প্রথমত এই লেখার উদ্দেশ্য অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে ভেদবাদীদের আক্ষেপ নিরসন। শুধুমাত্র দার্শনিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ ও অদ্বৈতবেদান্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের নিমিত্ত আমি এই কর্মে প্রবৃত্ত হচ্ছি।
পূর্বপক্ষ—
জগৎ সত্যই। 'জগৎমিথ্যা' শব্দটা সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন ও শঙ্করাচার্যের নিজ কল্পিত।
সিদ্ধান্ত—
পরমার্থতঃ ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। ইহা শঙ্করাচার্যের নিজকল্পিত সিদ্ধান্ত নয় বরংচ
শ্রুতি সিদ্ধান্ত। শুক্ল যজুর্বেদীয় নিরালম্বোপনিষদে বর্ণিত আছে— "তপ ইতি চ ব্রহ্ম
সত্যং জগন্মিথ্যেতি"-(নিরালম্ব উপনিষৎ-৩৫)
পূর্বপক্ষ—
শব্দবোধ্য ব্রহ্ম সত্য হলে ব্রহ্মবিষয়ক শাব্দজ্ঞানের প্রামাণ্যও সত্য। ফলতঃ ব্রহ্মের
সত্যতা রক্ষার জন্য প্রামাণ্যকেও সত্য বলতে হবে। কারণ বিষয়ের বাধ না হওয়ারূপ প্রামাণ্য
অসত্য হলে বিষয়ও সত্য হতে পারে না। এরূপে ব্রহ্মাতিরিক্ত সত্যবস্তু বিদ্যমান থাকায়
অবশ্যই দ্বৈতসিদ্ধি হবে, পরন্ত অদ্বৈতসিদ্ধি হবে না অতএব আকাশাদি জগৎপ্রপঞ্চও সত্য
হোক।
সিদ্ধান্ত—
ঘটের প্রামাণ্য যেরূপ ঘটাতিরিক্তের দ্বারা সংঘটিত হয়, তেমনি সত্যভূত ব্রহ্মজ্ঞানের
প্রামাণ্য ব্রহ্মাতিরিক্তের দ্বারা সংঘটিত হওয়ায় ঐ প্রামাণ্য মিথ্যা হতে পারে। কেননা
ব্রহ্ম ও ব্রহ্মজ্ঞানের প্রামাণ্য এক নয়। সুতরাং ব্রহ্মসূত্রের আরম্ভণাধিকরণের যুক্তি
অনুসারে সমগ্র আকাশাদি প্রপঞ্চের মিথ্যাত্ব বজ্রলেপসদৃশ সুস্থির।
"তদনন্যত্বমারম্ভণশব্দাদিভ্যঃ"(ব্রহ্মসূত্র,
২/১/১৪)। তৎ-অনন্যত্বম (ব্রহ্মরূপ অভিন্ন-নিমিত্ত-উপাদান-কারণ হতে তৎকার্যভূত এই জগৎপ্রপঞ্চ
ভিন্ন নয়; কেন না) আরম্ভণশব্দাদিভ্যঃ
("বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম"—ছান্দোগ্যোপনিষৎ,৬/১/৪—
ঘটাদি কার্য কেবল নাম, অর্থাৎ শব্দকে অবলম্বন করে বিদ্যমান আছে, কারণরূপী মৃত্তিকাই
সত্য; "ঐতদাত্মাম ইদং সর্বম্"—কার্যভূত এই সমস্তই ব্রহ্মসত্তায় সত্তাবান—ছান্দোগ্যোপনিষৎ,৬/৮/৭;
"ব্রহ্মৈবেদং সর্বম্"—ব্রহ্মই এই সমস্ত— ইত্যাদি শ্রুতিপ্রমাণ রয়েছে)।
পূর্বপক্ষ—মাধ্ব
প্রভৃতি জগৎসত্যতাবাদী বৈষ্ণব-বেদান্ত সম্প্রদায় ভেদের সত্যতা-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
কারণ বস্তুভেদ অসত্য হলে, বিবিধ যাগযজ্ঞাদি কর্মভেদের উপপাদক মীমাংসাশাস্ত্র অপ্রমাণ
হয়ে পড়ে। জগতের সত্যতার সমর্থক ন্যায়-বৈশেষিক, সাংখ্য-যোগ প্রভৃতি শাস্ত্ররাজির
প্রামাণ্য ব্যাহত হয়। এই অবস্থায় বিচিত্র বিবিধ বিশ্ব প্রপঞ্চের পরস্পর ভেদের সত্যতা
স্বীকার করায় যুক্তিসঙ্গত।
সিদ্ধান্ত—ভেদের
সত্যতার সাধক মাধ্বোক্ত অনুমানের বিরুদ্ধে অদ্বৈতবেদান্তী বলেন, বস্তুভেদ সত্য নয়,
মিথ্যায় বটে। মিথ্যা বলে দৃশ্য বস্তুরাজি অদ্বৈতবেদান্তের সিদ্ধান্তে আকাশকুসুমের
ন্যায় অলীক বা অসৎ নয়। বস্তুরাজির ব্যবহারিক সত্যতা অবশ্যই স্বীকার্য। শঙ্করাচার্য
ব্রহ্মসূত্রের আরম্ভণাধিকরণের ভাষ্যে স্পষ্ট বলেছেন—" ব্রহ্মাত্মবিজ্ঞানের (জীব
ও ব্রহ্মের একত্বজ্ঞানের) পূর্বে সকল প্রকার ব্যবহারেরই সত্যতা সঙ্গত; যেমন জাগরণের
পূর্বে স্বপ্নব্যবহারের সত্যতা সঙ্গত। যেহেতু যতদিন পর্যন্ত না আত্মার সত্য একত্বের
জ্ঞান হয়, ততদিন পর্যন্ত প্রমাণ প্রমেয় ও ফলরূপ কার্যসকলে কারও মিথ্যাত্ববুদ্ধি উৎপন্ন
হয় না।"
সত্য
কথা এই যে, পরিদৃশ্যমান ঘটপ্রমুখ দৃশ্যরাজি আকাশকুসুমের ন্যায় অসৎ নয়, আবার তা পরব্রহ্মের
ন্যায় ধ্রুব সত্যও নয়। দৃশ্য বস্তুরাজি অনির্বচনীয়। বিশ্বপ্রপঞ্চ অনির্বচনীয় হলেও
"সর্বং ব্রহ্মময়ং জগৎ", এইরূপে জাগতিক বস্তুবর্গের মধ্য দিয়ে এক অদ্বিতীয়
সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্মের স্ফুরণ না হওয়া পর্যন্ত মায়াময় জগতের মায়িক প্রপঞ্চের ব্যবহারিক
সত্যতা অস্বীকার করা চলে না। কর্মময় এই জগতে কর্মধারা অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই বস্তুভেদের
আপেক্ষিক অর্থাৎ ব্যবহারিক সত্যতা অবশ্য স্বীকার্য। জাগতিক প্রপঞ্চকে আত্মার ন্যায়
ধ্রুবসত্য কোনমতেই বলা চলে না। এইরূপে অদ্বৈতবেদান্তী জগতের সত্যতা ব্যাখ্যা করায়
কর্মমীমাংসা, ন্যায়-বৈশেষিক, সাংখ্য-যোগ প্রভৃতি কোন শাস্ত্রেরই অপ্রামাণ্যের প্রশ্ন
আসে না। অদ্বৈতবেদান্তী এরূপ সমন্বয়ের দৃষ্টিতে কর্মভেদের প্রতিপাদক শাস্ত্ররাজির
মর্যাদা রক্ষা করেছেন, ক্ষুণ্ন করেন নি। বিরুদ্ধবাদী দার্শনিকগণ প্রতিবাদের তমিস্রায়
জ্ঞানচক্ষু অন্ধ করে, সামঞ্জস্যের দৃষ্টি খুঁজে পান নি।
শঙ্কাঃ—জগৎ
যদি চিদাত্মা হইতে ভিন্ন নহে তবে উহা ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয় কেন?
উত্তরঃ—এই
শঙ্কার উত্তরে অষ্টাবক্র মুনি বলছেন-"আত্মবিষয়ক অজ্ঞানবশতই জগৎ প্রতিভাত হইয়া
থাকে, অধিষ্ঠানভূত আত্মার জ্ঞান হইলে আর আত্মা হইতে পৃথকরূপে কোন জগৎ দৃষ্টিগোচর হয়
না। যেমন রজ্জুস্বরূপের অজ্ঞানবশতই ভ্রান্তিসর্প দেখা যায়, রজ্জুর জ্ঞান হইলে আর ঐ
সর্পপ্রতীতি হয় না।" -(অষ্টাবক্র গীতা, শিষ্যোক্তমাত্মানুভবোল্লাসঃ, ৭)
অর্থাৎ
রজ্জুতে যেমন পরমার্থতঃ সর্প কোন কালেই থাকে না তদ্রূপ ব্রহ্মরূপ অধিষ্ঠানে পরমার্থতঃ
এই জগৎ কোন কালেই নেই। ব্রহ্মসূত্রের (২।১।১৪) এর ভাষ্যে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য তা
স্পষ্ট করেছেন-"পারমার্থিক দৃষ্টিতে শুদ্ধ চৈতন্যে ঈশ্বরত্ব ও জীবত্ব প্রভৃতি
দ্বৈতবুদ্ধি উপপন্ন হয় না, সেই বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ-
'যত্র
নান্যত্পশ্যতি নান্যচ্ছৃণোতি নান্যদ্বিজানাতি স ভূমা' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭/২৪/১)।
অর্থাৎ
'যেখানে অপর কিছু দর্শন করে না, অপর কিছু শ্রবণ করে না, অপর কিছু জানিতে পারে না, তাহাই
ভূমা।'
'যত্র
ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূত্তত্কেন কং পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৫/১৫)।
অর্থাৎ
'কিন্তু সমস্তই যখন ইহার আত্মাই হইয়া গেল, তখন কাহার দ্বারা কাহাকে দর্শন করিবে?'
ইত্যাদি
শ্রুতিবাক্যের দ্বারাও তাহাই বর্ণিত হচ্ছে। এই প্রকারে সকল উপনিষদই পরমার্থ অবস্থাতে
সকলপ্রকার ব্যবহারের অভাবের কথা বলছেন। সেইরূপেই শ্রীভগবান ভগবদ্গীতাতে বলিতেছেন-
'ন
কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ৷ ন কর্মফলসংযোগং স্বভাবস্তু প্রবর্ততে' 'নাদত্তে
কস্যচিত্পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ৷ অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ'।-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-
৫।১৪,১৫)
অর্থাৎ
'কারণ প্রভু আত্মা মনুষ্যের কর্তৃত্ব, কর্ম ও কর্মফলপ্রাপ্তি সৃষ্টি করেন না; কিন্তু
স্বভাব অর্থাৎ নিজ বা পরমাত্মার যে সদসদাত্মিকা ভাব অর্থাৎ অবিদ্যালক্ষণা মায়াশক্তি
কর্তৃত্বাদিরূপে প্রবর্তিত হয়। অর্থাৎ অবিদ্যাপ্রভাবে কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদি আত্মাতে
আরোপিত হয় । পরমার্থতঃ বিভু আত্মা কাহারও পাপ বা পূজা জপহোমাদিরূপ পুণ্যও গ্রহণ করেন
না । পূর্বোক্ত অবিদ্যা দ্বারা ‘আমি কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদিরহিত’ - এই বিবেকজ্ঞান
আত্মজ্ঞান দ্বারা আবৃত বলিয়া প্রাণিগণ মোহগ্রস্থ হয়, অর্থাৎ মোহবশে ‘আমি করি ও করাই’,
