জীব কি বৈশেষিকমতাবলম্বিগণের মতানুসারে আগন্তুক চৈতন্যবিশিষ্ট স্বভাবতঃ অচেতন, অথবা সাংখ্যমতাবলম্বিগণের ন্যায় নিত্য চৈতন্যস্বরূপই, এইরূপ সংশয়ের প্রত্যুত্তরে ভগবান বাদরায়ণ ব্রহ্মসূত্রের জ্ঞাধিকরণম্ এ সিদ্ধান্ত করিতেছে-
'জ্ঞোত এব৷৷' ব্রহ্মসূত্র-২।৩।১৮৷৷
'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য ভাষ্যে বলিতেছেন- এই প্রকার সংশয় প্রাপ্ত হইলে কথিত হইতেছে-এই আত্মা (-জীব) জ্ঞ অর্থাৎ নিত্য চৈতন্যস্বরূপ,'অতএব', অর্থাৎ যেহেতু ইহা উৎপন্নই হয় না। পরব্রহ্মই উপাধির সহিত সম্পর্কবশতঃ জীবরূপে অবস্থান করিতেছেন। যেহেতু-
'বিজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্ম'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৯।২৮)
"ব্রহ্ম বিজ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ।"
'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।১)
"ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞান ও অনন্তস্বরূপ।"
'অনন্তরোবাহ্যঃ কৃত্স্নঃ প্রজ্ঞানঘন এব'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৫।১৩)
"(এই আত্মা) অন্তররহিত, বাহ্যরহিত সম্পূর্ণরূপে প্রজ্ঞানঘন।"
ইত্যাদি শ্রুতিসকলে পরব্রহ্মেরই চৈতন্যস্বরূপতা পঠিত হইয়াছে। জীব নিশ্চয়ই সেই পরব্রহ্মস্বরূপ, সেইহেতু অগ্নির উষ্ণতা ও প্রকাশের ন্যায় জীবেরও নিত্য-চৈতন্যস্বরূপতা অবগত হওয়া যাইতেছে।
আর বিজ্ঞানময় প্রক্রিয়াতে-
'অসুপ্তঃ সুপ্তানভিচাকশীতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।১১)
"স্বয়ং অসুপ্ত (-অলুপ্ত দৃকশক্তি) থাকিয়া সুপ্তসকলকে (-স্বপ্নকালীন অন্তঃকরণবৃত্তিসকলকে) দর্শন (-প্রকাশিত) করেন।"
'অত্রায়ং পুরুষঃ স্বয়ংজ্যোতির্ভবতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।৯)
"এখানে (-স্বপ্নাবস্থাতে) পুরুষ স্বয়ং জ্যোতি হন।"
'ন হি বিজ্ঞাতুর্বিজ্ঞাতের্বিপরিলোপো বিদ্যতে'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।৩০)
"যেহেতু বিজ্ঞাতার বিজ্ঞানের বিপরিলোপ হয় না অর্থাৎ সাক্ষিচৈতন্যের জ্ঞান বিনষ্ট হয় না।"
ইত্যাদি এইরূপ আগমপ্রমাণবলে জীবের নিত্য চৈতন্যস্বরূপতা প্রতিপাদন হয়। আবার-
'অথ যো বেদেদং জিঘ্রাণীতি স আত্মা'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮।১২।৪)
"আর যিনি জানেন' আমি ইহা আঘ্রাণ করি', তিনি আত্মা।"
এইপ্রকারে সকলপ্রকার ইন্দ্রিয়রূপ দ্বার সকলের দ্বারা 'ইহা জানেন, ইহা জানেন', এইপ্রকার জ্ঞানের দ্বারা জ্ঞাতা আত্মার অনুসন্ধান অনুভব হয় বলিয়া জীবের নিত্যজ্ঞানরূপতা সিদ্ধ হয়।
(শঙ্কা-) যদি বলা হয়, (জীবাত্মা) নিত্যচৈতন্যস্বরূপ হইলে ঘ্রাণাদি ইন্দ্রিয়ের ব্যার্থতা হইয়া পড়িবে। তদুত্তরে সিদ্ধান্তী বলেন-না, তাহা বলা যায় না, যেহেতু গন্ধ প্রভৃতি বিশেষ বিষয়সকলের পরিচ্ছেদের জন্য ইন্দ্রিয়সকলের আবশ্যকতা আছে। 'গন্ধায় ঘ্রাণম্'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮।১২।৪) অর্থাৎ "গন্ধের জন্য ঘ্রাণেন্দ্রিয়", ইত্যাদি শ্রুতি।
আর যে শঙ্কা জন্মায়-সুপ্ত প্রভৃতি পুরুষের চেতনা থাকে না ইত্যাদি। তদুত্তরে সিদ্ধান্তী বলিতেছেন- সুষুপ্ত পুরুষকে প্রস্তাব করিয়া-
'যদ্বৈ তন্ন পশ্যতি পশ্যন্বৈ তন্ন পশ্যতি; ন হি দ্রষ্টুর্দৃষ্টের্বিপরিলোপো বিদ্যতেবিনাশিত্বাত্; ন তু তদ্দ্বিতীযমস্তি ততোন্যদ্বিভক্তং যত্পশ্যেত্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।২৩)
"সুষুপ্তিতে তিনি যে দর্শন করেন না, তাহা দর্শন করিয়াও দর্শন করেন না, যেহেতু দ্রষ্টার দৃষ্টির বিপরিলোপ হয় না, কারণ দ্রষ্টা অবিনাশী,, কিন্তু তাহা হইতে বিভক্ত অন্য দ্বিতীয় বস্তু নাই, যাহাকে দর্শন করিবেন।"
ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা শ্রুতি কর্ত্তৃকই তাহার পরিহার কথিত হইয়াছে। ইহাই কথিত হইয়াছে যে অচেতয়মানতা (-কিছুই না জানা), ইহা (সুষুপ্তিকালে) বিষয়ের অভাব বশতঃ হইয়া থাকে, কিন্তু (জীবাত্মার) চৈতন্যের অভাবপ্রযুক্ত নহে।। যেমন আকাশে আশ্রিত যে প্রকাশ (-সূর্য্যকিরণ), প্রকাশ্য বস্তুর অভাববশতঃই তাহার অনভিব্যক্তি হইয়া থাকে, কিন্তু (তাহার) স্বরূপের অভাববশতঃ নহে। আর বৈশেষিক প্রভৃতি মতাবলম্বীগণের তর্কও শ্রুতির সহিত বিরোধ হওয়ায় অসৎ তর্করূপে নিরাকৃত হইয়া পড়িতেছে। অতএব আত্মা অবশ্যই নিত্যচৈতন্যস্বরূপ, ইহা আমরা নিশ্চয় করিতেছি।
ইতি
No comments:
Post a Comment