Sunday, 29 June 2025

শ্রীরাম তীর্থ—

 


মধুসূদন সরস্বতীর বিদ্যা গুরু ছিলেন আচার্য শ্রীরাম তীর্থ। "শ্রীরাম বিশ্বেশ্বর-মাধবানাম্" মন্ত্রে গুরু প্রণাম জ্ঞাপন করেছেন মধুসূদন সরস্বতী তদীয় অদ্বৈতসিদ্ধি গ্রন্থের মঙ্গলাচরণে। মধুসূদন বেদান্তগুরুর সন্ধানে কাশীধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। কাশীধাম জ্ঞান পীঠ। মধুসূদন কাশীধামে আগমন করে অবলোকন করলেনএই ধাম বিশ্ব বিশ্রুত সর্বশাস্ত্র পারঙ্গম সারস্বত মণ্ডলী দ্বারা পরিশোভিত। মধুসূদনের কাশীধামে আগমনের হেতু, বেদান্তমীমাংসা দর্শনে জ্ঞানার্জন। তিনি দেখতে পেলেন গঙ্গার ঘাট, সন্ন্যাসীর মঠ, মন্দির প্রাঙ্গণ সর্বত্র নিরন্তর বেদবেদান্তাদি শাস্ত্রালোচনায় বিচার-দ্বন্দ সভায় মুখরিত। তৎকালীন সময়ে শ্রীরাম তীর্থ, নৃসিংহাশ্রম, উপেন্দ্র আশ্রম, নারায়ণ ভট্ট, অপ্পয় দীক্ষিত প্রমুখ দিগ্বিজয়ী সাধু সারস্বতগণ কাশীধামে অবস্থান করে এই পুণ্যতীর্থের মাহাত্ম্য বৃদ্ধি করেছেন স্বীয় জ্ঞান সাধনায়। শ্রীরাম তীর্থ মধুসূদনের সদাচার, সোম্যমূর্তি, ন্যায়-শাস্ত্রে তীক্ষ্ণ বিচার ধারা কবিত্ব শক্তি দর্শনে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে বেদান্তের বিদ্যার্থীরূপে গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। পরমেশ্বর শ্রীবিশ্বনাথ শিবের কৃপায় মণি-কাঞ্চন যোগ হল এইখানে।

শ্রীরাম তীর্থের সময় ১৪৭৫-১৫৭৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে অনুমান করা যায়। শ্রীরাম তীর্থের গুরু ছিলেন কৃষ্ণ তীর্থ। শ্রীরাম তীর্থ মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পরম ভক্ত ছিলেন। শ্রীরাম তীর্থ বেদান্ত দর্শনের শারীরক টীকা অন্বয়ার্থ প্রবেশিকার প্রারম্ভে লিখেছেন

সত্যজ্ঞান সুখাত্মকেঽখিল মনোহর স্থানু ভূত্যত্মনি।

শ্রীরামে রমতাং মনো মম সদা হেমাম্বুজৈহংসবৎ।

এই গ্রন্থে শ্রীরাম বন্দনা ব্যতীত বিদ্বন্মনোরঞ্জিনী গ্রন্থের সমাপ্তি শ্লোকেও শ্রীরামচন্দ্রের সহিত অভিন্নরূপে নিজেকে স্থাপন করতে বিস্মরণ ঘটে নি তাঁর। কাশীধামের সন্নিকটবর্তী অযোধ্যা। সুতরাং তাঁর উপর অযোধ্যাপতি শ্রীরামচন্দ্রের প্রভাব পড়া স্বাভাবিক।

শ্রীরাম তীর্থের রচিত গ্রন্থাবলী

. পদ যোজনিকা, এটা ভগবান্ শঙ্করাচার্যকৃত উপদেশ সাহস্রীর টীকা।

. শারীরক টীকা, অন্বয়ার্থ প্রবেশিকা।

. সুরেশ্বরাচার্য কৃত দক্ষিণামূর্তি বার্তিক টীকা, এই বার্তিক শঙ্করাচার্যের দশশ্লোকীর উপর লিখিত ছিল।

. শারীরক রহস্যার্থ তত্ত্ব প্রবেশিকা।

. সদানন্দ যোগীন্দ্রের বেদান্তসারের উপর বিদ্বন্মনোরঞ্জনী টীকা।

. বাক্যার্থ দর্পণ, এটা শারীরক শাস্ত্রার্থ সংগ্রহরূপ।

এইসব দুরহ গ্রন্থ প্রণয়ন দ্বারাই শ্রীরাম তীর্থের গভীর বিদ্যাবত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি তৎকালীন সারস্বত সমাজের উজ্জ্বল মার্তণ্ড ছিলেন। অদ্বৈতবেদান্তের শ্রীবৃদ্ধি সাধনে এই আচার্যের অবদান অপরিসীম।....