‘আমি ভোগ করি ও করাই’ - ইত্যাদি ভ্রম করিয়া থাকে।'এইপ্রকারে পারমার্থিক অবস্থাতে শাসক
(ঈশ্বর) ও শাসিত (জীব) ইত্যাদি ব্যবহারের অভাব প্রদর্শিত হইতেছে।"
ভাষ্যকার
আচার্য শঙ্কর তাঁর অধ্যাসভাষ্যে "অধ্যাসো মিথ্যেতি ভবিতুং যুক্তম্'', 'অধ্যাস
মিথ্যা হওয়াই উচিত' এইরূপে যে 'মিথ্যা' পদটির প্রয়োগ করেছেন, তার ব্যাখ্যায় আচার্য
পদ্মপাদ তাঁর 'পঞ্চপাদিকায়' বলেছেন, মিথ্যাশব্দের দুইটি অর্থ দেখা যায়—একটি অসম্ভব
দ্বিতীয়টি অনির্বচনীয়তা। প্রথম অর্থে 'অধ্যাসো মিথ্যা', অর্থাৎ চিৎ ও অচিতের গ্রন্থিরূপ
অধ্যাস সম্ভবপর নয়; দ্বিতীয় অর্থে অধ্যাস অনির্বচনীয়, ইহাই স্পষ্টতঃ বুঝা যায়।
অনির্বচনীয়, অর্থাৎ সৎও নয়, অসৎও নয়; সদসৎও নয়; যে বস্তুকে সৎ বা সত্যরূপেও নির্বচন
করা হয় না, অসত্যরূপেও নিরূপণ করা যায় না, সত্যাসত্যরূপেও ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর হয়
না; এরূপ বস্তুই অনির্বচনীয় আখ্যা লাভ করে। অনির্বচনীয় বস্তুমাত্রই মিথ্যা। ফলে,
'সদসদ্বিলক্ষণত্ব'ই মিথ্যাত্ব, এরূপ মিথ্যাত্বের লক্ষণই এসে পড়ে। আচার্য পদ্মপাদ্
এই দৃষ্টিতেই তার মিথ্যাত্বের লক্ষণ বা পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। পদ্মপাদের এই লক্ষণটি
চিৎসুখাচার্য তাঁর গ্রন্থে মিথ্যাত্বের পঞ্চম লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
পূর্বপক্ষঃ—
প্রতিবাদী দ্বৈতবেদান্তী প্রভৃতি সৎ ও অসৎ এই উভয়ের অনধিকরণ বস্তু অপ্রসিদ্ধ বলে আলোচ্য
লক্ষণের অসঙ্গতি প্রদর্শন করেছেন।
সিদ্ধান্তঃ—এই
প্রসঙ্গে অদ্বৈতবাদী বলেন, সৎ না হলেই অসৎ হবে, অসৎ না হলেই তা সৎ হবে, কোন বস্তুই
সৎ ও অসৎ, এই উভয়ের অনধিকরণ হবে না, হতে পারে না। এরূপে প্রতিবাদী যে আপত্তি তুলেছেন,
সেই আপত্তির বিশেষ কিছু মূল্য নেই। সৎ এবং অসৎ এই উভয়ের অভাব যে একই ধর্মীতে থাকতে
পারে তা নিম্নোক্ত অনুমানের সাহায্যে সহজেই উপপাদন করা যায়। 'চিৎসুখী' গ্রন্থের মিথ্যাত্বলক্ষণবিচারে
বর্ণিত আছে—"সত্ত্ব এবং অসত্ত্ব এই উভয়েরই অত্যন্তাভাব কোন এক ধর্মী বা আশ্রয়ে
বর্তমান থাকবে (সাধ্য), যেহেতু এই সত্ত্ব ও অসত্ত্ব কোন-না-কোন বিশেষ্যেরই ধর্ম (হেতু),
যেমন রূপ ও রস (সপক্ষ দৃষ্টান্ত)।"
রূপ
ও রস এই উভয়ই পৃথিবী ও জলের ধর্ম বটে অথচ, এদের অভাব বায়ুতে দেখতে পাওয়া যায়। ফলে
রূপ ও রসে ধর্মত্বরূপ হেতু যেমন আছে, সেইরূপ একই ধর্মীতে (বায়ুতে) রূপ ও রসের অত্যন্তাভাব
থাকায় রূপ ও রসের অত্যন্তাভাবের প্রতিযোগিত্বরূপ সাধ্যও থাকল। এইরূপে অনুমানাঙ্গ হেতু,
সাধ্য এবং হেতু ও সাধ্যের ব্যাপ্তি প্রসিদ্ধই হলো। আলোচ্য অনুমানের পক্ষ—সত্ত্ব ও অসত্ত্বে
