Friday, 27 November 2020

জীব নিত্যচৈতন্য অর্থাৎ জ্ঞানস্বরূপঃ-

জীব কি বৈশেষিকমতাবলম্বিগণের মতানুসারে আগন্তুক চৈতন্যবিশিষ্ট স্বভাবতঃ অচেতন, অথবা সাংখ্যমতাবলম্বিগণের ন্যায় নিত্য চৈতন্যস্বরূপই, এইরূপ সংশয়ের প্রত্যুত্তরে ভগবান বাদরায়ণ ব্রহ্মসূত্রের জ্ঞাধিকরণম্ এ সিদ্ধান্ত করিতেছে-

'জ্ঞোত এব৷৷' ব্রহ্মসূত্র-২।৩।১৮৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য ভাষ্যে বলিতেছেন- এই প্রকার সংশয় প্রাপ্ত হইলে কথিত হইতেছে-এই আত্মা (-জীব) জ্ঞ অর্থাৎ নিত্য চৈতন্যস্বরূপ,'অতএব', অর্থাৎ যেহেতু ইহা উৎপন্নই হয় না। পরব্রহ্মই উপাধির সহিত সম্পর্কবশতঃ জীবরূপে অবস্থান করিতেছেন। যেহেতু-
'বিজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্ম'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৯।২৮)
"ব্রহ্ম বিজ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ।"
'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।১)
"ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞান ও অনন্তস্বরূপ।"
'অনন্তরোবাহ্যঃ কৃত্স্নঃ প্রজ্ঞানঘন এব'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৫।১৩)
"(এই আত্মা) অন্তররহিত, বাহ্যরহিত সম্পূর্ণরূপে প্রজ্ঞানঘন।"
ইত্যাদি শ্রুতিসকলে পরব্রহ্মেরই চৈতন্যস্বরূপতা পঠিত হইয়াছে। জীব নিশ্চয়ই সেই পরব্রহ্মস্বরূপ, সেইহেতু অগ্নির উষ্ণতা ও প্রকাশের ন্যায় জীবেরও নিত্য-চৈতন্যস্বরূপতা অবগত হওয়া যাইতেছে।
আর বিজ্ঞানময় প্রক্রিয়াতে-
'অসুপ্তঃ সুপ্তানভিচাকশীতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।১১)
"স্বয়ং অসুপ্ত (-অলুপ্ত দৃকশক্তি) থাকিয়া সুপ্তসকলকে (-স্বপ্নকালীন অন্তঃকরণবৃত্তিসকলকে) দর্শন (-প্রকাশিত) করেন।"
'অত্রায়ং পুরুষঃ স্বয়ংজ্যোতির্ভবতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।৯)
"এখানে (-স্বপ্নাবস্থাতে) পুরুষ স্বয়ং জ্যোতি হন।"
'ন হি বিজ্ঞাতুর্বিজ্ঞাতের্বিপরিলোপো বিদ্যতে'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।৩০)
"যেহেতু বিজ্ঞাতার বিজ্ঞানের বিপরিলোপ হয় না অর্থাৎ সাক্ষিচৈতন্যের জ্ঞান বিনষ্ট হয় না।"
ইত্যাদি এইরূপ আগমপ্রমাণবলে জীবের নিত্য চৈতন্যস্বরূপতা প্রতিপাদন হয়। আবার-
'অথ যো বেদেদং জিঘ্রাণীতি স আত্মা'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮।১২।৪)
"আর যিনি জানেন' আমি ইহা আঘ্রাণ করি', তিনি আত্মা।"
এইপ্রকারে সকলপ্রকার ইন্দ্রিয়রূপ দ্বার সকলের দ্বারা 'ইহা জানেন, ইহা জানেন', এইপ্রকার জ্ঞানের দ্বারা জ্ঞাতা আত্মার অনুসন্ধান অনুভব হয় বলিয়া জীবের নিত্যজ্ঞানরূপতা সিদ্ধ হয়।
(শঙ্কা-) যদি বলা হয়, (জীবাত্মা) নিত্যচৈতন্যস্বরূপ হইলে ঘ্রাণাদি ইন্দ্রিয়ের ব্যার্থতা হইয়া পড়িবে। তদুত্তরে সিদ্ধান্তী বলেন-না, তাহা বলা যায় না, যেহেতু গন্ধ প্রভৃতি বিশেষ বিষয়সকলের পরিচ্ছেদের জন্য ইন্দ্রিয়সকলের আবশ্যকতা আছে। 'গন্ধায় ঘ্রাণম্'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮।১২।৪) অর্থাৎ "গন্ধের জন্য ঘ্রাণেন্দ্রিয়", ইত্যাদি শ্রুতি।
আর যে শঙ্কা জন্মায়-সুপ্ত প্রভৃতি পুরুষের চেতনা থাকে না ইত্যাদি। তদুত্তরে সিদ্ধান্তী বলিতেছেন- সুষুপ্ত পুরুষকে প্রস্তাব করিয়া-
'যদ্বৈ তন্ন পশ্যতি পশ্যন্বৈ তন্ন পশ্যতি; ন হি দ্রষ্টুর্দৃষ্টের্বিপরিলোপো বিদ্যতেবিনাশিত্বাত্; ন তু তদ্দ্বিতীযমস্তি ততোন্যদ্বিভক্তং যত্পশ্যেত্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।২৩)
"সুষুপ্তিতে তিনি যে দর্শন করেন না, তাহা দর্শন করিয়াও দর্শন করেন না, যেহেতু দ্রষ্টার দৃষ্টির বিপরিলোপ হয় না, কারণ দ্রষ্টা অবিনাশী,, কিন্তু তাহা হইতে বিভক্ত অন্য দ্বিতীয় বস্তু নাই, যাহাকে দর্শন করিবেন।"
ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা শ্রুতি কর্ত্তৃকই তাহার পরিহার কথিত হইয়াছে। ইহাই কথিত হইয়াছে যে অচেতয়মানতা (-কিছুই না জানা), ইহা (সুষুপ্তিকালে) বিষয়ের অভাব বশতঃ হইয়া থাকে, কিন্তু (জীবাত্মার) চৈতন্যের অভাবপ্রযুক্ত নহে।। যেমন আকাশে আশ্রিত যে প্রকাশ (-সূর্য্যকিরণ), প্রকাশ্য বস্তুর অভাববশতঃই তাহার অনভিব্যক্তি হইয়া থাকে, কিন্তু (তাহার) স্বরূপের অভাববশতঃ নহে। আর বৈশেষিক প্রভৃতি মতাবলম্বীগণের তর্কও শ্রুতির সহিত বিরোধ হওয়ায় অসৎ তর্করূপে নিরাকৃত হইয়া পড়িতেছে। অতএব আত্মা অবশ্যই নিত্যচৈতন্যস্বরূপ, ইহা আমরা নিশ্চয় করিতেছি।
ইতি

Tuesday, 17 November 2020

বিষ্ণুসহস্রনামস্তোত্রম্ শাঙ্করভাষ্য (পর্ব-০১)



মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাস প্রণীত শ্রীমহাভারতের অনুশাসন পর্ব্বের ১৪৯ তম অধ্যায়ে বিষ্ণুসহস্রনাম স্তোত্রম্ এ শ্রীভগবান বিষ্ণুর সহস্রনামের মাহাত্ম্য বর্ণিত আছে। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য এই স্তোত্রম্ এর প্রাঞ্জল ভাষ্য রচনা করেছেন-

মঙ্গলাচরণঃ-

সচ্চিদানন্দরূপায় কৃষ্ণায়াক্লিষ্টকারিণে।

নমো বেদান্তবেদ্যায় গুরুবে বুদ্ধিসাক্ষীণে।।

কৃষ্ণদ্বৈপায়নং ব্যাসং সর্বলোকহিতে রতম্।

বেদাব্জভাস্করং বন্দে শমাদিনিলয়ং মুনিম্।।

সহশ্রমূর্তেঃ পুরুষোত্তমস্য সহশ্রনেতাননপাদবাহোঃ

সহস্রনাম্নাং স্তবনং প্রশস্তং নিরুচ্যতে জন্মজরাদি শান্ত্যৈ।।

সচ্চিদানন্দস্বরূপ, অনায়াসে সকল কর্ম সম্পাদনকারী, বেদান্তবেদ্য, বুদ্ধি-সাক্ষী গুরুবর শ্রীকৃষ্ণকে নমষ্কার। বেদরূপী পদ্ম এর জন্য সূর্যরূপ, শমাদির আশ্রয়, সমস্ত সংসারের হিতে তৎপর মুনিবর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকে প্রণাম করছি। সহশ্র নেত্র, মুখ, হস্ত-পদ, এবং মূখময় সহস্রমূর্তিমান শ্রীপুরুষোত্তম ভগবানের সহস্র নামাবলি প্রশস্ত স্তবনের, জন্ম-জরাদি হতে শান্তির জন্য ব্যাখ্যা করা হল।

অথ বৈশম্পায়নে জনমেজয়মুবাচ- বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে বললেন-

১. শ্রুত্বা ধর্মানশোষেণ পাবনানি চ সর্বশঃ।

যুধিষ্ঠিরঃ শান্তনবং পুনরেবাভ্যভাষত।।

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘ধর্মাণ্’ অভ্যুদয়নিঃশ্রেয়সোৎপত্তিহেতুভূতান্ চোদনালক্ষণান্ ‘অশেষেণ’ কাৎসর্ন্যেন ‘পাবনানি’ পাপক্ষয়করাণি ধর্মরহস্যানি ‘চ সর্বশঃ’ সর্বপ্রকারৈঃ ‘শ্রুত্বা যুধিষ্ঠিরো’ ধর্মপুত্রঃ ‘শান্তনবং’ শন্তনুসুতং ভীষ্মং সকলপুরুষার্থসাধনং সুখসম্পাদ্যম্ অল্পপ্রয়াসম্ অনল্পফলম্ অনুক্তমিতি কৃত্বা ‘পুনঃ’ ভূয় ‘এব অভ্যভাষণ’ প্রশ্নং কৃতবান্।।

অনুবাদঃধর্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অভ্যুদয় এবং নিঃশ্রেয়সের প্রাপ্তির হেতু স্বরূপ সম্পূর্ণবিধিরূপ ধর্ম তথা পবিত্র অর্থাৎ পাপসমূহের ক্ষয়কারী ধর্মরহস্যকে সর্বশঃ সকল প্রকার শুনে এটা অবগত হল যে এক্ষণ পর্যন্ত কোন ধর্মে বলা হয় নি, যা সকল পুরুষার্থের সাধক এবং সুখসম্পাদ্য অর্থাৎ অল্প প্রয়াসেই সিদ্ধ হওয়ায় মহান ফলস্বরূপ। শান্তনুপুত্র ভীষ্মের কাছে পুনরায় জিজ্ঞেস করল। (১)

যুধিষ্ঠির উবাচ- যুধিষ্ঠির বললেন-

২. কিমেকং দৈবতং লোকে কিং বাচ্যেকং পরায়ণম্।

স্তুবন্তঃ কং কমর্চন্তঃ প্রাপ্তুয়ুর্মানবাঃ সুভম্।।

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘কিমেকং দ্বৈবতং’ দেব ইত্যর্থঃ, স্বার্থে তদ্বিতপ্রত্যয়বিধানাৎ, ‘লোকে’ লোকনহেতুভূতে সমস্তবিদ্যাস্থানে উক্তম্ ‘যদাজ্ঞয়া প্রবর্তন্তে সর্বে’ ইতি প্রথমঃ প্রশ্নঃ। ‘কিং বাচ্যেকং পরায়ণম্’ অস্মিংল্লোকে একং পরায়ণং চ কিম্? পরম্ অয়নং প্রাপ্তব্যং স্থানং যস্মিন্নিরীক্ষীতে-

“ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থি- শ্চিদ্যন্তে সর্বশংসয়াঃ।

ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে।।” (মুণ্ডক উপনিষৎ ২/২/৯)

ইতি শ্রুতেঃ হৃদয়গ্রন্থির্ভিদ্যতে। যস্য বিজ্ঞানমাত্রেণানন্দলক্ষণো মোক্ষঃ প্রাপ্যতে; যদ্বিদ্বান্ন বিভেতি কুতশ্চন; যৎপ্রবিষ্টস্য ন বিদ্যতে পুনর্ভবঃ; যস্য চ বেদনান্তদেব ভবতি, “ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি” (মুণ্ডক উপনিষৎ ৩/২/৯) ইতি শ্রুতেঃ।

যদ্বিহায়াপরঃ পন্থা নৃণাং নাস্তি, “নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ ৬/১৫) ইতি শ্রুতেঃ।

তদুক্তমেকং পরায়ণং লোকে যত্তত্ কিমিতি দ্বিতীয়ঃ প্রশ্নঃ।‘কং’ কতমং দেবং ‘স্তুবন্তঃ’ গুণসঙ্কীর্তনং কুর্বন্তঃ, ‘কং’ কতমং দেবম্ ‘অর্চন্তঃ’ বাহ্যমাভ্যন্তরং চার্চনং বহুবিধং কুর্বন্তঃ ‘মানবা’ মনুসুতাঃ ‘শুভং’ কল্যাণং স্বর্গাদিফলং ‘প্রাপ্তুয়ুঃ’ লভেরন্নিতি পুনঃ প্রশ্নদ্বয়ম্।।

অনুবাদঃ- সমস্ত বিদ্যার স্থানপ্রকাশক হেতুস্বরূপ সংসারে একমাত্র দেবতা কে? যার বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘যার আজ্ঞাতে সমস্ত প্রাণী প্রবৃত্ত হয়’ এটি প্রথম প্রশ্ন। এখানে ‘দৈবৎ’ শব্দের অর্থ করার জন্য তদ্ধিতপ্রত্যয় ব্যবহৃত হয়েছে। অতঃ ‘দৈবতম্’ শব্দের অর্থ দেবতাই হয়।

তথা একতা পরায়ণ কে? অর্থাৎ এই সংসারে একতা পরায়ণ- একই পর আপন মানে প্রাপ্তিস্থান কে? ‘যার সাক্ষাৎকার হলেই সেই কার্য্য-কারণরূপ পরমাত্মার দর্শনে অবিদ্যারূপ হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে যায়। সমস্ত সংশয় নাশ হয়ে যায় তথা সমস্ত কর্ম ক্ষীণ হয়ে যায়।’ এই শ্রুতি অনুসারে হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে যায়।

যার জ্ঞানহওয়া মাত্রই আনন্দস্বরূপ মোক্ষ প্রাপ্তি হয়, যিনি তাকে জানেন তার সমস্ত ভয় দূর হয়ে যায়, যাতে প্রবেশ করলে আর পুণর্জন্ম হয় না, যাকে জানলে – ‘যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রহ্ম হয়ে যান’ এই শ্রুতি বাক্যানুসারে জীব ব্রহ্মই হয়ে যায়। তথা যাকে ছেড়ে মানুষের জন্য দ্বিতীয় কোন মার্গ নেই। শ্রুতি বলেছে – ‘মোক্ষের জন্য অন্য কোন উপায় নেই।’ এভাবেই সংসারে যাকে একতা পরায়ণ বলা হয়েছে তিনি কে? এটি দ্বিতীয় প্রশ্ন।

এবং কোন দেবতার স্তুতি ও গুণকীর্তন করায় তথা কোন দেবতাকে নানা উপায়ে অর্চনা অর্থাৎ বাহ্যিক এবং আন্তরিক পূজা করায় মানুষ স্বর্গাদি ফলস্বরূপ কল্যাণকর প্রাপ্তি করতে পারে? এই দুটি প্রশ্ন আরও। (২) 

৩. কো ধর্মঃ সর্বধর্মাণাং ভবতঃ পরমো মতঃ।

কিং জপন্মুচ্যতে জন্তুর্জন্মসংসারবন্ধনাৎ।।

(কঃ, ধর্ম, সর্বধর্মাণাম্, ভবতঃ, পরম্, মতঃ।

কিম্, জপন্, মুচ্যতে, জন্তু, জন্মসংসারবন্ধনাৎ।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘কো ধর্মঃ’ পুর্বোক্তলক্ষণঃ ‘সর্বধর্মাণাং’ সর্বেষাং ধর্মাণাং মধ্যে ‘ভবতঃ পরমঃ’ প্রকৃষ্টো ‘মতঃ’ অভিপ্রেত ইতি পঞ্চমঃ প্রশ্নঃ

‘কিং জপন্’ কিং জপ্যং জপন্ উচ্চোপাংশুমানসলক্ষণং জপং কুর্বন্ ‘জন্তুঃ’ জননধর্মা। অনেন জন্তুশব্দেন্ জপার্চনস্তবনাদিষু যথাযোগ্যং সর্বপ্রাণিনামধিকারং মুচয়তি। ‘জন্মসংসারবন্ধনাৎ’ জন্ম অজ্ঞানবিজৃম্ভিতানামবিদ্যাকার্যাণামুপলক্ষণম্, সংসারোহবিদ্যা তাভ্যাং, জন্মসংসারাভ্যাং যদ্বন্ধনং তস্মাৎ ‘মুচ্যতে’ মুক্তো ভবতীতি ষষ্ঠঃ প্রশ্নঃ।

মুচ্যতে জন্মসংসারবন্ধনাদিতীদমুপলক্ষণম্ ইতরেষাং ফলানামপি এতদ্গ্রহণং মোক্ষস্য প্রাধান্যখ্যাপনর্থম্।।

অনুবাদঃ- পুর্ব লক্ষণযুক্ত সমস্তধর্মের মধ্যে কোন ধর্মকে শেষ্ঠ বলা হয়েছে? এটি পঞ্চম প্রশ্ন।

