শুরুতেই বলে রাখি শুধুমাত্র পাঠকের অনুরোধ, দার্শনিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ ও অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীর আপত্তির নিরসনের জন্যই আমি এই কর্মে প্রবৃত্ত হচ্ছি। ভিন্নমতাদর্শকে হেয় বা অবজ্ঞা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। প্রথম পর্বে নিরালম্ব শ্রুত্যুক্ত "জগৎ মিথ্যা" বিষয়ে পূর্বপক্ষের কিছু আপত্তির উপস্থাপনপূর্বক সেগুলোর নিরসনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে (প্রথম পর্বের লিঙ্ক কমেন্ট বক্সে দেয়া হয়েছে)। এই পর্বেও আরও কিছু আপত্তির উল্লেখ পূর্বক নিরসনের চেষ্টা করব।
পূর্বপক্ষঃ-
দ্বৈতবাদী ব্যাসরাজ বলেন, জগৎ যে সত্য
এবিষয়ে মানবমাত্রেরই ধ্রুব বিশ্বাস দেখতে পাওয়া যায়। "এই সেই বস্তু,
যা আমি পূর্বে দেখেছি,
যা আমার জীবনের বিবিধ
প্রয়োজন সাধন করেছে", এরূপে
জাগতিক বস্তুসম্পর্কে সকলেরই জ্ঞানের উদয় হতে দেখা
যায়, সুতরাং অদ্বৈতবাদ অনুসারে সৃষ্টিকে দৃষ্টির সমসাময়িক ও মিথ্যা বলা
যায় কিরূপে?
উত্তরপক্ষঃ-
ব্যাসরাজের এই আপত্তির উত্তরে
আচার্য মধুসূদন সরস্বতী বলেছেন, নিখিল বিশ্ব-সৃষ্টিই জীবের ব্যক্তিগত অজ্ঞানের বিলাস এবং তাঁর দৃষ্টির
বিভ্রমমাত্র। জীব যা দেখে,
তা জীব নিজেই নিজের
অজ্ঞানবশতঃ সাময়িকভাবে সৃষ্টি করে। অনির্বচনীয় মায়ার
বিচিত্র শক্তিই বিবিধ অনির্বাচনীয় মিথ্যা বিশ্ব-সৃষ্টির মূল। বিশ্বপ্রপঞ্চ মিথ্যা
বলেই বশিষ্ঠ প্রভৃতি ঋষিগণের প্রণীত বিভিন্ন তত্ত্বশাস্ত্রে আবিদ্যক বিশ্বপ্রপঞ্চকে জলবুদ্বুদের মত ক্ষণিক ও
মিথ্যা বলে বর্ণনা করা
হয়েছে। এক ব্রহ্ম ব্যতীত
সমস্ত দ্বৈত জগৎই ইন্দ্রজাল এবং
অজ্ঞানের খেলা। বিশ্ব প্রপঞ্চের মূলে কোন সত্যতা
নেই, বিশ্বের সত্যতা প্রতীতিকালীন মাত্র।
পূর্বপক্ষঃ-
ব্রহ্ম ব্যতীত সমস্তই যদি অবস্তু এবং
মিথ্যা হয়, তবে প্রত্যক্ষতঃ
দৃশ্যমান এই সকল বিশ্বপ্রপঞ্চেরও
কোনই অস্তিত্ব নেই, এটাই মেনে
নিতে হয়। জগৎপ্রপঞ্চ যদি
নাই থাকে, তবে বিশ্বপ্রপঞ্চের যে
প্রত্যক্ষ হচ্ছে, সেই প্রত্যক্ষও তো
মিথ্যা এবং অপ্রমাণই হয়ে
দাঁড়াবে। প্রত্যক্ষ অপ্রমাণ হলে অন্য কোন
প্রমাণই বলবত্তর হতে পারে না।
কেন না অপরাপর সকল
প্রমাণই প্রত্যক্ষমূলক। ফলে, প্রমাণ শাস্ত্র
মিথ্যা এবং অর্থহীন হয়ে
পড়ে।
উত্তরপক্ষঃ-
এই আশঙ্কার উত্তরে আচার্য বিমুক্তাত্মন্ বলেন যে, পরিদৃশ্যমান
বিশ্বপ্রপঞ্চ মায়াময় এবং অনির্বচনীয়। প্রপঞ্চ
অনির্বচনীয় এর তাৎপর্য এই
যে, বিশ্বপ্রপঞ্চ বস্তুও নয়, অবস্তুও নয়,
সৎও নয়, অসৎও নয়,
সদসৎও নয়। প্রপঞ্চের বাস্তবতা
স্বীকার করলে অদ্বৈতবাদ অসম্ভব
হয়, আবার প্রপঞ্চ অবস্তু
অসৎ হলে ওটা কোনমতেই
প্রত্যক্ষ প্রভৃতি প্রমাণের বিষয় হতে পারে না।
আকাশকুসুমের ন্যায় অলীকই হয়ে দাঁড়ায়। জগৎপ্রপঞ্চ
মায়ার কার্য। মায়া অনির্বচনীয় সুতরাং মায়াময় বিশ্বপ্রপঞ্চও অনির্বচনীয়।
পূর্বপক্ষঃ-
জগতের মিথ্যাত্ব সত্য, না মিথ্যা? জগতের
মিথ্যাত্ব যদি সত্য হয়,
তবে ব্রহ্ম এবং জগতের মিথ্যাত্ব
এই দুটি সত্য বস্তু
অঙ্গীকার করায়, অদ্বৈতবাদ আর অদ্বৈতবাদ থাকে
না, দ্বৈতবাদই হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে,
জগতের মিথ্যাত্ব যদি মিথ্যা হয়,
তবে জগতের সত্যতায় এসে দাঁড়ায়—'জগৎ
সত্যং মিথ্যাভূত-মিথ্যাত্বকত্বাৎ,' (ন্যায়ামৃত-তরঙ্গিণী)
উত্তরপক্ষঃ-
মধ্বমতাবলম্বী দ্বৈতবাদীগণের উল্লেখিত আপত্তির উত্তরে আচার্য নৃসিংহাশ্রম বলেন যে, দৃশ্যমান
বিশ্বপ্রপঞ্চ যেমন মিথ্যা, সেরূপ
যা বিশ্বপ্রপঞ্চের সমানস্বভাব তাও মিথ্যা বলে
জানবে। জগৎ যেরূপ ব্যবহারিক
সৎ এবং মিথ্যা, জগতের
মিথ্যাত্বও সেরূপ ব্যবহারিক সৎ এবং মিথ্যা।
নির্বিশেষ অদ্বৈত ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হলে সর্বপ্রকার
ব্যবহারিক বোধই মিথ্যা বলে
বিনষ্ট হয়ে যাবে। সেই
অবস্থায় জগতের বোধও যেরূপ তিরোহিত
হবে, জগতের মিথ্যাত্ববোধও সেরূপ তিরোহিত হবে। এক অদ্বিতীয়,
নির্বিশেষ ব্রহ্মই বিরাজ করবে। সুতরাং জগতের মিথ্যাত্ব মিথ্যা হলেও তাতে জগৎ
সত্য হবার আপত্তি আসে
না। অপ্পয় দীক্ষিত তাঁর সিদ্ধান্তলেশ-সংগ্রহে
এই প্রসঙ্গে নৃসিংহাশ্রমের অদ্বৈত-দীপিকার উল্লেখিত মতেরই অনুবর্তন করেছেন।
মধুসূদন
সরস্বতীও নৃসিংহাশ্রমের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বলছেন, জগতের
মিথ্যাত্বকে মিথ্যা দেখেই জগতের সত্যতা নিশ্চয় করা চলে না।
কেননা, অদ্বৈতবেদান্তের মতে দৃশ্যমাত্রই মিথ্যা
বলে দৃশ্যত্বকেই মিথ্যাত্বের অবচ্ছেদক ধর্ম ধরা যেতে
পারে। এই মিথ্যাত্বের অবচ্ছেদক
ধর্মটি জগতের সত্যতা এবং মিথ্যাত্ব এই
উভয় স্থলেই তুল্যরূপে বিদ্যমান। এজন্যই জগতের মিথ্যাত্ব মিথ্যা হলেও জগতের সত্যতার
প্রশ্ন আসে না। জগতের
সত্যতা ও মিথ্যাত্ব এই
উভয়ই মিথ্যা এটাই সাব্যস্ত হয়।
এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হলে জগতের
সত্যতা বা মিথ্যাত্ববোধ কিছুই
থাকবে না, সর্বপ্রকার ব্যবহারিক
বোধ বাধিত হবে। জগতের সত্যতা
ও মিথ্যাত্ব, উভয়ই ব্যবহারিক এবং দৃশ্য বলে
উভয়ে একজাতীয় (ব্যবহারিক) সত্ত্বাই বিরাজ করে এবং এক
অদ্বয় ব্রহ্মজ্ঞানোদয়েই বাধিত হয়। জগৎপ্রপঞ্চ এবং
তার মিথ্যাত্ববোধ এক ব্রহ্মজ্ঞান-বাধ্য
বলেই প্রপঞ্চের মিথ্যাত্ব নিবন্ধন জগতের সত্যতা নিশ্চয় করা যায় না।
তথ্যসূত্রঃ-
১.
আচার্য বিমুক্তাত্মনের "ইষ্টসিদ্ধি"।
২.
আচার্য নৃসিংহাশ্রমের "অদ্বৈতদীপিকা"।
৩.
আচার্য মধুসূদন সরস্বতী বিরচিত "অদ্বৈতসিদ্ধি"র মিথ্যাত্ব-মিথ্যাত্ব
নিরুক্তি।
৪.
"বেদান্তদর্শন অদ্বৈতবাদ", আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
এপ্রিল
১৯, শুক্রবার, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।