ধর্মত্বরূপ বিদ্যমান থাকায় হেতুর পক্ষবৃত্তিতাও পাওয়া গেল এবং অনুমানটি যে নির্দোষ
তাও বুঝা গেল। উক্ত অনুমানবলে সত্ত্ব এবং অসত্ত্বরূপ ধর্মের অত্যন্তাভাবও যে কোন একটি
ধর্মী বা বিশেষ্যে পাওয়া যাবে তাও সাব্যস্ত হলো।
পূর্বপক্ষঃ—
এখন প্রতিবাদী দ্বৈতবাদী হয়ত বলবেন যে, রূপ ও রসের অভাব বায়ুতে আছে, তা কে অস্বীকার
করেছে? রূপ ও রসের অভাব কোন এক ধর্মীতে থাকলেও, সত্ত্ব এবং অসত্ত্ব এই পরস্পর বিরুদ্ধ
ধর্মদ্বয়ের অভাব কোথাও থাকবে না। ধর্মী বা বিশেষ্য পদার্থটি হয় সৎ হবে, নয় অসৎ হবে।
সৎ এবং অসৎ এমন পরস্পরবিরোধী যে এরা কোন এক বস্তুতে কদাচ থাকবে না, এদের উভয়ের অত্যন্তাভাবও
কোন এক স্থানে পাওয়া যাবে না। এই অবস্থায় অদ্বৈতবাদীর উল্লেখিত অনুমান সত্ত্ব ও অসত্ত্বের
একত্র (কোন এক ধর্মী বা বিশেষ্যে) অবস্থানের সহায়ক হবে কিরূপে?
সিদ্ধান্তঃ—
অদ্বৈতবাদীর উল্লেখিত অনুমানের মর্ম এবং প্রতিবাদী মাধ্বের আপত্তির ভিত্তি কোথায় তা
জানতে হলে সর্বাগ্রে সত্ত্ব ও অসত্ত্ব বলতে বাদী, প্রতিবাদী কে কি বোঝেন, তা স্পষ্টতঃ
জানা আবশ্যক। সতের অভাবই অসৎ, অসতের অভাবই সৎ। সৎ ও অসৎ এরূপ পরস্পরবিরোধী যে, যা সৎ
নয়, তাই অসৎ, আর যা অসৎ নয়, তাই সৎ। সৎ ও অসতের এরূপ অর্থ অদ্বৈতবাদী গ্রহণ করে না।
অদ্বৈতবাদী আচার্য মধুসূদন সরস্বতী 'অদ্বৈতসিদ্ধি' তে বলেছেন— "যা ভূত, ভবিষ্যত
ও বর্তমান এই তিন কালের কোন কালেই বাধিত হয় না, তাই একমাত্র সৎ বা সত্য বস্তু। পরব্রহ্মই
সুতরাং একমাত্র সত্য বস্তু। আর যা কোন স্থলেই (কোন আশ্রয়ে বা আধারেই) সদ্রূপে প্রতীতির
বিষয় হয় না, যাতে কোনরূপ বস্তুত্বই নেই, সেইরূপ 'বস্তুশূন্য' অর্থাৎ বাস্তবতার সর্বপ্রকার
সংস্পর্শবর্জিত অলীক আকাশকুসুম প্রভৃতিই 'অসৎ' বলে জানবে।"
সদ্রূপে
কেন? যা সত্য বা মিথ্যা কোনোরূপ প্রতীতিরই কদাচ গোচর হয় না, তাই অসৎ। 'অয়ং বন্ধ্যা
পুত্রো যাতি', 'ইদম আকাশকুসুমং সুরভী', এরূপ সত্য বা মিথ্যা কোনরূপ অনুভবই জন্মে না।
এইজন্য বন্ধ্যাপুত্র , আকাশকুসুম প্রভৃতিকে অলীক বা অসৎ বলা হয়ে থাকে। শুক্তিরজতের
রজত অদ্বৈতবাদীর দৃষ্টিতে মিথ্যা হলেও তা অসৎ নয়। সত্যজ্ঞানের তা বিষয় না হলেও, ভ্রমপ্রতীতির
তা বিষয় হয়। রূপার খণ্ড মনে করে তা নেওয়ার জন্য ভ্রান্তব্যক্তি তার প্রতি ধাবিতও
হয়। এইরূপ রজতকে আকাশকুসুমের মত অসৎ বলা যায় কিরূপে? সৎ ও অসৎ অদ্বৈতবেদান্তের সিদ্ধান্তে
এমনই দুইটি বিরুদ্ধ কোটি যে তাদের মিলন সম্ভবপর না হলেও, তাদের অন্তরালে মিথ্যা জগতেরও
স্থান আছে।
শঙ্কাঃ—
শুক্তিরজত বা ঘট প্রমুখ বস্তুকে সদসদ্বিলক্ষণ বা মিথ্যা বলতে আপত্তি কি?
উত্তরঃ—
জাগতিক বস্তুকে আলোচ্য দৃষ্টিতে 'সদসদ্বিলক্ষণ' বা মিথ্যা বলে ব্যাখ্যা করায়, প্রতিবাদী
মাধ্ব 'সদসদ্বিলক্ষণ' রূপ সাধ্য অপ্রসিদ্ধ বলে পঞ্চপাদিকোক্ত মিথ্যাত্বলক্ষণে যে 'সাধ্যাপ্রসিদ্ধি'
দোষের উদ্ভাবন করেছেন, ঐ দোষও এখন অচল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পঞ্চপাদিকাবিবরণের রচয়িতা
আচার্য প্রকাশাত্মযতি বলেন—"যে বস্তুর যা আধার বলে প্রতিভাত হয়, সেই আধার বা
আশ্রয়েই যদি সেই বস্তুর অত্যন্তাভাব থাকে, তবে সেই বস্তু অবশ্যই মিথ্যাই হবে।"
এইরূপে
'সদসদ্বিলক্ষণত্ব'ই মিথ্যাত্ব, এই প্রকার পদ্মপাদাচার্যের লক্ষণ নির্দোষ বলে প্রতিভাত
হলেও, একটি কথা এ প্রসঙ্গে মনে রাখা আবশ্যক যে, শুক্তিরজতের রজতকে অদ্বৈতবাদী 'অসৎ'
বলেন না, প্রাতিভাসিকভাবে সৎ বলেন। ওটাকে অসৎ বলেন মাধ্ব। অসৎখ্যাতিবাদী মাধ্বের মতে
ভ্রমস্থলে অত্যন্ত অসৎ বস্তুরই খ্যাতি হয়ে থাকে। মাধ্বসম্প্রদায়ের মতে যা অবাধ্য,
তাই সৎ, যা বাধ্য তাই অসৎ। বিশ্বপ্রপঞ্চ এবং পরব্রহ্ম-পুরুষোত্তম, এই উভয়ই অবাধ্য,
উভয়ই সৎ। শুক্তিরজত এবং আকাশকুসুম এরা উভয়েই বাধ্য এবং উভয়েই অসৎ। আকাশকুসুম প্রভৃতি
যা সত্য বা মিথ্যা কোনরূপ প্রতীতিরই বিষয় হয় না, তাদেরকে ভ্রমের ক্ষেত্রে 'শুক্তিরজতং
সৎ' এই প্রকারে সত্যরূপে প্রতীয়মান রজতের সাথে এক জাতীয় বলে গ্রহণ করতে অদ্বৈতবাদী
কোনমতেই প্রস্তুত নয়। শুক্তিরজত ভ্রমপ্রতীতির বিষয় হয়, আকাশ কুসুম সত্য-মিথ্যা কোনরূপ
জ্ঞানেই ভাসেনা। এজন্য অত্যন্ত অসৎ অলীক আকাশকুসুম প্রভৃতিকে শুক্তিরজতের ন্যায় অসৎ
বলতে অসৎখ্যাতিবাদী মাধ্বের আগ্রহ থাকলেও, অদ্বৈতবাদীর কোন আগ্রহ নেই।.........
ঋণঃ—
১.
আচার্য অপ্পয় দীক্ষিত বিরচিত "সিদ্ধান্তলেশ সংগ্রহ"।
২.
ভগবান শঙ্করাচার্যের শারীরকমীমাংসা ভাষ্য।
৩.
প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার কাব্য ব্যাকরণ সাংখ্য বেদান্ততীর্থ ড. আশুতোষ শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতির
"বেদান্তদর্শন
ও অদ্বৈতবাদ"।