তর্কের ভিত্তিতে বিচার করলে দেখা যায় যে, নির্গুণকে বুঝতে গেলেই সগুণকে জানা প্রয়োজন হয়। নির্গুণ বাক্য দ্বারা উপনিষদে ব্রহ্মে সর্ববিধ গুণের নিষেধ করা হয়েছে। নিষেধের কোন বিষয় না থাকলে, কার নিষেধ তা না বুঝালে, নিষেধের সেক্ষেত্রে কোনই অর্থ হয় না। সগুণ বাক্যের দ্বারা ব্রহ্মের যে সকল গুণরাজি বর্ণিত হয়েছে, নির্গুণ বাক্যে সেই সমুদয় গুণেরই নিষেধ সূচিত হয়েছে। সগুণ বাক্য না থাকলে, নির্গুণ বাক্যের অবতারণাই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।
ব্রহ্মের
গুণ-সম্পর্ক কল্পিত না হলে, সত্য
স্বাভাবিক গুণের নিষেধ কোন মতেই সম্ভবপর
হয় না। সে অবস্থায়
গুণের নিষেধে গুণীরও নিষেধ হয়ে যায়। আবার
সগুণবাক্যের প্রাধান্য দিলে, উপনিষদে যে অসংখ্য নির্গুণবাক্য
দেখতে পাওয়া যায়, তা নির্বিষয় এবং
অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায়
অদ্বৈতবাদীর দৃষ্টিতে নির্গুণ বাক্যের প্রাধান্য স্বীকার করলে, উপাসনা জগতে সগুণ ব্রহ্মবোধক
বাক্যেরও নির্দিষ্ট স্থান পাওয়া যায়। সগুণ এবং নির্গুণ
কোনরূপ উপনিষদের উক্তিই মিথ্যা এবং অপ্রমাণ হয়
না। আচার্য মধুসূদন সরস্বতী বলেছেন— "সগুণবাক্যানাম্ ঔপাধিকগুণবিষয়েত্বেন স্বাভাবিকনির্ধর্মকত্বশ্রুতের্নবিরোধঃ।
(অদ্বৈতসিদ্ধি) স্থূলদর্শী সাধকের উপাসনার সুবিধার জন্য ব্রহ্মের সগুণ
ভাবের কল্পনা করা হয়ে থাকে।
যিনি স্বতঃ নির্গুণ, তিনিই মায়া উপাধিবশতঃ সগুণ সবিশেষ হন।
এই সগুণভাব তাঁর লীলামাত্র। তিনি
মায়াধীশ, তাঁর উপর মায়ার
কোন প্রভাব নেই।
'সর্বকর্মা সর্বকামঃ
সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৩।১৪।২) প্রভৃতি শ্রুতি ব্রহ্মের সগুণভাব প্রকাশ করছে। "নিষ্কলং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং নিরবদ্যং নিরঞ্জনম্"-( শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৬।১৯) ইত্যাদি শ্রুতি দ্বারা ব্রহ্মের নির্বিশেষ ভাব প্রতিপাদিত হয়েছে।
এই অবস্থায় কোন শ্রুতিবাক্য দুর্বল,
কোনটি প্রবল? তা বিচার করতে
গেলে দেখা যায় যে,
প্রথমতঃ ব্রহ্মের গুণ বর্ণনা না
করলে, নির্গুণ বাক্যে গুণের যে নিষেধ করা
হয়েছে, তার তো কোন
অর্থ হয় না। সুতরাং
গুণ থাকলে তবেই তো ওটার
নিষেধ হবে? গুণ না
থাকলে নিষেধ হবে কার? নির্গুণ
সুতরাং সগুণকে অপেক্ষা করে। এই অবস্থায়
"অপচ্ছেদ" ন্যায় অনুসারে গুণসাপেক্ষ নির্গুণ বাক্য যে সগুণ বাক্য
অপেক্ষা প্রবল, তাতে সন্দেহ কি?
সেই প্রবল নির্গুণ বাক্যের দ্বারা সগুণ বাক্যের বাধ
হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
ননু নির্গুণবাক্যং সগুণবাক্যং বাধতে, নতু সগুণবাক্যং তদিতি
কিমত্র নিয়ামকম্? ন চ নিষেধকতয়া
নির্গুণবাক্যং প্রবলম্, 'অসদ্বা' ইত্যাদিবাক্যস্য সদেব ইত্যাদিবাক্যাৎ প্রাবল্যাপত্তেরিতি
চেন্ন, অপচ্ছেদন্যায়েন প্রাবলস্য প্রাগেবোক্তেঃ। (অদ্বৈতসিদ্ধি)
"অপচ্ছেদ" ন্যায়টি
মীমাংসা দর্শনের একটি ন্যায়। অপচ্ছেদ
শব্দের অর্থ বিরোধ বা
ব্যাঘাত। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উক্তির
মধ্যে অপচ্ছেদ ঘটলে, পূর্বটি দুর্বল এবং পরবর্তী উক্তিটি
সবল হয়ে থাকে। উপরিউক্ত
ছান্দোগ্য শ্রুতির ব্রহ্মের সবিশেষতা সম্পাদক গন্ধ ও রূপরসাদি
উপাধিসকল অবিদ্যা কর্তৃক প্রত্যুপস্থাপিত। সুতরাং নির্বিশেষ ব্রহ্মই বেদান্ত প্রতিপাদ্য, সবিশেষতা উপাসনার সৌকর্যের জন্য। যেহেতু সকল স্থলেই অর্থাৎ
উপনিষদ্ সকলে ব্রহ্মস্বরূপ প্রতিপাদনপর
'অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ম্'-(কঠ উপনিষৎ-১।৩।১৫)
অর্থাৎ 'শব্দরহিত, স্পর্শরহিত, রূপবিহীন, ক্ষয়রহিত' ইত্যাদি এই বাক্যসকলে যাঁ
হতে সমস্ত বিশেষ নিরাকৃত হয়েছে, সেই ব্রহ্মই উপদিষ্ট
হচ্ছেন। কিন্তু সাকার অর্থাৎ সপ্রপঞ্চ সবিশেষ ব্রহ্মবিষয়ক অন্যান্য বাক্যসকল তৎপ্রধান নয় অর্থাৎ প্রধানভাবে
সবিশেষতা প্রতিপাদন করে না, যেহেতু
তারা প্রধানভাবে উপাসনাবিধি প্রতিপাদন করে অর্থাৎ বিধিবোধিত
উপাসনার অঙ্গরূপে ব্রহ্মকে সমর্পন করে।....
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা ভাষ্য।
২.
আচার্য মধুসূদন সরস্বতীর অদ্বৈতসিদ্ধি।
৩.
বেদান্তদর্শন অদ্বৈতবাদ, তৃতীয় খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
জুন
২০, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment