Sunday, 31 July 2022

অদ্বৈতবেদান্তে "জগৎ মিথ্যা" বিষয়ে দ্বৈতবাদীদের আপত্তির খণ্ডনঃ—(পর্ব-০১)

 


প্রথমত এই লেখার উদ্দেশ্য অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে ভেদবাদীদের আক্ষেপ নিরসন। শুধুমাত্র দার্শনিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ ও অদ্বৈতবেদান্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের নিমিত্ত আমি এই কর্মে প্রবৃত্ত হচ্ছি।

পূর্বপক্ষ— জগৎ সত্যই। 'জগৎমিথ্যা' শব্দটা সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন ও শঙ্করাচার্যের নিজ কল্পিত।

সিদ্ধান্ত— পরমার্থতঃ ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। ইহা শঙ্করাচার্যের নিজকল্পিত সিদ্ধান্ত নয় বরংচ শ্রুতি সিদ্ধান্ত। শুক্ল যজুর্বেদীয় নিরালম্বোপনিষদে বর্ণিত আছে— "তপ ইতি চ ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যেতি"-(নিরালম্ব উপনিষৎ-৩৫)

পূর্বপক্ষ— শব্দবোধ্য ব্রহ্ম সত্য হলে ব্রহ্মবিষয়ক শাব্দজ্ঞানের প্রামাণ্যও সত্য। ফলতঃ ব্রহ্মের সত্যতা রক্ষার জন্য প্রামাণ্যকেও সত্য বলতে হবে। কারণ বিষয়ের বাধ না হওয়ারূপ প্রামাণ্য অসত্য হলে বিষয়ও সত্য হতে পারে না। এরূপে ব্রহ্মাতিরিক্ত সত্যবস্তু বিদ্যমান থাকায় অবশ্যই দ্বৈতসিদ্ধি হবে, পরন্ত অদ্বৈতসিদ্ধি হবে না অতএব আকাশাদি জগৎপ্রপঞ্চও সত্য হোক।

সিদ্ধান্ত— ঘটের প্রামাণ্য যেরূপ ঘটাতিরিক্তের দ্বারা সংঘটিত হয়, তেমনি সত্যভূত ব্রহ্মজ্ঞানের প্রামাণ্য ব্রহ্মাতিরিক্তের দ্বারা সংঘটিত হওয়ায় ঐ প্রামাণ্য মিথ্যা হতে পারে। কেননা ব্রহ্ম ও ব্রহ্মজ্ঞানের প্রামাণ্য এক নয়। সুতরাং ব্রহ্মসূত্রের আরম্ভণাধিকরণের যুক্তি অনুসারে সমগ্র আকাশাদি প্রপঞ্চের মিথ্যাত্ব বজ্রলেপসদৃশ সুস্থির।

 "তদনন্যত্বমারম্ভণশব্দাদিভ্যঃ"(ব্রহ্মসূত্র, ২/১/১৪)। তৎ-অনন্যত্বম (ব্রহ্মরূপ অভিন্ন-নিমিত্ত-উপাদান-কারণ হতে তৎকার্যভূত এই জগৎপ্রপঞ্চ ভিন্ন নয়; কেন না)  আরম্ভণশব্দাদিভ্যঃ ("বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম"ছান্দোগ্যোপনিষৎ,৬/১/৪— ঘটাদি কার্য কেবল নাম, অর্থাৎ শব্দকে অবলম্বন করে বিদ্যমান আছে, কারণরূপী মৃত্তিকাই সত্য; "ঐতদাত্মাম ইদং সর্বম্"—কার্যভূত এই সমস্তই ব্রহ্মসত্তায় সত্তাবান—ছান্দোগ্যোপনিষৎ,৬/৮/৭; "ব্রহ্মৈবেদং সর্বম্"—ব্রহ্মই এই সমস্ত— ইত্যাদি শ্রুতিপ্রমাণ রয়েছে)।

পূর্বপক্ষ—মাধ্ব প্রভৃতি জগৎসত্যতাবাদী বৈষ্ণব-বেদান্ত সম্প্রদায় ভেদের সত্যতা-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কারণ বস্তুভেদ অসত্য হলে, বিবিধ যাগযজ্ঞাদি কর্মভেদের উপপাদক মীমাংসাশাস্ত্র অপ্রমাণ হয়ে পড়ে। জগতের সত্যতার সমর্থক ন্যায়-বৈশেষিক, সাংখ্য-যোগ প্রভৃতি শাস্ত্ররাজির প্রামাণ্য ব্যাহত হয়। এই অবস্থায় বিচিত্র বিবিধ বিশ্ব প্রপঞ্চের পরস্পর ভেদের সত্যতা স্বীকার করায় যুক্তিসঙ্গত।

সিদ্ধান্ত—ভেদের সত্যতার সাধক মাধ্বোক্ত অনুমানের বিরুদ্ধে অদ্বৈতবেদান্তী বলেন, বস্তুভেদ সত্য নয়, মিথ্যায় বটে। মিথ্যা বলে দৃশ্য বস্তুরাজি অদ্বৈতবেদান্তের সিদ্ধান্তে আকাশকুসুমের ন্যায় অলীক বা অসৎ নয়। বস্তুরাজির ব্যবহারিক সত্যতা অবশ্যই স্বীকার্য। শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের আরম্ভণাধিকরণের ভাষ্যে স্পষ্ট বলেছেন—" ব্রহ্মাত্মবিজ্ঞানের (জীব ও ব্রহ্মের একত্বজ্ঞানের) পূর্বে সকল প্রকার ব্যবহারেরই সত্যতা সঙ্গত; যেমন জাগরণের পূর্বে স্বপ্নব্যবহারের সত্যতা সঙ্গত। যেহেতু যতদিন পর্যন্ত না আত্মার সত্য একত্বের জ্ঞান হয়, ততদিন পর্যন্ত প্রমাণ প্রমেয় ও ফলরূপ কার্যসকলে কারও মিথ্যাত্ববুদ্ধি উৎপন্ন হয় না।"

সত্য কথা এই যে, পরিদৃশ্যমান ঘটপ্রমুখ দৃশ্যরাজি আকাশকুসুমের ন্যায় অসৎ নয়, আবার তা পরব্রহ্মের ন্যায় ধ্রুব সত্যও নয়। দৃশ্য বস্তুরাজি অনির্বচনীয়। বিশ্বপ্রপঞ্চ অনির্বচনীয় হলেও "সর্বং ব্রহ্মময়ং জগৎ", এইরূপে জাগতিক বস্তুবর্গের মধ্য দিয়ে এক অদ্বিতীয় সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্মের স্ফুরণ না হওয়া পর্যন্ত মায়াময় জগতের মায়িক প্রপঞ্চের ব্যবহারিক সত্যতা অস্বীকার করা চলে না। কর্মময় এই জগতে কর্মধারা অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই বস্তুভেদের আপেক্ষিক অর্থাৎ ব্যবহারিক সত্যতা অবশ্য স্বীকার্য। জাগতিক প্রপঞ্চকে আত্মার ন্যায় ধ্রুবসত্য কোনমতেই বলা চলে না। এইরূপে অদ্বৈতবেদান্তী জগতের সত্যতা ব্যাখ্যা করায় কর্মমীমাংসা, ন্যায়-বৈশেষিক, সাংখ্য-যোগ প্রভৃতি কোন শাস্ত্রেরই অপ্রামাণ্যের প্রশ্ন আসে না। অদ্বৈতবেদান্তী এরূপ সমন্বয়ের দৃষ্টিতে কর্মভেদের প্রতিপাদক শাস্ত্ররাজির মর্যাদা রক্ষা করেছেন, ক্ষুণ্ন করেন নি। বিরুদ্ধবাদী দার্শনিকগণ প্রতিবাদের তমিস্রায় জ্ঞানচক্ষু অন্ধ করে, সামঞ্জস্যের দৃষ্টি খুঁজে পান নি।

শঙ্কাঃ—জগৎ যদি চিদাত্মা হইতে ভিন্ন নহে তবে উহা ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয় কেন?

উত্তরঃ—এই শঙ্কার উত্তরে অষ্টাবক্র মুনি বলছেন-"আত্মবিষয়ক অজ্ঞানবশতই জগৎ প্রতিভাত হইয়া থাকে, অধিষ্ঠানভূত আত্মার জ্ঞান হইলে আর আত্মা হইতে পৃথকরূপে কোন জগৎ দৃষ্টিগোচর হয় না। যেমন রজ্জুস্বরূপের অজ্ঞানবশতই ভ্রান্তিসর্প দেখা যায়, রজ্জুর জ্ঞান হইলে আর ঐ সর্পপ্রতীতি হয় না।" -(অষ্টাবক্র গীতা, শিষ্যোক্তমাত্মানুভবোল্লাসঃ, ৭)

অর্থাৎ রজ্জুতে যেমন পরমার্থতঃ সর্প কোন কালেই থাকে না তদ্রূপ ব্রহ্মরূপ অধিষ্ঠানে পরমার্থতঃ এই জগৎ কোন কালেই নেই। ব্রহ্মসূত্রের (২।১।১৪) এর ভাষ্যে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য তা স্পষ্ট করেছেন-"পারমার্থিক দৃষ্টিতে শুদ্ধ চৈতন্যে ঈশ্বরত্ব ও জীবত্ব প্রভৃতি দ্বৈতবুদ্ধি উপপন্ন হয় না, সেই বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ-

'যত্র নান্যত্পশ্যতি নান্যচ্ছৃণোতি নান্যদ্বিজানাতি স ভূমা' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭/২৪/১)।

অর্থাৎ 'যেখানে অপর কিছু দর্শন করে না, অপর কিছু শ্রবণ করে না, অপর কিছু জানিতে পারে না, তাহাই ভূমা।'

'যত্র ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূত্তত্কেন কং পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৫/১৫)।

অর্থাৎ 'কিন্তু সমস্তই যখন ইহার আত্মাই হইয়া গেল, তখন কাহার দ্বারা কাহাকে দর্শন করিবে?'

ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারাও তাহাই বর্ণিত হচ্ছে। এই প্রকারে সকল উপনিষদই পরমার্থ অবস্থাতে সকলপ্রকার ব্যবহারের অভাবের কথা বলছেন। সেইরূপেই শ্রীভগবান ভগবদ্গীতাতে বলিতেছেন-

'ন কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ৷ ন কর্মফলসংযোগং স্বভাবস্তু প্রবর্ততে' 'নাদত্তে কস্যচিত্পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ৷ অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ'।-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা- ৫।১৪,১৫)

অর্থাৎ 'কারণ প্রভু আত্মা মনুষ্যের কর্তৃত্ব, কর্ম ও কর্মফলপ্রাপ্তি সৃষ্টি করেন না; কিন্তু স্বভাব অর্থাৎ নিজ বা পরমাত্মার যে সদসদাত্মিকা ভাব অর্থাৎ অবিদ্যালক্ষণা মায়াশক্তি কর্তৃত্বাদিরূপে প্রবর্তিত হয়। অর্থাৎ অবিদ্যাপ্রভাবে কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদি আত্মাতে আরোপিত হয় । পরমার্থতঃ বিভু আত্মা কাহারও পাপ বা পূজা জপহোমাদিরূপ পুণ্যও গ্রহণ করেন না । পূর্বোক্ত অবিদ্যা দ্বারা ‘আমি কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদিরহিত’ - এই বিবেকজ্ঞান আত্মজ্ঞান দ্বারা আবৃত বলিয়া প্রাণিগণ মোহগ্রস্থ হয়, অর্থাৎ মোহবশে ‘আমি করি ও করাই’, ‘আমি ভোগ করি ও করাই’ - ইত্যাদি ভ্রম করিয়া থাকে।'এইপ্রকারে পারমার্থিক অবস্থাতে শাসক (ঈশ্বর) ও শাসিত (জীব) ইত্যাদি ব্যবহারের অভাব প্রদর্শিত হইতেছে।"

ভাষ্যকার আচার্য শঙ্কর তাঁর অধ্যাসভাষ্যে "অধ্যাসো মিথ্যেতি ভবিতুং যুক্তম্'', 'অধ্যাস মিথ্যা হওয়াই উচিত' এইরূপে যে 'মিথ্যা' পদটির প্রয়োগ করেছেন, তার ব্যাখ্যায় আচার্য পদ্মপাদ তাঁর 'পঞ্চপাদিকায়' বলেছেন, মিথ্যাশব্দের দুইটি অর্থ দেখা যায়—একটি অসম্ভব দ্বিতীয়টি অনির্বচনীয়তা। প্রথম অর্থে 'অধ্যাসো মিথ্যা', অর্থাৎ চিৎ ও অচিতের গ্রন্থিরূপ অধ্যাস সম্ভবপর নয়; দ্বিতীয় অর্থে অধ্যাস অনির্বচনীয়, ইহাই স্পষ্টতঃ বুঝা যায়। অনির্বচনীয়, অর্থাৎ সৎও নয়, অসৎও নয়; সদসৎও নয়; যে বস্তুকে সৎ বা সত্যরূপেও নির্বচন করা হয় না, অসত্যরূপেও নিরূপণ করা যায় না, সত্যাসত্যরূপেও ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর হয় না; এরূপ বস্তুই অনির্বচনীয় আখ্যা লাভ করে। অনির্বচনীয় বস্তুমাত্রই মিথ্যা। ফলে, 'সদসদ্বিলক্ষণত্ব'ই মিথ্যাত্ব, এরূপ মিথ্যাত্বের লক্ষণই এসে পড়ে।‌ আচার্য পদ্মপাদ্ এই দৃষ্টিতেই তার মিথ্যাত্বের লক্ষণ বা পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। পদ্মপাদের এই লক্ষণটি চিৎসুখাচার্য তাঁর গ্রন্থে মিথ্যাত্বের পঞ্চম লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

পূর্বপক্ষঃ— প্রতিবাদী দ্বৈতবেদান্তী প্রভৃতি সৎ ও অসৎ এই উভয়ের অনধিকরণ বস্তু অপ্রসিদ্ধ বলে আলোচ্য লক্ষণের অসঙ্গতি প্রদর্শন করেছেন।

সিদ্ধান্তঃ—এই প্রসঙ্গে অদ্বৈতবাদী বলেন, সৎ না হলেই অসৎ হবে, অসৎ না হলেই তা সৎ হবে, কোন বস্তুই সৎ ও অসৎ, এই উভয়ের অনধিকরণ হবে না, হতে পারে না। এরূপে প্রতিবাদী যে আপত্তি তুলেছেন, সেই আপত্তির বিশেষ কিছু মূল্য নেই। সৎ এবং অসৎ এই উভয়ের অভাব যে একই ধর্মীতে থাকতে পারে তা নিম্নোক্ত অনুমানের সাহায্যে সহজেই উপপাদন করা যায়। 'চিৎসুখী' গ্রন্থের মিথ্যাত্বলক্ষণবিচারে বর্ণিত আছে—"সত্ত্ব এবং অসত্ত্ব এই উভয়েরই অত্যন্তাভাব কোন এক ধর্মী বা আশ্রয়ে বর্তমান থাকবে (সাধ্য), যেহেতু এই সত্ত্ব ও অসত্ত্ব কোন-না-কোন বিশেষ্যেরই ধর্ম (হেতু), যেমন রূপ ও রস (সপক্ষ দৃষ্টান্ত)।"

রূপ ও রস এই উভয়ই পৃথিবী ও জলের ধর্ম বটে অথচ, এদের অভাব বায়ুতে দেখতে পাওয়া যায়। ফলে রূপ ও রসে ধর্মত্বরূপ হেতু যেমন আছে, সেইরূপ একই ধর্মীতে (বায়ুতে) রূপ ও রসের অত্যন্তাভাব থাকায় রূপ ও রসের অত্যন্তাভাবের প্রতিযোগিত্বরূপ সাধ্যও থাকল। এইরূপে অনুমানাঙ্গ হেতু, সাধ্য এবং হেতু ও সাধ্যের ব্যাপ্তি প্রসিদ্ধই হলো। আলোচ্য অনুমানের পক্ষ—সত্ত্ব ও অসত্ত্বে ধর্মত্বরূপ বিদ্যমান থাকায় হেতুর পক্ষবৃত্তিতাও পাওয়া গেল এবং অনুমানটি যে নির্দোষ তাও বুঝা গেল। উক্ত অনুমানবলে সত্ত্ব এবং অসত্ত্বরূপ ধর্মের অত্যন্তাভাবও যে কোন একটি ধর্মী বা বিশেষ্যে পাওয়া যাবে তাও সাব্যস্ত হলো।

পূর্বপক্ষঃ— এখন প্রতিবাদী দ্বৈতবাদী হয়ত বলবেন যে, রূপ ও রসের অভাব বায়ুতে আছে, তা কে অস্বীকার করেছে? রূপ ও রসের অভাব কোন এক ধর্মীতে থাকলেও, সত্ত্ব এবং অসত্ত্ব এই পরস্পর বিরুদ্ধ ধর্মদ্বয়ের অভাব কোথাও থাকবে না। ধর্মী বা বিশেষ্য পদার্থটি হয় সৎ হবে, নয় অসৎ হবে। সৎ এবং অসৎ এমন পরস্পরবিরোধী যে এরা কোন এক বস্তুতে কদাচ থাকবে না, এদের উভয়ের অত্যন্তাভাবও কোন এক স্থানে পাওয়া যাবে না। এই অবস্থায় অদ্বৈতবাদীর উল্লেখিত অনুমান সত্ত্ব ও অসত্ত্বের একত্র (কোন এক ধর্মী বা বিশেষ্যে) অবস্থানের সহায়ক হবে কিরূপে?

সিদ্ধান্তঃ— অদ্বৈতবাদীর উল্লেখিত অনুমানের মর্ম এবং প্রতিবাদী মাধ্বের আপত্তির ভিত্তি কোথায় তা জানতে হলে সর্বাগ্রে সত্ত্ব ও অসত্ত্ব বলতে বাদী, প্রতিবাদী কে কি বোঝেন, তা স্পষ্টতঃ জানা আবশ্যক। সতের অভাবই অসৎ, অসতের অভাবই সৎ। সৎ ও অসৎ এরূপ পরস্পরবিরোধী যে, যা সৎ নয়, তাই অসৎ, আর যা অসৎ নয়, তাই সৎ। সৎ ও অসতের এরূপ অর্থ অদ্বৈতবাদী গ্রহণ করে না। অদ্বৈতবাদী আচার্য মধুসূদন সরস্বতী 'অদ্বৈতসিদ্ধি' তে বলেছেন— "যা ভূত, ভবিষ্যত ও বর্তমান এই তিন কালের কোন কালেই বাধিত হয় না, তাই একমাত্র সৎ বা ‌সত্য বস্তু। পরব্রহ্মই সুতরাং একমাত্র সত্য বস্তু। আর যা কোন স্থলেই (কোন আশ্রয়ে বা আধারেই) সদ্রূপে প্রতীতির বিষয় হয় না, যাতে কোনরূপ বস্তুত্বই নেই, সেইরূপ 'বস্তুশূন্য' অর্থাৎ বাস্তবতার সর্বপ্রকার সংস্পর্শবর্জিত অলীক আকাশকুসুম প্রভৃতিই 'অসৎ' বলে জানবে।"

সদ্রূপে কেন? যা সত্য বা মিথ্যা কোনোরূপ প্রতীতিরই কদাচ গোচর হয় না, তাই অসৎ। 'অয়ং বন্ধ্যা পুত্রো যাতি', 'ইদম আকাশকুসুমং সুরভী', এরূপ সত্য বা মিথ্যা কোনরূপ অনুভবই জন্মে না। এইজন্য বন্ধ্যাপুত্র , আকাশকুসুম প্রভৃতিকে অলীক বা অসৎ বলা হয়ে থাকে। শুক্তিরজতের রজত অদ্বৈতবাদীর দৃষ্টিতে মিথ্যা হলেও তা অসৎ নয়। সত্যজ্ঞানের তা বিষয় না হলেও, ভ্রমপ্রতীতির তা বিষয় হয়। রূপার খণ্ড মনে করে তা নেওয়ার জন্য ভ্রান্তব্যক্তি তার প্রতি ধাবিতও হয়। এইরূপ রজতকে আকাশকুসুমের মত অসৎ বলা যায় কিরূপে? সৎ ও অসৎ অদ্বৈতবেদান্তের সিদ্ধান্তে এমনই দুইটি বিরুদ্ধ কোটি যে তাদের মিলন সম্ভবপর না হলেও, তাদের অন্তরালে মিথ্যা জগতেরও স্থান আছে।

শঙ্কাঃ— শুক্তিরজত বা ঘট প্রমুখ বস্তুকে সদসদ্বিলক্ষণ বা মিথ্যা বলতে আপত্তি কি?

উত্তরঃ— জাগতিক বস্তুকে আলোচ্য দৃষ্টিতে 'সদসদ্বিলক্ষণ' বা মিথ্যা বলে ব্যাখ্যা করায়, প্রতিবাদী মাধ্ব 'সদসদ্বিলক্ষণ' রূপ সাধ্য অপ্রসিদ্ধ বলে পঞ্চপাদিকোক্ত মিথ্যাত্বলক্ষণে যে 'সাধ্যাপ্রসিদ্ধি' দোষের উদ্ভাবন করেছেন, ঐ দোষও এখন অচল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পঞ্চপাদিকাবিবরণের রচয়িতা আচার্য প্রকাশাত্মযতি বলেন—"যে বস্তুর যা আধার বলে প্রতিভাত হয়, সেই আধার বা আশ্রয়েই যদি সেই বস্তুর অত্যন্তাভাব থাকে, তবে সেই বস্তু অবশ্যই মিথ্যাই হবে।"

এইরূপে 'সদসদ্বিলক্ষণত্ব'ই মিথ্যাত্ব, এই প্রকার পদ্মপাদাচার্যের লক্ষণ নির্দোষ বলে প্রতিভাত হলেও, একটি কথা এ প্রসঙ্গে মনে রাখা আবশ্যক যে, শুক্তিরজতের রজতকে অদ্বৈতবাদী 'অসৎ' বলেন না, প্রাতিভাসিকভাবে সৎ বলেন। ওটাকে অসৎ বলেন মাধ্ব। অসৎখ্যাতিবাদী মাধ্বের মতে ভ্রমস্থলে অত্যন্ত অসৎ বস্তুরই খ্যাতি হয়ে থাকে। মাধ্বসম্প্রদায়ের মতে যা অবাধ্য, তাই সৎ, যা বাধ্য তাই অসৎ। বিশ্বপ্রপঞ্চ এবং পরব্রহ্ম-পুরুষোত্তম, এই উভয়ই অবাধ্য, উভয়ই সৎ। শুক্তিরজত এবং আকাশকুসুম এরা উভয়েই বাধ্য এবং উভয়েই অসৎ। আকাশকুসুম প্রভৃতি যা সত্য বা মিথ্যা কোনরূপ প্রতীতিরই বিষয় হয় না, তাদেরকে ভ্রমের ক্ষেত্রে 'শুক্তিরজতং সৎ' এই প্রকারে সত্যরূপে প্রতীয়মান রজতের সাথে এক জাতীয় বলে গ্রহণ করতে অদ্বৈতবাদী কোনমতেই প্রস্তুত নয়। শুক্তিরজত ভ্রমপ্রতীতির বিষয় হয়, আকাশ কুসুম সত্য-মিথ্যা কোনরূপ জ্ঞানেই ভাসেনা। এজন্য অত্যন্ত অসৎ অলীক আকাশকুসুম প্রভৃতিকে শুক্তিরজতের ন্যায় অসৎ বলতে অসৎখ্যাতিবাদী মাধ্বের আগ্রহ থাকলেও, অদ্বৈতবাদীর কোন আগ্রহ নেই।.........

ঋণঃ—

১. আচার্য অপ্পয় দীক্ষিত বিরচিত "সিদ্ধান্তলেশ সংগ্রহ"।

২. ভগবান শঙ্করাচার্যের শারীরকমীমাংসা ভাষ্য।

৩. প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার কাব্য ব্যাকরণ সাংখ্য বেদান্ততীর্থ ড. আশুতোষ শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতির

"বেদান্তদর্শন ও অদ্বৈতবাদ"।

Monday, 18 July 2022

শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন কি?

 


"আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যো"-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২/৪/৫) আচার্য শঙ্কর এই শ্রুতির ভাষ্যে বলছেন"অতএব আত্মাই দ্রষ্টব্যসাক্ষাৎকারের উপযুক্ত, অর্থাৎ আত্মবিষয়ক দর্শন সম্পাদন করা আবশ্যক। সেই জন্য শ্রোতব্যপ্রথমে শাস্ত্র ও আচার্য হতে জ্ঞাতব্য; পশ্চাৎ মন্তব্য, অর্থাৎ অনুকূল তর্ক দ্বারা তা সমর্থন করতে হবে; তারপর নিদিধ্যাসিতব্য অর্থাৎ নিসংশয়ঃরূপে তাকে ধ্যান করতে হবে। এইরূপে শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের সাহায্যে পরিশোধিত হলে পর, আত্মা প্রত্যক্ষগোচর হয়ে থাকে। যখন উক্ত সাধনগুলো একই আত্মবিষয়ে অনুগতভাবে প্রযুক্ত হয়, তখনই ব্রহ্মৈকত্ব-বিষয়ে সম্যক্ দর্শন উপস্থিত হয়, নচেৎ কেবল শ্রবণমাত্রে হয় না।"

এইপ্রকার পাঠের পর শ্রুতিতে পঠিত হচ্ছে"মৈত্রেয্যাত্মনে বা অরে দর্শনেন শ্রবণেন মত্যা বিজ্ঞানেন ইদং সর্বং বিদিতম্" অরে মৈত্রেয়ী! আত্মবিষয়ে দর্শন, শ্রবণ, মনন ও বিজ্ঞান হলেই এই দৃশ্যমান জগৎ বিজ্ঞাত হয়ে যায়।

শ্রবণতাৎপর্য নির্ণায়ক ষড়বিধ লিঙ্গের দ্বারা উপনিষৎসকলের অদ্বিতীয় একরস ব্রহ্মে তাৎপর্য অবধারণের অনুকূল মানসী ক্রিয়াকে বলে 'শ্রবণ'।

মননশ্রবণ দ্বারা অবধারিত বিষয়ে প্রমাণান্তরের দ্বারা বিরোধের আশঙ্কা হলে, তা নিরাকরণের জন্য শ্রুতির অনুকূল যুক্তিপ্রয়োগরূপ মানস ব্যাপারকে বলে 'মনন'।

নিদিধ্যাসনযদ্বিষয়ে শ্রবণ ও মনন করা হয়েছে, সেই অদ্বিতীয় ব্রহ্মবস্তুতে চিত্তস্থৈর্যের অনুকূল যে মানস ব্যাপার, অর্থাৎ অনাদি দুর্বাসনাবশে রূপরসাদি বিষয়ে আকৃষ্ট চিত্তকে বিষয় হতে অপসরণকরতঃ ব্রহ্মবস্তুতে যে তৎসজাতীয় প্রত্যয়প্রবাহ (-অবিচ্ছিন্নভাবে ধ্যান), তাকে বলে 'নিদিধ্যাসন'।

পূর্বেই বলেছি ইহারা অসম্ভাবনা ও বিপরীতভাবনার নিবর্তক। এইযে ভেদজ্ঞানের প্রাবল্য, ইহাই বিপরীতভাবনা। বস্তুতঃ দেহাদি পদার্থ সকল সত্য, তাহাতে আত্মবুদ্ধি, জীব ও ব্রহ্মের ভেদ সত্য, ইত্যাদি এইপ্রকার যে বিপরীত বুদ্ধি, তাহাই 'বিপরীতভাবনা'। নিদিধ্যাসনের বলে ইহা নিরাকৃত হয় এবং চিত্তের একাগ্রতা ও সুক্ষ্মবিষয়গ্রহণযোগ্যতা সম্পাদিত হয়।

বৃহদারণ্যক শ্রুতিতে বর্ণিত আছে

তমেব ধীরো বিজ্ঞায় প্রজ্ঞাং কুর্বীত ব্রাহ্মণঃ। নানুধ্যায়াদ্‌বহূঞ্ছব্দান্ বাচো বিগ্লাপনꣳ হি তৎ।-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/২১)

"ধীর ও ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষ সেই আত্মাকেই নিঃসংশয়রূপে অবগত হয়ে প্রজ্ঞালাভ করবেন অর্থাৎ অপরোক্ষ জ্ঞান লাভ করবেন। বহুশব্দের চিন্তা করবেন না, কারণ তাতে বাগিন্দ্রিয়ের অবসাদ জন্মে থাকে।"

অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে৷ তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্৷৷-(শ্রীগীতা -৯/২২) 

"আমাকেই আত্মভাবে চিন্তাপূর্বক যে সর্বত্যাগীগণ আমার ধ্যান করেন, সেই নিত্য-সমাহিত মুমুক্ষুগণের যোগ ও ক্ষেম আমি বহন করি।"

পূজ্যপাদ্ আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামী "পঞ্চদশীতে" বলছেন"এইরূপ  শ্রুতিবচন ও স্মৃতিবচন বিপরীতভাবনার নিবৃত্তির জন্যই আত্মাতে সর্বদা বুদ্ধির একাগ্রতার বিধান করছেন।"-(পঞ্চদশী-৭/১০৯)

শ্রীগীতার টীকার প্রারম্ভে আচার্য পূজ্যপাদ মধুসূদন সরস্বতী বলেছেন "ততস্তৎপরিপাকেন নিদিধ্যাসননিষ্ঠতা। যোগশাস্ত্রস্তু সম্পূর্ণমুপক্ষীণং ভবেদিহ"।(১৭ শ্লোক) অতএব ধ্যান ধারণা ও সমাধি ইহারা (যোগসূত্র-৩/১-৩) এই নিদিধ্যাসনেরই অন্তর্গত।

প্রসঙ্গতঃ শ্রবণ ও মননের দ্বারা নিরাকরণীয় অসম্ভাবনা কি, তা‌ বলছি। অসম্ভাবনা দুইপ্রকার১/ প্রমাণগত অসম্ভাবনা এবং ২/ প্রমেয়গত অসম্ভাবনা। 'বেদান্তবাক্য অদ্বিতীয় ব্রহ্মবস্তুকে প্রতিপাদন করে, অথবা অন্য কিছুকে, অর্থাৎ 'উপনিষদ্বাক্যসকলের ব্রহ্মপ্রতিপাদকতা আছে, অথবা নাই', এইপ্রকার যে উপনিদ্বাক্যরূপ প্রমাণবিষয়ক সংশয়, তাকে বলে ১/প্রমাণগত অসম্ভাবনা। শ্রবণের দ্বারা এটি নিরাকৃত হয়।

 আর জীব ও ব্রহ্মের ভিন্নতাই সত্য, অথবা অভিন্নতা; ইন্দ্রিয়াগ্রাহ্য ব্রহ্মবস্তু আছেন, অথবা নাই; বুদ্ধিই আত্মা, অথবা তদতিরিক্ত কিছু আছে; ইত্যাদি এই প্রকারে যে প্রমেয় ব্রহ্মবিষয়ক সন্দেহ, তাকে বলে ২/প্রমেয়গত অসম্ভাবনা। মননের দ্বারা এটি নিরাকৃত হয়।.....ইতি

অদ্বৈতবেদান্তে জ্ঞানমার্গ ও উপাসনামার্গঃ—

 

সাধনচতুষ্টয়সম্পন্ন উৎপন্ন বিবিদিষা, সুতরাং কথঞ্চিৎ দেহাত্মবুদ্ধিরহিত এবং উপাসনা-প্রভাবে বিক্ষেপরহিত চিত্তবিশিষ্ট ব্যক্তির হয় ব্রহ্মবিচারে প্রবৃত্তি। স্বীয় সংস্কার অনুসারে কারও হয় সদ্যোমুক্তির জন্য ১.জ্ঞানমার্গে নির্গুণব্রহ্মবিদ্যার অনুশীলনে প্রবৃত্তি, কারও বা হয় ক্রমমুক্তি লাভের জন্য ২.উপাসনামার্গে প্রবৃত্তি।

১. প্রথমোক্তগণের, ইনি নিবৃত্তপ্রতিবন্ধক উত্তম অধিকারী হলে, "তত্ত্বমসি" মহাবাক্য শ্রবণমাত্রেই "অহং ব্রহ্মাস্মি" ইত্যাকারা নির্বিশেষ ব্রহ্মবিদ্যার উদয় হয়। এতাদৃশ অধিকারী না হলে তাঁদের হয় শ্রবণমননাদি সাধন অনুষ্ঠানে প্রবৃত্তি। ব্রহ্মবিষয়ক শ্রবণ ও মননের দ্বারা অসম্ভাবনার এবং নিদিধ্যাসনের  দ্বারা বিপরীত ভাবনার নিবৃত্তি হয়। নিদিধ্যাসনের পরিপক্ক অবস্থাই সমাধি। ইহার সহকারিরূপে পাতঞ্জলোক্ত অষ্টাঙ্গযোগও পরিগৃহীত হয়। এই অবস্থা চলবার সময় পঞ্চকোশবিবেক দ্বারা পরবৈরাগ্যযুক্ত অধিকারীর ত্বং পদার্থের শোধন হয়, অর্থাৎ আমি শরীরচতুষ্টয় হতে ভিন্ন, তার অধিষ্ঠান শুদ্ধচৈতন্যমাত্রস্বরূপ, এইপ্রকার অনুভূতি হয়। তৎ পদার্থের শোধনও এই সময় হতে থাকে, অর্থাৎ উপাধিবিরহিত ব্রহ্ম বস্তুতঃ সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান নন, পরন্তু নির্বিশেষ শুদ্ধচৈতন্যমাত্রস্বরূপ, এইপ্রকার জ্ঞানোদয় হয়। এতাদৃশ অধিকারী জগৎপ্রপঞ্চকে স্বপ্নের ন্যায় প্রাতিভাসিকরূপে দর্শন করতে অভ্যাস করেন এবং ক্রমশঃ তাতে প্রতিষ্ঠিত হন। ইঁহার পক্ষে তখন আর নিত্যনৈমিত্তিক কর্মের অনুষ্ঠান সম্ভব হয় না। এতাদৃশ চতুর্থাশ্রমী অধিকারীর জন্যই ভগবান শঙ্করাচার্য জ্ঞানকর্মের সমুচ্চয় নিরাকরণ করেছেন স্বীয় শ্রীগীতাভাষ্যে। এতাদৃশ অধিকারীর "শুদ্ধচৈতন্যমাত্রস্বরূপ আমি" "শুদ্ধনির্গুনব্রহ্মচৈতন্যের" সহিত অভিন্ন এইপ্রকার নিদিধ্যাসনের দ্বারা বিপরীতভাবনার নিবৃত্তি হলে "তত্ত্বমসি" এই মহাবাক্যোত্থ "অহং ব্রহ্মাস্মি", এইপ্রকার নির্গুণব্রহ্মাত্মজ্ঞানের উদয় হয়।

২. ব্রহ্মলোকে ঈশ্বরীয় ঐশ্বর্যভোগ এবং মুক্তি, এই উভয়প্রকার আকাঙ্ক্ষাযুক্ত ব্যক্তির হয় উপাসনাতে প্রবৃত্তি। উপাসনা (উপ+আস্+অনট্+আপ্) শব্দের অর্থ'নিকটে অবস্থিতি'; অর্থাৎ তৈলধারাবৎ উপাস্যাকারা চিত্তবৃত্তি দ্বারা উপাস্য চিন্তন। ওঙ্কার উপাসনা ব্যতিরিক্ত উপাসনাসকল সগুণব্রহ্মেরই হয়ে থাকে। মায়াশক্তিযোগে নির্গুণপরব্রহ্মই সগুণপরব্রহ্মরূপে অঙ্গীকৃত হন। সগুণব্রহ্মের উপাসনা দ্বিবিধপ্রতীকাবলম্বনা ও অপ্রতীকাবলম্বনা। অপ্রতীকাবলম্বনা উপাসনাকে 'অহংগ্রহোপাসনা' বলে। ইহাতে নিজেকে শুদ্ধচৈতন্যমাত্রস্বরূপে চিন্তনকরতঃ সগুণপরব্রহ্মের সহিত নিজের অভিন্নতা চিন্তন করতে হয়। শ্রুত্যুক্ত দহরবিদ্যা (ছান্দোগ্য উপনিষদ- ৮।১), শাণ্ডিল্য বিদ্যা (ছান্দোগ্য উপনিষদ-৩।১৪) প্রভৃতি এই উপাসনার অন্তর্গত। ইহার ফলে ক্রমমুক্তি লব্ধ হয়। আবার নানাপ্রকার ফলপ্রদ বিদ্যুল্লোক পর্যন্ত গতিপ্রদ নানাপ্রকার প্রতীকোপাসনাও আছে। প্রতীকাবলম্বনা সাকার ব্রহ্মের উপাসনাও অদ্বৈতবেদান্তে অঙ্গীকৃত হয়। ব্রহ্মসূত্রের (৩/২/১৫) ভাষ্যে শঙ্করাচার্য বলেছেন "ব্রহ্মাপি পৃথিব্যাদ্যুপাধিসংবন্ধাত্ তদাকারতামিব প্রতিপদ্যতে; তদালম্বনো ব্রহ্মণ আকারবিশেষোপদেশ উপাসনার্থো ন বিরুধ্যতে" অর্থাৎ 'ব্রহ্মও পৃথিবী প্রভৃতি উপাধির সহিত সম্বন্ধবশতঃ যেন সেই আকারকেই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। উপাধি যাহার অবলম্বন, এতাদৃশ যে ব্রহ্মের আকারবিশেষের উপদেশ, তাহা উপাসনার জন্য এইজন্য সবিশেষতা ও নির্বিশেষতা জ্ঞাপিকা শ্রুতি বিরোধগ্রস্ত হয় না।'

শ্রুতিতেও উপাসনার জন্য সাকার ব্রহ্মের বর্ণনা আছে, যথা "হিরণ্ময়ঃ পুরুষঃ হিরণ্যশ্মশ্রুঃ হিরণ্যকেশঃ" (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-১/৬/৬), "বহুশোভমানাম্ উমাং হৈমবতীম্" (কেন উপনিষৎ ৩/১২) ইত্যাদি। লক্ষ্য করতে হইবে 'সাকার উপাসনা' শব্দে শঙ্করাচার্য বিভিন্ন শাস্ত্রে প্রতিপাদিত শিব, বিষ্ণু, শক্তি প্রভৃতি যাবতীয় সাকার বিগ্রহই গ্রহণ করলেন; সুতরাং আচার্য শঙ্করের অদ্বৈত মতবাদকে অসাম্প্রদায়িক বলতে হবে। প্রতিমাদি প্রতীকাবলম্বনা সাকার ব্রহ্মোপাসনাও ক্রমশঃ অপ্রতীকাবলম্বনা উপাসনাতে পরিণত হয়ে সিদ্ধ সাধককে ক্রমমুক্তি প্রদান করে। "সর্ব্বকালে সর্ব্বাবস্থাতে শ্রীভগবানের শ্রীমূর্ত্তি যাঁর হৃদয়ে প্রতিভাত হতে থাকেন, তিনিই সিদ্ধপুরুষ"। শমদমাদি সহকৃত শুভকর্মানুষ্ঠান, স্বাধ্যায়, বিষয়বৈরাগ্য, ভগবান্ নামগুণকীর্তন, তন্নামজপ, তন্মূর্তিধ্যান ইত্যাদি, প্রসিদ্ধ সাধনসকলই এই মতে সাধনরূপে অঙ্গীকৃত হয়। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের (২/২/৪২) ভাষ্যে বলছেন

 "পরমেশ্বরংভগবন্তমভিগমনোপাদানেজ্যাস্বাধ্যায়যোগৈর্বর্ষশতমিষ্ট্বা ক্ষীণক্লেশো ভগবন্তমেব প্রতিপদ্যত ইতি৷" অর্থাৎ পরমেশ্বরকে অভিগমন, উপাদান, ইজ্যা, স্বাধ্যায় এবং যোগের দ্বারা শতবর্ষ অর্থাৎ যাবজ্জীবন উপাসনাকরতঃ ক্ষীণক্লেশ হয়ে জীব ভগবানকেই প্রাপ্ত হয়। এই সূত্রের ভাষ্যে ভাষ্যকার আর বলছেন

"ভগবতোভিগমনাদিলক্ষণমারাধনমজস্রমনন্যচিত্ততযাভিপ্রেয়তে" অর্থাৎ 'সেই ভগবানের অভিগমনাদিরূপ আরাধনা অনন্যচিত্ত হয়ে অজস্রভাবে অভিপ্রায় করা হয়।' সর্বোপরি পরমেশ্বরের অনুগ্রহই ব্রহ্মবিদ্যালাভ ও মোক্ষের হেতুরূপে এই মতে অঙ্গীকৃত হয়, ব্রহ্মসূত্রের (২/৩/৪২) সূত্রের ভাষ্যে "তদনুগ্রহহেতুকেনৈব চ বিজ্ঞানেন মোক্ষসিদ্ধিঃ" অর্থাৎ 'তাঁহার অনুগ্রহই যাহার হেতু, সেই বিজ্ঞান দ্বারা জীবের মোক্ষ সিদ্ধ হয়' ইত্যাদি ভাষ্যকারের বচন দ্রষ্টব্য।

তথ্যসূত্রঃ- বেদান্তদর্শন, প্রথম খণ্ড (শাঙ্করভাষ্য, বৈয়াসিক ন্যায়মালা ও ভাষ্যরত্নপ্রভা টীকা সমন্বিত)

অন্তরঙ্গ সাধনঃ—

 


ব্রহ্মজ্ঞানের উৎপত্তিতে বহিরঙ্গ সাধনের কথা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, অদ্য #অন্তরঙ্গসাধন বিষয়ে আলোচনা করব। ভগবান শংকরাচার্য ব্রহ্মসূত্রের সর্বাপেক্ষা অধিকরণের ভাষ্যে বলছেন

ব্রহ্মবিদ্যা এতটাই মহাপ্রভাবশালিনী যে, যজ্ঞাদির দ্বারা ইহাকে প্রাপ্ত হতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তাহলেও ব্রহ্মবিদ্যা যজ্ঞাদি সাধনান্তর নিরপেক্ষ ও তত্ত্বমস্যাদি শব্দমাত্রগম্য হলেও ব্রহ্মবিদ্যার্থী শমদমাদিযুক্ত হবেন, যেহেতু

'তস্মাদেবংবিচ্ছান্তো দান্ত উপরতস্তিতিক্ষুঃ সমাহিতো ভূত্বাত্মন্যেবাত্মানং পশ্যতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/২৩)

"সেইহেতু ধর্মাধর্মরূপ কর্মের সহিত আত্মা সম্পর্কযুক্ত নহে এপ্রকার যিনি জানেন, তিনি শান্ত অর্থাৎ বাহ্যেন্দ্রিয়ব্যাপাররহিত, দান্ত অর্থাৎ অন্তঃকরণগত তৃষ্ণানিবৃত্ত, উপরত অর্থাৎ সমস্ত কামনাশূন্য, তিতিক্ষু অর্থাৎ সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্বসহিষ্ণু এবং সমাহিত অর্থাৎ একাগ্রচিত্ত হয়ে আত্মাতে (-শরীরমধ্যে, প্রত্যক্ চৈতন্যস্বরূপ) আত্মাকে দর্শন করেন", এইপ্রকারে ব্রহ্মবিদ্যার সাধনরূপে শমদমাদি বিহিত হয়েছে এবং যেহেতু যা বিহিত, তা অবশ্যই অনুষ্ঠেয়; সুতরাং ব্রহ্মবিদ্যাতে শমদমাদিরও আবশ্যকতা আছে, তদ্বিহীন ব্যক্তির পক্ষে সেই বিদ্যা তত্ত্বমস্যাদি শব্দমাত্রগম্যা নহে। আমি সাধনচতুষ্টয় শীর্ষক লেখাতে এই শমদমাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ইতি.....

বিবিদিষা কি?

 


অদ্বৈতবেদান্তে সাধন বিষয়ক আলোচনায় আজকের আলোচ্য বিষয় "বিবিদিষা"। শমদমাদির অভ্যাস সহ নিষ্কামভাবে অনুষ্ঠিত নিত্যনৈমিত্তিক শুভকর্মানুষ্ঠানের ফলে অন্তঃকরণের পাপাদি মল বিনষ্ট হলে বিবিদিষার উৎপত্তি হয়। ভগবান শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের সর্বাপেক্ষা অধিকরণের ভাষ্যে বলছেন—

'তমেতং বেদানুবচনেন ব্রাহ্মণা বিবিদিষন্তি যজ্ঞেন দানেন তপসানাশকেন '-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/২২)

অর্থাৎ সেই উপনিষৎপ্রতিপাদ্য ব্রহ্মকে ব্রাহ্মণগণ বেদপাঠ, যজ্ঞ, দান ও যথেচ্ছ ভোজন না করারূপ তপস্যার দ্বারা জানিতে ইচ্ছা করেন", ইত্যাদি শ্রুতি যজ্ঞ ও দান প্রভৃতির ব্রহ্মবিদ্যা সাধনতা প্রদর্শন করছে। আর বিবিদিষার সহিত সম্বন্ধবশতঃ কাম্যবর্জিত নিত্যনৈমিত্তিক কর্মের, ব্রহ্মজ্ঞানের উৎপত্তিতে সাধনভাব নিশ্চিত হচ্ছে।

'অথ যদ্যজ্ঞ ইত্যাচক্ষতে ব্রহ্মচর্যমেব তৎ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮/৫/১) "আর লোকে যাহাকে যজ্ঞ বলে, তাহা ব্রহ্মচর্যই", ইত্যাদি এই স্থলেও ব্রহ্মবিদ্যার সাধনভূত ব্রহ্মচর্যের যজ্ঞাদিশব্দের দ্বারা স্তুতি হওয়ায় যজ্ঞাদিরও ব্রহ্মজ্ঞানের প্রতি সাধনভাব সূচিত হচ্ছে। আর 'সর্বে বেদা যৎপদমামনন্তি তপাংসি সর্বাণি চ যদ্বদন্তি৷ যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রবীমি'—(কঠ উপনিষৎ-১/২/১৫) " সকল বেদ জ্ঞান সাধনভূত কর্মদ্বারা যে পদকে প্রতিপাদন করেন, তপস্যা সকল যাঁহার কথা বলে, যাঁহাকে অভিলাষ করিয়া ব্রহ্মচর্য পালন করে, সেই পদ তোমাকে সংক্ষেপে বলিতেছি", ইত্যাদি এই সকল শ্রুতি আশ্রমবিহিত কর্মসকলের বিদ্যাসাধনতা সূচনা করছে। তাছাড়া 'কর্মসকল পাপকে নাশ করে, জ্ঞান কিন্তু পরমা গতি, কর্মসকলের দ্বারা পাপ বিনষ্ট হলে তদনন্তর জ্ঞান প্রবৃত্ত হয়', ইত্যাদি এই সকল স্মৃতিও আশ্রমকর্মসকল যে ব্রহ্মজ্ঞানের সাধন, ইহা সূচনা করছে।

কিন্তু কতকাল কর্মানুষ্ঠান করতে হবে সেই বিষয়ে পূজ্যপাদ্ সুরেশ্বরাচার্য বলেছেন—"প্রত্যক্প্রবণতাং বুদ্ধেঃ কর্মাণ্যুৎপাদ্য শুদ্ধিতঃ। কৃতার্থান্যস্তমায়ান্তি প্রাবৃডন্তে ঘনা ইব।"-(নৈষ্কর্মসিদ্ধি-১/৪৯)

"কর্মসকল শুদ্ধতা সম্পাদন দ্বারা বুদ্ধির প্রত্যক্ প্রবণতাকে অর্থাৎ দেহান্দ্রিয়াদি হতে ভিন্ন শুদ্ধচৈতন্যস্বরূপ আত্মাতে আত্মবুদ্ধিকে উৎপাদনকরতঃ কৃতার্থ হয়ে বর্ষান্তে মেঘরাজির ন্যায় অস্তগমন করে।" বুদ্ধির এই যে প্রত্যক্ প্রবণতা যাহা চিত্তের শুদ্ধতাদ্বারা নিষ্কামকর্মসাধ্য, ইহারই অপর নাম 'বিবিদিষা'; ব্রহ্মকে জানবার ইচ্ছামাত্রই বিবিদিষা নহে। পূজ্যপাদ্ শ্রীধর স্বামীও তাই বলেছেন, যথা—"বিবিদিষা চ নিত্যানিত্যবস্তুবিবেকন নিবৃত্তদেহাদ্য-ভিমানতয়া বুদ্ধেঃ প্রত্যক্প্রবণতা"-(গীতা ১৮/২, শ্রীধর স্বামী টীকা)।

Tuesday, 5 July 2022

বিবেকিগণ বিজ্ঞান দ্বারা সেই আনন্দঘন অমৃতস্বরূপ প্রত্যাগাত্মাকে সর্বত্র উপলব্ধি করেনঃ—

 


অথর্ববেদীয় মুণ্ডক শ্রুতিতে বর্ণিত আছে—"তদ্বিজ্ঞানেন পরিপশ্যন্তি ধীরা আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি।।"-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২/২/৮)

আচার্য শঙ্কর এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন—"সেই আত্মতত্ত্বকে বিজ্ঞানদ্বারা অর্থাৎ শাস্ত্র ও আচার্যের উপদেশ হইতে লব্ধ পরোক্ষজ্ঞানের সহিত শম, দম, ধ্যান, সর্বকর্মসন্ন্যাস ও বৈরাগ্য হইতে উদ্ভূত বিশেষ জ্ঞান অর্থাৎ অনুভবের দ্বারা বিবেকিগণ চতুর্দিকে দেখেন অর্থাৎ সর্বত্র পূর্ণরূপে উপলব্ধি করেন, যে আনন্দঘন অর্থাৎ সম্পূর্ণ অনর্থদুঃখক্লেশরহিত সুখস্বরূপ এবং অমৃতস্বরূপ যিনি সর্বদা স্বীয় অন্তঃকরণে বিশেষরূপে অর্থাৎ বিবিধ বৃত্তিবিশিষ্টরূপে প্রকাশিত হইতেছেন।"

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...