Friday, 27 September 2019

মহামোহ কি?


শ্রীমহাভারতের উদ্যোগপর্বের দ্বি-চত্বারিংশোহধ্যায়ের সনৎ-সুজাতীয় সম্বাদে ব্রহ্মার মানসপুত্র চিরকুমার পরমপ্রাচীন সনাতন ঋষি সনৎ-সুজাত ধৃতরাষ্ট্রের বিবিধ প্রশ্নোত্তরে বলিতেছেন-

তদ্বৈ মহামোহনমিন্দ্রিয়াণাং মিথ্যার্থযোগেহস্য গতিহির্নিত্যা।

মিথ্যার্থযোগাভিহতান্তরাত্মা স্মরন্নুপাস্তে বিষয়ান্ সমস্তাৎ।।১০।।

ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- ভোগ্য বিষয়ে ইন্দ্রিয়সমূহের যে প্রবৃত্তি তাহাই মহামোহ। বিষয়ে সত্যত্ববুদ্ধি থাকিলেই উহা লাভের প্রবৃত্তি হয়। বিষয়ে প্রবৃত্তি না হইয়া আত্মাতেই যাহার প্রবৃত্তি তাহারই মোহ নিবৃত্তি হইয়া থাকে। মিথ্যাবিষয়ানুরাগী পুরুষের নিয়ত সংসারগতিই হইয়া থাকে। কারণ ঐ বিষয়ানুরক্তি জীবকে স্বীয় ব্রহ্মভাব হইতে বিচ্যুত করিয়া থাকে এবং জীব তখন সর্বতোভাবে বিষয়সমূহ স্মরণ করিতে করিতে বিষয়-চিন্তাতেই সদা মগ্ন হয়।

Thursday, 19 September 2019

শঙ্করাচার্য্যের কিছু অমৃত বাণী, পর্ব-০৭ঃ-


৩৬.'আত্মপ্রশংসার অভাব, দম্ভের অভাব ইত্যাদি ভগবদ্গীতোক্ত গুণসমূহ; শৌচাদি নিয়মসমূহ; অহিংসাদি যম প্রভৃতি; শ্রদ্ধা, ভক্তি, মুমুক্ষুতা, ভগবদ্গীতোক্ত অভয়, সত্ত্বসংশুদ্ধি প্রভৃতি বিভিন্ন দৈবী সম্পদ, অসদাচারণ ত্যাগ প্রভৃতি গুণ মিশ্র সত্ত্বগুণ হইতে উৎপন্ন হয়।'
-শঙ্করাচার্য্য (বিবেকচূড়ামণি-১১৮)
৩৭. 'চিত্তের প্রসন্নতা, স্ব-আত্ম অনুভূতি, পরম প্রশান্তি, তৃপ্তি, উত্তম আহ্লাদ এবং পরমাত্মনিষ্ঠা-এইসকল শুদ্ধ সত্ত্বগুণের কাজ। যার ফলে সদানন্দরস প্রাপ্তি হয়'
-শঙ্করাচার্য্য (বিবেকচূড়ামণি-১১৯)
৩৮.'অজ্ঞান, আলস্য, জড়ত্ব, নিদ্রা, প্রমাদ, নির্বুদ্ধিতা প্রভৃতি তমোগুণের কাজ। এইসবের দ্বারা সংসৃষ্ট পুরুষ কিছুই জানে না, কিন্তু নিদ্রিত ব্যক্তি বা স্তম্ভের মত জড়বৎ অবস্থান করে।'
-শঙ্করাচার্য্য (বিবেকচূড়ামণি-১১৬)
৩৯.'কাম, ক্রোধ, লোভ, দম্ভ, দর্পপ্রভৃতি, অসূয়া, ঈর্ষা, মাৎসর্য প্রভৃতি ঘোরবৃত্তিসমূহ রজোগুণ হইতে উৎপন্ন হয়। তাই রজোগুণ বন্ধনের কারণ।'
-শঙ্করাচার্য্য (বিবেকচূড়ামণি-১১২)

'শ্রীশিবমানসপূজা'


শঙ্করাচার্য্য বিরচিত 'শ্রীশিবমানসপূজা' ও ইহার ভাবার্থঃ-
রত্নৈঃ কল্পিতমাসনং হিমজলৈঃ স্নানং চ দিব্যাম্বরং
নানারত্নবিভূষিতং মৃগমদামোদাঙ্কিতং চন্দনম্ ।
জাতীচম্পকবিল্বপত্ররচিতং পুষ্পং চ ধূপং তথা
দীপং দেব দয়ানিধে পশুপতে হৃত্কল্পিতং গৃহ্যতাম্ ॥ ১॥

বহুবিধ রত্ন রচিত সুন্দর আসন, শীতল স্নানীয় জল, মনোহর বস্ত্ৰ, নানাবিধ রত্নময় আভরণ, মৃগমদসৌরভযুক্ত চন্দন, জাতী, চম্পক বিল্বপত্র যুক্ত নানাবিধ পুষ্প, ধূপ ও দীপ আমি মনে মনে আয়োজন করিয়াছি হে দয়ানিধি! হে দেব! হে পশুপতে, তুমি গ্ৰহণ কর।১
সৌবর্ণে নবরত্নখণ্ডরচিতে পাত্রে ঘৃতং পায়সং
ভক্ষ্যং পঞ্চবিধং পয়োদধিয়ুতং রম্ভাফলং পানকম্ ।
শাকানাময়ুতং জলং রুচিকরং কর্পূরখণ্ডোজ্জ্বলং
তাম্বূলং মনসা ময়া বিরচিতং ভক্ত্যা প্রভো স্বীকুরু ॥ ২॥

মণি খণ্ড ও রত্ন দ্বারা খচিত সুবৰ্ণময় পাত্রে আমি ভক্তি পুৰ্ব্বক ঘৃত, পায়স, পঞ্চবিধ খাদ্য, দধি, দুগ্ধ, রম্ভা ও পনস (কঁটাল) ফল, বহুবিধ শাক, সুস্বাদু কর্পূরসুবাসিত জল ও তাম্বূল মনে মনে সংগ্ৰহ করিয়াছি ও রচনা করিয়াছি প্রভো, তুমি গ্ৰহণ কর।২
ছত্রং চামরয়োর্যুগং ব্যজনকং চাদর্শকং নির্মলং
বীণাভেরিমৃদঙ্গকাহলকলা গীতং চ নৃত্যং তথা ।
সাষ্টাঙ্গং প্রণতিঃ স্তুতির্বহুবিধা হ্যেতত্সমস্তং ময়া
সঙ্কল্পেন সমর্পিতং তব বিভো পূজাং গৃহাণ প্রভো ॥ ৩॥

ছত্ৰ, চামর যুগল, ব্যজন, নিৰ্ম্মল দৰ্পণ, বীণা, ভেরী, মৃদঙ্গ কাহল প্ৰভৃতি বাদ্য, কলাসংযুক্ত গীত এবং নৃত্য, সাষ্টাঙ্গ প্ৰণাম, বহুবিধ স্তব, এই সমস্তই প্ৰভো আমি মানস কল্পনায় তোমাকে সমৰ্পণ করিলাম। হে বিভো ! তুমি পুজা গ্ৰহণ কর।
আত্মা ত্বং গিরিজা মতিঃ সহচরাঃ প্রাণাঃ শরীরং গৃহং
পূজা তে বিষয়োপভোগরচনা নিদ্রা সমাধিস্থিতিঃ ।
সঞ্চারঃ পদয়োঃ প্রদক্ষিণবিধিঃ স্তোত্রাণি সর্বা গিরো
য়দ্যত্কর্ম করোমি তত্তদখিলং শম্ভো তবারাধনম্ ॥ ৪॥

আমি যাহাকে আত্মা বা আমি বলি এই আত্মাই তুমি, আর আমার (সতত নৃত্যশালিনী) মতিই গিরিজা, আর পঞ্চ (ভূতময়) প্ৰাণ তোমার সহচর, আমার এই শরীর তোমার পূজামণ্ডপ, বিষয়ভোগরূপ কার্য্যকলাপ তোমার পূজা, আর আমি যে নিদ্রা যায় ইহা তোমাতেই সমাধিলাভ, আমার এই পদসঞ্চালন ইহা তোমারই প্ৰদক্ষিণবিধি, যাহা কিছু কথা বলি সে সমস্তই তোমার স্তব, যে কৰ্ম্ম আমি করি, শম্ভো! সে সমস্তই তোমার আরাধনা ৷
করচরণ কৃতং বাক্কায়জং কর্মজং বা ।
শ্রবণনয়নজং বা মানসং বাপরাধম্ ।
বিহিতমবিহিতং বা সর্বমেতত্ক্ষমস্ব ।
জয় জয় করুণাব্ধে শ্রীমহাদেবশম্ভো ॥ ৫॥

আমি হস্তপদাদি দ্বারা বা বাক্য ও শরীর দ্বারা অথবা কর্ম্ম দ্বারা যে পাপ করিয়াছি, চক্ষু কৰ্ণ ও মনের অসাবধানতায় আমার যে অপরাধ হইয়াছে, তাহা আমার বিদিতই হউক বা অবিদিতই হউক হে দয়াসিন্ধো, তুমি সে সমস্ত ক্ষমা কর, হে শম্ভো! শ্ৰীমহাদেব! তোমার জয় হউক।৫
॥ ইতি শ্রীমচ্ছঙ্করাচার্যবিরচিতা শিবমানসপূজা সমাপ্তা ॥
ইতি শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য বিরচিত শিবমানসপূজা সমাপ্ত।

Friday, 13 September 2019

শ্রীভগবানের 'কেশব' নাম মাহাত্ম্যঃ-


শ্রীমহাভারতে অনুশাসনপর্ব্বণি 'বিষ্ণুসহস্রনাম স্তোত্রম্' এর শঙ্করাচার্য্য কৃত শাঙ্করভাষ্যে শ্রীভগবানের 'কেশব' নাম মাহাত্ম্য বর্ণিত আছে এইভাবে-
বিষ্ণুপুরাণে (৫।১৬।২৩) শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নারদের বচন-'হে জনার্দন! যেহেতু তুমি দুষ্টাত্মা কেশীকে বিনাশ করেছ, সেইহেতু লোকে তোমাকে কেশব নামে পরিজ্ঞাত হবে।'
-(শঙ্করভাষ্য, বিষ্ণুসহস্রনাম ১৬)

সূর্যাদি সংক্রান্ত অংশু সকল ইঁহার কেশস্বরূপ সেইহেতু ইহাকে কেশব বলা হয়ে থাকে। মহাভারতে (শান্তিপর্ব-৩৪১।৪৮) আছে,হরি বলছেন-'যেসব কিরণ প্রকাশিত হচ্ছে এইসবই আমার কেশ, অতএব সর্বজ্ঞ ব্যক্তিরা আমার কেশব নাম কীর্ত্তন করে থাকে।'
অথবা 'ত্রয় কেশিনঃ' ইতি শ্রুতেঃ। অর্থাৎ ব্রহ্মা,বিষ্ণু,মহেশ ইঁহাদের শক্তিত্রয়ই কেশ সংজ্ঞক এবং এই শক্তিত্রয়রূপ কেশ বিশিষ্ট বলে কেশব নাম হয়েছে। বিষ্ণুপুরাণের অন্যত্র (৫।১।৬১) আছে-'বসুধাতলে আমার কেশদ্বয় (ব্রহ্মা ও মহেশ) আছে।' এই কেশ শব্দটি ভগবানের শক্তিবাচক হিসেবে প্রয়োগ হয়েছে।
-(শঙ্করভাষ্য, বিষ্ণুসহস্রনাম ৮২)
......................................................................................................
নারায়ণং নমস্কৃত্য নরং চৈব নরোত্তমম্।
দেবীং সরস্বতীং চৈব (ব্যাসং) ততো জয়মুদীরয়েৎ ॥ ১-১-১ (১)

॥ শ্রীবেদব্যাসায় নমঃ॥ শ্রীশঙ্করভগবত্পাদাচার্যস্বামিনে নমঃ ॥

Thursday, 12 September 2019

পরব্রহ্মের স্বরূপঃ-

শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ উত্তর মীমাংসা বেদান্তদর্শনের উভয়লিঙ্গাধিকরণের সিদ্ধান্ত হইল নির্বিশেষ ব্রহ্মই বেদান্ত প্রতিপাদ্য, সবিশেষতা উপাসনার সৌকর্যের জন্য। ব্রহ্মসূত্রের তৃতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদে বর্ণিত আছে-

ন স্থানতোপি পরস্যোভয়লিঙ্গং সর্বত্র হি৷৷ ব্রহ্মসূত্র- ৩.২.১১৷৷

ভগবৎপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ-ব্রহ্মবিষয়ক উভয়লিঙ্গক অর্থাৎ সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয়প্রকার ব্রহ্মজ্ঞাপক শ্রুতিসকল আছে। যথাঃ-

'সর্বকর্মা সর্বকামঃ সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৩।১৪।২)

'সমস্ত জগৎ যাহার কর্ম্ম, যিনি সর্ব্ববিধ বিশুদ্ধ কামনাবান্, সকলপ্রকার সুখকর গন্ধযুক্ত, সকল প্রকার উত্তম রসযুক্ত'- ইত্যাদি এই সকল শ্রুতি সবিশেষ লিঙ্গ অর্থাৎ সবিশেষ ব্রহ্মের জ্ঞাপক।

পুনশ্চ বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ এর শ্রতি বলিতেছে-

'অস্থূলমনণ্বহ্রস্বমদীর্ঘম্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ৩।৮।৮)

'ইনি স্থুল নহেন, অণু নহেন, হ্রস্ব নহেন, দীর্ঘ নহেন', এইসকল নির্বিশেষ ব্রহ্মের জ্ঞাপক। এই শ্রুতিসকলে কি ব্রহ্মকে সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয়লিঙ্গরূপে বুঝিতে হইবে, অথবা উভয়ের মধ্য যে কোন একরূপে বুঝিতে হইবে?

তাহা হইলে তিনি কি সবিশেষ, অথবা নির্বিশেষ,-ইহা মীমাংসা করা হইতেছে। তাহাতে পূর্ব্বপক্ষীয়রা বলেন দুইপ্রকার শ্রুতি থাকায় ব্রহ্ম সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয়াত্মক।

এই প্রকার পূর্ব্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে বলিতেছি-'পরের' অর্থাৎ সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মের স্বভাবতঃ উভয়লিঙ্গতা অর্থাৎ সবিশেষ ও নির্বিশেষ উভয়াত্মক হওয়া যুক্তিযুক্ত নহে। যেহেতু একই বস্তুর স্বভাবতঃই রূপাদি বিশেষযুক্ত এবং তাহার বিপরীত, ইহা অবধারণ করিতে পারা যায় না, কারণ বিরোধ হইয়া পড়ে।

শঙ্কা হইল-আচ্ছা, তাহা হইলে 'স্থানবশতঃ' অর্থাৎ পৃথিবী প্রভৃতি উপাধির সহিত সম্বন্ধবশতঃ (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।১)'ব্রহ্মের সবিশেষতা সিদ্ধ হইবে'। সমাধান হইল-তাহাও সঙ্গত নহে। যেহেতু উপাধির সহিত সম্বন্ধ হইলেও একপ্রকার স্বভাব সম্পন্ন বস্তুর অন্যপ্রকার স্বভাব সম্ভব নহে। দেখ, স্ফটিক স্বচ্ছ হওয়ায় আলতা প্রভৃতি উপাধি সহিত সম্বন্ধবশতঃ কদাপি অস্বচ্ছ হয় না, যেহেতু তাহাতে অস্বচ্ছতা বিষয়ক অভিনিবেশ জ্ঞান ভ্রমমাত্র।

