Friday, 23 May 2025

বন্ধন স্বাভাবিক না নৈমিত্তিক?

 


অবিদ্যা নিমিত্তই প্রাণিগণের বন্ধন। শিষ্য গুরুকে প্রশ্ন করছেনগুরুদেব! এই বন্ধন, স্বাভাবিক, না নৈমিত্তিক? যদি স্বাভাবিক হয়, তবে আমার মুক্তির আশা নেই, কারণ স্বভাব অবর্জনীয়, স্বভাবের কখনোই পরিত্যাগ সম্ভব না।

গুরু বললেন, বৎস! বন্ধন স্বাভাবিক নয়, এটা নৈমিত্তিক। কি নিমিত্ত এটা হয় তা অবহিতচিত্তে শ্রবণ কর। অবিদ্যা নামে একটি পদার্থ আছে, এটা আত্মাকে আশ্রয় করে থাকে, আত্মাই এটার বিষয়, এটা আত্মার অনুভবগম্য এবং আত্মার দ্বারা প্রকাশ্য। এই অবিদ্যা অবস্তু অর্থাৎ এটার পারমার্থিক সত্তা নেই, এবং অনির্বচনীয়, এটাকে সৎ বা অসৎ বলে নির্দেশ করা যায় না। এই অবিদ্যা আত্মার আশ্রিতা এবং আত্মবিষয়া; এই বলে প্রবল হওয়ায় এটা সৎ, চিৎ, আনন্দ, অনন্ত এবং অদ্বিতীয়স্বভাব আত্মাকে আবৃত করে। যেমন গৃহাভ্যন্তরস্থিত অন্ধকার দ্বারা গৃহের অভ্যন্তর সমাচ্ছন্ন হয়, তদ্রূপ অবিদ্যা চিৎস্বরূপ কুটস্থ আত্মাকে আচ্ছাদনীয় বস্তুর ন্যায় আচ্ছাদিত করে বিক্ষিপ্ত অন্যরূপে প্রকাশ করে। অন্যরূপে প্রকাশমান ব্রহ্ম অর্থাৎ জীব, অনাত্মভূত দেহ-ইন্দ্রিয়াদিকে আত্মা বলে অভিমান করে, সুতরাং সমস্ত পুরুষার্থ হতে বঞ্চিত হয়ে অশেষ অনর্থজালে জড়িত হয় এবং অবিদ্যা-কল্পিত বিবিধ সাধন সহায়ে ইষ্টবিষয়ের প্রাপ্তি এবং অনিষ্টবৃত্তিবিষয়ে আকাঙ্ক্ষা যুক্ত হয়ে লৌকিক, বৈদিক এবং স্বাভাবিক নানাপ্রকার অনুষ্ঠানের দ্বারা কেবলমাত্র বিষয়সুখের আকাঙ্ক্ষা করে, সুতরাং মোক্ষবাসনা হৃদয়ে স্থান পায় না, ঈদৃশ জীব রাগ-দ্বেষাদি দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে মনুষ্য, তির্যগাদি পৃথক্ পৃথক্ নানা যোনিতে জন্মগ্রহণ করত মোহমুগ্ধ হয়ে সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এটাই শ্রুতি স্মৃতিতে নির্দিষ্ট হয়েছে। শ্রুতিতে বর্ণিত আছে

তং বিদাথ ইমা জজানান্যৎ যুষ্মাকমন্তরং বভূব। নীহারেণ প্রাবৃতা জল্প্যাঃ চাসুতৃপউক্থশাসশ্চরন্তি।।

-(ঋগ্বেদ সংহিতা, ১০ম মণ্ডল, ৮২ সুক্ত, মন্ত্র)

অর্থাৎ যিনি এই সমস্ত সৃষ্টি করেছেন, তোমরা তাঁকে জান না; যেহেতু তিনি তোমাদের পক্ষে অন্তর অর্থাৎ অভ্যন্তরস্থ হলেও অন্য হয়ে আছেন, অর্থাৎ যদ্যপি তিনি সর্বান্তর, তথাপি তোমরা তাঁকে আপনা হতে ভিন্ন করে রেখেছ। (এরূপ ভেদভ্রমের কারণ)— জল্প্যগণ, অর্থাৎ আমি দেবদত্ত, আমি মৈত্র, ইত্যাদি বাক্য ব্যবহারের বিষয়ীভূত জীবমাত্রেই কুজ্ঝটিকাবৎ সৎ বা অসৎ রূপে অনির্বচনীয় অজ্ঞানে আচ্ছন্ন হয়ে বিষয়সুখে মত্ত হয় সেই সুখাশাতেই 'উক্থ' নামক বিশেষ বৈদিক স্তোত্র পাঠরত হয়ে বিচরণ করেন।

স্মৃতিতে বর্ণিত আছে

পুরুষঃ প্রকৃতিস্থো হি ভুঙ্ক্তে প্রকৃতিজান্গুণান্

কারণং গুণসঙ্গোস্য সদসদ্যোনিজন্মসু ৷৷

-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ১৩/২২)

পুরুষ (ভোক্তা, ক্ষেত্রজ্ঞ) অবিদ্যালক্ষণা প্রকৃতিতে অবস্থিত হয়ে  সুখ-দুঃখ-কার্য-করণরূপে পরিণত মোহাকারে অভিব্যক্ত প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন এই সকল গুণেতে আত্মভাবই পুরুষের দেবাদি সৎ জন্ম পশ্বাদি অসৎ জন্ম সদসদ্যোনিরূপ মনুষ্য-জন্ম-গ্রহণের প্রধান কারণ।......

তথ্যসূত্রঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বিরচিত "অজ্ঞানবোধিনী" পণ্ডিতপ্রবর পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত শিবাবতার শঙ্করাচার্যের গ্রন্থমালা দ্বিতীয় খণ্ড।

শ্রীশুভ চৌধুরী

মে ১৬, শুক্রবার, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

Photo editing credit Thākur Vishāl

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...