Tuesday, 28 September 2021

শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা যাঁহাকে কেহ শ্রবণ করিতে পারে না, পক্ষান্তরে যাঁহার নিমিত্ত শ্রবণেন্দ্রিয় সক্রিয় হয় তিনিই ব্রহ্মঃ-

 


সামবেদীয় কেন উপনিষদের প্রথম খণ্ডে- বর্ণিত আছে-

যচ্ছ্রোত্রেণ ন শৃণোতি যেন শ্রোত্রমিদং শ্রুতম্। তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি ....৭

ভগবান শঙ্করাচার্য ভাষ্যে বলিতেছেন- "মনের বৃত্তিদ্বারা সংযুক্ত ও দিগ্দেবতাপরিচালিত আকাশের কার্য শ্রোত্রেন্দ্রিয় দ্বারা লোকে যাঁহাকে (যে ব্রহ্মকে) শুনিতে পায় না অর্থাৎ বিষয়ীভূত বা প্রকাশ করিতে পারে না, পরন্তু যাঁহার দ্বারা অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ আত্মজ্যোতির দ্বারাই এই লোক প্রসিদ্ধ শ্রোত্রেন্দ্রিয় শ্রুত অর্থাৎ প্রকাশিত হয়। তাহাকেই তুমি ব্রহ্ম বলিয়া জানিবে।"

প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের এক একজন অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আছেন। শ্রোত্রেন্দ্রিয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হইতেছেন দিগ্দেবতা। ইন্দ্রিয়াধিষ্ঠাত্রী এই সকল দেবতাকর্তৃক পরিচালিত হইয়া ইন্দ্রিয়সকল কার্য করে। তবে এই শ্রোত্রেন্দ্রিয়ের শব্দ গ্রহণের ক্ষমতা কিন্তু আত্মচৈতন্যের সন্নিধিবশতঃই হইয়া থাকে। কিন্তু শ্রোত্রেন্দ্রিয় ব্রহ্মকে গ্রহণ করিতে পারেনা।

Saturday, 25 September 2021

তেজোপাধিক (-তেজোভাবাপন্ন) ব্রহ্ম হইতে জলোৎপত্তিঃ-

 


অদ্বৈতবেদান্তে সৃষ্টিক্রম বিষয়ক ধারাবাহিক আলোচনায় আজকের বিচার্য বিষয় জলোৎপত্তি। পূর্বাধিকরণে তেজের বায়ু হইতে উৎপত্তি কথিত হইয়াছে। এক্ষণে বেদান্তমীমাংসা শাাস্ত্রের অবধিকরণম্ এ ভগবান্ সূত্রকার বাদরায়ণ বলিতেছেন-

আপঃ ৷৷ ব্রহ্মসূত্র ২.৩.১১৷৷

ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য্য ভাষ্য করিতেছেন-জল তেজঃ হইতে উৎপন্ন হয়। কিন্তু বহ্নি ও জলের বিরোধ থাকায় কোন হেতুবলে বলিতেছ? উত্তর-যেহেতু

'তদপোসৃজত'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।২।৩)

"তিনি (-সেই তেজোপাধিক সৎ) জলকে সৃষ্টি করিলেন"

'অগ্নেঃ আপঃ'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।১)

"অগ্নি হইতে জল উৎপন্ন হইল", ইত্যাদি শ্রুতি সেইপ্রকার বলিতেছেন। এইরূপ বচন থাকায় সংশয় হয় না; তেজের সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করিয়া পৃথিবীর ব্যাখ্যা করিতে প্রবৃত্ত ভগবান্ সূত্রকার জলকে মধ্যবর্ত্তী (-তেজঃ ও ক্ষিতির উৎপত্তির মধ্যে জলোৎপত্তিকে নিবিষ্ট) করিতেছি এইপ্রকার 'চিন্তা করিয়া' "আপঃ", এইসূত্রটী রচনা করিয়াছেন।......

 

Friday, 3 September 2021

বায়ুভাবাপন্ন ব্রহ্ম হইতে তেজোৎপত্তিঃ-

 


অদ্বৈতবেদান্তে সৃষ্টিক্রম বিষয়ক আলোচনায় তেজোৎপত্তি বিষয়ক বাক্যসকল আজকের বিচার্য্য বিষয়। ছান্দোগ্যে (৬.২.৩) সৎস্বরূপ ব্রহ্ম হইতে তেজের উৎপত্তি শ্রাবিত হইয়াছে, তৈত্তিরীয়কে (২.১) কিন্তু বায়ু হইতে তেজের উৎপত্তি শ্রাবিত হইয়াছে। এইস্থলে একবাক্যতার সম্ভাবনা বা অসম্ভাবনাবশতঃ সংশয় হয়-বহ্নি ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন হয়, অথবা ব্রহ্মসংযুক্ত বায়ু হইতে?

ভগবান্ সূত্রকার বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত করিতেছেন-

তেজোতস্তথাহ্যাহ ৷৷ ব্রহ্মসূত্র ২.৩.১০৷৷

ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য্য ভাষ্য করিতেছেন-এইপ্রকার শঙ্কা প্রাপ্ত হইলে কথিত হইতেছে-তেজঃ ইহা হইতে, অর্থাৎ বায়ু হইতে উৎপন্ন হয়। তাহাতে প্রমাণ কি? যেহেতু শ্রুতি সেইপ্রকারই বলেন, যথা-

'বায়োরগ্নিঃ'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।১)

'বায়ু হইতে অগ্নি উৎপন্ন হইল', ইত্যাদি।

তেজঃ অব্যবহিত ব্রহ্মজ (-সাক্ষাৎভাবে ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন) হইলে, বায়ু হইতে উৎপন্ন না হইলে এই শ্রুতি কদর্থিতা হইয়া পড়িবে। ....

এখন যদি বলা হয়, অন্য শ্রুতিও তেজের ব্রহ্ম হইতে উৎপত্তি বোধ করাইতেছে, যথা-

'তত্তেজোসৃজত'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬.২.৩)

'তিনি তেজকে সৃষ্টি করিলেন।'

তাহা হইলে তো শ্রুতি বিরোধ হইয়া পড়িবে। তদুত্তরে সিদ্ধান্তী বলিতেছেন-না তাহা হয় না, যেহেতু পারম্পর্য্য (-পরম্পরাভাবে ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন) হইলেও এইশ্রুতির বিরোধ হয় না। যেহেতু যখন 'আকাশ ও বায়ু সৃষ্টি করিয়া বায়ুভাবাপন্ন (-বায়ুরূপ উপাধিযুক্ত) ব্রহ্ম তেজকে সৃষ্টি করিলেন', এইপ্রকার কল্পনা করা হয়, তখনও তেজের ব্রহ্ম হইতে উৎপত্তি বিরোধগ্রস্ত হয় না। যেমন উষ্ণ দুগ্ধ গাভীর সাক্ষাৎ কার্য্য, দধি তাহার পরম্পরাপ্রাপ্ত কার্য্য, ছানা তাহার আরও ব্যবহিত কার্য্য, ইত্যাদি সকল স্থলে গাভীকেই কারণরূপে অঙ্গীকার করা হয়। আর ব্রহ্ম আকাশাদি কার্য্যরূপেও অবস্থান করেন, ইহা-

'তদাত্মানম্ স্বয়ম্ অকুরুত'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।৭)

'তিনি নিজেই নিজেকে নাম ও রূপের দ্বারা অভিব্যক্ত করিয়াছিলেন' ইত্যাদি শ্রুতি প্রদর্শন করিতেছেন।

আর সেইপ্রকার ঈশ্বরস্মরণও (ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের উক্তিরূপা স্মৃতিও) আছে, যথা-

বুদ্ধির্জ্ঞানমসংমোহঃ ক্ষমা সত্যং দমঃ শমঃ ৷

সুখং দুঃখং ভবোভাবো ভযং চাভযমেব চ ৷৷

অহিংসা সমতা তুষ্টিস্তপো দানং যশোযশঃ৷

ভবন্তি ভাবা ভূতানাং মত্ত এব পৃথগ্বিধাঃ৷৷-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, বিভূতিযোগ-৪,৫)