তথা কোন জপ শ্রেষ্ঠ এবং কি প্রকার মানস জপ করায় জননধর্মা জীব জন্ম-সংসার-বন্ধন থেকে মুক্ত হয়? এই ‘জন্ত’ শব্দ দ্বারা জপ, অর্চন ও স্তবাদিতে সমস্ত প্রাণীর যথাযোগ্য অধিকার সূচিত করে। ‘জন্ম’ শব্দ অজ্ঞান দ্বারা প্রণীত হওয়া অবিদ্যাকার্যকে নির্দেশ করে তথা ‘সংসার’ অবিদ্যারই নাম রূপ। সেই জন্ম ও সংসারের যে বন্ধন তার থেকে নিস্তারের উপায় কি? এটি ষষ্ঠ প্রশ্ন।

‘জন্ম-সংসাররূপ বন্ধন থেকে কি করে মুক্তি হবে?’ যেখানে বলা হয়েছে মোক্ষই প্রধান। অতঃ বাক্য দ্বারা অন্য ফলেরও গ্রহণ করা বুঝায়। (৩)

কিমেকমিতি ষট্ প্রশ্নাঃ কথিতাঃ। তেষু পাশ্চাত্যোহনন্তরো জপ্যবিষয়ঃ ষষ্ঠঃ প্রশ্নোহনেন শ্লোকেন পরিহিয়তে।

শ্রীভীষ্ম উত্তরমুবাচ-

‘সেই একমাত্র দেব কে?’ ইত্যাদি বিষয়ে (যুধিষ্ঠির কর্তৃক) ৬টি প্রশ্ন করা হয়েছে উপরে। তার মধ্যে ৬নং অর্থাৎ শেষ প্রশ্নটি যা জপ বিষয়ে করা হয়েছিল নিম্নের শ্লোকে তারই উত্তর দেওয়া হচ্ছে।

শ্রীভীষ্মদেব উত্তর দিলেন-

৪. জগৎপ্রভুং দেবদেবমনন্তং পুরুষোত্তমম্।

স্তুবন্নামসহস্রেণ পুরুষঃ সততোত্থিতঃ।।

(জগৎপ্রভুম্, দেবদেবম্, অনন্তম্, পুরুষোত্তমম্।

স্তুবন্, নামসহস্রেণ, পুরুষঃ, সততোত্থিতঃ।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ সর্বেষাং বহিরন্তঃ শত্রুণাং ভয়হেতুর্ভীষ্মঃ মোক্ষধর্মাদীনাং প্রবক্তা সর্বজ্ঞঃ।

‘জগৎ’ স্থাবরজঙ্গমাত্মকং তস্য ‘প্রভুং’ স্বামিনম্, ‘দেবদেবং’ দেবতাং ব্রহ্মাদীনাং দেবম্, ‘অনন্তং’ দেশতঃ কালতো বস্তুতশ্চাপরিচ্ছিন্নম্, ‘পুরুষোত্তমং’ ক্ষরাক্ষরাভ্যাং কার্যকারণাভ্যামুৎকৃষ্টং, ‘নামসহস্রেণ’ নাম্নাং সহস্রেণ ‘স্তুবন’ গুণান্মঙ্কোর্তয়ন্ ‘সততোত্থিতো’ নিরন্তর ম্রুদ্যুক্তঃ। ‘পুরুষঃ’ পুর্ণত্বাৎ পুরি শয়নাদ্বা পুরুষঃ – ‘সর্বদুঃখাতিগো ভবেৎ’ ইতি সর্বত্র সম্বধ্যতে।।

অনুবাদঃ মোক্ষধর্মাদির বর্ণনাকারী সর্বজ্ঞ (দেবব্রতকে) ই বাহ্যিক ও আন্তরিক সমস্ত শত্রুভয়ের কারণ হওয়ায় ভীষ্ম বলা হয়। স্থাবরজঙ্গমরূপ যে সংসার তার প্রভু-জগৎ স্বামী, দেবোকেদেব ব্রহ্মা, অনন্ত অর্থাৎ দেশ, কাল ও বস্তু দ্বারা অপরিচ্ছন্ন, কার্য-কারণরূপ ক্ষর ও অক্ষর হতে শ্রেষ্ঠ পুরুষোত্তমের সহস্রনামের দ্বারা নিরন্তর তৎপর হয়ে স্তব- গুণসংকীর্তন করায় পুরুষ (জীব) সমস্ত দুঃখ হতে নিস্তার হয়ে যায়। পূর্ণ হওয়ায় অথবা শরীররূপ পুরমেং শয়ন করায় জীবের নামই ‘পুরুষ’। এখান থেকে (ষষ্ঠ শ্লোক পর্যন্ত) ‘সর্বদুঃখাতিগো ভবেৎ’ (সমস্ত দুঃখ থেকে নিস্তার হয়ে যায়) এই বাক্যটি প্রত্যেক শ্লোকের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হবে। (৪)

উত্তরেণ শ্লোকেন চতুর্থঃ প্রশ্নঃ সমাধীয়তে – নিন্মের শ্লোকে চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে-

৫. তমেব চার্চয়ন্নিত্যং ভক্ত্যা পুরুষমব্যয়ম্।

ধ্যায়ংস্তুবন্নমস্যংশ্চ যজমানস্তমেব চ ।।

(তম্, এব, চ, অর্চয়ন্, নিত্যম্, ভক্ত্যা, পুরুষম্, অব্যয়ম্। ধ্যায়ন্, স্তুবন্, নমস্যন্, চ, যজমানঃ, তম্, এব, চ।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘তমেব চার্চয়ন্’ বাহ্যার্চনং কুর্বন্ ‘নিত্যং’ সর্বেষু কালেষু ভক্তির্ভজনং তাৎপর্যং তয়া ‘ভক্ত্যা পুরুষমব্যয়ম্’ বিনাশক্রিয়ারহিতম্, তমেব চ ‘ধ্যায়ন্’ পূর্বোক্তেন ‘নমস্যন্’ নমস্কারং কুর্বন্, পূজাশেষভূতমুভয়ং স্তুতিনমষ্কারলক্ষণং ‘যজমান’ পূজকঃ ফলভোক্তা।

অথবা, অর্চয়ন্নিত্যনেনোভয়বিঘ্নমর্চনমুচ্যতে। ধ্যায়ংস্তুবন্নমস্যংশ্চেত্যনেন মানসং বাচিকং কায়িকং চোচ্যতে।।

অনুবাদঃ- তথা সেই অবিনাশী পুরুষের নিত্য ভজনা করাকে ভক্তি বলে, সেই ভক্তিতে মগ্ন হয়ে পূজা এবং ধ্যান (আন্তরিক পূজা) পুর্বোক্ত উপায়ে অর্থাৎ সহস্রনাম দ্বারা স্তব এবং নমষ্কার করায় যজমান (পূজারী বা ফল ভোক্তা) এর সমস্ত দূঃখ দূর হয়ে যায়।

অথবা, ‘অর্চয়ন্’ শব্দ দ্বারা এখানে বাহ্যিক ও আন্তরিক দুই প্রকারের অর্চনা তথা ধ্যানকে বুঝানো হয়েছে। স্তব ও নমষ্কার করাকে মানসিক, শারিরীক ও বাচিক পূজা বলা হয়েছে। (৫)

তৃতীয়ং প্রাশ্নং পরিহরতি উত্তরৈস্ত্রিভিঃ পাদৈঃ – নিন্মে তিন পদে তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হচ্ছে-

৬. অনাদিনিধনং বিষ্ণুং সর্বলোকমহেশ্বরম্।

লোকাধ্যত্তুং স্তুবন্নিত্যং সর্বদুঃখাতিগো ভবেত্।।

(অনাদিনিধনম্, বিষ্ণুম্, সর্বলোকমহেশ্বরম্।

লোকাধ্যক্ষম্, স্তুবন্, নিত্যম্, সর্বদুঃখাতিগঃ, ভবেৎ।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘অনাদিনিধনং’ ষড়ভাববিকারবর্জিতম্, ‘বিষ্ণুং’ ব্যাপনশীলম্, সর্ব লোক্যতে ইতি লোকো দৃশ্যবর্গো লোকস্তস্য নিয়ন্তৃণাং ব্রহ্মাদীনামপীশ্বরত্বাৎ ‘সর্বলোকমহেশ্বরঃ তম্’ লোকং দৃশ্যবর্গং সাভাবিকেন বোধেন সাক্ষাৎপশ্যতীতি ‘লোকাধ্যক্ষঃ তং নিত্যং’ নিরন্তরং ‘স্তুবন্ সর্বদুঃখাতিগো ভবেৎ’ ইতি ত্রয়াণাং স্তবনার্চনজপানাং সাধারণং ফলবচনম্। সর্বাণ্যাধ্যাত্মিকাদীনি দুঃখান্যতীত্য গচ্ছতীতি সর্বদুঃখাতিগঃ ভবেৎ স্যাৎ।।

অনুবাদঃ- অনাদিনিধন অর্থাৎ [হওয়া, জন্ম নেওয়া, বড় হওয়া, পরিবর্তন হওয়া, সূক্ষ্ম হওয়া, নষ্ট হওয়া -এই ] ৬টি ভাববিকার রহিত, বিষ্ণু অর্থাৎ ব্যাপক তথা সম্পূর্ণ লোকের মহেশ্বর – যা কিছু দেখি সেই সমস্ত দৃশ্যবর্গ নাম লোকের নিয়ন্তা ব্রহ্মাদিরও প্রভু হওয়ায় যিনি সর্বলোকমহেশ্বর এবং সমস্ত দৃশ্যবর্গকে নিজের স্বাভাবিক জ্ঞান দ্বারা সাক্ষাৎ দর্শনহেতু লোকধ্যক্ষ তিনি। সেই দেব এর নিরন্তর স্তুতি করায় মানুষের সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে যায়। এভাবে স্তবন, অর্চন ও জপ এই তিনেরই ফল একই বলা হয়েছে। সম্পূর্ণ অর্থাৎ আধ্যাত্মিকাদি তিন প্রকারের দুঃখেরই নাশ হয় মানে সমস্ত দুঃখেরই অতীত হয়ে যায়। (৬)

পুনরপি তমেব স্তুত্যং বিশিনষ্টি- সেই স্তুতিকারী দেবতার বৈশিষ্ট্য পুনরায় বলছি-

৭. ব্রহ্মণ্যং সর্বধর্মজ্ঞং লোকানাং কীর্তিবর্ধনম্।

লোকনাথং মহদ্ভূতং সর্বভূতভবোদ্ভবম্।।

(ব্রহ্মণ্যম্, সর্বধর্মজ্ঞম্, লোকানাম্, কীর্তিবর্ধনম্।

লোকনাথম্, মহদ্ ভূতম্, সর্বভূতভবোদ্ভবম্।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘ব্রহ্মণ্যং’ ব্রহ্মণে স্রষ্টৃ ব্রাহ্মণায় তপসে শ্রুতয়ে হিতম্, সর্বান্ ধর্মান্ জানাতীতি ‘সর্বধর্মজ্ঞঃ তম্, লোকানাং’ প্রাণিনাং ‘কীর্তয়ঃ’ যশাংসি স্বশক্ত্যানুপ্রবেশেন ‘বর্ধয়তীতি তম্’ লোকৈর্নাথ্যতে লোকানুপতাপয়তে শাস্ত্রে লোকানামীষ্ট ইতি বা ‘লোকনাথঃ তম্ মহৎ’ ব্রহ্ম-বিশ্বোৎকর্ষেণ বর্তমানত্বাৎ- ‘মহদ্ভূতং’ পরমার্থসত্যম্ সর্বভূতানাং ভবঃ সংসারো যৎসকাশাদুদ্ভবতীতি ‘সর্বভূতভবোদ্ভবঃ তম্’।

অনুবাদঃ- যে ব্রহ্মণ্য অর্থাৎ জগতের রচনাকর ব্রহ্মার তথা ব্রাহ্মণ, তপ ও শ্রুতির হিতকারী, যিনি সকল ধর্মকে জানেন, সকল লোক অর্থাৎ প্রাণীবর্গে প্রবিষ্ট হয়ে তাদের যশকে যিনি বৃদ্ধি করেন, যিনি লোকনাথ অর্থাৎ লোকের প্রতিনিধি অথবা লোকদের অনুতপ্ত বা শাসন কর্তা অথবা লোকদের প্রতি রাজত্বকারী, যিনি নিজে সমস্ত উৎকর্ষ দ্বারা বর্তমান হওয়ার জন্য মহদ্ অর্থাৎ ব্রহ্ম তথা মহদ্ভূত অর্থাৎ পরমার্থত সত্য এবং যার সান্নিধ্যমাত্র সমস্ত ভূতের উৎপত্তি-স্থান সংসার উৎপন্ন হয় এইজন্য যিনি সমস্ত ভূতের উদ্ভবস্থান সেই পরমেশ্বরের স্তব করে মানুষ সমস্ত দুঃখ হতে মুক্তি পেয়ে যায়। (৭)

পঞ্চমং প্রশ্নং পরিহরতি-

৮. এষ মে সর্বধর্মাণাং ধর্মোহধিকতমে মতঃ।

যদ্ভক্ত্যা পুণ্ডরীকাক্ষং স্তবৈরর্চেন্নরঃ সদা।।

(এষঃ, মে, সর্বধর্মাণাম্, ধর্মঃ, অধিকতম্ঃ, মতঃ।

যৎ, ভক্ত্যা, পুণ্ডরীকাক্ষম্, স্তবৈঃ অর্চেৎ, নরঃ, সদা।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ ‘সর্বেষাং’ চোদনালক্ষণানাং ‘ধর্মাণামেষ’ বক্ষ্যমাণো ‘ধর্মোহধিকতম্’ ইতি মে মম ‘মতঃ’ অভিপ্রেতঃ, যদ্ভক্ত্যা তাৎপর্যেণ ‘পুণ্ডরীকাক্ষং’ হৃদয়পুণ্ডরীকে প্রকাশমানং বাসুদেবং স্তবৈর্গুণসঙ্কীর্তনলক্ষণৌঃ স্তুতিভিঃ ‘সদার্চেৎ’ সৎকারপূর্বকমর্চনং করোতি ‘নরঃ’ মনুষ্যঃ ইতি যৎ এষ ধর্ম ইতি সম্বন্ধঃ।

অস্য স্তুতিলক্ষণস্যার্চনস্যাধিক্যে কিং কারণম্ উচ্যতে- হিংসাদিপুরুষান্তরদ্রব্যান্তরদেশকালাদিনিয়মানপেক্ষত্বম্ আধিক্যে কারণম্।

“ধ্যায়ন্ কৃতে যজন্ যজ্ঞৈ-

ত্রেতায়াং দ্বাপরেহর্চয়ন্।

যদাপ্রোতি তদান্পোতি

কলৌ সঙ্কীর্ত্য কেশবম্।।”

ইতি বিষ্ণুপুরাণে (৬/২/১৩)

“জপ্যেনৈব তু সংসিদ্ধ্যেদ্

ব্রাহ্মণো নাত্র সংশয়ঃ।

কুর্যাদন্যন্ন বা কুর্যা-

ন্মৈত্রো ব্রাহ্মণ উচ্যতে।।”

ইতি মানবং বচনম্ (মনুঃ ২/৮৭)

“জপস্তু সর্বধর্মেভ্যঃ

পরমো ধর্ম উচ্যতে

অহিংসয়া চ ভূতানাং

জপযজ্ঞঃ প্রবর্ততে।।”

ইতি মহাভারতে। ‘যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোহস্মি’ (গীতা ১০/২৫) ইতি ভগবদ্বচনম্।

এতৎসর্বমভিপ্রেত্য ‘এষ মে সর্বধর্মাণাং ধর্মোহধিকতমো মতঃ।’ (বিষ্ণুসহস্রনাম ৫) ইত্যুক্তম্।।

অনুবাদঃ- সম্পূর্ণ বিধিরূপ ধর্মে আমি নিম্নে বর্ণিত এমন ধর্মকে সবচেয়ে বড় মনে করি কারণ মানুষ শ্রীপুণ্ডরীকাক্ষের অর্থাৎ নিজের হৃদয়কমলে বিরাজমান ভগবান বাসুদেবের ভক্তিপূর্বক – তৎপরতার সাথে গুণসঙ্কীর্তণরূপ স্তুতি দ্বারা সদা অর্চন করে অর্থাৎ মানুষের ন্যায় প্রীতীপূর্বক পূজা করে- এরূপ ধর্মই আমার সবচেয়ে অধিক মান্য।

এই স্তুতিরূপ অর্চনের অধিক মান্যতার কারণ কি? সেটাই বলছি-

হিংসাদি পাপ-কর্মের অভাব তথা অন্য পুরুষ এবং দ্রব্য, দেশ ও কালের নিয়মের অনাবশ্যকতাই এর অধিক মান্যতার কারণ। অর্থাৎ জপ যজ্ঞের জন্য স্থান, কাল ও পাত্রের বিশেষ কোন নিয়ম আবশ্যক নয়।

বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, “সত্যযুগে ধ্যান দ্বারা, ত্রেতাযুগে যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা, দ্বাপরে পূজা-পার্বণ দ্বারা মানুষ যা লাভ করেছে কলিযুগে ভগবান এর নামসঙ্কীর্তন করায় সেই একই ফল অতি সহজেই প্রাপ্ত হওয়া যায়।”

মনুর বচনে, “নিঃসন্দেহে ব্রাহ্মণ অন্য কর্ম করে কিংবা না করেও কেবল জপের দ্বারা পূর্ণ সিদ্ধি লাভ করতে পারে। এই ব্রাহ্মণকেই সকলের মিত্র বলা হয়ে থাকে।”

মহাভারতে বলা হয়েছে, “সমগ্র ধর্মের মধ্যে জপই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। কারণ জপ যজ্ঞ কোন প্রাণী হিংসা না করেই সম্পন্ন করা যায়।”

গীতায় ভগবান বলেছেন, “যজ্ঞের মধ্যে আমি জপ যজ্ঞ।”

