Wednesday, 25 December 2024

দৃগ্দৃশ্যবিবেকঃ

 


অদ্বৈতবেদান্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকরণ হল এই দৃগ্দৃশ্যবিবেক। বাক্যসুধা অবলম্বনে এটির সারমর্ম প্রকাশের চেষ্টা করব। সংসারে সকল রূপই কেবল দৃশ্য। সেই রূপের গ্রাহক চক্ষু, নিজ বিষয় রূপের সাথে সম্বন্ধ ধরে দ্রষ্টা হয়। নানাত্বই দৃশ্যত্বের হেতু এবং একত্বই দ্রষ্টৃত্বের হেতু। সেই কারণে রূপসমূহ নীল, পীত ইত্যাদি অনেকপ্রকার ভেদবশতঃ নানাত্বহেতু দৃশ্য বলে গণ্য হয়। বহুপ্রকার দৃশ্য হতে তাদের দ্রষ্টৃরূপে অবধৃত সেই চক্ষুও সাক্ষাৎ দ্রষ্টা নয়। কেননা, চক্ষুর দ্রষ্টা মনের বাইরে চক্ষুর অস্তিত্বই নেই। একই পুরুষে নেত্রেন্দ্রিয় এক অবস্থায় থাকে না। তা কখনো অন্ধ, কখনো মন্দ ইত্যাদি অবস্থান্তর প্রাপ্ত হয়ে বিকৃত হয় এবং যা বিকারী, তার পক্ষে স্বকীয় বিকারের দ্রষ্টা হওয়া সম্ভব নয়। সেই চক্ষুরও যে দ্রষ্টা, তার অন্বেষণ করতে গেলে পাওয়া যায়, মন তার দ্রষ্টৃরূপে তার সাথে সম্বদ্ধ। সেই প্রকারে আবার সেই চক্ষু ইন্দ্রিয় নিজের অপেক্ষা আভ্যন্তর মনের দৃশ্য হয় এবং মন নিজপ্রকাশ্য চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্বন্ধ ধরে দ্রষ্টা হয়।

আবার চক্ষুরাদির ন্যায় মনও অন্য কারও দৃশ্য। বৃহদারণ্যক শ্রুত্যোক্ত কাম, সঙ্কল্প, সন্দেহ, শ্রদ্ধা, অশ্রদ্ধা, ধৃতি, অধৃতি, লজ্জা, প্রজ্ঞা, ভয় ইত্যাদি মনোবৃত্তিসমূহ অবিদ্যার কার্য বলে জড়স্বরূপ, সেহেতু তারা দৃশ্য। কেননা 'আমার মন অন্যত্র গিয়েছে', এরূপ অনুভব হয়, আর শ্রুতিও বলছেন'অন্যত্রমনা অভূবং নাদর্শম্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-//) লোকে বলে 'আমি অন্যমনস্ক ছিলাম, দেখি নি' এর দ্বারা সিদ্ধ হলো মনের অস্তিত্বও অন্য দ্রষ্টার অধীন। সেই মন বা মনোবৃত্তিসমূহের 'সাক্ষী' চিদাত্মাই হল 'দৃক'—দ্রষ্টা বা প্রকাশক। সেই সাক্ষী বা কূটস্থচৈতন্য কিন্তু দ্রষ্টাই থাকে, কখনো কারো দৃশ্য হয় না। এই চৈতন্যের উদয় (জন্ম) নেই, অস্ত (তিরোভাব) নেই, বৃদ্ধি নেই, ক্ষয় নেই; যা স্বয়ংপ্রকাশ এবং সাধননিরপেক্ষ হয়ে অপর সকল বস্তুকে প্রকাশ করে থাকে।

কূটস্থচৈতন্য সর্বাপেক্ষা আভ্যন্তর বলে এবং তার অভ্যন্তরে সেই কূটস্থকে দৃশ্য করবার মতো অন্য কোন দ্রষ্টা নেই বলে কূটস্থে যে দ্রষ্টৃত্ব বর্তমান রয়েছে, তাই চরম দ্রষ্টৃত্ব। সেহেতু চক্ষু মনে যে আপেক্ষিক দ্রষ্টৃত্ব বর্তমান, কূটস্থের দ্রষ্টৃত্ব তা হতে বিলক্ষণ। সাক্ষী বা কূটস্থের দৃশ্যত্ব কোন প্রমাণগোচর নয়; সেহেতু কূটস্থ ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমানএই তিন কালেই দ্রষ্টা, দ্রষ্টৃত্বই তার স্বরূপ। 'তদ্বা এতদক্ষরং গার্গ্যদৃষ্টং দ্রষ্ট্রশ্রুতং শ্রোত্রমতং মন্ত্রবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতৃ...' (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-//১১)সে- এই অক্ষর হচ্ছেন অপরের অদৃষ্ট (দৃষ্টিগোচর হন না) অথচ নিজে সকলের দ্রষ্টা; অপরের অশ্রুত (শ্রুতিগোচর হন না), অথচ নিজের সকলের শ্রোতা, এরূপ অপরের মনোবৃত্তির অগোচর, কিন্তু নিজে সকলকে মনন করেন। বুদ্ধিবৃত্তির অগোচর বলে অবিজ্ঞাত, অথচ নিজে সকলের বিজ্ঞাতা। আরও বলা হয়েছে

' দৃষ্টের্দ্রষ্টারং পশ্যের্ন শ্রুতেঃ শ্রোতরং শৃণুয়া মতের্মন্তারং মন্বীথা বিজ্ঞাতের্বিজ্ঞাতারং বিজানীয়াঃ।'(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-//)

অতএব দৃষ্টির অর্থাৎ চক্ষুরিন্দ্রিয়জজ্ঞানের যিনি দ্রষ্টা (প্রকাশক) তাঁকে কেউ দেখতে পারেন না, শ্রবণেন্দ্রিয়জজ্ঞানের প্রকাশককে কেউ শ্রবণ করতে পারেন না; মনোবৃত্তিরসংশয়াদির প্রকাশককে মনের দ্বারা কেউ প্রকাশ করতে পারেন না এবং কর্তব্যাকর্তব্য নির্ধারক বুদ্ধিবৃত্তির বোদ্ধাকে বুদ্ধি দ্বারা কেউ জানতে পারেন না।

এরূপ সহস্র সহস্র শ্রুতিবচনের তাৎপর্য দ্বারা উক্ত অর্থই প্রতিপাদিত হয়েছে। এই হেতু 'তুমি' বা 'এই' এরূপ জ্ঞানের আলম্বন অন্তঃকরণ প্রভৃতি বস্তু দৃশ্যই; আর 'আমি' এরূপ জ্ঞানের আলম্বন স্বরূপ প্রত্যক্চৈতন্য (কূটস্থচৈতন্য) স্বরূপত দ্রষ্টা; সেহেতু প্রত্যক্চৈতন্যই পরমব্রহ্ম, এটাই অভিপ্রেতার্থ।।.........

তথ্যসূত্রঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যকৃত (মতান্তরে ভারতী তীর্থ) বাক্যসুধা (দৃগ্দৃশ্যবিবেকঃ) আনন্দ গিরি ব্রহ্মানন্দ ভারতীর টীকা সমেত।

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ১৯, বৃহস্পতিবার, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

Sunday, 15 December 2024

নিরালম্ব শ্রুতিপ্রমাণ ব্যতিরেকে ন্যায় অনুসারে জগৎ মিথ্যাত্বে প্রমাণ কি?

 


জাগতিক প্রপঞ্চের মিথ্যাত্বসাধনে প্রধানতঃ অনুমানই প্রমাণ। এই অনুমানের প্রয়োগ বাক্যটি কিরূপ, তা দেখাতে গিয়ে চিৎসুখাচার্য বলেছেন

অয়ং পটঃ (পক্ষ), এতত্তন্তু নিষ্ঠাত্যন্তাভাবপ্রতিযোগী (সাধ্য), দৃশ্যত্বাৎ (হেতু), ঘটবৎ (দৃষ্টান্ত)

এই পটের (বস্ত্রের) অবয়ব এই যে তন্তু বা সূতা, তাতে এই পটের অত্যন্তাভাব আছে, এবং এই পট সেই অত্যন্তাভাবের প্রতিযোগীও বটে, যেহেতু এটা দৃশ্য, যেমন ঘট। তন্তু বা সূতাগুলো তো আর পট বা বস্ত্র নয়। সূতায় বস্ত্রের অত্যন্তাভাব চিরকালই আছে এবং থাকবে। এইজন্যই আলোচ্য অনুমানে পট বা বস্ত্রকে সাধ্যের আধার অর্থাৎ পক্ষ করে বলা হয়েছে যে, এই পটের উপাদান তন্তুতে এই পটের অত্যন্তাভাব আছে, যেহেতু এই পট দৃশ্য পদার্থ। দৃশ্য পদার্থমাত্রেরই সূক্ষ্ম উপাদানে সকল স্থূল দৃশ্যবস্তুর অত্যন্তাভাব দেখতে পাওয়া যায়। ঘটের উপাদান মাটিতে ঘটের অভাব, কাঞ্চনময় কণ্ঠহারের উপাদান কাঞ্চনে কণ্ঠহারের অভাব, লৌহকুঠারের উপাদান লোহায় কুঠারের অভাব কে না প্রত্যক্ষ করেন? পটে দৃশ্যত্ব থাকায়, দৃশ্যত্ব হেতুর পক্ষ পটে অবস্থিতি (হেতুর পক্ষবৃত্তিত্ব) বুঝা গেল। ঘটেও দৃশ্যত্ব (হেতু) আছে এবং পটের অবয়ব তন্তুতে পটের অত্যন্তাভাবও (উক্ত অনুমানের সাধ্যও) আছে। ঘটেও এইরূপ নিশ্চিত সাধ্য থাকায়, আলোচ্য অনুমানে ঘটকে দৃষ্টান্তরূপে উপন্যাস করা হয়েছে বুঝতে হবে।.......

তথ্যসূত্রঃ- "বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ", তৃতীয়খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী, কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

নভেম্বর ২৪, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

Friday, 22 November 2024

এই দৃশ্যমান জগৎ ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছুই নয়—

 


যোগবাশিষ্ঠে বর্ণিত আছে

সর্বমেকমিদং শান্তমাদিমধ্যান্তবর্জিতম্।

ভাবাভাববিনির্মুক্তমিতি জ্ঞাত্বা সুখী ভব।

দৃশ্যমান এই জগৎ আদি-মধ্য-অন্ত-রহিত, ভাব-অভাব অতীত, শান্ত, অদ্বিতীয় ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছুই নয়এরূপ জেনে সুখী হও।

ভগবান্ শঙ্করাচার্য অপরোক্ষানুভূতিতে এই তত্ত্বটিকে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। আচার্য বলেছেনজগৎপ্রপঞ্চের উপাদান ব্রহ্ম ভিন্ন অন্য কিছু নয়, সুতরাং এই প্রপঞ্চসমূহে ব্রহ্মই আছেন অন্য কিছুই নেই। যেরূপ পৃথিবী ঘট নামে, তন্তুসকল পট (বস্ত্র) নামে প্রতীত হয়, সেরূপ চৈতন্যও জগৎ নামে আভাসিত হয়। ঘট পট নামের তিরোধান হলে মৃত্তিকা তন্তুকে জানা যায়। যেরূপ রজ্জুতে সর্প, আকাশে নীলবর্ণ, মরুমরীচিকায় জল দর্শন ভ্রমবশতঃ হয়ে থাকে, সেরূপ চৈতন্যসত্তায় জগৎপ্রপঞ্চের ভ্রমদর্শন ঘটে। নামরূপ মিথ্যা। ঘট, পট, কুণ্ডলনামরূপের সত্যতা নেই। মৃত্তিকা, তন্তু, সুবর্ণই সত্য। ছান্দোগ্য শ্রুতি বলছে"বাচারম্ভনং বিকারো নামধেয়ম্ মৃত্তিকেত্যেব সত্যম্।" ঘট মৃত্তিকায় যে কার্য-কারণ সম্পর্ক, প্রপঞ্চ ব্রহ্মেও তা বিদ্যমান; কিন্তু এখানে কার্যকে কারণ হতে ভিন্ন করা যায় না। কারণ জগৎ প্রপঞ্চের উপাদান নিমিত্ত কারণ ব্রহ্মই। " এষোঽণিমৈতদাত্ম্যমিদং সর্বং"-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-//); "সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম"-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-/১৪/)

বিচার করলে ঘটের নাম রূপ তিরোহিত হয়ে এক মৃত্তিকাই দৃঢ়ভাবে উপস্থিত হয়, তদ্রূপ বিচার করলে জগৎও স্বয়ংপ্রকাশ ব্রহ্মরূপেই অবশিষ্ট থাকে। জীবের সকল ব্যবহার ব্রহ্মের মধ্য দিয়েই হয়ে থাকে, কিন্তু অজ্ঞানবশে যেরূপ ঘট প্রভৃতি স্বরূপতঃ যে মৃত্তিকাই তা যেমন জানতে পারে না, তদ্রূপ সে তা জানতে পারে না। এখন প্রশ্ন হল, সবই যদি ব্রহ্মস্বরূপ হয়, তবে আত্মা অনাত্মা এরূপ বিভাগ কেন করা হয়? তদুত্তরে আচার্য শ্রীশঙ্কর বলেছেনযেরূপ ঘট মৃত্তিকা নির্মিত সেরূপ দেহও চৈতন্যময়। অজ্ঞান কর্তৃক আত্মা অনাত্মার বিভাগ বৃথাই কৃত হয়।...

তথ্যসূত্রঃ-

. "যোগবাশিষ্ঠসারঃ", স্বামী ধীরেশানন্দ।

. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের "অপরোক্ষানুভূতি"

শ্রীশুভ চৌধুরী

নভেম্বর ২২, শুক্রবার, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

Tuesday, 19 November 2024

এই দৃশ্যমান চরাচর দ্বৈতজগৎ মনোমাত্র—


রজ্জুতে কল্পিত সর্পের ন্যায় চৈতন্যস্বরূপ আত্মাতে মায়া দ্বারা বিকল্পিত মনই দ্বৈতরূপে অবভাত হচ্ছে।

মনোদৃশ্যমিদং দ্বৈতং যৎকিঞ্চিৎসচরাচরম্

মনসো হ্যমনীভাবে দ্বৈতং নৈবোপলভ্যতে

-(মাণ্ডুক্যকারিকা, /৩১)

এই যা কিছু স্থাবরজঙ্গমাত্মক দ্বৈতজগৎ পরিদৃষ্ট হচ্ছে, তৎসমস্তই মনোমাত্র; কারণ যতক্ষণ মন আছে ততক্ষণ জগৎ আছে। যেহেতু মনের সত্তায় দ্বৈতের সত্তা, মনের অভাবে দ্বৈতেরও অভাব হয়ে থাকে। বিবেকের অভ্যাস এবং বিবেকজ বৈরাগ্যের দ্বারা মনের অমনীভাব হলে অর্থাৎ রজ্জুতে সর্পের ন্যায় মন যখন নিরোধ সমাধিতে বা সুষুপ্তিতে লয়প্রাপ্ত হয়, তখন দ্বৈতের উপলব্ধি হয় না।

এখন প্রশ্ন, মন কি প্রকারে অমনীভাব প্রাপ্ত হয়?

আত্মসত্যানুবোধেন সঙ্কল্পয়তে যদা

অমনস্তাং তদা যাতি গ্রাহ্যাভাবে তদগ্রহম্ ।।

-(মাণ্ডুক্যকারিকা-/৩২)

আত্মার সত্যত্ব সাক্ষাৎ উপলব্ধিহেতু "বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম্" অর্থাৎ মৃণ্ময় কলসী প্রভৃতি কার্যবস্তু বাক্যারব্ধ নামমাত্র, কারণরূপী মৃত্তিকাই একমাত্র সত্য; ছান্দোগ্য শ্রুতির এই বাক্যানুসারে মৃত্তিকার ন্যায় আত্মাই একমাত্র সত্যবস্তু। শাস্ত্র এবং আচার্যের উপদেশের পশ্চাৎ সেই সত্যবস্তু আত্মার সাক্ষাৎ উপলব্ধি দ্বারা গ্রাহ্যপদার্থের অভাবহেতু সেই মন আর সঙ্কল্প করে না। দাহ্য পদার্থের অভাবে অগ্নি যেরূপ জ্বলন-ক্রিয়া করে না, সেইরূপ মন অগ্রহ অর্থাৎ গ্রহণ-বিষয়ক সঙ্কল্পরহিত হয়ে অমনীভাব প্রাপ্ত হয়।.......

তথ্যসূত্রঃ- আচার্য গৌড়পাদ বিরচিত মাণ্ডুক্যকারিকা, ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্য সমেত।

শ্রীশুভ চৌধুরী

নভেম্বর ১৯, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

অদ্বৈতবেদান্ত দর্শন বৌদ্ধ দর্শনেরই একটি প্রচ্ছন্ন রূপ—এই আপত্তির নিরসনঃ-

 


শুরুতেই বলে রাখি, রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য প্রভৃতি প্রতিবাদী দার্শনিকগণ বৌদ্ধদর্শন অদ্বৈতদর্শনের কেবলমাত্র একটি দিক্ দেখেই এইরূপ একটি অনভিপ্রেত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। সেই দিক্টি হল 'নেতিবাচক' দিক্। মাধ্যমিক, যোগাচার অদ্বৈতবেদান্তে পরিদৃশ্যমান বিশ্বের বাস্তব সত্যতা স্বীকৃত হয় নি, এটা সত্য বটে। কিন্তু এই নিষেধাত্মক দিক্টিতে মহাযান বৌদ্ধমত অদ্বৈতবেদান্ত মতের অংশতঃ মিল দেখেই, বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত দুইটি দার্শনিক চিন্তাধারাকে এক অভিন্ন বলে সিদ্ধান্ত করা বিভ্রান্তির পরিচায়ক সন্দেহ নেই। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে তত্ত্ব বিচার করতে গেলে, দুইটি বিশিষ্ট দার্শনিক মত কোন তত্ত্ব অস্বীকার করল, শুধু তা দেখলেই চলবে না; কোন তত্ত্ব স্বীকার করল তাও আলোচনা করতে হবে।

অস্বীকারের ক্ষেত্রে মিল থাকলেও, স্বীকারের ক্ষেত্রে যদি গুরুতর পার্থক্য দেখা দেয়, তবে দুইটি ভিন্ন পথগামী দর্শনকে মূলতঃ এক বলে অভিযোগ উত্থাপন করা নিতান্তই অসমীচীন। 'নেতিবাচক' 'ইতিবাচক' দুইটি দিক্ সমানভাবে বিচার করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। অদ্বৈতবেদান্ত সিদ্ধান্তে বিজ্ঞানাতিরিক্ত বিজ্ঞেয় জগতের কোনরূপ বাস্তব সত্তা নেই; কিন্তু এই বিজ্ঞান এক অদ্বিতীয় শাশ্বত ধ্রুব। এই বিজ্ঞান বিশেষ্য-বিশেষণ, জ্ঞান-জ্ঞাতা-জ্ঞেয় প্রভৃতি সর্বপ্রকার সম্বন্ধের অতীত, কূটস্থ ব্রহ্মস্বরূপ। বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধমতে বিজ্ঞানই একমাত্র সৎ হলেও, এই বিজ্ঞান ক্ষণিক। 'উৎপদ্য বিনশ্যতি', এটাই বৌদ্ধক্ত বিজ্ঞানের স্বভাব। বৌদ্ধ সিদ্ধান্তে সৎ বা সত্তামাত্রই ক্ষণিক, এবং ক্ষণিক অর্থই অনিত্য; সুতরাং সৎ বা অস্তিত্বের অর্থই দাঁড়াচ্ছে অনিত্য। নিত্যবস্তুর এইমতে কোনরূপ অস্তিত্বই নেই। এই বিষয়ে সর্বদর্শনসংগ্রহে মাধবাচার্য (বিদ্যারণ্য স্বামী) কর্তৃক উদ্ধৃত বৌদ্ধাচার্য জ্ঞানশ্রীর কারিকা দ্রষ্টব্য। অদ্বৈতমত এটার সম্পূর্ণ বিপরীত। অদ্বৈত সিদ্ধান্তে অস্তিত্ব অর্থই নিত্য। অনিত্য বস্তুর কোনপ্রকার বাস্তব অস্তিত্ব থাকতেই পারে না। যা বাস্তবিকই সৎ, তার বিলোপ, বিকার বা বিবর্তন ঘটতে পারে না। এই অবস্থায় দৃশ্যমান বিশ্বপ্রপঞ্চের তাত্ত্বিক অস্তিত্ব অস্বীকার করায় এবং একমাত্র ভূমা বিজ্ঞানেরই সত্যতা স্বীকার করায় যদি অদ্বৈতবাদীকে বিজ্ঞানবাদী বলে ধরে নি, তথাপি একথা মানতে হবে যে, বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ অদ্বৈতবাদী নন, তাঁরা বহুত্ববাদী। অপরপক্ষে, অদ্বৈতবাদীরাই কেবল অবিমিশ্র একত্ববাদীযা বৌদ্ধসম্মত বহুত্ববাদের সম্পূর্ণ বিপরীত।

ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য এই কথা বিচার করেই বললেনপ্রদীপ যেমন অন্য জ্ঞাতার জ্ঞানে ভাসে এবং প্রকাশিত হয়, বৌদ্ধোক্ত ক্ষণিক বিজ্ঞানও সেইরূপ অপরের জ্ঞানে ভাসবে এবং প্রকাশিত হবে। এইরূপ বিজ্ঞান স্বপ্রকাশ নয়, পরপ্রকাশ; জ্ঞানস্বরূপ নয়, জ্ঞেয়। এইরূপ বিজ্ঞান অদ্বৈতবেদান্তীর ব্রহ্মবিজ্ঞানের মর্যাদা লাভ করতে পারে কি করে?

সাক্ষিণোবগন্তুঃ স্বয়ংসিদ্ধতামুপক্ষিপতা, স্বয়ং প্রথতে বিজ্ঞানম্ ইত্যেষ এব মম পক্ষস্ত্বয়া বাচোযুক্ত্যন্তরেণাশ্রিত ইতি চেৎ, ; বিজ্ঞানস্যোৎপত্তিপ্রধ্বংসানেকত্বাদিবিশেষবত্ত্বাভ্যুপগমাৎ; অতঃ প্রদীপবদ্বিজ্ঞানস্যাপি ব্যতিরিক্তাবগম্যত্বমস্মাভিঃ প্রসাধিতম্ ৷৷ -(ব্রহ্মসূত্র-//২৮, শাঙ্করভাষ্য দ্রষ্টব্য)

অর্থাৎ বৌদ্ধ যদি বলেন বেদান্তী ভঙ্গীক্রমে বিজ্ঞানবাদই স্বীকার করছেন, ফলতঃ তা নয়। কারণ এই যে, বৌদ্ধরা বিজ্ঞানের উৎপত্তি বিনাশ নানাত্ব স্বীকার করে থাকেন। আমরা বেদান্তী, আমরা সর্ব-জ্ঞাতা সাক্ষীর উৎপত্ত্যাদি স্বীকার করি না। সাক্ষী বিজ্ঞানের মধ্যে প্রভেদ থাকায় প্রদীপের ন্যায় বিজ্ঞানও স্বভিন্ন বস্তুকর্তৃক বিজ্ঞাত হয়, এটা আমরা প্রকৃষ্টরূপে প্রতিপাদন করলাম।

ভাষ্যের নিগূঢ় উক্তির ব্যাখ্যায় ভামতীকার বাচস্পতি মিশ্র বলছেন—"বিজ্ঞানবাদীরা বিজ্ঞানের উৎপত্তি বিনাশরূপ ধর্ম স্বীকার করেন। তাহলে বিজ্ঞান ফল বা কার্য হয়ে দাঁড়ায়। যে নিজেই ফলস্বরূপ, তার জ্ঞাতৃত্ব থাকতে পারে না; অর্থাৎ ক্ষণিক বিজ্ঞান কোনমতেই জ্ঞাতা হতে পারে না, ওটা স্বপ্রকাশ এবং স্বয়ংসিদ্ধও হতে পারে না। "

অতএব বিজ্ঞানবাদীদের বিজ্ঞান উৎপত্তিবিনাশশীল, সুতরাং কার্যবস্তু, সেহেতু জড়পদার্থ। যা জড়, তা অবশ্যই অন্যকর্তৃক প্রকাশিত হয়, যেমন প্রদীপ। অদ্বৈতবেদান্তে সাক্ষী কিন্তু স্বয়ংপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ, উৎপত্তিনাশরহিত, সুতরাং কূটস্থ। তাঁর আর অন্য প্রকাশকের অপেক্ষা নেই।

বৌদ্ধ শূন্যবাদের সহিত অদ্বৈতবাদের বৈসাদৃশ্য আরও পরিস্ফুট। শূন্যবাদীর মতে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞেয় কারও কোনরূপ বাস্তব সত্তা নেই। তত্ত্বের রাজ্যে মহাশূন্যতায় বিরাজ করে। এই শূন্যই একমাত্র তত্ত্ব। শূন্যবাদী বলেন যে, বিজ্ঞান বা বিজ্ঞেয় বিশ্বপ্রপঞ্চ কারও পারমার্থিক সত্যতা নিরূপণ করা যায় না। সুতরাং তত্ত্ব নিরূপণ দুরূহ। পারমার্থিক তত্ত্ব নেই, শূন্যবাদীর এই উক্তিও পরমার্থ কিনা; সকলই শূন্য এই মতবাদও শূন্য কিনা? বৌদ্ধতার্কিক নাগার্জুন তাঁর 'বিগ্রহব্যাবর্তনী' গ্রন্থে উল্লিখিত প্রশ্নের সুনিপুণ সমাধান করেছেন। শ্রীহর্ষ প্রমুখ অদ্বৈত আচার্যগণ নাগার্জুনের যুক্তি বিচারশৈলী হতে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। কারণ, অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধেও অনুরূপ প্রশ্নই উঠেছে—'জগৎ মিথ্যা', এই উক্তিটিও মিথ্যা কিনা? এই উক্তি মিথ্যা হলে জগৎ সত্য হয়ে দাঁড়ায়। আচার্য শ্রীহর্ষ খণ্ডনখণ্ডখাদ্যে, আচার্য মধুসূদন সরস্বতী 'অদ্বৈতসিদ্ধিতে' আলোচ্য প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বিশেষতঃ শ্রীহর্ষের খণ্ডনরীতি যে অনেকাংশে নাগার্জুনের খণ্ডনশৈলীরই অনুরূপ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। অদ্বৈতবাদকে বৌদ্ধ মতবাদরূপে অভিযুক্ত করার পিছনে এটাও একটা কারণ বলে আমাদের মনে হয়।

শূন্যবাদের সিদ্ধান্তে বস্তুতত্ত্বের সত্যতা অসম্ভব পরিকল্পনা। অদ্বৈতবাদে পরমার্থ সত্যতা শুধু সম্ভব তাই নয়, এটা স্বয়ংভব, স্বয়ংজ্যোতিঃ, ধ্রুব, নিত্য এবং আনন্দঘন বিজ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্ম। শূন্যবাদের খণ্ডন প্রসঙ্গে বাচস্পতি মিশ্র বলেছেনশূন্যবাদীর দর্শনে ভ্রমের বা নিষেধের কোনও প্রকার নিশ্চিত ভিত্তি নেই। কিন্তু অদ্বৈতবেদান্তী ভ্রমের অধিষ্ঠানরূপে এক অদ্বিতীয় ভূমা বিজ্ঞানসত্তা স্বীকার করেছেন।

আচার্য শ্রীহর্ষ 'খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্' গ্রন্থে বলেছেনএইভাবে প্রমাণাদি প্রপঞ্চের অসত্তা স্বীকার করলেও সৌগত (বৌদ্ধ) ব্রহ্মবাদীর (বেদান্তীর) মধ্যে পার্থক্য এই যে, শূন্যবাদী বৌদ্ধগণ জ্ঞান জ্ঞেয়াত্মক নিখিল প্রপঞ্চকেই অনির্বচনীয় (মিথ্যা) রূপে বর্ণনা করেন, যা বুদ্ধদেবের লঙ্কাবতার সূত্রে বর্ণিত আছে—'বুদ্ধি হতে বিবেচিত অর্থাৎ জ্ঞান হতে ভিন্নরূপে বিষয়ীভূত পদার্থসমূহের কোন স্বভাব অর্থাৎ স্বরূপ নির্ণয় করা যায় না, তেমনি বুদ্ধিও (জ্ঞানও) বিচারসহ নয়। অতএব তারা (জ্ঞান জ্ঞেয়) উভয়ই নিরভিলপ্য অর্থাৎ অনির্বচনীয় এবং নিঃস্বভাব (স্বরূপহীন)'

