সাধনচতুষ্টয়সম্পন্ন উৎপন্ন বিবিদিষা, সুতরাং কথঞ্চিৎ দেহাত্মবুদ্ধিরহিত এবং উপাসনা-প্রভাবে বিক্ষেপরহিত চিত্তবিশিষ্ট ব্যক্তির হয় ব্রহ্মবিচারে প্রবৃত্তি। স্বীয় সংস্কার অনুসারে কারও হয় সদ্যোমুক্তির জন্য ১.জ্ঞানমার্গে নির্গুণব্রহ্মবিদ্যার অনুশীলনে প্রবৃত্তি, কারও বা হয় ক্রমমুক্তি লাভের জন্য ২.উপাসনামার্গে প্রবৃত্তি।
১.
প্রথমোক্তগণের, ইনি নিবৃত্তপ্রতিবন্ধক উত্তম অধিকারী হলে, "তত্ত্বমসি" মহাবাক্য
শ্রবণমাত্রেই "অহং ব্রহ্মাস্মি" ইত্যাকারা নির্বিশেষ ব্রহ্মবিদ্যার উদয়
হয়। এতাদৃশ অধিকারী না হলে তাঁদের হয় শ্রবণমননাদি সাধন অনুষ্ঠানে প্রবৃত্তি। ব্রহ্মবিষয়ক
শ্রবণ ও মননের দ্বারা অসম্ভাবনার এবং নিদিধ্যাসনের দ্বারা বিপরীত ভাবনার নিবৃত্তি হয়। নিদিধ্যাসনের
পরিপক্ক অবস্থাই সমাধি। ইহার সহকারিরূপে পাতঞ্জলোক্ত অষ্টাঙ্গযোগও পরিগৃহীত হয়। এই
অবস্থা চলবার সময় পঞ্চকোশবিবেক দ্বারা পরবৈরাগ্যযুক্ত অধিকারীর ত্বং পদার্থের শোধন
হয়, অর্থাৎ আমি শরীরচতুষ্টয় হতে ভিন্ন, তার অধিষ্ঠান শুদ্ধচৈতন্যমাত্রস্বরূপ, এইপ্রকার
অনুভূতি হয়। তৎ পদার্থের শোধনও এই সময় হতে থাকে, অর্থাৎ উপাধিবিরহিত ব্রহ্ম বস্তুতঃ
সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান নন, পরন্তু নির্বিশেষ শুদ্ধচৈতন্যমাত্রস্বরূপ, এইপ্রকার জ্ঞানোদয়
হয়। এতাদৃশ অধিকারী জগৎপ্রপঞ্চকে স্বপ্নের ন্যায় প্রাতিভাসিকরূপে দর্শন করতে অভ্যাস
করেন এবং ক্রমশঃ তাতে প্রতিষ্ঠিত হন। ইঁহার পক্ষে তখন আর নিত্যনৈমিত্তিক কর্মের অনুষ্ঠান
সম্ভব হয় না। এতাদৃশ চতুর্থাশ্রমী অধিকারীর জন্যই ভগবান শঙ্করাচার্য জ্ঞানকর্মের সমুচ্চয়
নিরাকরণ করেছেন স্বীয় শ্রীগীতাভাষ্যে। এতাদৃশ অধিকারীর "শুদ্ধচৈতন্যমাত্রস্বরূপ
আমি" "শুদ্ধনির্গুনব্রহ্মচৈতন্যের" সহিত অভিন্ন এইপ্রকার নিদিধ্যাসনের
দ্বারা বিপরীতভাবনার নিবৃত্তি হলে "তত্ত্বমসি" এই মহাবাক্যোত্থ "অহং
ব্রহ্মাস্মি", এইপ্রকার নির্গুণব্রহ্মাত্মজ্ঞানের উদয় হয়।
২.