এই সকল কথা বিবেচনা করেই ভীষ্মদেব বলেছিলেন যে সমস্ত ধর্মের মধ্যে এই জপ ধর্মই সবচেয়ে অধিক মান্য আমার। (৮)

দ্বিতীয় প্রশ্নং সমাধত্তে-

৯. পরমং যো মহত্তেজঃ পরমং যো মহত্তপঃ

পরমং যো মহদ্ ব্রহ্ম পরমং যঃ পরায়ণম্।।

(পরমম্, যঃ, মহদ্, তেজঃ, পরমম্, যঃ, মহৎ, তপঃ।

পরমম্, যঃ, মহৎ, ব্রহ্ম, পরমম্, যঃ, পরায়ণম্।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ ‘পরমং’ প্রকৃষ্টং ‘মহৎ’ বৃহৎ ‘তেজ’ চৈতন্যলক্ষণং সর্বাবভাসকং, “যেন সূর্যস্তপতি তেজসেদ্বঃ।” (তৈঃব্রাঃ ৩১২/৯৮) “তদেবা জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ” (বৃঃউপঃ ৪/৪/১৬) “ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকম্” (মুঃউপঃ ২/২/১০) ইত্যাদি শ্রুতেঃ “যদাদিত্যগতং তেজঃ” (গীতা ১৫/১২) ইত্যাদি স্মৃতেশ্চ।

‘পরমং তপঃ’ তপত আজ্ঞাপয়তীতি তপঃ, “য ইমং চ লোকং পরমং চ লোকং সর্বাণি চ ভূতানি যোহন্তরো যময়তি” (বৃঃউপঃ ৩/৮/১) ইত্যন্তর্যামীব্রাহ্মণে সর্বনিয়ন্তৃত্বং শ্রুয়তে।

“ভীষাস্মাদ্বাতঃ পবতে ভীষোদেতি সূর্যঃ। ভীষাস্মাদগ্নিশ্চেন্দ্রশ্চ মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ” (তৈঃউপঃ ২/৭/১) ইত্যাদি তৈত্তিরীয়কে।

তপতিষ্ট ইতি বা তপঃ তস্যৈশ্বর্যমনবচ্ছিন্নমিতি মহত্ত্বম্, “এব সর্বেশ্বরঃ” (মাঃউপঃ ৬) ইত্যাদি শ্রুতে।

‘পরমং’ সত্যাদিলক্ষণং ‘ব্রহ্ম’ মহনীয়তয়া মহৎ। ‘পরমং’ প্রকৃষ্টং পুনরাবৃত্তিশঙ্কারহিতম্। ‘পরায়ণং’ পরম্ অয়নংপরায়ণম্।

পরমগ্রহণাৎসর্বত্র অপরং তেজঃ আদিত্যাদিকং ব্যাবর্ত্যতে। সর্বত্র যো দেব ইতি বিশেষ্যতে চ-

যো দেবঃ পরমং তেজঃ পরমং তপঃ পরমং ব্রহ্ম পরমং পরায়ণং, স একং সর্বভূতানাং পরায়ণমিতি বাক্যার্থঃ

দ্বিতীয় প্রশ্নের সমাধান করা হচ্ছে-

অনুবাদঃ- যিনি সকলের প্রকাশক, পরম অর্থাৎ উত্তম এবং মহান্ চিন্ময় প্রকাশ, যার বিষয়ে “যে তেজ দ্বারা প্রকাশিত হয়ে সূর্য তাপ দেয়, তাকে দেবগণ জ্যোতিরও জ্যোতি বলে থাকে। সেখানে না সূর্যের প্রকাশ পৌছায় এবং না চন্দ্রমা ও তারকার প্রকাশ পৌছায়। ইত্যাদি শ্রুতিতে তথা সূর্যের অন্তর্গত যে তেজ আছে ইত্যাদি স্মৃতি দ্বারাও এটাই প্রমাণিত হয়।

যিনি পরম তাপ অর্থাৎ তাপ প্রদানকারী তথা তাপ প্রদানের জন্য আদেশকারী, যেমন- ‘যিনি এই লোককে, পরলোককে তথা সমস্ত প্রাণীকে তার ভিতরে অবস্থিত হয়ে শাষণ করছে, এই শ্রুতি দ্বারা অন্তর্যামী ব্রাহ্মণে তার সকল কিছুর নিয়ামক বলা হয়ে থাকে।

তৈত্তিরীয় শ্রুতিতেও বলা হয়েছে, “তার ভয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়, তার ভয়ে সূর্য উদিত হয়, তথা তার ভয়ে অগ্নি, ইন্দ্র এবং পঞ্চম মৃত্যু ঘটে থাকে।

তাপ প্রদান করে অথবা শাসন করে বলে তিনি তপ। তার ঐশ্বর্য অপরিমিত যার জন্য তিনি মহান। শ্রুতিও বলেছে যে তিনি সর্বেশ্বর।

যিনি সত্যাদি লক্ষণযুক্ত পরব্রহ্ম তথা মহত্তাযুক্ত হওয়ার জন্য মহান এবং যিনি পুনরাবৃত্তির শঙ্কা হতে রহিত পরম- শ্রেষ্ঠ পরায়ণ। পরম আশ্রয়ের নাম পরায়ণ।

এখানে সর্বত্র পরম শব্দের গ্রহণ করায় সূর্যাদি এবং অন্য তেজের ভিন্নার্থ করা হল। ‘যে দেব’ এই পদের বিশেষতা ব্যাক্ত হয়েছে যেভাবে-

” যে দেব পরম তেজ, পরম তপ, পরম ব্রহ্ম ও পরম পরায়ণ তিনিই সমস্ত প্রাণীর পরম গতি” ইহাই এই বাক্যের অর্থ। (৯)

ইদানীং প্রথমপ্রশ্নস্যোত্তরমাহ-

১০. পবিত্রাণাং পবিত্রং যো মঙ্গলানাং চ মঙ্গলম্।

দৈবতং দেবতানাং চ ভূতানাং যোহব্যয়ঃ পিতা।।

(পবিত্রাণাম্, পবিত্রম্, যঃ, মঙ্গলানাম্, চ, মঙ্গলম্।

দৈবতম্, দেবতানাম্, চ, ভূতানাম্, যঃ, অব্যয়ঃ, পিতা।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ ‘পবিত্রাণাং পবিত্রং’ পাবনানাং তীর্থাদীনাং পবিত্রম্। পরমস্তু পুমান্ ধ্যাতো দৃষ্টঃ কীর্তিতঃ স্তুতঃ সম্পুজিতঃ স্মৃতঃ প্রণতঃ পাপ্মনঃ সর্বানুন্মূলয়তীতি পরমং পবিত্রম্। সংসারবন্ধহেতুভূতং পুণ্যাপুণ্যাত্মকং কর্ম তৎকারণং চাজ্ঞানং সর্ব নাশয়তি স্বয়াথাত্ম্যজ্ঞানেনেতি বা পবিত্রাণাং পবিত্রম্।

“ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থি-

শ্চিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ।

ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি

তস্মিন্ দৃষ্ট পরাবরে।।” (মুণ্ডকঃ উপঃ ২/২/৭)

“একোহপি কৃষ্ণাস্য কৃতঃ প্রণামো

দশাশ্বমেধাবভৃতেন তুল্যঃ

দশাশ্বমেধী পুনরেতি জন্ম

কৃষ্ণাপ্রণামী ন পুনর্ভবায়।।” (মহাভারতঃ শান্তিঃ ৪৭/৯১)

‘মঙ্গলানাং চ মঙ্গলং’ মঙ্গলং সুখং তৎসাধনং তজ্জ্ঞাপকং চ, তেষামপি পরমানন্দলক্ষণং পরং মঙ্গলমিতি মঙ্গলানাং চ মঙ্গলম্। ‘দৈবতং দেবতানাং চ’ দেবানাং দেবঃ, দ্যোতনাদিভিঃ সমুৎকর্ষেণ বর্তমানত্বাৎ। ‘ভূতানাং যঃ অব্যয়’ ব্যয়রহিতঃ ‘পিতা’ জনকো যো দেবঃ, স একং দৈবতং লোক ইতি বাক্যার্থঃ।

“একো দেবঃ সর্বভূতেষু গুঢ়ঃ

সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা।

কর্মাধ্যক্ষঃ সর্বভূতাধিবাসঃ

সাক্ষী চেতাঃ কেবলো নির্গুণশ্চ।।” (শ্বেতাশ্বতর উপঃ ৬/১১)

“একমেবাদ্বিতীয়ম্” (ছান্দোগ্য উপঃ ৬/২/১)

“অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ

অহমাদিশ্চ মধ্যং চ ভূতানামন্ত এব চ।। (গীতা ১০/২০)

ইতি অদ্বৈতাত্মজ্ঞানং সম্যগ্দর্শনমিত্যুক্তং ভগবতাপি। তস্মাদাত্মন্যেবেশ্বরে মনো দধীত।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হচ্ছে –

অনুবাদঃ- যিনি পবিত্র হতেও পবিত্রতম অর্থাৎ পবিত্রকারী তীর্থাদিও পবিত্র করেন। সেই পরমপুরুষ পরমাত্মা যার ধ্যান, দর্শন, কীর্তন, স্তুতি, পূজা, স্মরণ তথা প্রণাম করায় সমস্ত পাপ থেকে বিমুক্ত করেন এজন্যই তিনি পরম পবিত্র। অথবা এমনটা বুঝতে হবে যে সংসারবন্ধন হেতু পাপ-পূণ্যরূপ কর্ম, পরমাত্মা নিজ স্বরূপের যথার্থ জ্ঞান দ্বারা কর্মকে কারণরূপ সেই সম্পূর্ণ অজ্ঞানকে নষ্ট করে দেয়। এজন্য তিনি পবিত্রতম হতেও পবিত্র।

মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে সেই পরাবর পরমাত্মার দর্শন হলে জীবগণের অবিদ্যারূপ হৃদয়গ্রন্থি ভঙ্গ হয়ে যায়। তার সম্পূর্ণ সংশয় নাশ হয়ে যায় এবং কর্ম ক্ষীণ হয়ে যায়।

মহাভারত শান্তিপর্বে বলা হয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে একবার প্রণাম করা দশ অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান। অর্থাৎ দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞে যে পবিত্রতা অর্জিত হয় তা একবার শ্রীকৃষ্ণকে প্রণামে অর্জন করা যায়। সেই দশ অশ্বমেধ যজ্ঞকারীদেরও পুণর্জন্ম হয় কিন্তু কৃষ্ণকে প্রণাম করলে তাদের আর পুনর্জন্ম হয় না।

মঙ্গল বলতে সুখকে বুঝায়; যিনি তার সাধক এবং জ্ঞাপক তার পরমানন্দরূপ পরম মঙ্গল হওয়ায় তিনি (বিষ্ণু) মঙ্গলেরও মঙ্গল। তিনি দেবতাদেরও দেবতা কারণ তিনি প্রকাশাদির মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। প্রাণীদের যে অব্যয় অবিনাশী পিতা অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা। সেই আদি দেবই ভুবনের একমাত্র দেবতা। এরূপই বাক্যার্থ।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে সেই এক দেবতাই সমস্ত প্রাণীতে লুকায়িত রয়েছে। সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন। সমস্ত জীবের অন্তরাত্মা, সমস্ত কর্মের বিভাগকর্তা, সমস্ত ভূতের অধিষ্ঠাতা, সকলের সাক্ষী, সকলের চৈতন্য দাতা, এবং কেবল নির্গুণ ব্রহ্ম।

ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে তিনিই এক ও অদ্বিতীয়।

গীতায় বলা হয়েছে আমিই সর্বভূতে অবস্থিত আত্মা। তথা সমস্ত জীবের আদি, মধ্য ও অন্ত আমিই।

এভাবেই শ্রীভগবান অদ্বৈত – আত্মদর্শনকেই সম্যক দর্শন বলেছেন। সেই এক ঈশ্বরেই মনকে স্থির রাখতে বলা হয়েছে।


সৌন্দর্যলহরী বা আনন্দলহরী (পর্ব-০১)



ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য বিরচিত দেবীস্তুতিসমূহের মধ্যে আনন্দলহরী অন্যতম। এই আনন্দলহরীর মাধবাচার্য্য-সম্মত নাম সৌন্দর্যলহরী।

শিবঃ শক্ত্যা যুক্তো যদি ভবতি শক্তঃ প্রভবিতুং

ন চেদেবং দেবো ন খলু কুশলঃ স্পন্দিতুমপি ।

অতস্ত্বামারাধ্যাং হরিহরবিরিঞ্চাদিভিরপি

প্রণন্তুং স্তোতুং বা কথমকৃতপুণ্যঃ প্রভবতি ॥ ১॥

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থঃ-শিব নির্বিশেষ ব্রহ্ম, নিরাকার, সর্বব্যাপক, তিনি শক্তি অর্থাৎ মায়া যুক্ত হইয়া ঈশ্বর সৃষ্টিস্থিতিসংহারকর্ত্তা হন, নতুবা শক্তিরহিত হইলে তিনি স্পন্দনেও অসমর্থ; এই অংশের আগম সম্মত অর্থ এই-

শিব-উর্দ্ধমুখ চারটী ত্রিকোণরেখা,-শক্তি অধোমুখ পাঁচটী ত্রিকোনরেখা সহ মিলিত হইলে অ্থাৎ শিবশক্তিময় শ্রীচক্র হইলে, তাহা হইতে সৃষ্টিস্থিতিসংহারকার্য্য সম্পন্ন হয়। কেবল শিব স্পন্দনেও অশক্ত।

শিব শব্দে 'ক' কারাদি ব্যঞ্জনবর্ণ, শক্তি শব্দে 'অ' কারাদি স্বরবর্ণ। শিব যদি শক্তিযুক্ত হন অর্থাৎ ব্যঞ্জনবর্ণ যদি স্বরবর্ণের সহিত মিলিত হয়, তাহা হইলেই বেদ প্রভৃতি ব্যক্ত করিতে পারে; অন্যথা স্বরবর্ণ যুক্ত না হলে ব্যঞ্জনবর্ণ স্পন্দিত অর্থাৎ উচ্চারিতই হয় না।

অথবা শিব শব্দে ইকার যুক্ত না থাকিলে শব হয়, শবে ইকার যুক্ত থাকিলে ঈশ্বরবাচক হইয়া থাকে। কিংবা শিব শব্দে হং, শক্তি শব্দে সঃ। শিবশক্তিযুক্ত হইলে অর্থাৎ হংসঃ এই বর্ণদ্বয় একত্র মিলিত হইলে তন্ত্রোক্ত প্রধানমন্ত্র হইয়া থাকে। জীব নিঃশ্বাস প্রশ্বাস দ্বারা সর্বদা এই মন্ত্র জপ করিতেছে। নিঃশ্বাস আকর্ষণে হং, নিঃশ্বাস পরিত্যাগে সঃ উচ্চারিত হয়। ইহার নাম অজপা মন্ত্র।

হে মাতঃ, তুমি প্রণব প্রভৃতি বেদবাক্য দ্বারা আরাধ্যা, হরি-হর-বিরঞ্চিবাচক অর্থাৎ অকার-উকার-মকারবাচক। প্রণবে যেরূপ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই তিন দেবতা প্রতিষ্ঠিত আছেন, সেইরূপ এই তিন দেবতাতেও ইচ্ছাশক্তি, ক্রিয়া শক্তি ও জ্ঞানশক্তি, এই শক্তিত্রয় অবস্থিত রহিয়াছেন। ক্রিয়াশক্তি ব্রহ্মাতে অবস্থিতি করত সৃষ্টি করিতেছেন, জ্ঞানশক্তি বিষ্ণুতে অধিষ্ঠানপূর্বক পালনে প্রবৃত্ত হইতেছেন; আর ইচ্ছাশক্তি মহেশ্বরে অধিষ্ঠান করিয়া সংহার করিতেছেন; ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বরের সামর্থ্যের তুমিই মূল।

সেই তোমাকে কায়িক, বাচিক ও মানসিক নমস্কার করিতে অথবা স্তব করিতে প্রাক্তন পূণ্যহীন ব্যক্তির সামর্থ্য কিরূপে হইতে পারে?

তনীয়াংসং পাংসুং তব চরণপঙ্কেরুহভবং

বিরিঞ্চিঃ সঞ্চিন্বন্ বিরচয়তি লোকানবিকলম্ ।

বহত্যেনং শৌরিঃ কথমপি সহস্রেণ শিরসাং

হরঃ সংক্ষুদ্যৈনং ভজতি ভসিতোদ্ধূলনবিধিম্ ||২||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - পরমাণু হতে ভূরাদি লােক-সৃষ্টি, ও প্রসিদ্ধই আছে, হে মাতঃ, সে পরমাণু তােমারই চরণরজঃকণা। ব্রহ্মা তাই সঞ্চয় করে অব্যাহতভাবে চতুর্দশ লােক সৃষ্টি করেছেন, বিষ্ণু অনন্তরূপে সহস্র মস্তক দ্বারা লােকরূপে পরিণত সেই পাদপদ্মরেণু কোন প্রকারে রক্ষা করছেন। আর হর অন্তকালে তাকে চুর্ণ করে তদ্দ্বারা ভস্ম মাখার কার্য্য সম্পন্ন করেন।

হে জননি! ব্ৰহ্মা তােমার পাদপদ্মস্থিত অল্পমাত্র ধূলি সংগ্রহ করে (অর্থাৎ পরমাণু লয়ে) তদ্দ্বারা এই জগৎ প্রপঞ্চ নির্ম্মাণ করেছেন। পরে বিষ্ণু অনন্তরূপে সহস্র মন্তক দ্বারা ত্বদীয় (পাদপদ্ম-পরাগবিনির্মিত) সেই জগৎ ধারণ করছেন। প্রলয়কালে হর স্বীয় তেজো দ্বারা এই জগৎ (দগ্ধ ও ভস্মবশিষ্ট) বিচূর্ণিত করে নিজ অঙ্গে সেই ভম্ম লেপন করে থাকেন ||২||

অবিদ্যানামন্ত-স্তিমির-মিহিরদ্বীপনগরী

জড়ানাং চৈতন্য-স্তবক-মকরন্দ-স্রুতিঝরী ।

দরিদ্রাণাং চিন্তামণিগুণনিকা জন্মজলধৌ

নিমগ্নানাং দংষ্ট্রা মুররিপু-বরাহস্য ভবতি ||৩||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতী! আপনার চরণরেণু অবিদ্যাগ্রস্ত মানবগণের আন্তরিক অন্ধকারের পক্ষে সূর্য্যোদয়-দ্বীপনগরী তুল্য, অজ্ঞদিগের চৈতন্য-কল্পবৃক্ষের কুসুম মকরন্দক্ষরণ নির্ঝরস্বরূপ, দরিদ্রগণের চিন্তামণিহার স্বরূপ এবং সংসারসাগরনিমগ্নদের পক্ষে বরাহরূপী ভগবান বিষ্ণুর দন্তস্বরূপ হচ্ছেন। ভাবার্থ এই যে, বেদে আছে, সুর্য্য জল হতে উত্থিত হয়েন, কবি তদনুসারে কল্পনা করলেন, সমুদ্রস্থ এক তেজোময় দ্বীপের নগরীতে সূর্য্যের রথ, সে নগরীতে অন্ধকারের একেবারেই সম্পর্ক নাই। ভগবতীর চরণরেণুও সেইরূপ, সেই রেণু সংবন্ধ যথায় ঘটে, তথায় অস্তরের অন্ধকার অজ্ঞান থাকতেই পারে না।

হে মাতঃ! অজ্ঞানতমসাচ্ছন্ন ব্যক্তিদের অন্তঃকরণস্থ অহঙ্কার-রূপ গাঢ় অন্ধকার দূর করতে তুমি দ্বাদশাদিত্যের উদয়-নগরীস্বরূপা, নির্ব্বোধদের জ্ঞান কুসুম স্তবক মকরন্দ ক্ষরণে তুমিই শিরা-স্বরূপা, অর্থাৎ তুমি নির্ব্বোধ ব্যক্তিদেরকেও বিশিষ্ট জ্ঞান প্রদান করে থাক। তুমি দরিদ্র জনগণের অভীষ্ট ফলপ্রদ চিন্তামণিশক্তি এবং সংসারসাগরনিমগ্নগণের উদ্ধারে বরাহরূপী বিষ্ণুর দংষ্ট্রাস্বরূপ,অর্থাৎ উদ্ধারকর্ত্রী ||৩||

ত্বদন্যঃ পাণিভ্যামভয়বরদো দৈবতগণঃ

ত্বমেকা নৈবাসি প্রকটিতবরাভীত্যভিনয়া ।

ভয়াৎ ত্রাতুং দাতুং ফলমপি চ বাঞ্ছাসমধিকং

শরণ্যে লোকানাং তব হি চরণাবেব নিপুণৌ ||৪||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে মা, হস্তযুগল দ্বারা বর ও অভয়দানের অভিনয়- প্রকাশ একা তুমিই যে কর, তা নয়, তােমার ব্যতীত, দেবতারা হস্তযুগল দ্বারা বর ও অভয়মুদ্রা ধারণ করে থাকেন, হে শরণ্যে, এই চিন্তা করে লােক সমূহকে ভয় হতে রক্ষা, এ আকাঙ্ক্ষার অতিরিক্ত ফলদান করতে তােমার চরণযুগলই নিরত হয়েছেন। ( অপর দেবতা হতে এটাই আপনার বিশেষত্ব ) ।

হে লােকশরণ্যে, হস্তুযুগলে অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা প্রদর্শনাভিনয় তােমার ব্যতীত অপর দেবতাগণ করে থাকেন। কেবল এক তুমিই সমপ্রত্যক্ষী কৃত বর ও অভয়দান করায় অন্য দেবতার বর ও অভয় মুদ্রার অভিনয়কারিণী নয়। যেহেতু তােমার চরণযুগলই ভর হতে রক্ষা এবং কামনার অধিক ফল দান করতে সুদক্ষ ||৪||

হরিস্ত্বামারাধ্য প্রণতজনসৌভাগ্যজননীং

পুরা নারী ভূত্বা পুররিপুমপি ক্ষোভমনয়ৎ ।

স্মরোঽপি ত্বাং নত্বা রতিনয়নলেহ্যেন বপুষা

মুনীনামপ্যন্তঃ প্রভবতি হি মোহায় মহতাম্ ||৫||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - বিষ্ণু প্রণতজন-সৌভাগ্য প্রদায়িনী ( শ্রীচক্ররূপিণী ও বিদ্যারূপিণীকে ) আরাধনা ( পূজা, জপ ও ধ্যান ) করে, নারীরূপে ত্রিপুরারিকেও মনােবিকারবুক্ত করেছিলেন, কামদেবও তােমাকে প্রণাম করে রতিনয়নলেহনীয় ( কোমল ) শরীরের দ্বারা মুনিদেরও মনঃক্ষোভ সম্পাদনে সমর্থ হয়েছেন। ( বিষ্ণু এবং কাম শ্রীবিদ্যা দুইটি পৃথক পৃথক মন্ত্রের ঋষি, বিষ্ণুদৃষ্টমন্ত্রের বিবরণ ঋগ্বেদে আছে, তার উল্লেখ টীকাতে এবং পাদটীকায় স্থাননির্দেশ করা আছে )।

হে মাতঃ! তুমি প্রণত-জনগণসম্বন্ধে সৌভাগ্যসম্পৎ প্রদাত্রী। বিষ্ণু তােমার আরাধনা করত পূর্ব্বকালে নারীরূপ ধারণ করে ত্রিপুরারি মহাদেবকেও বিক্ষোভিত করেছিলেন। তােমার চরণরেণুবলে মদন রতি-নয়নের অস্বাদনীয় স্বীয় শরীর দ্বারা মহাত্মা মুনিদেরও অন্তঃকরণ মােহাভিভূত করতে সমর্থ হয়ে থাকেন ||৫||

ধনুঃ পৌষ্পং মৌর্বী মধুকরময়ী পঞ্চ বিশিখাঃ

বসন্তঃ সামন্তো মলয়মরুদায়োধনরথঃ ।

তথাপ্যেকঃ সর্বং হিমগিরিসুতে কামপি কৃপাম্

অপাঙ্গাত্তে লব্ধ্বা জগদিদ-মনঙ্গো বিজয়তে ||৬||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - যার পুষ্পময় ধনু, ভ্ৰমর-নির্মিত জ্যা ( ছিলা ), বাণ পাঁচটি মাত্র, সচিব ( মন্ত্রী ) বসন্ত, যুদ্ধের বল মলয়পবন, অর্থাৎ এ সমন্তই অকিঞ্চিৎকর, দৃঢ়ধনুই যুদ্ধোপযুক্ত, কোমল ধনু নয়, জ্যা ছিলাও খুব দৃঢ় হওয়া আবশ্যক, ভ্রমরের ছিলা দৃশ্যমাত্র পরস্পর জোড় তো নাই, পাঁচটি বাণে কি যুদ্ধ করা যায়, অসংখ্যবাণ আবশ্যক, বসন্ত কালমাত্র জড় পদার্থ সে কি মন্ত্রী হতে পারে? আর ফুরফুরে হাওয়া কি রথ হতে পারে, এই সব খেলা-ঘরের উপকরণ লয়েও অনঙ্গ ( যার হস্তপদাদি নাই ) তােমার ( আরাধনা-ফলে ) কৃপাকটাক্ষ লাভ করে সমস্তলােকবিজয়ী।

হে হিমগিরিসুতে, মদন স্বয়ং অনঙ্গ, অর্থাৎ অঙ্গহীন। তার ধনু পুষ্পময়, মৌৰ্বী ( ধনুকের গুণ ) মধুকরময়ী, পুষ্পময় পাঁচটিমাত্র বাণ, বসন্ত-ঋতু সারথি এবং মন্দগামী মলয়পবন যুদ্ধরথ ; মদন এতাদৃশ অবস্থাপন্ন হয়েও তােমার অনির্ব্বচনীয় কৃপা-কটাক্ষ লাভ করে একাকীই সমুদায় জগৎ জয় করছেন ||৬||

ক্বণৎকাঞ্চীদামা করিকলভকুম্ভস্তননতা

পরিক্ষীণা মধ্যে পরিণতশরচ্চন্দ্রবদনা ।

ধনুর্বাণান্পাশং সৃণিমপি দধানা করতলৈঃ

পুরস্তাদাস্তাং নঃ পুরমথিতুরাহোপুরুষিকা ||৭||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - ( সুধাসিন্ধো মধ্যে ইত্যাদি পরবর্তী শ্লোকের উপযােগী সময়াচারীদের আবগ্যক মণিপুরচক্রবাসিনীর ধ্যান এই শ্লোকে কথিত হচ্ছে ) মণিমেখলা-শিঞ্জিতা করিকলভ কুম্ভসদৃশ স্তনভারে ঈষৎ নম্রা, ক্ষীণমধ্যা শারদপূর্ণচন্দ্রসদৃশবদনা, চারিকরকমলে ধনুঃ, বাণ, পাশ ও অঙ্কুণ ধারণ করে অবস্থিত, পুরমথনকর্তা রদ্রের গর্বগরিমা রূপিনী দেবী আমাদের হৃদয়কমলে ( মণিপুর হতে নিঃসৃত হয়ে ) আবির্ভূত হোন।

যার কটিদেশে শব্দায়মান কাঞ্চীদাম, যার স্তনমণ্ডল হস্তিশাবক-কুম্ভের সদৃশ, যার মধ্যদেশ ক্ষীণতর, যার বদনমণ্ডল শরৎকালীন পূর্ণ-শশধরের তুল্য, যিনি করতলচতুষ্টয়ে ধনুঃ, বাণ, পাশ, অঙ্কুশ ধারণ করে আছেন, ভগবান্ ভূতনাথের অঙ্কারস্বরূপা এই প্রকার মূর্তিতে দেবী আমার সম্মুখে আবির্ভূতা হোন ||৭||

সুধাসিন্ধোর্মধ্যে সুরবিটপিবাটীপরিবৃতে

মণিদ্বীপে নীপোপবনবতি চিন্তামণিগৃহে ।

শিবাকারে মঞ্চে পরমশিবপর্যঙ্কনিলয়াং

ভজন্তি ত্বাং ধন্যাঃ কতিচন চিদানন্দলহরীম্ ||৮||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - ( সময়াচার-যােগমার্গ, অন্তর্যাগরতি–তাতে অনুষ্ঠেয়, আর কুলাচার বাহ্যপূজারতি, যন্ত্র অঙ্কন করে তাতে পূজা করতে হয়, এই শ্লোকে তদুভয়পূজারই প্রণালী বর্ণিত ) যন্ত্রের প্রসিদ্ধ নাম শ্রীচক্র, এর নামান্তর বিয়চ্চক্র, সময়াচারিগণের বিয়চ্চক্র হৃদয়াকাশে কল্পিত, কৌলদের বিয়চ্চক্র বহিরাকাশে রচিত। সুধাসিন্ধু শ্রীচক্রের বিন্দুস্থান, তার পঞ্চ ত্রিকোণ রেখা সুরতরু-পঞ্চক, উর্দ্ধমুখ ত্রিকোণরেখা-চতুষ্টয়, কদম্ব উপবন, বিন্দুস্থানমধ্যে মণিদ্বীপ, ত্রয়শ্চত্বারিংশৎ কোণযুক্ত বিয়চ্চক্র ( শ্রীচক্র ) চিন্তামণিগৃহ। শিবা অর্থাৎ শক্তি তৎস্বরূপ ত্রিকোণ মধ্যে পরম শিব শয্যায় ( ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র এবং ঈশ্বর, এই পাদচতুষ্টয়যুক্ত পর্য্যঙ্ক–সদাশিব পিক্দান,–ইন্দ্র, মহেশ্বর শয্যার আস্তরণ, এইরূপ শয্যায় ) চিদানন্দলহরী ( নিত্যজ্ঞান ও নিত্যানন্দরূপা তােমাকে কয়েকটি ধন্যপুরুষ ভজনা ( অন্তর্যাগ বা বাহ্যে আরাধনা ) করে থাকেন। ( রুদ্র, ঈশ্বর, সদাশিব মহেশ্বর-শিবেরই বিবিধ রূপ )

হে মাতঃ, সুধাসিন্ধু-মধ্যস্থিত কল্পবৃক্ষবাটিকা-পরিবৃত মণিময়দ্বীপে কদম্ববৃক্ষসমূহ-সুশোভিত উপবনমধ্যে চিন্তামণিগৃহে শিবদ্বয়, রুদ্র ও ঈশ্বর, অ–বিষ্ণু, ক–ব্রহ্মা, এই চারি দেবতা যার চতুষ্কোণে পাদ-( পায়া ) স্বরূপে বর্তমান, এইরূপ মঞ্চে উপরি পরমশিবময় পর্য্যঙ্কফলকে উপবিষ্টা চিদানন্দলহরী স্বরূপা তােমাকে কোন কোন ধন্য ব্যত্তি ভজনা করেন ||৮||

মহীং মূলাধারে কমপি মণিপূরে হুতবহং

স্থিতং স্বাধিষ্ঠানে হৃদি মরুতমাকাশমুপরি ।

মনোঽপি ভ্রূমধ্যে সকলমপি ভিত্বা কুলপথং

সহস্রারে পদ্মে সহ রহসি পত্যা বিহরসে ||৯||

সুধাধারাসারৈশ্চরণয়ুগলান্তর্বিগলিতৈঃ

প্রপঞ্চং সিঞ্চন্তী পুনরপি রসাম্নায়মহসঃ ।

অবাপ্য স্বাং ভূমিং ভুজগনিভমধ্যুষ্টবলয়ং

স্বমাত্মানং কৃত্বা স্বপিষি কুলকুণ্ডে কুহরিণি ||১০||

চতুর্ভিঃ শ্রীকণ্ঠৈঃ শিবয়ুবতিভিঃ পঞ্চভিরপি

প্রভিন্নাভিঃ শম্ভোর্নবভিরপি মূলপ্রকৃতিভিঃ ।

চতুশ্চত্বারিংশদ্বসুদলকলাশ্রত্রিবলয়-

ত্রিরেখাভিঃ সার্ধং তব শরণকোণাঃ পরিণতাঃ ||১১||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - চক্রবিদ্যা কৌলমতে এবং সময়াচারমতে এই স্থলে উপদিষ্ট। কৌলমতে সংহারক্রমে এবং সময়াচারমতে সৃষ্টিক্রমে। সংহারক্রমে চক্রলেখনরীতিতে,–প্রথমে বৃত্ত অঙ্কিত করে নব-রেখা অঙ্কিত করতে হবে। তৎপরে পশ্চাদ্বর্ত্তিরেখাগুলির প্রান্তভাগ হতে ত্রিকোণ উৎপন্ন করবে ইত্যাদি ক্রম। সৃষ্টিক্রমের বিশেষত্ব এই যে, প্রথমে ত্রিকোণ অঙ্কিত করে মধ্যে বিন্দু, বিন্দুর উপরে ত্রিকোণ ভেদ করে অপর ত্রিকোণ এইরূপ ক্রমে চলবে। শ্রীকণ্ঠ শব্দে উর্দ্ধমুখী ত্রিকোণ রেখা এবং শিবযুবতিশব্দে অধােমুখী ত্রিকোণ-রেখা। গৃহ ( বিন্দুস্থল ) ও কোণ-এতদুভয়ের সমষ্টি সংখ্যা চতুশ্চত্বারিংশ (৪৪); শ্রীচক্রের ( শ্রীবিদ্যাযন্ত্রের ) চিত্রদর্শন কর্তব্য। স্বাধিষ্ঠানচক্র অগ্নিস্থান এবং মণিপুরচক্র জলস্থান, এ লক্ষ্মীধরের ব্যাখ্যায় আছে। তদ্ব্যতীত ৯|১০|১১ শ্লোকের মর্ম অত্রস্থ অনুবাদ সাহায্যে জ্ঞাতব্য ; চক্রবিদ্যার প্রমাণ শ্রুতিসমুহ সংস্কৃত লক্ষ্মীধরকৃত টীকার দ্রষ্টব্য।

হে দেবী, তুমি কুলকুণ্ডলিনীস্বরূপা হয়ে মূলাধারচক্রস্থিত মহীমওল, স্বাধিষ্ঠানচক্রস্থিত জলমণ্ডল, মণিপুরচক্রস্থিত অগ্নিমণ্ডল, অনাহতচক্রস্থিত বায়ুমণ্ডল, বিশুদ্ধচক্রস্থিত আকাশমণ্ডল এবং ভ্রূমধ্যে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রস্থিত মনস্তত্ত্ব এই সমস্ত কুলপথ ( ষট্চক্র ) ভেদ করে গমন করত, সহস্রারপদ্মে পতির সহিত একান্তে বিহার করে থাকে। হে দেবী, তুমি কুলপথ দ্বারা ষট্চক্রভেদ পূর্বক সহস্রারে গমন করে যখন পরম শিবের সহিত সৎমিলিতা হও, তখন তোমার পাদপদ্মযুগলে প্রান্ত হতে বিগলিত অমৃতধারা বর্ষণ দ্বারা সমুদায় চক্র ও চক্রস্থ দেবতাগণকে পুনরুজ্জীবিত ও সন্তর্পিত করতে করতে পুনর্বার তুমি সেই কুলপথ দ্বারাই মূলাধারে প্রত্যাগমন কর তো আপনাকে সার্দ্ধত্রিবলয়াকৃতি সর্পরূপিণী করে মূলাধারস্থিত স্বয়ম্ভূলিঙ্গে নিদ্রিত হয়ে থাক। হে জননি, চারিটি উর্দ্ধমুখ ত্রিকোণ ও পাঁচটি অধােমুখ ত্রিকোণ, এই নয়টি মূল প্রকৃতি (তার বহির্ভাগে ক্রমে) অষ্টদল পদ্ম,ষোড়শদল পদ্ম ভূপুরত্রয় রেখা সহ,–তােমার ভবনের ( শ্রীচক্রের ) ত্রয়শ্চত্বাবিংশৎ (৪৩) কোণে পরিণত হয়ে থাকে। অর্থাৎ বহির্ভাগে বৃত্ত অষ্টদল, তার বহির্দেশে বৃত্ত ষোড়শদল, তার বহির্ভাগে তিনটি বৃত্ত এবং তার বহির্ভাগে তিনটি ভূপূর অঙ্কিত করলে শ্রীচক্র নিষ্পন্ন হয় ||৯-১০-১১||

