অদ্বৈতবেদান্তে সৃষ্টিক্রম বিষয়ক আলোচনায় তেজোৎপত্তি বিষয়ক বাক্যসকল আজকের বিচার্য্য বিষয়। ছান্দোগ্যে (৬.২.৩) সৎস্বরূপ ব্রহ্ম হইতে তেজের উৎপত্তি শ্রাবিত হইয়াছে, তৈত্তিরীয়কে (২.১) কিন্তু বায়ু হইতে তেজের উৎপত্তি শ্রাবিত হইয়াছে। এইস্থলে একবাক্যতার সম্ভাবনা বা অসম্ভাবনাবশতঃ সংশয় হয়-বহ্নি ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন হয়, অথবা ব্রহ্মসংযুক্ত বায়ু হইতে?
ভগবান্
সূত্রকার বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত করিতেছেন-
তেজোতস্তথাহ্যাহ
৷৷ ব্রহ্মসূত্র ২.৩.১০৷৷
ভগবান্
ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য্য ভাষ্য করিতেছেন-এইপ্রকার শঙ্কা প্রাপ্ত হইলে কথিত হইতেছে-তেজঃ
ইহা হইতে, অর্থাৎ বায়ু হইতে উৎপন্ন হয়। তাহাতে প্রমাণ কি? যেহেতু শ্রুতি সেইপ্রকারই
বলেন, যথা-
'বায়োরগ্নিঃ'-(তৈত্তিরীয়
উপনিষৎ-২।১)
'বায়ু
হইতে অগ্নি উৎপন্ন হইল', ইত্যাদি।
তেজঃ
অব্যবহিত ব্রহ্মজ (-সাক্ষাৎভাবে ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন) হইলে, বায়ু হইতে উৎপন্ন না হইলে
এই শ্রুতি কদর্থিতা হইয়া পড়িবে। ....
এখন
যদি বলা হয়, অন্য শ্রুতিও তেজের ব্রহ্ম হইতে উৎপত্তি বোধ করাইতেছে, যথা-
'তত্তেজোসৃজত'-(ছান্দোগ্য
উপনিষৎ-৬.২.৩)
'তিনি
তেজকে সৃষ্টি করিলেন।'
তাহা
হইলে তো শ্রুতি বিরোধ হইয়া পড়িবে। তদুত্তরে সিদ্ধান্তী বলিতেছেন-না তাহা হয় না, যেহেতু
পারম্পর্য্য (-পরম্পরাভাবে ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন) হইলেও এইশ্রুতির বিরোধ হয় না। যেহেতু
যখন 'আকাশ ও বায়ু সৃষ্টি করিয়া বায়ুভাবাপন্ন (-বায়ুরূপ উপাধিযুক্ত) ব্রহ্ম তেজকে সৃষ্টি
করিলেন', এইপ্রকার কল্পনা করা হয়, তখনও তেজের ব্রহ্ম হইতে উৎপত্তি বিরোধগ্রস্ত হয় না।
যেমন উষ্ণ দুগ্ধ গাভীর সাক্ষাৎ কার্য্য, দধি তাহার পরম্পরাপ্রাপ্ত কার্য্য, ছানা তাহার
আরও ব্যবহিত কার্য্য, ইত্যাদি সকল স্থলে গাভীকেই কারণরূপে অঙ্গীকার করা হয়। আর ব্রহ্ম
আকাশাদি কার্য্যরূপেও অবস্থান করেন, ইহা-
'তদাত্মানম্
স্বয়ম্ অকুরুত'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।৭)
'তিনি
নিজেই নিজেকে নাম ও রূপের দ্বারা অভিব্যক্ত করিয়াছিলেন' ইত্যাদি শ্রুতি প্রদর্শন করিতেছেন।
আর
সেইপ্রকার ঈশ্বরস্মরণও (ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের উক্তিরূপা স্মৃতিও) আছে, যথা-
বুদ্ধির্জ্ঞানমসংমোহঃ
ক্ষমা সত্যং দমঃ শমঃ ৷
সুখং
দুঃখং ভবোভাবো ভযং চাভযমেব চ ৷৷
অহিংসা
সমতা তুষ্টিস্তপো দানং যশোযশঃ৷
ভবন্তি
ভাবা ভূতানাং মত্ত এব পৃথগ্বিধাঃ৷৷-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, বিভূতিযোগ-৪,৫)
'অন্তঃকরণের
সুক্ষ্মবিষয়ে বোধসামর্থ, আত্মাদি পদার্থের জ্ঞান, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, ক্ষমা, সত্য,
বাহ্যেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়ের সংযম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা,
সমচিত্ততা, সন্তোষ, তপস্যা, দান, ধর্মনিমিত্ত কীর্তি ও অধর্মর্নিমিত্ত অকীর্তি - এইসকল
ভিন্ন ভিন্ন ভাব প্রাণীগণের স্ব স্ব কর্মানুসারে আমা হইতেই উৎপন্ন হয়।'
যদিও
বুদ্ধি প্রভৃতিকে স্ব স্ব কারণ হইতে উৎপন্ন হইতে প্রত্যক্ষভাবে দেখা যাইতেছে, তাহা
হইলেও সকল ভাব পদার্থ সাক্ষাৎ, অথবা পরম্পরাভাবে ঈশ্বরের বংশে জাত হওয়ায় 'আমা হইতে
উৎপন্ন' এইপ্রকার উক্তি কখনও অসঙ্গত নহে।
এইভাবে
ব্রহ্ম হইতে সাক্ষাৎ অথবা পরম্পরাভাবে উৎপত্তি অঙ্গীকারের দ্বারা যেসকল শ্রুতিতে সৃষ্টির
ক্রম বর্ণিত হয় নাই, তাহারা ব্যাখ্যাত হইলে তাহাদের সকলপ্রকার যুক্তিযুক্ততা সিদ্ধ
হয়। কিন্তু যেসকল শ্রুতিতে ক্রমবিশিষ্ট সৃষ্টি বর্ণিত হইয়াছে, তাহাদের অন্যপ্রকারে
(-পারম্পর্য্য অঙ্গীকার না করিয়া) উপপত্তি হয় না বলিয়া 'উক্তপ্রকারে ব্যাখ্যা করা যায়
না'। 'একবিজ্ঞানে সর্ববিজ্ঞান' বিষয়ক প্রতিজ্ঞাও সৎস্বরূপ ব্রহ্মের বংশে উৎপত্তিমাত্রকে
অপেক্ষা করে, কিন্তু ব্রহ্ম হইতে অব্যবহিতভাবে উৎপত্তিকে অপেক্ষা করে না, অতএব শ্রুতিবাক্যসকলের
মধ্যে বিরোধ নাই।....
No comments:
Post a Comment