তথ্যসূত্রঃ- "অদ্বৈত সিদ্ধি, মধুসূদন সরস্বতী", শ্রীব্যোমকেশ ভট্টাচার্য, ভাগবত-রত্ন।

শ্রীশুভ চৌধুরী

জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা, জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ।

Photo editing credit Thākur Vishāl

সদানন্দ যোগীন্দ্র ও বেদান্তসার—

 


নব্যন্যায়ের অভ্যুত্থান, বৈষ্ণব মতের জাগরণ সাংখ্যমতের বিকাশ প্রভৃতির ফলে খৃষ্টীয় পঞ্চদশ ষোড়শ শতকে অদ্বৈতবাদের সাথে যে বাদযুদ্ধ ঘনীভূত হয়ে আসছিল, সেই যুগে অদ্বৈতবাদী আচার্য নৃসিংহাশ্রম, মল্লনারাধ্যাচার্য, অপ্পয় দীক্ষিত সদানন্দ যোগীন্দ্র প্রভৃতি আচার্যগণ অগ্রসর হয়ে তাঁদের প্রতিভার অমল জ্যোতিতে সর্বপ্রকার অদ্বৈত বিরোধী সিদ্ধান্তের অন্ধকাররাশি ভেদ করে অদ্বৈত ব্রহ্মবিদ্যার গৌরব-পতাকা বহন করে।

খৃষ্টীয় ১৫শ-১৬শশতাব্দীতে আচার্য সদানন্দ যোগীন্দ্র আবির্ভূত হন। তাঁর কর্মস্থল ছিল কাশীধাম। তাঁর গুরুর নাম ছিল অদ্বয়ানন্দ সরস্বতী। আচার্যের অদ্বিতীয় কীর্তি হল 'বেদান্তসার' গ্রন্থ। আসমুদ্রহিমাচল ভারতের সর্বত্র এই 'বেদান্তসার' গ্রন্থ বেদান্তের পাঠ্য। অদ্বৈতবেদান্তের গূঢ়তত্ত্বের সারমর্ম আচার্য এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। পরবর্তীকালে অনেক দার্শনিক আচার্য এই বিখ্যাত গ্রন্থের উপর টীকা রচনা করেছেন। খৃষ্টীয় ১৭শ শতকে মীমাংসক আচার্য আপোদেব বেদান্তসারের উপর বালবোধিনী নামে টীকা রচনা করেন। জগন্নাথ আশ্রমের শিষ্য, নৃসিংহাশ্রমের সতীর্থ শ্রীরামতীর্থ বেদান্তসারের উপর বিদ্বন্মনোরঞ্জিনী নামে টীকা রচনা করেন। অনেকের মতে এই রামতীর্থ স্বামী মধুসূদন সরস্বতীর বিদ্যা গুরু। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে আচার্য নৃসিংহ সরস্বতী সদানন্দের বেদান্তসারের উপর সুবোধিনী নামে টীকা রচনা করে অদ্বৈতবাদের শ্রীবৃদ্ধি করেছিলেন।

বেদান্তসার ব্যতীত সদানন্দ যোগীন্দ্রের আরেকটি কীর্তি হল 'শঙ্কর বিজয়' এই গ্রন্থ রচনা করে সদানন্দ যোগীন্দ্র ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্য ধারার পুষ্টিসাধনের পাশাপাশি জগদ্গুরু শঙ্করের দিব্য লীলারও বিশেষ প্রচার সাধন করেন। কাশ্মীর হতে কুমারিকা, আবার গুর্জর হতে প্রাগজ্যোতিষপুর পর্যন্ত সদানন্দ যোগীন্দ্রের এই কীর্তি বিঘোষিত।....

