Friday, 23 May 2025

আচার্য বিমুক্তাত্মন্ ও ইষ্টসিদ্ধি—

 


খৃষ্টীয় নবম-দশম শতকে অব্যয়াত্ম ভগবানের শিষ্য বিমুক্তাত্মন্ ইষ্টসিদ্ধি নামক এক অতি উপাদেয় গ্রন্থ রচনা করেন। ইষ্টসিদ্ধি অদ্বৈতবেদান্তের সিদ্ধি নামাঙ্কিত চারখানা প্রসিদ্ধ গ্রন্থের (মণ্ডনমিশ্রের ব্রহ্মসিদ্ধি, সুরেশ্বরাচার্যের নৈষ্কর্মসিদ্ধি, বিমুক্তাত্মনের ইষ্টসিদ্ধি এবং মধুসূদন সরস্বতীর অদ্বৈতসিদ্ধি) মধ্যে একটি। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী যামুনাচার্য তাঁর আত্ম-সিদ্ধিতে আত্মার স্বরূপবিচার-প্রসঙ্গে ইষ্টসিদ্ধির প্রথম শ্লোকটি উদ্ধৃত করেছেন। আচার্য রামানুজ তদীয় শ্রীভাষ্যে অনুভূতিই আত্মার স্বরূপ, অনুভূতি এক, নিত্য অমেয় এবং স্বপ্রকাশ, এই অদ্বৈতমতের বিবরণে (পূর্বপক্ষের বিশ্লেষণে) ইষ্টসিদ্ধির ব্যাখ্যা বিচারশৈলীর অনুসরণ করেছেন বলে বেদান্তদেশিকাচার্য তৎকৃত তত্ত্বটীকায় উল্লেখ করেছেন। যামুনাচার্য দশম-একাদশ শতকে বিদ্যমান ছিলেন। রামানুজাচার্য একাদশ শতকে শ্রীভাষ্য রচনা করেন। সুতরাং আচার্য বিমুক্তাত্মন্ যে কোনমতেই দশম শতকের পরবর্তী হতে পারেন না, এটা নিঃসন্দেহ। বিমুক্তাত্মন্ ইষ্টসিদ্ধিতে সুরেশ্বরাচার্যের বার্তিক ভাস্কর-বেদান্ত-মতের উল্লেখ করেছেন। সুরেশ্বরাচার্য ভগবান্ শঙ্করাচার্যের সাক্ষাৎ শিষ্য। ভাস্করাচার্য ভগবান্ শঙ্করের কিছু পরবর্তী। তিনি খৃষ্টীয় নবম শতকের প্রথম ভাগে বিদ্যমান ছিলেন। এটা হতে বিমুক্তাত্মনের আবির্ভাবকাল যে নবম শতকের পূর্ব হতে পারে না এটাও নিঃসঙ্কোচে বলা যায়।

ইষ্টসিদ্ধির চিন্তার মৌলিকতা আছে। বিমুক্তাত্মনের পূর্ব পর্যন্ত আমরা যে সকল অদ্বৈতবাদী আচার্যের দার্শনিক মতের পরিচয় পেয়েছি, তন্মধ্যে মণ্ডনমিশ্র ব্যতীত অপর সকলই ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্য-ধারার ব্যাখ্যাতা মাত্র। স্বাধীনভাবে তর্কের ভিত্তিতে শঙ্করোক্ত অদ্বৈতবাদ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা ইষ্টসিদ্ধিতেই প্রথম দেখতে পাওয়া যায়। অনির্বাচ্যবাদের প্রতিষ্ঠা করাই বিমুক্তাত্মনের ইষ্ট। এই স্বাভীষ্ট তাঁর গ্রন্থে সিদ্ধি বা চরম পূর্ণতা লাভ করেছে বলেই তদীয় গ্রন্থকে ইষ্টসিদ্ধি বলা হয়ে থাকে। ইষ্টসিদ্ধি পরবর্তী দার্শনিকগণের চিন্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। খৃষ্টীয় দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতকে শ্রীহর্ষ, আনন্দবোধ, চিৎসুখাচার্য প্রভৃতির অবদানে অদ্বৈতবেদান্তে যে খণ্ডন-মণ্ডনযুগের বিকাশ হয়েছিল, বিমুক্তাত্মনই ছিলেন তার অগ্রদূত। চিৎসুখাচার্য তৎকৃত তত্ত্বপ্রদীপিকায়, অমলানন্দ স্বামী তদীয় বেদান্ত-কল্পতরুতে, বিদ্যারণ্য মুনীশ্বর তৎকৃত বিবরণ-প্রমেয়-সংগ্রহে, বেঙ্কটদেশিক সর্বার্থসিদ্ধিতে, পণ্ডিত রামাদ্বয় বেদান্ত-কৌমুদীতে ইষ্টসিদ্ধির উল্লেখ করেছেন। আনন্দবোধ ভট্টারকাচার্য তৎকৃত ন্যায়মকরন্দে বিভিন্ন দার্শনিকগণের স্বীকৃত খ্যাতিবাদ বা ভ্রমবাদের যে বিস্তৃত সমালোচনা করেছেন এবং অনির্বচনীয় মায়ার ব্যাখ্যায় যে মৌলিকতা প্রদর্শন করেছেন, তা বিমুক্তাত্মনের ইষ্টসিদ্ধিতে পূর্ণরূপেই দেখতে পাওয়া যায়। বিমুক্তাত্মনের নিকট আনন্দবোধের ঋণ অপরিশোধ্য। ইষ্টসিদ্ধির উপর আনন্দানুভবের জ্ঞানোত্তমের ইষ্টসিদ্ধি-বিবরণ নামে টীকা আছে। ইষ্টসিদ্ধি আটটি অধ্যায় বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত। গ্রন্থের আয়তনও বড় কম নয়। আট পরিচ্ছেদের মধ্যে প্রথম পরিচ্ছেদটিই অতি বিস্তৃত, গ্রন্থের অর্ধেকেরও বেশী। অপরাপর পরিচ্ছেদগুলো স্বল্পায়তন। এটা গদ্যে পদ্যে লিখিত। অনুষ্ঠুভ্ ছন্দে সংক্ষেপে যে দার্শনিক সমস্যার আলোচনা করা হয়েছে, তাই গদ্যে বিস্তৃতভাবে বিচার করে প্রতিপক্ষের মতের অসারতা প্রদর্শনপূর্বক সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইষ্টসিদ্ধির বিচারের গভীরতা গ্রন্থকারের সর্বতোমুখী প্রতিভা সুধীমাত্রেরই হৃদয় স্পর্শ করে। ইষ্টসিদ্ধি পাঠে জানা যায় যে বিমুক্তাত্মন্ প্রমাণবৃত্ত-নির্ণয় নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থের এখন আর কোন পরিচয় পাওয়া যায় না।...

তথ্যসূত্রঃ- "বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ", প্রথম খণ্ড, আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

এপ্রিল , ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

Photo editing credit Thakur Vishal

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...