আর যেহেতু উপরিউক্ত ছান্দোগ্য শ্রুতির ব্রহ্মের সবিশেষতা সম্পাদক গন্ধ ও রূপরসাদি উপাধিসকল অবিদ্যা কর্তৃক প্রত্যুপস্থাপিত। আর সেইহেতু অন্যতর লিঙ্গের পরিগ্রহ হইলেও সমস্তবিশেষরহিত নির্বিকল্পরূপেই ব্রহ্মকে অবগত হইতে হইবে, তাহার বিপরীতরূপে নহে। যেহেতু সকল স্থলেই অর্থাৎ উপনিষদ্ সকলে ব্রহ্মস্বরূপ প্রতিপাদনপর 'অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ম্'-(কঠ উপনিষদ্-১।৩।১৫) অর্থাৎ 'শব্দরহিত, স্পর্শরহিত, রূপবিহীন, ক্ষয়রহিত' ইত্যাদি এই বাক্যসকলে যাঁহা হইতে সমস্ত বিশেষ নিরাকৃত হইয়াছে, সেই ব্রহ্মই উপদিষ্ট হইতেছেন।

 

শ্রীভারতী তীর্থকৃত বৈয়াসিক ন্যায়মালাঃ-
ব্রহ্ম কিং রূপি চারূপং ভবেন্নীরূপমেব বা।
দ্বিবিধ শ্রুতি সদ্ভাবাদ্ব্রহ্মস্যাদুভয়াত্মকম্।।
নীরূপমেব বেদান্তৈ প্রতিপাদ্যমপূর্ব্বতঃ।
রূপং ত্বনুদ্যতে ভ্রান্তমুভয়ত্বং বিরুধ্যতে।।

Friday, 6 September 2019

শঙ্করাচার্য্যের কিছু অমৃত বাণী, পর্ব-০৬ঃ-


৩১.'দেহবাসনা ও লোকজনের প্রিয় হওয়ার চেষ্টায় শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন এবং তাহা প্রকাশের ইচ্ছা থাকিলে যথার্থ জ্ঞান জন্মাইতে পারে না।'
-শঙ্করাচার্য্য (বিবেকচূড়ামণি-২৭১)
৩২.'প্রিয় বা অপ্রিয় বিষয়ের প্রাপ্তি হইলে সমদর্শিতাবশতঃ সুখ বা দুঃখ উভয়বিষয়ে মনে হর্ষ-বিষাদের অভাব জীবন্মুক্তের লক্ষণ।'
-শঙ্করাচার্য্য (বিবেকচূড়ামণি-৪৩৪)
৩৩,যিনি দেহে, ইন্দ্রিয়াদিতে এবং গৃহধনাদি বিষয়ক কর্তব্য কর্মে 'আমি আমার'-এইরূপ অহংভাব বর্জিত এবং রাগদ্বেষরহিত তিনিই জীবন্মুক্ত।
-শঙ্করাচার্য্য (বিবেকচূড়ামণি-৪৩৬)
৩৪.'হে বিষ্ণো ! আমার অবিনয় অপনয়ন কর, মনকে দমন কর, বিষয় মৃগতৃষ্ণার শান্তিবিধান কর, সৰ্ব্বজীবে আমার দয়া বিস্তার কর এবং আমাকে ভবসমুদ্র হইতে উদ্ধার কর।'
-শঙ্করাচার্য্য (শ্রীবিষ্ণুষট্পদী-১)
৩৫.'ছেড়ে এবার অর্থবাসনা ,
জাগ - মন ও জাগুক , হয়ে ইচ্ছাবিহীনা ,
সন্তুষ্ট হ' মনে - নিজ শ্রম-উপার্জনে ,,
কায়মনোবাক্যে হোক সাধা .....
গোবিন্দের নাম গা ।।
ভজ গোবিন্দম্ ভজ গোবিন্দম্
গোবিন্দম্ ভজ মূঢমতে ।'
-শঙ্করাচার্য্য ('ভজগোবিন্দম্'-২)

Thursday, 5 September 2019

'শ্রীবিষ্ণুষট্পদী'


শঙ্করাচার্য্য বিরচিত 'শ্রীবিষ্ণুষট্পদী' ও ইহার ভাবার্থঃ-

শ্রীভগবান বিষ্ণুর প্রতি নিবেদিত এই ভক্তি ও বৈরাগ্যমূলক স্তোত্রম্ আচার্য্য শঙ্করের লিখনীতে প্রকাশ পাইতেছে এইভাবে-