ব্রহ্মলোকে ঈশ্বরীয় ঐশ্বর্যভোগ এবং মুক্তি, এই উভয়প্রকার আকাঙ্ক্ষাযুক্ত ব্যক্তির
হয় উপাসনাতে প্রবৃত্তি। উপাসনা (উপ+আস্+অনট্+আপ্) শব্দের অর্থ—'নিকটে
অবস্থিতি'; অর্থাৎ তৈলধারাবৎ উপাস্যাকারা চিত্তবৃত্তি দ্বারা উপাস্য চিন্তন। ওঙ্কার
উপাসনা ব্যতিরিক্ত উপাসনাসকল সগুণব্রহ্মেরই হয়ে থাকে। মায়াশক্তিযোগে নির্গুণপরব্রহ্মই
সগুণপরব্রহ্মরূপে অঙ্গীকৃত হন। সগুণব্রহ্মের উপাসনা দ্বিবিধ—প্রতীকাবলম্বনা
ও অপ্রতীকাবলম্বনা। অপ্রতীকাবলম্বনা উপাসনাকে 'অহংগ্রহোপাসনা' বলে। ইহাতে নিজেকে শুদ্ধচৈতন্যমাত্রস্বরূপে
চিন্তনকরতঃ সগুণপরব্রহ্মের সহিত নিজের অভিন্নতা চিন্তন করতে হয়। শ্রুত্যুক্ত দহরবিদ্যা
(ছান্দোগ্য উপনিষদ- ৮।১), শাণ্ডিল্য বিদ্যা (ছান্দোগ্য উপনিষদ-৩।১৪) প্রভৃতি এই উপাসনার
অন্তর্গত। ইহার ফলে ক্রমমুক্তি লব্ধ হয়। আবার নানাপ্রকার ফলপ্রদ বিদ্যুল্লোক পর্যন্ত
গতিপ্রদ নানাপ্রকার প্রতীকোপাসনাও আছে। প্রতীকাবলম্বনা সাকার ব্রহ্মের উপাসনাও অদ্বৈতবেদান্তে
অঙ্গীকৃত হয়। ব্রহ্মসূত্রের (৩/২/১৫) ভাষ্যে শঙ্করাচার্য বলেছেন—
"ব্রহ্মাপি পৃথিব্যাদ্যুপাধিসংবন্ধাত্ তদাকারতামিব প্রতিপদ্যতে; তদালম্বনো ব্রহ্মণ
আকারবিশেষোপদেশ উপাসনার্থো ন বিরুধ্যতে" অর্থাৎ 'ব্রহ্মও পৃথিবী প্রভৃতি উপাধির
সহিত সম্বন্ধবশতঃ যেন সেই আকারকেই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। উপাধি যাহার অবলম্বন, এতাদৃশ
যে ব্রহ্মের আকারবিশেষের উপদেশ, তাহা উপাসনার জন্য এইজন্য সবিশেষতা ও নির্বিশেষতা জ্ঞাপিকা
শ্রুতি বিরোধগ্রস্ত হয় না।'
শ্রুতিতেও
উপাসনার জন্য সাকার ব্রহ্মের বর্ণনা আছে, যথা— "হিরণ্ময়ঃ পুরুষঃ হিরণ্যশ্মশ্রুঃ হিরণ্যকেশঃ"
(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-১/৬/৬), "বহুশোভমানাম্ উমাং হৈমবতীম্" (কেন উপনিষৎ ৩/১২)
ইত্যাদি। লক্ষ্য করতে হইবে— 'সাকার উপাসনা' শব্দে শঙ্করাচার্য বিভিন্ন শাস্ত্রে
প্রতিপাদিত শিব, বিষ্ণু, শক্তি প্রভৃতি যাবতীয় সাকার বিগ্রহই গ্রহণ করলেন; সুতরাং
আচার্য শঙ্করের অদ্বৈত মতবাদকে অসাম্প্রদায়িক বলতে হবে। প্রতিমাদি প্রতীকাবলম্বনা
সাকার ব্রহ্মোপাসনাও ক্রমশঃ অপ্রতীকাবলম্বনা উপাসনাতে পরিণত হয়ে সিদ্ধ সাধককে ক্রমমুক্তি
প্রদান করে। "সর্ব্বকালে সর্ব্বাবস্থাতে শ্রীভগবানের শ্রীমূর্ত্তি যাঁর হৃদয়ে
প্রতিভাত হতে থাকেন, তিনিই সিদ্ধপুরুষ"। শমদমাদি সহকৃত শুভকর্মানুষ্ঠান, স্বাধ্যায়,
বিষয়বৈরাগ্য, ভগবান্ নামগুণকীর্তন, তন্নামজপ, তন্মূর্তিধ্যান ইত্যাদি, প্রসিদ্ধ সাধনসকলই
এই মতে সাধনরূপে অঙ্গীকৃত হয়। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের (২/২/৪২) ভাষ্যে
বলছেন—
"পরমেশ্বরংভগবন্তমভিগমনোপাদানেজ্যাস্বাধ্যায়যোগৈর্বর্ষশতমিষ্ট্বা ক্ষীণক্লেশো ভগবন্তমেব প্রতিপদ্যত ইতি৷" অর্থাৎ পরমেশ্বরকে অভিগমন, উপাদান, ইজ্যা, স্বাধ্যায় এবং যোগের দ্বারা শতবর্ষ অর্থাৎ যাবজ্জীবন উপাসনাকরতঃ ক্ষীণক্লেশ হয়ে জীব ভগবানকেই প্রাপ্ত হয়। এই সূত্রের ভাষ্যে ভাষ্যকার আর বলছেন—
"ভগবতোভিগমনাদিলক্ষণমারাধনমজস্রমনন্যচিত্ততযাভিপ্রেয়তে"
অর্থাৎ 'সেই ভগবানের অভিগমনাদিরূপ আরাধনা অনন্যচিত্ত হয়ে অজস্রভাবে অভিপ্রায় করা
হয়।' সর্বোপরি পরমেশ্বরের অনুগ্রহই ব্রহ্মবিদ্যালাভ ও মোক্ষের হেতুরূপে এই মতে অঙ্গীকৃত
হয়, ব্রহ্মসূত্রের (২/৩/৪২) সূত্রের ভাষ্যে "তদনুগ্রহহেতুকেনৈব চ বিজ্ঞানেন মোক্ষসিদ্ধিঃ"
অর্থাৎ 'তাঁহার অনুগ্রহই যাহার হেতু, সেই বিজ্ঞান দ্বারা জীবের মোক্ষ সিদ্ধ হয়' ইত্যাদি
ভাষ্যকারের বচন দ্রষ্টব্য।
তথ্যসূত্রঃ- বেদান্তদর্শন, প্রথম খণ্ড (শাঙ্করভাষ্য, বৈয়াসিক ন্যায়মালা ও ভাষ্যরত্নপ্রভা টীকা সমন্বিত)
No comments:
Post a Comment