ত্বদীয়ং সৌন্দর্যং তুহিনগিরিকন্যে তুলয়িতুং

কবীন্দ্রাঃ কল্পন্তে কথমপি বিরিঞ্চিপ্রভৃতয়ঃ ।

যদালোকৌৎসুক্যাদমরললনা যান্তি মনসা

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ- হে হৈমবতি, ব্রহ্মা, গ্রভৃতি কবিশ্রেষ্টগণ তোমার সৌন্দর্য্যের তুলনা করতে অসমর্থ; কেন না–তোমার সদৃশ সুন্দর বস্তুর সত্তাই নাই। উর্বশী, তিলোত্তমা প্রভৃতি অপ্সরারাও তোমার রূপের তুলনায় ন-গণ্য, যেহেতু তারা অন্যের দুর্লভ তোমার রূপ দর্শন আশায় বিবিধতপশ্যায় দুর্লভ শিবত্বপ্রাপ্তির জন্য আকাঙ্ক্ষা করে থাকে।

হে হিমালয়কন্যে, বিরিঞ্চি প্রভৃতি কবিশ্রেষ্টগণ অতিকষ্টে তোমার সৌন্দর্য্য তুলনা করতে সমর্থ হন। অমরললনাগণ তোমার ঔৎসুক্যবশতঃ তোমার সৌন্দর্য্য মনে মনে দর্শন করিয়া কৃচ্ছ্রসাধ্য তপস্যা দ্বারাও দুষ্প্রাপ্য শিবসাযুজ্য পাইতে অভিলাষী হয়ে থাকেন। অর্থাৎ 'জানি, শিবসাযুজ্য, তপস্যা দ্বারাও দুর্লভ, কিন্তু কোন উপায়ে যদি শিবসাযুজ্য প্রাপ্ত হইত”, আমরা সর্বদাই দেবীর রূপ দর্শন করতে পারি,' সুরসুন্দরীগণও এইরূপ মনে করেন। সুন্দরীদের স্বভাব এই যে, অপরের সৌন্দর্য্যে ঈর্ষ্যা প্রকাশ করে, কিন্তু দেবীর সৌন্দর্য্য এত অধিক যে, তাদেখার জন্যই সুরসুন্দরীগণ লালায়িত, ঈর্ষ্যা করবে কি? ||১২||

নরং বর্ষীয়াংসং নয়নবিরসং নর্মসু জড়ং

তবাপাঙ্গালোকে পতিতমনুধাবন্তি শতশঃ ।

গলদ্বেণীবন্ধাঃ কুচকলশবিস্রস্তসিচয়া

হঠাৎ ত্রুট্যৎকাঞ্চ্যো বিগলিতদুকূলা যুবতয়ঃ ||১৩||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - 'হে ভগবতি, বর্ষীয়াংসং নয়নবিরসং নর্মসু জড়ং তবাপাঙ্গালোকে পতিতং নরং শতশঃ যুবতয়ঃ গলদ্ধেণীবন্ধাঃ কুচকলশবিস্রস্তসিচয়াঃ হঠাত্রুট্যৎকাঞ্চ্যঃ বিগলিতদুকূলাঃ সত্যঃ'–নিম্নলিখিত অনুবাদের তুল্য। যে সাধনবিশেষের কথা এই শ্লোকে বলা হয়েছে–তা 'মুখং বিন্দু কৃত্বা' ইত্যাদি শ্লোকে বিশেষভাবে আলোচিত হবে।

হে মাতঃ, তুমি যাকে কৃপাকটাক্ষে দর্শন কর, সে ব্যক্তি যদিও বৃদ্ধ, কর্মাক্ষম, দর্শনশক্তি-রহিত ও রমনীসম্ভোগে অশক্ত হয়, তবুও যুবতী রমণীগণ ( মন্মথবশবর্তিনী হয়ে ) তার প্রতি ধাবমানা হয়ে থাকে। তৎকালে রমলীদের কবরীবন্ধন শিথিল হয়ে বিগলিত প্রায় হতে থাকে, স্তনমণ্ডল হতে বসন স্খলিত হয়, কটিভূষণ মেখলা পতিত প্রায় হতে থাকে এবং পরিধেয় কৌষেয় বদন বিগলিতপ্রায় হয়ে যায় ||১৩||

ক্ষিতৌ ষট্পঞ্চাশৎ দ্বিসমধিকপঞ্চাশদুদকে

হুতাশে দ্বাষষ্টিশ্চতুরধিকপঞ্চাশদনিলে ।

দিবি দ্বিঃষট্ত্রিংশন্মনসি চ চতুঃষষ্টিরিতি যে

ময়ূখাস্তেষামপ্যুপরি তব পাদাম্বুজয়ুগম্ ||১৪||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর অনাহত, বিশুদ্ধাক্ষ এবং আজ্ঞা এই ষট্চক্র । এই ষট্চক্রের দুই দুই চক্র লয়ে এক এক খণ্ড। প্রথম খণ্ডের উপরিভাগে অগ্নিস্থান। দ্বিতীয় খণ্ডের উপরিভাগে সূর্য্যের স্থান। তৃতীয় খণ্ডের উপরিভাগে চন্দ্রস্থান। প্রথম খণ্ডস্থিত অগ্নির‌ কিরণ-সংখ্যা অষ্টোত্তরশত। তার মধ্যে ক্ষিতি অর্থাৎ মূলাধারচক্রে ৫৬ এবং জল অর্থাৎ মণিপুরকে ৫২ আর হুতাশন অর্থাৎ বহ্নিস্থানের অন্তর্গত স্বাধিষ্ঠানচক্রে সূর্য্যের কিরণ ৫৪। সূর্য্যকিরণ মোট ১১৬। আকাশ অর্থাৎ বিশুদ্ধিচক্রে চন্দ্রকিরণ ৭২ এবং আজ্ঞাচক্রে চন্দ্রকিরণ ৬৪ চন্দ্রকিরণ মোট–১৩৬। হে ভগবতি, এই সমস্তের উপর তোমার চরণযুগল অবস্থিত। আজ্ঞাচক্রের উপরে সহস্রদলপদ্মে তোমার স্থিতি। গুঢ় অর্থ এই যে শ্রীবিদ্যার নামান্তর চন্দ্রকলাবিদ্যা–৩৬০ তিথিতে একবৎসর। এই ৩৬০ তিথিই হইল সর্বসমেত ৩৬০ কিরণস্বরূপ| এ সংবৎসর। প্রভাপতিমাথে কথিত। সেই সকল কিরণও আপনার পাদপদ্ম হতে উদ্ভূত, অতএব সেই সকল কিরণের উপরে আপনার পাদপদ্ম বিরাজিত।

হে জননি, মূলাধারচক্রে পৃথিবীর যে ষট পঞ্চাশৎ কিরণ আছে, স্বাধিষ্ঠানচক্রে জলের যে দ্বিপঞ্চাশৎ কিরণ রয়েছে, মণিপুরচক্রে তেজের যে দ্বিষষ্টি কিরণ আছে, অনাহতচক্রে বায়ুর যে চতুঃপঞ্চাশৎ কিরণ রয়েছে, বিশুদ্ধচক্রে আকাশে যে দ্বিসপ্ততিসংখ্যক কিরণ আছে এবং আজ্ঞাচক্রে মনের যে চতুঃষষ্টিসংখ্যক কিরণ বিদ্যমান, তদুপরি হংস এই অক্ষয়দ্বয়স্বরূপ তোমার পাদপদ্ম শোভা পাচ্ছে ||১৪||

শরজ্জ্যোৎস্নাশুদ্ধাং শশিয়ুতজটাজূটমকুটাং

বরত্রাসত্রাণস্ফটিকঘটিকাপুস্তককরাম্

সকৃন্নত্বা নত্বা কথমিব সতাং সন্নিদধতে

মধুক্ষীরদ্রাক্ষামধুরিমধুরীণাঃ ভণিতয়ঃ ||১৫||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - ( সারস্বত প্রয়োগ কথিত হচ্ছে ) হে ভগবতি, শরচ্চন্দ্রিকার ন্যায় অতিশুভ্রবর্ণা চন্দ্রকলাবতংসা, বর, অভয়, স্ফটিকপানপাত্র, এবং পুস্তক-যুক্তহস্তা তোমাকে একবার নমস্কার না করলে কবীশ্বরগণেরও মধুক্ষীর দ্রাক্ষাতুল্য মধুরতম বাণী কিরূপে সন্নিহিত হয়? অর্থাৎ ব্রহ্মাদি কবীশ্বরগণ তোমার ঐ রূপের নমস্কারফলেই কবিত্বলাভ করেছেন, তা না করলে, কোনমতেই কবিত্বলাভ কারও হয় না।

(হে বাগ্ভবকূটাধিষ্ঠাত্রি, বা বাগ্ভবাধিষ্ঠাত্রি জননি,) তোমার কান্তি শরৎকালীন চন্দ্রমার ন্যায় নির্মূল ও দিগন্তব্যাপিনী, তোমার শিরোদেশে চন্দ্রকলারূপ মুকুট ও সুরম্য জটাকলাপ শোভা পাচ্ছে, তোমার হস্তচতুষ্টয়ে বর, অভয়, অক্ষমালা ও পুস্তক রয়েছে । হে মাতা, এই প্রকার মূর্তিযুক্তা তোমাকে যারা একবারমাত্রও নমস্কার না করেন, মধু, ক্ষীর ও দ্রাক্ষার ন্যায় অপূর্ব মাধুর্যসম্পন্ন নানারসগভীর কবিতারচনা তাদের নিকটে আসিবে কিরূপে? অর্থাৎ বাগ্ভবকূটাধিষ্টাত্রী তোমায় একবার নমস্কার করলেও কবিত্ব- সম্পন্ন হওয়া যায় ||১৫||

(ঐ ক্লীং সৌঃ এই বীজত্রয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ক্রিয়াশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও জ্ঞানশক্তির ধ্যানফল বলার নিমিত্ত প্রথমতঃ ক্রিয়াশক্তির ধ্যান বলা হলো। এ টীকাকার অচ্যুতানন্দের মত। সিদ্ধান্ত এই যে, ত্রিপুরাসুন্দরীর ত্রিকূট মন্ত্র,–বাগ্ভবকূট,কামরাজকুট ও শক্তিকূট। বাগ্ভবকুটাধিষ্ঠাত্রীর ধ্যান এই স্থলে বলা হল, এরপর শ্লোক দ্বারা যথাক্রমে কামরাজকূট ও শক্তিকূটের অধিষ্ঠাত্রীর ধ্যান কথিত হবে।)

কবীন্দ্রাণাং চেতঃকমলবনবালাতপরুচিং

ভজন্তে যে সন্তঃ কতিচিদরুণামেব ভবতীম্ ।

বিরিঞ্চিপ্রেয়স্যাস্তরুণতরশৃঙ্গারলহরী-

গভীরাভির্বাগ্ভির্বিদধতি সভারঞ্জনমমী ||১৬||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতি, যে কয়টি সৎপুরুষ, কবীশ্বর-চিত্র-কমলবনে প্রাভাতিকাতপারুণকান্তি 'অরুণা'রূপা তোমাকে ভজনা করেন, তার পুরুষরূপপ্রাপ্ত সরস্বতীর ন্যায় শৃঙ্গাররসপ্রধান কলা বৈভবে সভারঞ্জন করে থাকেন।

(হে কামরাজকূটাধিষ্টাত্রি বা কামবীজাধিষ্ঠাত্রি জননি) তুমি মহাকবিদের চিত্তরূপ কমলবনে নবোদিত সূর্য্যকিরণরূপে বিরাজিতা রয়েছ। তোমার অরুণবর্ণ। যে সকল সাধু ব্যক্তি এইপ্রকার মুর্তিধারিণী তোমাকে ভজনা করেন, তারা গদ্য-পদ্যময়ী সরস্বতীর অভিনব শৃঙ্গার-রস- তরঙ্গ-নিস্যন্দিনী গভীরার্থ রচনা দ্বারা সভাস্থিত জনগণের মনোরঞ্জন করতে সমর্থ হয়েন ||১৬|| (এই স্থলে 'ক্লীং' এই কামবীজের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা ইচ্ছাশক্তিরূপা গৌরীর ধ্যান বিবৃত হল।)

সবিত্রীভির্বাচাং শশিমণিশিলাভঙ্গরুচিভিঃ

বশিন্যাদ্যাভিস্ত্বাং সহ জননি সঞ্চিন্তয়তি যঃ ।

কর্তা কাব্যানাং ভবতি মহতাং ভঙ্গিরুচিভিঃ

বচোভির্বাগ্দেবীবদনকমলামোদমধুরৈঃ ||১৭||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে মাতা, (পঞ্চাশৎ মাতৃকাবর্ণ অষ্টবর্গে বিভক্ত, (১) স্বর, (২) ককারাদি পঞ্চবর্ণ, (৩) চকারাদি পঞ্চ (৪) টকারাদি পঞ্চ (৫) তকারাদি পঞ্চ (৬) পকারাদি পঞ্চ (৭) চকারাদি চারিরর্ণ (৮) শকারাদি ক্ষকারান্ত বর্ণ–এই অষ্টবর্গে বিভক্ত বর্ণমালার প্রসূতি চন্দ্রকান্তমণি-খণ্ড-শুভ্রা বশিনী প্রভৃতি অষ্ট শক্তির এবং দ্বাদশ যোগিনী ও গন্ধাকর্ষিনী প্রভৃতি চতুর্দ্বার-দেবতার সহিত তোমার ধ্যান যে ব্যক্তি করেন, সরস্বতী-মুখকমল-সৌরভ-মধুর, কালিদাসাদি মহাকবি রচনা-সদৃশ মনোহর পদদ্বারা কাব্য নির্মাণে তিনি সমর্থ হন।

(হে শক্তিকূটাধিষ্ঠাত্রী বা শক্তিবীজাধিষ্ঠাত্রী মাতঃ) যাদের প্রসাদে সুমধুর বাক্যবিন্যাস করার শক্তি জন্মে, যাদের শরীরকান্তি চন্দ্রকান্তমণিখণ্ডের ন্যায় প্রদীপ্ত অর্থাৎ অতি শুভ্র, ঈদৃশী, বশিনী প্রভৃতি অষ্ট শক্তির সহিত তোমাকে যে ব্যক্তি চিন্তা করেন, তিনি সরস্বতীর মুখপদ্ম-সৌরভ-মধুর অর্থাৎ ওজঃপ্রসাদ-মাধুর্য্য-গুণবিশিষ্ট শ্রবণ-সুখকর বক্রোক্তি অলঙ্কার সম্পন্ন বাক্যসমূহ দ্বারা অবলীলাক্রমেই মহাকাব্যসমূহ রচনা করতে সমর্থ হয়েন ||১৭|| ( এই স্থলে 'সৌঃ' এই শক্তিবীজের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা জ্ঞানশক্তির ধ্যান কথিত হল। বশিনী প্রভৃতি অষ্টশক্তি যথা–বশিনী, কামেশ্বরী, মোহিনী, বিমলা, অরুণা, জয়িনী, সর্বেশ্বরী ও কৌলিনী।)

তনুচ্ছায়াভিস্তে তরুণতরণিশ্রীসরণিভিঃ

দিবং সর্বামুর্বীমরুণিমনি মগ্নাং স্মরতি যঃ ।

ভবন্ত্যস্য ত্রস্যদ্বনহরিণশালীননয়নাঃ

সহোর্বশ্যা বশ্যাঃ কতি কতি ন গীর্বাণগণিকাঃ ||১৮||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতি, যে সাধক নবোদিত দিনকরকান্তি-সদৃশ শ্রীমতী ভবদীয় দেহপ্রভায় সমগ্র নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে অলক্তক-রাগ-সাগরে-নিমগ্র বলে ধ্যান করেন, ভয়চকিত বনহরিণ-চারু-নয়না কত শত অমরগণিকা উর্বশীসহ তার বশীভূতা না হন?

হে মাতা, তোমার দেহকান্তি মধ্যাহ্নকালীর সূর্য্যের ন্যায় সমুজ্জ্বল; যে ব্যক্তি তৎ দ্বারা ভূমণ্ডল ও আকাশমণ্ডল সূর্য্যকান্ত-মণি-কিরণ-নিমগ্ন এইরূপ ভাবনা করেন, ভীতা বনহরিণীর ন্যায় চকিতনয়না উর্বশীসহ কত কত অপ্সরা তার বশীভূত না হয়ে থাকেন ||১৮|| (এই স্থলে শক্ত্যাধিষ্ঠাত্রীদেবতারূপা জ্ঞানশক্তির ধ্যানফল বিবৃত হল)

মুখং বিন্দুং কৃত্বা কুচয়ুগমধস্তস্য তদধো

হরার্ধং ধ্যায়েদ্যো হরমহিষি তে মন্মথকলাম্ ।

সদ্যঃ সংক্ষোভং নয়তি বনিতা ইত্যতিলঘু

ত্রিলোকীমপ্যাশু ভ্রময়তি রবীন্দুস্তনয়ুগাম্ ||১৯||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - ('মাদন' নামক প্রয়োগ কথিত হচ্ছে) হে হরমহিষি, যে (সকাম) সাধক, শ্রীচক্রের বিন্দুস্থানে (কামিনীর) মুখ, তার অধোদেশে স্তনযুগল, তার অধোদেশে বরাঙ্গ ধ্যান এবং তাতে আপনার কামরাজবীজ ভাবনা করত নিজকে তন্ময় চিন্তা করবে, সে ব্যক্তি যে কামিনীকেই সংক্ষোভযুক্ত করবে, এ অতি সামান্য, সূর্য্যচন্দ্রস্তনযুগলশালিনী ত্রিলোকীকে বিঘূর্ণিত সংক্ষুভিত করতে তার সামর্থ্য হয়।

হে হরমহিষি, যে সাধক উর্দ্ধস্থিত বিন্দুকে তোমার বদনস্বরূপ এবং অধঃস্থিত বিন্দুদ্ধয়কে তোমার স্তনযুগলস্বরূপ কল্পনা করে তার নিম্নভাগে সূক্ষ্ম চিৎকলাকে হকারার্দ্ধ অর্থাৎ ত্রিকোণাকৃতি অঙ্গরূপে কামকলারূপা চিন্তা করেন, তার পক্ষে কামিনীগণকে সদ্যঃ উদ্ভ্রান্ত করা তো অতি তুচ্ছ কথা, তিনি চন্দ্রসূর্য্যস্বরূপস্তনযুগলশোভিতা ত্রিলোকীরূপা নায়িকাকেও অতি শীঘ্র বিভ্রান্ত (মুগ্ধ বা অস্থির) করতে সমর্থ হন। অপর অন্থবাদ এই,–নিম্নে (শ্রীচক্রের) বিন্দুস্থানে (সাধ্যা রমণীর) মুখ, তার অধস্থানে স্তনদ্বয়, তাহার ত্রিকোণ-অঙ্গ চিন্তা করবে, হে হরমহিষি, (এই অঙ্গত্রয়ে) যে সাধক, তোমার কামরাজবীজ ধ্যান করেন,–(অর্থাৎ এইরূপে বশীকরণ প্রয়োগ করেন) তার পক্ষে সাধারণ রমনীগণের মনঃক্ষোভ অর্থাৎ কামভাব উদ্দীপনে বশীভূত করা তো সামান্য কথা, রবি-শশি-মণ্ডলস্বরূপ স্তনযুগলশালিনী ত্রিলোকীকে তিনি বিভ্রান্ত (মুগ্ধ) করতে পারেন (এটা স্ত্রী-বশীকরণ প্রয়োগ) ||১৯||

কিরন্তীমঙ্গেভ্যঃ কিরণনিকুরম্বামৃতরসং

হৃদি ত্বামাধত্তে হিমকরশিলামূর্তিমিব যঃ ।

সর্পাণাং দর্পং শময়তি শকুন্তাধিপ ইব

জ্বরপ্লুষ্টান্ দৃষ্ট্যা সুখয়তি সুধাধারসিরয়া ||২০||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - (গারুড় প্রয়োগ কথিত হচ্ছে) হে দেবি, যে সাধক, সকল অঙ্গ হতে কিরণ-নিকর-সুধাবর্ষিণী চন্দ্রকান্তমণি-প্রতিমার ন্যায় আপনাকে (ছয় মাস) ধ্যান করেন, তিনি খগরাজ গরুড়ের ন্যায় দৃষ্টিমাত্রে সর্পগণের দর্পনাশ করেন ; তিনি সুধানিষ্যন্দিনী শিরা তুল্য দৃষ্টি দ্বারা জরসন্তপ্তকে সুস্থ করেন।

হে জননি, যিনি নিজ দেহ হতে কিরণসমূহরূপ অমৃতরূপ বিস্তার করছেন, যার মূর্তি হিমাচলশিলার ন্যায় অতীব স্নিগ্ধতরা, তুমিই সেই কুলকুণ্ডলিনী কামকলা। যে সাধক তোমার এবম্বিধ স্থুলরূপ ধ্যান করেন, তিনি দৃষ্টিমাত্র গরুড়ের ন্যায় সর্পবিষ বিনষ্ট করতে সমর্থ হয়েন এবং তিনি চন্দ্রমণ্ডলের ন্যায় স্নিগ্ধতমা সুধাক্ষরণনাড়ীস্বরূপা দৃষ্টি দ্বারা জরাভিভূত জনগণকেও নীরোগ ও সুখী করতে সমর্থ হয়েন ||২০|| (এ দ্বারা কামকলার স্থুলধ্যান কীর্তিত হল।)

তটিল্লেখাতন্বীং তপনশশি বৈশ্বানরময়ীং

নিষণ্ণাং ষণ্ণামপ্যুপরি কমলানাং তব কলাম্ ।

মহাপদ্মাটব্যাং মৃদিতমলমায়েন মনসা

মহান্তঃ পশ্যন্তো দধতি পরমাহ্লাদলহরীম্ ||২১||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতি, বিদ্যুল্লতার ন্যায় দীর্ঘসূক্ষ্ম আজ্ঞাচক্রে ক্ষণমাত্র দৃশ্যা সূর্য্যচন্দ্র-বহ্নি-স্বরূপা ষট্চক্রপদ্মের উর্দ্ধে, সহস্রদলকমলবনে সাদা-নাম্নী ভবদীয় কলার মৃতধারা-নিষ্যন্দ, যে মহাপুরুষেরা মলমায়াবিহীন হৃদয়ে অনুভব করেন, তারা পরমানন্দলহরী প্রাপ্ত হন।

হে মাতঃ, যে সমুদায় মহাত্মা যোগী প্রশান্তহৃদয়ে মায়া- পরিশূন্যচিত্তে ষট্চক্রের উপরি ব্রহ্মরন্ধ্রস্থিত সহস্রদল-পদ্মমধ্যে তড়িল্লেখার ন্যায় সূক্ষ্মতমা চন্দ্রসূর্য্যাগ্নিরূপ বিন্দুত্রয়ের কারণভূতা কামকলারূপা ত্বদীয় সূক্ষ্মমূর্তি দর্শন করেন, তারাই পরম আনন্দলহরী ভোগ করে থাকেন অর্থাৎ তৎকালে তারা অনির্বচনীয় ব্রহ্মানন্দসুখানুভব করেন ||২১||

ভবানি ত্বং দাসে ময়ি বিতর দৃষ্টিং সকরুণা-

মিতি স্তোতুং বাঞ্ছন্ কথয়তি ভবানি ত্বমিতি যঃ ।

তদৈব ত্বং তস্মৈ দিশসি নিজসায়ুজ্যপদবীং

মুকুন্দব্রহ্মেন্দ্রস্ফুটমুকুটনীরাজিতপদাম্ ||২২||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - "হে ভবানি, আমি দাস, আমাতে আপনি করুণাকটাক্ষ নিক্ষেপ করুন,"–এইরূপ স্তব করতে ইচ্ছুক হয়ে "ভবানি ত্বৎ"–এই অংশ উচ্চারণ করামাত্র (তুমিই আমি হচ্ছি–এই) মহাবাক্যার্থ নিশ্চায়ক সাধকের বাক্যাশ্রবণে শব্দমাহাত্ম্যেই তৎক্ষণাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ইন্দ্রাদি দেবগণের মণিমুকুটে চরণনীরাজনাযুক্ত নিজ সাযুজ্যপদ আপনি তাকে দান করে থাকেন।

“হে ভবানি, আমি তোমার দাস, তুমি আমার প্রতি সকরুণ দৃষ্টিপাত কর ।”–এইরূপ স্তব করতে ইচ্ছুক হয়ে যদি কোন ব্যক্তি, “ভবানি তুমি” এই পর্যন্ত বলে, তাহলে তুমি তৎক্ষণাৎ ঐ দুই পদের “আমি তুমি হচ্ছি”–এই অর্থ অনুসারে তাকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেন্দ্রের মুকুটরত্ন দ্বারা নীরাজিত-চরণ নিজ সাযুজ্যপদ প্রদান করে থাক ||২২||

ত্বয়া হৃত্বা বামং বপুরপরিতৃপ্তেন মনসা

শরীরার্ধং শম্ভোরপরমপি শঙ্কে হৃতমভূৎ ।

যদেতত্ত্বদ্রূপং সকলমরুণাভং ত্রিনয়নং

কুচাভ্যামানম্রং কুটিলশশিচূড়ালমুকুটম্ ||২৩||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - (হে ভগবতি) আপনি শিবের বামার্ধ আত্মসাৎ করেও মন পরিতুষ্ট না হওয়ায় অপর অর্দ্ধও হরণ করেছেন, এটা আমি বিবেচনা করি। তাই–আপনার সম্পূর্ণ শরীর অরুণাভ, ত্রিনয়ন, স্তনভারনম্র ও বক্র শশিকলা মৌলিদেশে অবস্থিত। অর্থাৎ ত্রিনয়ন ও শশিকলা শিবের প্রসিদ্ধ চিহ্ন, তা আপনার শরীরে থাকলেও বর্ণ ও স্তনভারে নিশ্চয় হচ্ছে, শিব আপনার এই মাতৃমূর্তিতে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন। (শিবতত্ত্ব যে শক্তিতত্ত্ব হতে অভিন্ন, তা ৩৫|৪১ শ্লোকব্যাখ্যায় বিবৃত হবে)

হে জননি, আমার বোধ হচ্ছে, তুমি স্বীয় দক্ষিণাঙ্গ দ্বারা মহেশের বাম অঙ্গ হরণ পূর্ব্বক অর্দ্ধনারীশ্বরমূর্ত্তি হয়েও পরিতৃপ্তহৃদয়া হতে না পেরে তুমি মহেশের অবশিষ্ট দক্ষিণাঙ্গও হরণ পূর্বক নিজ শরীরে মিশ্রিত করেছ। আমার ঈদৃশ অনুমানের প্রতি কারণ এই যে, তুমি পূর্বে যখন অর্ধনারীশ্বরমূর্ত্তি ছিলে, তখন তোমার অর্ধশরীর পাণ্ডুরবর্ণ ছিল, এক্ষণে সর্বশরীরই অরুপবর্ণ দেখছি। তৎকালে তোমায় সার্দ্ধদ্বয় নয়ন ছিল, এক্ষণে নয়ন দৃষ্ট হচ্ছে। পূর্বে তোমার দেহ এক স্তন দ্বারাই আনত ছিল, এক্ষণে স্তনযুগল দ্বারা আনত দেখছি। তৎকালে তোমার মস্তকে শশিকলার অর্ধাংশ ও মুকুটের অর্দ্ধাংশ শোভা পেত, এক্ষণে সেই মস্তকে সম্পূর্ণ শশিকলা ও সম্পূর্ণ মুকুট শোভা পাচ্ছে ||২৩||

জগৎ সূতে ধাতা হরিরবতি রুদ্রঃ ক্ষপয়তে

তিরস্কুর্বন্নেতৎ স্বমপি বপুরীশস্তিরয়তি ।

সদাপূর্বঃ সর্বং তদিদমনুগৃহ্ণাতি চ শিব-

স্তবাজ্ঞামালম্ব্য ক্ষণচলিতয়োর্ভ্রূলতিকয়োঃ ||২৪||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতি, ব্রহ্মা জগৎ সৃষ্টি, বিষ্ণু জগৎ পালন, রুদ্র জগৎ সংহার করেন, ঈশান, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্রকে স্বরূপে লীন করে–নিজ তত্ত্বকেও সদাশিবতত্ত্বে অন্তর্হিত করেন (এ প্রলয়াবস্থা)। অনন্তর সদাশিব আপনার ক্ষণসঞ্চালিত ভ্রলতিকাযুগলের আজ্ঞা প্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র ও ঈশ্বরতত্ত্বকে অনুগৃহীত করেন অর্থাৎ আপনার ইঙ্গিতেই সদাশিবের সৃষ্টি করার ইচ্ছা হলে, ঈশ্বরতত্ত্বাদি সৃষ্টি ও তদ্দ্বারা জগতের সৃষ্টি প্রভৃতি হয়।

হে মাতঃ, তোমার ঈষচ্চলিত ভ্রলতা দ্বারা আজ্ঞা প্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মা জগৎ সৃষ্টি করছেন, বিষ্ণু তা রক্ষা করছেন এবং যথাসময়ে রুদ্র আবার সেই সৃষ্ট জগৎ লয় করছেন। ঈশ্বর সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কার্য্যে লিপ্ত না হয়ে যোগবলে আপনাকে স্থির করে রাখছেন এবং সদাশিব সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কার্য্যে নিযুক্ত থেকেও যোগযুক্ত হচ্ছেন ||২৪||

ত্রয়াণাং দেবানাং ত্রিগুণজনিতানাং তব শিবে

ভবেৎ পূজা পূজা তব চরণয়োর্যা বিরচিতা ।

তথা হি ত্বৎপাদোদ্বহনমণিপীঠস্য নিকটে

স্থিতা হ্যেতে শশ্বন্মুকুলিতকরোত্তংসমুকুটাঃ ||২৫||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে শিবে, আপনার সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণজনিত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র–এই দেবত্রয়ের সম্পাদিত যে আপনার চরণযুগলপুজা, তাই প্রকৃত পূজা, তাই এরা আপনার পাদপীঠসমীপে অঞ্জলিবন্ধকরপুট শিরোভূষণরূপে মুকুটে রেখেও নিরন্তর থাকার অধিকার পেয়েছেন। অর্থাৎ সাধারণ পূজায় এ অধিকার লাভ হয় না। ব্রহ্মাদির প্রতি আপনার অসীম কৃপাবশতঃ, এদের এই অধিকারলাভ।

হে শিবে, তোমার চরণকমল অর্চনা করিলে ত্রিগুণজনিত দেবত্রয়ের অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরেরও পূজা করা হয়, তাদের আর স্বতন্ত্র পূজার অপেক্ষা থাকে না। কারণ, তোমার চরণকমলের আধার মণিপীঠের নিকটে নিরন্তর অবস্থিত এই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর করপুটে অঞ্জলিবন্ধন পূর্বক তোমার পাদ-পদ্মদ্বয় নিজ নিজ মুকুটের ভূষণস্বরূপ করে রেখেছেন ||২৫||

বিরিঞ্চিঃ পঞ্চত্বং ব্রজতি হরিরাপ্নোতি বিরতিং

বিনাশং কীনাশো ভজতি ধনদো যাতি নিধনম্ ।

বিতন্দ্রা মাহেন্দ্রী বিততিরপি সম্মীলিতদৃশা

মহাসংহারেঽস্মিন্ বিহরতি সতি ত্বৎপতিরসৌ ||২৬||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - ব্রহ্মা পঞ্চত্ব প্রাপ্ত, বিষ্ণু উপরতঃ, যম বিনাশ প্রাপ্ত, কুবের নিধনপ্রাপ্ত এবং চতুর্দশ মন্বন্তরের বিভিন্ন ইন্দ্রসমূহ চক্ষু মুদ্রিত করে মহানিদ্রায় আচ্ছন্ন,–এইরূপ মহাসংহার অবস্থাতেও হে সতি, আপনার পতি সদাশিব ক্রীড়া করে থাকেন–এটা আপনারই পাতিব্রত্যফল।

হে সতি, মহাপ্রলয়কাল উপস্থিত হলে ব্রহ্মা পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েন, বিষ্ণুরও শরীর ধ্বংস হয়, কালান্তক যমও বিনষ্ট হয়ে থাকেন, ধনাধ্যক্ষ নিধন প্রাপ্ত হয়েন এবং মহেন্দ্রের তন্দ্রারহিত সদা উন্মীলিত নয়নসমূহও নিমীলিত হয়ে যায় অর্থাৎ মহেন্দ্রও মহানিদ্রায় অভিভূত হয়েন। এই মহাসংহারসময়ে একমাত্র তোমার পতি সদাশিবই বিহার করতে থাকেন ||২৬||

জপো জল্পঃ শিল্পং সকলমপি মুদ্রাবিরচনা

গতিঃ প্রাদক্ষিণ্যক্রমণমশনাদ্যাহুতিবিধিঃ ।

প্রণামঃ সংবেশঃ সুখমখিলমাত্মার্পণদৃশা

সপর্য্যাপর্য্যায়স্তব ভবতু যন্মে বিলসিতম্ ||২৭||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতি, আত্মসমর্পণ-বুদ্ধি অনুসারে শব্দোচ্চারণ মাত্রই জপ, শিল্পমাত্রই মুদ্রা ( খেচরী দ্রাবণ প্রভৃতি ) রচনা, গমনমাত্রই প্রদক্ষিণ, ভোজনমাত্রই আহুতি, শয়নমাত্রই প্রণাম এবং অন্যান্য যে সকল সুখবিলাস আমার আছে, তৎসমস্তই আপনার পূজা স্বরূপে পরিগণিত হোক। অর্থাৎ জীবন্মুক্ত সময়াচারী গৃহস্থ, সাদনাম্নী কলায় নিবিষ্টচিত্ত এবং আত্মধ্যানপরায়ণ, তাদের যাদৃচ্ছিক শব্দোচ্চারণাদিই জপাদি-স্থানীয়। সাধক সেই ভাব প্রার্থনা করছেন।

হে মাতঃ, আমি সংসারমধ্যে যখন যে কার্য্য করব, তৎসমস্তই যেন তোমার অর্চনাস্বরূপ হয় এবং আমার বাক্যসমূহ তোমার জপস্বরূপ হোক। আর আমি যখন যেরূপ অঙ্গুলিসঞ্চালন করব, তৎসমুদয় তোমার মুদ্রা-রচনাস্বরূপ, আমি যখন যে দিকে গমন করব, তা তোমাকেই প্রদক্ষিণ করা স্বরূপ, আমার পান-ভোজনাদি তোমার উদ্দেশে আহুতি প্রদানস্বরূপ, আমি যখন শয়ন করব, তখন তা তোমার উদ্দেশে সাষ্টাঙ্গ প্রণামস্বরূপ, এবং আমার নিখিল-শক্তিসংযোগজনিত-সুখ আত্মার্পণস্বরূপ হোক ||২৭||

সুধামপ্যাস্বাদ্য প্রতিভয়জরামৃত্যুহরিণীং

বিপদ্যন্তে বিশ্বে বিধিশতমখাদ্যা দিবিষদঃ ।

করালং যৎক্ষ্বেলং কবলিতবতঃ কালকলনা

শম্ভোস্তন্মূলং তব জননি তাটঙ্কমহিমা ||২৮||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - জগতে ব্রহ্মা ও ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ ভীষণ জরামৃত্যুনিবায়ক অমৃত পান করেও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েও থাকেন, আর শিব করাল কালকূট সেবন করেও মৃত্যুঞ্জয়,– হে মাতঃ, এর মূল তোমার ( সধবাচিহ্ন ) কর্ণভূষণের মাহাত্ম্য।

হে জননি, জরা, মৃত্যু ও বিপক্ষভয়-বিদূরণকারী অমৃত পান করেও এই জগতে ব্রহ্মা ও ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ প্রলয়কালে কাল-কবলিত হয়ে থাকেন; কিন্ত নীলকণ্ঠ সদ্যোমৃত্যুর কারণ ভীষণ কালকুট ভক্ষণ করেও কালের বশীভূত হয়েন নাই। তোমার আত্মপ্রকাশ অর্থাৎ শম্ভু-শরীরে তোমার অনুপ্রবেশের এবং মহিমাই তৎপ্রতি কারণ ||২৮||

কিরীটং বৈরিঞ্চং পরিহর পুরঃ কৈটভভিদঃ

কঠোরে কোটীরে স্খলসি জহি জম্ভারিমুকুটম্ ।

প্রণম্রেষ্বেতেষু প্রসভমুপয়াতস্য ভবনং

ভবস্যাভ্যুত্থানে তব পরিজনোক্তির্বিজয়তে ||২৯||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ -হে ভগবতি, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও ইন্দ্র যখন (আপনার চরণসমীপে) দণ্ডবৎ প্রণত, তখন মহাদেব আপনার ভবনে আগমন করাতে আপনি সহসা তার অভ্যুত্থান করলে, (সম্ভ্রম-প্রচলিত) পরিজনগণের যে একজনকে আর একজন বলে থাকে- “সম্মুখে ব্রহ্মার কিরীট, পা দিও না, (ওদিকে) বিষ্ণুর (ভূপতিত) কঠোর মুকুটে পড়ে যাবে, ইন্দ্রের মুকুট সরিয়ে দেও,”–সেই উক্তির জয় জয়কার।

হে মাতঃ, ব্রহ্মাদি যখন তোমার চরণে দণ্ডবৎ প্রণত, তদবস্থায় শিব সহসা তোমার ভবনে উপস্থিত হলে তোমাকে সসম্ভ্রমে তার প্রত্যুদ্গমন করতে দেখে তোমার পরিজনবর্গ সতর্কতার জন্য বলতে থাকেন যে, “দেবি, সম্মুখে ব্রহ্মার কিরীট রয়েছে, এটা দ্বারা যেন তোমার চরণে আঘাত লাগে না ; এখানে বিষ্ণুর কঠোর মুকুট, সাবধান হও, যেন এতে পদস্খলন হয় না। এখানে দেবরাজের মুকুট, এটা অতিক্রম করে এসো।” হে দেবি, তোমার পরিজনগণের এই সমস্ত বাক্য জয়োল্লাসে পরিপূর্ণ হোক ||২৯||

স্বদেহোদ্ভূতাভির্ঘৃণিভিরণিমাদ্যাভিরভিতো

নিষেব্যে নিত্যে ত্বামহমিতি সদা ভাবয়তি যঃ ।

কিমাশ্চর্যং তস্য ত্রিনয়নসমৃদ্ধিং তৃণয়তো

মহাসংবর্তাগ্নির্বিরচয়তি নিরাজনবিধিম্ ||৩০||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে নিত্যে, নিষেব্যে আপনার চরণোদ্ভূত কিরণস্বরূপ অণিমাদি অষ্টসিদ্ধি-পরিবৃতা আপনাকে যে সাধক 'অহং'ভাবে সদা ধ্যান করে, শিবের ঐশ্বর্য্যেও তৃণ-জ্ঞানযুক্ত সেই ব্যক্তি (কালে তোমার সাযুজ্য প্রাপ্ত হওয়াতে) প্রলয়কালের অনলে যে নীরাজিত হবে, তার আর আশ্বর্য্য কি? ।

হে নিত্যে, “স্বীয় দেহসম্ভূত রশ্মিবৃন্দরূপ অণিমাদি আবরণ দেবতা কর্তৃক যিনি সেবিতা হয়েছেন, আমি সেই ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরী,” এইরূপ সোঽহংভাবে যিনি তোমাকে সর্বদা চিন্তা করেন, তিনি মহাদেবের অষ্ট বিভূতিকেও তৃণজ্ঞান করে থাকেন। মহাপ্রলয়কাল উপস্থিত হলে সর্বসংহারক মহাপ্রলয়াগ্নিও তার নীরাজনকার্য্য সম্পাদন করে থাকে। এতে আর আশ্চর্য্য কি? অর্থাৎ সেই সাধক চিরতরে শিবরূপে অবস্থিত হয়ে থাকেন ||৩০||

চতুঃষষ্ট্যা তন্ত্রৈঃ সকলমতিসন্ধায় ভুবনং

স্থিতস্তত্তৎসিদ্ধিপ্রসবপরতন্ত্রৈঃ পশুপতিঃ ।

পুনস্ত্বন্নির্বন্ধাদখিলপুরুষার্থৈকঘটনা-স্বতন্ত্রং

তে তন্ত্রং ক্ষিতিতলমবাতীতরদিদম্ ||৩১||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতি, মানবের সেই একৈক লৌকিক অভীষ্টসিদ্ধিসম্পাদন সমর্থ চতুঃষষ্টি তন্ত্র দ্বারা নিখিল ভূবনকে বঞ্চিত করে অবস্থিত পশুপতি, আপনারই আগ্রহে, নিখিল পুরুষার্থ-সম্পাদনে স্বয়মেব সমর্থ– আপনারই বক্ষ্যমাণ তন্ত্র ভূতলে অবতীর্ণ করেছেন। অর্থাৎ মহামায়া শঙ্কর প্রভৃতি চতুঃষষ্টি তন্ত্র বেদ-বাহ্য ও মায়া ইন্দ্রজাল প্রভৃতি একৈক ক্ষুদ্র সিদ্ধিসম্পাদক, তা অনুলোমসঙ্কর এবং বেদানধিকারী ও ঐরূপ সিদ্ধি অভিলাষী জনগণের সাধনার্থ শিব উপদেশ করেছেন, কিন্ত যারা উচ্চসাধনার অধিকারধুক্ত ব্রাহ্মণাদি জাতিমধ্যে জন্মেছে, তারাও ক্ষুদ্রসিদ্ধিলাভের আশায় এবং অপর সাধনা অপ্রকাশ থাকায় এ সকল মার্গ অবলম্বন করাতে বঞ্চিত হয়েছে। আপনি করুণাময়ী, ব্রাহ্মণাদি সকল বর্ণের কল্যাণার্থ বেদমার্গানুগত আপনার সাধনোপদেশক তন্ত্র-প্রকাশ শিবমুখ হতে আপনিই করিয়েছেন। এই শিবমুখনিঃসৃত তন্ত্র বশিষ্ঠ, সনক, শুক, সনন্দন ও সনৎকুমার দ্বারা ভূতলে প্রচারিত ও শুভাগম-পঞ্চক নামে খ্যাত। এই মতোক্ত আচার সময়াচার নামে খ্যাত, এ বৈদিক মার্গ। ভগবান্‌ শঙ্করাচার্য্য এই মতে শ্রীবিদ্যা সাধনার আদর করেছেন। চন্দ্র কলাবিদ্যাদি তন্ত্র সময়ামতানুসারী হলেও কৌলভাব মিশ্রিত বলে মিশ্রক এবং অপর তন্ত্রসমূহ কৌলমার্গ নামেই খ্যাত, তা ব্রাহ্মণের অবলম্বনীয় নয়। শুভাগম-পঞ্চক ধর্মার্থ-কাম-মোক্ষ প্রদানে ম্বাধীনভাবে সক্ষম। এই মত লক্ষ্মীধরের, তিনি তার ব্যাখ্যামধ্যে চতুঃষষ্টি তন্ত্রের নাম ও কোন্ তন্ত্র কি কারণে বেদবহির্ভূত, তা দেখিয়েছেন। সময়ামত পরে বিশেষভাবে আলোচিত হবে।

হে জননি, ভগবান্‌ পশুপতি শিব সনাতন চতুঃষষ্টি তন্ত্র দ্বারা সমস্ত জগতের নিখিল বিষয় অবগত হয়ে সর্বজ্ঞতা লাভ করত যে তন্ত্রে যেরূপ সিদ্ধি হতে পারে, তা জগতে প্রচারের জন্য ইতিকর্তব্যতা-নিরূপণের অধীন হয়ে থাকলেন। পরে তোমার নির্বন্ধাতিশয় প্রযুক্ত পুরুষার্থচতুষ্টয় এবং তত্তৎসিদ্ধির উপায় সমুদায় একত্র সঙ্ঘটিত করে তিনি স্বতন্ত্রতন্ত্র নামক তোমার এই কুলতন্ত্র পৃথিবীতে অবতারিত করেছেন ||৩১||

শিবঃ শক্তিঃ কামঃ ক্ষিতিরথ রবিঃ শীতকিরণঃ

স্মরো হংসঃ শক্রস্তদনু চ পরামারহরয়ঃ ।

অমী হৃল্লেখাভিস্তিসৃভিরবসানেষু ঘটিতা

ভজন্তে বর্ণাস্তে তব জননি নামাবয়বতাম্ ||৩২||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - পূর্ববর্তী গ্লোকে তন্ত্র অবতীর্ণ করেছেন বলা হয়েছে, এখন সেই তন্ত্র উপদিষ্ট হচ্ছে--( তন্ত্র মন্ত্রশাস্ত্র প্রথমেই মন্ত্রোপদেশ যথা ) হে জননি, শিব ( ক ), শক্তি ( এ ), কাম ( ঈ ), ক্ষিতি ( ল ), এর পরেই মায়াবীজ, অনন্তর রবি ( হ ), চন্দ্র ( স ), স্মর ( ক ), হংস ( হ ), শক্র ( ল ), এর পর মায়াবীজ। তৎপরে পরা ( স ), মার ( ক ), হরি অর্থাৎ ইন্দ্র ( ল ), তদন্তে মায়াবীজ, এইরূপ একৈক খণ্ডের অবসানে মায়াবীজযুক্ত ( চার বর্ণে প্রথম, পাঁচ বর্ণে দ্বিতীয়, তিন বর্ণে তৃতীয়,–এই তিন খণ্ডে বিভক্ত ) 'ক' এ ইত্যাদি দ্বাদশবর্ণ, আপনার মন্ত্রের অবরব। প্রথম খণ্ড আগ্নেয়, দ্বিতীয় সৌর, তৃতীয় চান্দ্র, পূর্বে কথিত হয়েছে–মূলাধার প্রভৃতি ষট্চক্রের দুই দুই চক্র এক এক খণ্ড। কথিত ত্রিখণ্ড মন্ত্রবর্ণ যথাক্রমে অগ্নি, সূর্য্য ও চন্দ্রস্বরূপ। মধ্যে যে তিনটি মায়াবীজ আছে–তার প্রথমটি আগ্নেয় খণ্ডের উপরিস্থিত রুদ্রগ্রন্থি, তদুপরিস্থিত সৌরখণ্ডের উপরি যে মায়াবীজ, তা বিষ্ণুগ্রন্থি। তদুপরিস্থিত চন্দ্রখণ্ডের উর্দ্ধে বা শেষে যে মায়াবীজ, তা ব্রহ্মগ্রন্থি-_ সহস্রদলকমলস্থ একাক্ষরী চিন্ময়ী চন্দ্রকলার সহিত এই গ্রন্থির সন্বন্ধ। রুদ্রগ্রন্থি আগ্নেয় ও সৌরখণ্ডের, বিষ্ণুগ্রন্থি সৌর ও চন্দ্রখণ্ডের সহিত সন্বন্ধ। এই যে পঞ্চদশবর্ণ, এ চন্দ্রকলারূপে ধ্যেয়। সর্বশুদ্ধ মন্ত্রস্থিত পঞ্চদশবর্ণ–প্রতিপদাদি পৌর্ণমাস্যন্ত শুক্লা ও প্রতিপদাদি অমাবস্যান্ত কৃষ্ণা তিথি। তদুপরি একাক্ষরী ষোড়শী কলা। এই ষোড়শী কলা নিত্যা। এর যোগ হেতু সমস্ত কলাই নিত্যা নামে খ্যাত। সময়াচারমতে এদের সাধনা অন্তরেই করতে হয়। এতৎসন্বন্ধে শ্রুতি ও তদনুকুল শুভাগমমতও বিশেষ উপদেশ সংস্কৃত ব্যাখ্যা হতে সাধকের জ্ঞাতব্য।

হে জননি, শিব বলতে সকার, কাম বলতে ককার, ক্ষিতিশব্দে লকার এবং এর অন্তে হৃল্লেখা অর্থাৎ 'হ্রী' এই বীজ যোগ করলে 'হ স ক ল হ্রীং' এই মন্ত্র হল। এর নাম বাগ্ভবকূট। রবি শব্দে হকার, শীতকিরণ বলতে সকার, স্মর শব্দে ককার, হংস বলতে হকার, শক্র শবে লকার, এর অন্তে হৃল্লেখা যোগ করলে 'হ স ক হ ল হ্রীং' এই মন্ত্র হল; এর নাম কামরাজকুট । পরাশব্দে সকার, মার শব্দে ককার, হরিশব্দে লকার, এর অন্তে হৃল্লেখা যোগ করলে 'স ক ল হ্রীং' এই মন্ত্র হল; এটা ত্রৈলোক্যমোহিনী নামক শক্তিকূট। এই ত্রিকূট মধ্যস্থিত বর্ণগুলি তোমার নামের অবয়ব হচ্ছে। ( এ দ্বারা 'হ স ক ল হ্রীং', 'স ক ল হ্রীং', 'হ স ক হ ল হ্রীং' এই ত্রিকূট-মন্ত্র উদ্ধত হল। এর নাম লোপামুদ্রা বিদ্যা ; এই বিদ্যা সমুদায় মন্ত্রের বীজস্বরূপা। )

স্মরং যোনিং লক্ষ্মীং ত্রিতয়মিদমাদৌ তব মনো-

র্নিধায়ৈকে নিত্যে নিরবধি মহাভোগরসিকাঃ ।

ভজন্তি ত্বাং চিন্তামণিগুননিবদ্ধাক্ষবলয়াঃ

শিবাগ্নৌ জুহ্বন্তঃ সুরভিঘৃতধারাহুতিশতৈঃ ||৩৩||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে নিত্যে, কামবীজ, মায়াবীজ ও শ্রীবীজ এই বীজত্রয়কে আপনার মন্ত্রের প্রথমে স্থাপন করে পরমযোগীশ্বর সময়াচারী কতিপয় সাধক চিন্তামণি মন্ত্রে সংবদ্ধ অক্ষ ( অকারাদি ক্ষকারান্ত ) বর্ণমালায় অন্তরে রেখে বৈন্দবস্থানে স্বাধিষ্ঠানাগ্নিযোগসম্পাদিত শিবাগ্নিকুণ্ডে সুরতিঘৃতধারায় বহু শত আহুতি ভাবনা দ্বারা আপনাকে ভজনা করেন।

হে নিত্যে, মহাভোগরসিক অর্থাৎ অপর্য্যাপ্ত সুখানুভবাকাঙ্ক্ষী জনগণ তোমার উল্লিখিত মন্ত্রের আদিতে ক এ ঈ অথবা ক্লীঁ হ্রীঁ শ্রীং এই বীজত্রয় যোগ করে সর্বদা জপ করত যদি কুণ্ডলিনীমুখে গোলোকাধিষ্টিত সুরভিসম্ভূত শত শত ঘৃতাহুতি দ্বারা অর্থাৎ পরমামৃত দ্বারা হোম করেন, তা হলে তারা চিন্তামণিগুণে নিবদ্ধ অক্ষরে লয়প্রাপ্ত হয়েন ||৩৩|| ( এ স্থলে চিন্তামণি শব্দে অভীষ্টফলদায়িনী চিৎকলা। চিৎকলা সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণময়ী। তা দ্বারা নিবন্ধ অক্ষর অর্থাৎ শব্দব্রহ্ম অথবা উপহিত চৈতন্যরূপ পরমব্রহ্ম )

শরীরং ত্বং শম্ভোঃ শশিমিহিরবক্ষোরুহয়ুগং

তবাত্মানং মন্যে ভগবতি নবাত্মানমনঘম্ ।

অতঃশেষঃ শেষীত্যয়মুভয়সাধারণতয়া

স্থিতঃ সংবন্ধো বাং সমরসপরানন্দপরয়োঃ ||৩৪||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - ( পূর্ব-কৌলমতের তাৎপর্য্যানুসারে কথিত হচ্ছে )–হে ভগবতি, আনন্দভৈরবী আপনিই আনন্দভৈরব শঙ্কর–চন্দ্রসূর্য্যরূপ স্তনযুগলযুক্ত শরীর, আর আপনার আত্মাকেই আমি মনে করি নির্মলনবব্যূহাত্মক আনন্দভৈরব। অতএব এই যে শেষশেষিভাব সন্বন্ধ এ পরানন্দ ও পরাশক্তিরূপা সমরসময়ী আপনাদের উভয়ের পরস্পর সাপেক্ষ সাধারণ। শেষ অঙ্গ বা অপ্রধান, শেষী অঙ্গী বা প্রধান। জগতের ব্যক্তাবস্থা অর্থাৎ পূর্ণ প্রলয়াবস্থা যত দিন না হয়, তত দিন প্রকৃতি আনন্দভৈরবীই প্রধান,–পূর্ণ অব্যক্তাবস্থায়, প্রাকৃত লয়সময়ে আনন্দভৈরব চিন্মাত্র প্রধান। এই শিবশক্ত্যাত্মক তত্ত্ব পূর্ব-কৌলমতে স্বীকৃত। নবব্যূহ–যথা: ( ১ ) কালব্যূহ–নিমেষ হতে মন্বন্তর কল্প পর্য্যন্ত। ( ২ ) কুলব্যুহ–নীলাদিরূপ। ( ৩ ) নামব্যূহ–সংজ্ঞাদি। ( 8 ) জানব্যূহ–বিজ্ঞানাদি। ( ৫ ) চিত্তব্যূহ–অহঙ্কারাদি। ( ৬ ) নাদব্যূহ–ইচ্ছাপ্রযত্নাদি। ( ৭ ) বিন্দুব্যূহ–ষট্চক্র। ( ৮ ) কলাব্যূহ–পঞ্চাশৎ মাতৃকাবর্ণ। ( ৯ ) জীবব্যূহ–ভোক্তৃসঙ্ঘ। অর্থাৎ জীবব্যূহ–ভোক্তা, জ্ঞানব্যূহ–ভোগ এবং অপর সপ্তব্যূহ ভোগ্য–এই ত্রিবিধ ভাব এতন্মধ্যে নিবিষ্ট।

হে ভগবতি, পরব্রহ্মস্বরূপ শিবের চন্দ্রসূর্য্যস্বরূপ স্তনযুগল সুশোভিত যে বিশ্বব্যাপক মুর্তি, তুমিই সেই বিরাট বিশ্বমূর্তি। গুণাতীত বিশ্বব্যাপক ব্রহ্মস্বরূপই তোমার স্বরূপ। হে মাতা, একমাত্র তুমিই শিবশক্তিরূপে আধারাধেয়ভাবে পুরুষ ও প্রকৃতিরূপে নিরূপিত হচ্ছে| বস্ততঃ তোমরা উভয়েই পরষ্পর অভিন্ন পরমানন্দস্বরূপ ||৩৪||

মনস্ত্বং ব্যোম ত্বং মরুদসি মরুৎসারথিরসি

ত্বমাপস্ত্বং ভূমিস্ত্বয়ি পরিণতায়াং ন হি পরম্ ।

ত্বমেব স্বাত্মানং পরিণময়িতুং বিশ্ববপুষা

চিদানন্দাকারং শিবয়ুবতি ভাবেন বিভৃষে ||৩৫||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - ( উত্তরকৌলমতে, শক্তিতত্ত্বই একমেবাদ্বিতীয়ম্‌, শিবতত্ত্ব এর অন্তর্গত, তন্মতানুসারে স্তোত্র যথা )–হে ভগবতি, তুমিই আজ্ঞাচক্রস্থ মনস্তত্ত্ব, তুমি বিশুদ্ধিচক্রস্থিত আকাশতত্ত্ব, তুমি অনাহতচক্রস্থিত বায়ুতত্ত্ব। তুমি স্বাধিষ্ঠানচক্রস্থিত বহ্নি বা অগ্নি, তুমি মণিপুরচক্রস্থিত জল, তুমি মূলাধারস্থিত ভূতত্ত্ব, নির্বিকারা তোমার চিন্তামণি তুল্য যে কারণরূপে অবস্থিতি, তাই এ সমুদয়ের হেতু, অপরবিধ পরিণাম তোমার নাই। তুমি নিজরূপকেই জগৎপ্রপঞ্চরূপে প্রকাশ করার জন্য, শিবযুবতিভাবে চিদানন্দরূপ গ্রহণ করে আছ। অর্থাৎ চিদানন্দ পরব্রহ্ম ও জগৎপ্রপঞ্চ সমন্তই তুমি।

হে মাতঃ, তুমিই মন ( পরমশিবস্থান মহর্লোক ), তুমিই ব্যোম ( সদাশিবস্থান তপোলোক ), তুমিই বায়ু ( ঈশ্বরস্থান জনলোক ), তুমিই অমি ( রুদ্রস্থান স্বলোক ), তুমিই জল ( নারায়ণস্থান ভূবর্লোক ) এবং তুমিই তুমি ( ব্রহ্মার স্থান ভূর্লোক )। এটাই ষট্চক্ররূপে তোমার সুক্ষ্মরূপ। তুমি স্থুলরূপে পরিণতা হলে তুমি ভিন্ন আর কোন বস্তুই থাকে না; তৎকালে তুমিই বিশ্বরূপা হয়ে বিরাজমানা হতে থাক। হে ভবানি, তুমি আপনাকে বিশ্বরূপে পরিণত করার নিমিত্ত লীলাক্রমে চিদানন্দাকার ধারণ করছ ||৩৫||

তবাজ্ঞাচক্রস্থং তপনশশিকোটিদ্যুতিধরং

পরং শম্ভুং বন্দে পরিমিলিতপার্শ্বং পরচিতা ।

যমারাধ্যন্ ভক্ত্যা রবিশশিশুচীনামবিষয়ে

নিরালোকেঽলোকে নিবসতি হি ভালোকভুবনে ||৩৬||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতি, তোমার আজ্ঞাচক্রস্থিত অর্থাৎ সাধকের ভ্রূমধান্তরগত ত্বদীয় শ্রীচক্রযুক্ত যে শিবচক্র ( উর্ধমুখ ত্রিকোণ ) চতুষ্টয়, তাতে অবস্থিত অগণিত কোটি সূর্য্য-চন্দ্র-প্রভাশ্রয় পরাচিচ্ছক্তি-সম্মিলিত-পার্শ্বদ্বয় পরতত্ত্ব শিবকে বন্দনা করি। যাকে আরাধনা করার সময়ে সূর্য্য, চন্দ্র, অগ্নির অগোচর তদীয় আলোকশূন্য ( কিন্তু অন্যবিধ ) জ্যোৎস্নাময় নিভৃত লোকে অর্থাৎ সহস্রারকমলে অবস্থিতি হয়।

হে জননি, আজ্ঞাচক্রস্থিত কোটি কোটি চন্দ্রসূর্য্যের ন্যায় দ্যুতিধর সচ্চিদানন্দস্বরূপ তোমার পরমশিব ও তৎপার্শ্বস্থিতা চিৎশক্তিকে আমি প্রণাম করছি । একে ভক্তিসহকারে আরাধনা করার নিমিত্ত সাধকগণ চন্দ্র, সূর্য্য ও অগ্নির অগোচর পার্থিব আলোকবিহীন ভালোকভবনে অর্থাৎ দিব্য তেজোলোকস্থিত তেজোময় গৃহে বাস করে থাকেন ||৩৬||

বিশুদ্ধৌ তে শুদ্ধস্ফটিকবিশদং ব্যোমজনকং

শিবং সেবে দেবীমপি শিবসমানব্যবসিতাম্ ।

যয়োঃ কান্ত্যা যান্ত্যাঃ শশিকিরণসারূপ্যসরণেঃ

বিধূতান্তর্ধ্বান্তা বিলসতি চকোরীব জগতী ||৩৭||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতি, সাধকের বিশুদ্ধিচক্রস্থিত তোমার শ্রীচক্রভুক্ত যে ষোড়শদল পদ্ম, তাতে আকাশতত্ত্ব স্রষ্টা শুদ্ধস্ফটিকশুভ্র শিব ও শিবসমানকার্য্যা দেবীকে সেবা করি। যাদের বিপুল জ্যোৎস্নাতুল্য প্রভার সাধক জগৎ চকোরীয় ন্যার তৃপ্তিপূর্ণ হয়ে থাকে।

হে মাতা, বিশুদ্ধ-চক্রস্থিত আদ্যাশক্তির সহিত শুদ্ধস্ফটিক সদৃশ শুভ্র ও আকাশতুল্য অসীমমূর্তি সদাশিবকে আমি প্রণাম করছি। আদ্যাশক্তিও সদাশিবের সহিত সামরস্যপরতন্ত্রা ও সমদুঃখসুখা হয়ে অবস্থান করছেন। এই অর্দ্ধনারীশ্বরের কান্তি চন্দ্রকিরণের সারূপ্য লাভ করাতে তদ্দ্বারা জগতীরূপা চকোরী নির্মল-হৃদয়া হয়ে পরমানন্দে বিহার করছে ||৩৭||

সমুন্মীলৎ সংবিৎ কমলমকরন্দৈকরসিকং

ভজে হংসদ্বন্দ্বং কিমপি মহতাং মানসচরম্ ।

যদালাপাদষ্টাদশগুণিতবিদ্যাপরিণতিঃ

যদাদত্তে দোষাদ্ গুণমখিলমদ্ভ্যঃ পয় ইব ||৩৮||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতি, বিকসিত সংবিৎ কমল অর্থাৎ অনাহতচক্ররূপ কমলের মকরন্দ পানে অদ্বিতীয় নিপুণ মহাজনগণের মানসচারী অনির্বচনীয় হংসমিথুন–( শিব-শিবাকে) ভজনা করি। যে হংসমিথুন জলমিশ্রিত দুগ্ধের জল ত্যাগ করে দুগ্ধ-গ্রহণের ন্যায় দোষমধ্য হতে নিখিল গুণই গ্রহণ করে থাকেন। লক্ষ্মীধর বলেন, দোষাভাবও গুণের অন্তর্গত। এই সাধনা সময়াচারস্থ কোন সম্প্রদায়ের । ভগবান্‌ শঙ্করাচার্য্য সম্প্রদায়ে অনাহতচক্রে সাধনা–অগ্নি ও অগ্নি-শক্তি মিলিত হয়ে দীপাঙ্কুরবৎ প্রতিভাত, তিনিই ধ্যেয়।

হে মাতা, যারা অনাহতচক্রে অধিষ্টিত রয়েছেন, যারা সুপ্রকাশিত জ্ঞানকমলের মকরন্দ পান করে থাকেন, সেই হংস ও হংসীরূপা ঈশ্বর ও ভুবনেশ্বরীকে আমি নমস্কার করছি। এই হংসযুগল জ্ঞানীগণের মানসসরোবরে সতত বিহার করে থাকেন। এদের ধ্যান করলে অষ্টাদশবিদ্যায় পারদর্শী হতে পারা যায়। সাধারণ হংস যেরূপ একত্রীকৃত জল ও দুগ্ধ হতে দুগ্ধকে পৃথক্‌ করে পান করে, এই হংসযুগলও তদ্রূপ দোষভাগ পরিত্যাগ পূর্বক গুণমাত্র গ্রহণ করে থাকেন ||৩৮||

তব স্বাধিষ্ঠানে হুতবহমধিষ্ঠায় নিরতং

তমীডে সংবর্তং জননি মহতীং তাঞ্চ সময়াম্ ।

যদালোকে লোকান্ দহতি মহতি ক্রোধকলিতে

দয়ার্দ্রা যা দৃষ্টিঃ শিশিরমুপচারং রচয়তি ||৩৯||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে জননি, স্বাধিষ্ঠানচক্র কল্পিত আপনার শ্রীচক্রাংশে, স্বাধিষ্টানোৎপন্ন অগ্নিকে রুদ্রাত্মক সংবর্তানল রূপ চিন্তা করত স্তব করি এবং মহতী সংবর্তানল জ্বালাহুতিই সময়া অর্থাৎ মহাশক্তি তাকে স্তব করি। ক্রোধোদ্দীপ্ত সেই শক্তিমান ও শক্তির দর্শনে দহ্যমান জগত্রয়, আপনারই করুণার্দ্রদৃষ্টিপ্রভাবে শীতলোপাচার প্রাপ্ত হয়। ( এইরূপ ভাবনা কর্ত্তব্য )

হে জননি, যিনি স্বাধিষ্ঠানচক্রে অগ্নিরূপ ধারণ করে অবস্থিত রয়েছেন, সেই রুদ্র ও রুদ্রশক্তি ভদ্রকালীকে স্তব করি। প্রলয়কালে এই রুদ্রের ক্রোধবিকসিত নয়ন যখন সমুদায় লোক দগ্ধ করতে প্রবৃত্ত হয়, তখন তুমি করুণার্দ্র-দৃষ্টিপাত দ্বারা এই সমুদায় জগৎ সুশীতল করে থাক ||৩৯||

তটিত্ত্বন্তং শক্ত্যা তিমিরপরিপন্থিফুরণয়া

স্ফুরন্নানারত্নাভরণপরিণদ্ধেন্দ্রধনুষম্

তব শ্যামং মেঘং কমপি মণিপূরৈকশরণং

নিষেবে বর্ষন্তং হরমিহিরতপ্তং ত্রিভুবনম্ ||৪০||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতি, মণিপূরচক্রে কল্পিত ত্বদীয় শ্রীচক্রাংশে তিমিরহর পরিস্ফুরণ। শক্তি-বিকাশে সৌদামিনীসমুজ্জল নানারত্নকিরণে ইন্দ্রধনুর্মণ্ডিত শ্যাম মেঘের আমি সেবা করি। এই মেঘ রুদ্ররূপ সূর্য্যতপ্ত অর্থাৎ পূর্বোক্ত সংবর্তানলতপ্ত জগতে সলিল বর্ষণ করে থাকেন। অর্থাৎ মণিপুরস্থানে জলতত্ত্ব, অনাহতের উপরে সূর্য্যস্থান, দেই সূর্য্যকিরণসমূহ স্বাধিষ্ঠানস্থ অগ্নির ধূমজালকে মেঘরূপে পরিণত করেন, তা হতে মণিপুরস্থানে জল উৎপন্ন হয়। স্বাধিষ্ঠানানলদগ্ধ জগৎ সেই জল দ্বারা শীতল হয়। মেঘ শিবেরই স্বরূপ, তৎস্থিত সৌদামিনী শক্তি, মণিপূরচক্রে উক্তরূপে জল-সৃষ্টি ভাবনা করবে, এবং জ্যা-হীন ধনুর্ধারী শ্যামবর্ণ শিব ও তার ধ্বান্তবিধ্বংসিনী সৌদামিনীরূপা শক্তি ভাবনা করবে।

হে জননি, মণিপূরস্থিত অনির্বচনীয় মেঘাভ বিষ্ণুকে এবং তোমার অংশ বৈষ্ণবী শক্তিকে নমস্কার করছি। নিজস্ফুরণ দ্বারা তমোরাশি বিধ্বংসিনী এই বৈষ্ণবী শক্তি অন্ধকার সদৃশ শ্যামবর্ণ বিষ্ণুর অঙ্গে চপলার ন্যায় শোভা পাচ্ছেন। তার নানারত্নবিনির্মিত বহুবিধ সুনির্মল আভরণ ইন্দ্রধনুর ন্যায় শোভা ধারণ করেছে। এই বিষ্ণুরূপ অপূর্ব মেঘ করুণবারিবর্ষণ দ্বারা রুদ্ররূপ প্রচণ্ড সুর্য্য-সন্তপ্ত ত্রিভুবনকে পুনর্জ্জীবিত করছেন ||৪০||

তবাধারে মূলে সহ সময়যা লাস্যপরয়া

নবাত্মানং মন্যে নবরসমহাতাণ্ডবনটম্ ।

উভাভ্যামেতাভ্যামুদয়বিধিমুদ্দিশ্য দয়যা

সনাথাভ্যাং জজ্ঞে জনকজননীমজ্জগদিদম্ ||৪১||

লক্ষ্মীধর টীকা ও অচ্যুতানন্দের টীকানুসারে ভাবার্থ - হে ভগবতি, মূলাধারচক্রকল্পিত আপনার শ্রীচক্রাংশে বুঝছি, লাস্যতৎপরা সময়া অর্থাৎ আনন্দ- ভৈরবীসহ শৃঙ্গারাদি নবরসে বিচিত্র তাণ্ডবের অভিনেতা নবব্যূহাত্মা ( নবব্যূহ পূর্বে কথিত হয়েছে ) আনন্দভৈরব বর্তমান। তারা সংবর্তানল ( প্রলয়ানল )- দগ্ধ লোকের উৎপত্তির জন্য কৃপাপূর্বক মিলিত হওয়াতে এই জগৎ জনক-জননীযুক্ত হয়ে উৎপন্ন হয়েছে।

হে মাতা, তুমি পিতৃমাতৃ-স্বরূপ। মূলাধারচক্রে তোমার কলা অর্থাৎ অংশস্বরূপা সাবিত্রী-শক্তির সহিত যে ব্রহ্মা নামে শিব আছেন, তাকে আমি নমস্কার করছি । এই সাবিত্রী শৃঙ্গার অবধি শান্তি পর্য্যন্ত নবরসের অভিনয়ে সুদক্ষ নটস্বরূপ স্বীয় পতি ব্রহ্মার সহিত বহুবিধ হাবভাব প্রদর্শন সহকারে অভিনয়পূর্বক নৃত্য করছেন । এই ব্রহ্মা ও সাবিত্রী স্ব স্ব অভিলাষ-সাধনের উদ্দেশে পরস্পর পরস্পরের সহায় হয়ে পিতৃমাতৃভাবে পরিপূর্ণ শ্রীসম্পন্ন এই সমুদায় জগৎ সৃষ্টি করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন ||৪১||

.............................................................................................

বিঃদ্রঃ- ধারাবাহিকভাবে লিখব।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...