অবিনয়মপনয় বিষ্ণো দময় মনঃ শময় বিষয়মৃগতৃষ্ণাম্ ।
ভূতদয়াং বিস্তারয় তারয় সংসারসাগরতঃ ॥ ১॥

হে বিষ্ণো ! আমার অবিনয় অপনয়ন কর, মনকে দমন কর, বিষয় মৃগতৃষ্ণার শান্তিবিধান কর, সৰ্ব্বজীবে আমার দয়া বিস্তার কর এবং আমাকে ভবসমুদ্র হইতে উদ্ধার কর৷ ১ ৷৷
দিব্যধুনীমকরন্দে পরিমলপরিভোগসচ্চিদানন্দে ।
শ্রীপতিপদারবিন্দে ভবভয়খেদচ্ছিদে বন্দে ॥ ২॥

স্বৰ্গগঙ্গা সুরধুনী যে পাদপদ্মের মকরন্দ স্বরূপ, যে পাদপদ্মের পরিমল উপভোগ করিতে পারিলে সচ্চিদানন্দে স্থিতি লাভ হয়, শ্ৰীপতির যে চরণারবিন্দ সংসার ভীতি ছেদন করে আমি সেই চরণপদ্মযুগল বন্দনা করি ৷ ২ ৷৷
সত্যপি ভেদাপগমে নাথ তবাহং ন মামকীনস্ত্বম্ ।
সামুদ্রো হি তরঙ্গঃ ক্বচন সমুদ্রো ন তারঙ্গঃ ॥ ৩॥

তোমায় আমায় যে ভেদ তাহা দূরীভূত হইলেও হে নাথ ! তোমারই আমি ইহাই সত্য কিন্তু আমার তুমি হইতেই পার না । কারণ সমুদ্রেরই তরঙ্গ এইরূপ বলা যায় তরঙ্গের সমুদ্র ইহা কখনও নহে । ৩।।
উদ্ধৃতনগ নগভিদনুজ দনুজকুলামিত্র মিত্রশশিদৃষ্টে ।
দৃষ্টে ভবতি প্রভবতি ন ভবতি কিং ভবতিরস্কারঃ ॥ ৪

হে গোবৰ্দ্ধনধারিন! হে পৰ্ব্বতপক্ষাবিদারক ইন্দ্ৰানুজ! হে দৈত্যকুলের অমিত্ৰ! হে সূৰ্য্যচন্দ্র চক্ষু! তুমি যাহার দৃষ্টিপথে আইস তাঁহার সমস্ত জ্ঞানের প্রকাশ হয় । তখন কি সংসার তাহার কাছে অতি তুচ্ছ ও ঘুণ্য বলিয়া উপেক্ষিত হয় না ? ৪।।
ত্স্যাদিভিরবতারৈরবতারবতাঽবতা সদা বসুধাম্ ।
পরমেশ্বর পরিপাল্যো ভবতা ভবতাপভীতোঽহম্ ॥ ৫॥

মৎস্যাদি দশ-অবতাররূপে অবতরণ করিয়া তুমি পৃথিবীকে রক্ষা কর। হে পরমেশ্বর আমি তােমার প্রতিপাল্য আমি বড়ই ভবতাপে ভীত হইয়াছি।৫।।
দামোদর গুণমন্দির সুন্দরবদনারবিন্দ গোবিন্দ ।
ভবজলধিমথনমন্দর পরমং দরমপনয় ত্বং মে ॥ ৬॥

হে দামোদর ! হে গোবিন্দ ! সমস্ত গুণরাশির মন্দির তুমি। আহা কি সুন্দর তোমার মুখ অরিবিন্দ ! তুমি সংসার সমুদ্ৰ মথনের মন্দর স্বরূপ, তুমি আমার পরম সংসার ভয় নিবারণ কর ৷ ৬ ৷৷
নারায়ণ করুণাময় শরণং করবাণি তাবকৌ চরণৌ ।
ইতি ষট্পদী মদীয়ে বদনসরোজে সদা বসতু ॥ ৭॥

হে নারায়ণ ! হে করুণাময় ! আমি তোমার শ্ৰীচরণে শরণা লইলাম । হে প্ৰভু! এই ষট্পদী স্তোত্ররূপ ভ্রমর যেন আমার বদনপদ্মে সদা বাস করে।৭।।
॥ ইতি পরমহংস পরিব্রাজকাচাৰ্য্য শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য বিরচিতং বিষ্ণুষট্পদীস্তোত্রং সম্পূর্ণম্ ॥

Wednesday, 4 September 2019

শ্রুতিতে সত্যের জয়গানঃ-


অথর্ববেদীয় মুন্ডক উপনিষদে বর্ণিত আছে
-সত্যমেব জয়তে নানৃতং সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ৷ যেনাক্রমন্ত্যৃষয়ো হ্যাপ্তকামা যত্র তত্সত্যস্য পরমং নিধানম্৷৷৩।১।৬।।
ভগবৎপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ-
সত্যই বা সত্যাশ্রয়ীই জয়লাভ করেন, মিথ্যা অর্থাৎ মিথ্যাশ্রয়ী নহে। আর জগতে তো ইহা প্রসিদ্ধ আছে যে, সত্যবাদীকর্তৃক মিথ্যাবাদী পরাভূত হয় কিন্তু ইহার বৈপরীত্য হয় না। অতএব সত্যের প্রবল সাধনত্ব প্রতিপন্ন হইল।

দেবযানসংজ্ঞক মার্গ সত্যের দ্বারা অর্থাৎ যথাযথ কথনরূপ নিষ্ঠা অবলম্বনে বিস্তৃত হয় অর্থাৎ সত্যাবলম্বনের সাথে সাথেই উৎপন্ন হয়। যে পথাবলম্বনে উপাসক ঋষিগণ যাহারা কপটতা, শঠতা, অহঙ্কার, দম্ভ ও অসত্যবর্জিত এবং আপ্তকাম অর্থাৎ সকলবিষয়ে বিগততৃষ্ণা তাহারাই সেখানে আরূঢ় হন যেখানে উত্তম সাধনরূপ সত্যের সম্বন্ধ বিশিষ্ট ফলস্বরূপ যে সত্য ব্রহ্মরূপ প্রকৃষ্ট ধন-পুরষার্থরূপে স্থিত আছেন। সেখানে যে পথ দিয়া সাধক আরোহন করেন সেই পথ সত্যের দ্বারা ব্যাপ্ত।

'হরগৌর্যষ্টকম্'


শঙ্করাচার্য্যকৃত 'হরগৌর্যষ্টকম্' ভাবার্থঃ-

হরগৌরীর শিবশিবান্বিত মূর্ত্তি আচার্য্য শঙ্করের অভেদজ্ঞানে প্রস্ফুটিত হয়েছে এইভাবে-
কস্তূরিকাচন্দনলেপনায়ৈ, শ্মশানভস্মাঙ্গবিলেপনায়।
সৎকুণ্ডলায়ৈ ফণিকুণ্ডলায় নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায় ॥১॥

ভাবার্থঃ- যাঁর অর্ধেক গৌরীদেহ, কস্তুরিচন্দন বিলেপিত, অপর অর্ধেক হরদেহে শ্মশানভস্মের বিলেপন; অর্ধেক অঙ্গের কর্ণে মনোহরকুণ্ডল শোভিত, অপর অর্ধেকে সর্পকুণ্ডল শোভিত সেই শিবা (দুর্গা) এবং শিবকে প্রণাম করি। ১

মন্দারমালাপরিশোভিতায়ৈ, কপালমালাপরিশোভিতায়।
দিব্যাম্বরায়ৈ চ দিগম্বরায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায় ॥২॥

ভাবার্থঃ- যাঁর অর্ধেক অঙ্গের গলায় পারিজাতমালা পরিশোভিত, অপর অর্ধেক কপালমালায় পরিশোভিত, অর্ধেক অঙ্গে দিব্য অম্বর (বস্ত্র) এবং অপর অর্ধেকে দিগম্বর সেই শিবা এবং শিবকে প্রণাম করি। ২

