ব্রহ্মসূত্রের অনুকৃত্যধিকরণের প্রতিপাদ্য বিষয় ব্রহ্মচৈতন্যই জগতের প্রকাশক। "ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোঽয়মগ্নিঃ৷ তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।"-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২।২।১০) অর্থাৎ সেই স্থলে সূর্য প্রকাশিত হয় না, চন্দ্রমা এবং তারকা প্রকাশিত হয় না, এই বিদ্যুৎ সকল প্রকাশিত হয় না, এই অগ্নি আর কি প্রকারে প্রকাশিত হবে? প্রকাশমান্ তাঁকেই অনুকরণকরতঃ সমস্ত পদার্থ (জগৎ) প্রকাশিত হচ্ছে, তাঁর দীপ্তির দ্বারা এই সমস্ত বস্তু বিবিধরূপে প্রকাশ প্রাপ্ত হচ্ছে, মুণ্ডকাধ্যায়িগণ এইপ্রকার পাঠ করেন। উক্ত শ্রুতিবাক্যে প্রকাশমান্ যাঁকে অনুসরণকরতঃ সমস্ত বস্তু প্রকাশিত হচ্ছে এবং যাঁর দীপ্তির দ্বারা এই সমস্ত বিবিধরূপে প্রকাশপ্রাপ্ত হচ্ছে, তিনি কি কোন প্রকার জ্যোতির্ময় জড় পদার্থ অথবা প্রাজ্ঞ আত্মা (—জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মা)? এই প্রকার সন্দেহ হলে ভগবান সূত্রকার সিদ্ধান্ত করছেন—
অনুকৃতেস্তস্য
চ৷৷ -(ব্রহ্মসূত্র-১.৩.২২)
প্রাজ্ঞ
আত্মাই উক্তরূপে প্রতীয়মান বস্তু হওয়া উচিত। তাতে হেতু কি?
যেহেতু অনুকরণ করে, অনুকৃতি শব্দের
অর্থ অনুকরণ। 'তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বম্'
অর্থাৎ প্রকাশমান্ তাঁকেই অনুসরণকরতঃ সমস্ত পদার্থ প্রকাশিত হয়, উক্ত মুণ্ডক
শ্রুত্যোক্ত এই যে অনুভান,
এটাই অনুকরণ; তা স্বপ্রকাশ পরমাত্মা
গৃহীত হলে সঙ্গত হয়।
যেহেতু "ভারূপঃ সত্যসংকল্পঃ"-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৩.১৪.২)
চৈতন্যরূপ দীপ্তিই যাঁর রূপ, যাঁর
সঙ্কল্পসকল অমোঘ—এইপ্রকারে শ্রুতি
স্বপ্রকাশ পরমাত্মাকে পাঠ করছেন। অন্য
সমস্ত পদার্থ এই পরমাত্মার দীপ্তি
অবলম্বনেই প্রকাশিত হয়, এটাই ভাব।
কিন্তু সূর্য প্রভৃতি অন্য কোন উৎকৃষ্টতর
জড় জ্যোতির্ময় বস্তুর দীপ্তিকে অবলম্বন করে স্বয়ং প্রকাশিত
হয়, এটা প্রসিদ্ধ নয়।
ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য বলছেন—"যদুপলভ্যতে তৎসর্বং ব্রহ্মণৈব জ্যোতিষোপলভ্যতে; ব্রহ্ম তু নান্যেন জ্যোতিষোপলভ্যতে,
স্বয়ং জ্যোতিঃস্বরূপত্বাৎ" অর্থাৎ এই সংসারমণ্ডলে যা
কিছু উপলব্ধ হয়, সেই সমস্তই
ব্রহ্মরূপ জ্যোতির দ্বারাই উপলব্ধ হয়। স্বয়ংজ্যোতিঃস্বরূপ হন বলে
ব্রহ্ম কিন্তু অন্য জ্যোতির দ্বারা
উপলব্ধ (প্রকাশিত) হন না। "আত্মনৈবায়ং
জ্যোতিষাস্তে"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।৬) অর্থাৎ ইনি (—এই পুরুষ) আত্মরূপ
জ্যোতির দ্বারাই উপবেশন করেন, ইত্যাদি শ্রুতিসকল হতে এটা অবগত
হওয়া যায়।
আর
ভগবদ্গীতাতেও প্রাজ্ঞ আত্মারই এতাদৃশ স্বরূপ স্মৃত হয়েছে। যথা—"ন তদ্ভাসয়তে সূর্যো
ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ৷ যদ্গত্বা
ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম"-(শ্রীগীতা-১৫।৬) অর্থাৎ যাঁকে লাভ করলে সংসারে
আর পুনর্জন্ম হয় না, যা
চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি প্রকাশ
করতে পারে না, তাই
আমার পরমধাম (—স্বরূপ)। "যদাদিত্যগতং তেজো জগদ্ভাসয়তেঽখিলম্৷ যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ
তত্তেজো বিদ্ধি মামকম্৷"-(শ্রীগীতা-১৫।১২) অর্থাৎ যে জ্যোতিঃ সূর্যে,
চন্দ্রে ও অগ্নিতে আছে
এবং যা সমগ্র জগৎকে
প্রকাশ করে, সেই জ্যোতিঃ
আমার জানবে। অতএব
এটা সিদ্ধ হল যে পরমাত্মা
অন্য কর্তৃক প্রকাশিত হন না, কিন্তু
স্বয়ং সমস্ত বিশ্বের প্রকাশক।.....
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান শঙ্করাচার্য বিরচিত "শারীরকমীমাংসাভাষ্য"।
২.
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
"শাঙ্করভাষ্য"।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
জুন
২৩, রবিবার, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment