Friday, 28 February 2020

জ্ঞাননিষ্ঠ সন্ন্যাসীর সম্যগ্ জ্ঞানের সহকারী সত্যাদি সাধনসকলঃ-


অথর্ববেদের শৌনকীয় শাখার অন্তর্গত মুণ্ডক উপনিষদে বর্ণিত আছে-
সত্যেন লভ্যস্তপসা হ্যেষ আত্মা সম্যগ্জ্ঞানেন ব্রহ্মচর্যেণ নিত্যম্।,,, ৷৷৩.১.৫৷৷
ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- সত্যাবলম্বনে অর্থাৎ মিথ্যাত্যাগের দ্বারা তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমে আত্মা উপলব্ধ হন। সেইরূপ তপস্যা অর্থাৎ ইন্দ্রিয় ও মনের একাগ্রতা সহকৃত তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমে তিনি লভ্য হন; যেহেতু স্মৃতিতে আছে-
'মন ও ইন্দ্রিয়গণের একাগ্রতাই শ্রেষ্ঠ তপস্যা।'-(মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব-২৫০।৪)
আর একাগ্রতাই আত্মবিষয়ক তত্ত্বজ্ঞানের অনুকুলরূপে অভিমুখী সত্তাবিশিষ্ট বলিয়া এই একাগ্রতারূপ তপস্যা শ্রেষ্ঠসাধন কিন্তু অপর যে চান্দ্রায়ণাদি তপস্যা, তাহারা এরূপ নহে। অর্থাৎ সত্য, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য্য সহকৃত অর্থাৎ মৈথুন পরিত্যাগপূর্ব্বক সম্যগ্-জ্ঞানের মাধ্যমে প্রত্যগাত্মার উপলব্ধি করিতে হইবে। আর নিত্য অর্থাৎ অবিরাম সত্যাবলম্বনে, অবিরাম তপস্যা সহকারে, অবিরাম সম্যক্ জ্ঞানের মাধ্যমে-এইরূপ অন্তদীপিকা ন্যায়ের মতো নিত্যশব্দ সর্বত্র সম্বন্ধিত হইবে।
সেইরূপ প্রশ্ন উপনিষদে বর্ণিত আছে-'যাঁহাদের মধ্যে কুটিলতা, অসত্য ও কপটতা নাই তাঁহাদিগেরই তত্ত্বজ্ঞান অনুশীলন সার্থকতায় অর্থাৎ অনুভূতিতে পর্য্যবসিত হয়।'-(প্রশ্ন উপনিষৎ-১।১৬)

Monday, 24 February 2020

ওঙ্কারই জ্ঞাত্বা ও উপাস্য ব্রহ্মঃ-




কৃষ্ণযজুর্বেদীয় কঠ উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয়া বল্লীতে বর্ণিত আছে-
এতদ্ধ্যেবাক্ষরং ব্রহ্ম এতদ্ধ্যেবাক্ষরং পরং ৷
এতদ্ধ্যেবাক্ষরং জ্ঞাত্বা যো যদিচ্ছতি তস্য তৎ ৷৷ ১.২.১৬ ৷৷

ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- অতএব এই অক্ষরই অর্থাৎ ওঙ্কারই অপরব্রহ্ম এবং এই অক্ষরই পরব্রহ্ম। কেননা যেহেতু এই অক্ষর উভয়েরই অঙ্গ অর্থাৎ ॐ পরব্রহ্মের বাচক এবং অপরব্রহ্মের প্রতীকও। এই অক্ষরকেই উপাস্য ব্রহ্ম বলিয়া মনে করিয়া যিনি পর অথবা অপরব্রহ্ম যাঁহাকে বাঞ্ছা করেন তাঁহার তাহাই সিদ্ধ হয়। পরব্রহ্মের ইচ্ছা করিলে পরব্রহ্মের জ্ঞান হয়, আর অপরব্রহ্মের ইচ্ছা করিলে অপরব্রহ্মের প্রাপ্তি হয়।


Sunday, 23 February 2020

সমস্ত বেদের লক্ষ্যবস্তু কি?


কৃষ্ণযজুর্বেদীয় কঠ উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয়া বল্লীতে এইরূপ প্রশ্নকারী নচিকেতাকে জিজ্ঞাসিত ঐ বস্তু এবং ঐবস্তুর অনান্য জ্ঞাপককে বলিবার ইচ্ছা করিয়া যম বলিতে লাগিলেন-
সর্বে বেদা যৎ পদমামনন্তি তপাংসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি ৷
যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্ তে পদং সংগ্রহেণ ব্রবীমি-ওমিত্যেতৎ ৷৷ (কঠ উপনিষৎ-১।২।১৫)

ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- সমস্ত বেদ অবিভাগে অর্থাৎ অবিরুদ্ধভাবে যে পদ অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তুকে প্রতিপাদন করেন, সমস্ত শাস্ত্রীয় কর্ম্মসকল যাঁহাকে বলিয়া দেয় অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধাদির মাধ্যমে যাঁহার প্রাপ্তির নিমিত্ত হয়, যাঁহার প্রাপ্তির ইচ্ছায় গুরুকুলবাসরূপ ব্রহ্মচর্য্য অর্থাৎ বেদ অধ্যয়ানাদি অথবা অন্যপ্রকার অর্থাৎ পবিত্রতা সংযমাদিরূপ ব্রহ্মচর্য্য পালন করেন, সেই লক্ষ্যবস্তুকে যাঁহাকে তুমি জানিতে চাহিতেছ তাহা তোমাকে সংক্ষেপে বলিতেছি- ইনি ওঙ্কারের স্বরূপ অর্থাৎ বাচ্য। যিনি এই ওঙ্কারের স্বরূপ অর্থাৎ ॐ শব্দের বাচ্য এবং 'ॐ' ই যাঁহার প্রতীক সেই লক্ষ্যবস্তু ইনি অর্থাৎ ব্রহ্ম যাঁহাকে তুমি জানিতে চাহিয়াছ।

Saturday, 15 February 2020

ব্রহ্মের জগৎকর্তৃত্ব শরীরেন্দ্রিয়সাপেক্ষ নহে, সেই বিষয়ে বেদপ্রমাণ প্রদর্শনঃ-


শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ বেদান্তদর্শনের ‘ঈক্ষ্ণতের্ন অশব্দম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫) এই সূত্রের ভাষ্যে ভগবৎপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য লিখিতেছেন- আর যে বলা হইয়াছে জগতের উৎপত্তির পূর্ব্বে শরীরাদির সহিত সম্বন্ধ না থাকায় ব্রহ্মের ঈক্ষণকর্তৃত্ব সঙ্গত হয় না তদুত্তরে সিদ্ধান্তী বলিতেছেন-
সেই প্রকার আশঙ্কা হইতে পারে না, যেহেতু সূর্য্যের প্রকাশের ন্যায় ব্রহ্মের জ্ঞানস্বরূপতা নিত্য হওয়ায় জ্ঞানের সাধন শরীর ও ইন্দ্রিয় প্রভৃতির প্রতি তাঁহার অপেক্ষা যুক্তিসঙ্গত নহে। দেখ, অবিদ্যাদিযুক্ত যে জীব, তাহারই শরীর প্রভৃতিকে অপেক্ষা করিয়া জ্ঞানোৎপত্তি হইয়া থাকে, কিন্তু যাঁহার জ্ঞানে কোনপ্রকার প্রতিবন্ধককারণ নাই, সেই ঈশ্বরের তাহা হয় না।
এই মন্ত্রদ্বয় ঈশ্বরের যে শরীর প্রভৃতির প্রতি অপেক্ষা নাই এবং তাঁহার জ্ঞানে যে কোনপ্রকার আবরণ নাই, ইহা প্রদর্শন করিতেছে, যথা-
'তাঁহার কার্য্য অর্থাৎ শরীর ও ইন্দ্রিয় নাই, তাঁহার সমান বা তাঁহা অপেক্ষা অধিক উৎকৃষ্ট কাহাকেও দেখা যায় না। ইহার পরাশক্তি অর্থাৎ মায়াশক্তি আকাশাদি-বিচিত্র-কার্য্যকারিণী হওয়ায় বিবিধ বলিয়ায় শ্রুতিতে বর্ণিত হয়। তাহার জ্ঞানরূপ বলের দ্বারা যে সৃষ্টিক্রিয়া তাহা স্বাভাবিক অর্থাৎ অনাদিময়াত্মক হওয়ায় অন্যকারণ নিরপেক্ষ।'-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৬।৮)
'তাঁহার হস্ত ও পদ নাই, তথাপি দ্রুত গমন করেন ও গ্রহণ করেন, চক্ষুহীন হইলেও দর্শন করেন, কর্ণহীন হইলেও তিনি শ্রবণ করেন। তিনি শরীর ও ইন্দ্রিয়াদির অপেক্ষা না করিয়া বেদ্য বিষয় সকলকে অবগত হন, তাহার কিন্তু বেত্তা কেহ নাই; নিত্য জ্ঞানস্বরূপ তাঁহাকে কেউ জ্ঞানের বিষয় করিতে পারে না, ব্রহ্মবিদ্গণ তাঁহাকে অগ্র্য অর্থাৎ অনাদি পুরুষ এবং মহান বিভু বলিয়া থাকেন।'-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৩।১৯)

ব্রহ্মজিজ্ঞাসার উত্তরঃ-


সামবেদের তলবকার ব্রাহ্মণের অন্তর্গত কেন উপনিষদে বর্ণিত আছে-
'ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাগ্গচ্ছতি নো মনো ন বিদ্মো ন বিজানীমো যথৈতদনুশিষ্যাত্ ৷৷'-(কেন উপনিষৎ-১।৩)
ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- যেহেতু ব্রহ্ম শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়সকলেরও শ্রোত্রাদিস্বরূপ অর্থাৎ আত্মস্বরূপ, অতএব তাঁহাতে অর্থাৎ সেই ব্রহ্মে চক্ষু-ইন্দ্রিয় যাইতে পারে না, কারণ নিজ সত্তায় নিজের গমন সম্ভব হয় না। সেইরূপ শব্দ বা বাগিন্দ্রিয়ও তাঁহাতে গমন করে না। কেননা বাগিন্দ্রিয়ের দ্বারা উচ্চারিত শব্দ যখন স্বীয় বক্তব্য বিষয়কে প্রকাশ করে তখন এইরূপ বলা হয় যে বাগিন্দ্রিয় বা উচ্চারিত শব্দ বক্তব্য বিষয়ে পৌঁছিতেছে। কিন্তু যেহেতু সেই শব্দেরও শব্দসম্পাদক বাগিন্দ্রিয়ের প্রকৃত স্বরূপ আত্মা হইতেছেন ব্রহ্ম, অতএব শব্দ বা বাগিন্দ্রিয় নিজস্বরূপ ব্রহ্মে গমন করিতে পারে না। যেমন অগ্নি কাষ্ঠাদি অন্য বস্তুর দাহক ও প্রকাশক হইলেও কিন্তু নিজেকে দগ্ধ করে না কিংবা প্রকাশও করে না।
সেইরূপ মন অর্থাৎ মনবুদ্ধিও নিজস্বরূপ ব্রহ্মে পোঁছিতে অর্থাৎ তৎবিষয়ক সঙ্কল্প অধ্যবসায়াদি করিতে পারে না। কারণ মন অন্য পদার্থের সঙ্কল্প ও নিশ্চয়কারী হইলেও নিজের মূল সত্তা প্রত্যগাত্মাকে সঙ্কল্প ও নিশ্চয় করিতে পারে না, কেননা ব্রহ্ম মনেরও আত্মস্বরূপ।
অতএব যে প্রকারে অপর গুরু কর্তৃক এই ব্রহ্মের অনুশাসন-শিষ্যের প্রতি উপদেশ হইতে পারে তাহাও আমরা জানিনা। কারণ যাহা ইন্দ্রিয়ের বিষয় তাহাকে জাতি, গুণ, ক্রিয়া, ও বিশেষণের দ্বারা অপরকে উপদেশ করা যাইতে পারে। কিন্তু ব্রহ্ম সেই জাতি প্রভৃতি বিশেষণ বিশিষ্ট না। সেইজন্য শিষ্যদিগকে উপদেশের দ্বারা ব্রহ্মকে বুঝানো দুরহ ব্যাপার।

Thursday, 6 February 2020

সেশ্বরসাংখ্যমতেও প্রধানের সর্বজ্ঞতা অসিদ্ধঃ-


শ্রীমন্মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীতম্ বেদান্তদর্শনের ‘ঈক্ষ্ণতের্ন অশব্দম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/৫) এই সূত্রের ভাষ্যে ভগবৎপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য লিখিতেছেন-
আর পাতঞ্জলগণের অনুসরণ করতঃ প্রধানের যে ঈক্ষণকর্ত্তৃত্ব, তাহা 'ক্লেশকর্মাদির সহিত সম্বন্ধশূন্য পুরুষবিশেষাত্মক' ঈশ্বর-সাক্ষিরূপ নিমিত্ত বশতঃ হইয়া থাকে, যদি এই প্রকার কল্পনা করা হয়, যেমন অগ্নিরূপ নিমিত্তবশতঃ লৌহ-পিণ্ডের দহনকর্ত্তৃত্ব হইয়া থাকে। তদুত্তরে বলিতেছেন- তাহা হইলে যে নিমিত্তবশতঃ প্রধানের ঈক্ষণকর্তূত্ব সিদ্ধ হইবে, সেই নিমিত্তটিই হইবে জগতের কারণভূত সর্বজ্ঞ মূখ্য ব্রহ্ম, ইহাই যুক্তিসঙ্গত।

Wednesday, 5 February 2020

'দক্ষিণামূর্তি-স্তোত্রম্'


শঙ্করাচার্য্য বিরচিত 'দক্ষিণামূর্তি-স্তোত্রম্' ও ইহার ভাবার্থঃ-
বিশ্বং দর্পণদৃশ্যমাননগরীতুল্যং নিজান্তর্গতং
পশ্যন্নাত্মনি মায়য়া বহিরিবোদ্ভূতং য়থা নিদ্রয়া ।
য়ঃ সাক্ষাত্কুরুতে প্রবোধসময়ে স্বাত্মানমেবাদ্বয়ং
তস্মৈ শ্রীগুরুমূর্তয়ে নম ইদং শ্রীদক্ষিণামূর্তয়ে ॥ ১॥

অর্থাৎ স্বপ্নের প্রভাবে যদ্রূপ অন্তঃস্থ বস্তুই বহির্ভাগে স্থিত বলিয়া মনে হয়, তদ্রূপ মায়ার দ্বারা বিশ্ব বহির্ভাগে বিরচিত হইলেও যিনি উহাকে দর্পণে দৃশ্যমান প্রতিবিম্বিত নগরের ন্যায় আপনার মধ্যেই অবস্থিতরূপে দর্শন করেন এবং প্রবোধকালে অর্থাৎ বিজ্ঞান কালে সমাধি অবস্থায় আপনার অদ্বিতীয় স্বরূপমাত্রকেই প্রত্যক্ষ করেন, সেই শ্রীগুরুরূপধারী শ্রীদক্ষিণামূর্তিকে আমার এই নমস্কার।১
বীজস্যান্তরিবাঙ্কুরো জগদিদং প্রাঙ্নির্বিকল্পং পুনঃ
মায়াকল্পিতদেশকালকলনাবৈচিত্র্যচিত্রীকৃতম্ ।
মায়াবীব বিজৃম্ভয়ত্যপি মহাযোগীব য়ঃ স্বেচ্ছয়া
তস্মৈ শ্রীগুরুমূর্তয়ে নম ইদং শ্রীদক্ষিণামূর্তয়ে ॥ ২॥

অর্থাৎ যে জগৎ সৃষ্টির পূর্ব্বে বীজমধ্যস্থ অঙ্কুরসদৃশ অব্যাকৃত থাকে, অথচ পুনরায় মায়া দ্বারা কল্পিত দেশ ও কালের অপূর্ব প্রভাবের দ্বারা বিচিত্র হয়, সেই জগৎকে যিনি মায়াবীর ন্যায় এবং মহাযোগীর ন্যায় স্বেচ্ছায় বাহিরে বিস্তার করেন, সেই শ্রীগুরুরূপধারী শ্রীদক্ষিণামূর্তিকে আমার এই নমস্কার।২
য়স্যৈব স্ফুরণং সদাত্মকমসত্কল্পার্থকং ভাসতে
সাক্ষাত্তত্ত্বমসীতি বেদবচসা য়ো বোধয়ত্যাশ্রিতান্ ।
য়ত্সাক্ষাত্করণাদ্ভবেন্ন পুনরাবৃত্তির্ভবাম্ভোনিধৌ
তস্মৈ শ্রীগুরুমূর্তয়ে নম ইদং শ্রীদক্ষিণামূর্তয়ে ॥ ৩॥

অর্থাৎ যাঁহার বহিঃপ্রকাশ সত্যবস্তুকে অবলম্বন করিয়াই হয়, অথচ তৎপ্রকাশ্য বস্তু অসৎকল্প অর্থরূপে প্রতিভাত হয়, যিনি আশ্রিতদিগকে তত্ত্বমসি এই বেদবাক্যের দ্বারা সাক্ষাৎভাবে জ্ঞান দান করেন, যাঁহার সাক্ষাৎকারের ফলে সংসারসাগরে পুনরাগমন হইবে না, সেই শ্রীগুরুরূপধারী শ্রীদক্ষিণামূর্তিকে আমার এই নমস্কার।৩
নানাচ্ছিদ্রঘটোদরস্থিতমহাদীপপ্রভাভাস্বরং
জ্ঞানং য়স্য তু চক্ষুরাদিকরণদ্বারা বহিঃ স্পন্দতে ।
জানামীতি তমেব ভান্তমনুভাত্যেতত্সমস্তং জগত্
তস্মৈ শ্রীগুরুমূর্তয়ে নম ইদং শ্রীদক্ষিণামূর্তয়ে ॥ ৪॥

অর্থাৎ তথাপি বহুছিদ্রযুক্ত ঘটের মধ্যে স্থাপিত উজ্জল দীপের আলোক যদ্রূপ স্ফুরিত হয়, তদ্রূপ যাঁহার জ্ঞান চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের পথে 'আমি জানিতেছি' ইত্যাদি প্রকারে বহির্দেশে স্পন্দিত হয়, তিনি প্রকাশমান বলিয়াই তৎপশ্চাৎ এই সমস্ত জগৎ প্রকাশিত হয়, সেই শ্রীগুরুরূপধারী শ্রীদক্ষিণামূর্তিকে আমার এই নমস্কার। ৪
দেহং প্রাণমপীন্দ্রিয়াণ্যপি চলাং বুদ্ধিং চ শূন্যং বিদুঃ
স্ত্রীবালান্ধজডোপমাস্ত্বহমিতি ভ্রান্তা ভৃশং বাদিনঃ ।
মায়াশক্তিবিলাসকল্পিতমহা ব্যামোহসংহারিণে
তস্মৈ শ্রীগুরুমূর্তয়ে নম ইদং শ্রীদক্ষিণামূর্তয়ে ॥ ৫॥

অর্থাৎ দেহ, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়সমূহকে, এমন কি চঞ্চল বুদ্ধিকেও কেহ কেহ শূন্য বলিয়া জানে; কিন্তু স্ত্রী, বালক, অন্ধ এবং জড়তুল্য লোকগণ ভ্রমবশতঃ ঐ সকলকে পুনঃ পুনঃ 'আমি' বলিয়া নির্দ্দেশ করে। মায়াশক্তির ক্রীড়াদ্বারা বিরচিত মহামোহের বিনাশকারী সেই শ্রীগুরুরূপধারী শ্রীদক্ষিণামূর্তিকে আমার এই নমস্কার।৫
রাহুগ্রস্তদিবাকরেন্দুসদৃশো মায়াসমাচ্ছাদনাত্
সন্মাত্রঃ করণোপসংহরণতো য়োঽভূত্সুষুপ্তঃ পুমান্ ।
প্রাগস্বাপ্সমিতি প্রবোধসময়ে য়ঃ প্রত্যভিজ্ঞায়তে
তস্মৈ শ্রীগুরুমূর্তয়ে নম ইদং শ্রীদক্ষিণামূর্তয়ে ॥ ৬॥

অর্থাৎ রাহুগ্রস্ত সূর্য্য এবং চন্দ্রের ন্যায় যিনি মায়ার সমাচ্ছাদনবশে জীবরূপে সুষুপ্ত হইয়া ইন্দ্রিয়সমূহের উপসংহারবশতঃ সৎ-মাত্ররূপে অবস্থিত থাকেন এবং যিনি জাগরণকালে 'আমিই পূর্বে ঘুমাইয়াছিলাম' এইরূপে পূর্বানুভূত বিষয়ের স্মরণ করেন, সেই শ্রীগুরুরূপধারী শ্রীদক্ষিণামূর্তিকে আমার এই নমস্কার।৬
বাল্যাদিষ্বপি জাগ্রদাদিষু তথা সর্বাস্ববস্থাস্বপি
ব্যাবৃত্তাস্বনুবর্তমানমহমিত্যন্তঃ স্ফুরন্তং সদা ।
স্বাত্মানং প্রকটীকরোতি ভজতাং য়ো মুদ্রয়া ভদ্রয়া
তস্মৈ শ্রীগুরুমূর্তয়ে নম ইদং শ্রীদক্ষিণামূর্তয়ে ॥ ৭॥

অর্থাৎ বাল্যাদি ও জাগ্রদাদি, তথা সমস্ত অবস্থাই পরিবর্তিত হইলেও যে আত্মা সর্বানুগতরূপে বর্তমান থাকেন ও 'আমি আমি' এইরূপে সর্বদা অন্তঃকরণে স্ফুরিত হন, সেই স্বাত্মাকে যিনি ভজনাকারীদের সমীপে শুভমুদ্রাসহকারে প্রকটিত করেন, সেই শ্রীগুরুরূপধারী শ্রীদক্ষিণামূর্তিকে আমার এই নমস্কার।৭
বিশ্বং পশ্যতি কার্যকারণতয়া স্বস্বামিসংবন্ধতঃ
শিষ্যাচার্যতয়া তথৈব পিতৃপুত্রাদ্যাত্মনা ভেদতঃ ।
স্বপ্নে জাগ্রতি বা য় এষ পুরুষো মায়াপরিভ্রামিতঃ
তস্মৈ শ্রীগুরুমূর্তয়ে নম ইদং শ্রীদক্ষিণামূর্তয়ে ॥ ৮॥

অর্থাৎ যিনি মায়া দ্বারা চালিত পুরুষরূপে স্বপ্ন অথবা জাগ্রদবস্থায় বিশ্বকে কার্য্য ও কারণরূপে, প্রভু ও তৎসম্পত্তিরূপে, শিষ্য ও আচার্য্যরূপে, অধিকন্তু পিতা ও পুত্রাদিরূপে পৃথক্ পৃথক্ ভাবে দর্শন করেন, সেই শ্রীগুরুরূপধারী শ্রীদক্ষিণামূর্তিকে আমার এই নমস্কার।৮
ভূরম্ভাংস্যনলোঽনিলোঽম্বরমহর্নাথো হিমাংশুঃ পুমান্
ইত্যাভাতি চরাচরাত্মকমিদং য়স্যৈব মূর্ত্যষ্টকম্ ।
নান্যত্কিঞ্চন বিদ্যতে বিমৃশতাং য়স্মাত্পরস্মাদ্বিভোঃ
তস্মৈ শ্রীগুরুমূর্তয়ে নম ইদং শ্রীদক্ষিণামূর্তয়ে ॥ ৯॥

অর্থাৎ প্রত্যক্ষদৃষ্ট পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, সূর্য্য, চন্দ্র ও পুরুষ যাঁহার চরাচরাত্মক অষ্টমূর্ত্তিরূপে প্রকাশ পায়, বিবেকবান্ দিগের নিকট যে শ্রেষ্ঠ বিভু ভিন্ন অপর কাহারও অস্তিত্ব নাই, সেই শ্রীগুরুরূপধারী শ্রীদক্ষিণামূর্তিকে আমার এই নমস্কার।৯
সর্বাত্মত্বমিতি স্ফুটীকৃতমিদং য়স্মাদমুষ্মিন্ স্তবে
তেনাস্য শ্রবণাত্তদর্থমননাদ্‍ধ্যানাচ্চ সঙ্কীর্তনাত্ ।
সর্বাত্মত্বমহাবিভূতিসহিতং স্যাদীশ্বরত্বং স্বতঃ
সিদ্‍ধ্যেত্তত্পুনরষ্টধা পরিণতং চৈশ্বর্যমব্যাহতম্ ॥ ১০॥

যেহেতু উপরোক্ত স্তবে এই সর্বাত্মরূপ বস্তুটিকে প্রকাশ করা হইয়াছে, সুতরাং এই স্তবের শ্রবণ, অর্থচিন্তা, ধ্যান ও সংকীর্তনের দ্বারা সর্বাত্মরূপ মহাবিভূতির সহিত ঈশ্বরত্ব লাভ হইবে এবং প্রসিদ্ধ অণিমাদি অষ্টধাপরিণত ঐশ্বর্য স্বতঃই সিদ্ধ হইবে। ১০
বটবিটপিসমীপে ভূমিভাগে নিষণ্ণং
সকলমুনিজনানাং জ্ঞানদাতারমারাত্ ।
ত্রিভুবনগুরুমীশং দক্ষিণামূর্তিদেবং
জননমরণদুঃখচ্ছেদদক্ষং নমামি ॥১১

অর্থাৎ যিনি বটবৃক্ষের সমীপে ভূমিভাগে উপবিষ্ট, যিনি সকল মুনিদিগকে অপরোক্ষভাবে জ্ঞান দান করেন, যিনি ত্রিভুবনের গুরু, যিনি ঈশ্বর এবং যিনি জন্ম ও মৃত্যরূপ দুঃখের ছেদনকারী, সেই দক্ষিণামূর্তিদেবকে নমস্কার করি।১১
ইতি শ্রীমত্পরমহংসপরিব্রাজকাচার্যস্য শ্রীগোবিন্দভগবত্পূজ্যপাদশিষ্যস্য
শ্রীমচ্ছঙ্করভগবতঃ কৃতৌ দক্ষিণামূর্ত্যস্তোত্রং সম্পূর্ণম্ ।

ইতি শ্রীগোবিন্দভগবত্পূজ্যপাদশিষ্য শ্রীমৎ শঙ্কর ভগবৎ প্রণীত 'দক্ষিণামূর্তিস্তোত্রম্ সম্পূর্ণ।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...