খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা-শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল, তা কোন মতেই অস্বীকার করা যায় না। বিশেষকরে ন্যায় ও বৈশেষিকের আলোচনায় দেখা যায় যে, খৃষ্টীয় দশম শতকে বাঙ্গালী নৈয়ায়িক জয়ন্ত ভট্ট ন্যায়মঞ্জরী নামে সূক্ষ্ম বিচারবহুল গভীর গ্রন্থ রচনা করে ন্যায়মতের পুষ্টিসাধন করেন। উদয়নাচার্য আত্মতত্ত্ব-বিবেক, ন্যায়কুসুমাঞ্জলি, লক্ষণমালা, ন্যায়বার্তিক-তাৎপর্য-পরিশুদ্ধি, প্রশস্তপাদ-কৃত বৈশেষিক ভাষ্যের টীকা কিরণাবলী প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করে ন্যায় ও বৈশেষিকের চিন্তায় যুগান্তর আনয়ন করেন। ন্যায় ও বৈশেষিক আচার্যগণ দ্বৈতবাদী, জগৎ তাঁদের মতে মিথ্যা নয়, সত্য, সুতরাং অদ্বৈতবাদের সাথে ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনের বিরোধ চিরন্তন।
ঠিক
সেই সময় অদ্বৈতবেদান্তের আকাশে
এক নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটে। একাধারে অসামান্য
কবি ও দার্শনিক পণ্ডিত
শ্রীহর্ষাচার্য খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকে আবির্ভূত হন।
শ্রীহর্ষ মিশ্রের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের
প্রকরণ গ্রন্থের ধারা অবলম্বন করে
"খণ্ডনখণ্ডখাদ্য"
শীর্ষক গ্রন্থ প্রণয়ন। তাঁর এই খণ্ডন
গ্রন্থ দিয়ে তিনি প্রতিপক্ষ মত
বিধ্বস্ত করেছিলেন। শ্রীহর্ষ উদয়নকৃত লক্ষণাবলী হতে লক্ষণ উদ্ধৃত
করে খণ্ডন-খণ্ডখাদ্যে খণ্ডন করেছেন। শ্রীহর্ষের আক্রমণ এতই তীব্র হয়েছিল
যে, ন্যায় ও বৈশেষিক মত
তাঁর আক্রমণ-বেগে ছিন্নভিন্ন হয়ে
যায় এবং প্রতিপক্ষ-বিজয়ে
অদ্বৈতবাদ পূর্ণ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কবি শ্রীহর্ষ
তৎকৃত মহাকাব্য নৈষধ-চরিতের (নিষধ
দেশাধিপতি নল ও ভীমরাজ
তনয়া দময়ন্তীর প্রেমকাহিনী অবলম্বনে রচিত মহাকাব্যের) প্রতি
সর্গের সমাপ্তি শ্লোকে তাঁর পিতা মাতার
এবং তাঁর রচিত বিবিধ
গ্রন্থাবলীর পরিচয় প্রদান করেছেন। ঐ পরিচয়ের মূলে
জানা যায় যে, তাঁর
পিতার নাম শ্রীহীর পণ্ডিত
ও মাতার নাম মামল্লদেবী। নৈষধের
টীকাকার চাণ্ডু পণ্ডিতের উক্তি অনুসারে জানা যায় যে,
শ্রীহর্ষের পিতা পণ্ডিত শ্রীহীর
কোন এক সভায় উদয়নের
সাথে শাস্ত্রীয় বিচারে পরাজিত হয়েছিলেন। সেই পিতৃ অবমাননার
প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে এই খণ্ডন গ্রন্থে
উদয়নের অনেক লক্ষণ খণ্ডিত
হয়েছে।
গ্রন্থকার
স্বয়ং তাঁর জন্মস্থান সম্পর্কে
স্পষ্টভাবে কিছু উল্লেখ করেন
নি। অনেকে মনে করেন যে,
তিনি কান্যকুব্জীয়। কিন্তু অনেকে অনুমান করেন যে, তিনি
গৌড়দেশীয় বা বঙ্গদেশীয়। বর্তমান
ভারতের উত্তরবঙ্গের কিয়দংশ ও মিথিলার কিয়দংশ
একদা 'গৌড়দেশ' নামে বিখ্যাত ছিল।
তার রাজধানী লক্ষণাবতীর নিকটবর্তী কোন স্থানে শ্রীহর্ষ
জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এটাই তাঁদের অভিমত।
পরে তিনি কান্যকুব্জে গমন
করে স্বীয় পাণ্ডিত্যগুণে তদ্দেশীয় নৃপতি কর্তৃক পরম সম্মাণিত হয়ে
তদীয় সভাপণ্ডিতের পদ অলংকৃত করেছিলেন।
এই সময়ে মহারাজ বিজয়চন্দ্র ও তদন্তে তৎপুত্র
জয়চন্দ্র কান্যকুব্জের অধিপতি ছিলেন। শ্রীহর্ষ বিজয়চন্দ্রের প্রশংসাসূচক 'বিজয় প্রশস্তি' নামে একখানা গ্রন্থও
রচনা করেছিলেন।
তাছাড়া
শ্রীহর্ষ প্রণীত অন্যান্য গ্রন্থ হল— নবসাহসাঙ্ক চরিতম্
(নব বিক্রমাদিত্যরূপে প্রসিদ্ধ কোন রাজার বর্ণনা),
গৌড়োবীর্শকুল প্রশস্তিঃ (তৎকালীন গৌড়দেশাধিপতির বংশ বর্ণনাত্মক কাব্য),
অর্ণব বর্ণনম্, শিবশক্তিসিদ্ধিঃ, ঈশ্বরাভিসন্ধিঃ, ছন্দঃ প্রশস্তিঃ, স্থৈর্যবিচারণ প্রকরণম্ (বৌদ্ধসম্মত ক্ষণভঙ্গবাদের খণ্ডন)। তবে তাঁর
গ্রন্থরাজির মধ্যে নৈষধচরিত এবং খণ্ডনখণ্ডখাদ্যই প্রধান।
নৈষধচরিত শ্রীহর্ষের কবি প্রতিভার অপূর্ব
অবদান; খণ্ডনখণ্ডখাদ্য তাঁর দার্শনিক মনীষার
বিজয়-প্রশস্তি।
খণ্ডনখণ্ডখাদ্য
জগৎসত্যতাবাদী নৈয়ায়িকগণের মত খণ্ডনোদ্দেশ্যে রচিত
হয়েছে। এটাতে চারটি পরিচ্ছেদ আছে। প্রথম পরিচ্ছেদে
নৈয়ায়িক-সম্মত বিভিন্ন প্রমান এবং হেত্বাভাস প্রভৃতির
খণ্ডন করা হয়েছে। এই
পরিচ্ছেদটি অতিশয় বিস্তৃত। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে নিগ্রহস্থান প্রভৃতি লক্ষণের অসারতা প্রদর্শিত হয়েছে। তৃতীয় পরিচ্ছেদে সর্বনাম পদার্থের নির্বচন-প্রক্রিয়া খণ্ডিত হয়েছে। চতুর্থ পরিচ্ছেদে ন্যায়োক্ত দ্রব্য, গুণ প্রভৃতি ভাব
পদার্থ এবং অভাব পদার্থের
লক্ষণ খণ্ডন করে সমস্ত বস্তুই
যে অনির্বচনীয় এবং মায়াময় তা
আলোচিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে।
শ্রীহর্ষ এই গ্রন্থে অনির্বাচ্যবাদের
ভিত্তি সুদৃঢ় করেছেন। শ্রীহর্ষের এই খণ্ডন গ্রন্থের
দ্বারা কেবল যে পরমতখণ্ডনব্যসনী
ব্যক্তিই উপকৃত হবেন তা নয়,
পরন্তু যাঁরা নিঃস্পৃহ ও বীতরাগ, তাঁরাও
লব্ধ তত্ত্বজ্ঞানকে রক্ষা করতে সমর্থ হবেন।
এই খণ্ডন গ্রন্থই পরবর্তীকালে চিৎসুখাচার্যের 'প্রত্যক্ তত্ত্বপ্রদীপিকা' ও মধুসূদন সরস্বতীর
'অদ্বৈতসিদ্ধি' গ্রন্থের আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অদ্বৈতসিদ্ধি
ও চিৎসুখী গ্রন্থের বহুস্থলে শ্রীহর্ষের মত উদ্ধৃত হয়েছে।
তর্ক-কঠোর এই দুর্বোধ
গ্রন্থকে সহজবোধ্য করবার জন্য পরবর্তীকালে অনেক
টীকা রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে
চিৎসুখাচার্যের ভাবদীপিকা টীকা, আনন্দপুর্ণ বিদ্যাসাগরের খণ্ডনফক্বিকাবিভজনী (বিদ্যাসাগরী) টীকা, পদ্মনাভের শিষ্যহিতৈষিণী টীকা, বর্ধমান উপাধ্যায়ের খণ্ডন-প্রকাশ টীকা, শঙ্কর মিশ্রের আনন্দবর্ধনী (শাঙ্করী) টীকা, রঘুনাথ শিরোমণির খণ্ডন-দীধিতি টীকা, প্রগল্ভ মিশ্রের খণ্ডনদর্পণ টীকা, শুভঙ্কর মিশ্রের শ্রীদর্পণ, চরিত্রসিংহকৃত খণ্ডন মহাতর্ক, বিদ্যাভরণ বিরচিত বিদ্যাভরণী টীকা, ভবনাথকৃত খণ্ডনমণ্ডন, পরমানন্দ বিরচিত খণ্ডনমণ্ডন, শঙ্করচৈতন্য ভারতীর শারদা টীকা ও সূর্যনারায়ণ
শুক্লের খণ্ডনরত্নমালিকা উল্লেখযোগ্য। তবে আনন্দপূর্ণের বিদ্যাসাগরী
টীকাই পণ্ডিত সমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত।....
তথ্যসূত্রঃ-
১.
খণ্ডন-খণ্ডখাদ্যম্, প্রমাত্ব খণ্ডন, মহামহোপাধ্যায় শ্রী মোহন ভট্টাচার্য
তর্কবেদান্ত তীর্থ।
২.
বেদান্তদর্শন—অদ্বৈতবাদ, প্রথম খণ্ড, আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।....
শ্রীশুভ
চৌধুরী
মে
২৩, শুক্রবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।
Photo editing credit Thākur
Vishāl
No comments:
Post a Comment