Tuesday, 17 November 2020

বিষ্ণুসহস্রনামস্তোত্রম্ শাঙ্করভাষ্য (পর্ব-০১)



মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাস প্রণীত শ্রীমহাভারতের অনুশাসন পর্ব্বের ১৪৯ তম অধ্যায়ে বিষ্ণুসহস্রনাম স্তোত্রম্ এ শ্রীভগবান বিষ্ণুর সহস্রনামের মাহাত্ম্য বর্ণিত আছে। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য এই স্তোত্রম্ এর প্রাঞ্জল ভাষ্য রচনা করেছেন-

মঙ্গলাচরণঃ-

সচ্চিদানন্দরূপায় কৃষ্ণায়াক্লিষ্টকারিণে।

নমো বেদান্তবেদ্যায় গুরুবে বুদ্ধিসাক্ষীণে।।

কৃষ্ণদ্বৈপায়নং ব্যাসং সর্বলোকহিতে রতম্।

বেদাব্জভাস্করং বন্দে শমাদিনিলয়ং মুনিম্।।

সহশ্রমূর্তেঃ পুরুষোত্তমস্য সহশ্রনেতাননপাদবাহোঃ

সহস্রনাম্নাং স্তবনং প্রশস্তং নিরুচ্যতে জন্মজরাদি শান্ত্যৈ।।

সচ্চিদানন্দস্বরূপ, অনায়াসে সকল কর্ম সম্পাদনকারী, বেদান্তবেদ্য, বুদ্ধি-সাক্ষী গুরুবর শ্রীকৃষ্ণকে নমষ্কার। বেদরূপী পদ্ম এর জন্য সূর্যরূপ, শমাদির আশ্রয়, সমস্ত সংসারের হিতে তৎপর মুনিবর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকে প্রণাম করছি। সহশ্র নেত্র, মুখ, হস্ত-পদ, এবং মূখময় সহস্রমূর্তিমান শ্রীপুরুষোত্তম ভগবানের সহস্র নামাবলি প্রশস্ত স্তবনের, জন্ম-জরাদি হতে শান্তির জন্য ব্যাখ্যা করা হল।

অথ বৈশম্পায়নে জনমেজয়মুবাচ- বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে বললেন-

১. শ্রুত্বা ধর্মানশোষেণ পাবনানি চ সর্বশঃ।

যুধিষ্ঠিরঃ শান্তনবং পুনরেবাভ্যভাষত।।

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘ধর্মাণ্’ অভ্যুদয়নিঃশ্রেয়সোৎপত্তিহেতুভূতান্ চোদনালক্ষণান্ ‘অশেষেণ’ কাৎসর্ন্যেন ‘পাবনানি’ পাপক্ষয়করাণি ধর্মরহস্যানি ‘চ সর্বশঃ’ সর্বপ্রকারৈঃ ‘শ্রুত্বা যুধিষ্ঠিরো’ ধর্মপুত্রঃ ‘শান্তনবং’ শন্তনুসুতং ভীষ্মং সকলপুরুষার্থসাধনং সুখসম্পাদ্যম্ অল্পপ্রয়াসম্ অনল্পফলম্ অনুক্তমিতি কৃত্বা ‘পুনঃ’ ভূয় ‘এব অভ্যভাষণ’ প্রশ্নং কৃতবান্।।

অনুবাদঃধর্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অভ্যুদয় এবং নিঃশ্রেয়সের প্রাপ্তির হেতু স্বরূপ সম্পূর্ণবিধিরূপ ধর্ম তথা পবিত্র অর্থাৎ পাপসমূহের ক্ষয়কারী ধর্মরহস্যকে সর্বশঃ সকল প্রকার শুনে এটা অবগত হল যে এক্ষণ পর্যন্ত কোন ধর্মে বলা হয় নি, যা সকল পুরুষার্থের সাধক এবং সুখসম্পাদ্য অর্থাৎ অল্প প্রয়াসেই সিদ্ধ হওয়ায় মহান ফলস্বরূপ। শান্তনুপুত্র ভীষ্মের কাছে পুনরায় জিজ্ঞেস করল। (১)

যুধিষ্ঠির উবাচ- যুধিষ্ঠির বললেন-

২. কিমেকং দৈবতং লোকে কিং বাচ্যেকং পরায়ণম্।

স্তুবন্তঃ কং কমর্চন্তঃ প্রাপ্তুয়ুর্মানবাঃ সুভম্।।

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘কিমেকং দ্বৈবতং’ দেব ইত্যর্থঃ, স্বার্থে তদ্বিতপ্রত্যয়বিধানাৎ, ‘লোকে’ লোকনহেতুভূতে সমস্তবিদ্যাস্থানে উক্তম্ ‘যদাজ্ঞয়া প্রবর্তন্তে সর্বে’ ইতি প্রথমঃ প্রশ্নঃ। ‘কিং বাচ্যেকং পরায়ণম্’ অস্মিংল্লোকে একং পরায়ণং চ কিম্? পরম্ অয়নং প্রাপ্তব্যং স্থানং যস্মিন্নিরীক্ষীতে-

“ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থি- শ্চিদ্যন্তে সর্বশংসয়াঃ।

ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে।।” (মুণ্ডক উপনিষৎ ২/২/৯)

ইতি শ্রুতেঃ হৃদয়গ্রন্থির্ভিদ্যতে। যস্য বিজ্ঞানমাত্রেণানন্দলক্ষণো মোক্ষঃ প্রাপ্যতে; যদ্বিদ্বান্ন বিভেতি কুতশ্চন; যৎপ্রবিষ্টস্য ন বিদ্যতে পুনর্ভবঃ; যস্য চ বেদনান্তদেব ভবতি, “ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি” (মুণ্ডক উপনিষৎ ৩/২/৯) ইতি শ্রুতেঃ।

যদ্বিহায়াপরঃ পন্থা নৃণাং নাস্তি, “নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ ৬/১৫) ইতি শ্রুতেঃ।

তদুক্তমেকং পরায়ণং লোকে যত্তত্ কিমিতি দ্বিতীয়ঃ প্রশ্নঃ।‘কং’ কতমং দেবং ‘স্তুবন্তঃ’ গুণসঙ্কীর্তনং কুর্বন্তঃ, ‘কং’ কতমং দেবম্ ‘অর্চন্তঃ’ বাহ্যমাভ্যন্তরং চার্চনং বহুবিধং কুর্বন্তঃ ‘মানবা’ মনুসুতাঃ ‘শুভং’ কল্যাণং স্বর্গাদিফলং ‘প্রাপ্তুয়ুঃ’ লভেরন্নিতি পুনঃ প্রশ্নদ্বয়ম্।।

অনুবাদঃ- সমস্ত বিদ্যার স্থানপ্রকাশক হেতুস্বরূপ সংসারে একমাত্র দেবতা কে? যার বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘যার আজ্ঞাতে সমস্ত প্রাণী প্রবৃত্ত হয়’ এটি প্রথম প্রশ্ন। এখানে ‘দৈবৎ’ শব্দের অর্থ করার জন্য তদ্ধিতপ্রত্যয় ব্যবহৃত হয়েছে। অতঃ ‘দৈবতম্’ শব্দের অর্থ দেবতাই হয়।

তথা একতা পরায়ণ কে? অর্থাৎ এই সংসারে একতা পরায়ণ- একই পর আপন মানে প্রাপ্তিস্থান কে? ‘যার সাক্ষাৎকার হলেই সেই কার্য্য-কারণরূপ পরমাত্মার দর্শনে অবিদ্যারূপ হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে যায়। সমস্ত সংশয় নাশ হয়ে যায় তথা সমস্ত কর্ম ক্ষীণ হয়ে যায়।’ এই শ্রুতি অনুসারে হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে যায়।

যার জ্ঞানহওয়া মাত্রই আনন্দস্বরূপ মোক্ষ প্রাপ্তি হয়, যিনি তাকে জানেন তার সমস্ত ভয় দূর হয়ে যায়, যাতে প্রবেশ করলে আর পুণর্জন্ম হয় না, যাকে জানলে – ‘যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রহ্ম হয়ে যান’ এই শ্রুতি বাক্যানুসারে জীব ব্রহ্মই হয়ে যায়। তথা যাকে ছেড়ে মানুষের জন্য দ্বিতীয় কোন মার্গ নেই। শ্রুতি বলেছে – ‘মোক্ষের জন্য অন্য কোন উপায় নেই।’ এভাবেই সংসারে যাকে একতা পরায়ণ বলা হয়েছে তিনি কে? এটি দ্বিতীয় প্রশ্ন।

এবং কোন দেবতার স্তুতি ও গুণকীর্তন করায় তথা কোন দেবতাকে নানা উপায়ে অর্চনা অর্থাৎ বাহ্যিক এবং আন্তরিক পূজা করায় মানুষ স্বর্গাদি ফলস্বরূপ কল্যাণকর প্রাপ্তি করতে পারে? এই দুটি প্রশ্ন আরও। (২) 

৩. কো ধর্মঃ সর্বধর্মাণাং ভবতঃ পরমো মতঃ।

কিং জপন্মুচ্যতে জন্তুর্জন্মসংসারবন্ধনাৎ।।

(কঃ, ধর্ম, সর্বধর্মাণাম্, ভবতঃ, পরম্, মতঃ।

কিম্, জপন্, মুচ্যতে, জন্তু, জন্মসংসারবন্ধনাৎ।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘কো ধর্মঃ’ পুর্বোক্তলক্ষণঃ ‘সর্বধর্মাণাং’ সর্বেষাং ধর্মাণাং মধ্যে ‘ভবতঃ পরমঃ’ প্রকৃষ্টো ‘মতঃ’ অভিপ্রেত ইতি পঞ্চমঃ প্রশ্নঃ

‘কিং জপন্’ কিং জপ্যং জপন্ উচ্চোপাংশুমানসলক্ষণং জপং কুর্বন্ ‘জন্তুঃ’ জননধর্মা। অনেন জন্তুশব্দেন্ জপার্চনস্তবনাদিষু যথাযোগ্যং সর্বপ্রাণিনামধিকারং মুচয়তি। ‘জন্মসংসারবন্ধনাৎ’ জন্ম অজ্ঞানবিজৃম্ভিতানামবিদ্যাকার্যাণামুপলক্ষণম্, সংসারোহবিদ্যা তাভ্যাং, জন্মসংসারাভ্যাং যদ্বন্ধনং তস্মাৎ ‘মুচ্যতে’ মুক্তো ভবতীতি ষষ্ঠঃ প্রশ্নঃ।

মুচ্যতে জন্মসংসারবন্ধনাদিতীদমুপলক্ষণম্ ইতরেষাং ফলানামপি এতদ্গ্রহণং মোক্ষস্য প্রাধান্যখ্যাপনর্থম্।।

অনুবাদঃ- পুর্ব লক্ষণযুক্ত সমস্তধর্মের মধ্যে কোন ধর্মকে শেষ্ঠ বলা হয়েছে? এটি পঞ্চম প্রশ্ন।

তথা কোন জপ শ্রেষ্ঠ এবং কি প্রকার মানস জপ করায় জননধর্মা জীব জন্ম-সংসার-বন্ধন থেকে মুক্ত হয়? এই ‘জন্ত’ শব্দ দ্বারা জপ, অর্চন ও স্তবাদিতে সমস্ত প্রাণীর যথাযোগ্য অধিকার সূচিত করে। ‘জন্ম’ শব্দ অজ্ঞান দ্বারা প্রণীত হওয়া অবিদ্যাকার্যকে নির্দেশ করে তথা ‘সংসার’ অবিদ্যারই নাম রূপ। সেই জন্ম ও সংসারের যে বন্ধন তার থেকে নিস্তারের উপায় কি? এটি ষষ্ঠ প্রশ্ন।

‘জন্ম-সংসাররূপ বন্ধন থেকে কি করে মুক্তি হবে?’ যেখানে বলা হয়েছে মোক্ষই প্রধান। অতঃ বাক্য দ্বারা অন্য ফলেরও গ্রহণ করা বুঝায়। (৩)

কিমেকমিতি ষট্ প্রশ্নাঃ কথিতাঃ। তেষু পাশ্চাত্যোহনন্তরো জপ্যবিষয়ঃ ষষ্ঠঃ প্রশ্নোহনেন শ্লোকেন পরিহিয়তে।

শ্রীভীষ্ম উত্তরমুবাচ-

‘সেই একমাত্র দেব কে?’ ইত্যাদি বিষয়ে (যুধিষ্ঠির কর্তৃক) ৬টি প্রশ্ন করা হয়েছে উপরে। তার মধ্যে ৬নং অর্থাৎ শেষ প্রশ্নটি যা জপ বিষয়ে করা হয়েছিল নিম্নের শ্লোকে তারই উত্তর দেওয়া হচ্ছে।

শ্রীভীষ্মদেব উত্তর দিলেন-

৪. জগৎপ্রভুং দেবদেবমনন্তং পুরুষোত্তমম্।

স্তুবন্নামসহস্রেণ পুরুষঃ সততোত্থিতঃ।।

(জগৎপ্রভুম্, দেবদেবম্, অনন্তম্, পুরুষোত্তমম্।

স্তুবন্, নামসহস্রেণ, পুরুষঃ, সততোত্থিতঃ।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ সর্বেষাং বহিরন্তঃ শত্রুণাং ভয়হেতুর্ভীষ্মঃ মোক্ষধর্মাদীনাং প্রবক্তা সর্বজ্ঞঃ।

‘জগৎ’ স্থাবরজঙ্গমাত্মকং তস্য ‘প্রভুং’ স্বামিনম্, ‘দেবদেবং’ দেবতাং ব্রহ্মাদীনাং দেবম্, ‘অনন্তং’ দেশতঃ কালতো বস্তুতশ্চাপরিচ্ছিন্নম্, ‘পুরুষোত্তমং’ ক্ষরাক্ষরাভ্যাং কার্যকারণাভ্যামুৎকৃষ্টং, ‘নামসহস্রেণ’ নাম্নাং সহস্রেণ ‘স্তুবন’ গুণান্মঙ্কোর্তয়ন্ ‘সততোত্থিতো’ নিরন্তর ম্রুদ্যুক্তঃ। ‘পুরুষঃ’ পুর্ণত্বাৎ পুরি শয়নাদ্বা পুরুষঃ – ‘সর্বদুঃখাতিগো ভবেৎ’ ইতি সর্বত্র সম্বধ্যতে।।

অনুবাদঃ মোক্ষধর্মাদির বর্ণনাকারী সর্বজ্ঞ (দেবব্রতকে) ই বাহ্যিক ও আন্তরিক সমস্ত শত্রুভয়ের কারণ হওয়ায় ভীষ্ম বলা হয়। স্থাবরজঙ্গমরূপ যে সংসার তার প্রভু-জগৎ স্বামী, দেবোকেদেব ব্রহ্মা, অনন্ত অর্থাৎ দেশ, কাল ও বস্তু দ্বারা অপরিচ্ছন্ন, কার্য-কারণরূপ ক্ষর ও অক্ষর হতে শ্রেষ্ঠ পুরুষোত্তমের সহস্রনামের দ্বারা নিরন্তর তৎপর হয়ে স্তব- গুণসংকীর্তন করায় পুরুষ (জীব) সমস্ত দুঃখ হতে নিস্তার হয়ে যায়। পূর্ণ হওয়ায় অথবা শরীররূপ পুরমেং শয়ন করায় জীবের নামই ‘পুরুষ’। এখান থেকে (ষষ্ঠ শ্লোক পর্যন্ত) ‘সর্বদুঃখাতিগো ভবেৎ’ (সমস্ত দুঃখ থেকে নিস্তার হয়ে যায়) এই বাক্যটি প্রত্যেক শ্লোকের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হবে। (৪)

উত্তরেণ শ্লোকেন চতুর্থঃ প্রশ্নঃ সমাধীয়তে – নিন্মের শ্লোকে চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে-

৫. তমেব চার্চয়ন্নিত্যং ভক্ত্যা পুরুষমব্যয়ম্।

ধ্যায়ংস্তুবন্নমস্যংশ্চ যজমানস্তমেব চ ।।

(তম্, এব, চ, অর্চয়ন্, নিত্যম্, ভক্ত্যা, পুরুষম্, অব্যয়ম্। ধ্যায়ন্, স্তুবন্, নমস্যন্, চ, যজমানঃ, তম্, এব, চ।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘তমেব চার্চয়ন্’ বাহ্যার্চনং কুর্বন্ ‘নিত্যং’ সর্বেষু কালেষু ভক্তির্ভজনং তাৎপর্যং তয়া ‘ভক্ত্যা পুরুষমব্যয়ম্’ বিনাশক্রিয়ারহিতম্, তমেব চ ‘ধ্যায়ন্’ পূর্বোক্তেন ‘নমস্যন্’ নমস্কারং কুর্বন্, পূজাশেষভূতমুভয়ং স্তুতিনমষ্কারলক্ষণং ‘যজমান’ পূজকঃ ফলভোক্তা।

অথবা, অর্চয়ন্নিত্যনেনোভয়বিঘ্নমর্চনমুচ্যতে। ধ্যায়ংস্তুবন্নমস্যংশ্চেত্যনেন মানসং বাচিকং কায়িকং চোচ্যতে।।

অনুবাদঃ- তথা সেই অবিনাশী পুরুষের নিত্য ভজনা করাকে ভক্তি বলে, সেই ভক্তিতে মগ্ন হয়ে পূজা এবং ধ্যান (আন্তরিক পূজা) পুর্বোক্ত উপায়ে অর্থাৎ সহস্রনাম দ্বারা স্তব এবং নমষ্কার করায় যজমান (পূজারী বা ফল ভোক্তা) এর সমস্ত দূঃখ দূর হয়ে যায়।

অথবা, ‘অর্চয়ন্’ শব্দ দ্বারা এখানে বাহ্যিক ও আন্তরিক দুই প্রকারের অর্চনা তথা ধ্যানকে বুঝানো হয়েছে। স্তব ও নমষ্কার করাকে মানসিক, শারিরীক ও বাচিক পূজা বলা হয়েছে। (৫)

তৃতীয়ং প্রাশ্নং পরিহরতি উত্তরৈস্ত্রিভিঃ পাদৈঃ – নিন্মে তিন পদে তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হচ্ছে-

৬. অনাদিনিধনং বিষ্ণুং সর্বলোকমহেশ্বরম্।

লোকাধ্যত্তুং স্তুবন্নিত্যং সর্বদুঃখাতিগো ভবেত্।।

(অনাদিনিধনম্, বিষ্ণুম্, সর্বলোকমহেশ্বরম্।

লোকাধ্যক্ষম্, স্তুবন্, নিত্যম্, সর্বদুঃখাতিগঃ, ভবেৎ।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘অনাদিনিধনং’ ষড়ভাববিকারবর্জিতম্, ‘বিষ্ণুং’ ব্যাপনশীলম্, সর্ব লোক্যতে ইতি লোকো দৃশ্যবর্গো লোকস্তস্য নিয়ন্তৃণাং ব্রহ্মাদীনামপীশ্বরত্বাৎ ‘সর্বলোকমহেশ্বরঃ তম্’ লোকং দৃশ্যবর্গং সাভাবিকেন বোধেন সাক্ষাৎপশ্যতীতি ‘লোকাধ্যক্ষঃ তং নিত্যং’ নিরন্তরং ‘স্তুবন্ সর্বদুঃখাতিগো ভবেৎ’ ইতি ত্রয়াণাং স্তবনার্চনজপানাং সাধারণং ফলবচনম্। সর্বাণ্যাধ্যাত্মিকাদীনি দুঃখান্যতীত্য গচ্ছতীতি সর্বদুঃখাতিগঃ ভবেৎ স্যাৎ।।

অনুবাদঃ- অনাদিনিধন অর্থাৎ [হওয়া, জন্ম নেওয়া, বড় হওয়া, পরিবর্তন হওয়া, সূক্ষ্ম হওয়া, নষ্ট হওয়া -এই ] ৬টি ভাববিকার রহিত, বিষ্ণু অর্থাৎ ব্যাপক তথা সম্পূর্ণ লোকের মহেশ্বর – যা কিছু দেখি সেই সমস্ত দৃশ্যবর্গ নাম লোকের নিয়ন্তা ব্রহ্মাদিরও প্রভু হওয়ায় যিনি সর্বলোকমহেশ্বর এবং সমস্ত দৃশ্যবর্গকে নিজের স্বাভাবিক জ্ঞান দ্বারা সাক্ষাৎ দর্শনহেতু লোকধ্যক্ষ তিনি। সেই দেব এর নিরন্তর স্তুতি করায় মানুষের সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে যায়। এভাবে স্তবন, অর্চন ও জপ এই তিনেরই ফল একই বলা হয়েছে। সম্পূর্ণ অর্থাৎ আধ্যাত্মিকাদি তিন প্রকারের দুঃখেরই নাশ হয় মানে সমস্ত দুঃখেরই অতীত হয়ে যায়। (৬)

পুনরপি তমেব স্তুত্যং বিশিনষ্টি- সেই স্তুতিকারী দেবতার বৈশিষ্ট্য পুনরায় বলছি-

৭. ব্রহ্মণ্যং সর্বধর্মজ্ঞং লোকানাং কীর্তিবর্ধনম্।

লোকনাথং মহদ্ভূতং সর্বভূতভবোদ্ভবম্।।

(ব্রহ্মণ্যম্, সর্বধর্মজ্ঞম্, লোকানাম্, কীর্তিবর্ধনম্।

লোকনাথম্, মহদ্ ভূতম্, সর্বভূতভবোদ্ভবম্।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ- ‘ব্রহ্মণ্যং’ ব্রহ্মণে স্রষ্টৃ ব্রাহ্মণায় তপসে শ্রুতয়ে হিতম্, সর্বান্ ধর্মান্ জানাতীতি ‘সর্বধর্মজ্ঞঃ তম্, লোকানাং’ প্রাণিনাং ‘কীর্তয়ঃ’ যশাংসি স্বশক্ত্যানুপ্রবেশেন ‘বর্ধয়তীতি তম্’ লোকৈর্নাথ্যতে লোকানুপতাপয়তে শাস্ত্রে লোকানামীষ্ট ইতি বা ‘লোকনাথঃ তম্ মহৎ’ ব্রহ্ম-বিশ্বোৎকর্ষেণ বর্তমানত্বাৎ- ‘মহদ্ভূতং’ পরমার্থসত্যম্ সর্বভূতানাং ভবঃ সংসারো যৎসকাশাদুদ্ভবতীতি ‘সর্বভূতভবোদ্ভবঃ তম্’।

অনুবাদঃ- যে ব্রহ্মণ্য অর্থাৎ জগতের রচনাকর ব্রহ্মার তথা ব্রাহ্মণ, তপ ও শ্রুতির হিতকারী, যিনি সকল ধর্মকে জানেন, সকল লোক অর্থাৎ প্রাণীবর্গে প্রবিষ্ট হয়ে তাদের যশকে যিনি বৃদ্ধি করেন, যিনি লোকনাথ অর্থাৎ লোকের প্রতিনিধি অথবা লোকদের অনুতপ্ত বা শাসন কর্তা অথবা লোকদের প্রতি রাজত্বকারী, যিনি নিজে সমস্ত উৎকর্ষ দ্বারা বর্তমান হওয়ার জন্য মহদ্ অর্থাৎ ব্রহ্ম তথা মহদ্ভূত অর্থাৎ পরমার্থত সত্য এবং যার সান্নিধ্যমাত্র সমস্ত ভূতের উৎপত্তি-স্থান সংসার উৎপন্ন হয় এইজন্য যিনি সমস্ত ভূতের উদ্ভবস্থান সেই পরমেশ্বরের স্তব করে মানুষ সমস্ত দুঃখ হতে মুক্তি পেয়ে যায়। (৭)

পঞ্চমং প্রশ্নং পরিহরতি-

৮. এষ মে সর্বধর্মাণাং ধর্মোহধিকতমে মতঃ।

যদ্ভক্ত্যা পুণ্ডরীকাক্ষং স্তবৈরর্চেন্নরঃ সদা।।

(এষঃ, মে, সর্বধর্মাণাম্, ধর্মঃ, অধিকতম্ঃ, মতঃ।

যৎ, ভক্ত্যা, পুণ্ডরীকাক্ষম্, স্তবৈঃ অর্চেৎ, নরঃ, সদা।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ ‘সর্বেষাং’ চোদনালক্ষণানাং ‘ধর্মাণামেষ’ বক্ষ্যমাণো ‘ধর্মোহধিকতম্’ ইতি মে মম ‘মতঃ’ অভিপ্রেতঃ, যদ্ভক্ত্যা তাৎপর্যেণ ‘পুণ্ডরীকাক্ষং’ হৃদয়পুণ্ডরীকে প্রকাশমানং বাসুদেবং স্তবৈর্গুণসঙ্কীর্তনলক্ষণৌঃ স্তুতিভিঃ ‘সদার্চেৎ’ সৎকারপূর্বকমর্চনং করোতি ‘নরঃ’ মনুষ্যঃ ইতি যৎ এষ ধর্ম ইতি সম্বন্ধঃ।

অস্য স্তুতিলক্ষণস্যার্চনস্যাধিক্যে কিং কারণম্ উচ্যতে- হিংসাদিপুরুষান্তরদ্রব্যান্তরদেশকালাদিনিয়মানপেক্ষত্বম্ আধিক্যে কারণম্।

“ধ্যায়ন্ কৃতে যজন্ যজ্ঞৈ-

ত্রেতায়াং দ্বাপরেহর্চয়ন্।

যদাপ্রোতি তদান্পোতি

কলৌ সঙ্কীর্ত্য কেশবম্।।”

ইতি বিষ্ণুপুরাণে (৬/২/১৩)

“জপ্যেনৈব তু সংসিদ্ধ্যেদ্

ব্রাহ্মণো নাত্র সংশয়ঃ।

কুর্যাদন্যন্ন বা কুর্যা-

ন্মৈত্রো ব্রাহ্মণ উচ্যতে।।”

ইতি মানবং বচনম্ (মনুঃ ২/৮৭)

“জপস্তু সর্বধর্মেভ্যঃ

পরমো ধর্ম উচ্যতে

অহিংসয়া চ ভূতানাং

জপযজ্ঞঃ প্রবর্ততে।।”

ইতি মহাভারতে। ‘যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোহস্মি’ (গীতা ১০/২৫) ইতি ভগবদ্বচনম্।

এতৎসর্বমভিপ্রেত্য ‘এষ মে সর্বধর্মাণাং ধর্মোহধিকতমো মতঃ।’ (বিষ্ণুসহস্রনাম ৫) ইত্যুক্তম্।।

অনুবাদঃ- সম্পূর্ণ বিধিরূপ ধর্মে আমি নিম্নে বর্ণিত এমন ধর্মকে সবচেয়ে বড় মনে করি কারণ মানুষ শ্রীপুণ্ডরীকাক্ষের অর্থাৎ নিজের হৃদয়কমলে বিরাজমান ভগবান বাসুদেবের ভক্তিপূর্বক – তৎপরতার সাথে গুণসঙ্কীর্তণরূপ স্তুতি দ্বারা সদা অর্চন করে অর্থাৎ মানুষের ন্যায় প্রীতীপূর্বক পূজা করে- এরূপ ধর্মই আমার সবচেয়ে অধিক মান্য।

এই স্তুতিরূপ অর্চনের অধিক মান্যতার কারণ কি? সেটাই বলছি-

হিংসাদি পাপ-কর্মের অভাব তথা অন্য পুরুষ এবং দ্রব্য, দেশ ও কালের নিয়মের অনাবশ্যকতাই এর অধিক মান্যতার কারণ। অর্থাৎ জপ যজ্ঞের জন্য স্থান, কাল ও পাত্রের বিশেষ কোন নিয়ম আবশ্যক নয়।

বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, “সত্যযুগে ধ্যান দ্বারা, ত্রেতাযুগে যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা, দ্বাপরে পূজা-পার্বণ দ্বারা মানুষ যা লাভ করেছে কলিযুগে ভগবান এর নামসঙ্কীর্তন করায় সেই একই ফল অতি সহজেই প্রাপ্ত হওয়া যায়।”

মনুর বচনে, “নিঃসন্দেহে ব্রাহ্মণ অন্য কর্ম করে কিংবা না করেও কেবল জপের দ্বারা পূর্ণ সিদ্ধি লাভ করতে পারে। এই ব্রাহ্মণকেই সকলের মিত্র বলা হয়ে থাকে।”

মহাভারতে বলা হয়েছে, “সমগ্র ধর্মের মধ্যে জপই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। কারণ জপ যজ্ঞ কোন প্রাণী হিংসা না করেই সম্পন্ন করা যায়।”

গীতায় ভগবান বলেছেন, “যজ্ঞের মধ্যে আমি জপ যজ্ঞ।”

এই সকল কথা বিবেচনা করেই ভীষ্মদেব বলেছিলেন যে সমস্ত ধর্মের মধ্যে এই জপ ধর্মই সবচেয়ে অধিক মান্য আমার। (৮)

দ্বিতীয় প্রশ্নং সমাধত্তে-

৯. পরমং যো মহত্তেজঃ পরমং যো মহত্তপঃ

পরমং যো মহদ্ ব্রহ্ম পরমং যঃ পরায়ণম্।।

(পরমম্, যঃ, মহদ্, তেজঃ, পরমম্, যঃ, মহৎ, তপঃ।

পরমম্, যঃ, মহৎ, ব্রহ্ম, পরমম্, যঃ, পরায়ণম্।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ ‘পরমং’ প্রকৃষ্টং ‘মহৎ’ বৃহৎ ‘তেজ’ চৈতন্যলক্ষণং সর্বাবভাসকং, “যেন সূর্যস্তপতি তেজসেদ্বঃ।” (তৈঃব্রাঃ ৩১২/৯৮) “তদেবা জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ” (বৃঃউপঃ ৪/৪/১৬) “ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকম্” (মুঃউপঃ ২/২/১০) ইত্যাদি শ্রুতেঃ “যদাদিত্যগতং তেজঃ” (গীতা ১৫/১২) ইত্যাদি স্মৃতেশ্চ।

‘পরমং তপঃ’ তপত আজ্ঞাপয়তীতি তপঃ, “য ইমং চ লোকং পরমং চ লোকং সর্বাণি চ ভূতানি যোহন্তরো যময়তি” (বৃঃউপঃ ৩/৮/১) ইত্যন্তর্যামীব্রাহ্মণে সর্বনিয়ন্তৃত্বং শ্রুয়তে।

“ভীষাস্মাদ্বাতঃ পবতে ভীষোদেতি সূর্যঃ। ভীষাস্মাদগ্নিশ্চেন্দ্রশ্চ মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ” (তৈঃউপঃ ২/৭/১) ইত্যাদি তৈত্তিরীয়কে।

তপতিষ্ট ইতি বা তপঃ তস্যৈশ্বর্যমনবচ্ছিন্নমিতি মহত্ত্বম্, “এব সর্বেশ্বরঃ” (মাঃউপঃ ৬) ইত্যাদি শ্রুতে।

‘পরমং’ সত্যাদিলক্ষণং ‘ব্রহ্ম’ মহনীয়তয়া মহৎ। ‘পরমং’ প্রকৃষ্টং পুনরাবৃত্তিশঙ্কারহিতম্। ‘পরায়ণং’ পরম্ অয়নংপরায়ণম্।

পরমগ্রহণাৎসর্বত্র অপরং তেজঃ আদিত্যাদিকং ব্যাবর্ত্যতে। সর্বত্র যো দেব ইতি বিশেষ্যতে চ-

যো দেবঃ পরমং তেজঃ পরমং তপঃ পরমং ব্রহ্ম পরমং পরায়ণং, স একং সর্বভূতানাং পরায়ণমিতি বাক্যার্থঃ

দ্বিতীয় প্রশ্নের সমাধান করা হচ্ছে-

অনুবাদঃ- যিনি সকলের প্রকাশক, পরম অর্থাৎ উত্তম এবং মহান্ চিন্ময় প্রকাশ, যার বিষয়ে “যে তেজ দ্বারা প্রকাশিত হয়ে সূর্য তাপ দেয়, তাকে দেবগণ জ্যোতিরও জ্যোতি বলে থাকে। সেখানে না সূর্যের প্রকাশ পৌছায় এবং না চন্দ্রমা ও তারকার প্রকাশ পৌছায়। ইত্যাদি শ্রুতিতে তথা সূর্যের অন্তর্গত যে তেজ আছে ইত্যাদি স্মৃতি দ্বারাও এটাই প্রমাণিত হয়।

যিনি পরম তাপ অর্থাৎ তাপ প্রদানকারী তথা তাপ প্রদানের জন্য আদেশকারী, যেমন- ‘যিনি এই লোককে, পরলোককে তথা সমস্ত প্রাণীকে তার ভিতরে অবস্থিত হয়ে শাষণ করছে, এই শ্রুতি দ্বারা অন্তর্যামী ব্রাহ্মণে তার সকল কিছুর নিয়ামক বলা হয়ে থাকে।

তৈত্তিরীয় শ্রুতিতেও বলা হয়েছে, “তার ভয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়, তার ভয়ে সূর্য উদিত হয়, তথা তার ভয়ে অগ্নি, ইন্দ্র এবং পঞ্চম মৃত্যু ঘটে থাকে।

তাপ প্রদান করে অথবা শাসন করে বলে তিনি তপ। তার ঐশ্বর্য অপরিমিত যার জন্য তিনি মহান। শ্রুতিও বলেছে যে তিনি সর্বেশ্বর।

যিনি সত্যাদি লক্ষণযুক্ত পরব্রহ্ম তথা মহত্তাযুক্ত হওয়ার জন্য মহান এবং যিনি পুনরাবৃত্তির শঙ্কা হতে রহিত পরম- শ্রেষ্ঠ পরায়ণ। পরম আশ্রয়ের নাম পরায়ণ।

এখানে সর্বত্র পরম শব্দের গ্রহণ করায় সূর্যাদি এবং অন্য তেজের ভিন্নার্থ করা হল। ‘যে দেব’ এই পদের বিশেষতা ব্যাক্ত হয়েছে যেভাবে-

” যে দেব পরম তেজ, পরম তপ, পরম ব্রহ্ম ও পরম পরায়ণ তিনিই সমস্ত প্রাণীর পরম গতি” ইহাই এই বাক্যের অর্থ। (৯)

ইদানীং প্রথমপ্রশ্নস্যোত্তরমাহ-

১০. পবিত্রাণাং পবিত্রং যো মঙ্গলানাং চ মঙ্গলম্।

দৈবতং দেবতানাং চ ভূতানাং যোহব্যয়ঃ পিতা।।

(পবিত্রাণাম্, পবিত্রম্, যঃ, মঙ্গলানাম্, চ, মঙ্গলম্।

দৈবতম্, দেবতানাম্, চ, ভূতানাম্, যঃ, অব্যয়ঃ, পিতা।।)

শাঙ্করভাষ্যম্ঃ ‘পবিত্রাণাং পবিত্রং’ পাবনানাং তীর্থাদীনাং পবিত্রম্। পরমস্তু পুমান্ ধ্যাতো দৃষ্টঃ কীর্তিতঃ স্তুতঃ সম্পুজিতঃ স্মৃতঃ প্রণতঃ পাপ্মনঃ সর্বানুন্মূলয়তীতি পরমং পবিত্রম্। সংসারবন্ধহেতুভূতং পুণ্যাপুণ্যাত্মকং কর্ম তৎকারণং চাজ্ঞানং সর্ব নাশয়তি স্বয়াথাত্ম্যজ্ঞানেনেতি বা পবিত্রাণাং পবিত্রম্।

“ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থি-

শ্চিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ।

ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি

তস্মিন্ দৃষ্ট পরাবরে।।” (মুণ্ডকঃ উপঃ ২/২/৭)

“একোহপি কৃষ্ণাস্য কৃতঃ প্রণামো

দশাশ্বমেধাবভৃতেন তুল্যঃ

দশাশ্বমেধী পুনরেতি জন্ম

কৃষ্ণাপ্রণামী ন পুনর্ভবায়।।” (মহাভারতঃ শান্তিঃ ৪৭/৯১)

‘মঙ্গলানাং চ মঙ্গলং’ মঙ্গলং সুখং তৎসাধনং তজ্জ্ঞাপকং চ, তেষামপি পরমানন্দলক্ষণং পরং মঙ্গলমিতি মঙ্গলানাং চ মঙ্গলম্। ‘দৈবতং দেবতানাং চ’ দেবানাং দেবঃ, দ্যোতনাদিভিঃ সমুৎকর্ষেণ বর্তমানত্বাৎ। ‘ভূতানাং যঃ অব্যয়’ ব্যয়রহিতঃ ‘পিতা’ জনকো যো দেবঃ, স একং দৈবতং লোক ইতি বাক্যার্থঃ।

“একো দেবঃ সর্বভূতেষু গুঢ়ঃ

সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা।

কর্মাধ্যক্ষঃ সর্বভূতাধিবাসঃ

সাক্ষী চেতাঃ কেবলো নির্গুণশ্চ।।” (শ্বেতাশ্বতর উপঃ ৬/১১)

“একমেবাদ্বিতীয়ম্” (ছান্দোগ্য উপঃ ৬/২/১)

“অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ

অহমাদিশ্চ মধ্যং চ ভূতানামন্ত এব চ।। (গীতা ১০/২০)

ইতি অদ্বৈতাত্মজ্ঞানং সম্যগ্দর্শনমিত্যুক্তং ভগবতাপি। তস্মাদাত্মন্যেবেশ্বরে মনো দধীত।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হচ্ছে –

অনুবাদঃ- যিনি পবিত্র হতেও পবিত্রতম অর্থাৎ পবিত্রকারী তীর্থাদিও পবিত্র করেন। সেই পরমপুরুষ পরমাত্মা যার ধ্যান, দর্শন, কীর্তন, স্তুতি, পূজা, স্মরণ তথা প্রণাম করায় সমস্ত পাপ থেকে বিমুক্ত করেন এজন্যই তিনি পরম পবিত্র। অথবা এমনটা বুঝতে হবে যে সংসারবন্ধন হেতু পাপ-পূণ্যরূপ কর্ম, পরমাত্মা নিজ স্বরূপের যথার্থ জ্ঞান দ্বারা কর্মকে কারণরূপ সেই সম্পূর্ণ অজ্ঞানকে নষ্ট করে দেয়। এজন্য তিনি পবিত্রতম হতেও পবিত্র।

মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে সেই পরাবর পরমাত্মার দর্শন হলে জীবগণের অবিদ্যারূপ হৃদয়গ্রন্থি ভঙ্গ হয়ে যায়। তার সম্পূর্ণ সংশয় নাশ হয়ে যায় এবং কর্ম ক্ষীণ হয়ে যায়।

মহাভারত শান্তিপর্বে বলা হয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে একবার প্রণাম করা দশ অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান। অর্থাৎ দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞে যে পবিত্রতা অর্জিত হয় তা একবার শ্রীকৃষ্ণকে প্রণামে অর্জন করা যায়। সেই দশ অশ্বমেধ যজ্ঞকারীদেরও পুণর্জন্ম হয় কিন্তু কৃষ্ণকে প্রণাম করলে তাদের আর পুনর্জন্ম হয় না।

মঙ্গল বলতে সুখকে বুঝায়; যিনি তার সাধক এবং জ্ঞাপক তার পরমানন্দরূপ পরম মঙ্গল হওয়ায় তিনি (বিষ্ণু) মঙ্গলেরও মঙ্গল। তিনি দেবতাদেরও দেবতা কারণ তিনি প্রকাশাদির মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। প্রাণীদের যে অব্যয় অবিনাশী পিতা অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা। সেই আদি দেবই ভুবনের একমাত্র দেবতা। এরূপই বাক্যার্থ।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে সেই এক দেবতাই সমস্ত প্রাণীতে লুকায়িত রয়েছে। সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন। সমস্ত জীবের অন্তরাত্মা, সমস্ত কর্মের বিভাগকর্তা, সমস্ত ভূতের অধিষ্ঠাতা, সকলের সাক্ষী, সকলের চৈতন্য দাতা, এবং কেবল নির্গুণ ব্রহ্ম।

ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে তিনিই এক ও অদ্বিতীয়।

গীতায় বলা হয়েছে আমিই সর্বভূতে অবস্থিত আত্মা। তথা সমস্ত জীবের আদি, মধ্য ও অন্ত আমিই।

এভাবেই শ্রীভগবান অদ্বৈত – আত্মদর্শনকেই সম্যক দর্শন বলেছেন। সেই এক ঈশ্বরেই মনকে স্থির রাখতে বলা হয়েছে।


No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...