Sunday, 7 April 2024

আচার্য বিদ্যা তীর্থ—

 


শৃঙ্গেরি শারদা পীঠের দশম মঠাধীশ ছিলেন আচার্য শ্রীবিদ্যা তীর্থ। শ্রীবিদ্যা তীর্থ শৃঙ্গেরি মঠে ১২২৯-১৩৩৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত মঠের পীঠাধিপতি ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি বেদাদি সর্বশাস্ত্রে প্রকাণ্ড পণ্ডিত ছিলেন। প্রসিদ্ধ বেদভাষ্যকার সায়ণাচার্য তাঁর বেদভাষ্যের মঙ্গলাচরণে যে "...বিদ্যাতীর্থ মহেশ্বরম্" বলে স্তুতি করেছেন ওটা আপাতদৃষ্টিতে মহাদেবের স্তুতি বলে মনে হলেও বস্তুতঃ ভাষ্যকার সেখানে শিবরূপী জগৎগুরু বিদ্যাতীর্থেরই স্তব করেছেন। মঙ্গলাচরণটি নিম্নরূপ

"যস্য নিঃশ্বসিতং বেদা যো বেদেভ্যোঽখিলং জগত্।

 নির্মমে তমহং বন্দে বিদ্যাতীর্থমহেশ্বরম্।।"

—"বেদসমূহ যাঁর নিঃশ্বাসস্বরূপ, যিনি বেদসমূহের দ্বারা সম্পূর্ণ জগত রচনা করেন, মায়ার প্রভাবরহিত সেই বিদ্যাতীর্থ মহেশ্বরকে আমি বন্দনা করি।"

সায়ণাচার্য বিদ্যারণ্যের সহোদর ছিলেন। দুই ভ্রাতাই আচার্য বিদ্যাতীর্থ থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন বলে জানা যায়। তৎকালীন ধুরন্ধর দার্শনিক আচার্যসকল শ্রীবিদ্যা তীর্থের শিষ্য ছিলেন। বিদ্যারণ্য মুনি বিবরণ-প্রমেয়-সংগ্রহের প্রারম্ভে গুরু শঙ্করানন্দের পাদপদ্মে তাঁর প্রণতি জানিয়েছেন এবং গ্রন্থের সমাপ্তিতে তিনি বিদ্যাতীর্থ পরমগুরুর পাদপদ্মে গ্রন্থার্পণ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। বিদ্যা তীর্থ শঙ্করানন্দ ভারতী তীর্থের গুরু ছিলেন। শ্রীশঙ্করানন্দ, শ্রীবিদ্যারণ্য মুনীশ্বর ছাড়াও শ্রীসচ্চিদানন্দ, শ্রী অদ্বৈত ব্রহ্মানন্দ, শ্রীসন্দ্রানন্দ, শ্রী অদ্বৈতানন্দ, শ্রীমহাদেব শিব, শ্রী অদ্বৈত সুখানন্দ, শ্রীশিবযোগী এবং শ্রী প্রত্যগ্জ্যোতি নামক আরও আটজন বিশিষ্ট শিষ্য ছিলেন। বিদ্যাতীর্থ এই আটজন শিষ্যকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত আটটি মঠের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন বলে জানা যায়।

আচার্য শুধু সর্বশাস্ত্রবিদই ছিলেন না বরং একজন পরম সিদ্ধপুরুষও ছিলেন। সর্বদা আত্মোপলব্ধির আনন্দে নিমগ্ন থাকতেন। আচার্য বহুবছর তাঁর শিষ্যদের সহিত সিংহগিরিতে কাটিয়েছিলেন, যারা তাঁর কৃপায় মন্ত্র, তন্ত্র, যোগ-ধ্যানে পারদর্শী হয়েছিলেন। তৎকালীন রাজভাতৃদ্বয় হরিহর বুক্ক আচার্যের দর্শনকামনায় সিংহগিরিতে এসেছিলেন, পরে আচার্যকে শৃঙ্গেরিতে নিয়ে আসেন। এই মহান ঋষির কাছে একদা একশিলানগরম্ (ওয়ারঙ্গল) থেকে একজন ব্রাহ্মণ বালক এসেছিলেন, এই বালকের বয়স অল্প হলেও তীব্র বৈরাগ্যবান্ মুমুক্ষু ছিলেন। তাঁর প্রতিভায় প্রভাবিত হয়ে আচার্য তাঁকে শ্রীভারতী তীর্থ নামে সন্ন্যাস প্রদান করেন এবং মঠের পরবর্তী মঠাধীশ পদে নিযুক্ত করেন। ভারতী তীর্থ নিজ গুরুর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন এবং সর্বদা গুরু সান্নিধ্যে জীবনযাপন করতেন।