চলৎক্বণৎকঙ্কণনূপুরায়ৈ, বিভ্রৎফণাভাসুরনূপুরায়।
হেমাঙ্গদায়ৈ চ ফণাঙ্গদায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায় ॥৩॥

ভাবার্থঃ- যাঁর অর্ধেক অঙ্গে চরণে চঞ্চল শব্দায়মান নূপুর শোভিত, অপর অর্ধেক ভাগে সর্পের ফণা চরণের নূপুর হয়েছে, অর্ধেক অঙ্গের বাহুতে সুবর্ণ বাজু (অঙ্গদ), অপর অর্ধেকে সর্পের বাজু সেই শিবা ও শিবকে প্রণাম করি। ৩

বিলোলনীলোৎপললোচনায়ৈ, বিকাসিপঙ্কেরুহলোচনায়।
ত্রিলোচনায়ৈ চ বিষমেক্ষণায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায় ॥৪॥

ভাবার্থঃ- মুখমণ্ডলে অর্ধেক অংশে যাঁর চঞ্চল নীলপদ্মের ন্যায় লোচন (নয়ন) এবং অপর অর্ধেকে স্ফোটনোন্মুখ পদ্মের ন্যায় লোচন, সেই ত্রিনয়না এবং অযুগ্মনেত্র (ত্রিনয়ন) শিবা এবং শিবকে প্রণাম করি। ৪

প্রপন্নপৃষ্ঠৈ সুখদাশ্রয়ায়ৈ, ত্ৰৈলোক্যসংহারকতাণ্ডবায়।
কৃতস্মরায়ৈ বিকৃতস্মরায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায় ॥৫॥

ভাবার্থঃ- যিনি অর্ধেক অঙ্গে আশ্রিত সিংহপৃষ্ঠে সুখাসীনা, অপর অর্ধেকে ত্রৈলোক্য সংহারের জন্য তাণ্ডবনৃত্য করছেন, অর্ধেক অঙ্গে কামের রচয়িত্রী, অপর অর্ধেকে কামের সংহারকর্তা সেই শিবা ও শিবকে প্রণাম করি। ৫

চাম্পেয়গৌরার্ধ শরীরকায়ৈ, কর্পূরগৌরার্ধশরীরকায়।
ধম্নিল্লবত্যৈ চ জটাধরায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায় ॥৬॥

ভাবার্থঃ- যাঁর দেহের অর্ধেক চম্পক-কুসুমের ন্যায় গৌরবর্ণ অপর অর্ধেক কর্পূরবৎ শুভ্র, অর্ধেকভাগে কেশপাশে কবরী ধারণ করেছেন, অপর অর্ধেকে জটাধর সেই শিবা ও শিবকে প্রণাম করি। ৬

অম্ভোধরশ্যামলকুন্তলায়ৈ, বিভূতিভূষাঙ্গ জটাধরায়।
জগজ্জনন্যৈ জগদেকপিত্রে, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥৭॥

ভাবার্থঃ- যাঁর মস্তকের অর্ধেক অংশ নবীন মেঘের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ কেশগুচ্ছ, অপর অর্ধেকে জটাবিভূতি শোভিত সেই জগজ্জননী এবং জগতের একমাত্র পিতা, সেই শিবা ও শিবকে প্রণাম করি। ৭

সদা শিবানাং পরিভূষণায়ৈ, সদাহশিবানাং পরিভূষণায়।
শিবান্বিতায়ৈ চ শিবান্বিতায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায় ॥৮॥

ভাবার্থঃ- যিনি সর্বদা অর্ধাঙ্গস্থ মঙ্গলময় বস্তুসমূহেরও শোভাবর্ধনকারিণী, প্রত্যুত যিনি সর্বদা অপরার্ধে স্থিত অমঙ্গল বস্তুসমূহেরও শোভাবর্ধক, যিনি শিবের সহিত সংযুক্তা এবং যিনি শিবার সহিত সংযুক্ত, সেই শিবা ও শিবকে প্রণাম করি। ৮

ইতি জগদ্গুরু আদি শংকরাচার্য্যকৃত 'হরগৌর্যষ্টকম্'।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...