'অন্তঃকরণের সুক্ষ্মবিষয়ে বোধসামর্থ, আত্মাদি পদার্থের জ্ঞান, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, ক্ষমা, সত্য, বাহ্যেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়ের সংযম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, সমচিত্ততা, সন্তোষ, তপস্যা, দান, ধর্মনিমিত্ত কীর্তি ও অধর্মর্নিমিত্ত অকীর্তি - এইসকল ভিন্ন ভিন্ন ভাব প্রাণীগণের স্ব স্ব কর্মানুসারে আমা হইতেই উৎপন্ন হয়।'

যদিও বুদ্ধি প্রভৃতিকে স্ব স্ব কারণ হইতে উৎপন্ন হইতে প্রত্যক্ষভাবে দেখা যাইতেছে, তাহা হইলেও সকল ভাব পদার্থ সাক্ষাৎ, অথবা পরম্পরাভাবে ঈশ্বরের বংশে জাত হওয়ায় 'আমা হইতে উৎপন্ন' এইপ্রকার উক্তি কখনও অসঙ্গত নহে।

এইভাবে ব্রহ্ম হইতে সাক্ষাৎ অথবা পরম্পরাভাবে উৎপত্তি অঙ্গীকারের দ্বারা যেসকল শ্রুতিতে সৃষ্টির ক্রম বর্ণিত হয় নাই, তাহারা ব্যাখ্যাত হইলে তাহাদের সকলপ্রকার যুক্তিযুক্ততা সিদ্ধ হয়। কিন্তু যেসকল শ্রুতিতে ক্রমবিশিষ্ট সৃষ্টি বর্ণিত হইয়াছে, তাহাদের অন্যপ্রকারে (-পারম্পর্য্য অঙ্গীকার না করিয়া) উপপত্তি হয় না বলিয়া 'উক্তপ্রকারে ব্যাখ্যা করা যায় না'। 'একবিজ্ঞানে সর্ববিজ্ঞান' বিষয়ক প্রতিজ্ঞাও সৎস্বরূপ ব্রহ্মের বংশে উৎপত্তিমাত্রকে অপেক্ষা করে, কিন্তু ব্রহ্ম হইতে অব্যবহিতভাবে উৎপত্তিকে অপেক্ষা করে না, অতএব শ্রুতিবাক্যসকলের মধ্যে বিরোধ নাই।....

 

Thursday, 2 September 2021

স্বরূপানুসন্ধানাষ্টকম্ বিজ্ঞাননৌকা

 


তপোয়জ্ঞদানাদিভিঃ শুদ্ধবুদ্ধি-

র্বিরক্তো নৃপাদৌ পদে তুচ্ছবুদ্ধ্যা ।

পরিত্যজ্য সর্বং যদাপ্নোতি তত্ত্বং

পরং ব্রহ্ম নিত্যং তদেবাহমস্মি ||১||

ভাবার্থ - তপ ও যজ্ঞদানাদি দ্বারা শুদ্ধবুদ্ধি ও রাজপদ ইত্যাদিকে তুচ্ছ বিবেচনা করে আসক্তিহীন হয়ে সমস্ত পরিত্যাগ পূর্বক যে স্বরূপ তত্ত্বপদ প্রাপ্ত হওয়া যায়, সেই তত্ত্বপদস্বরূপ নিত্য পরব্রহ্মদেব আমি ||১||

দয়ালুং গুরুং ব্রহ্মনিষ্ঠং প্রশান্তং

সমারাধ্য তক্ত্যা বিচার্য স্বরূপম্ ।

যদাপ্নোতি তত্ত্বং নিদিধ্যাস বিদ্বান্-

পরং ব্রহ্ম নিত্যং তদেবাহমস্মি ||২||

ভাবার্থ - ভক্তিপূর্বক দয়ালু প্রশান্ত ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরুর আরাধনা, স্বরূপ বিচার এবং নিদিধ্যাসন (ধ্যানের) দ্বারা বিদ্বান ব্যক্তি যে স্বরূপ তত্ত্বপদ প্রাপ্ত হন, সেই তত্ত্বপদস্বরূপ নিত্য পরব্রহ্ম দেব আমি ||২||

যদানন্দরূপং প্রকাশস্বরূপং

নিরস্তপ্রপঞ্চং পরিচ্ছেদহীনম্ ।

অহংব্রহ্মবৃত্ত্যৈকগম্যং তুরীয়ং

পরং ব্রহ্ম নিত্যং তদেবাহমস্মি ||৩||

ভাবার্থ - যিনি আনন্দস্বরূপ স্বপ্রকাশ, যার অংশ কল্পনা করা যায় না, যাকে জগৎপ্রপঞ্চ স্পর্শ করতে পারে না, জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্ত্যাদি তিন অবস্থার অতীত এবং 'আমি ব্রহ্ম' এই একমাত্র তত্ত্ববৃত্তি দ্বারা যাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, সেই নিত্য পরব্রহ্ম দেব আমি ||৩||

যদজ্ঞানতো ভাতি বিশ্বং সমস্তং

বিনষ্টং স চাপি যদাত্মপ্রবোধে ।

মনোবাগতীতং বিশুদ্ধং বিমুক্তং

পরং ব্রহ্ম নিত্যং তদেবাহমস্মি ||৪||

ভাবার্থ - যে আত্মজ্ঞান অভাবে সমস্ত জগতের অস্তিত্ব প্রতীয়মান হয় এবং যে আত্মজ্ঞান উৎপন্ন হলে জগতের অস্তিত্ব উপলব্ধি হয় না, সেই আত্মজ্ঞান স্বরূপ শুদ্ধ, মুক্ত, মন ও বাক্যের অতীত নিত্য পরব্রহ্ম দেব আমি ||৪||

নিষেধে কৃতে নেতি নেতীতি বাক্যে

সমাধিস্থিতানাং যদাভাতি পূর্ণম্ ।

অবস্থাত্রয়াতীতমদ্বৈতমেকং

পরং ব্রহ্ম নিত্যং তদেবাহমস্মি ||৫||

ভাবার্থ - 'এ ব্রহ্ম নয়, এ ব্রহ্ম নয়,' এইরূপ উপনিষদুক্ত নিষেধ নির্ধারণ দ্বারা ব্রহ্মপদার্থ নির্ধারণকারী সমাধিমগ্ন ঋষিদের প্রজ্ঞায় যিনি পূর্ণরূপে প্রতীয়মান হয়, যিনি এক, অদ্বিতীয় এবং জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি এই তিন অবস্থার অতীত, সেই নিত্য পরব্রহ্ম দেব আমি ||৫||

যদানন্দলেশৈঃ সদানন্দি বিশ্বং

যদাভাতি সত্ত্বে তদাভাতি সর্বম্ ।

যদালোচনে হেমমন্যৎ সমস্তং

পরং ব্রহ্ম নিত্যং তদেবাহমস্মি ||৬||

ভাবার্থ - যার আনন্দ কণামাত্রে সমস্ত বিশ্ব আনন্দময়, যিনি আত্মায় প্রকাশিত, যার সত্তায় সমস্ত প্রকাশ এবং যে স্থানে সমস্তই হেমময় উজ্জ্বল জ্যোতিঃ স্বরূপ, সেই নিত্য পরমব্রহ্ম দেব আমি ||৬||

অনন্তং বিভুং নির্বিকল্পং নিরীহং

শিবং সঙ্গহীনং যদোঙ্কারগম্যম্ ।

নিরাকারমত্যুজ্জ্বলং মৃত্যুহীনং

পরং ব্রহ্ম নিত্যং তদেবাহমস্মি ||৭||

ভাবার্থ - যিনি অনন্ত, বিভু এবং সর্বযোনি অথচ সর্বচেষ্টা রহিত শিব, নিঃসঙ্গ আর যিনি ওঙ্কার ( প্রণবের ) গম্য, নিরাকার, অতিশয় উজ্জ্বল ও মৃত্যুহীন, সেই পরব্রহ্ম দেব আমি ||৭||

যদানন্দ সিন্ধৌ নিমগ্নঃ পুমান্

স্যাদ্বিদ্যাবিলাসঃ সমস্তপ্রপঞ্চঃ ।

তদা নঃ স্ফুরত্যদ্ভুতং যন্নিমিত্তং

পরং ব্রহ্ম নিত্যং তদেবাহমস্মি ||৮||

ভাবার্থ - যে আনন্দসাগরে সিদ্ধপুরুষগণ নিমগ্ন হলেন যার প্রভায় এই অদ্ভুত অবিদ্যাবিলাস প্রপঞ্চ প্রকাশ প্রাপ্ত হয় না, সেই পরব্রহ্ম দেব আমি ||৮||

স্বরূপানুসন্ধানরূপাং স্তুতিং যঃ

পঠেদাদরাদ্ভক্তিভাবো মনুষ্যঃ ।

শৃণোতি বা নিত্যং মদ্যক্তচিত্তো

ভবেদ্বিষ্ণুরত্রৈব বেদপ্রমাণাৎ ||৯||

ভাবার্থ - স্বরূপ অনুসন্ধানে যিনি তুরীয় অর্থাৎ চতুর্থাবস্থা প্রাপ্ত, আর যে মনুষ্য সাদরে ও ভক্তিপূর্বক এ পাঠ করেন এবং নিত্য বিষ্ণুরত চিত্তে শ্রবণ করে, তিনিও বিষ্ণুস্বরূপ হন, এ বেদের প্রমাণ ||৯||

|| ইতি শ্রীমৎপরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যস্য শ্রীগোবিন্দ ভগবৎ পূজ্যপাদ শিষ্যস্য শ্রীমচ্ছঙ্কর ভগবতঃ কৃতৌ স্বরূপানুসন্ধানাষ্টকং বিজ্ঞাননৌকা  সম্পূর্ণম্ ||

ইতি শ্রীমৎপরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্য শ্রীগোবিন্দ ভগবৎ পূজ্যপাদ শিষ্য শ্রীমদ শঙ্করাচার্য বিরচিত স্বরূপানুসন্ধানাষ্টকং বিজ্ঞাননৌকা সমাপ্ত।

 

শ্রীকৃষ্ণাষ্টকং শ্রীকৃষ্ণতাণ্ডবস্তোত্রং

 


নিত্যানন্দৈকরসং সচ্চিন্মাত্রং স্বয়ঞ্জ্যোতিঃ ।

পুরুষোত্তমমজমীশং বন্দে শ্রীযাদবাধীশম্ ॥

নিত্যানন্দ, একরস, সৎচিৎ মাত্র, স্বয়ংজ্যোতি, পুরুষোত্তম, অজাত ঈশ্বর, যাদবাধীশকে বন্দনা করি।

যত্র গায়ন্তি মদ্ভক্তাঃ তত্র তিষ্ঠামি নারদ ।

শ্রীকৃষ্ণাষ্টকম্

ভজে ব্রজৈকমণ্ডনং সমস্তপাপখণ্ডনং

স্বভক্তচিত্তরঞ্জনং সদৈব নন্দনন্দনম্ ।

সুপিচ্ছগুচ্ছমস্তকং সুনাদবেণুহস্তকং

অনঙ্গরঙ্গসাগরং নমামি কৃষ্ণনাগরম্ ||১||

ভাবার্থ - ব্ৰজমণ্ডলের একমাত্র অলঙ্কারস্বরূপ, সমস্ত পাপখণ্ডনকারী, নিজভক্তগণের চিত্তরঞ্জনকারী, নন্দনন্দনকে সর্বদা ভজনা করি; সুন্দর ময়ূরপুচ্ছশােভিত মস্তকবিশিষ্ট, সুস্বর বেণুযুক্তহস্তবিশিষ্ট, অনঙ্গরঙ্গের সাগরস্বরূপ, নাগর শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করি ||১||

মনোজগর্বমোচনং বিশাললোললোচনং

বিধূতগোপশোচনং নমামি পদ্মলোচনম্ ।

করারবিন্দভূধরং স্মিতাবলোকসুন্দরং

মহেন্দ্রমানদারণং নমামি কৃষ্ণাবারণম্ ||২||

ভাবার্থ - কামগৰ্বহারী, বিশাল চঞ্চল লােচনশালী, কম্পিত ( ভীত ) গােপগণ কর্তৃক শােচিত ( যার গােবর্ধন ধারণ কালে মােহগ্রস্ত গােপগণ বালকবুদ্ধিতে যার জন্য শােক করেছিলেন ) সেই পদ্মলােচনকে প্রণাম করি। যার করপদ্মে ভূধর ( পৰ্ব্বত ), যার ঈষৎ হাস্যযুক্ত দৃষ্টি অতি মনােজ্ঞ, যিনি ইন্দ্রের মানহরণ করেন, সেই কৃষ্ণরূপ বারণ বা হস্তীকে প্রণাম ||২||

কদম্বসূনকুণ্ডলং সুচারুগণ্ডমণ্ডলং

ব্রজাঙ্গনৈকবল্লভং নমামি কৃষ্ণদুর্লভম্ ।

যশোদয়া সমোদয়া সগোপয়া সনন্দয়া

যুতং সুখৈকদায়কং নমামি গোপনায়কম্ ||৩||

ভাবার্থ - যার কদম্বপুষ্পবৎ কুণ্ডল, যার গণ্ডদেশ অতি মনােহর, যিনি ব্রজাঙ্গনাগণের একমাত্র বল্লভ ( প্রিয় ) সেই দুর্লভ কৃষ্ণকে প্রণাম করি; নন্দ ও গােপীগণসহ বর্তমান আনন্দিতা যশােদার সহিত যুক্ত, একমাত্র সুখদাতা, গােপগণের নায়ককে প্রণাম করি ||৩||

সদৈব পাদপঙ্কজং মদীয় মানসে নিজং

দধানমুক্তমালকং নমামি নন্দবালকম্ ।

সমস্তদোষশোষণং সমস্তলোকপোষণং

সমস্তগোপমানসং নমামি নন্দলালসম্ ||৪||

ভাবার্থ - আমার চিত্তে নিজ পাদপদ্ম সর্বদা স্থাপনকারী, উত্তম অলক বিশিষ্ট ( অলক শব্দে চূর্ণ কুন্তল বুঝায় ) নন্দের বালককে ( পুত্রকে ) প্রণাম করি। যিনি সমস্ত দোষের শোষণকারী, সমস্ত লােকের পােষণকারী, সমস্ত গােপের অভিলাষের বিষয়, ( কাম্য ) লালসারূপী কৃষ্ণকে প্রণাম করি ||৪||

ভুবো ভরাবতারকং ভবাব্ধিকর্ণধারকং

যশোমতীকিশোরকং নমামি চিত্তচোরকম্ ।

দৃগন্তকান্তভঙ্গিনং সদা সদালিসঙ্গিনং

দিনে দিনে নবং নবং নমামি নন্দসম্ভবম্ ||৫||

ভাবার্থ - পৃথিবীর ভার অবতারক ( লাঘবকারী ), সংসারসমুদ্রে কর্ণধারস্বরূপ, যশােমতীর কিশাের দুগ্ধচোরকে প্রণাম করি; চক্ষুঃপ্রান্তের কমনীয় ভঙ্গীবিশিষ্ট, সর্বদা মদে অলস অঙ্গবিশিষ্ট, প্রতিদিনই নতুন নতুন ( শােভাবিশিষ্ট ) নন্দের পুত্রকে প্রণাম করি ||৫||

গুণাকরং সুখাকরং কৃপাকরং কৃপাবরং

সুরদ্বিষন্নিকন্দনং নমামি গোপনন্দনম্ ।

নবীনগোপনাগরং নবীনকেলিলম্পটং

নমামি মেঘসুন্দরং তড়িৎপ্রভালসৎপটম্ ||৬||

ভাবার্থ - গুণের আকর, সুখের আকর, কৃপা দ্বারা শ্রেষ্ঠ, ( কৃপালুগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ) নবীন গােপরূপ নাগর, নূতন নূতন কেলি বা ক্রীড়ায় আসক্ত, বিদ্যুৎ-প্রভা সদৃশ ছটাসম্পন্ন বস্ত্রধারী, মেঘবৎ সুন্দরকে ( কৃষ্ণকে‌ ) প্রণাম করি ||৬||

সমস্তগোপনন্দনং হৃদম্বুজৈকমোদনং

নমামি কুঞ্জমধ্যগং প্রসন্নভানুশোভনম্ ।

নিকামকামদায়কং দৃগন্তচারুসায়কং

রসালবেণুগায়কং নমামি কুঞ্জনায়কম্ ||৭||

ভাবার্থ - সমস্ত গােপগণের আনন্দদায়ক, হৃদয়স্বরূপ পদ্মের একমাত্র মােহ সম্পাদনকারী, উজ্জ্বল সূর্য্যবৎ শােভাসম্পন্ন, কুঞ্জমধ্যস্থিতকে নমস্কার করি। অতিশয় কামনা বা অভিলাষপুরণ-কারী, চক্ষুঃপ্রান্তরূপ ( অপাঙ্গরূপ ) মনােজ্ঞ বাণযুক্ত, মনােহর রসযুক্ত বেণুদ্বারা গানকারী, কুঞ্জনায়ককে প্রণাম করি ||৭||

বিদগ্ধগোপিকামনোমনোজ্ঞতল্পশায়িনং

নমামি কুঞ্জকাননে প্রবৃদ্ধবহ্নিপায়িনম্ ।

কিশোরকান্তিরঞ্জিতং দৃগঞ্জনং সুশোভিতং

গজেন্দ্রমোক্ষকারিণং নমামি শ্রীবিহারিণম্ ||৮||

ভাবার্থ - রসিক গােপীগণের মনােরূপ মনোহর শয্যাশায়ী, কুঞ্জকাননে অবস্থিত হয়ে প্রবৃদ্ধকামরূপবহ্নি পানকারীকে প্রণাম করি, যার চোখ ছেলেবেলার আকর্ষণ দ্বারা আকর্ষণীয় করা হয়েছে এবং চক্ষুঃপ্রান্তের কালো অধম (অঞ্জন), যিনি গজেন্দ্র হাতিটিকে মুক্ত করেছিলেন অর্থাৎ মোক্ষপ্রদানকারিনী ( কুমিরের চোয়াল থেকে ), এবং সেই লক্ষ্মীর সঙ্গী (শ্রী) কে প্রণাম করি ||৮||

যদা তদা যথা তথা তথৈব কৃষ্ণসৎকথা

ময়া সদৈব গীয়তাং তথা কৃপা বিধীয়তাম্ ।

প্রমাণিকাষ্টকদ্বয়ং জপত্যধীত্য যঃ পুমান

ভবেৎস নন্দনন্দনে ভবে ভবে সুভক্তিমান ||৯||

ভাবার্থ - যেখানে সেখানে যেরূপে সেরূপেই কৃষ্ণ-সতকথা সর্ব্বদা মৎ কর্তৃক গীত হইতে পারে সেইরূপ কৃপা বিধান কর, যে ব্যক্তি প্রমাণিকাছন্দের আটটি শ্লোক অধ্যয়ন করে জপ বা ভাবনা করে, সে জন্ম জন্ম শ্রীনন্দনন্দন কৃষ্ণে সুভক্তিসম্পন্ন হয় ||৯||

|| ইতি শ্রীমৎপরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যস্য শ্রীগোবিন্দ ভগবৎ পূজ্যপাদ শিষ্যস্য শ্রীমচ্ছঙ্করাচার্য ভগবত কৃতৌ শ্রীকৃষ্ণাষ্টকং কৃষ্ণকৃপাকটাক্ষ স্তোত্রং সম্পূর্ণম্ ||

ইতি শ্রীমৎপরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্য শ্রীগোবিন্দ ভগবৎ পূজ্যপাদ শিষ্য শ্রীমদ শঙ্করাচার্য বিরচিত শ্রীকৃষ্ণ তাণ্ডব স্তোত্র বা শ্রীকৃষ্ণাষ্টকম্ কৃষ্ণকৃপাকটাক্ষ স্তোত্র সমাপ্ত।

 শ্রী কৃষ্ণার্পণমস্তু

 

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...