাষ্যের উপসংহারে নিজেই বলেছেন—
সাক্ষিণোবগন্তুঃ স্বয়ংসিদ্ধতামুপক্ষিপতা, স্বয়ং প্রথতে বিজ্ঞানম্ ইত্যেষ এব মম পক্ষস্ত্বয়া বাচোযুক্ত্যন্তরেণাশ্রিত ইতি চেৎ, ন; বিজ্ঞানস্যোৎপত্তিপ্রধ্বংসানেকত্বাদিবিশেষবত্ত্বাভ্যুপগমাৎ; অতঃ প্রদীপবদ্বিজ্ঞানস্যাপি ব্যতিরিক্তাবগম্যত্বমস্মাভিঃ প্রসাধিতম্ ৷৷ -(ব্রহ্মসূত্র-২/২/২৮, শাঙ্করভাষ্য দ্রষ্টব্য)
অর্থাৎ
বৌদ্ধ যদি বলেন বেদান্তী ভঙ্গীক্রমে বিজ্ঞানবাদই স্বীকার করছেন, ফলতঃ তা নয়। কারণ
এই যে, বৌদ্ধরা বিজ্ঞানের উৎপত্তি বিনাশ ও নানাত্ব স্বীকার
করে থাকেন। আমরা বেদান্তী, আমরা সর্ব-জ্ঞাতা সাক্ষীর উৎপত্ত্যাদি স্বীকার করি না। সাক্ষী ও বিজ্ঞানের মধ্যে
প্রভেদ থাকায় প্রদীপের ন্যায় বিজ্ঞানও স্বভিন্ন বস্তুকর্তৃক বিজ্ঞাত হয়, এটা আমরা প্রকৃষ্টরূপে প্রতিপাদন করলাম।
ভাষ্যের
নিগূঢ় উক্তির ব্যাখ্যায় ভামতীকার বাচস্পতি মিশ্র বলছেন—"বিজ্ঞানবাদীরা বিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিনাশরূপ ধর্ম
স্বীকার করেন। তাহলে বিজ্ঞান ফল বা কার্য
হয়ে দাঁড়ায়। যে নিজেই ফলস্বরূপ,
তার জ্ঞাতৃত্ব থাকতে পারে না; অর্থাৎ ক্ষণিক বিজ্ঞান কোনমতেই জ্ঞাতা হতে পারে না, ওটা স্বপ্রকাশ এবং স্বয়ংসিদ্ধও হতে পারে না। "
অতএব
বিজ্ঞানবাদীদের বিজ্ঞান উৎপত্তিবিনাশশীল, সুতরাং কার্যবস্তু, সেহেতু জড়পদার্থ। যা জড়, তা
অবশ্যই অন্যকর্তৃক প্রকাশিত হয়, যেমন প্রদীপ। অদ্বৈতবেদান্তে সাক্ষী কিন্তু স্বয়ংপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ, উৎপত্তিনাশরহিত, সুতরাং কূটস্থ। তাঁর আর অন্য প্রকাশকের
অপেক্ষা নেই।......
তথ্যসূত্রঃ-
ভগবান্ শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা ভাষ্য ও বাচস্পতি মিশ্রের
ভামতী টীকা।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
নভেম্বর
২০, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment