Friday, 19 April 2024

অদ্বৈতবেদান্তে "জগৎ মিথ্যা" বিষয়ে দ্বৈতবাদীদের আপত্তির খণ্ডনঃ- (পর্ব-২)

 


শুরুতেই বলে রাখি শুধুমাত্র পাঠকের অনুরোধ, দার্শনিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীর আপত্তির নিরসনের জন্যই আমি এই কর্মে প্রবৃত্ত হচ্ছি। ভিন্নমতাদর্শকে হেয় বা অবজ্ঞা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। প্রথম পর্বে নিরালম্ব শ্রুত্যুক্ত "জগৎ মিথ্যা" বিষয়ে পূর্বপক্ষের কিছু আপত্তির উপস্থাপনপূর্বক সেগুলোর নিরসনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে (প্রথম পর্বের লিঙ্ক কমেন্ট বক্সে দেয়া হয়েছে) এই পর্বেও আরও কিছু আপত্তির উল্লেখ পূর্বক নিরসনের চেষ্টা করব।

পূর্বপক্ষঃ- দ্বৈতবাদী ব্যাসরাজ বলেন, জগৎ যে সত্য এবিষয়ে মানবমাত্রেরই ধ্রুব বিশ্বাস দেখতে পাওয়া যায়। "এই সেই বস্তু, যা আমি পূর্বে দেখেছি, যা আমার জীবনের বিবিধ প্রয়োজন সাধন করেছে", এরূপে জাগতিক বস্তুসম্পর্কে সকলেরই জ্ঞানের উদয় হতে দেখা যায়, সুতরাং অদ্বৈতবাদ অনুসারে সৃষ্টিকে দৃষ্টির সমসাময়িক মিথ্যা বলা যায় কিরূপে?

উত্তরপক্ষঃ- ব্যাসরাজের এই আপত্তির উত্তরে আচার্য মধুসূদন সরস্বতী বলেছেন, নিখিল বিশ্ব-সৃষ্টিই জীবের ব্যক্তিগত অজ্ঞানের বিলাস এবং তাঁর দৃষ্টির বিভ্রমমাত্র। জীব যা দেখে, তা জীব নিজেই নিজের অজ্ঞানবশতঃ সাময়িকভাবে সৃষ্টি করে। অনির্বচনীয় মায়ার বিচিত্র শক্তিই বিবিধ অনির্বাচনীয় মিথ্যা বিশ্ব-সৃষ্টির মূল। বিশ্বপ্রপঞ্চ মিথ্যা বলেই বশিষ্ঠ প্রভৃতি ঋষিগণের প্রণীত বিভিন্ন তত্ত্বশাস্ত্রে আবিদ্যক বিশ্বপ্রপঞ্চকে জলবুদ্বুদের মত ক্ষণিক মিথ্যা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এক ব্রহ্ম ব্যতীত সমস্ত দ্বৈত জগৎই ইন্দ্রজাল এবং অজ্ঞানের খেলা। বিশ্ব প্রপঞ্চের মূলে কোন সত্যতা নেই, বিশ্বের সত্যতা প্রতীতিকালীন মাত্র।

পূর্বপক্ষঃ- ব্রহ্ম ব্যতীত সমস্তই যদি অবস্তু এবং মিথ্যা হয়, তবে প্রত্যক্ষতঃ দৃশ্যমান এই সকল বিশ্বপ্রপঞ্চেরও কোনই অস্তিত্ব নেই, এটাই মেনে নিতে হয়। জগৎপ্রপঞ্চ যদি নাই থাকে, তবে বিশ্বপ্রপঞ্চের যে প্রত্যক্ষ হচ্ছে, সেই প্রত্যক্ষও তো মিথ্যা এবং অপ্রমাণই হয়ে দাঁড়াবে। প্রত্যক্ষ অপ্রমাণ হলে অন্য কোন প্রমাণই বলবত্তর হতে পারে না। কেন না অপরাপর সকল প্রমাণই প্রত্যক্ষমূলক। ফলে, প্রমাণ শাস্ত্র মিথ্যা এবং অর্থহীন হয়ে পড়ে।

উত্তরপক্ষঃ- এই আশঙ্কার উত্তরে আচার্য বিমুক্তাত্মন্ বলেন যে, পরিদৃশ্যমান বিশ্বপ্রপঞ্চ মায়াময় এবং অনির্বচনীয়। প্রপঞ্চ অনির্বচনীয় এর তাৎপর্য এই যে, বিশ্বপ্রপঞ্চ বস্তুও নয়, অবস্তুও নয়, সৎও নয়, অসৎও নয়, সদসৎও নয়। প্রপঞ্চের বাস্তবতা স্বীকার করলে অদ্বৈতবাদ অসম্ভব হয়, আবার প্রপঞ্চ অবস্তু অসৎ হলে ওটা কোনমতেই প্রত্যক্ষ প্রভৃতি প্রমাণের বিষয় হতে পারে না। আকাশকুসুমের ন্যায় অলীকই হয়ে দাঁড়ায়। জগৎপ্রপঞ্চ মায়ার কার্য। মায়া অনির্বচনীয় সুতরাং মায়াময় বিশ্বপ্রপঞ্চও অনির্বচনীয়।

পূর্বপক্ষঃ- জগতের মিথ্যাত্ব সত্য, না মিথ্যা? জগতের মিথ্যাত্ব যদি সত্য হয়, তবে ব্রহ্ম এবং জগতের মিথ্যাত্ব এই দুটি সত্য বস্তু অঙ্গীকার করায়, অদ্বৈতবাদ আর অদ্বৈতবাদ থাকে না, দ্বৈতবাদই হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, জগতের মিথ্যাত্ব যদি মিথ্যা হয়, তবে জগতের সত্যতায় এসে দাঁড়ায়'জগৎ সত্যং মিথ্যাভূত-মিথ্যাত্বকত্বাৎ,' (ন্যায়ামৃত-তরঙ্গিণী)

উত্তরপক্ষঃ- মধ্বমতাবলম্বী দ্বৈতবাদীগণের উল্লেখিত আপত্তির উত্তরে আচার্য নৃসিংহাশ্রম বলেন যে, দৃশ্যমান বিশ্বপ্রপঞ্চ যেমন মিথ্যা, সেরূপ যা বিশ্বপ্রপঞ্চের সমানস্বভাব তাও মিথ্যা বলে জানবে। জগৎ যেরূপ ব্যবহারিক সৎ এবং মিথ্যা, জগতের মিথ্যাত্বও সেরূপ ব্যবহারিক সৎ এবং মিথ্যা। নির্বিশেষ অদ্বৈত ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হলে সর্বপ্রকার ব্যবহারিক বোধই মিথ্যা বলে বিনষ্ট হয়ে যাবে। সেই অবস্থায় জগতের বোধও যেরূপ তিরোহিত হবে, জগতের মিথ্যাত্ববোধও সেরূপ তিরোহিত হবে। এক অদ্বিতীয়, নির্বিশেষ ব্রহ্মই বিরাজ করবে। সুতরাং জগতের মিথ্যাত্ব মিথ্যা হলেও তাতে জগৎ সত্য হবার আপত্তি আসে না। অপ্পয় দীক্ষিত তাঁর সিদ্ধান্তলেশ-সংগ্রহে এই প্রসঙ্গে নৃসিংহাশ্রমের অদ্বৈত-দীপিকার উল্লেখিত মতেরই অনুবর্তন করেছেন।

মধুসূদন সরস্বতীও নৃসিংহাশ্রমের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বলছেন, জগতের মিথ্যাত্বকে মিথ্যা দেখেই জগতের সত্যতা নিশ্চয় করা চলে না। কেননা, অদ্বৈতবেদান্তের মতে দৃশ্যমাত্রই মিথ্যা বলে দৃশ্যত্বকেই মিথ্যাত্বের অবচ্ছেদক ধর্ম ধরা যেতে পারে। এই মিথ্যাত্বের অবচ্ছেদক ধর্মটি জগতের সত্যতা এবং মিথ্যাত্ব এই উভয় স্থলেই তুল্যরূপে বিদ্যমান। এজন্যই জগতের মিথ্যাত্ব মিথ্যা হলেও জগতের সত্যতার প্রশ্ন আসে না। জগতের সত্যতা মিথ্যাত্ব এই উভয়ই মিথ্যা এটাই সাব্যস্ত হয়। এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হলে জগতের সত্যতা বা মিথ্যাত্ববোধ কিছুই থাকবে না, সর্বপ্রকার ব্যবহারিক বোধ বাধিত হবে। জগতের সত্যতা মিথ্যাত্ব, উভয়ই ব্যবহারিক এবং দৃশ্য বলে উভয়ে একজাতীয় (ব্যবহারিক) সত্ত্বাই বিরাজ করে এবং এক অদ্বয় ব্রহ্মজ্ঞানোদয়েই বাধিত হয়। জগৎপ্রপঞ্চ এবং তার মিথ্যাত্ববোধ এক ব্রহ্মজ্ঞান-বাধ্য বলেই প্রপঞ্চের মিথ্যাত্ব নিবন্ধন জগতের সত্যতা নিশ্চয় করা যায় না।

তথ্যসূত্রঃ-

. আচার্য বিমুক্তাত্মনের "ইষ্টসিদ্ধি"

. আচার্য নৃসিংহাশ্রমের "অদ্বৈতদীপিকা"

. আচার্য মধুসূদন সরস্বতী বিরচিত "অদ্বৈতসিদ্ধি" মিথ্যাত্ব-মিথ্যাত্ব নিরুক্তি।

. "বেদান্তদর্শন অদ্বৈতবাদ", আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

এপ্রিল ১৯, শুক্রবার, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

অদ্বৈতবেদান্তে এক-জীববাদ ও এক-জীববাদের বিরুদ্ধে বন্ধ-মুক্ত-ব্যবস্থার অনুপপত্তি নিরসনঃ-

 


ব্রহ্মপ্রতিবিম্ব জীব নানা নয়, এক। অন্তঃকরণরূপ উপাধির নানাত্ববশতঃ জীব নানা বলে ভ্রম হয়ে থাকে। অবিদ্যা এক, এক অবিদ্যায় নানা প্রতিবিম্ব পড়তে পারে না, জীবও সুতরাং নানা হতে পারে না। এখন প্রশ্ন হল, জীব এবং জীবের অজ্ঞান যখন এক, তখন এক জীব মুক্ত হলে, কিংবা জীবের মধ্যে একজন তত্ত্বজ্ঞানী হলে সকলেই মুক্ত, সকলেই তত্ত্বজ্ঞানী হয় না কেন? একজীববাদে বন্ধ, মোক্ষ ব্যবস্থা যুক্তিযুক্ত হয় কিরূপে?

এটার উত্তরে আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনি বলেন যে, অজ্ঞান একই বটে, তবে এক অজ্ঞানই অন্তঃকরণরূপ উপাধিভেদে বিভিন্ন অসংখ্য জীবব্যক্তিকে আশ্রয় করে একই গোত্ব যাতে যেমন নিখিল গোশরীরে বিদ্যমান থাকে, এরূপ জাতিপদার্থের ন্যায় অসংখ্য জীবে বিদ্যমান আছে। যে ব্যক্তির জ্ঞানোদয় হচ্ছে, সেই ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তির অজ্ঞান বিনষ্ট হচ্ছে, তিনি মুক্ত হচ্ছেন; অপরাপর অজ্ঞানীর অজ্ঞানবন্ধনই থেকে যাচ্ছে, সে মুক্ত হচ্ছে না। এরূপে এক অনাদি অজ্ঞান স্বীকার করলেও বন্ধ বা মুক্তির কোন অসুবিধা হয় না।

আচার্য মধুসূদন সরস্বতী আলোচ্য-মতের প্রতিধ্বনি করে বলেছেন যে, অন্তঃকরণ-পরিচ্ছিন্ন জীবের দ্রষ্টৃত্ব, ব্রহ্মজিজ্ঞাসা প্রভৃতিও যে অন্তঃকরণভেদে বিভিন্ন হবে, তাতে সন্দেহ কি? তবে, যেই অন্তঃকরণ-পরিচ্ছিন্ন জীবের ব্রহ্মজিজ্ঞাসা তীব্রতর হয়, শাস্ত্র গুরুবাক্যে অচলা শ্রদ্ধার উদয় হয়, শ্রবণ-মনন প্রভৃতি আয়ত্ত হয়, সেই ভাগ্যবান্ জিজ্ঞাসু জীবই ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করেন। যাঁদের অনুরূপ সাধনসম্পদ্ নেই, শ্রদ্ধার দৃঢ়তা নেই, তাঁরাই অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়ার কুহকে মজে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এরূপে বিচার করলে এক-জীববাদেও বদ্ধ-মুক্ত-ব্যবস্থার অনুপপত্তি নেই।...

তথ্যসূত্রঃ-

. আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনির "সংক্ষেপ-শারীরকম্"

. বেদান্তদর্শন অদ্বৈতবাদ, প্রথম খণ্ড তৃতীয় খণ্ড, শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

এপ্রিল ১০, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

Sunday, 7 April 2024

আচার্য বিদ্যা তীর্থ—

 


শৃঙ্গেরি শারদা পীঠের দশম মঠাধীশ ছিলেন আচার্য শ্রীবিদ্যা তীর্থ। শ্রীবিদ্যা তীর্থ শৃঙ্গেরি মঠে ১২২৯-১৩৩৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত মঠের পীঠাধিপতি ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি বেদাদি সর্বশাস্ত্রে প্রকাণ্ড পণ্ডিত ছিলেন। প্রসিদ্ধ বেদভাষ্যকার সায়ণাচার্য তাঁর বেদভাষ্যের মঙ্গলাচরণে যে "...বিদ্যাতীর্থ মহেশ্বরম্" বলে স্তুতি করেছেন ওটা আপাতদৃষ্টিতে মহাদেবের স্তুতি বলে মনে হলেও বস্তুতঃ ভাষ্যকার সেখানে শিবরূপী জগৎগুরু বিদ্যাতীর্থেরই স্তব করেছেন। মঙ্গলাচরণটি নিম্নরূপ

"যস্য নিঃশ্বসিতং বেদা যো বেদেভ্যোঽখিলং জগত্।

 নির্মমে তমহং বন্দে বিদ্যাতীর্থমহেশ্বরম্।।"

—"বেদসমূহ যাঁর নিঃশ্বাসস্বরূপ, যিনি বেদসমূহের দ্বারা সম্পূর্ণ জগত রচনা করেন, মায়ার প্রভাবরহিত সেই বিদ্যাতীর্থ মহেশ্বরকে আমি বন্দনা করি।"

সায়ণাচার্য বিদ্যারণ্যের সহোদর ছিলেন। দুই ভ্রাতাই আচার্য বিদ্যাতীর্থ থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন বলে জানা যায়। তৎকালীন ধুরন্ধর দার্শনিক আচার্যসকল শ্রীবিদ্যা তীর্থের শিষ্য ছিলেন। বিদ্যারণ্য মুনি বিবরণ-প্রমেয়-সংগ্রহের প্রারম্ভে গুরু শঙ্করানন্দের পাদপদ্মে তাঁর প্রণতি জানিয়েছেন এবং গ্রন্থের সমাপ্তিতে তিনি বিদ্যাতীর্থ পরমগুরুর পাদপদ্মে গ্রন্থার্পণ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। বিদ্যা তীর্থ শঙ্করানন্দ ভারতী তীর্থের গুরু ছিলেন। শ্রীশঙ্করানন্দ, শ্রীবিদ্যারণ্য মুনীশ্বর ছাড়াও শ্রীসচ্চিদানন্দ, শ্রী অদ্বৈত ব্রহ্মানন্দ, শ্রীসন্দ্রানন্দ, শ্রী অদ্বৈতানন্দ, শ্রীমহাদেব শিব, শ্রী অদ্বৈত সুখানন্দ, শ্রীশিবযোগী এবং শ্রী প্রত্যগ্জ্যোতি নামক আরও আটজন বিশিষ্ট শিষ্য ছিলেন। বিদ্যাতীর্থ এই আটজন শিষ্যকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত আটটি মঠের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন বলে জানা যায়।

আচার্য শুধু সর্বশাস্ত্রবিদই ছিলেন না বরং একজন পরম সিদ্ধপুরুষও ছিলেন। সর্বদা আত্মোপলব্ধির আনন্দে নিমগ্ন থাকতেন। আচার্য বহুবছর তাঁর শিষ্যদের সহিত সিংহগিরিতে কাটিয়েছিলেন, যারা তাঁর কৃপায় মন্ত্র, তন্ত্র, যোগ-ধ্যানে পারদর্শী হয়েছিলেন। তৎকালীন রাজভাতৃদ্বয় হরিহর বুক্ক আচার্যের দর্শনকামনায় সিংহগিরিতে এসেছিলেন, পরে আচার্যকে শৃঙ্গেরিতে নিয়ে আসেন। এই মহান ঋষির কাছে একদা একশিলানগরম্ (ওয়ারঙ্গল) থেকে একজন ব্রাহ্মণ বালক এসেছিলেন, এই বালকের বয়স অল্প হলেও তীব্র বৈরাগ্যবান্ মুমুক্ষু ছিলেন। তাঁর প্রতিভায় প্রভাবিত হয়ে আচার্য তাঁকে শ্রীভারতী তীর্থ নামে সন্ন্যাস প্রদান করেন এবং মঠের পরবর্তী মঠাধীশ পদে নিযুক্ত করেন। ভারতী তীর্থ নিজ গুরুর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন এবং সর্বদা গুরু সান্নিধ্যে জীবনযাপন করতেন।

সিংহগিরিতে এখনও একটি অদ্ভূত বিগ্রহমূর্তি সংরক্ষিত রয়েছে। যা 'চতুর্মূর্তি বিদ্যেশ্বর' নামে পরিচিত। যার চারমুখে চারটি মূর্তি রয়েছে। সামনের মুখটিতে শ্রীবিদ্যাতীর্থ তার পাশে প্রণামরত অবস্থায় দণ্ডায়মান দুই প্রধান শিষ্য ভারতী তীর্থ বিদ্যারণ্যের মূর্তি চিত্রিত হয়েছে। তাঁর উপরে লক্ষ্মীনৃসিংহের একটি মূর্তি সর্বোপরে একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। বিগ্রহটির অপর তিনটি মুখে ব্রহ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বর চিত্রিত হয়েছে। ত্রিমূর্তি আর জগৎগুরু বিদ্যাতীর্থ স্বয়ং এই চারজন বিদ্যাধিপতি রয়েছেন বলে এই মূর্তিটি 'চতুর্মূর্তি বিদ্যেশ্বর' নামে পরিচিত। এই মূর্তিটি জগৎগুরুর বিদ্যমান অবস্থাতেই নির্মিত হয়েছিল। ওটা দেখে জগৎগুরু তার শিষ্য ভারতী তীর্থকে বলেছিলেন যে "আমি অন্য জায়গায় (যেখানে বর্তমান বিদ্যাশঙ্কর মন্দির আছে) গিয়ে যোগধ্যান সমাধিতে মনোনিবেশ করব। ১২ বছর পর দ্বার খুলে দেখবে যে হুবহু এইরকম মূর্তি সেখানেও তৈরি হয়ে গেছে। তার আগে দ্বার খুলো না।" তুঙ্গার উত্তর তীরে ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠটি খনন করা হয়েছিল। আচার্য সেখানে যোগাসানে নিমগ্ন হন। কিন্তু তিনবছর অতিবাহিত হওয়ার পর যখন ভারতীতীর্থ মহাস্বামী কোনো এক কাজে মঠের বাইরে গিয়েছিলেন তখন অনুচরগণের একজন কৌতুহলবশতঃ দ্বার খুলে ফেলেছিল এবং তখন সেখানে ঋষির শরীর সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, ওখানে অনুচরগণ শুধু চতুর্মূর্তির সর্বোপরি শিবলিঙ্গের অনুরূপ একটি শিবলিঙ্গ পেয়েছিল যা এখনও বিদ্যমান। এটা আচার্যের সজীবসমাধিস্থান বলেও পরিচিত। ভারতী তীর্থ পরিচায়কদের এরূপ অবিবেচনামূলক আচরণে মর্মাহত হন, এবং পরবর্তীতে কয়েক বছরের মধ্যে এখানে বিদ্যাশঙ্কর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।....

অবিদ্যাচ্ছন্নভাবানাং নৃণাং বিদ্যোপদেশতঃ।

প্রকাশয়তি যস্তত্ত্বং তং বিদ্যাতীর্থমাশ্রয়ে।।

বিদ্যার উপদেশ দ্বারা অবিদ্যায় আচ্ছন্ন মনুষ্যগণের মধ্যে যিনি তত্ত্বজ্ঞানের আলোক প্রজ্জ্বলিত করেন সেই বিদ্যাতীর্থ গুরুর শরণ গ্রহণ করছি।

তথ্যসূত্রঃ-

https://www.sringeri.info/sri-vidyatirtha

শ্রীশুভ চৌধুরী

এপ্রিল , ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...