কিন্তু অদ্বৈতবাদীগণ বলেন যে, বিজ্ঞেয় মিথ্যা হলেও বিজ্ঞান সত্য, স্বয়ংজ্যোতিঃ এবং ধ্রুব। বিজ্ঞান ব্যতিরিক্ত এই বিশ্বপ্রপঞ্চ সদসদ্বিলক্ষণ অর্থাৎ অনির্বাচ্য (মিথ্যা) যুক্তি এই যে, এই বিশ্ব সৎ হতে পারে না, যেহেতু বক্ষ্যমাণ বহুদোষ কলুষিত। শশশৃঙ্গাদির ন্যায় অসৎও হতে পারে না, কেননা তাহলে লৌকিক বিচারকগণের সমস্ত ব্যবহারের ব্যাঘাত ঘটে।

অদ্বৈত বৌদ্ধ দর্শনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈসাদৃশ্য হল তত্ত্ব তর্কের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে। মাধ্যমিক বৌদ্ধাচার্য নাগার্জুনও তত্ত্বের ব্যাখ্যায় বিচার বিশ্লেষণের গণ্ডীর বাইরে যেতে চান নি। তর্কের বাইরে তত্ত্ব নেই, এটা তাঁরও অভিমত। কিন্তু অদ্বৈতসিদ্ধান্তে তত্ত্ব তর্কের সীমার বাইরে। তর্কের পটভূমিতে সত্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর নয় বলেই, অদ্বৈতবেদান্তী দৃশ্যমান অনির্বচনীয় বিশ্বপ্রপঞ্চের আধাররূপেও এক অদ্বিতীয় স্বপ্রকাশ বিজ্ঞানময় তত্ত্ব স্বীকার করেছেন। বেদান্তবেদ্য তত্ত্ব তর্কের অগম্য।

সুতরাং দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দার্শনিক প্রস্থানের মধ্যে কোন সিদ্ধান্তে আংশিক সাদৃশ্য থাকলেই যদি দুটি দর্শন এক হয়ে যেত, তবে পৃথিবীর সকল দার্শনিক মতবাদই মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। দ্বৈতবাদীরাও স্বীকার করে থাকেন যে, বিজ্ঞানে বিজ্ঞেয় বিষয় প্রতিভাসিত হয়, যেটা বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদীরা স্বীকার করে। তাহলে তো দ্বৈতবাদীরাও বিজ্ঞানবাদী। বহির্জগতের বস্তুসত্ত্বা অস্বীকার করার জন্য যদি বিজ্ঞানবাদ অদ্বৈতবাদ এক হয়ে যায়, তবে পরিদৃশ্যমান বিশ্বের বাস্তব সত্তা স্বীকার করার জন্য চার্বাকদর্শন দ্বৈতদর্শন এক বা অভিন্ন হয়ে যায় না কেন? প্রভাকরের মতে অনুভূতিই প্রমাণ। বৌদ্ধ জৈন মতে জ্ঞানই প্রমাণ, তাহলে কি বৌদ্ধ জৈন দর্শন এক? জৈনগণ ভেদাভেদবাদী, কুমারিলও ভেদাভেদবাদী। চার্বাক সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর মানে না, পূর্বমীমাংসকেরাও সর্বজ্ঞ ঈশ্বর মানে না। অতএব যেই যুক্তিতে অদ্বৈত বৌদ্ধ এক দর্শন, সেই একই যুক্তিতে প্রভাকর অর্ধেক চার্বাকপন্থী এবং অর্ধেক বৌদ্ধপন্থী। কুমারীল অর্ধেক জৈনপন্থী অর্ধেক চার্বাকপন্থী। এইরূপে প্রতিবাদীর যুক্তির অসারতা প্রদর্শন করে, যাঁরা অদ্বৈতবেদান্তকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধমত বলে উপহাস করেছেন, তাঁদেরকে আচার্য প্রকাশাত্মযতি তদীয় পঞ্চপাদিকা বিবরণে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেছেন।.......

তথ্যসূত্রঃ-

. ভগবান শঙ্করাচার্যের "শারীরকমীমাংসা ভাষ্য", আচার্য প্রকাশাত্ম যতির "পঞ্চপাদিকা বিবরণ" বাচস্পতি মিশ্রের "ভামতী"

. আচার্য শ্রীহর্ষের "খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্"

. "বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ", তৃতীয় খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী।

শ্রীশুভ চৌধুরী

নভেম্বর ১৪, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...