অদ্বৈতবেদান্তে সাধন বিষয়ক আলোচনায় আজকের আলোচ্য বিষয় "বিবিদিষা"। শমদমাদির অভ্যাস সহ নিষ্কামভাবে অনুষ্ঠিত নিত্যনৈমিত্তিক শুভকর্মানুষ্ঠানের ফলে অন্তঃকরণের পাপাদি মল বিনষ্ট হলে বিবিদিষার উৎপত্তি হয়। ভগবান শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের সর্বাপেক্ষা অধিকরণের ভাষ্যে বলছেন—
'তমেতং
বেদানুবচনেন ব্রাহ্মণা বিবিদিষন্তি যজ্ঞেন দানেন তপসানাশকেন '-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/২২)
অর্থাৎ
সেই উপনিষৎপ্রতিপাদ্য ব্রহ্মকে ব্রাহ্মণগণ বেদপাঠ, যজ্ঞ, দান ও যথেচ্ছ ভোজন না করারূপ
তপস্যার দ্বারা জানিতে ইচ্ছা করেন", ইত্যাদি শ্রুতি যজ্ঞ ও দান প্রভৃতির ব্রহ্মবিদ্যা
সাধনতা প্রদর্শন করছে। আর বিবিদিষার সহিত সম্বন্ধবশতঃ কাম্যবর্জিত নিত্যনৈমিত্তিক কর্মের,
ব্রহ্মজ্ঞানের উৎপত্তিতে সাধনভাব নিশ্চিত হচ্ছে।
'অথ
যদ্যজ্ঞ ইত্যাচক্ষতে ব্রহ্মচর্যমেব তৎ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮/৫/১) "আর লোকে যাহাকে
যজ্ঞ বলে, তাহা ব্রহ্মচর্যই", ইত্যাদি এই স্থলেও ব্রহ্মবিদ্যার সাধনভূত ব্রহ্মচর্যের
যজ্ঞাদিশব্দের দ্বারা স্তুতি হওয়ায় যজ্ঞাদিরও ব্রহ্মজ্ঞানের প্রতি সাধনভাব সূচিত
হচ্ছে। আর 'সর্বে বেদা যৎপদমামনন্তি তপাংসি সর্বাণি চ যদ্বদন্তি৷ যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং
চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রবীমি'—(কঠ উপনিষৎ-১/২/১৫) " সকল বেদ জ্ঞান সাধনভূত
কর্মদ্বারা যে পদকে প্রতিপাদন করেন, তপস্যা সকল যাঁহার কথা বলে, যাঁহাকে অভিলাষ করিয়া
ব্রহ্মচর্য পালন করে, সেই পদ তোমাকে সংক্ষেপে বলিতেছি", ইত্যাদি এই সকল শ্রুতি
আশ্রমবিহিত কর্মসকলের বিদ্যাসাধনতা সূচনা করছে। তাছাড়া 'কর্মসকল পাপকে নাশ করে, জ্ঞান
কিন্তু পরমা গতি, কর্মসকলের দ্বারা পাপ বিনষ্ট হলে তদনন্তর জ্ঞান প্রবৃত্ত হয়', ইত্যাদি
এই সকল স্মৃতিও আশ্রমকর্মসকল যে ব্রহ্মজ্ঞানের সাধন, ইহা সূচনা করছে।
কিন্তু
কতকাল কর্মানুষ্ঠান করতে হবে সেই বিষয়ে পূজ্যপাদ্ সুরেশ্বরাচার্য বলেছেন—"প্রত্যক্প্রবণতাং
বুদ্ধেঃ কর্মাণ্যুৎপাদ্য শুদ্ধিতঃ। কৃতার্থান্যস্তমায়ান্তি প্রাবৃডন্তে ঘনা ইব।"-(নৈষ্কর্মসিদ্ধি-১/৪৯)
"কর্মসকল
শুদ্ধতা সম্পাদন দ্বারা বুদ্ধির প্রত্যক্ প্রবণতাকে অর্থাৎ দেহান্দ্রিয়াদি হতে ভিন্ন
শুদ্ধচৈতন্যস্বরূপ আত্মাতে আত্মবুদ্ধিকে উৎপাদনকরতঃ কৃতার্থ হয়ে বর্ষান্তে মেঘরাজির
ন্যায় অস্তগমন করে।" বুদ্ধির এই যে প্রত্যক্ প্রবণতা যাহা চিত্তের শুদ্ধতাদ্বারা
নিষ্কামকর্মসাধ্য, ইহারই অপর নাম 'বিবিদিষা'; ব্রহ্মকে জানবার ইচ্ছামাত্রই বিবিদিষা
নহে। পূজ্যপাদ্ শ্রীধর স্বামীও তাই বলেছেন, যথা—"বিবিদিষা চ নিত্যানিত্যবস্তুবিবেকন
নিবৃত্তদেহাদ্য-ভিমানতয়া বুদ্ধেঃ প্রত্যক্প্রবণতা"-(গীতা ১৮/২, শ্রীধর স্বামী
টীকা)।
No comments:
Post a Comment