তথ্যসূত্রঃ- "অদ্বৈত সিদ্ধি, মধুসূদন সরস্বতী", শ্রীব্যোমকেশ ভট্টাচার্য, ভাগবত-রত্ন।

শ্রীশুভ চৌধুরী

জুন , ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

Photo editing credit Thākur Vishāl

আনন্দবোধ ভট্টারকাচার্য ও ন্যায়মকরন্দঃ-

 


খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকে শ্রীহর্ষের পাশাপাশি আরও একটি নক্ষত্রের আবির্ভাব হয়েছিল অদ্বৈতবেদান্তের আকাশে। আনন্দবোধ ভট্টারকাচার্য, যিনি দক্ষিণ দেশে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। আনন্দবোধেন্দ্র ভট্টারকাচার্যের অন্যতম কীর্তি হল 'ন্যায়মকরন্দ', 'প্রমাণমালা', 'ন্যায়-দীপাবলী' নামক তিনখানা অতুল্য গ্রন্থ প্রণয়ন। তৎকালীন সময়ে নব্যন্যায়মত যখন প্রবলাকার ধারণ করে তখন নৈয়ায়িকগণের সূক্ষ্ম বিচারশৈলী অনুসরণ করে প্রতিপক্ষ মত খণ্ডনে স্বীয় অদ্বৈত মত-স্থাপনে তিনি বদ্ধপরিকর হন। ন্যায়মকরন্দে আনন্দবোধ অকপটচিত্তে স্বীকার করেছেন যে, পূর্ববর্তী নিবন্ধকারগণের নিবন্ধ-কুসুমাকর হতে নির্মল ভাব-কুসুম আহরণ করে তিনি তাঁর চিন্তার কুসুমদাম রচনা করেছেন। আনন্দবোধের উক্তি হতে তার পূর্বেও যে বিবিধ অদ্বৈতবেদান্ত-নিবন্ধ রচিত হয়েছিল, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু সকল গ্রন্থরাজির এখন আর বিশেষ কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না।

উল্লেখিত গ্রন্থ তিনখানার মধ্যে ন্যায়মকরন্দই আয়তনে নাতিবৃহৎ এবং প্রমেয়বহুল। আনন্দবোধ তদীয় ন্যায়মকরন্দে ভ্রমজ্ঞানের ব্যাখ্যায় ন্যায়, মীমাংসা, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি দর্শনের বিভিন্ন খ্যাতিবাদ বা ভ্রমবাদের যুক্তিজাল আলোচনা করে সকল মতের অসারতা প্রদর্শন করে স্বীয় অনির্বাচ্য খ্যাতিবাদ সুদৃঢ় যুক্তির সাথে স্থাপন করেন। খণ্ডন মণ্ডন এই দুই প্রকার চিন্তাধারাই আনন্দবোধের গ্রন্থে তরঙ্গায়িত হয়ে সুধীগণের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই গ্রন্থখানা পরবর্তী দার্শনিক আচার্যগণেরও অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ন্যায়মকরন্দের উপর চিৎসুখাচার্য তাঁর শিষ্য সুখপ্রকাশ ন্যায়মকরন্দ-টীকা ন্যায়মকরন্দ-বিবেচনী নামে টীকা রচনা করেছেন। সুখপ্রকাশ ন্যায়দীপাবলীর উপরও ন্যায়দীপাবলী-তাৎপর্য টীকা রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। আনন্দজ্ঞানের গুরু অনুভূতি স্বরূপাচার্য আনন্দবোধের তিনখানা গ্রন্থেরই টীকা রচনা করেছিলেন বলে শোনা যায়। দ্বৈতবেদান্ত-কেশরী ব্যাসতীর্থ তদীয় ন্যায়ামৃতে মায়াবাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তাতে তিনি আনন্দবোধ ভট্টারকাচার্যকে অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষরূপে গ্রহণ করে আনন্দবোধের যুক্তিজাল ছিন্নভিন্ন করার প্রয়াস করেছিলেন। এটা হতেই অদ্বৈত চিন্তায় আনন্দবোধের দান কতটা মহার্ঘ, তা বুঝতে পারা যায়।

তথ্যসূত্রঃ- বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, প্রথম খণ্ড, আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

মে ৩০, ২০২৫ খৃষ্টাব্দ।

Photo editing credit Thākur Vishāl

আত্মানাত্মবিবেকঃ-

  আত্মা ও অনাত্মা অর্থাৎ আত্মা ভিন্ন দেহের পৃথকত্বের বিবেকবোধই আত্মানাত্মবিবেক। দেহকেই আমরা ' আমি ' ভাবিয়া থাকি। ...