সিংহগিরিতে এখনও একটি অদ্ভূত বিগ্রহমূর্তি সংরক্ষিত রয়েছে। যা 'চতুর্মূর্তি বিদ্যেশ্বর' নামে পরিচিত। যার চারমুখে চারটি মূর্তি রয়েছে। সামনের মুখটিতে শ্রীবিদ্যাতীর্থ তার পাশে প্রণামরত অবস্থায় দণ্ডায়মান দুই প্রধান শিষ্য ভারতী তীর্থ বিদ্যারণ্যের মূর্তি চিত্রিত হয়েছে। তাঁর উপরে লক্ষ্মীনৃসিংহের একটি মূর্তি সর্বোপরে একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। বিগ্রহটির অপর তিনটি মুখে ব্রহ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বর চিত্রিত হয়েছে। ত্রিমূর্তি আর জগৎগুরু বিদ্যাতীর্থ স্বয়ং এই চারজন বিদ্যাধিপতি রয়েছেন বলে এই মূর্তিটি 'চতুর্মূর্তি বিদ্যেশ্বর' নামে পরিচিত। এই মূর্তিটি জগৎগুরুর বিদ্যমান অবস্থাতেই নির্মিত হয়েছিল। ওটা দেখে জগৎগুরু তার শিষ্য ভারতী তীর্থকে বলেছিলেন যে "আমি অন্য জায়গায় (যেখানে বর্তমান বিদ্যাশঙ্কর মন্দির আছে) গিয়ে যোগধ্যান সমাধিতে মনোনিবেশ করব। ১২ বছর পর দ্বার খুলে দেখবে যে হুবহু এইরকম মূর্তি সেখানেও তৈরি হয়ে গেছে। তার আগে দ্বার খুলো না।" তুঙ্গার উত্তর তীরে ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠটি খনন করা হয়েছিল। আচার্য সেখানে যোগাসানে নিমগ্ন হন। কিন্তু তিনবছর অতিবাহিত হওয়ার পর যখন ভারতীতীর্থ মহাস্বামী কোনো এক কাজে মঠের বাইরে গিয়েছিলেন তখন অনুচরগণের একজন কৌতুহলবশতঃ দ্বার খুলে ফেলেছিল এবং তখন সেখানে ঋষির শরীর সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, ওখানে অনুচরগণ শুধু চতুর্মূর্তির সর্বোপরি শিবলিঙ্গের অনুরূপ একটি শিবলিঙ্গ পেয়েছিল যা এখনও বিদ্যমান। এটা আচার্যের সজীবসমাধিস্থান বলেও পরিচিত। ভারতী তীর্থ পরিচায়কদের এরূপ অবিবেচনামূলক আচরণে মর্মাহত হন, এবং পরবর্তীতে কয়েক বছরের মধ্যে এখানে বিদ্যাশঙ্কর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।....

অবিদ্যাচ্ছন্নভাবানাং নৃণাং বিদ্যোপদেশতঃ।

প্রকাশয়তি যস্তত্ত্বং তং বিদ্যাতীর্থমাশ্রয়ে।।

বিদ্যার উপদেশ দ্বারা অবিদ্যায় আচ্ছন্ন মনুষ্যগণের মধ্যে যিনি তত্ত্বজ্ঞানের আলোক প্রজ্জ্বলিত করেন সেই বিদ্যাতীর্থ গুরুর শরণ গ্রহণ করছি।

তথ্যসূত্রঃ-

https://www.sringeri.info/sri-vidyatirtha

শ্রীশুভ চৌধুরী

এপ্রিল , ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...